অস্তাচলে ভানু

অস্তাচলে ভানু

ভানু বলতে আমাদের মনে আসে দু’জনের কথা – ভানু সিংহ ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনেই পুরুষ। তবে আমাদের আজকের কাহিনি যে ভানুকে নিয়ে তিনি একজন নারী। তাঁর নাম ভানুমতী আন্না সাহেব রাজোপাধ্যায়।
১৯৮২ সালে একটি সিনেমা ভারতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সিনেমাটির নাম ‘গান্ধী।’ মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বেন কিংসলে। ‘গান্ধী’ ছবিটি ছিল রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘ড্রিম প্রজেক্ট।’ গান্ধীজির সঙ্গে সিনেমার চরিত্রের এতটুকুও ফারাক ধরা পড়েনি। পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবরোর সেই সিনেমা মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পরেও জীবন্ত করে তুলেছিল গান্ধীজিকে। তবে ভারতীয় পোশাক ডিজাইনার ভানু আথাইয়া না থাকলে হয়তো এটা সম্ভব হয়ে উঠত না। গান্ধীজির রূপদানের জন্য প্রথম ভারতীয় হিসাবে তিনিই বিশ্বের দরবারে সম্মানিত হয়েছেন অস্কার পুরস্কারে। ২০২০ সালের ১৫ই অক্টোবর জীবনাবসান হয়েছে ভারতের এই প্রথম অস্কার বিজয়ীর।
মুম্বাইয়ে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন ভানু আথাইয়া, জানলেন তাঁর মেয়ে রাধিকা গুপ্ত। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। ভানু আথাইয়া কিছুদিন ধরে হালকা জ্বর ও কাশিতে ভুগছিলেন – অনেকটা নিউমোনিয়ার মত। এজন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ২০১২ সালে ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে অপারেশন করা সম্ভব হয়নি। তার পরেই পক্ষাঘাতে একদিক অচল হয়ে গিয়েছিল তিন বছর আগে। সেই কারণে শেষের দিনগুলো শয্যাশায়ী হয়ে কাটিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই মুক্তি পেলেন ১৫ই অক্টোবর।

গোড়ার কথা
যৌবনে ভানু আথাইয়া

মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর শহরে ১৯২৯ সালে ২৮ শে এপ্রিল জন্ম হয় ভানুর। বাবার নাম ছিল আন্না সাহেব রাজোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন একজন চিত্রকর। মাত্র ন’বছর বয়সেই তাঁকে হারান ভানু। মা’র নাম শান্তা বাই। ভানু আথাইয়া ছিলেন তাঁর সাত ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। তাঁর স্বামীর নাম ছিল সত্যেন্দ্র আথাইয়া। তবে ওঁরা আলাদা হয়ে গেছিলেন। একজন ফ্রিল্যান্স ফ্যাশন চিত্রকর হিসাবে বোম্বেতে ‘ইভস উইকলি’ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ভানু। পরে এই ম্যাগাজিনের সম্পাদক যখন একটি বুটিক খোলেন, তিনি আথাইয়াকে ড্রেস ডিজাইনিং-এর কাজের জন্য চেষ্টা করতে বলেন। তখনই তিনি পোশাক ডিজাইনের জন্য নিজের স্বাভাবিক প্রবণতা আবিষ্কার করেন। এরপর ডিজাইনার হিসেবে তাঁর সাফল্য জীবিকার পথ সুগম করে তোলে।

সাত ভাই-বোনের সংসারে টানাপোড়েন ছিল বেশ। ভানুর চিত্রকলার খুব শখ ছিল। তিনি J.J. School of Art থেকে চিত্রশিল্পে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন। সেখানে গোল্ড মেডেলও পান। তবে ড্রেস ডিজাইনিং-এ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথাগত শিক্ষালাভের সুযোগ তাঁর হয়নি। শিল্প ও সৃজনীর ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল বাবা। ভানুর বাবা ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা বাবুরাও পেইন্টারের সঙ্গে কাজ করতেন। তবে নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে দৃঢ় করেছেন ভানু নিজেই। নিজের অদম্য অনুরাগের জন্য তিনি অঙ্কনশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম ড্রেস ডিজাইনের জন্য ভানুকে ডেকে পাঠান স্বনামধন্য নায়িকা কামিনী কৌশল।

কর্মজীবন

কর্মজীবনের পাঁচ দশক জুড়ে ভারতের শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন ভানু আথাইয়া। ১৯৫৬ সালে গুরু দত্তের ‘সি. আই. ডি’ ছবিতে প্রথম উল্লেখযোগ্য সুযোগ পান। সাতাশ বছর বয়সে এই চলচ্চিত্রে কস্টিউম ডিজাইনারের কাজ করেন। বলা বাহুল্য সিনেমাটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ ছোঁয়া। কার্যত তারপরই ঘুরে যায় তাঁর ভাগ্যের চাকা। গুরু দত্তের দলে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নেন তিনি। গুরু দত্তের পরিচালনায় ‘পিয়াসা,’ ‘সাহেব বিবি গোলাম,’ ‘চৌধভি কা চাঁদ,’ প্রভৃতি একাধিক সিনেমার সাফল্যের অন্যতম ভাগীদার ছিলেন ভানু।
সব মিলিয়ে ১৩০ টি ছবিতে ভানু কস্টিউম ডিজাইন করেছেন। এগুলির মধ্যে ‘কর্জ,’ ‘গীতা মেরা নাম,’ ‘অগ্নিপথ,’ ‘পরম্পরা,’ ‘লেকিন,’ ‘লাগান,’ ‘স্বদেশ,’ ইত্যাদি বিখ্যাত। ‘শ্রী চারশো বিশ’ ছিল রাজ কাপুরের সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজ। তাঁর কল্পিত পোশাকে এই সিনেমায় ‘মুর মুর কে না দেখ, মুর মুর কে’ গানের সঙ্গে নাদিরার নাচটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘গাইড’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রে ওয়াহিদা রহমানকে একজন শহুরে মেয়ের থেকে একজন নৃত্যশিল্পীতে রূপান্তরিত করেন ভানু আথাইয়াই। ১৯৮৩ সালেই তিনি পেলেন কাজ এবং দক্ষতার যোগ্য মূল্য। ভারতের মাটিতে এল প্রথম অস্কার। সত্যজিৎ রায় তখনও পাননি এই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। এছাড়াও ১৯৯১ সালে ‘লেকিন’ ও ২০০২ সালে ‘লাগান’ চলচ্চিত্রের জন্য ভানু দু’বার সম্মানিত হয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কারে। ২০০৯ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন চলচ্চিত্র সম্মানে ভূষিত হন তিনি।
আজ দুঃখ হয় এই নারীর নাম জগতে সর্বজনবিদিত হয়ে ওঠেনি। তাঁর কথা আমি জানলাম ওঁর মৃত্যুর পর দৈনিক সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদন থেকে। ১৯৮৩ সালে গান্ধী চলচ্চিত্রে পোশাক পরিকল্পনার জন্য প্রথম ভারতীয় হিসাবে অস্কার পেয়েছিলেন ভানু আথাইয়া। কিন্তু গান্ধী চলচ্চিত্রে এমন কী ছিল যা ভানুকে অ্যাকাডেমি পুরস্কারের শিরোপা এনে দিয়েছিল?
গান্ধী চলচ্চিত্রে বিভিন্ন খাদির বস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল; বিভিন্ন ভারতীয় নেতার মাথায় আলাদা আলাদা টুপি ব্যাবহৃত হয়েছিল যা ছিল ভারতীয় পোশাকের বিশেষত্ব। চলচ্চিত্রে একমাত্র ভানু আথাইয়াই ছিলেন ভারতীয়। তিনি এই চলচ্চিত্রে ভারতীয়দের পোশাক ডিজাইন করেছিলেন এবং ব্রিটিশদের কস্টিউম ডিজাইন করেছিলেন জন মলো (John Mollo)।
পুরস্কারটি নিয়ে ভানুর দুশ্চিন্তা ছিল। তিনি মনে করতেন ভারতে তাঁর অস্কার পুরস্কারটি নিরাপদ নয়। তাঁর ভাষায়, “ভারতে কারোর ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। যদি শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কারটি চুরি হয়ে যেতে পারে আমার অস্কারের নিশ্চয়তা দেবে কে? ভারতে এ ধরনের আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কোনো মূল্য নেই। আর দেশের পরিচয় তুলে ধরা বা পরিচয় বহনকারী ঐতিহ্য নষ্ট করতে ভারতীয়দের জুড়ি নেই।” জানি না তাঁর এই ক্ষোভের যুক্তিযুক্ত কারণ আছে কি নেই। তবে তিনি তাঁর অস্কারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস্ অ্যাঞ্জেলসের সংগ্রহশালায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

নারী, তাই কি তিনি অবহেলিত?

এত কিছুর পরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে! অস্কারের প্রশ্ন এলেই যাঁর নাম প্রথমে মনে হয়, তিনি হলেন সত্যজিৎ রায় আর তারপরে এ.আর. রহমান। ভানুর নাম অন্ধকারে ডুবে থাকার কারণ কী? ভানু নারী বলে, নাকি তাঁর অস্কার জয় পরিচালনা বা অভিনয়ে নয়, তাই? নাকি ভানু নিজেই এই আড়ালটি বেছে নিয়েছিলেন? কারণ হিসেবে এসব হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আসলে পুরনো কিছু ঘটনা এইসব প্রশ্নগুলিকে জাগিয়ে তোলে। এ নিয়ে একটু ভাবা যাক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতীয় আই.সি.এস., ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। সত্যেন্দ্রনাথ যখন বিয়ে করেন তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। শোনা যায় এই জ্ঞানদানন্দিনী পরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের নিয়ন্ত্রক হয়েছিলেন। আপনি হয়তো ভাবছেন হঠাৎ ভানু আথাইয়া থেকে ঠাকুরবাড়িতে কেন এসে পড়লাম।

আসলে বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার পথিকৃৎ এই মহীয়সী নারী – জ্ঞানদানন্দিনী। এঁর কাছে আজকের আধুনিক বাঙালি নারীর ঋণের শেষ নেই। কেমন করে? সেই উত্তরেই আসছি।  জ্ঞানদানন্দিনীই বাঙালী নারীকে আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরতে শিখিয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির বউদের শাড়ি পরার ধরনটি ফ্যাশন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে, আর তা শেখান স্বয়ং জ্ঞানদানন্দিনী। স্বামীর কর্মস্থল বোম্বাইয়ে (বর্তমানে মুম্বাই) থাকাকালে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তিনি শাড়ি ও জামার নমুনার বিবিধ পরিবর্তন করেন। গুজরাটি মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরে তার কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়ে, ডান কাঁধের বদলে বাম কাঁধে আঁচল নিয়ে শাড়ি পরার প্রচলিত যে রূপটি আমরা আজকের দিনে বাঙালি মেয়েদের গায়ে দেখি তা স্বয়ং জ্ঞানদানন্দিনীর আবিষ্কার। শাড়ির সঙ্গে সায়া, ব্লাউজ, সেমিজ, জামা পরার চলটিও অবিভক্ত বাংলায় তিনি প্রথম প্রবর্তন করেন। এছাড়াও পত্রিকা প্রকাশ, প্রবন্ধ রচনা, রূপকথাকে নাট্যরূপ দেওয়া, অভিনয়, এসব কাজেও জ্ঞানদানন্দিনী পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। অথচ জ্ঞানদানন্দিনীকে কেউ মনে রাখেনি।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

ভেবে দেখুন, ঠাকুর বাড়ির পুরুষ শাসিত সমাজে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এঁরা কেউই কারোর চেয়ে কম নন। শিল্প সাহিত্যের নানান শাখায় এঁদের বিচরণ ছিল। কিন্তু আলোকজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের দাপটে যখন এইসব পুরুষ প্রতিভাবানরাই স্তিমিত জ্যোতিষ্ক, সেখানে জ্ঞানদানন্দিনীর মত মহীয়সী তো তুচ্ছ। তেমনি হয়তো কেউ মনে রাখেনি ভানু আথাইয়াকে।
বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় অস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯২ সালে, মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে। এর দশ বছর আগে ১৯৮৩ সালে ভানু আথাইয়া ভারতীয় হিসাবে প্রথম অস্কার পেয়েছিলেন। স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবরো পরিচালিত গান্ধীর পোশাক পরিকল্পনাকরী হিসাবে তিনি এই পুরস্কার পান, যা আগেই আমি বলেছি। এরপর এর.আর. রহমান ও গুলজার অস্কারের মুকুট জিতে নিয়েছেন ২০০৯ সালে ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ ছবিতে যথাক্রমে সুরারোপ ও গীতরচনা করে। সব মিলিয়ে ভারতে এই চারজন অস্কার বিজয়ী।

‘গান্ধী’ চলচ্চিত্র

গান্ধী চলচ্চিত্রে গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান দৃশ্যায়নে অংশ নেয় প্রায় চার লক্ষ শিল্পী। চলচ্চিত্রের ভাষায় এই জনতাকে এক্সট্রা বলা হয়। ভারতের মতো জাতি ও বর্ণ বৈচিত্র্যের দেশে এই ধরনের একটা অনুষ্ঠানে চার লক্ষ মানুষের উপস্থিতি পোশাক পরিকল্পনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে চলচ্চিত্রের পর্দায় ঠিক যেভাবে ভানু উপস্থাপন করেছিলেন সেটি সত্যি প্রশংসনীয় ও অননুকরণীয়। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী গান্ধীর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান গান্ধী চলচ্চিত্রে বিশ্বের সর্বাধিক শিল্পীর সমন্বয়ে করা দৃশ্য হিসাবে স্বীকৃত।
অস্কার প্রতিযোগিতায় গান্ধী, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদনা, কেন্দ্রীয় অভিনেতা, শিল্প নির্দেশনা, ও পোশাক পরিকল্পনা বিভাগে পুরস্কার পায়। ভানু জানিয়েছিলেন গান্ধী চলচ্চিত্রে মহাত্মার পঞ্চাশ বছরের জীবন তুলে ধরা হয়েছিল, যা খুবই কষ্টকর। ইংল্যান্ডের ডান্ডি সহ নানান স্থানে নানা অবস্থায় ছিল তাঁর বিচরণ। দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মার যুবক সময় এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পরিবর্তন ফুটিয়ে তোলা বাস্তবে খুবই কঠিন হয়েছিল। এছাড়াও একটা নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে শত শত মানুষের পোশাকে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এই কাজ ভানু একা হাতেই করেছেন এবং তাঁকে আন্তর্জাতিক মানের কর্মীবাহিনীর সঙ্গে তালে তাল রেখে কাজটি সামলাতে হয়েছিল।

চলচ্চিত্র তত্ত্ব, চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যম ও তার বিবর্তন

চলচ্চিত্র একপ্রকারের দৃশ্যমান বিনোদন মাধ্যম। চলমান চিত্র তথা “মোশন পিকচার্স” থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি এসেছে। একটি একটি বিশেষ শিল্প মাধ্যম। বাস্তব জগতের চলমান ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে যা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগৎ তৈরী করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। চলচ্চিত্রের ধারণা অনেক পরে এসেছে, ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে। আর অ্যানিমেশন চিত্রের ধারণা এসেছে আরও পরে। বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসাবে ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি বা ফিল্ম শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়।
চলচ্চিত্রের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে সাংস্কৃতিক উপাদান সমূহ। যে সংস্কৃতিতে তা নির্মিত হয় তাকেই প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসাবে খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। ছায়াছবির সাথে ভিজুয়্যাল বিশ্বের সমন্বয় থাকায় সাধারণ মানুষের সাথে সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। অন্য কোনো শিল্প মাধ্যম সাধারণের সাথে এতটা যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম নয়। অন্যভাষায় চলচ্চিত্রের ডাবিং বা সাবটাইটেল করার মাধ্যমে নিজ ভাষায় নিয়ে আসার প্রচলন রয়েছে।
প্রথাগত চলচ্চিত্র নির্মিত হয় অনেকগুলো একক ছবি তথা ফ্রেমের ধারাবাহিক সমন্বয়ের মাধ্যমে। এই স্থির চিত্রগুলি যখন খুব দ্রুত দেখানো হয় তখন দর্শক মনে করেন তিনি চলমান কিছু দেখছেন। প্রতিটি ছবির মাঝে যে বিরতি তা একটি বিশেষ কারণে দর্শকদের চোখে ধরা পড়ে না। ধরা না পড়ার এই বিষয়টিকে persistence of vision বলে। সহজ কথায় মানুষকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। এভাবে চলমান ছবির ধারণা লাভের বিষয়টিকে মনোবিজ্ঞানে বিটা চলন নামে আখ্যায়িত করা হয়।
চলচ্চিত্রের সুসংক্ষিপ্ত, সুষ্ঠ এবং পদ্ধতিগত ধারণা তৈরী করার নামই চলচ্চিত্র তত্ত্ব। এসব তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য চলচ্চিত্রকে একটি শিল্প হিসাবে অধ্যায়নের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা। Ricciotto Canudo ১৯১১সালে প্রকাশিত তার “The birth of the Sixth Art” নামক ম্যানিফেস্টোতে প্রথম চলচ্চিত্র তত্ত্বের উল্লেখ করেন। এরপরে ফর্মালিস্ট তত্ত্ব দিয়ে এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন Rudolf Arnheim, Bela Balazs এবং Siegfried Knacaur। এই তাত্ত্বিকেরা চলচ্চিত্রকে দেখেছেন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি প্রকৃত শিল্প মাধ্যম হিসেবে। Andre Bazin এই তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন চলচ্চিত্রের সার্থকতা যান্ত্রিক উপায়ে বাস্তবতাকে পুনঃনির্মাণ করার মধ্যে নিহিত। বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা কখনোও চলচ্চিত্রের লক্ষ্য হতে পারেনা। এই চিন্তাধারার ফলে চলচ্চিত্র রিয়েলিস্ট তথা বাস্তবিকতা তত্ত্বের জন্ম হয়। বর্তমানে Lacan এর মনোবিশ্লেষণ এবং Ferdinand de Saussur এর সেমিওটিক্স এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র নতুন কিছু তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। এগুলি হল মনবিশ্লেষণ মূলক চলচ্চিত্র তত্ত্ব, স্ট্রাকচারালিস্ট চলচ্চিত্র তত্ত্ব, নারীবাদী চলচ্চিত্র তত্ত্ব ইত্যাদি।
বিষয়বস্তু, পরিপ্রেক্ষিত, পটভূমি আর অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে যে কোনো সাহিত্য মাধ্যমেরই ধরণ নির্দিষ্ট করা যায়। চলচ্চিত্রও এরকম কিছু ধরণ রয়েছে যাদেরকে ইংরেজিতে জেনার বা জনরা (genre) বলে। এই ধরণগুলো মূলত সারণীকরণের মাধ্যমে করা হয়। ধরণ দিয়ে একটা চলচ্চিত্রকে সম্পূর্ণ ব্যবসা করা সম্ভব নয়। একটি চলচ্চিত্র আবার একাধিক ধরনের মধ্যে পড়তে পারে। জনপ্রিয় কিছু ধরনের মধ্যে রয়েছে হরর, রোমাঞ্চ, অ্যাকশন, থ্রিলার, ঐতিহাসিক, মহাকাব্যিক, রূপকথা, অপরাধ, কমেডি ইত্যাদি। চলচ্চিত্রকে নিয়ে এতগুলি কথা বলার একটি প্রধান হল আধুনিক যুগে চলচ্চিত্র মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর আকার ছোটো হয়ে এসেছে।
চলচ্চিত্র চলে মূলত ইমেজকে ধরে। তাই চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘাটলে ইমেজের নির্দিষ্ট বিবর্তন ধরা পড়ে। আইজেনস্টানের ভাষায় কোনো এক বিশেষ যুগের শিল্পে লভ্য কল্পমূর্তির মালা তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে ওই যুগের কল্পমূর্তির সাথে সাথে ওই যুগের কল্পনাধারা ও যুক্তিপ্রণালী তুলে ধরতে হবে। এটা বিবর্তনের অংশ। এ কারণে ছবির ইমেজের ধরণ ছবির জাতিত্ব ও ঘরনার ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল হয়। পরাবাস্তববাদ চলচ্চিত্রের ইমেজ থেকে নব্যবাস্তববাদ চলচ্চিত্রের ইমেজ, হলিউড চলচ্চিত্রের ইমেজ থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড চলচ্চিত্রের ধরণ, অর্থ ব্যঞ্জনা ও পরিণতিতে আলাদা। এই প্রসঙ্গেই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে ক্রিয়াশীল হয়েছে নানা ইজম বা বাদ। চলচ্চিত্রে ইজমের প্রসঙ্গে আসলেই ন্যাচারালিজম বা রিয়ালিজম নিয়ে কথা বলতে হয়।
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপের সবখানে সর্বক্ষেত্রেই ন্যাচারালিজম বা স্বাভাবিকতাবাদের প্রাধান্য দেখা যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তখন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মানে জীববিদ্যা, মনোবিদ্যা ও সমাজবিদ্যার জয়জয়কার। সাহিত্যের ন্যাচারালিজম আগ্রহী ছিল তথাকথিত শিল্প সৃষ্টির পরিবর্তে Slices of life তুলে ধরায়।
রিয়ালিজমের মতো এরও লক্ষ্য অবজেক্টিভিটি। রিয়ালিজম বস্তুজগতের সম্পর্ক উন্মেষের ও জীবন অন্বেষণের বাস্তবসম্মত পদ্ধতির পক্ষপাতি,জীবনকে আরও জীবন্ত করে দেখানোর প্রচেষ্টা। চলচ্চিত্রে প্রথম যখন এদের প্রকাশ দেখা যায় তখন তার সাথে মিশে থাকত কল্পনা ও অতিরঞ্জন। মূল উদ্দেশ্য ছিল বস্তুজগতের সঙ্গে চিত্র উপাদানের স্বাভাবিক ও বাস্তব নৈকট্য বজায় রেখে চিত্র নির্মাণ। যদিও চলচ্চিত্রে বাস্তববাদের প্রসঙ্গ বহু আলোচিত ও বিতর্কিত। তারপরও এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজিমের মতো ইউমের সঙ্গে পথ পরিক্রমায় ইতালিতে জন্ম নেওয়া নিওরিয়ালিজমের আবির্ভাব চলচ্চিত্রে বাস্তববোধের আরেক রূপ। সুররিয়ালিজিম যেখানে বাস্তবকে বোঝানোর জন্য বাস্তবকে অতিক্রমের পক্ষে মত দেয়, নিওরিয়ালিজম সেখানে বাস্তবের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে পুরো মিশে যাওয়ার কথা বলতে থাকে।
চলচ্চিত্রের দুটো বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ –
১) এর গতিময়তা বা ভরবেগ, চলচ্চিত্রের ধারাবাহিক চিত্রুরুপের চলমানতা।
২) এর স্বপ্নময়তা, চলচ্চিত্রের কল্পলোক বা স্বপ্নলোক সৃষ্টি করতে পারার ক্ষমতা।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি পোশাক পরিকল্পনার জন্য অন্যতম। কারণ এই স্বপ্নলোক ও কল্পলোক সৃষ্টির যে ক্ষমতা চলচ্চিত্রের আছে, সেটার জন্য পোশাকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

চলচ্চিত্রে সাজসজ্জার ভূমিকা


সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় ‘ইমেজ এখানে শুধু ছবি নয়, বর্ণময় ছবি।’ পেইন্টিং-এর মাধ্যমে ছবির শুরু ও শেষ। এখানে মুখ্য হল ছবির অর্থ। এক একটি ছবি যেন এক একটি বাক্য। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগেও ছবি অর্থবহন করেছে। ইমেজ আমাদের সামনে যে বাস্তবতাকে তুলে ধরে সেখানে পোশাক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাদা-কালো যুগে রঙ আলাদা কোনো বার্তা বহন না করলেও পোশাকের ধরন, তার নকশা, নিঃসন্দেহে বার্তা বহন করেছে। আর রঙিন চলচ্চিত্রের যুগে রঙ নতুন মাত্রা যোগ করে। তাই যে কোনো ইমেজ সৃষ্টির ক্ষেত্রে পোশাক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রথাগত সমাজে কোনো ব্যক্তির পোশাক, তার চেহারার গড়ন, গায়ের রঙ, প্রভৃতির মাধ্যমে তার শ্রেণী, পেশা, মর্যাদা, ফুটে উঠত। মধ্যযুগেও যে কেউ চাইলে যে কোনো পোশাক পরতে পারত না। তবে সপ্তদশ শতকের শুরু থেকে পোশাকের এই অবস্থা অনেকখানি বদলে যেতে থাকে। ফরাসী বিপ্লবের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাশনের গণতন্ত্রায়ন হয়। একটি আধুনিক-মনস্ক সমাজের জন্ম হয়। পুঁজির চূড়ান্ত কর্তৃত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধনতন্ত্রের। জীবনের সবক্ষেত্রে – জ্ঞানজগতে, কর্মজগতে, শিল্পে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে, সব শাখায় আধুনিকতা পরিপ্রসারিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ক্রমে সে সমস্তই মৌলবাদী আধুনিকতায় পর্যবসিত হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অবশ্য সমাজতন্ত্র নামক চিন্তার প্রকাশ ও বিকাশ ম্রিয়মাণ হতে থাকে।
অন্যদিকে বিশ্বের একটি বিশাল অংশ অর্থের ও যন্ত্রের দাসরুপে বিকশিত হয়। তারা নতুন নতুন চাহিদা তৈরীর মাধ্যমে এক অস্থির আধুনিক ব্যাক্তিত্বকে চিরস্থায়ী করে। যা সবসময় নতুন, প্রশংসার বিষয় খুঁজতে থাকে। জন্ম হয় ফ্যাশনের; ফ্যাশন ও আধুনিকতা হাত ধরাধরি করে তথাকথিত ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করে চলে।
তবে ফ্যাশন ডিজাইনিং সঙ্গে পোশাক পরিকল্পনাকারীর একটি বড় পার্থক্য আছে। ফ্যাশন ডিজাইনে সৌন্দর্য, আকর্ষণ ক্ষমতা, কিংবা উজ্জ্বলতা গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু পোশাক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ন হল নাটক বা শিল্প নির্দেশনার সাথে পোশাক পরিকল্পনার সম্পর্ক। পোশাক পরিকল্পনাকারী ও শিল্প নির্দেশকের মধ্যে একটি নিকট সম্পর্ক থাকে। ভানুর মতে একজন পোশাক পরিকল্পনাকারী একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যরূপটি তুলে ধরেন। যেমন ‘লাগান’ ছবিটিতে সাধারণ গ্রামবাসী থেকে শুরু করে ভারতীয় উপনিবেশে থাকা ব্রিটিশ উচ্চপদস্থদের তুলে ধরা হয়েছে।
একটি চলচ্চিত্র পারিপার্শ্বিক আবহাওয়াকে তুলে ধরে। যা কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য তা সবই চলচ্চিত্রে ধরা পরে। স্থান এবং কাল চলচ্চিত্রের মূল আধার। চলচ্চিত্রে কোন সময়কাল তুলে ধরা হয়েছে তা পাঠোদ্ধারের ক্ষমতা আছে কেবলমাত্র পোশাকের। সেই এলিজাবেথিয়ান যুগ থেকে পোশাকের খেলা চলেছে।
তাই চলচ্চিত্রের পোশাক পরিকল্পনার আগে কতগুলি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। পোশাক পরিকল্পনাকারীকে চলচ্চিত্রের কাহিনি, কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত সঙ্গীত, নৃত্য, ইত্যাদি বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হয়। তা ছাড়াও বিশেষ দ্রষ্টব্য ভৌগলিক অবস্থান, দিন, মাস, বছর, বিশেষ কোনো পরিস্থিতি, এবং আর্থসামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, নৈতিক, বৈবাহিক, কিংবা পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদি। আবার সময়কে ধরার জন্য কখনও কখনও জাদুঘর, সেই সময়ের সংবাদপত্র, স্থাপত্য, পেইন্টিং এগুলিকে প্রাথমিক বিষয় হিসেবে মাথায় রাখতে হয়।
অস্কার নিয়ে ভানু ভারতে ফেরার পর তাঁকে একটা মজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন যে ঠিক কী কারণে তিনি ‘গান্ধী’তে অস্কার পেলেন? কারণ ওই চলচ্চিত্রে সব কিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। তাহলে ভানু আলাদা করে কী করলেন? এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় পোশাক পরিকল্পনা সম্পর্কে সেই সময় মানুষের কতখানি জ্ঞান ছিল। বেশির ভাগই মনে করত পোশাক পরিকল্পনা মানে নতুন কোনো কিছু করে দেখানো যা সবার চোখে পড়বে, যা সকলে অনুসরণ বা অনুকরণ করবে।
ভানু যে বুটিকে পোশাক পরিকল্পনার কাজ শুরু করেন সেই বুটিকে নিয়মিত ভাবে সেই সময়ের তারকারা আসতে থাকেন। কামিনী কৌশল, নার্গিস থেকে রামানন্দ সাগর সবাই ছিল এই তালিকায়। কামিনী কৌশলই তাঁর ব্যক্তিগত পোশাকের জন্য ভানুকে ডিজাইনার হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। পরে তাঁর ‘শাহেনশাহ’ ও ‘আলিবাবা অওর চাল্লিশ চোর’ চলচ্চিত্রে ভানু পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন। ২০১২ সালে জুনে হঠাৎ ভানুর ব্রেইন টিউমার ধরা পরে এবং সেই বছরই ডিসেম্বর মাসে ভানু তার অস্কার পুরস্কারটি লস্ অ্যাঞ্জেলসে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ মোশান পিকচার্স আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের কাছে হস্তান্তর করেন। ১৯৮৩ সালের ১১ই এপ্রিল অস্কারের পঞ্চান্নতম আসরে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইতিহাস গড়েছিলেন ভানু আথাইয়া। আজ পর্যন্ত নারী হিসাবে তাঁর এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেনি কেউ। এই অর্জন ভানু আথাইয়াকে অনন্য করেছে।

ভারতীয় চলচ্চিত্রে নারীরা – গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সত্ত্বেও অবহেলিত

নারীর অবদান ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন নয়। তবে দুঃখ, ভারতীয় হিসাবে অস্কার পেলেও ভানু আথাইয়া দেশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সম্মাননা পাননি। একটি প্রশ্ন সেই থেকেই যায়, পুরুষশাসিত সমাজ বলে কি নারী এতটা পিছিয়ে? পিছিয়ে মানে তথাকথিত সম্প্রচারের দিক থেকে। তবুও এই স্বনামধন্যা নারীর চলচ্চিত্রে অবদান অনস্বীকার্য। 

চলচ্চিত্রে নারীদের এই অসম্ভব অবদান নতুন নয়। ক্রমে উঠে আসে ফাতিমা বেগম (১৮৯২-১৯৮৩) এর কথা। তিনি ছিলেন ভারতীয় অভিনেত্রী, পরিচালক ও চিত্র নাট্যকার। তাকেই ভারতের প্রথম নারী চলচ্চিত্র পরিচালক বলে মনে করা হয়। চার বছর বয়সে তিনি লিখতে শুরু করেন। তিনি তার নিজের প্রোডাকশন হাউস চালু করেন। এই কোম্পানির নাম ছিল ফাতিমা ফিল্মস্। কোম্পানিটি পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া ফাতিমা ফিল্মস্ হয়ে ওঠে এবং এটিতে পরিচালিত তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘বুলবুল ই পাকিস্তান’, যা ছিল ১৯২৬ সালের চলচ্চিত্র। যদিও তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করে ছিলেন ঊর্দু মঞ্চে। একপরে তিনি চলচ্চিত্রে স্থানান্তরিত হন এবং ‘বীর অভিমন্যু’ (১৯২২) তিনি তার আত্মপ্রকাশ করেন।
তার সময়ে পুরুষদের সাথে নারীদের অভিনয় করা প্রচলিত ছিল। তাই তিনি হয়ে উঠলেন বিশাল এক নারী তারকা। ১৯২৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ‘ফাতিমা ছায়াছবি’ ১৯২৮ সালে ‘ভিক্টোরিয়া ফাতিমা ছায়াছবি’ নামে পরিচিত হয়। তিনি হয়ে ওঠেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। বেগম ১৯২৬ সালের চলচ্চিত্র ‘বুলবুল ই পাকিস্তান’ নির্মাণ করার জন্য এবং এই চলচ্চিত্র থেকে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম মহিলা পরিচালক হন। তাঁর নির্দেশনায় অনেক ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। তবে তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ছিল ১৯২৯ সালের ‘ভাগ্য দেবী’।
আবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে এলেন কানন দেবী (এপ্রিল ২২, ১৯১৬ – জুলাই ১৭, ১৯৯২), যিনি কাননবালা নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় অভিনেত্রী এবং গায়িকা। যিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকাদের মধ্যে প্রথম গায়িকা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম তারকা হিসেবে স্বীকৃত। সাধারণত দ্রুতলয়ে তার গান গাওয়ার ধরণ নিউ থিয়েটার, কলকাতার ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
কানন দেবী অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্য এবং সঙ্গীতেও ছিলেন পারদর্শী। প্রায় ৭০ এর অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন চিত্রেও দেখা যায় তাকে। কানন দেবীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’। শিল্প মাধ্যমে অসাধারণ অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ১৯৬৪ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী ও পরিচালক দুইয়ের ভূমিকাই পালন করেন অরুন্ধতী দেবী (জন্ম ১৯২৩ – মৃত্যু ৩১ শে জানুয়ারি, ১৯৯০)। খ্যাতনামা চিত্রনির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিউ থিয়েটার্সের ‘মহা প্রস্থানের পথে’ (১৯৫২) ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জীবনে প্রবেশ করেন। চিত্রনাট্যকার বিনয় চট্টোপাধ্যায় এ কাজে তাঁকে প্রথম সহায়তা করেন।প্রথম ছবিতেই অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করেন এবং একের পর এক বাংলা সিনেমায় সফলভাবে অভিনয় করে গেছেন অরুন্ধতী দেবী। এরমধ্যে ‘নদ ও নদী'(১৯৫৪), ‘বকুল'(১৯৫৪), ‘সতী’ (১৯৫৪), ‘প্রশ্ন'(১৯৫৪), ‘গোধূলি'(১৯৫৫), ‘মা'(১৯৬০), ‘পঞ্চতপা'(১৯৬০), ‘ক্ষুধিত পাষাণ'(১৯৬০) ও ‘দুজনার'(১৯৫৫) অন্যতম। ভগিনী নিবেদিতার জীবনাবলম্বে তাঁর অভিনীত ‘ভগিনী নিবেদিতা’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তিনি বেশ কয়েকটি ছবি পরিচালনাও করেন। চল্লিশের দশকে তার বিবাহ হয় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং তাদের অনুরাধা নামে একটি কন্যাও হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি বিখ্যাত পরিচালক তপন সিংহের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের এক পুত্র অনিন্দ্য সিংহ, পেশায় বিজ্ঞানী।

সুতরাং নারীর অবদান ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন নয়। তবে দুঃখের সাথে জানানো হচ্ছে ভারতীয় হিসাবে অস্কার পেলেও ভানু আথাইয়া দেশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সম্মাননা পাননি। একটি প্রশ্ন সেই থেকেই যায়, পুরুষশাসিত সমাজ বলে কি নারীরা এতটা পিছিয়ে? পিছিয়ে মানে তথাকথিত সম্প্রচারের দিক থেকে। তবুও এই স্বনাম ধন্যা নারীদের চলচ্চিত্রে অবদান অনস্বীকার্য।

কানন দেবী
অরুন্ধতী দেবী
ফতিমা বেগম
অস্কারের মঞ্চে ভানু

অস্কার পুরস্কারের জন্য যখন মঞ্চে ভানুকে আহ্বান করা হয় তখন তার পরনে ছিল শাড়ি। পোশাকের মাধ্যমে তিনি ভারতের মর্যাদাকে তুলে ধরেছিলেন। সারা জীবনে সবাইকে নানা পোশাকে সাজিয়েও নিজের দেশ, সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি ভানু। আজ আমি আমার লেখার মাধ্যমে সকল পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই চলচ্চিত্রে নারীদের ভূমিকাকে। যদিও সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভবপর হয়নি। তবুও মূল আকর্ষণ ও স্রোতের কর্ণধারা ভানু আথাইয়া, যাকে দুঃখজনক ভাবে আমরা ভুলে যেতে বসেছিলাম।।

অস্কার হাতে ভানু আথাইয়া
গান্ধী ছবির দৃশ্য
জন্ম: শ্যামনগর, উত্তর ২৪পরগনা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা। দীর্ঘ ১০ বছর বিভিন্ন জীবিকার সাথে যুক্ত । কবিতা প্রকাশিত হয়েছে - উন্মেষ, আলেয়া, আমরা সহযাত্রী, সংস্কৃতি বার্তা, মৌন মুখর, নবাবী, দৃষ্টি সাহিত্য পত্রিকা, - ইত্যাদি বহু পত্রিকাতে।

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • BHASKAR SINHA , July 16, 2021 @ 6:08 pm

    প্রবন্ধে Film theorist Siegfried Kracauer-এর নাম মুদ্রিত হয়েছে Siegfried Knacaur.

    ভাস্কর সিংহ | ভোপাল | মধ্য প্রদেশ| ভারত
    16-JUL-2021

  • Rubel Chowdury , July 31, 2021 @ 7:01 am

    খুবই সুন্দর প্রবন্ধ আরো জানতে

  • চন্দন কুন্ডু , August 6, 2021 @ 4:46 am

    খুবই সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ। আমাদের অনেকেই এখনো উদার চিন্তা, অপরের যৌক্তিক প্রাপ্যতার প্রতি সমর্থন, সম্মান বোধ ইত্যাদি থেকে দূরে সরে আছি। এসব একজন ব্যক্তি সমাজ সম্প্রদায় রাষ্ট্রে – সামন্তবাদী চিন্তা চেতনা পোষণ ও ধারণের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। তবু্ও সময়ের ব্যবধানে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আশা রাখি ভবিষ্যতে আরো ভাল কিছু ঘটবে- আমাদের সমাজের অনেক পুরুষ নারীদের যোগ্য মর্যাদা দিয়ে থাকেন এবং দিচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *