মেঘনাদবধ কাব্য ও শ্রেণিকক্ষে মধুসূদনের মেঘমুক্তি

মেঘনাদবধ কাব্য ও শ্রেণিকক্ষে মধুসূদনের মেঘমুক্তি

যেকোনও সৃজনশীল কর্মের সার্থকতা কোথায় নিহিত? সাহিত্য-সঙ্গীত-অঙ্কন কিংবা চলচ্চিত্র—সৃষ্টিপ্রবাহের বহুবিধ ধারা কোন খাতে বইলে তা অর্থপূর্ণ ও নান্দনিক হতে পারে? যা মানুষকে আন্দোলিত, রোমাঞ্চিত ও ভাবিত করে তোলে সেই সৃষ্টিই নান্দনিক, অর্থপূর্ণ ও সার্থক। কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পী তাদের সৃষ্টিকর্মকে একান্ত গোপনীয়তায় মুড়ে রাখেন না, বরং তাকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেন, মৃত্যুর পর প্রকাশিত হলেও সৃষ্টির নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন থাকেই মানুষের সানন্দ-সমাদর প্রত্যাশা! অতএব, যিনি তাঁর মেধা ও প্রতিভার আলোয় একান্ত আত্মগত অনুভূতি ও ভাবনা বিচ্ছুরিত করছেন, তা মানুষের মনে প্রভূত আনন্দ দেয় ও হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, যখন তার সাথে মানুষ নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। ”আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে”–ভারতচন্দ্র লিখিত অমর এই পংক্তিটি সারল্য বিবেচনায় গম্ভীর গবেষকের চিত্তকে হয়তো তৃপ্ত করবে না, কিন্তু আপামর মানুষের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে এর শাশ্বত মানবিক আবেদনে। এখানেই সার্থক স্রষ্টার সৃষ্টিসাধনা।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ( ১৮২৪–১৮৭৩ ) ‘রামায়ণ’ নামক প্রাচীন মহাকাব্যটির প্রতিষ্ঠিত পাঠগ্রাহ্যতার বিপরীতে পতিতপাবন রামচন্দ্র এবং রাবণ ও মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিত-কে চিত্রিত করলেন, যা ঐতিহ্যবাদী সমালোচকের চোখে ‘আপন মনের মাধুরী মেশানো’ হিসেবে হয়তো প্রতিভাত হতে পারে; তবুও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এত বিপুলভাবে সমাদৃত হ’ল কেন? তবে কি প্রতিষ্ঠিত সর্বজনগ্রাহ্যতাকে অতিক্রম করে মাটির পৃথিবী অন্য কিছুর প্রত্যাশায় আদতেই প্রতীক্ষিত ছিল, যা গভীর অন্তর্দৃষ্টির আলোয় একজন কবিই দেখতে পান?

নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম, তা সাহিত্য-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র যা-ই হোক, মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে না পারলে নিরর্থক তার সৃজন-প্রয়াস; তা হয়তো বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলের উচ্চমার্গে অবস্থিত মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কৃপাধন্য হতে পারে, কিন্তু জননন্দিত না-হওয়ায় সেইসব সৃষ্টিসম্ভার মহাকালের নির্মম হস্তে একদিন যে মহাশূন্যে বিলীন হতে বাধ্য একথার মধ্যে একবিন্দুও ভুল নেই!

নবজাগরণের অগ্রদূত বলা হয় ডিরোজিও-কে। তাঁর সম্পর্কে বিশ্লেষণ করার সময় দুটি বিষয় মনে রাখা উচিত। তিনি কোন সামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কি কি করেছিলেন এবং তাঁর ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের বয়স কেমন ছিল। যে তুমুল রক্ষণশীল পরিবেশে সমূহ কর্মকাণ্ড তিনি সম্পাদন করেছিলেন তা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভীষণ রকম বৈপ্লবিক ও আধুনিক। এবং, বয়সজনিত আবেগের আতিশয্যে যদি ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর কিছু কাজ ‘আপত্তিকর’ মনে হয়, তার আগে ভেবে দেখতে হবে, তাদের দিকে যে বিপুল, তীক্ষ্ণ বাণগুলি নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল, সেগুলি তারই ফলশ্রুতি কিনা।

নবজাগরণের অগ্রদূত ডিরোজিও
জলরঙে আঁকা কিশোর মধুসূদনের ছবি

 

মধুসূদন-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুরাসক্তি সত্ত্বেও তাঁকে কিন্তু ‘আধুনিক কবি’র আসন দিতে স্বভাবতই হৃদয়-কার্পণ্য করা যায়নি। অথচ, তিনিই আঙ্গিকের দিক থেকে পয়ারের কাব্যিক রক্ষণশীলতা ভেঙে যেমন হাজির করলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের আধুনিকতা, তেমনই ভাবের দিক থেকে মিথকে আশ্রয় করেই মিথ ভাঙার নতুন ঐতিহ্য; যা হয়তো রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত অনুপ্রাণিত করল ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’-এর মতো নবতর মহাভারতীয় কাব্যনাট্যরস সৃষ্টিতে!

প্রশংসনীয় হোক, অথবা নিন্দনীয়, সে প্রসঙ্গে না-গিয়ে, অন্তত এটা স্বীকার করতেই হয় যে, ‘খ্যাতি’ প্রাপ্তির বাসনা মানুষের সহজাত। মধুসূদন কোনও ‘অতিমানব’ ছিলেন না, অতএব সেই বাসনা, তীব্রভাবেই, তাঁর মধ্যেও ছিল, যা শেষপর্যন্ত তাঁকে নিয়ে গিয়ে ফেলে প্রবাসে। কিন্তু, তাঁর সংবেদনশীল মনটা হারিয়ে যায়নি। কিংবা, শিকড়ের প্রতি গভীর টান। ‘শিকড়’ বলতে তো শুধু জন্মভূমি নয়, অতি-অবশ্যই নিজের ‘মাতৃভাষা’-কেও বোঝায়। প্রবাসে এসব তাঁর সংবেদনশীল সত্তাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। ‘দূর’ থেকে তিনি যেন সত্যিকারের ‘নিকট’-কে অনুভব করতে পারলেন। তিনি ফিরে এলেন। তারপর যা হ’ল সেটা ‘ইতিহাস’। তাঁর প্রতিভার বিশালত্ব অথবা বিশেষত্ব নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, বলা হয়েছেও বিস্তর। সেসব কথা থাক। আজ এই ধ্বস্ত সময়ে শুধু এটুকুই বলার যে, বাঙালি কি তাঁর মাধ্যমে আজ আরেকবার ‘আত্ম-অন্বেষণ’-এ ব্রতী হবে? এই জরুরি কাজটির জন্য তিনি ছাড়া আদর্শ উদাহরণ কি বাঙালির কাছে আর আছে?

মধুসূদন ‘শিকড়ের কাছে’ ফিরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মনে রাখা ভাল যে, তিনি মাতৃভাষার প্রতি কখনও বিতৃষ্ণা বা বিরাগ পোষণ করেননি। তিনি শুধু চেয়েছিলেন, ইংরেজিতে কবিতা লিখে বিখ্যাত হতে। ফলে, বাঙালিকে শিকড়-সন্ধানী হতে বলে মধুসূদনের প্রসঙ্গ টানার সময় ওই সূক্ষ্ম প্রভেদটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। স্মরণীয় যে, শিকড়ের কাছে তাঁর প্রত্যাবর্তন আরোপিত ছিল না, ছিল স্বেচ্ছাকৃত।
একটি কথা মনে রাখা উচিত। ব্যক্তিগত জীবনচর্যার সঙ্গে প্রতিভাকে মিলিয়ে দেখা অর্থহীন। মধুসূদন ‘তরলসুধা’ পান করতেন। সেজন্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ একটুও গরিমা হারায় না। যদি এমন গোঁড়ামি দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে গালিবকে এক লহমায় নস্যাৎ করে দিতে হয়, যা সম্ভব নয়!

মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছরের আয়ুষ্কালে মধুসূদন বাংলা কবিতায় ও নাট্য-সাহিত্যে বিষয় ও আঙ্গিক দুই থেকেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং বলতে গেলে ‘নব নব সমীরণ’ প্রবাহিত করেছেন! ব্রজাঙ্গনা থেকে বীরাঙ্গনা, শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী থেকে একেই কি বলে সভ্যতা কিংবা বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। কিন্তু, সব ছাপিয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান– মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১)। লক্ষণীয়, এই মহাকাব্যটি উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা কবিতার প্রথাগত ভাবাদর্শের বিরুদ্ধ স্রোত হিসেবে একটি অনুপম সৃষ্টি হলেও মধুসূদন কাব্য-অলঙ্কার প্রয়োগের চেনা ছকটিকে কিন্তু অস্বীকার করেননি। বরং কথায় কথায় একেবারে অলঙ্কারের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর অসামান্য প্রয়োগ-নৈপুণ্যে সেটাই হয়েছে রসসৃষ্টির মুখ্য বাহন।

কিন্তু, মুশকিল হয় তখন, যখন ইস্কুল স্তরের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সামনে এই কাব্যের টুকরো টুকরো অংশ পড়াতে হয়। মূলত রাবণ ও ইন্দ্রজিত-এর কণ্ঠে রাম ও লক্ষণ সম্পর্কে যেসব কথা সালঙ্কারে উচ্চারিত হয়েছে তা তাদের কাছে বিস্ময়কর ঠেকে! রাম ও লক্ষণ পিতাপুত্রের মুখনিঃসৃত ধিক্কারে, নিন্দায়, তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায় যেভাবে চিত্রিত হয়েছেন তা এইরূপ: ভীরু, কাপুরুষ, পামর, তুচ্ছ নর, কপট, দেশ (স্বর্ণলঙ্কা) আক্রমণকারী ইত্যাদি। রাবণ ও ইন্দ্রজিতের মতো চিত্রাঙ্গদা ও ইন্দ্রজিৎ-পত্নী প্রমীলাও প্রখর বচনের শর-নিক্ষেপে অবলীলায় স্বামীদের অনুসরণ করেছেন। এমনকি রাবণসহ স্বীয় বংশকে পরিত্যাগকারী বিভীষণও ইন্দ্রজিতের চরম ধিক্কার থেকে মুক্ত হননি।

কিন্তু, ‘মেঘ’ কেটে যায় তখন, যখন তাদের বোঝানো হয় দুনিয়ার তাবৎ শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগুলির মূলস্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার সাহস দেখানোর সমান্তরালে মধুসূদনের কবি-প্রতিভার মৌলিকতা, এই মহাকাব্যের নেপথ্যে মূলত অনুরণিত গভীর স্বদেশপ্রেমের অন্ত:সলিলা সুর এবং আধুনিক কবিতার একটি অন্যতম চরিত্র-লক্ষণ হিসেবে দেবতার দৈব মহিমা নয় বরং ‘দেবতার মানবায়ন’ রচনার সৃজন-ঐতিহ্যটি!

লেখক মুর্শিদাবাদের একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Emelie Connelly , January 23, 2024 @ 6:20 pm

    helloI like your writing very so much proportion we keep up a correspondence extra approximately your post on AOL I need an expert in this space to unravel my problem May be that is you Taking a look forward to see you

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *