টেস্ট ক্রিকেট ও ‘চৌকস’ ক্রিকেটার – আংশিক আলোকপাত

টেস্ট ক্রিকেট ও ‘চৌকস’ ক্রিকেটার - আংশিক আলোকপাত

ভূমিকা

২৫শে জুন, ১৯৮৩। ভারতীয় ক্রিকেটের ক্যালেন্ডারে এক সোনার দিন। এই দিনেই ভারত বিশ্বজয়ী হয়। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের এক সেরা অল-রাউন্ডার (চৌকস খেলোয়াড়) – কপিলদেব নিখাঞ্জ। শুধু তিনিই নন, দলটিতে ছিলেন আরো বেশ কয়েকজন এমন খেলোয়াড়, মহিন্দর অমরনাথ, মদনলাল, রজার বিনি প্রমুখ। ভারতের এই বিশ্ব জয়ে চৌকসদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।

সেই শুরু। তবে তখন তো এত ‘হিসেবের কড়ি’ প্রচলিত ছিল না। এখন হয়েছে। তার সঙ্গে আবার আছে সামাজিক মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া, যার অন্যতম ফেসবুক।

ফেসবুকে ক্রিকেট-বিষয়ক বেশ কিছু নিয়মিত লেখালিখি-আলোচনা হয়। আমিও কিঞ্চিৎ যোগদান করেছি। বিশ্ব টেস্ট-ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ (WTC 2019-2021) ফাইনালের কারণেই কিনা জানিনা, বিগত জুন-জুলাই মাসে সেখানে কয়েকটা বিশ্লেষণমূলক বিস্তারিত লেখা (ও তৎসংক্রান্ত মতামতসমূহ) চোখে পড়েছে। এগুলির বিষয় মূলতঃ ক্রিকেট মাঠের ‘চৌকস ক্রিকেটার’-রা [চলতি কথায়, অল-রাউন্ডাররা (all-rounders)] ও তাঁদের প্রদর্শন।

ফেসবুকের কয়েকটি লেখা আমার বেশ কৌতুহলোদ্দীপকও মনে হয়েছে, তাছাড়াও ওয়েবে পড়া কয়েকটি লেখা আমার মনে কিছু প্রশ্ন তুলেছে। সেই সূত্র ধরে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহের দুয়েকটা ক্রিকেটের বইতে [চিত্র নং] একটু চোখ বোলাতে গিয়ে মনে হ’ল যে এই নিয়ে কিছু একটা লেখা যাক, অতএব … ‘আমি এলেম, পাঠকের দ্বারে’ –

চিত্র নং-১

কে চৌকস, কে নয়?

গোড়াতেই বলে রাখি, সঙ্গত কারণেই, বেশ কিছুকাল যাবৎ ‘অল-রাউন্ডার’ বলতে কিন্তু ক্রিকেট-প্রেমীরা ‘ব্যাটিং-দক্ষ’ উইকেট-রক্ষকদেরও ধরে থাকেন ‘wicket-keeping all-rounders’ হিসেবে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের ব্যাটিংয়ের রান এবং বোলিংয়ের উইকেটের সঙ্গে ফিল্ডিংয়ের ক্যাচের হিসেবও ধরা হয়। তাই অল-রাউন্ডারের ‘সংজ্ঞা’ নিয়ে ক্রিকেট-প্রেমীদের মধ্যে বেশ কিছু মতানৈক্য থাকতেই পারে ও আছেও।

তাই সবিনয়ে বলে রাখি যে আমি এই লেখা প্রসঙ্গে সেইসব ক্রিকেটারদেরই ধরেছি যাঁরা জুন-২০২১ পর্যন্ত  ‘Test Double’ করেছেন, অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে টেস্ট ক্রিকেট-জীবনে অন্তত ১০০০ রান করেছেন এবং অন্তত ১০০ উইকেট পেয়েছেন। এর কারণ – ক্রিকেটের মূল কাজ দুটি, ব্যাটিং ও বোলিং। দুটি দুই মেরুর। সুতরাং, আমার মতে তাঁরাই চৌকস যাঁদের এই দুই মেরুতেই স্বচ্ছন্দ যাতায়াত।

ESPNcricInfo.com অনুযায়ী ১৮৭৭ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস যাবৎ এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা ৭১ – শুরুতে আছেন অস্ট্রেলিয়ার জর্জ গিফেন ও শেষে আছেন ইংল্যান্ডের মঈন আলি – এঁদের মধ্যে কে ‘অল-রাউন্ডার’ আর কে নন, এই নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতেই  পারে। উঠতেই পারে এই তালিকার বাইরে-থাকা বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের কথা যাঁরা (মোটেই তাঁদের আয়ত্তাধীন নয়, এমন) বিভিন্ন কারণে যথেষ্ট-সংখ্যক টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি ফলে এই ‘লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণ করতে পারেননি [যেমন হয়েছে দুই বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন দুনিয়ার সমস্ত ক্রিকেটারদেরই, বা দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ক্রিকেটারদের] – তাই এই লেখার ‘তথ্যভিত্তিক সীমানা’-র সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। দেখা যাক, যাঁদের হয়ত ‘ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান’, সেইসব বঞ্চিতদের নিয়ে পরে কোনসময় আলাদাভাবে লেখা যায় কিনা।

এইভাবে কেন? ওইভাবে নয় কেন?

কে চৌকস আর কে নয়? আর প্রায় দেড়শ বছরের ক্রিকেটারদের একটিই তালিকা? জটিল বিষয়।

এই দুই জটিল বিষয়ের পর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত আসছে বিশ্লেষণের পদ্ধতি। বলতে দ্বিধা নেই যে এইখানেই থাকে সবচেয়ে বেশি জটিলতা।

অতএব আরো বিতর্ক! সংখ্যাতত্ত্বের যথাযথ প্রয়োগ ও শ্রেণিবিন্যাসের সঠিক ব্যবহার নিয়ে রয়েছে প্রবল মতভেদ। একদিকে সংখ্যাপ্রেমীর দল [“Numbers do not lie”], অন্যদিকে কট্টর-সনাতনপন্থী ক্রিকেট-রসিকেরা [“The scoreboard is an ass”] – শ্যাম রাখি না কুল রাখি!

বহু ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতির বিতর্কের ‘বৃক্ষটি’-তে নজর দিতে গিয়ে ক্রিকেটারদের প্রদর্শনের ‘অরণ্যটি’-র থেকে নজর সরে যায় বহু পাঠকের, আর লেখাটা হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যাতত্ত্বের এক ‘গবেষণাপত্র’। পরিসংখ্যানবিদদের প্রতি অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বলি যে আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য এই আকর্ষণীয় ‘অরণ্যটি’-র এক ‘ঝাঁকি-দর্শন’ – কোনও বিশেষ ‘বৃক্ষটি’-র বিস্তারিত-বিশ্লেষণ নয়।

আমি যে পদ্ধতি এই লেখায় ব্যবহার করেছি তা এরকম।

মূল তালিকার ৭১ জনের থেকে বেছে নিয়েছি তাঁদেরকে, যাঁদের

ব্যাটিং গড় ৩০ বা তার বেশি

বোলিং গড় ৩৫ বা তার কম।

তালিকায় আছেন ২০ জন। কারা আছেন  দেখার আগে একঝলক দেখি, কারা বাদ পড়লেন।

যাঁরা নেই

যাঁরা বাদ পড়লেন তাঁদের জনা-কয়েকের নাম – ট্রেভর বেইলি, রিচি বেনো, অ্যালান ডেভিডসন, রিচার্ড হ্যাডলি [চিত্র নং]। এঁদের মধ্যে বেইলি ছিলেন পঞ্চাশের দশকে ইংল্যান্ড দলের বিপদে রক্ষণমূলক বড় এক ভরসাস্থল, এবং সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী দেড় দশক হ্যাডলি যে নিউজিল্যান্ড দলের কী ছিলেন, তা তৎকালীন ক্রিকেট-প্রেমীদের থেকে বেশি কেউ জানেন না। বেনো-ডেভিডসন ছিলেন পঞ্চাশের দশক ও ষাটের দশকের গোড়ার দিকে অস্ট্রেলিয়া দলের অন্যতম দুই শক্তিস্তম্ভ।

চিত্র নং-২ [বাঁ-দিক থেকে ট্রেভর বেইলি, রিচি বেনো, অ্যালান ডেভিডসন, রিচার্ড হ্যাডলি]

ক্রীড়াদক্ষতার মূল্যায়ন

যে কোন ব্যাটসমানের ধারাবাহিক দক্ষতার হিসেবে ধরা হয় টেস্ট ব্যাটিং গড় ৩০ বা তার বেশি। বোলিংয়ের ক্ষেত্রে সেটা কেউ বলেন ৩০ বা তার কম থাকাই ভাল, তবে আমি একটু ‘ছাড়’ রেখে ধরেছি ৩৫ বা তার কম। এই ব্যাটিং-বোলিং গড়ের সমন্বয় (combination) ‘৩০-৩০’, ‘৩০-৩৫’, ‘৩৫-৩০’ বা ‘৩৫-৩৫’ করে ফল কেমন হয় দেখা যেতেই পারে। তবে তাতে চারটি বিভিন্ন তালিকা বেরোবে এই পর্যায়ে! সে তো এক এলাহি ব্যাপার, ছোটখাট একটা পুস্তিকা হয়ে যাবে! অতএব এই লেখার জন্য আমি কেবল ‘৩০-৩৫’ এই সমাহারটি নিয়েই এগোচ্ছি। সময়ের ক্রমানুযায়ী এই সেই তালিকা [তালিকা নং-১ ] – শেষ চারজন এখনও টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন। 

তালিকা নং-১ [ব্যাটিং ও বোলিং গড় অনুযায়ী বাছাই-করা ক্রিকেটাররা, সময়ের ক্রমানুযায়ী]

তালিকার কয়েকটি নাম অনেকেকে একটু অবাক করল কি? কয়েকজনের উল্লেখ করি [ চিত্র নং৩, নং৪, নং-৫, নং-৬

  ট্রেভর গর্ডার্ড – ১৯৭০ সালের পরেই অবসর নেন বলে ষাটের-কম-বয়স্ক অনেকেই তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত নন।                                                                     ড্যানিয়েল ভেট্টোরি – বোধহয় অধিকাংশ কিউয়ি ক্রিকেটারের মতন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে চলতেন।

চিত্র নং–৩ ও ৪ [বাঁদিকে ট্রেভর গর্ডার্ড, ডান-দিকে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি]

 ইরফান পাঠান – তাঁর বোলিং-প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ না হওয়ার খেদে ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজে বোধহয় একটু অন্তরালে থেকে যান।                           রবীন্দ্র জাদেজাপ্রায় এক দশক ধরে টেস্ট খেলা সত্ত্বেও তাঁর (ফিল্ডিং বাদে) দক্ষতাকে টেস্ট ক্রিকেটের মাঠে সম্ভবত কিছুটা খাটো করেই দেখা হয়। 

চিত্র নং-৫ ও ৬ [বাঁদিকে ইরফান পাঠান, ডান-দিকে রবীন্দ্র জাদেজা]

আগের শর্তানুসারে (ব্যাটিং গড় > ৩০) তালিকা নং–১ নিয়ে তাকে ব্যাটিং গড়ের বেশি থেকে কম ক্রমানুযায়ী সাজালে আমরা পাই একটি ‘ব্যাটিং-দক্ষতা’-অনুসারি তালিকা [তালিকা নং]। এই তালিকার ক্রিকেটারদের আমি চারটি শ্রেণীতে (category) বিন্যস্ত করেছি –

গ্রুপ A (৪০ বা তার বেশি),

গ্রুপ – B (৩৫ থেকে ৪০),

গ্রুপ – C (৩১ থেকে ৩৫), এবং

গ্রুপ – D (৩০ থেকে ৩১)।

বিতর্কের জায়গা আছে।  যেমন CD শ্রেণীর মধ্যে ফাঁক নেই বললেই চলে, আবার A শ্রেণী ‘অতি-প্রসারিত’।

তালিকা নং-২ [ব্যাটিং-দক্ষতা – কে কোথায়?]

একই রকম ভাবে যদি ধরে নিই ২৫টি বা তার বেশি টেস্ট খেলা ক্রিকেটারের ধারাবাহিক বোলিং দক্ষতার একটা সহজ অথচ যুক্তিপূর্ণ মাপ হচ্ছে তাঁর বোলিং গড়, তাহলে তালিকা নং–১ নিয়ে তাকে বোলিং গড়ের ক্রমানুসারে (in ascending order – গড় কম হলে বেশি ভাল) সাজালে আমরা পাই একটি ‘বোলিং-দক্ষতা’-মূলক তালিকা [তালিকা নং-৩]। এই তালিকার ক্রিকেটারদের আমি চারটি শ্রেণীতে (category) বিন্যস্ত করেছি – ঠিক আগের মতই।

গ্রুপ – A (২৫ বা তার কম),

গ্রুপ – B  (২৬ থেকে ৩০),

গ্রুপ – C (৩১ থেকে ৩৩, এবং

গ্রুপ – D (৩৩ থেকে বেশি)।

তালিকা নং-৩ [বোলিং-দক্ষতা – কে কোথায়?]

এবার তালিকা নং–২ ও তালিকা নং–৩, এই দুটিকে প্রতিটি ক্রিকেটারের ব্যাটিং-দক্ষতাকে আর বোলিং-দক্ষতাকে পাশাপাশি রাখি।

তালিকা নং-৪  তৈরি করি তাহলে সেটি হবে এইরকম।

তালিকা নং- ৪ [মিলেমিশে – কে কোথায়?]

মিলেমিশে – ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’

অঙ্কের হিসেবে সম্ভব ১৬টি (৪ X ৪) গ্রুপ। তার পরিবর্তে আমি বেছে নেব অল-রাউন্ডারের প্রধান চারটি গ্রুপ – “সুষম” (balanced), “উপযোগী” (utility), “ব্যাটিং-কেন্দ্রিক” (batting-centric) ও “বোলিং-কেন্দ্রিক” (bowling-centric) – এটি management চর্চার ‘two-related-parameters and one four-quadrant graph’ ধারণার ভিত্তিতে করা যেতে পারে। দেখা যাক কীভাবে করা যায়। খুব সহজ সিদ্ধান্ত, – ‘AA’ পেলেই “সুষম”, আর ‘A?’ পেলে “ব্যাটিং-কেন্দ্রিক” ও ‘?A’ পেলে “বোলিং-কেন্দ্রিক”, কিন্তু সম্ভাব্য বাদবাকি ১২টি যৌথ-দক্ষতার কি গতি হবে! তালিকা নং-৪ তো বাস্তবের তথ্য নিয়ে অন্যরকম ও আরো কিছু দেখাচ্ছে।

  • সুষম”: ‘AA’ তো কেউই পাননি (বাস্তবে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু!) – তাহলে “সুষম” কে বা কারা? ‘BA’ পেয়েছেন তিনজন – মিলার, ইমরান, এবং (অবাক লাগলেও!) জাদেজা। প্রথম দুজনকে নিয়ে তর্কের অবকাশ কম, কিন্তু তৃতীয় জন? কিন্তু তাঁর তথ্য তো সামনেই রয়েছে – দেখে নিন তালিকা নং-২ ও তালিকা নং-৩ – তারপর তর্ক করুন।
  • ব্যাটিং-কেন্দ্রিক”: ‘A?’ পেয়েছেন সোবার্স (‘AD’), ক্যালিস (‘AC’) ও গ্রেগ (‘AC’) যাঁদের মধ্যে প্রথম দুজনকে প্রায় সবাই একবাক্যে ‘সেরা’ অল-রাউন্ডার বলে থাকেন, অথচ বোলিংয়ে তাঁদের কেউই ‘A’ তো ননই এমনকি ‘B’-ও নন – অতএব এঁরা তিনজনই “ব্যাটিং-কেন্দ্রিক”। অবশ্য অনেকেই গ্রেগের ‘A?’ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারেন এবং বলতেই পারেন যে উনি “উপযোগী” শ্রেণীর।
  • বোলিং-কেন্দ্রিক”: এখানে সরাসরি ‘?A’ পেয়ে নোবল (‘DA’) ও পোলক (‘CA’)। তবে পোলক যেহেতু ‘C?’, তাই ওঁকে বরং “উপযোগী” বলাই উচিৎ। ‘D?’ নিয়ে ঘুরপথে রোডস (‘DB’) আর ন-যযৌ-ন-তস্থৌ দশায়-পড়া ভেট্টোরি (‘DD’), এই দুজনকেও “বোলিং-কেন্দ্রিক” বলেই ধরি, যদিও দ্বিতীয় জনকে নিয়ে সোবার্স (‘AD’) কিঞ্চিৎ আপত্তি করলেও করতে পারেন তবে উনি তো খেলোয়াড়ি-মনোভাবের জন্য পৃথিবী-বিখ্যাত, তাই হাসিমুখেই মেনে নেবেন! অনেকেই হয়তো মনে করবেন যে রোডসের “উপযোগী” শ্রেণীতে থাকা উচিৎ।
  • উপযোগী”: পোলকের সঙ্গে, ব্যাটিংয়ে ‘B’ বা ‘C’ এবং বোলিংয়েও ‘B’ বা ‘C’ [আদতে ‘BC’ – দু’জন, ‘CB’ – পাঁচজন, ‘CC’ – তিনজন], পেয়ে মোট ১১জন থাকছেন এই “উপযোগী” শ্রেণীতে। জাদেজা, গ্রেগ ও রোডস – এই তিনজকেও এই শ্রেণীতে রাখবার সপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি আসতেই পারে।

যাহোক, এইবার যাকে বলা যায়, ‘উপসংহার’ – আমার লেখার বিশ্লেষণ অনুযায়ী ‘টেস্ট অল-রাউন্ডার শ্রেণীবিন্যাস’ তালিকাটি [তালিকা নং] পেশ করি – উল্লেখ্য যে এই তালিকায় একই শ্রেণীভুক্তদের দেখানো হয়েছে সময়ের ক্রমানুযায়ী [তাই মিলার-ইমরান-জাদেজা, সোবার্স-গ্রেগ-ক্যালিস, নোবল-রোডস-ভেট্টোরি, ইত্যাদি], এর মধ্যে অন্য কোন তারতম্য দেখানোর বাসনা নেই।

তালিকা নং-৫ [টেস্ট অল-রাউন্ডারের শ্রেণীবিন্যাস]

এমন সোজা-সাপটা ভাবে, কেবলমাত্র ক্রিকেটারের টেস্ট-জীবনের ব্যাটিং-বোলিং গড়ের ‘৩০-৩৫’ সমাহারটি দিয়ে ক্রিকেট-যুগ নির্বিশেষে ‘Test Double’-ধারী মাত্র (নাকি খুব বেশি!) ৭১ জন ক্রিকেটারকে বিবেচনা করা – এইসব নিয়ে আপত্তি তো উঠবেই। তা উঠুক, যদি তাতে আরো কিছু সাধারণ ক্রিকেট-প্রেমীদের মধ্যে (শুধুমাত্র স্মৃতিমেদুর ‘নষ্ট-logic’ ভাবপ্রবণ না হয়ে) ক্রিকেটারদের সংখ্যাভিত্তিক (অথচ সহজবোধ্য) মূল্যায়নের প্রবণতা সামান্য কিছুটা বাড়ে, তাতেই এই লেখার যৎকিঞ্চিৎ সার্থকতা আমি দেখি।

আর আগেই বলেছি যে তালিকা নং–৫ এর এই শ্রেণীকরণের মধ্যেও সম্ভাব্য বিতর্কের জায়গা রয়েইছে – জাদেজা কেন “উপযোগী” না হয়ে “সুষম”, গ্রেগ কেন “উপযোগী” না হয়ে “ব্যাটিং-কেন্দ্রিক”, রোডস কেন “উপযোগী” না হয়ে “বোলিং-কেন্দ্রিক”? এই নিয়ে তর্কাতর্কির ফলে এই তালিকার ২০ জনের শ্রেণীকরণটি শেষ পর্যন্ত এমনও হয়ে উঠতে পারে – ভাবুন, ভেবে দেখুন – আপনি খুশি তো!

  • সুষম”:                    মিলার, ইমরান।
  • ব্যাটিং-কেন্দ্রিক”:      সোবার্স, ক্যালিস।
  • বোলিং-কেন্দ্রিক”:    নোবল, ভেট্টোরি।
  • উপযোগী”:           রোডস, মানকড়, গর্ডার্ড, গ্রেগ, বথাম, কপিল, কেয়ার্নস, পোলক, ফ্লিন্টফ, পাঠান, শাকিব, জাদেজা, স্টোকস, হোল্ডার।

 শেষ পাতে ভারতীয়  মতে

শেষ পাতে ভারতীয় মতে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’-টাই রীতি। কিন্তু তার আগে স্বাদ-বদলের জন্য সামান্য একটু ‘চাটনি’-র ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? ওপরের তালিকা নং–৫ অনুযায়ী চারজন ভারতীয় – ভিনু মানকড়, কপিল দেব, ইরফান পাঠান ও রবীন্দ্র জাদেজা – সবাই “উপযোগী” শ্রেণীতে রয়েছেন। এঁদের পরিসংখ্যান নিয়েই [তালিকা নং] – সেদিকে এবার নজর দেওয়া যাক। সঙ্গে দু-চারটি প্রশ্ন ও মন্তব্যও রাখি।

তালিকা নং-৬ [চার ভারতীয়ের পরিসংখ্যান]

ব্যাটিং গড় অনুযায়ী, জাদেজা বাকি তিনজনের থেকে ‘উন্নত’ ব্যাটসম্যান এবং পাঠান ‘সমতুল্য’ মানকড়ের বা কপিলের – তাই তো! যাঁরা মানকড় বা কপিলকে খেলতে দেখেছেন বা এমনকি তাঁদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়েছেন (দৈনিক সংবাদের শিরোনাম নয়, মাপ করবেন!), তাঁরা অনেকেই খুব সম্ভবত হাসতে গিয়ে বিষম খাবেন। কেন? একটু পরেই সামান্য কিছু তথ্য পেশ করলেই বুঝবেন।

বোলিং গড় অনুযায়ী, জাদেজা বাকি তিনজনের থেকে ‘উন্নত’ বোলার [যদিও পেসার কপিলের সঙ্গে স্পিনার জাদেজার তুলনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা আরেক প্রশ্ন!], এবং বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে তিনি মানকড়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে – তাই না! যাঁরা মানকড়কে খেলতে দেখেছেন বা এমনকি তাঁর সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়েছেন (দৈনিক সংবাদের শিরোনাম নয়, মাপ করবেন!), তাঁরা অনেকেই হয়ত ভ্রূকুঞ্চিত করবেন। কেন? একটু তথ্য ঘেঁটে দেখালেই বুঝবেন।

‘চাটনি’-পর্ব চটপট শেষ করে চলে আসি ভারতীয় ‘মিষ্টান্ন’-পর্বে – এই চারজনের উপহার-দেওয়া কিছু ‘sweet memories’ রোমন্থনে – ভিনুকে দিয়ে শুরু করে কপিল হয়ে ইরফান ছুঁয়ে বর্তমানের জাদেজা, প্রত্যেকেই ক্রিকেট-প্রেমীদের জন্য কম-বেশি কিছু-না-কিছু মধুর স্মৃতি রেখে গেছেন (ও রাখছেন) – সেগুলোর দিকে একবার নজর দিই।

চিত্র নং– ৭ [ভিনু মানকড়] / চিত্র নং–৮ [কপিল দেব]

  • ভিনু মানকড় [১৯১৭-১৯৭৮]: ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে ভিনু মানকড় [চিত্র নং–৭] তাঁর ‘Test Double’ মাইলফলকে পৌঁছে যান তাঁর ২৩তম টেস্টে, তখনকার দিনে ক্রিকেটের ৭৫ বছরের ইতিহাসে দ্রুততম। তাঁর এই বিশ্ব-রেকর্ড আড়াই দশকেরও বেশি সময় পরে ১৯৭৯ সালের অগাস্ট মাসে ভেঙ্গে দেন ইয়ান বথাম, তাঁর ২১তম টেস্টে ঐ মাইলফলকটি ছুঁয়ে দিয়ে।
  • মানকড় ব্যাটিংয়ে কি করেছেন? লিন্ডওয়াল-মিলার-জনস্টন পেসার-ত্রয়ীর বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে একই সিরিজে দু-দু’খানা শতরান করেছেন (১৯৪৭-৪৮), লর্ডসের মাঠে নিজের একক প্রদর্শনের দৌলতে ক্রিকেট-বিশ্বকে চমৎকৃত করেছেন (১৯৫২), পঞ্চাশোর্ধ বছরব্যাপী (১৯৫৫ থেকে ২০০৭) ওপেনিং জুটির বিশ্ব-রেকর্ডের প্রধান অংশীদার, দেশের মাঠে একই সিরিজে দু’খানা দ্বিশতরান করেছেন (১৯৫৫-৫৬), দলের প্রয়োজনে এক থেকে এগারো সব জায়গায় ব্যাট করেছেন – এটুকু বললেই আশা করি যথেষ্ট।
  • বোলার মানকড় সম্পর্কে বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার জন আর্লট পঞ্চাশের দশকে বলেছিলেন: “A great bowler, clearly the best of his type in post-war cricket and possibly as good as any in any period. Certainly, he is entitled to stand with (Wilfred) Rhodes and (Hedley) Verity in the line of classis slow left-arm bowlers.(1)”
  •  ১৯৫২ সালের লর্ডস টেস্টে মানকড়ের অসাধারণ প্রদর্শন নিয়ে লিখতে গিয়ে বিখ্যাত বাংলা ক্রিকেট-লেখক ও জীবনীকার শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর “ইডেনে শীতের দুপুর” বইতে [চিত্র নং–৯] লিখেছেন: “চারদিন ভিনু খেলে গেলেন। উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক চেস্টার, ক্রিকেটের (তৎকালীন) বিখ্যাততম বিচারক। অতি দীর্ঘ দিন মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে রৌদ্রজল গ্রহণ করেছেন। চেস্টার অকুণ্ঠে বলেছেন, এ জিনিস তিনি দেখেননি। (2)

চিত্র নং [১৯৫২ সালের লর্ডস টেস্টে মানকড়ের মহান কীর্তি সম্বন্ধে দু’টি মন্তব্য]

  • কপিল দেব [১৯৫৯-]: ১৯৮০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কপিল দেব [চিত্র নং–৮] তাঁর ‘Test Double’ মাইলফলকে পৌঁছে যান, তাঁর বয়স তখন সবেমাত্র ২১ পেরিয়েছে, তখনকার দিনে ক্রিকেটের ১০৩ বছরের ইতিহাসে তরুণতম।
  • কপিল ব্যাটিংয়ে কি করেছেন? নাঃ, ১৯৮৩-র বিশ্বকাপের সেই প্রবাদপ্রতিম অপরাজিত ১৭৫ এই হিসেবে আসবে না, কারণ আমরা টেস্ট-ক্রিকেটের কথা বলছি। ইংল্যান্ড সফরে তিন টেস্টে চার ইনিংসে ২৯২ রান করেন (১৯৮২), মাদ্রাজের সেই ‘টাই’ টেস্টে প্রথম ইনিংসে নিজে ১১৯ রান করে শেষ তিন উইকেটে ১৫২ রান তুলে দলকে ‘ফলো-অন’ বাঁচাতে সাহায্য করেন, মাদ্রাজের ‘হিরওয়ানি-অভিষেক’ টেস্টে প্যাটার্সন-ওয়ালশ-ডেভিস পেসার-ত্রয়ীর বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে নিজে ১০৯ রান করে দলকে ১৫৬/৫ থেকে ৩১৩/৭ করতে সাহায্য করেন [ওঁর ১৯৮৮ সালের এই ইনিংসটি টেস্ট-ক্রিকেটের ১৩৫ বছরের ইতিহাসের সেরা-১০০টি শতরানের মধ্যে ধরা হয়(3)।], পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে ডোনাল্ড-শ্যুলজ-ম্যাকমিলান-ম্যাথুজ পেস-চতুষ্টয়ের বিরুদ্ধে নিজে ১২৯ রান করে শেষ পাঁচ উইকেটে ১৮৮ রান তুলে দলকে ইনিংস-পরাজয় থেকে বাঁচতে সাহায্য করেন (১৯৯২-৯৩) – এটুকু বললেই বোধহয় চলবে।
  • কপিলের ব্যাটিং সম্বন্ধে শেন ওয়ার্ন বলেছেন: “What I liked most about Kapil was his style. I loved the way he batted at a time when scoring rates in Test cricket was much lower and a side scoring 300 runs in a day was reckoned to be taking crazy risks. Kapil had a different attitude. Maybe he wanted to save his energy for bowling and didn’t think he could afford to spend a long time out there in the middle to score his runs (4).”
  • কপিলকে ২০০২ সালের জুলাই মাসে ৩২ জন আন্তর্জাতিক-স্তরের ক্রিকেট-বিচারক (খেলোয়াড়, লেখক ও ধারাভাষ্যকার) মিলে “Wisden Indian Cricketer of the Century” নির্বাচিত করেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন ভিনু মানকড়, বিজয় হাজারে, সুনীল গাভাস্কর, সচিন তেন্ডুলকর, বিষাণ সিং বেদি, ভাগবত চন্দ্রশেখর প্রমুখ।
  • কপিল [চিত্র নং–১০] বোলিংয়ে কি করেছেন? প্রথমে মনে করুন, ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির সেই দিনটি যেদিন এক ‘ভারতীয় ফাস্ট-বোলার’ [এটি নাকি ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশকের অর্ধেকের বেশি সময় পর্যন্ত ‘oxymoron’-এর এক অন্যতম ক্রিকেটীয় উদাহরণ ব’লে প্রচলিত ছিল!] টেস্ট-ক্রিকেটের সর্বাধিক উইকেট-শিকারির আসন নিলেন (১৯৮৮ সালের নভেম্বরের রিচার্ড হ্যাডলিকে সরিয়ে) এবং সেই আসনে থাকলেন ২০০০ সালের মার্চে কোর্টনি ওয়ালশ না আসা অবধি। কপিলের তিনটি বোলিং-প্রদর্শনী টেস্ট-ক্রিকেটের ১৩৮ বছরের ইতিহাসের সেরা-১০০টি ‘five-wickets-in-innings’-এর মধ্যে ধরা হয় (5) – ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৯৮৩-৮৪ মরশুমে আহমেদাবাদে ৯/৮৩ ও দিল্লিতে ৬/৭৭ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭৯-৮০ মরশুমে মাদ্রাজে ৭/৫৬।
  • কপিলের সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী অল-রাউন্ডার ইয়ান বথাম মন্তব্য করেছেন:     “I enjoyed my tussles with Kaps more than most. I loved his attitude to the game – attack at all times except when defence is absolutely the only option – because it mirrored my own. …  in everything he did, Kaps had the swank and swagger of the cavalier about him (6).
  • কপিলের সমসাময়িক বিখ্যাত ব্যাটসম্যান ডেভিড গাওয়ার মন্তব্য করেছেন: “India have been blessed with many great batsmen and spin bowlers, but they have often suffered from a shortage of great fast bowlers and all-rounders. But in Kapil Dev they had one of each.(7)”
  • ১৯৮৫-৮৬ মরশুমে কপিলের ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে টেস্ট-অভিষেক-হওয়া, আশি ও নব্বইয়ের দশকের অস্ট্রেলিয়ান পেসার, মার্ভ হিউজ লিখেছেন: “He was India’s best fast bowler and their best bowling all-rounder.(8)”
  • ইরফান পাঠান [১৯৮৪-]: অনেক প্রতিভার অধিকারী প্রতিশ্রুতিবান ইরফান পাঠান [চিত্র নং] কেন আরেকজন (বাঁ-হাতি) কপিল দেব হয়ে উঠতে পারলেন না, তার একটা অন্যতম কারণ হয়ত তাঁর চোট-আঘাত পাওয়ার প্রবণতা – সেখানে কপিলের ধারেকাছে বিশ্বের প্রায় কোনও অল-রাউন্ডার আসতে পারেননি। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যদলের প্রাক্তন ওপেনার, ক্রিকেট-লেখক (ও ডাক্তার) ড্যানিয়েল হ্যারিস লিখেছেন: “Of all the men to reach the 400-wicket mark, there is only one who also scored 4000 runs, and of his (Kapil’s) 434 dismissals, a remarkable 217 of them came in India despite carrying a sub-continental attack for 15 years, he missed not a single match through injury, tribute to a healthy mind as well as a freakish body.(9)”
  • ইরফান মাত্র ১৯ বছর বয়সে ২০০৩-০৪ মরশুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট-জীবন শুরু করেন, বেশ জোরের ওপর বাঁ-হাতি স্যুইং করিয়ে দক্ষ ব্যাটসম্যানদেরও অসুবিধেয় ফেলেন। তারপরেই ২০০৪ সালের পাকিস্তান সফরেও দলের সাফল্যে বড় ভূমিকা নেন। তাঁর ব্যাটিংয়েও উন্নতি হতে থাকে। বছর দুয়েকের মধ্যেই আশা জাগান কপিলের সম্ভাব্য উত্তরসুরী হয়ে ওঠার। মনে করুন ২০০৬ সালের জানুয়ারির করাচি টেস্ট – ম্যাচের প্রথম ওভারের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বলে পরপর ধরাশায়ী সলমান বাট, ইউনিস খান ও মহম্মদ ইউসুফ – ভারতীয় পেস-বোলিংয়ের প্রথম টেস্ট হ্যাট-ট্রিক। কিংবা মনে করা যাক তার ঠিক আগের টেস্টেই ফয়জলাবাদে পাকিস্তানের ৫৮৮-র জবাবে ৫/২৮১ থেকে ধোনির (১৪৮) সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ২১০ রান তুলে ভারতকে ফলো-অন থেকে বাঁচানো – ইরফান করেন ৯০ রান।
  • এরপর কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর বলের গতি কমতে থাকে, উইকেট পাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০০৬ সালের শেষের দিকে দল থেকে বাদ পড়েন, দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ফেরত আসতে হয় ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে হারনো নৈপুণ্য পুনরুদ্ধার করতে। ২০০৭-০৮ মরশুমে টেস্ট-দলে ফেরেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গালোরে, টেস্ট-জীবনের একমাত্র শতরানটি (১০২) করেন, অস্ট্রেলিয়া সফরে পার্থ টেস্টে পাঁচ উইকেট নিয়ে এবং ২৮ ও ৪৬ রান করে ম্যাচের-সেরা হয়ে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন – ঐ সিরিজেই তাঁর ‘Test Double’ মাইলফলকেও পৌঁছে যান। কিন্তু ২০০৯ সালে টেস্ট-দল থেকে আবার বাদ পড়েন, আর ফিরতে পারেননি – তাঁর টেস্ট-জীবনের সমাপ্তি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের আহমেদাবাদ ম্যাচে।
  • রবীন্দ্র জাদেজা [১৯৮৮-]: ২০১৭ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্র জাদেজা [চিত্র নং-৬] যখন তাঁর ‘Test Double’ মাইলফলকে পৌঁছলেন, তখন অনেকেই একটু আশ্চর্য হয়ে যান। ২০১২-১৩ মরশুমে যখন তাঁর টেস্ট-জীবন শুরু হয়, তখন তিনি সীমিত-ওভারের ক্রিকেটের ‘bits and pieces cricketer’ নামেই প্রধানত পরিচিত ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে টেস্ট-দলে উপযোগী খেলোয়াড় হিসেবেও নিজেকে চিনিয়ে দেন।
  • কেমন বোলার জাদেজা? টেস্ট-দলে স্থান পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রান-আটকানো নিঁখুত-নিশানার কার্যকরী বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে দলে নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করেন – ২০১৩ সালে দেশের মাটিতে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে জুটি বেঁধে টেস্ট-সিরিজে চার ম্যাচে ২৪টা উইকেট নেন (অশ্বিন নেন ২৯টা উইকেট), ভারত ৪-০ ম্যাচে সিরিজ জেতে। ২০১৫-১৬ মরশুমে সালে দেশের মাটিতে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিরুদ্ধে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে আবার জুটি বেঁধে টেস্ট-সিরিজে চার ম্যাচে ২৩টা উইকেট নেন (অশ্বিন নেন ৩১টা উইকেট), ভারত ৩-০ ম্যাচে সিরিজ জেতে। দেশের মাটিতে প্রায় প্রতিটি টেস্ট-সিরিজেই এই জুটি সফরকারী দলের বিভীষিকা হয়ে ওঠেন – ২০১৬-১৭ মরশুমে তিন-টেস্টের সিরিজে নিউজিল্যান্ড হারে ৩-০ (জাদেজার ১৪টা উইকেট), পাঁচ-টেস্টের সিরিজে ইংল্যান্ড হারে ৪-০ (জাদেজার ২৬টা উইকেট), চার-টেস্টের সিরিজে অস্ট্রেলিয়া হারে ২-১ (জাদেজার ২৫টা উইকেট)। ২০১৬ ও ২০১৭ এই দু’বছরে তিনি ৯৭টা টেস্ট-উইকেট নেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ্বের বাঁ-হাতি বোলারদের মধ্যে তিনিই টেস্টে দ্রুততম ২০০ উইকেট পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
  • জাদেজার (এ-যাবৎ – জুলাই-২০২১ পর্যন্ত) ৫৩টা ম্যাচে ২২১টা উইকেটের মধ্যে ১৫৭টাই দেশের (প্রধানত স্পিন-সহায়ক) মাঠে ৩৩টা ম্যাচে, অর্থাৎ ৭১ শতাংশ উইকেট ৬২ শতাংশ ম্যাচে – বিদেশের মাঠে এখনও তেমন ম্যাচ-জেতানো বোলিং করে উঠতে পারেননি, তবে তিনি এখনও টেস্ট-ক্রিকেট খেলছেন, অতএব আশা রাখাই যেতে পারে। [এই প্রসঙ্গে চট করে একবার মানকড়কে দেখা যাক – ৪৪টা ম্যাচে ১৬২টা উইকেটের মধ্যে ১০৩টা দেশের (প্রধানত স্পিন-সহায়ক) মাঠে ২৩টা ম্যাচে, অর্থাৎ প্রায় ৬৪ শতাংশ উইকেট ৫২ শতাংশ ম্যাচে – বিদেশের মাঠে ম্যাচ-জেতানো বোলিং করে উঠতে পারেননি, কারণ ভারত বিদেশে প্রথম টেস্ট-ম্যাচ জেতে ১৯৬৭-৬৮ মরশুমে নিউজিল্যান্ডে, তিনি অবসর নেওয়ার প্রায় এক দশক বাদে।]
  • ব্যটিংয়ে জাদেজার টেস্ট-জীবনের প্রথম বছর তিনেক বিশেষ উজ্জ্বল নয় (বিক্ষিপ্তভাবে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের দুয়েকটি ইনিংস ছাড়া), কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল এই চার বছরে ৩২টা ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১৩৭১ রান, একটি শতরান ও ১৩টি অর্ধশত সমেত, গড় ৪৫.৭০ – মূলতঃ সাত-আট-নয় (কদাচিৎ ছয়) নম্বরে ব্যাট করার ফলে ঐ সময়ের ৪৫টা ইনিংসের মধ্যে ১৫টায় অপরাজিত-থাকা তাঁর ব্যাটিং গড় রীতিমত ভাল হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট-ইনিংসের কথা উল্লেখ করি – ধরমশালায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সপ্তম উইকেটে ঋদ্ধিমান সাহার (৩১) সঙ্গে ৯৬ রানের জুটি করে নিজে ৬৩ রান করে দলকে ২২১/৬ থেকে ৩১৭/৭ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে রাখা (২০১৬-১৭), মোহালিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অশ্বিন (৭২) ও জয়ন্ত যাদবের (৫৫) সহায়তায় নিজে ৯০ রান করে দলকে ২০৪/৬ থেকে ৩৮১/৮ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে রাখা (২০১৬-১৭), লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মূলতঃ ভুবনেশ্বর কুমারের (৫২) সহায়তায় নিজে (৫৭ বল খেলে) ৬৮ রান করে দলকে ২০৩/৬ থেকে ৩৩৪/৮ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনশতাধিক রানের পুঁজি জমানো (২০১৪) – তিনটি ক্ষেত্রেই ভারত ম্যাচ জেতে, শেষটা (১৯৮৬ সালের পর) দীর্ঘ ২৮ বছর বাদে লর্ডসের মাঠে।

শেষ প্রশ্ন’ বা ‘শেষ উত্তর’?

এই বিতর্কের “শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে” – সব খেলাতেই এই সমস্যা অল্প-বিস্তর আছে, কিন্তু ক্রিকেটের মত এতরকম প্রভূত তথ্যবহুল খেলাতে সেটা অনেক সময় ‘আঘাত হয়ে’ দেখা দিয়ে, ‘আগুন হয়ে’ জ্বলে ওঠে! তবে আমার এই সামা্ন্য রচনার উদ্দেশ্য অবশ্যই কাউকে ‘আঘাত’ করা বা কোনও ‘আগুন’ জ্বালানো নয় – উদ্দেশ্যটি হ’ল আরো বেশিসংখ্যক ক্রিকেট-প্রেমীদের মধ্যে তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় (বা অপ্রিয়) ক্রিকেটারদের বস্তুনিষ্ঠ ও সংখ্যাভিত্তিক মূল্যায়নের প্রবণতাটা যৎকিঞ্চিৎ বাড়িয়ে তোলা। বেশ কিছু ক্রিকেট-লেখক ও গবেষক এই ব্যাপারে বহুকাল যাবৎ মনোনিবেশ করেছেন (ও করছেন), তাঁদের প্রচেষ্টার ফসলের অল্প কয়েকটির ছবি [চিত্র নং১১] দিয়ে এখানেই ইতি টানি।

চিত্র নং-১১

[কৃতজ্ঞতাস্বীকার এবং তথ্যনির্দেশ]:

  1. Meher-Homji, Kersi | (2008) | Cricket’s Great All-rounders
  2. Bacher, Ali & Williams, David | 2013 | Jacques Kallis and 12 Other Great South African All-rounders
  3. Hill, Alan | (2012) | The Valiant Cricketer
  4. Benaud, Richie | (2015) | Those Summers of Cricket
  5. Davidson, Alan | (1963) | Fifteen Paces
  6. Hadlee, Richard | (1985) | At the Double
  7. Nikhanj, Kapil Dev | (2004) | Straight from the Heart
  8. বসু, শঙ্করীপ্রসাদ | (১৯৬০) | ইডেনে শীতের দুপুর
  9. Ferriday, Patrick & Wilson, Dave | (2013) | Masterly Batting: 100 Great Test Centuries
  10. Ferriday, Patrick & Wilson, Dave | (2016) | Supreme Bowling: 100 Great Test Performances
  11. Warne, Shane | (2009) | Shane Warne’s Century: My Top 100 Test Cricketers
  12. Botham, Ian | (2001) | Botham’s Century: My 100 Great Cricketing Characters
  13. Gower, David | (2015) | David Gower’s 50 Greatest Cricketers of All Time
  14. Hughes, Merv | (2015) | Merv Hughes’ 104 Cricket Legends
  15. https://cricket.yahoo.net/news/top-5-ravindra-jadeja-knocks-213247692
  16. https://stats.espncricinfo.com/ci/engine/records/index.html?class=1
  17. https://stats.espncricinfo.com/ci/content/records/282786.html
  18. https://bleacherreport.com/articles/1948097-picking-the-worlds-best-test-all-rounder-by-net-average
  19. https://www.espncricinfo.com/story/test-all-rounders-an-alternative-bcg-view-618313
  20. https://www.ripublication.com/ijome20/ijomev10n1_06.pdf

[ছবির কৃতজ্ঞতাস্বীকার]:

  • Cricket’s Great All-rounders – চিত্র নং-১ (আংশিক), নং-৩ (আংশিক), নং-৭
  • Jacques Kallis and 12 Other Great South African All-rounders – চিত্র নং-১ (আংশিক)
  • The Valiant Cricketer – চিত্র নং-২ (আংশিক)
  • Those Summers of Cricket – চিত্র নং-২ (আংশিক)
  • Fifteen Paces – চিত্র নং-২ (আংশিক)
  • At the Double – চিত্র নং-২ (আংশিক)
  • Straight from the Heart – চিত্র নং-৮
  • ইডেনে শীতের দুপুর – চিত্র নং-৯
  • Botham’s Century: My 100 Great Cricketing Characters – চিত্র নং-১০
  • ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত – চিত্র নং-৩ (আংশিক), নং-৪, নং-৫, নং-৬
  • অন্যান্য চিত্র – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে 

পাদটীকা

  1. Meher-Homji, Kersi | (2008) | Cricket’s Great All-rounders
  2.  বসু, শঙ্করীপ্রসাদ | (১৯৬০) | ইডেনে শীতের দুপুর
  3.  Ferriday, Patrick & Wilson, Dave | (2013) | Masterly Batting: 100 Great Test Centuries
  4.  Warne, Shane | (2009) | Shane Warne’s Century: My Top 100 Test Cricketers
  5.  Ferriday, Patrick & Wilson, Dave | (2016) | Supreme Bowling: 100 Great Test Performances
  6. Botham, Ian | (2001) | Botham’s Century: My 100 Great Cricketing Characters
  7. Gower, David | (2015) | David Gower’s 50 Greatest Cricketers of All Time
  8. Hughes, Merv | (2015) | Merv Hughes’ 104 Cricket Legends
  9. Ferriday, Patrick & Wilson, Dave | (2016) | Supreme Bowling: 100 Great Test Performances
কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", এই বছর এল “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর লিখেছেন “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *