সুজনদা বললেন,"খুবই ভালো লাগছে, 'নিজের' সঙ্গে পরিচিত হয়ে"
জানুয়ারি, ২০১৮।
পাঁচ বছরের একটা লম্বা বিরতির পর আবার অভিনয় জগতে ফেরার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করেই ‘Eyewash’ বলে একটি প্রোডাকশন হাউস থেকে একটি ফোন আসে। অনির্বাণদাদের (অনির্বাণ মল্লিক) আমি বহু বছর ধরেই চিনতাম। গেলাম ওঁদের অফিসে। অনির্বাণদা, নন্দিনীদি এবং অনিন্দ্যদার সাথে একটা মিটিং ও হল। বুঝলাম ওঁরা একেনবাবু ও তাঁর দুই সাগরেদ, প্রমথ আর বাপ্পাদিত্যকে (বাপি নামেই সমধিক প্রচলিত) নিয়ে Hoichoi এর জন্য একটা নতুন ওয়েবসিরিজ করছেন। আমাকে ব্রিফিং করার সময় বলা হল, – যদি সত্যজিতের ‘জটায়ু’ ডিটেকটিভ হত আর ফেলুদা ও তোপসে তার সাগরেদ হত, তাহলে আমার চরিত্রটা ফেলুদার। ওঁরা আরো জানালেন যে বাপ্পাদিত্য ইংরেজির প্রফেসর, ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। সে এই একেনবাবুর কীর্তিকলাপ লিপিবদ্ধ করে।
আমি স্ক্রিপ্ট শোনার আগেই গল্পগুলো পড়তে চাইলাম। আসলে এর আগে বাংলা সাহিত্যে ‘একেন্দ্র সেন’ নামে যে কোন টিকটিকি আছে তাই জানতাম না। “ম্যানহাটানে মুনস্টোন” গল্পের একটা ফটো কপি আমাকে দেওয়া হল। সেখানেই প্রথম ‘সুজন দাশগুপ্ত’ নামটা পড়ি। গল্পটা পড়ার মূল কারণ ছিল ঐ বাপ্পাদিত্য ভদ্রলোকটির চরিত্রায়ন। তারপর থেকেই আমার শুরু হল একেনবাবুর গল্প পড়া এবং বাপ্পাদিত্য থুড়ি বাপিকে খুঁজে বের করার।
তা সেকাজ করতে গিয়ে একটা গল্পে আর থেমে থাকতে পারলাম না। মূল স্ক্রিপ্ট শোনার আগেই একেনবাবু সমগ্র কিনে পরপর তিনটে গল্প পড়ে ফেললাম। এতদিনে বাপ্পাদিত্য ওরফে বাপি আমার কাছে মোটামুটি একটা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। তবু মনটা খচখচ করছিল। মনে হচ্ছিল যে লেখক সুজন দাশগুপ্তর সঙ্গে যদি একবার দেখা করা যেত, তাহলে হয়তো ওঁর কাছ থেকে আরেকটু বাপির সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পারতাম। কিন্তু সে গুড়ে বালি, উনি তো থাকেন দূর বিদেশে। কোন ভাবেই যোগাযোগ সম্ভব নয়।
যাইহোক, কল্পনাতে যে বাপির ছবি এঁকেছি, তাকে মনে রেখেই একদিন স্ক্রিপ্ট শুনতে গেলাম। পদ্মনাভ দা (পদ্মনাভ সেনগুপ্ত) স্ক্রিপ্ট শোনালেন। সেখানেই গল্পের বাকি চরিত্রদের সঙ্গেও আলাপ হল।
স্ক্রিপ্ট শুনে অবশ্য খুবই হতাশ হলাম। না, না! স্ক্রিপ্ট ভালো লাগেনি তা একেবারেই নয়। স্ক্রিপ্ট খুবই ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল ‘বাপি’ চরিত্রটির কিছুই করার নেই। একেনবাবুর পেছনে ঘোরা ছাড়া আর চাড্ডি সংলাপ বলা ছাড়া আর সত্যিই বিশেষ কিছু করার নেই।
আমার এক মাসির চূড়ান্ত OCD আছে। এতটাই যে আমরা তাই নিয়ে খুব হাসাহাসি করি। বাপির চরিত্রটাকে আরো একটু ইন্টারেস্টিং করার জন্য OCDটাকে আমি চরিত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিই। আনন্দের কথা, আমাদের ডিরেকটর সাহেবের তাতে আপত্তি ছিল না।
হৈ হৈ করে শুরু হয়ে গেল শ্যুটিং। বেশ মজা করেই আমরা শ্যুটিং করলাম। যদিও খুবই হেকটিক শ্যুটিং ছিল। সেদিন আমরা দোলের দিন ভোর অবধি শ্যুটিং করেছি। জোকাতে আমরা শ্যুটিং করছিলাম, শেষদিন সেটের মধ্যেই আমাদের দোল খেলা শুরু হয়ে গেল। আচ্ছা থাক, শ্যুটিং এর গল্পগুলো না হয় ‘অবসর’ পত্রিকার পাঠকদের পরবর্তী সংখ্যার জন্যই তোলা থাক।
এর পর হল রিলিজের পালা। একেনবাবু OTT তে রিলিজ করার সময় আমার বেশ টেনশন শুরু হয়েছে। খালি মনে হচ্ছে ‘এ বাবা! ছড়িয়ে লাট করলাম না তো!’ এরমধ্যে একদিন সুজন দাশগুপ্ত নামটা খুঁজে টুক করে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম। ভয় ছিল গল্পের বাপি নিশ্চয়ই লেখক নিজেই, কারণ দুজনেরই পদবী দাশগুপ্ত। তাই ওঁকেই বললাম যে রিলিজের পর একটু দেখে আমাকে জানাতে যে কেমন লাগলো। উনি উত্তর দেবেন সেটা অবশ্য কল্পনাতেও ছিল না। সেই দিনই উত্তর এল। সেটা ২রা মার্চ, ২০১৮। তখনও একেনবাবু রিলিজ করেনি।
“খুবই ভালো লাগছে, ‘নিজের’ সঙ্গে পরিচিত হয়ে। মনে মনে ভাবছি, আমি যদি ওয়েব সিরিজের ‘বাপি’র মতো সুপুরুষ হতাম! কাজ নিশ্চয় ঠিক হবে… পদ্মনাভ দক্ষ স্ক্রিপ্ট রাইটার…নিউ ইয়র্ক থেকে ব্যাঙ্গালোর-এ টেনে নিয়ে যাবার হ্যাপা অনেক… সেগুলো নিশ্চয় ভালোমতোই সামলেছে…আমার শুভেচ্ছা রইল। আমার বন্ধু ‘প্রমথ’-র সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি… ধরে নিচ্ছি সেও ফেসবুক-এ আছে।”
ব্যস! মনে বেশ উৎসাহ পেলাম, একটু বলও পেলাম বলা যায়। সেদিন আরেকটা মেসেজে উনি বললেন, “একেনবাবুর কাহিনির চরিত্রদের তোমরাই বাঁচিয়ে রাখবে।” কথায় কথায় যে গুরুদায়িত্বটা উনি দিয়ে দিলেন, তাতে আমার ভয় প্রায় দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ বেড়ে গেল। যাই হোক, এভাবেই দশ তারিখ এগিয়ে এল, দুটো এপিসোড রিলিজ করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে আবার মেসেজ করলাম, ‘দেখে জানাবেন কেমন লাগল।’
উনি লিখে পাঠালেন, “দেখলাম। চমৎকার অভিনয় করেছো। আশাকরি প্রথম দুটো এপিসোড-এর মতো অন্যান্যগুলোও সমানভাবে আকর্ষণীয় হবে। পদ্মনাভ ম্যানহাটানকে সুন্দরভাবে ব্যাঙ্গালোর-এ সাজিয়েছে… অনেক শুভেচ্ছা রইল।”
কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। খুব খারাপ করিনি তাহলে। আস্তে আস্তে সমস্ত এপিসোড রিলিজ করল। আমরা মূলতঃ সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমেই জানতে পারলাম যে আপামর দর্শকের একেনবাবু খুব ভালো লেগেছে। একেবারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ যাকে বলে। সেই প্রশংসার সিকিভাগ বাপি আর প্রমথর ঘাড়েও পড়ল। আমরা তো আনন্দে আত্মহারা। রাস্তা ঘাটে লোকে ‘বাপিবাবু’ বলে ডেকে উঠলে আমি বেশ খুশি হতাম। আসলে বেশ খুশি হতাম বললে একটু, একটু না খুবই কম বলা হবে। এই আনন্দের রেশ টেনেই ২০১৮র বছরটা পেরিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে লেখক সুজন দাশগুপ্ত যে কখন আমার কাছে সুজনদা হয়ে গেছেন সেটাই টের পাইনি। ঐ ২০১৮র ডিসেম্বর মাসে সুজনদা একটা মেসেজে জানালেন যে উনি কলকাতায় আসছেন। কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতনে থাকবেন। জানুয়ারির শুরুর দিকে কলকাতায় থাকবেন। ব্যস, আড্ডাবাজ বাঙালিকে আর পায় কে?
সব্বার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হল যে ২০শে জানুয়ারি (২০১৯) আমরা সুজনদার বাড়িতে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারব। সুজনদা জানতেন যে আহারপ্রিয় বাঙালিকে শুধু আড্ডার লোভে টেনে আনা যাবে না। তাই লাঞ্চের নেমন্তন্ন পাঠালেন। মোটামুটি সকাল দশটা এগারোটার মধ্যেই ওঁর বাড়িতে সব্বাই পৌঁছে গেলাম।
সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার মশাই। গল্পের বাপ্পাদিত্য আমার সামনে ঘোরাঘুরি করছেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধর মত সুজনদার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। উনি আমাকে ‘সুপুরুষ’ অভিধা দিয়েছিলেন। তা পর্দার বাপি যদি সুপুরুষ হয়, আসল বাপি তাহলে আরও অনেক গুণ বেশি সুপুরুষ। ওঁর উইট, কথা বলার ভঙ্গি, শব্দচয়ন ইত্যাদি দেখে মনে হল যাঁরা পর্দার বাপিকে দেখে ভালো বলেন, তাঁরা ভাগ্যিস আসল বাপ্পাদিত্যকে চেনেন না। নাহলে দুচ্ছাই ছাড়া আর কিছুই জুটত না আমার কপালে।
জমজমাট একটা আড্ডা হল সেদিন। কী বিষয়ে যে আড্ডা দিলাম আর কী বিষয়ে নয়, তা আজ আর মনে করে বলা মুশকিল। আমার আবার কথা খুবই কম মনে থাকে। মানুষের স্মৃতিশক্তি একটা অভাবনীয় বস্তু। একেবারে পুরোপুরি প্রত্যেক শব্দ মনে না থাকলেও আমার ‘মনক্যামেরা’ যে ‘ছবি তুলে’ রেখেছে তাই এই লেখার সময় স্ন্যাপশটের মত ভেসে উঠছে। ঠিক যেন মনে ফেসবুক মেমরি রিমাইন্ডার পাঠাচ্ছে।
এক্কেবারে ‘চব্যচোষ্য’ খাওয়া হল সেদিন। ইস! দেখেছেন! শুধু সুজনদা না, শমীতা বৌদির কথাও বলতে হয়। এতক্ষণ বলতে ভুলে গেছি যে উনিও আমাদের সমানভাবে আপন করে নিয়েছিলেন। যেন একেনবাবুরই এক বৃহত্তর পরিবার! কত গল্পই তো ফুটে ওঠে পর্দায়, কিন্তু সবক্ষেত্রে এভাবে কী আর একটা বড় পরিবার গড়ে ওঠে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্যই সুজনদার আর বৌদির প্রাপ্য। সেদিনের আড্ডার কিছু কিছু ছবি আমাদের মোবাইলে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে শুধুই আড্ডার পরের আভাসটুকুই টের পাওয়া যাবে। বিকেলে আড্ডা ছেড়ে যখন সবাই নিজ নিজ জগতে ফিরে যাবে তখন মনে হচ্ছিল কী দরকার ফেরার! ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না!’ কথা ছিল সুজনদা – শমীতা বৌদি কলকাতায় এলেই আমরা একদিন অন্ততঃ এভাবে আড্ডা মারব। সুজনদার সাথে মেসেজে কথাবার্তা হত।
সে আড্ডা শুধুমাত্র একেনবাবুতে থেমে থাকেনি। সুজনদার মেয়ের বই রিলিজ, সুজনদার অন্যান্য বই নিয়ে আলোচনা সবই থাকত। এমনকি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে যখন অভিযান তৈরি হচ্ছে এবং আমাকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তখনও আমি সুজনদার কাছে জানতে চাই কার কাছে সন্দীপন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব। উনি আমাকে সে বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন।
একেনবাবু সিজন ৩ দেখে উনি লিখে পাঠিয়েছিলেন -“চমৎকার অভিনয় করেছ একেনবাবু ৩-এ। ওয়েব-এ পদ্মনাভ তো রূপলকেই গার্ল-ফ্রেন্ড বানিয়ে দিচ্ছে তোমার। মনে হচ্ছে পালাতে দেবে না।😀যাক, তোমার একটা গতি হতে চলেছে দেখলে পাবলিক খুশি হবে মনে হয়। ভালো থেকো।”
২০১৯ এর নভেম্বর মাসে আবার সেই আড্ডার আমন্ত্রণ এল। সুজনদা কলকাতায়। কিন্তু এবারে মেগা সিরিয়ালে ব্যস্ত থাকার দরুণ আর শামিল হতে পারলাম না।
আস্তে আস্তে প্রায় একেনবাবুর পাঁচটা সিজন হয়ে গেল। পঞ্চম সিজন দেখেও সুজনদা মন্তব্য করেছিলেন, “পঞ্চম সিজন দেখলাম। আমার তো খুবই ভালো লাগল। শান্তিনিকেতনে একেনবাবুকে তুমি একা সামলেছ। প্রমথ দূর থেকে আর কতটুকু পারে! তোমাদের ছাড়া একেনবাবু এতোগুলো সিজন পার হতে পারত না। ভালো থেকো।”
ইতিমধ্যে ‘বাপি’ নামের তকমা লেগে গেছে আমার সাথে। এত বছর এত চরিত্র করলাম, কিন্তু এত লোকে আমায় বাপি বলে চেনে সেটা আমার ভাববার অতীত। বাপির ভূমিকাতে অভিনয় করার সময় এটা আমি ভাবিনি কখনো। সম্প্রতি একটা অন্য ওয়েব সিরিজ প্রমোশনের সময় এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি যে বাপি হিসেবে এত পরিচিত সেটা আপনাকে ডিস্টার্ব করে না?”
আমি বললাম, ” না, একদমই না। এটা তো একটা বড় পাওয়া। অভিনেতা হিসেবে এমন একটা চরিত্র পাব যা দর্শকের মনে থেকে যাবে এরকম স্বপ্নই তো আমরা দেখি।” অথচ এই স্মৃতিচারণের শুরুতেই আমি বলেছি যে প্রথমে মনে হয়েছিল এই চরিত্রে আমার তেমন কিছু করার নেই। এমনকি আমি আর প্রমথ এই বলে মস্করা করতাম যে আমরা তো আসবাব, বল কোথায় দাঁড়াব। অথচ আমাদের কাছে যা কিছু না করা, তাই যে এভাবে দর্শকের মন কেড়ে নেবে তা কে জানত? এটা আসলে সুজনদা এবং পদ্মনাভদার জন্য।
আগের বছর নভেম্বর মাসে গিরীন্দ্রশেখর বসুর একটা বই নিয়ে সুজনদার সঙ্গে কথা বলছি, উনি জানালেন যে উনি নভেম্বর মাসে কলকাতা আসছেন। দেখা হলে ভালো লাগবে। আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম যে এবার দেখা হবেই কিন্তু তার আগেই খবরটা এল। যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমিই বোধহয় দেখা করতে একটু বেশিই দেরি করে ফেললাম।
তবে হ্যাঁ! গল্পের বাপ্পাদিত্য ওরফে বাপি কে তো যম বাবাজীবন নিয়ে যেতে পারবেন না। বাপি নামটা আমি গর্বে বয়ে বেড়াব নিজের সাথে। যেন এক টুকরো সুজনদা সবসময় রয়ে গেলেন আমার সঙ্গে।
3 Comments