শ্যাম বেনেগাল খুঁজেছিলেন ভারতবর্ষকে
কোঙ্কনি ছেলেটি হায়দ্রাবাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন সাঁতারের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে কলকাতায় মুক্তি পাওয়া ‘পথের পাঁচালি ‘ ছবিটির কথা বলেন এবং তিনি একবর্ণ বাংলা ভাষা না বুঝেও কমসে কম বারোবার ছবিটি দেখেন এই শহরের কোনো এক সিনেমা হলে। এসেছিলেন সাঁতারু হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে, সত্যজিৎ রায়ের ছবি কম্পাস হয়ে তাঁকে নিয়ে যায় অচেনা গভীর সমুদ্রে। সেই ছেলেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেনে আনেন ভারতীয় ছবির উজ্জ্বল মণিমুক্তো। সেইসব সম্পদ জ্বলজ্বল করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মানচিত্রে।
এখন অনেক পরিচালক ভাবেন, অনেক তো হল হেলিকপ্টার থেকে নায়কের অবতরণ, পৌরুষ-গন্ধে কিংবা দেশভক্তিতে ঝাঁঝালো একই ফর্মুলা কিংবা প্রেমের তিনটি কোণের সন্ধান, বরং ফেরা যাক খানিকটা মাটির দিকে। ছোটো শহরের গল্প, প্রান্তরের মানুষের জীবন নিয়ে বাণিজ্যিক ছবির মোড়কে তাঁরা খানিক ছুঁতে চান সমান্তরাল ছবিকে। মূলধারার ছবির পরিচালকরা হতে পারেন না ততখানি নির্ভীক, যতখানি হতে পেরেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। এবং পরবর্তীকালে, আদুর গোপালকৃষ্ণন, গোবিন্দ নিহালনি, কেতন মেহতা, সাই পরাঞ্জপে, সৈয়দ মির্জা প্রমুখরা। বিশেষত বেনেগাল তাঁর কাজ দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন ফোলানো ফাঁপানো ‘ইন্ডিয়া’ ঠিক কোথায় কোথায় আসল ভারতবর্ষের থেকে আলাদা। কেন বলা হয় না তেমনভাবে যে নিম্নবর্ণের মানুষ নিয়ত নির্যাতিত হয় সামন্ততন্ত্র, উচ্চবর্ণ, সুবিধাভোগী মানুষের দ্বারা? পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো দমিয়ে রাখে নারীর ক্ষমতায়ন এবং চেতনার উন্মেষ। সত্যজিৎ-পরবর্তী যুগে বেনেগাল নব্য ধারার ছবিকে যেভাবে লালন করলেন, যতই ভেবেছি শ্রদ্ধায় নত হয়েছি।
সত্তরের দশক অন্যদিকে দেখছে পর্দায় রাগী যুবকের উত্থান। তিনি রাগছেন, প্রতিবাদ করছেন, শত্রুকে বিনাশ করতে চাইছেন। পেলব প্রেমের ছবি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে মূলধারার চিত্রপটও। কিন্তু সে বদল ব্যক্তিতান্ত্রিক। যদিও পঞ্চাশ ষাটের দশকে ‘দো বিঘা জমিন’ , ‘ বন্দিনী ‘, ‘শ্রী ৪২০ ‘, ‘নয়া দৌর’ , ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘জাগতে রহো’, ‘পিয়াসা’ প্রভৃতি ছবিগুলোতে এসেছে সাধারণ মানুষের বঞ্চনা, প্রতিবাদ, এবং শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে অপ্রতিরোধ্য জীবনকাহিনি। কিন্তু শ্যাম চেয়েছেন একেবারে বাস্তবোচিত নির্মাণ, সেখানে সম্পর্কের বুনন কিংবা প্রেমের গান ফিকে করে দিচ্ছে না আসল যন্ত্রণা, ভুলিয়ে দিচ্ছে না সমস্যার তীব্রতা। শ্যাম বেনেগাল মনে করতেন, ভারতবর্ষের আত্মাকে জানতে হলে এই দেশের গ্রামজীবনকে জানতেই হবে। এই নব্য ধারায় ‘অঙ্কুর’ হয়ে ফোটে নিচু তলার মানুষের রাগ, অত্যাচারিত হতে হতে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প ‘নিশান্ত’ ছবিতে পূর্ণতা পায়। ব্যক্তি-সংগ্রাম সামগ্রিক আদল পায়। ব্যক্তি ভিলেন বদলে যায়। সিস্টেম কতখানি ত্রুটিপূর্ণ, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কতখানি ক্ষতিকর, সুনিপুণ দক্ষতায় তিনি সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তোলেন, যেভাবে ফুটিয়ে তুলতেন প্রেমচাঁদ, ফণীশ্বরনাথ রেণু, মাণিক বন্দোপাধ্যায় তাঁদের সাহিত্যসৃজনে। ‘নিশান্ত’ ছবিতে একটা গ্রাম বিদ্রোহ করে সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারী পরিবারের বিরুদ্ধে। আরো দু চার কদম এগিয়ে শ্যাম নির্মাণ করলেন ‘মন্থন’, যেখানে ভারতের এক সাম্যবাদী ছবি ফুটে উঠল, আত্মনির্ভর হওয়ার দিশা প্রতিভাত হল। দুধ-বিক্রেতা মানুষগুলো নিজেদের মূঢ়তা, দৈন্য দূর করার পথে চলতে চলতে গড়ে তুলল সমবায়, নিয়ে এল সফেদ বিপ্লব। এই ছবিটি নির্মাণ করার সময় গ্রামের মানুষ ২ টাকা করে চাঁদা তুলে দিয়েছিল। এটি সত্যিকারের ক্রাউড ফান্ডেড ছবির দিশা দেখায় সমগ্র দেশকে। পরবর্তীকালে যখন আমি কেতন মেহতার ‘মির্চ মশালা’ দেখেছি, আমার মনে হয়েছে আঙ্গিকে, নির্মাণে এ যেন ‘মন্থন’ ছবির পরের ধাপ। স্মিতা পাটিল দুটি ছবিতেই অসামান্য। মূলধারার ছবিতে রাগী যুবকের উত্থান হলেও এমন নারী চরিত্র আসেনি তেমন করে। ভূমিকা, মান্ডি, মাম্মো, সরদারি বেগম, জুবেইদা প্রভৃতি ছবিতে নারীচরিত্রকে শ্যাম শ্রেণী, ধর্ম, লিঙ্গবৈষম্যের প্রতিবেশে এমনভাবে নির্মাণ করলেন যে উঠে এল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মূল প্রশ্নটি – হিন্দু কিংবা মুসলমান নারী পুরুষতন্ত্রের যে শিকল গয়নার মতন পরে নেয়, তাতে কীভাবে এবং কতখানি আটকা পড়ে তাদের সৃষ্টিশীল জীবন ও মন? কোন পথে যায় তাদের মুক্তি ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আবহ? প্রান্তিক এবং সংখ্যালঘু নারীদের জীবন, যাপন, স্বাধীনতা ও শিকড়ের সন্ধান ফুরোয় না।
দেশ, রাজনীতি, ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস জড়িয়ে থাকে তাঁর নির্মাণে। রাষ্ট্রের সমালোচনা করেন তিনি নির্দ্বিধায়। তাঁর ছবির আঙ্গিক, বিষয়, নির্মাণ বদলে গেছে সময়ের সঙ্গে, কিন্তু তিনি সমঝোতা করেননি মূল্যবোধ এবং আদর্শের সঙ্গে। শ্যাম যখন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়ের, তখন আমরা মোহিত হয়ে শুনছি সিনেমা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে নির্মাতার নৈতিকতা, ভারতবর্ষের মানুষ, তাদের অবস্থান এবং সময় কিভাবে জুড়ে যায় সৎ শিল্পের সঙ্গে।
“The whole idea was that filmmaking is not just about moving pictures – people singing and dancing and speaking dialogues. It’s an art form of its own. And Satyajit Ray not only made the audience and filmmakers conscious of the fact that cinema is an art, but also the government.” বলেছিলেন শ্যাম বেনেগাল।
এই তো ২০১৬ সালের ঘটনা। তখন সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন-এর কাজগুলি অর্থাৎ সেন্সরশিপের নিয়ম ও শর্তাবলী কার্যকরী করা এবং গোটা বিশ্বের ওই এই সংক্রান্ত সেরা কাজগুলি প্রণিধান করার জন্য শ্যাম বেনেগালের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির উদ্দেশ্য ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণে যথাযথ এবং পর্যাপ্ত স্বাধীনতা যেন বজায় থাকে, সেটা নিশ্চিত করা। কোনোরকম আপস না করেই শ্যাম বেনেগাল কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় তিন মাসের মধ্যে। কিন্তু রিপোর্ট অনুযায়ী কাজ আজও শুরু হয়নি।
শ্যাম বেনেগালের বাবা শ্রীধর বেনেগাল ছিলেন স্থির ছবির চিত্রগ্রাহক। বাবার দেওয়া ক্যামেরা দিয়েই কৈশোরে হায়দ্রাবাদে গরমের ছুটিতে শ্যাম তৈরি করে ফেলেছিলেন তাঁর প্রথম ছবি। পরিচালক ও অভিনেতা গুরু দত্ত ছিলেন তাঁর আত্মীয়। সুতরাং চলচ্চিত্র নিয়ে কৌতূহল এবং আগ্রহ ছিল তাঁর ছোটবেলা থেকেই। আর ছিল ইতিহাসের প্রতি ঝোঁক।
ইতিহাস ও ভারতবর্ষ নিয়ে তাঁর চিন্তা, মনন ও নির্মাণ মনে রাখবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। নেহরুর সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর আস্থা, ভারতের সংবিধানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রতিফলিত হয়েছিল কাজে। জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ কে তিনি পরম যত্নে গেঁথে ফেলেছিলেন ৫৩টি পর্বে, যার নাম ‘ভারত এক খোঁজ’। দূরদর্শনের সেই সিরিজ আজও জনপ্রিয়। সংবিধান তৈরির ইতিহাস নিয়ে শ্যাম তৈরি করলেন দশ পর্বের ‘সংবিধান’। হিস্ট্রি, ডিসকভারি এবং আজকের ওটিটি চ্যানেলগুলো আসার আগেই তিনি সিরিজের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিকৃত এবং ভুল ইতিহাস প্রচার করার যুগে তথ্যনির্ভর ইতিহাসে ভর করে তাঁর কাজগুলি ফিরে দেখার আশু প্রয়োজন আছে। নেহরুকে নিয়ে করেছিলেন তথ্যচিত্র। ‘দি মেকিং ওফ মহাত্মা’ তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। শেষ ছবি ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। আশা করি এক মহৎ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উন্মোচিত হবে যদি ছবিটি মুক্তি পায়। নেতাজিকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগটন হিরো’। ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তাঁর মতো করে কজন স্রষ্টাই বা দেখেছেন? ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ছিল ‘জুনুন’ ছবিটির প্রেক্ষাপট। আর সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তথ্যচিত্রটি ভাবী নিষ্ঠাবান পরিচালক এবং বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকের কাছে এক আকর চিত্র। ভারত সরকারের নির্দেশমতো তিনি এসেছিলেন কুড়ি মিনিটের তথ্যচিত্রের খসড়া নিয়ে। সেই ছবিটির দৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়ে হয় আড়াই ঘন্টা। নিজের পয়সা খরচ করে তিনি শেষ করেন তথ্যচিত্রটি। বহুল সমাদৃত হয় এই কাজ, দেশে এবং বিদেশে। শ্যাম বলতেন, “Films are divided into pre-Satyajit and post-Satyajit.”
শ্যাম বেনেগালের হাত ধরেই ভারতের একঝাঁক শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্ম হয়। শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাটিল, ওম পুরি, অমরিশ পুরি, গিরিশ কারনাড, কুলভূষণ খারবান্দা, অনন্ত নাগ প্রমুখ অভিনেতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মানচিত্রে চিরকালীন হয়ে ওঠেন। শশী কাপুর, রেখা, রাজ বব্বর প্রমুখ অভিনেতারা স্মরণীয় অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর ছবিতে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যাচ্ছে মহাভারতের নির্যাস আধারিত ‘কলযুগ’ ছবিটার কথা। পরবর্তী কালে রজিত কাপুর, রাজেশ্বরী সচদেব, মনোজ বাজপেয়ী, করিশ্মা কাপুর প্রমুখরা সুযোগ পেয়েছেন শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে কাজ করার।
শাবানা আজমি সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, প্রথমবার তিনি যখন দেশের বাইরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন, তখন কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে হিসেবে তিনি পথে যেতে যেতে ভাবছিলেন কী কেনাকাটা করবেন, কোথায় কী পাবেন। কিন্তু অবাক হয়ে গেলেন শ্যাম বেনেগালকে দেখে। শ্যাম অচেনা দেশের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিগ্যেস করছেন সেখানকার বাগানের কথা, ইতিহাসের কথা, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কথা। শাবানা বলছিলেন, মানুষ হিসেবেও তিনি এই পরিচালকের কাছে শিখেছেন। কেন তিনি অর্থবহ এই ধরণের ছবিতে অভিনয় করবেন, সেই ধারণাও গড়ে উঠেছিল তাঁর অঙ্কুর করার পর থেকেই। নাসিরউদ্দিন শাহ শ্যামকে পিতার সমান মনে করতেন, শ্যামের কাছে তাঁর অপরিসীম ঋণ।
শ্যাম বেনেগাল সমান্তরাল ছবিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর তুলনীয় কেউ নেই।পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রায় আঠারোটির মতো জাতীয় পুরস্কার তো বটেই, সঙ্গে বিদেশের সম্মান ও স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদের সমাদর ছিল তাঁর জীবন জুড়ে।
চিত্রঋণ: অন্তর্জাল