ঠাকুরমার ঝুলি
সাদা রঙের মারফি ট্রানজিস্টার রেডিও, তার ওপরের ছবিতে ছোট্ট একটা মিষ্টি মেয়ে, কোঁকড়া চুল নেমে এসেছে গালের দুপাশ দিয়ে। চুলের নিচটা বাঁকানো, তার নিজস্ব সিগনেচার হেয়ারস্টাইল। টোপাটোপা গালের নীচে হাতের একটা আঙুল রেখেছে। সাদাকালো ছবিতে চোখের রং তো বোঝা যায় না, তবে মনে হয় নীল চোখই হবে। মারফি গার্ল। ক্লাস টুয়ে পড়া একটা পুঁচকে মেয়ে তাকে নিয়ে নিজের ঘরের সবুজরঙা দরজাটি বন্ধ করে দিত। তখন সদ্য একটি ঘর পেয়েছে সে, একান্তই নিজের। দিনরাত সেই ঘরের দরজা এঁটে পড়াশোনা করে। দরজা খোলা থাকলে বাইরের আওয়াজে মনঃসংযোগ নষ্ট হবে না? জননী প্রখর বুদ্ধিমতী, সবই বোঝেন। মাঝে মাঝে শুধু বিনোদনের সময়টা একটু রেশন করে দেন। বিনোদন মানে রেডিও শোনার সময়।
এ ঘটনা সেই আদ্যিকালের, প্রাক-টিভি যুগের কথা। সত্তরের দশকের একেবারে প্রথম দিক, যখন ট্রানজিস্টার রেডিওতেই ধরা থাকত সব্বার ছোটোবেলার জিওনকাঠি। AM রেডিও, তাতে বেশ কয়েকটি চ্যানেল। চ্যানেলে চ্যানেলে বিভিন্ন সময়ে রংবেরঙের অনুষ্ঠানের আয়োজন। সে যে কত মণিমুক্তোর ছড়াছড়ি, সে আর কী বলি!
এমনি এক সোনালি দিনে মঙ্গলবারের দুপুর যখন গড়িয়ে নামছে বিকেলের কোলে, কলকাতা ক-এর ঘোষিকা কেমন এক মায়ামাখানো গলায় বললেন, “ছোটোরা, তোমরা সঙ্গে আছ তো? এখন আমাদের রূপকথার সময়। শুরু হচ্ছে গীতিনাট্য, ‘বুদ্ধু ভুতুম।’”
আরে! নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া। বুদ্ধু-ভুতুম? সেই বাঁদর আর পেঁচার রূপকথা? যা নীল মলাটের বই ঠাকুরমার ঝুলিতে ধরা আছে? বইয়ের ওপরে জ্বলজ্বল করছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের নাম। বাবা বলেছে, রূপকথার গল্পগুলি লেখক সংগ্রহ করে এনেছেন নানা জায়গার ঠাকুরমা আর দিদিমাদের কাছ থেকে। তাই তো বইয়ের ওই নাম। সেই রূপকথা থেকে আবার গীতিনাট্য হয় নাকি? গীতিনাট্য মানে তো রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা,’ ‘চিত্রাঙ্গদা,’ ‘তাসের দেশ।’ বাড়ির গ্রামোফোনে বাজে সে সব রেকর্ড। কই, ঠাকুরমার ঝুলির গীতিনাট্য তো তাদের নেই? ‘বুদ্ধু ভুতুম’ অতি প্রিয় গল্প। সেই কাহিনি বলা হবে গান গেয়ে? কী মজা!
অধীর আগ্রহে রেডিওতে কান পাতল মেয়েটা।
কাঁপাকাঁপা গলায় বেজে উঠল আদরের এক ডাক –
আয়রে আমার নাতিপুতি, আমি তোদের সেই আদ্যিকালের ঠাকুরমা।
আমার এই ঝুলি ভরা, কত গল্প, কত ছড়া – শুনবি তোরা?
তবে ঝুলি খুলি?
এই ঝুলি নড়ছে, এই ঝুলি নড়ছে, এই ঝুলি নড়ছে…
ধাপে ধাপে ওঠে ঠাকুরমার কাঁপাকাঁপা গলা। নিজের অজান্তেই মেয়েটা বলে ওঠে, “শুনব, শুনব ঠাকুরমা!”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। এ গলা মেয়েটার খুব চেনা – বাবার দৌলতে। তাঁর গানের রেকর্ড ‘রানার,’ ‘গাঁয়ের বধূ,’ সবসময় বাড়িতে বাজছে। সেই চেনা হেমন্ত কোন ম্যাজিকে একদম অচেনা এক গল্পদাদু হয়ে গেলেন কে জানে! দিব্যি ফেঁদে বসলেন রূপকথার গল্প –
সপ্তদ্বীপের রাজামশাই, সাতটি রানি তাঁর,
পাঁচটি রানির কোলে এল পাঁচটি রাজকুমার
হীরা রাজকুমার, মতি রাজকুমার, মাণিক রাজকুমার…
হ্যাঁ, এই তো, এই তো সেই চেনা গল্প। চোখের সামনে ভাসছে নীল মলাটের বাঁধানো বই, ওপরে সোনার রঙে লেখা – ‘ঠাকুরমার ঝুলি।’ মাঝে মাঝেই বইয়ের আলমারি থেকে নেমে এসে মেয়েটার বালিশের পাশে জায়গা করে নেয়।
ব্যারিটোন গলা ততক্ষণে পাঁচটি রানির পাঁচটি কুমারকে পেরিয়ে গিয়ে শেষ দুই রানির দুঃখের কথায় এসেছে –
মনের দুঃখে সে দুই রানি পড়ে থাকেন ভুঁই!
কেন?
না রাজকুমারের বদলে তাদের কোলে এসেছে, “একটি বাঁদর, একটি প্যাঁচা, ছি ছি ছি ছি ছি!”
উফ, কী টেনশন! পাঁচ-পাঁচটা রাজকুমারের ভাই কিনা বাঁদর আর পেঁচা? কী হবে এবার?
নিপুণ দক্ষতায় সুরে সুরে নাটকের জাল বুনছেন হেমন্ত, এ কাজে তাঁর জুড়ি নেই। ‘গাঁয়ের বধূ’ আর ‘রানার’ও তো গল্পই বলে! মেয়েটা অতশত বোঝে না, সে মন্ত্রমুগ্ধ। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছে শতকষ্টের মাঝে বাস করেও বুদ্ধু আর ভুতুমের মায়েদের সোহাগ।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সোনাঝুরি কণ্ঠে যেন মায়ের আদরটুকু মাখানোই আছে,
আয়রে আমার সোনা মাণিক, আয়রে আমার বুদ্ধু
পাশ থেকে কচি গলা সুর মেলাল, “থাকলে পঙ্খী উড়ে যেতুম নিয়ে তোমায় শুদ্ধু”
এবার আরতি মুখোপাধ্যায়ের রিনরিনে মিষ্টি গলা। ভুতুমের মা বলছেন –
আয়রে আমার বুকের ধন, আয়রে আমার ভুতুম…
সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি কচি গলায় নিখুঁত গানের কলি – “থাকত যদি ময়ূরপঙ্খী, দূরবিদেশে যেতুম…”
নীচে রইল সেই গানের টুকরো, নিজের গলায় গাওয়া।
ততক্ষণে মেয়েটা স্বপ্নের ময়ূরপঙ্খীতে সওয়ার। ঠাকুরমার ঝুলি খুলে যাচ্ছে তার সামনে। বুদ্ধু আর ভুতুম বড় হচ্ছে, বুঝতে শিখছে অনেক কিছু। মা’কে শুধোচ্ছে বাবার কথা, কেন তাদের সঙ্গে এমন অবিচার! গানের সুর, তাল, লয় বদলে যাচ্ছে। বারোমাত্রার ছন্দকে এমন মুন্সিয়ানায় সাজানো হচ্ছে যে তবলার বোল যেন উগরে দিচ্ছে বিক্ষুব্ধ সব প্রশ্ন। শুনতে শুনতে শিশুমন উত্তাল।
“আমাদের বাবা কোথায়?”
“কেন, ওই রাজামশায়!”
“কেন তুমি কাঠকুড়ুনি?
চুলে কেন নেই চিরুনি?”
“কেন তুমি ঘুঁটে কুড়াও?
প্রাসাদে কেন না যাও?”
এই যে সেই গান, নিজের গলায় গাওয়া।
তখন আবছা আবছা ধরা পড়ত মনের পর্দায়। পরে মেয়েটা একটু বড় হয়ে বুঝতে পারে, কী অবলীলায় শ্রোতার মনে ক্ষোভের ছবি এঁকে গেছেন গীতিকার, সুরকার!
গল্প এগোয়। বঞ্চনাকে জয় করে, দুঃখ, বেদনাকে ছাপিয়ে গিয়ে শেষে আসে ইচ্ছাপূরণের আনন্দ। বুদ্ধু-ভুতুম জিতে নেয় রাজকন্যা, জিতে নেয় সুখ, সৌভাগ্য। রূপকথার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
ঠাকুরমার ঝুলির অন্য মাণিকটি হল নীলকমল-লালকমলের গল্প। পরের মঙ্গলবার দুপুরে বাজবে। এ গল্পে রাক্ষস আর রাক্ষসীর ভিড়। খোনা গলায় “হাঁউ মাউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ,” আওয়াজে দুপুরের রোদে কেমন গা-ছমছমে রহস্য ঘনিয়ে আসে, ঘোর লেগে যায় চোখে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকা মাথায় ওঠে। সাদা ট্রানজিস্টারে মারফি গার্লকে হাতে ঝুলিয়ে এবার সে গুটি গুটি মায়ের পাশে। তখন মায়ের চোখদুটো হয়ত একটু জুড়ে এসেছে। মর্নিং স্কুল শুরু হয় ভোর ছ’টায়। কাকভোরে উঠে সংসারের কাজ সেরে স্কুলে পড়াতে যাওয়া। ঘুমের আর দোষ কী?
মেয়েটা সোজা মায়ের বুকে সেঁধোয়। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়, চুপটি করে শোনে বলিষ্ঠ, অসম্ভব ভারী এক পুরুষগলা একেবারে নিচের মন্দ্রসপ্তকে নেমে গিয়ে কেটে কেটে উচ্চারণ করে –
রূপ দেখতে তরাস লাগে, বলতে করে ভয়
কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়!
চবচবচব চিবিয়ে খেলে আপন পেটের ছেলে
লোহার ডিম, সোনার ডিম, কৃষাণ কোথায় পেলে…
প্রথম দু’লাইনে সুর প্রায় নেই বললেই চলে। গায়ক যেন ঈষৎ টেনে শুধু গানের কথাগুলিই বলে যাচ্ছেন! সুরহীন সে উচ্চারণে মেয়ের বুক ঢিপঢিপ, জাগছে গা ছমছমে এক অনুভূতি। সুর থাকলে এমনটা বোধহয় হতই না! ছোটো হলে কী হয়, এগুলো সে বুঝতে পারে।
মা হাসেন, “অংশুমান রায়চৌধুরি গাইছেন।”
মেয়েটা অবাক! ওমা, তাই তো?
ভাদর-আশিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা ঘাসে, মন আমার কেমন কেমন করে
ও বঁধু হে, আরো কি থাকিবে বাপের ঘরে?
এ গান তার খুব মনে আছে। ভারী আওয়াজে ঝুমুর, টুসু. ভাদু বড্ড মানায়। সেই গলাই হবে রাক্ষসের গলা?
মা বলেন, “অংশুমানকে ঠিকই বেছেছেন সুরকার।”
বুঝুক না বুঝুক, সেও ঘাড় নাড়ে। মায়ের আঁচল ধরে শুয়ে শুয়ে অনুপ ঘোষালের গলায় শোনে –
রাক্ষসী সেই রানি, লোভে চকচক চোখ,
শুধু ভাবে রাত্তির হোক,
সতীনপুতের মুণ্ডু খাবে দিয়ে লংকা ঝাল।
তবলা বাজে ছয়মাত্রার তালে, কেমন একটা হালকা, উচ্ছল সুর, লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে।
কিন্তু না! একমুহূর্তেই সব বদলে গেল! রাক্ষসী রানির নিজের ছেলেই যে শত্তুর! সারাক্ষণ সতীনপুতের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। রানি তাহলে সতীনপুতের মুণ্ডু খাবে কী করে? রেগে কাঁই হয়ে খোনা গলায় যেই না চেঁচিয়েছে –
কী? আপন পেটের পুত্তুর? সেই হল শত্তুর?
তবে সতীনকে খাব, খাবখাবখাবখাবখাবখাব…
সঙ্গে সঙ্গে তবলার বোল ঢিমে হয়ে যায়, ছয়মাত্রার গতি থেকে মুহূর্তে চারমাত্রায়, কোমল স্বর একমুহূর্তে বদলে দেয় পরিবেশ, ঘনিয়ে আসে শংকার ছায়া –
তখন কালো ঘোমটার আড়ে উঁকিঝুঁকি মারে,
ও তার জিভ লকলক করে, যেন সতীন মরে!
রাজার হাতিশালে হাতি মরে রাতারাতি,
আর ঘোড়াশালে ঘোড়া, মরে জোড়া জোড়া।
রাত নিঝঝুম হলে –
‘হাঁউ মাউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ’ বলে
রাক্ষসী যায় সেথা, যেথা অজিত কুসুম ঘুমায়।
গা ছমছম করে, আর বুক কনকন করে,
গায়ের লোমে কাঁটা, চোখের পলক ভাঁটা!
উফ, মেয়েটার গায়ের লোমে সত্যিই কাঁটা দিচ্ছে। গীতিকার কী করে বুঝলেন? নিচে রইল সেই গান, নিজের গলায় গাওয়া।
গল্প এগোয়। অজিত আর কুসুম হয়ে ওঠে লালকমল, নীলকমল। নীলকমল খুঁজে বার করে তার নিজেরই মা রাক্ষসী রানির প্রাণভোমরা। মারবে তাকে।
মেয়েটার কেমন কান্না পায়। নিজের মাকে মেরে ফেলবে? মায়ের আঁচলটা ধরে ছোট্ট একটু টান দেয়।
“না মারলে রাজার রাজ্যের মানুষ সব উজাড় হয়ে যাবে না? রাক্ষসীকে তো মারতেই হবে!” মা ঘুমচোখে পাশ ফেরেন। শ্যামল মিত্র তখন গাইছেন –
যেই না এবার ভোমরাটার বুকে পড়ল ঘা
রাক্ষসী রানিমা মরে ধড়ফড়িয়ে গা!
তারপরে যেই ভোমরিটাকে মারল তরোয়ালে,
রইল না কেউ বেঁচে আর রাক্ষসের পালে, আর রাক্ষসের পালে…
গানের কথাগুলো কেমন ঝিমিয়ে আসছে, সুরে যেন দুঃখের ধূসর ছায়া। মেয়েটা চমকে ওঠে, তাহলে কি সুরকারও তারই মত ভাবছেন? বুকের মধ্যে কেমন এক চিনচিনে ব্যথা। মা মরে যাওয়ার পর নীলকমল কি একবারও কাঁদেনি তার মায়ের জন্যে? তার আইমার জন্যে? যে রাক্ষসী মায়ের দুধ খেয়ে তার গায়ে এত জোর, সেই মাকে মারতে গিয়ে মনে পড়েনি ছোটবেলায় পাওয়া মায়ের আদর?
নাহ, বড় উল্টোপাল্টা ভাবনা আসছে মনে। কুড়ি মিনিটের গীতিনাট্য শেষ। লালকমল আর নীলকমলের বিয়ে হচ্ছে রাজকন্যাদের সঙ্গে। মনকেমনিয়া এক সানাই বাজছে। মেয়েটা ছলছলে চোখে শুনছে ঠাকুরমার কাঁপা কাঁপা গলা, “আমার কথাটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল…”
ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল এবার। কই, দক্ষিণারঞ্জনের বই পড়ে তো এমন কান্না কোনোদিন পায়নি? তাহলে কি গান, সুর, লয়, তাল – এদের ক্ষমতা কাগজের পাতায় লেখা অক্ষরের থেকেও বেশি? গল্পের বইয়ের থেকেও বেশি মন ছুঁয়ে যায় গীতিনাট্য?
মা জেগে উঠেছেন, “আরে, আরে এ কী কাণ্ড!”
“আমি আর কোনোদিন লালকমল-নীলকমল শুনব না,” মেয়েটা ফোঁপাচ্ছে।
“সেই ভালো। নিজের মাকে মেরে ফেলা, এসব আবার কী বাপু?” মা মেয়েকে সান্ত্বনা দেন।
সেই ঠাকুরমার ঝুলি গীতিনাট্য শুনেই ছ’বছরের মেয়েটার মনে রূপকথার রং কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। কেন এমন হবে যে রাজামশাই ইচ্ছেমত রানিদের প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেবেন? কাউকে করবেন দুয়োরানি, সে হবে ঘুঁটেকুড়ুনি, আর সুয়োরানি রাখবে ‘সোনার খাটে পা, রুপোর খাটে গা?’ আবার সেই সুয়োরানিকেই একদিন ‘হেঁটোয় কাঁটা মাটিতে কাঁটা’ দিয়ে পুঁতবেন? রানিরা তাহলে শুধুই খেলার পুতুল? যেমন নাচাবে, তেমনি নাচতে হবে? এমন সব উল্টোপাল্টা ভাবনায় ছোট্ট মাথা বোঝাই। ছোটদের গীতিনাট্যই যেন মেয়েটাকে একটানে বড় করে দিল!
যতই ভাবনা আসুক না কেন, তা বলে রেডিও শোনায় কিন্তু ফাঁক পড়ে না। গানগুলো কী যে ভালো, আর গেয়েছেনও যাঁরা, তাঁদের গানের সে যে বড্ড ভক্ত! কতবার যে বাজে ঠাকুরমার ঝুলি, আর মেয়েটা একমনে শোনে। শুনতে শুনতে গান মুখস্থ, সুর মুখস্থ। মা অবাক হয়, “একই নাটক এতবার শুনিস কী করে?”
কী করবে সে? নতুন গীতিনাট্য পেতে যে ঝাড়া সাত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল!
ততদিনে সে স্কুলের উঁচু ক্লাসে। বাড়িতে ঠাকুরমার ঝুলির এল পি রেকর্ড কবেই কেনা হয়ে গেছে। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কালো রঙের ভাইনিল রেকর্ড। সে জেনেছে, ঠাকুরমার ঝুলির গীতিকার ভাস্কর বসু। যাঁর আসল নাম অরুণ কুমার বসু। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক। গীতিকার হিসেবে গান লেখেন ছদ্মনামে। তাঁর লেখা গানের কথায় মেয়েটা যেন মাটির গন্ধ পায়, বৃষ্টি পড়লে মাটির বুক ভিজে যে সোঁদা গন্ধ বেরোয়, সেইরকম।
সজলপুরের কাজল মেয়ে নাইতে নেমেছে,
চিকন চিকন চুলগুলি সে ঝাড়তে লেগেছে…
কিংবা,
যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনা লীলাবতী,
কাজিতলার ঘাটে বাঁধা যমুনাবতীর নাও
ঘর করে আঁধার বালা কোন বিদেশে যাও…
যমুনাবতীর গানে জল আসে চোখে, খুব প্রিয় গান এগুলো।
সুর দিয়েছেন নচিকেতা ঘোষ, যাঁর পরিচয় আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ম্যাজিক দেখিয়েছেন সুর-তাল-লয় নিয়ে, গল্পের মুড ধরেছেন অসামান্য মুনশিয়ানায়। সঙ্গে মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে অলোকনাথ দে।
শিশুশিল্পীদের কেরামতিও কম নয়। কী অবলীলায় গলা মিলিয়েছে সন্ধ্যা-আরতি-হেমন্ত-শ্যামলের মত নক্ষত্রের সঙ্গে! সুর একচুল এদিক ওদিক হয়নি, তাল কাটেনি। মেয়েটা খুঁজে খুঁজে বার করেছে তাদের নাম। বুদ্ধুর মিষ্টি গলার পিছনে আছে রেশমা চৌধুরী নামের ছোট্ট মেয়ে। ভুতুমের গলায় গেয়েছে নচিকেতা ঘোষেরই ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ, যে বড় হয়ে হবে বিখ্যাত সুরকার!
সেই সুপর্ণকান্তিই আবার নীলকমল লালকমল গীতিনাট্যের লালকমল। নীলকমলের গান গেয়েছে মাস্টার অরিন্দম, যে পরে হংসরাজ ছবিতে অভিনয় করে মাতিয়ে দেবে। চাষির গলার লোকগানে নির্মলেন্দু চৌধুরি, সে তো শুনলেই বোঝা যায়! রাক্ষসের গলায় এক ও অদ্বিতীয় অংশুমান রায়চৌধুরি, আর কেই বা গাইতে পারবেন এমন! সঙ্গে খোনা গলায় সাথ দিয়েছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরি, চন্দ্রকান্ত শীল। রাক্ষসীর গলায় জানকী দত্ত। পুরো গীতিনাট্যের বুনোটটি ধরে রেখেছেন অনুপ ঘোষাল, শ্যামল মিত্র, কাজী সব্যসাচী, আর সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সবার ওপরে যিনি, সেই ঠাকুরমার কাঁপা কাঁপা গলাটি আশা দেবীর।
গানের এই দলটিই মাতিয়ে রেখেছিল মেয়েটার ছোটোবেলা। তার বড় হওয়াও যে এদেরই সঙ্গে।
তাই উনিশশো সাতাত্তর সালে যখন সেই একই হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে ‘হিংসুটে দৈত্য’ রিলিজ করল, তখন প্রত্যাশার পারদ একেবারে তুঙ্গে। কেমন হবে সে গীতিনাট্য? ঠাকুরমার ঝুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে তো?
সব কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে এক মঙ্গলবারের দুপুরে রেডিওতে বেজে উঠল কিবোর্ডে সুরের টুকরো, ভাস্কর বসু এবার গাঁটছড়া বেঁধেছেন আরেক সুরের নক্ষত্র সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে। চার-চার প্যাটার্নে সুরের কম্পোজিশন, তবলার ঢিমে তাল, এবার মান্না দে হয়েছেন গল্পদাদু।
শোনো বসে চুপচাপ, শোনো এক গল্প
গল্পটা বড় নয়, নয় খুব অল্প”
কিবোর্ড সুর তুলছে, রে ধা মা রে – রে নি পা গা, রে ধা মা রে – রে নি পা গা।
ও মা, এ তো বিদেশি সুরের কর্ড প্রোগ্রেশনের মত! মেয়েটা বুঝতে পারছে সুরকারের চিন্তা, কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছেন শ্রোতাকে। পরে সে আরও বেশি করে চিনবে সুরকার সুধীন দাশগুপ্তকে, জানবে বিদেশি সুরকে কী অনায়াসে তিনি গানে মিশিয়ে দিতেন! তখন বুঝবে, কেন অস্কার ওয়াইল্ডের রূপকথায় সুর দিতে সুধীন দাশগুপ্তকে আনা হয়েছিল। আপাতত তার কান খাড়া, কারণ মান্না দে গল্প শোনাচ্ছেন –
কোনো এক রাজ্যে ছিল এক দত্যি,
কথাটা মিথ্যে নয় একদম সত্যি”
আবার কিবোর্ড – রে মা ধা রে – সা ধা পা গা, রে মা ধা রে – সা ধা পা গা…
তার ছিল সুন্দর বাগান এক মস্ত
ফুলে ফলে গাছে ছিল সাজানো সমস্ত
নি পা গা নি – ধা গা সা ধা, নি পা গা নি – ধা গা সা ধা – কিবোর্ড বিদেশি সুরের ছায়া ফেলে যাচ্ছে!
আর ছিল পশুপাখি নানা জীবজন্তু,
সে বাগানে হাসিখুশি ছিল না কো কিন্তু -“
কেন? সে তো আমরা সবাই জানি!
দিত না সে বাগানে ছোটদের ঢুকতে,
লুকোচুরি খেলতে কি গাছে গাছে উঠতে!
ছিল না তাদের মনে সুখ একরত্তি,
হিংসুটে, ভারি হিংসুটে সেই দত্যি…
সম্মোহন গ্রাস করে নিচ্ছে, বড় হয়ে যাওয়া মেয়েটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে রূপকথার দেশে। সে কোন দূর বিদেশের এক বাগানে, যেখানে সারাবছর দাপিয়ে বেড়ায় শিলাবৃষ্টি, ঘন তুষারে চাপা পড়ে মাটির বুক, শুকনো ডালের ফাঁকে কনকনে উত্তুরে হাওয়া বয়, পাখি গায় না গান। মান্না দে’র হাতটা শক্ত করে ধরে মেয়েটা ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে থাকে উষ্ণতার দিকে, উত্তাপের দিকে। জানে, পথের শেষে ঠিকই মিলে যাবে বরফ গলে যাওয়া এক রঙিন বসন্ত।
লেখকের বক্তব্য: দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের বইয়ের নাম যদিও ‘ঠাকু’মার ঝুলি’, HMV থেকে প্রকাশিত LP রেকর্ডে কিন্তু গীতিনাট্যের নাম দেওয়া আছে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। এই লেখায় তাই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ নামটিই আগাগোড়া ব্যবহার করা হয়েছে।
লেখায় ব্যবহৃত গানগুলি লেখকের স্বকণ্ঠে গাওয়া।
তথ্যসূত্র:
হিজ মাস্টার্স ভয়েস LP রেকর্ড: (১)ঠাকুরমার ঝুলি (১৯৭০); (২)হিংসুটে দৈত্য (১৯৭৭)।
ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।
2 Comments