রাশিদনামা- এক দীক্ষিত রাজপুত্রের কথা

রাশিদনামা- এক দীক্ষিত রাজপুত্রের কথা

শব্দটির উৎস আরবি ভাষায়। অর্থ, যিনি গুরু বা মুর্শিদের থেকে দীক্ষা বা হিদায়ত প্রাপ্ত হয়েছেন। উচ্চারণটি, বাংলা অক্ষরে হবে ‘রাশিদ’। গত পঁয়তাল্লিশ বছর বাংলায় কাটাবার পরেও বাঙালির মুখে তাঁর নাম ইংরেজি প্রাপ্তিস্বীকার-পত্রের অপভ্রংশ হয়ে থেকে গেলো। আক্ষেপ শুধু এটুকুই।

হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে ‘ঘরানাদার’ বলে একটি পরিভাষা আছে। কণ্ঠ বা বাদ্যসঙ্গীতে শিল্পীর কৌলীন্যের সূচক হিসেবে শব্দটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বর্তমান শৈলীগুলি, বিশেষত যদি খেয়ালের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি, তবে তার পরম্পরা শুরু হয়েছে মুঘল বাদশা মহম্মদ শাহ রঙ্গিলে’র (১৭০২-৪৮) সময় থেকে। পূর্বতন যে সঙ্গীত ধারা আমির খুসরো থেকে তানসেন বা তার পরের দেড়শো বছর উত্তর ভারতীয় সাধনার মূল স্রোত ছিল, আঠেরো শতকে এসে তার বস্তুস্থিতি পালটে যায়। এই সময় থেকে বিভিন্ন রাজা-বাদশা, নবাব-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক অন্য ধরনের সঙ্গীত সংস্কৃতির জন্ম হয়। বিভিন্ন সামন্ত রাজত্বের ছত্রছায়ায় আলাদা আলাদা শৈলীর সঙ্গীত চর্চা বিকশিত হতে থাকে। স্থাননাম ভিত্তিক সেই সব সঙ্গীত শৈলীকে চলতি কথায় ‘ঘর’ বা ‘ঘরানা’ বলা হয়।
উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁর কাছে এরকমই একটি দেশীয় রাজ্য ছিল, নাম রামপুর। সেখানকার জমিদার য়ুসুফ আলি খান ছিলেন ‘বুদ্ধিমান’ লোক। সিপাহি বিদ্রোহের সময় তিনি ইংরেজের পক্ষ নিয়েছিলেন। ইংরেজও তাঁকে দাক্ষিণ্য জানাতে কসুর করেনি। ঝামেলা মিটে গেলে য়ুসুফ আলি ‘নবাব’ হয়ে যান। তাঁর পুত্র কলবে আলি খানও ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী। ভাই হায়দার আলি খানের পরামর্শে রামপুর নবাবি দরবারে তিনি সঙ্গীত গুণীদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিয়াঁ তানসেনের বংশধর বহাদুরসেন বা বহাদুর হুসেন খান। কলবে আলি থেকে তাঁর নাতি হামিদ আলি খানের আমলে রামপুর হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিরাট মাপের শিল্পীদের জমায়ৎ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যেমন, ওয়জির খান, আলাউদ্দিন খান, হাফীজ আলি খান, হায়দার খান, ফিদা হুসেন খান, মহম্মদ আলি খান, বুন্দু খান, আহমদজান থিরাকুয়া, ভাইসাহেব গনপত রাও, মহবুব বখ্স খান প্রমুখ। সেকালের মস্ত ওস্তাদ মহবুব বখ্স খান ছিলেন গোয়ালিয়রের লোক।

সহসওয়ন, রামপুরের উত্তর পশ্চিমে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। নবাব কলবে আলি খানের আমলে বহু সঙ্গীত গুণীকে ওই গ্রামে বসতি করে দেওয়া হয়েছিলো। তাঁরা ছিলেন রামপুর দরবারের সভাগায়ক। পরবর্তীকালের রামপুর-সহসওয়ান ঘরানা সেই ধারারই ফসল। মহবুব বখ্স এবং আলি বখ্স ছিলেন করিম বখস খানের পুত্র। ওঁরা গোয়ালিয়রের লোক। আলি বখস ছিলেন সুবিখ্যাত নত্থন খান এবং রহমত খানের সমকালীন। তাঁরা চার ভাই। সবাই সেকালের জনপ্রিয় শিল্পী। বড়ো বড়ো সঙ্গীত গুণীদের মধ্যে গায়ন, পাণ্ডিত্য, পরিবেশনা অনেক সময়ই উনিশ-বিশ হয়ে থাকে। তবে তাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ‘স্টার’ হয়ে ওঠেন। আলি বখসের মেজো ভাই মহবুব বখ্স ছিলেন রামপুর দরবারের প্রথম ‘স্টার’। তাঁর বিবাহ হয়েছিলো লখনউ-এর সঙ্গীতজ্ঞানী উজির কুতবুদ্দৌলাহের কন্যার সঙ্গে। তাঁদের প্রথম কন্যা আলিমুন্নিসার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিলো আলি বখসের পুত্র হায়দার খানের। হায়দার খানের পুত্র ছিলেন বিখ্যাত ফিদা হুসেন খান এবং তাঁর পৌত্র নিসার হুসেন খান। নিসার হুসেনের কোনও পরিচয় নিষ্প্রয়োজন।
মহবুব বখ্স-এর মেজো ছেলের নাম ইনায়ত হুসেন খান (১৮৪৯-১৯১৯)। এঁর বিবাহ হয়েছিলো গোয়ালিয়র ঘরের ‘রাজা’ হদ্দু খানের কন্যার সঙ্গে। পণ্ডিতরা বলেন ইনায়ত হুসেন খানই রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার জনক। তাঁর তিন কন্যা ছিলেন এই ঘরানার প্রধান শিল্পীদের জননী ও ধাত্রী। বড়ো মেয়ে জাকরি বেগমের বিবাহ হয়েছিলো রামপুর সহসওয়ান ঘরানার প্রথম সুপার স্টার মুস্তাক হুসেন খানের সঙ্গে। মুস্তাক হুসেন অন্যদিকে ছিলেন ইনায়ত হুসেনের ভাইপো। হায়দার খানের ছেলে। মেজ মেয়ে কাদরি বেগমের বিবাহ হয়েছিলো সেই হায়দার খানেরই পৌত্র নিসার হুসেন খানের সঙ্গে। ইনায়ত হুসেন খানের সেজো মেয়ে সাবরি বেগম নিকাহ করেছিলেন ওয়ারিশ হুসেন খানকে।তাঁদের তিন পুত্র-কন্যা। বড়ো ছেলে গুলাম মুস্তাফা খান, মেজো মেয়ের নাম কল্লো বেগম। কল্লো বেগমের অকাল মৃত্যু হয়েছিলো। কিন্তু তিনি ছিলেন রত্নগর্ভা। তাঁর সুপুত্রের নাম রাশিদ খান। সমঝদার রসিকদের মনে রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার চার নক্ষত্র সতত উজ্জ্বল। ইনায়ত হুসেন খান, মুস্তাক হুসেন খান, নিসার হুসেন খান এবং ‘শেষ’ প্রদীপ রাশিদ খান।

ইনায়ত হুসেন খান
মুস্তাক হুসেন খান
নিসার হুসেন খান

প্রশ্ন উঠতে পারে, সংক্ষিপ্ত হলেও এই লেখায় রামপুর ঘরানা বিষয়ে এই পর্যায়ের সাত কাহন বর্ণনার প্রয়োজনটা কী? বলবো, উদ্দেশ্য একটাই। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অগণন পরিপ্রেক্ষিত ও বহুমুখী ব্যঞ্জনা বিষয়ে কাজ চালানো ধারণা করতে গেলেও ইতিহাসটি সামান্য জানা দরকার। তা শুধু কানে শোনার বস্তু নয়। তাকে বুঝতে কিছু শ্রম লাগে। কিছুটা হলেও শ্রোতার মননকে প্রস্তুত হতে হয়। ‘কানসেন’ হবার পথে যে যে পর্বগুলি আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘ঘরানাদারি’ বিষয়ে সামান্য ধারণা। একজন ভীমসেন জোশি, আমীর খান, রাজন মিশ্র বা রাশিদ খান হঠাৎ জন্ম নেন না। গন্ধর্বদের ‘হয়ে ওঠা’র পিছনে কী কী ‘সূত্র’ কাজ করে, পরিপূর্ণ শ্রোতা হতে চাইলে সে বিষয়ে কিছু আগ্রহ থাকাটা জরুরি। আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, অসংখ্য নক্ষত্রের মধ্যে মাত্র এই চারজনের নামই নেওয়া হচ্ছে কেন?
পূর্বজন্মের পুণ্য বা ‘কর্মফল’ তত্ত্ব বিষয়ে আস্থা রাখেন না বহু মানুষ। সঙ্গত কারণেই রাখেন না। তবে ডারউইন বা মেন্ডেল সাহেবের তত্ত্বকে সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষ অস্বীকার করতে পারেন না। সঙ্গীত মস্তিষ্কের জন্য একটি জটিল খেলা। কর্টেক্সের নানা অংশ জুড়ে সঙ্গীতের ক্রিয়াশীলতা গড়ে ওঠে। শিল্পীদের জন্য অক্সিপেটাল কর্টেক্স। আবার সাধারণ শ্রোতাদের জন্য টেম্পোরল লোব। মোদ্দা কথা সঙ্গীত নামক কলাটির উপর দখল, শিল্পী বা শ্রোতা উভয় ক্ষেত্রেই, মস্তিষ্কের এলেমের উপর নির্ভরশীল। মস্তিষ্কের কোষ বিকাশের পিছনে জিন প্রোটিনের চাবি। যার কিছুটা বংশগত উত্তরাধিকার, কিছুটা নিজস্ব অর্জন। ঘরানাদারদের মধ্যে বংশগত উত্তরাধিকারের আশীর্বাদ প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা যায়।
এই আশীর্বাদ পেয়েছিলেন রাশিদ খান। পেয়েছিলেন রাজন মিশ্র। বংশগত ভাবে এই পুণ্য ছিল না ভীমসেন জোশি বা আমীর খানের। অন্যদিকে এঁদের সবার সাধনার পথ ছিল অত্যন্ত শ্রম সংকুল। কোষগত পুণ্য, বা তার ‘নিরাপত্তা’র স্বাচ্ছন্দ্য এঁদের অন্বিষ্ট ছিল না। শিল্পী হিসেবে যে এঁরা সিদ্ধির স্বাদ পেয়েছিলেন, সেটা স্বতঃসিদ্ধ। এই গরিমা, স্বল্প হলেও, অন্য নিয়মিত শিল্পীরাও কখনও কখনও অর্জন করেন। কিন্তু উদাহরণ হিসেবে যে চার জন গন্ধর্বের নাম নিচ্ছি, তাঁরা আরও কিছু কীর্তি স্তম্ভ স্পর্শ করেছিলেন। রসিক শ্রোতার ধেয়ানে তাঁরা শুধু শিল্পী ছিলেন না। ‘দেবতা’ হয়ে উঠেছিলেন।

তথ্য অনুযায়ী রাশিদ প্রস্তুতিপর্বে তালিম নিয়েছেন মামা গুলাম মুস্তাফা খানের কাছে। কিন্তু একেবারে বাল্যকালেই তিনি সম্পর্কিত মাতামহ নিসার হুসেন খানের ছত্রছায়ায় আশ্রয় পেয়েছিলেন। চোদ্দো বছর বয়সেই তিনি কলকাতায় সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে পুরো দস্তুর সঙ্গীতের পাঠ নিতে শুরু করেছিলেন, তাঁর গুরু নিসার হুসেনের কাছে। শোনা যায় মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি গুরুর থেকে জন সমক্ষে অনুষ্ঠান করার অনুমতি ও সুযোগ পেয়েছিলেন।

কৈশোরে প্রস্তুতি পর্বে
আসরে পরিবেশনকালীন

রামপুর ঘরানা, গোয়ালিয়র ঘরানার শাখা নদী। গোয়ালিয়র ঘরের কাছেই রামপুরের উস্তাদদের নাড়া বাঁধা। রামপুর সহসওয়ানের জনক বলে খ্যাত ইনায়ত হুসেন খান-এর প্রধান শিষ্য ছিলেন মুস্তাক হুসেন খান। ইনায়ৎ হুসেনের পর মুস্তাক হুসেন রামপুর সহসওয়ান ঘরের শীর্ষস্থানীয় খলিফা ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে একজন পণ্ডিত পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে বলেছিলেন ‘He is easily the best exponent of Gwalior gayaki today.’ সামান্য অতিশয়োক্তি থাকলেও এই উক্তি বহুলাংশে সত্য। রাশিদের প্রধান গুরু নিসার হুসেন খান তালিম নিয়েছিলেন তাঁর পিতামহ এবং ইনায়ত হুসেন খানের বড়ো ভাই হায়দর খানের কাছে। পরবর্তী কালে তাঁর উপর প্রভাব পড়ে আগ্রা ঘরানার অফতাব-এ-মওসিকি উস্তাদ ফ্যয়েজ খানের শিষ্য ও শ্যালক আতা হুসেন খান-এর।
কুমারপ্রসাদ লিখেছেন যদি মুস্তাক হুসেন আর নিসার হুসেন’কে রামপুর-সহসওয়ানের ‘বড়ো ওস্তাদ’ বলা হয়, তবে এও সত্য দুজনের গায়কির মধ্যে মিলের থেকে গরমিল অনেক বেশি। মুস্তাক হুসেন নব্বই ভাগ গোয়ালিয়র ঘরানা অনুসরণ করেছেন। নিসার হুসেনের গায়কিতে গোয়ালিয়রের মাত্রা সে তুলনায় অনেক কম। কুমারপ্রসাদ নিসার হুসেন’কে ‘সেলফ-মেড মিউজিসিয়ন’ বলেছিলেন। রামপুর-সহসওয়ান থেকে শুরু করলেও তাঁর গানে আগ্রা-আতরৌলির প্রভাব বেশি। তাছাড়া আরও অন্যান্য ঘরের যা কিছু তিনি অনুসরণযোগ্য মনে করেছিলেন, নির্দ্বিধায় আত্তীকরণ করেছিলেন। অস্যার্থ, কোনও ঘরানার বিশেষের মোহে বদ্ধ থাকেননি।

গত শতকের নব্বই-য়ের দশকে কুমারপ্রসাদ রাশিদ সম্বন্ধে একটি উক্তি করেছিলেন। সেখান থেকেই, বলতে গেলে, রাশিদের ‘আত্মপরিচয়’টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাশিদের বয়স তখন বছর চব্বিশ।
‘… রাশিদ খাঁর কাছে (নিসার হুসেনের) অনেক আশা ছিল, কিন্তু আধা-খ্যাঁচড়া তালিমের মাঝখানে সে খাঁ সাহেবের নাতনীর পরিবর্তে একটি টুকটুকে বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে গুরুকুল থেকে বিতাড়িত হয়েছে। খাঁ সাহেব একে ক্ষমা করলে ভাল করতেন, কারণ এঁর গলা ও প্রতিভা অসাধারণ। এবং বয়সও বেশি নয়। এ সহসওয়ানের নাম রাখত ভবিষ্যতের প্রজন্মের সামনে।’
রাশিদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে তিনি ‘মামাদাদু’র (Maternal Grand uncle) থেকে বিলম্বিত খেয়ালের তালিম নিয়েছিলেন। কুমারপ্রসাদের মতে তা হয়তো ‘আধাখ্যাঁচড়া’ ছিল। প্রত্যাশা মতো সম্পূর্ণ হয়নি। এছাড়া ওই ওয়েবসাইটে লেখা আছে ‘He is influenced with the style of Amir Khan and Bhimsen Joshi.’ প্রসঙ্গত, আমীর খান এবং ভীমসেন জোশি দুই গন্ধর্বই এক কথায় ‘সৃষ্টিছাড়া’। তাঁরা দুজনেই কখনও কোনও বিশেষ গুরু বা বিশেষ ঘরানায় বাঁধা থাকেননি। সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব মেধা ও ধীশক্তির জোরে দেশবন্দিত হয়ে উঠেছিলেন। আমীর খানের ওয়ালিদ ছিলেন সারঙ্গিবাদক শাহমীর খান। তিনি কোনও ঘরানাদার বড়ো ওস্তাদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি তিনি যখন কলকাতায় গান শোনাতে এসেছিলেন তখন তাঁর গায়নের মধ্যে সবাই কিরানা ঘরানার খলিফা আব্দুল ওয়হিদ খানের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু আমীর তাঁর গায়নে ওয়হিদ খানকে পুরোপুরি অনুসরণ করতেন না। তাঁর কণ্ঠও গুরুর থেকে উত্তম ছিল। বিস্তার, বিলম্বিতের খেলায় তিনি অন্তরা পরিহার করতেন। খ্যয়াল গাইতে গিয়ে মুড়কির ব্যবহার করতেন। এসব ওয়হিদ খানের ধরন ছিল না। পরবর্তীকালে আবার তিনি বলতেন তাঁর তালিম পিতা শাহমীর খান এবং পিতৃবন্ধু ওস্তাদ রজব আলি খানের কাছে। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ভিন্ডিবাজার-ওয়ালা আমান আলি খান। কিছু ব্যক্তিগত কারণে আমীর খান আবদুল ওয়হিদ খানকে গুরু বলে স্বীকার করতে চাইতেন না। কিন্তু ঘটনা হলো তাঁর শিক্ষার ভিত্তি ছিল কিরানা ঘরানার প্রশিক্ষণ। যদিও তিনি এ সব বন্ধন তুচ্ছ করে অনেক উচ্চমার্গের পথিক হয়ে উঠেছিলেন। কিরানা বা ইন্দোর নয়, তিনি নিজেই ছিলেন এক পরিপূর্ণ ‘ঘরানা’।
অন্য যে গন্ধর্বের প্রতি রাশিদ আনুগত্য জানিয়েছিলেন তিনি পণ্ডিত ভীমসেন জোশি।
যাঁর পারিবারিক সঙ্গীত ঐতিহ্য বলতে শৈশবে মায়ের মুখে শোনা ভজন। শৈশবেই বারবার শিক্ষকের খোঁজে গৃহত্যাগ। ষোলোটি ভাইবোনের জ্যেষ্ঠ সন্তানের গানের ‘নেশা’ নিয়ে বিপত্নীক শিক্ষক পিতা ‘উত্যক্ত’ হয়ে থাকতেন। এগারো বছর বয়সে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ গুরুর সন্ধানে পুনে, গোয়ালিয়র, দিল্লি, কলকাতা, লখনউ, রামপুর। রামপুরে উস্তাদ মুস্তাক হুসেন খান-এর আশ্রয়ে এক বছর থেকে তাঁদের ঘরানার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হাসিল করাও তার মধ্যে একটি। তার পর জলন্ধর থেকে তাঁর পিতৃদেব ভীমসেনকে ‘গ্রেফতার’ করে গদগ, কর্ণাটকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ধারওয়াড়ে পণ্ডিত সওয়াই গন্ধর্বের গান্ডাবন্দ শাগির্দ হয়ে তালিম নেওয়া। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ঘরের গুরুদের থেকে শিক্ষা নিলেও তাঁর ‘ঘরানা’ হিসেবে কিরানা’ই রসিক শ্রোতাদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।
ঘরানাদার ছিলেন না তিনি। এই জন্য নানান গুরুর থেকে অসলি চিজ হাসিল করতে পারেননি বহুকাল। তাঁর গন্ধর্ব হয়ে ওঠার পিছনে ছিল দুর্দম মনোবল আর পরিশ্রম। আমাদের কালে ‘মন্ত্রের সাধন বা শরীর পাতন’-এর এমন উদাহরণ বোধ হয় আর পাওয়া যায় না। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, ফিদা হুসেন, ঘগ্গে খুদাবখ্স প্রমুখ সরস্বতীর বরপুত্রদের সম্বন্ধে এ ধরনের গল্প শোনা যায় বটে, কিন্তু ভীমসেনজি আমাদের জীবৎকালের মানুষ। দিনে আট ঘন্টা রেয়াজ করতেন। সকালে একটি রাগ চার ঘন্টা খরজে গাইতেন। বিকেলে আবার সেই রাগটিই মধ্য ও তার সপ্তকে তানকারি করতেন। নিরন্তর যোগাভ্যাসের মধ্যে থাকতেন। গুরু সওয়াই গন্ধর্বের থেকে শুধু নয়, কিরানা ঘরানার প্রথাগত গায়কি থেকেও আলাদা ছিল তাঁর লয় ও ছন্দের প্রতি অভিনিবেশ। মধ্য বিলম্বিতে আলাপ শুরু করতেন। যেটা রাশিদেরও ধরন ছিল। বোলতান ও তানকারি ছিল জয়পুর ঘরের। বড়া খ্যয়াল গাইতে গিয়ে বলিষ্ঠ, উদাত্ত কণ্ঠে দ্রুত ও ভারি তান আদায় করতেন আগ্রার ধরনে। কুমারপ্রসাদ বলেছিলেন ,
‘….যেদিন উনি ভাল গান, ওঁর সঙ্গীতে একপ্রকারের atmosphere বা বাতাবরণের সৃষ্টি হয়, যা থেকে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকে না যে, ওঁর প্রভাব গুণের পেছনে ঈশ্বরের কৃপা আছে।’
‘ঘরানাহীন’ ভীমসেন জোশি বা ‘ঘরানা-প্রত্যাখ্যাত’ আমীর খান, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনন্ত আকাশে দুটি ধ্রুবতারা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কোনও গণিতে তাঁদের এই সিদ্ধির রহস্য মেলানো যাবে না। নিজের ঘরানা, গুরু বা স্থানিক উত্তরাধিকার, সবাইকে পিছনে রেখে রাশিদ যখন বলেন তিনি অনুসরণ করেন এই দুজন গন্ধর্বকে, তখন তাঁর মেধা, সাফল্য, সিদ্ধির প্রাণভোমরাটি মানুষের মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভীমসেন বা আমীর ছিলেন ‘মানুষে’র শিল্পী। দীক্ষিত, ‘অশিক্ষিত’, মেধাবী, অপ্রতিভ, কানসুন্নি বা ঘরানাদার, সব ধরনের ‘মানুষ’ই এঁদের দুজনের সঙ্গীত সভায় নতজানু হয়ে কৃপা ভিক্ষা করেন। রাশিদ এই রহস্যটি বুঝতে পেরেছিলেন খুব অল্প বয়সেই। মানুষের কাছে গান নিয়ে পৌঁছোতে চাইলে তাঁকে ঠিক কোন পথে চলতে হবে, সেটা স্পষ্ট ছিল তাঁর চেতনায়। পণ্ডিতরা যদি তাঁর শিক্ষাকে ‘আধাখ্যাঁচড়া’ বলে অভিযুক্তও করেন, তিনি জানতেন তাঁর সাধনার রূপরেখা ঠিক কেমন হওয়া উচিত।

'ঘরানাহীন' ভীমসেন জোশি
'ঘরানা-প্রত্যাখ্যাত' আমীর খান

নব্বই শতকের গোড়ায় সঙ্গীত ইতিহাসকার শ্রী অমল দাশশর্মা রাশিদ সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘a promising vocalist, began his career as an ‘A’ class radio artiste at the age of 17. He studied under his family elders mainly under Nisar Husain Khan. He is a scholar of Sangeet Research Academy (ITC) and a popular vocalist of Calcutta.’ এই পরিচিতির পরে কেটে যাওয়া তিন দশকে রাশিদ খান নিজেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে রাজপুত্রের মতো প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন। নিজের ঘরানা থেকে উত্তরাধিকারে পাওয়া কী কী সম্পদ তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন? বোলতান, সার্গম, পাল্টা, তরানা। তিন সপ্তকের ফিরৎ, সপাট তান, রাগরূপের প্রতি অপার ভালোবাসা। তাঁর দুই স্বপ্নের গুরুর মধ্যে ভীমসেনের থেকে তিনি নিয়েছিলেন মধ্য দ্রুত তিনতালে বড়হত, দুনি-চৌদুনিতে বহলাওয়া, ওজনদার সুরেলা স্বরক্ষেপে সপাট-হলক তান। দ্রুত ও অতিদ্রুত, অথচ সুরেলা, ছন্দ ও লয়ের ঝাপটায় রাগবিস্তারের শেষ পর্যায়টিকে ঈপ্সিত মুকামে পৌঁছে দেওয়া। আমীর খানের থেকে রাশিদ শিখতে চেয়েছিলেন মন্দ্র ও মধ্য সপ্তকে বুক বা নাভি থেকে স্বর তুলে আনার রহস্য। রাগালাপের ঠহরাও। এমন নয় যে রাশিদের আপন ঘরানায় এসব ছিল না। কিন্তু অন্য ঘরের সেরাটা নিজের ঘরে নিরন্তর নিয়ে আসার স্বতঃস্ফূর্ত মেধা বা শ্রম ছিল তাঁর ইউএসপি।

সুরেলা, ছন্দ ও লয়ের ঝাপটায় রাগবিস্তার
পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে রাজপুত্র

আলাদা ভাবে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন, এই অতি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটি রাশিদ খানের কলাকৃতির সামগ্রিক মূল্যায়ন নয়। এই রচনায় আমি রাশিদের গঙ্গোত্রী সন্ধান করতে চেয়েছি মাত্র। শুধু রামপুর-সহসওয়ান বা ওস্তাদ নিসার হুসেন খান নয়। রাশিদের দাঁড়াবার জায়গা সঙ্গীতের দিকচক্রকে স্পর্শ করে ফেলেছিলো এই অল্প বয়সেই। প্রত্যাশিত ছিল আরও অন্তত দুই দশক তিনি আমাদের গান শুনিয়ে যাবেন। তাঁকে নিয়ে নিয়তির কাছে আমাদের অনুযোগ থেকেই যাবে।

শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *