বাঙালি জীবনে সত্যজিতের অবস্থান
সত্যজিৎ রায় বাঙালি জীবনে ঈশ্বর-প্রেরিত উপহার স্বরূপ। তিনি ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে’ উদিত না-ই হতে পারতেন। বাঙালির সত্যিই তাতে কিছু যেত-আসত কি না, তা ভেবে দেখার মতো বিষয় বটে!
ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত বঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দু’টি পরিবার সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এবং অবিভক্ত বঙ্গের মসূয়ার রায়চৌধুরী পরিবার। মসূয়া ছিল তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ময়মনসিংহ জেলায়, বর্তমানে যা ঢাকা ডিভিশনের কিশোরগঞ্জে অবস্থিত।
১২৭০ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী নিকটাত্মীয় কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে কামদারঞ্জনকে পোষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করে নতুন নামকরণ করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এই উপেন্দ্রকিশোরই ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষায় প্রথম সচিত্র শিশুসাহিত্য পত্রিকা ‘সন্দেশ’ শুরু করেন। তিনি শুধু বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিকই ছিলেন না, ছিলেন বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক এবং মুদ্রণশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর হাতে গড়া ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির মাধ্যমেই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণ শিল্প বিকাশের সূত্রপাত ঘটে। একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার উপেন্দ্রকিশোর পাশ্চাত্যবিদ্যায়ও নিজেকে সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘টুনটুনির বই’ যেমন একদিকে লিখেছেন, অন্যদিকে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল’ পত্রিকায় হাফটোন মুদ্রণ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রবন্ধও রচনা করেছেন।
উপেন্দ্রকিশোরের অনুজ কুলদারঞ্জন রায়ও ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক, আলোকচিত্রশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ ও ক্রীড়াবিদ। পুরাণ ও বিভিন্ন বিদেশি সাহিত্য থেকে শিশুপাঠোপযোগী তর্জমা তিনি প্রকাশ করেন। ‘ছেলেদের বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘কথাসরিৎসাগর’, ‘পুরাণের গল্প’, ‘ছেলেদের পঞ্চতন্ত্র’, ‘রবীনহুড’, ‘আশ্চর্য দ্বীপ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গ্রন্থ।
সাহেবদের হাত ধরে বাংলায় ক্রিকেটযাত্রা শুরু করেন গণিতের যে অধ্যাপক, সেই বাংলা ক্রিকেটের জনক, বাঙালি ডব্লিউ জি গ্রেস সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের অগ্রজ। রায়চৌধুরীরা পাঁচ ভাই মিলে গড়ে তুলেছিলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। পরে তাঁরা কলকাতায় টাউন ক্লাবও গড়ে তোলেন। ক্রিকেটের নিয়মকানুন নিয়ে প্রথম বাংলা বই ‘ক্রিকেট খেলা’ সারদারঞ্জনেরই রচনা।
‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে সত্যজিৎ লিখেছেন, “… সারদা ও মুক্তিদা… এই দুই ভাই খেলাধূলা করতেন। ক্রিকেট শুরু করেন সারদা, তারপর সেটা রায় পরিবারে হিন্দু-ব্রাহ্ম সব দিক ছড়িয়ে পড়ে।”
উপেন্দ্রকিশোর-বিধুমুখীর তিন পুত্র— সুকুমার, সুবিনয়, সুবিমল এবং তিন কন্যা— সুখলতা, পুণ্যলতা, শান্তিলতা ছিলেন বিবিধ গুণের অধিকারী। ক্ষণজন্মা সুকুমার ছিলেন শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম সেরা শিশুসাহিত্যিক এবং ‘ননসেন্স ছড়া’র প্রবর্তক। একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার সুকুমার রায়ের সুযোগ্য সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকা অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছেছিল। ‘আবোল তাবোল’, ‘হযবরল’ সুকুমারের অমর সৃষ্টি। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবীন্দ্রনাথ সরাসরি সুকুমারকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোরের আরেক ভাই প্রমদারঞ্জনের মেয়ে লীলা জন্মগ্রহণ করেন রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে। বাংলা গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস লীলা মজুমদার প্রতিভা-স্পর্শে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘হলদে পাখির পালক’-এর মতো অবিস্মরণীয় শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা লীলাপিসিকে সঙ্গে নিয়েই সত্যজিৎ রায় ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা পুনর্জীবিত করেন।
মসূয়া থেকে কলকাতায় চলে আসা গড়পাড়ের রায়চৌধুরী পরিবারের খ্যাতকীর্তি তিন প্রজন্মের তৃতীয় প্রজন্মের আলোকবর্তিকা ছিলেন সত্যজিৎ রায়। একই সঙ্গে তিনি ধারক ও বাহক ছিলেন পারিবারিক ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক মনীষার।
সত্যজিৎ রায় নামটি উচ্চারিত হলেই প্রথমেই মনে আসে চলচ্চিত্রের সেই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের কথা, যাঁর হাত ধরে চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রেখেছিল বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র। আগেও বাংলা চলচ্চিত্র ছিল— নির্বাক স্টিল ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে তা বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে টকিজ-মুভিতেও পর্যবসিত হয়েছিল। কিন্তু তা যেন প্রকৃষ্ট চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার জন্য কোনও সোনার কাঠির অপেক্ষায় ছিল।
পঞ্চাশের দশকে বাংলা সিনেমা বিষয়ে অতৃপ্ত একদল তরুণ নানা বিদেশি সিনেমা দেখে ও বইপত্র পড়ে নিজেদের বৌদ্ধিক চাহিদা মেটাতেন। তাঁরা একত্রিত হয়ে ১৯৪৭-এর ৫ অক্টোবর গঠন করেন ভারতের দ্বিতীয় ফিল্ম সোসাইটি ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। এই সোসাইটির মাধ্যমে ভারতে প্রথম ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের জন্ম হয়। তার ফলে ভারতে বসে শুধু আরও উন্নতমানের বিদেশি ছবি দেখার সুযোগই ঘটল না, ভারতীয় চলচ্চিত্রক্ষেত্রে উঠে আসেন একাধিক প্রতিভাবান আন্তর্জাতিক মানের পরিচালক, কলাকুশলী, মনোজ্ঞ ফিল্ম সমালোচক এবং শিক্ষিত সিনেমাপ্রেমী দর্শক। বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার নবজন্ম ঘটে এঁদের হাতে। সত্যজিৎ রায়, বংশীচন্দ্র গুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, নিমাই ঘোষ এবং আরও কিছুদিন পরে ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনরাও এই ভাবধারার শরিক হন।
১৯৪৯-৫০ সালে বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়া ‘দ্য রিভার’ ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এলে শুটিং দেখতে নিয়মিত হাজির হতেন দুই বন্ধু— সত্যজিৎ রায় এবং বংশীচন্দ্র গুপ্ত। রেনোয়ার সঙ্গে সিনেমা তৈরির নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের আলোচনাও হত। ইতিমধ্যে ১৯৫০ সালে সত্যজিৎ রায়ের কর্মক্ষেত্র বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ডি জে কিমার’ তাঁকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইংল্যান্ডে থাকার সময় সত্যজিৎ ইউরোপের বিখ্যাত সব সিনেমা দেখার সুযোগ পান এবং চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়। ইতালিয় পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকা-র নব্য বাস্তববাদী ছবি (neorealist drama) ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ (ইতালিয় ‘Ladri di biciclette’) দেখেই সত্যজিৎ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবেন।
এমন সিদ্ধান্ত নিলেও তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের তৎকালীন অবস্থা তথা সমস্যা ও ত্রুটি সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তিনি তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘Our Films, Their Films’-এর ‘What is wrong with Indian films’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “What Indian Cinema needs today is not more gloss, but more imagination, more integrity and more intelligent appreciation of the limitations of the medium. … … … Our cinema needs above everything else a style, an idiom, a sort of iconography of cinema, which would be uniquely and recognizably Indian.”
অর্থাৎ সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভারতীয় সিনেমার প্রয়োজন ছিল ভারতীয়ত্বের। কিন্তু সেই ভারতীয়ত্ব আনয়ন মুখের কথা ছিল না, তা অপেক্ষায় ছিল মিডাস টাচের; যে স্পর্শ নিয়ে এসেছিলেন চলচ্চিত্রবিদ্যার মনোযোগী ছাত্র এবং একাধারে সাধক-চলচ্চিত্রবেত্তা সত্যজিৎ রায়।
এই একাধারে শিক্ষানবীশ এবং শিক্ষক হওয়ার বিষয়ে আমবাঙালির একটু সমস্যা রয়েছে। বাংলার পলল মৃত্তিকায় লালিত-পালিত-বর্ধিত বাঙালি প্রকৃতিগতভাবে একটু নরম-সরম-লাজুক-ভীরু-অলস। কোনও বিষয়ে কঠোর অনুশীলন তার ঠিক ধাতে সয় না। কোনও লক্ষ্যের পিছনে কায়মনোবাক্যে পশ্চাদ্ধাবন তার যেন ঠিক পোষায় না; সে আধুনিক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষ তাঁর ঋষিপ্রতিম মন্দ্র-উচ্চারণে যতই শোনান না কেন— উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত…। স্বোপার্জনের থেকে বাঙালির অনেক বেশি পছন্দ পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। এ হল গড়পড়তা বাঙালির স্বভাবধর্ম। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান-শ্রীচৈতন্যদেব-রাজা রামমোহন রায়-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-মাইকেল মধুসূদন দত্ত-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-স্বামী বিবেকানন্দ-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু-শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অলোকসামান্য বাঙালি তথা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরা অবশ্যই অন্য ধাতুতে গড়া। সত্যজিৎও ছিলেন তেমনই শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব, যিনি একাধারে বাঙালিয়ানায় নিমজ্জিত চিরন্তন বাঙালি আবার স্বভাবধর্ম-মানসগঠনে শাশ্বত আন্তর্জাতিক। তিনি কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। চলচ্চিত্রের মতো তখনও পর্যন্ত একটা নতুন মাধ্যমকে বাঙালি তথা ভারতীয় মনোজগতে গেঁথে দেওয়ার জন্য তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁর অনুশীলনলব্ধ-শিক্ষাকে। কিন্তু তিনি অনুকরণে অনাগ্রহী থেকেছেন, নিছক অনুসরণেও ছিল তাঁর অনীহা। তিনি তাঁর অর্জিত জ্ঞান-বিদ্যাকে নিজস্ব বোধসঞ্জাত করে প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত করেছেন। তারপর তার সঙ্গে বাঙালিয়ানা তথা ভারতীয় উপকরণ মিশিয়ে সুচারুরূপে পরিবেশন করেছেন। আর সেখানে তিনি ভরপুর প্রয়োগ করেছেন অনন্য নিজস্বতা।
বাংলা সাহিত্যে গল্প ছিল। তর্কযোগ্যভাবে যার কিছুকে ছোটগল্প হিসাবে আখ্যায়িতও করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক স্রষ্টা; চলচ্চিত্রক্ষেত্রে সত্যজিতের ভূমিকাও অনেকটা তেমনই। সত্যজিৎ রায় ছিলেন প্রথম সার্থক বাঙালি তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক। এ নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশই নেই। তর্কের খাতিরে কেউ যদি ভিন্নমত পোষণ করেন, তা হলে তাঁর যুক্তি অবশ্যই শুনতে হবে; কিন্তু ঠিকমতো প্রতিযুক্তি অবতারণা করতে পারলে অন্তিম প্রস্তাবে তিনি অবশ্যই স্বীকার করবেন সত্যজিতের ভূমিকা এবং অবস্থানকে; এটুকু আশা করা যেতেই পারে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পকে শুধু সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি, তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করেছিলেন, চলচ্চিত্রক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ও ঠিক সেটাই করেছিলেন।
১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট ‘পথের পাঁচালি’র মুক্তি বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক মাইল ফলক। ভারতীয় সিনেমার এই ম্যাগনাম ওপাস কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ শিরোপা নিয়ে পুরস্কৃত হয়। সত্যজিৎ রায় যে শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র দুনিয়ায় ‘মানবিক দলিল’ পেশ করেছিলেন তা-ই নয়, বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করে তাকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রক্ষেত্রে শ্লাঘার বিষয় করে তুলেছিলেন। সত্যজিতের চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে কান-ভেনিস-বার্লিন বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ইউরোপের কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসাবে। সত্যজিতের চলচ্চিত্রের সুবাদে এই স্থাননামগুলি বাঙালির কাছে অন্য ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিভাত হল। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র, দুনিয়াসেরা চলচ্চিত্র উৎসব তথা প্রতিযোগিতা, বিদেশি পরিচালকদের চলচ্চিত্র-নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র-ভাবনা সম্পর্কে বাঙালি প্রথম ব্যাপক অর্থে ওয়াকিবহাল হল সত্যজিতের মাধ্যমেই। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে একই সারিতে স্থান লাভ করে তিনি বাঙালি তথা ভারতীয় পরিচালকদের প্রাথমিক জড়তা এবং হীনমন্যতা কাটাতে বিশেষভাবে সহায়ক হলেন।
সত্যজিৎ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রেই যে ইয়ার্ড-স্টিক এবং বেঞ্চমার্ক নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, তাঁর নির্মিত শেষ চলচ্চিত্র পর্যন্ত তা মেনে চলতে খুব সচেতনভাবে প্রয়াসী ছিলেন। সাফল্য এবং জনপ্রিয়তায় ভেসে গিয়ে তিনি কখনও তাঁর নিজের ইয়ার্ড-স্টিককে নামিয়ে আনেননি। সত্যজিৎকৃত সমস্ত চলচ্চিত্রই সমমানের বা কালোত্তীর্ণ কি না, সে স্বতন্ত্র প্রশ্ন। কিন্তু তিনি যে কোথাও অসচেতনভাবেও বেনোজল ঢুকতে দেননি, তা নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশ নেই।
সত্যজিৎ রায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “… একটা ক্লাসিক রচনাকে দর্শকের সামনে ফিল্ম দিয়ে তুলে ধরাটা একটা বড় কর্তব্য,”। সেই কর্তব্যসাধনের তাগিদেই ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ বানিয়েছিলেন ‘ঘরে-বাইরে’। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস থেকে ছবি করার কথা তিনি ভেবে আসছিলেন ‘পথের পাঁচালি’ করারও আগে থেকে। এমনকি চল্লিশের দশকে ছবিটির একটি চিত্রনাট্যও রচনা করে ফেলেছিলেন। সত্যজিৎকৃত ‘ঘরে-বাইরে’ স্টেজ থিয়েটারের মতো সংলাপের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় এবং নিখিলেশের চোখ দিয়ে বর্ণিত দৃশ্যপটের মধ্যে বারবার রবীন্দ্রনাথের ছায়া পরিলক্ষিত হওয়ায় সিনেমার ম্যাজিক যেন কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে হয়।
নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক হেনরিক ইবসেনের ‘An Enemy of the People’ নাটককে সিনেমার ছাঁচে ঢেলে ‘গণশত্রু’ নির্মাণের পিছনেও ছিল উদ্দেশ্যমুখীনতা। শেষ জীবনে সত্যজিৎ ক্রমশ সমাজের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে ক্ষুণ্ণ হয়ে উঠছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা, অস্থির ও নিষ্ফলা রাজনীতি এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি তাঁকে হতাশ করে তুলেছিল। ধর্ম আর বিজ্ঞানের চিরাচরিত দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশের ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সমান্তরাল বৈপরীত্যের লেখচিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সত্যজিৎ তাঁর ক্ষোভ এবং হতাশাকেও ব্যক্ত করে ‘গণশত্রু’র মাধ্যমে ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এক সপাট চপেটাঘাত করতে চেয়েছিলেন।
সত্যজিৎ তাঁর নিজের যে ছবিটিকে মনে করেছিলেন ম্যাগনাম ওপাস, সেই ‘শাখা প্রশাখা’ ‘গণশত্রু’র তুলনায় উন্নততর ছবি হলেও এটিকে দীর্ঘদিনের অসুস্থতাশেষে ফিরে আসার পর তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের পুনর্প্রচেষ্টা হিসেবে দেখাই শ্রেয়। প্রজন্মান্তরে মূল্যবোধের অবনমন, সততার স্থলে অসততার সাম্রাজ্যবিস্তার, সমাজে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ পরিস্ফুট করে তোলাতেই ‘শাখা প্রশাখা’ যেন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
নিজের লেখা ছোটগল্প ‘অতিথি’ অবলম্বনে সত্যজিৎ ১৯৯১ সালে নির্মাণ করেন তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’। সেলুলয়েডের জাদুকর সত্যজিৎ জীবন সায়াহ্নে এসে এই হালকা মেজাজের ছবিতে কতটা চলচ্চিত্রমান রক্ষা করতে পেরেছেন, সে প্রশ্ন এসেই যায়। আসলে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর নির্মিত শেষ তিনটে ছবি আউটডোর লোকেশনের কাব্যময়তা থেকে বঞ্চিত হয়ে সংলাপ নির্ভর অভ্যন্তরীণ মঞ্চের থিয়েটারসুলভ হয়ে উঠেছে, সিনেমার জাদুকরী ছবিগুলোকে ঠিক যেন ছুঁয়ে যেতে পারেনি। তা সত্ত্বেও শেষ বিচারে বলা যায় ‘গণশত্রু’ বা ‘শাখা প্রশাখা’— শিল্পমানে সমুজ্জ্বল না হলেও হতে পারে, কিন্তু সেখানে তাঁর সমাজের প্রতি কষাঘাত লক্ষণীয়।
সচেতনভাবে না হলেও অবচেতনে লঘুকরণে আগ্রহী বাঙালি তাঁর কাছ থেকে এই শিক্ষা নেবে কি না সেটা বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে, তবে কতিপয় বাঙালি সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয়ই এই শিক্ষা লাভ করেছেন যে, নিজের মননশীল সৃষ্টিকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ধরে রাখতে গেলে পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই এবং মেধা-মস্তিষ্কে জং ধরতে দেওয়া কখনও কাজের কথা নয়। নতুন কিছু সৃষ্টির প্রণোদনা এবং নিজেকে কখনও পুনরাবৃত্ত করতে না-চাওয়ার সদর্থক প্রচেষ্টা একজন মানুষকে শেষদিন পর্যন্ত কেমন সৃজনশীল রাখতে পারে সত্যজিৎ রায় তার আদর্শ উদাহরণ। আর সে-কারণেই টিভির পর্দায় চোখ রেখে অস্কার অ্যাওয়ার্ড সেরেমনি দেখা বাঙালি তাঁর মাধ্যমে এই বিশ্বাসে উত্তীর্ণ হতে পারে যে, স্বীকৃতির জন্য বিদেশে যাওয়াটা অবশ্যমান্য নয়, সর্বশ্রেষ্ঠ বিদেশি তথা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ঘরে বসেই পাওয়া সম্ভব। এমনকি রোগশয্যায় শায়িত ব্যক্তিকেও সেই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানকে ছুটে আসতে হয়, কারণ তার মনে হয় তাঁকে গৌরবান্বিত করতে পারাটা তার নিজের গৌরব।
সাহিত্যিক সত্যজিতের কাছ থেকে বাঙালি কী পেল, তাতে যাওয়ার আগে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান ‘নন্দন’-এ ঘুরে আসা যেতে পারে। যে শৈল্পিক সৌকর্যসমন্বিত উৎকর্ষে ‘নন্দন’ নামটি সেখানে উৎকীর্ণ আছে, সত্যজিৎ রায় না-থাকলে বাঙালি তা অবলোকন করা থেকে বঞ্চিত হত। শিল্পী সত্যজিৎ, প্রধানত অলংকরণ শিল্পী সত্যজিৎ, তাঁর যে নিজস্ব ঘরানা নির্মাণ করেছিলেন, তা চোখ চেয়ে দেখার মতো। সেগুলো দেখার পর বাঙালি বলে উঠতে পারে— ‘দেখোরে নয়ন মেলে’ রূপের বাহার। বইয়ের প্রচ্ছদ, গল্প-কাহিনির অলংকরণ, নিজের চলচ্চিত্রের নামাঙ্কণ এবং নামকরণ-পোস্টারের বর্ণবিন্যাসে তিনি যে স্বকীয়তা আমদানি করেছিলেন, তা যে সাধারণ্যের ভালো লাগার বাইরেও অনেক বাঙালি শিল্পীমানসকে প্রভাবিত এবং প্রাণিত করেছিল বা করে চলেছে, তা অনস্বীকার্য। চার-চারটি নতুন ফন্ট— রে রোমান, বিজার, ডাফনিস ও হলিডে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে বাংলা তথা ভারতের ক্যালিগ্রাফির অদ্ভুত সুন্দর জগতটিকে সবার সামনে নিয়ে আসেন সত্যজিৎ। আসলে ক্যালিগ্রাফি এবং মুদ্রণ শিল্পের ক্ষেত্রে বাবা সুকুমার রায় এবং ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ছিল শান্তিনিকেতনের নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষা।
আগেই আমরা বলেছি বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত সত্যজিতের শিল্প-সাহিত্য-খাজানার কথা। পূর্বপুরুষের ধনসম্পত্তি— সে তো অনেকেই লাভ করে থাকে, কিন্তু তাকে আরও ‘রতনের রাজি’ দিয়ে ভরিয়ে তুলতে আর ক’জন পারে!
সাহিত্যিক হওয়ার মনোবাসনা সেভাবে না-থাকলেও প্রধানত প্রয়োজনের তাগিদে সত্যজিতের সাহিত্যক্ষেত্রে অবতরণ। চিত্রনাট্য লিখতে লিখতেই সম্ভবত তাঁর বাংলা সাহিত্য রচনার দিকে ঝোঁক। বাংলার বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা নিয়ে চিত্রনাট্য করা এবং তার জন্য প্রাপ্ত সাফল্য নিঃসন্দেহে তাঁকে প্রত্যয়ী করে তুলেছিল। আর ছিল শিশু সাহিত্যে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার।
‘সন্দেশ’ পত্রিকার দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে সেখানে প্রকাশোপযোগী সাহিত্য রচনা করতেই হত। আর সেই সূত্রেই মূলত তাঁর সাহিত্যিক হয়ে ওঠা। ভাগ্যিস তিনি হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন! বাঙালিকে তিনি যে রসাস্বাদনের সুযোগ করে দিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যরসে বুঁদ হয়ে পড়ল। এবং যতদিন বাংলাভাষায় সাহিত্য পঠিত হবে, সেই একইরকমভাবে যে বাঙালি সত্যজিৎ-সাহিত্যে নিমজ্জিত থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিদেশভ্রমণের সুযোগ না-পাওয়া মানচিত্র-বিমুখ বাঙালিও সত্যজিতের শঙ্কুর হাত ধরে পৃথিবীভ্রমণ করে আসতে পারে। এমনকি সেখানে উল্লেখিত চরিত্রগুলির নাম তার মাথায় এমন গেঁথে যায় যে, পরবর্তীতে কোন বিদেশি নাম শুনলেই সে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করে নিতে পারে যে, সেই ব্যক্তি কোথাকার। আর ফেলুদা তো ভ্রমণপিপাসু বাঙালির মধ্যে বেড়ানোর স্পৃহা আরও বাড়িয়ে তোলেন। ফেলুদার হাত ধরে গোয়েন্দাগিরি তো উপরি পাওনা! রহস্য সমাধানে ফেলুদা-তোপসে-জটায়ু— এই ত্রয়ীর হাত ধরে বাঙালির কত ভ্রমণ যে সারা হয়ে যায়! শুধু দার্জিলিং-লখনৌ-সিকিম-রাজস্থান-সিমলা-ঔরঙ্গাবাদ-বেনারস-মুম্বাই নয়, ভারতের বাইরে হংকং-লন্ডন-কাঠমান্ডুতেও পৌঁছে যায় বাঙালি। প্রাথমিক উদ্দেশ্য যদিও রহস্যের বিস্তার, তবুও প্রতিটি জায়গাকে পর্যটনস্থল হিসেবে পাঠক-দর্শকের চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার অদ্ভুত এক দায়িত্বও যেন সত্যজিৎ এখানে পালন করেছেন। ফেলুদার প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ যে দার্জিলিংয়ে, সেখানেই তিনি আবার ফিরে এসেছেন ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এ। হিমালয়ের পাদদেশে ছবির মত সুন্দর দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত কেভেনটার্সে ত্রয়ীর হট চকলেট পান অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে বিস্ময়চকিত দৃষ্টিপাতের সঙ্গে জটায়ুর কবিতা আবৃত্তি ভোলার নয়।
নবাবদের শহর লখনৌ ‘বাদশাহী আংটি’ এবং ‘শকুন্তলার কন্ঠহার’-এর সুবাদে বড়া ইমামবড়া, রেসিডেন্সি এবং ভুলভুলাইয়াসহ উঠে এসেছে। ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’-এ সত্যজিৎ বাঙালিকে এনেছেন সিকিমে। রুমটেক মনাস্ট্রির প্রাচীরগাত্রে খোদিত বৌদ্ধ দেবতা যমান্তক, সেখানকার বিখ্যাত লামা নৃত্য, বর্ষার মরশুমে জোঁকের আতঙ্ক যেন জীবন্ত বলে প্রতিভাত হয়। ‘সোনার কেল্লা’র সন্ধানে রাজস্থানের বিকানের, কিষাণগড় এবং জয়সলমীরের রাজকীয় দুর্গের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায় বাঙালি। সে এখন রাজস্থান ভ্রমণের পরিকল্পনা করে জয়সলমীরকে কেন্দ্রে রেখে। রাস্তায় ভারতীয় দেখতে না পেলে তোপসের যে জায়গাকে ভারত বলেই মনে হত না, অথবা মন্ত্রমুগ্ধ জটায়ু ফেলুদাকে বারংবার যে জায়গা সম্পর্কে বলেছেন ‘সুইজারল্যান্ড’, সেই শৈলশহর সিমলায় ত্রয়ী বাঙালিকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন ‘বাক্স রহস্য’ সমাধানে। ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ বাঙালির প্রিয় বেনারস বা কাশির গলিঘুঁজি এবং গঙ্গার ঘাটকে নতুন করে চিনিয়েছে। বিশেষ করে দশাশ্বমেধ ঘাটকে বাঙালির পক্ষে ভোলা বোধহয় আর সম্ভব নয়। ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র রহস্য ঘনীভূত হয়েছে ঔরঙ্গাবাদের ইলোরা গুহায়। সেখানে গল্পের হাত ধরে বাঙালি ঘুরে আসে তাজমহলের সমতুল বিবি কা মকবড়া থেকে। জটায়ুর বই থেকে নির্মিত ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ চলচ্চিত্রের শুটিং দর্শন করতে স্বপ্নপুরী মুম্বাইয়ে হাজির হন তিন মূর্তি। কিন্তু সেখানে রহস্য সমাধানের ফাঁকে তাঁরা বাঙালিকে মেরিন ড্রাইভ, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া এবং তাজমহল প্যালেস হোটেলেও নিয়ে যান।
‘টিনটোরেটোর যীশু’তে হংকংয়ের রাত্রিকালীন নিয়ন আলোর রোশনাই, ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডু’তে দরবার স্কোয়ার, কালভৈরব মন্দির, স্বয়ম্ভুনাথ স্তূপ, পশুপতিনাথ মন্দির এবং ‘লন্ডনে ফেলুদা’তে টিউব রেল, অক্সফোর্ড ষ্ট্রীট, বেকার স্ট্রিট বাঙালির দৃষ্টিগোচর হয়।
আসলে সত্যজিৎ জানতেন যে কিশোরোপযোগী ভ্রমণকাহিনিতে ক্রাইম ঢোকাতে হয় খুব সতর্কতার সঙ্গে। সেজন্য ভ্রমণকাহিনির স্বাদ দিয়ে তিনি লেখাগুলিকে আরও স্বাদু করে তুলেছিলেন।
আর সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর অনবদ্য নির্মাণ গল্প! প্রায় একশো গল্পে তিনি যে-সমমান ধরে রাখতে পেরেছেন তা বিস্ময়কর। প্রতিটা গল্পে নিজের সিগনেচার-স্টাইল বজায় রেখে গল্পগুলোকে কালোত্তীর্ণ করে তোলা তাঁর মতো কোনও মহান সাহিত্যস্রষ্টার পক্ষেই বোধহয় সম্ভব। সত্যজিৎ রায়ের লেখা একানব্বইটি ছোটগল্পের মধ্যে তারিণীখুড়ো, বিপিন চৌধুরী (‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’), রতনবাবু (‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’), প্রোফেসর হিজিবিজবিজ (‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’), বাতিকবাবু (‘বাতিকবাবু’), হারুনদা (‘ফটিকচাঁদ’), অসমঞ্জবাবু (‘অসমঞ্জবাবুর কুকুর’), পুলিন রায় (‘অতিথি’), নিকুঞ্জবাবু (‘অনুকূল’), শঙ্করবাবু (‘অভিরাম’), শশাঙ্ক (‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’) এবং আরও অনেক নিঃসঙ্গ একা মানুষের দেখা মেলে, যারা কেউ থাকেন বিশ্বস্ত চাকরের সাহচর্যে, সে রোবট চাকর হলেও, আবার কেউবা নিঃসঙ্গতা তাড়াতে পোষেন পাখি, কুকুর। ছোটগল্পগুলির অধিকাংশ চরিত্র পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, নয়তো অবিবাহিত বাঙালি। এই অবিবাহিত পুরুষের জীবনে অবশ্য একটি বা দু’টি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরও সন্ধান মেলে। ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পে সে বন্ধু গ্রহান্তরের জীব অ্যাং হলেও কোনও অসুবিধা নেই। ‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট’, ‘গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো’, ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’তে বন্ধুত্বের আড়ালে কেমন নিজের কোলে ঝোল টেনে অন্যের কৃতিত্বের দাবিদার হওয়া যায় তার ছবি এঁকেছেন সত্যজিৎ। তাঁর গল্পে মনোজগতের বিভিন্ন রূপ ধরা পড়েছে। ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘খগম’, ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’, ‘পিকুর ডায়রি’ মানুষের সচেতন এবং অবচেতন মনের জলছবি হয়ে উঠে এসেছে। তাঁর চব্বিশটি ছোটগল্পে সাক্ষাৎ মেলে ভূতের। এই ভূতেদের অবশ্য নেই কোনও ভুতুড়ে বদখেয়াল। এরা কখনও কখনও মানুষের চেয়েও বেশি মানবিক, কোথাও ভারি নিঃসঙ্গ আবার কোনও ভূত ভোগে হীনমন্যতায়। ‘অনাথবাবুর ভয়’, ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’, ‘বাদুড় বিভীষিকা’, ‘নীল আতঙ্ক’ গল্পে আবার ভৌতিক অভিজ্ঞতা অন্য রকমের। সত্যজিতের গল্পে কৈশোর কাল, বন্ধুত্ব, বিশ্বাসের অমর্যাদা, তুচ্ছকে মর্যাদা দেওয়া, স্বীকারোক্তি, ভূত বা সায়েন্স ফিকশন— কতই না বৈচিত্র্যের সমারোহ!
পল্লবগ্রাহী বাঙালি-জীবনে আর একটি বিষয়ও স্মরণে রাখা প্রয়োজন। তা হল তাঁর একাধিক ভাষাজ্ঞানের অগাধ গভীরতা এবং সেগুলির প্রয়োগের ক্ষেত্রে সচেতন সতর্কতা। তিনি যখন বাংলা বলেছেন-লিখেছেন, মনে হয়েছে তাঁর মনোজগতে বাংলা ছাড়া আর অন্য কোনও দ্বিতীয় ভাষার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। আবার যখন তিনি ইংরেজি বলেছেন-লিখেছেন, তাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি বলে বিভ্রম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই যে ভারসাম্য রক্ষা, এটা বাঙালি তাঁর কাছ থেকে শিখতে পারলে তার গাম্ভীর্য এবং জাতি-কৌলীন্য বাড়বে বই কমবে না! একই ব্যাপার লক্ষ করা যায় তাঁর দুই ভাষাতে লিখিত প্রবন্ধগুলি পড়লে। বিশেষ করে ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ সহজ সরল বাংলায় রচিত একটি অসাধারণ বই। চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল পদ্ধতি এবং তাঁর নির্মিত ছবির সমালোচনার প্রত্যুত্তর সম্বলিত সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলনগ্রন্থ এই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’। এখানে তাঁর কলম ধরার মূল কারণ মূলত পাঠক-দর্শককে চলচ্চিত্র বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষিত করা। বইটির সূচিপত্রে চোখ রাখলেই তা প্রতিভাত হয়। ‘চলচ্চিত্রের ভাষা: সেকাল ও একাল’, ‘চলচ্চিত্র-রচনা: আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’, ‘বাংলার চলচ্চিত্রের আর্টের দিক’, ‘চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে’— এবম্বিধ প্রবন্ধে স্বচ্ছ ও সাবলীল চিন্তা ও বর্ণনার মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র শিল্পকে সাধারণ বাঙালি চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে তুলে ধরেছেন। চলচ্চিত্রকে ভালবাসতে এবং বুঝতে চাওয়া বাঙালির কাছে গ্রন্থটি শয্যাসঙ্গী হয়ে থাকার যোগ্য।
সুতরাং প্রকৃত প্রস্তাবে এটা অনস্বীকার্য যে, সত্যজিৎ রায় না-থাকলে বাঙালি আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র, সাবলীল-নয়নলোভন অঙ্কন, পরমরমণীয় সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হত। সর্বোপরি তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের স্পর্শ না-পেলে বাঙালি শিল্পীমানস এতটা ধনী হয়ে উঠতেও পারত না।
বাঙালি সত্যজিৎ বাঙালিয়ানার চর্চা করেই হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক। তিনি বাঙালি না-হলেও তাঁর খুব একটা কিছু যেত-আসত বলে মনে হয় না। অবশ্য বাংলা তাঁর জন্ম-কর্মস্থল না-হলে বাঙালি অনেকটাই দরিদ্র হয়ে পড়ত। কারণ বাংলা-বাঙালিকে জগতসভায় কে এত চেনাত, না-চেনালে সত্যজিৎ! কিন্তু একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকেই যায়— সত্যজিৎ রায়কে পাওয়া সত্ত্বেও বাঙালি কি তাঁকে গ্রহণ করে জীবনবেদ করে নিতে পেরেছে, না, তাঁকে সম্ভ্রমের দূরত্বে রেখে তাঁর মেধা এবং প্রতিভার আলোকটুকু পেয়েই নিজেকে ধন্য মনে করেছে?
তাঁর জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে শেখার প্রচুর সুযোগ আমাদের। আমরা জানি, বিভিন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক যেমন ঋতুপর্ণ ঘোষ, সৃজিত মুখোপাধায় বা অনীক দত্ত, তাঁর প্রতি ঋণ স্বীকার করেছেন বিভিন্ন ভাবে। তবুও —–