অর্ধেক আকাশ ও যাতনাসংহিতা

অর্ধেক আকাশ ও যাতনাসংহিতা

‘আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে…’

(ঘোড়া-জীবনানন্দ)

প্রথম দৃশ্য-
আমার দ্বিতীয় কন্যাটি যখন জন্ম নিয়েছিল, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রণায় কাতর তার মায়ের আধো আধো মনে পড়ে। ডাক্তারের সহযোগীরা নাকি বলছিলেন, ‘মত বতাও। দুসরি বেটি হুই হ্যাঁয়। ফির বেহোশ হো জায়গি।’ মা বুঝতে পারেন মেয়ে হয়েছে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টায় বলতে চান, ‘মুঝে অপনি বেটি কো দিখাইয়ে।’ ওটি’র কুশলীরা তখন শিশুটিকে মা’কে দেখান। স্বাস্থ্যবান, প্রফুল্ল একটি শিশু। নন্দনের সংবাদ নিয়ে এসেছে মায়ের কোলে।

দ্বিতীয় দৃশ্য-
মা ও শিশু’কে যেদিন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়, তার বাবা সন্ধেবেলা সেই ডাক্তারের বাড়ি যান, যাঁর চিকিৎসায় মায়ের গর্ভাবস্থা কেটেছিলো। এক বাক্স মিষ্টি হাতে। তিনিও দুই মেয়ের মা। আমাদের পূর্ব পরিচিত। দরজা খুলে আমাকে দেখে বলেন ‘কী ব্যাপার? শ্রাবণী কেমন আছে?’ আমি বলি ভালো আছে। মিষ্টির বাক্সটি বৈঠকখানার টেবিলে রাখি। তিনি সপ্রশ্ন চোখে তাকান আমার দিকে।
বলি, ‘মেয়ে হয়েছে। তিন দশমিক আট কেজি। দুজনেই ভালো আছে। আজ ছেড়ে দিলো।’
ডাক্তার উদ্ভাসিত মুখে আমাকে বলেন, ‘একটা কথা বলি?’ আমি বলি, ‘নিশ্চয়ই।’ তিনি বলেন, ‘ত্রিশ বছর প্র্যাকটিস করছি। এই প্রথম দেখলাম দ্বিতীয় মেয়ে হবার পর বাবা মিষ্টি নিয়ে এলেন। আশীর্বাদ করি আপনার মেয়ে যেন জীবনে অনেক দূর যায়।’

তৃতীয় দৃশ্য-
তখন জামশেদপুরের একটা ছোটো ব্রাঞ্চে ম্যানেজারের দায়িত্বে। সরকারি অফিসের একটা আকর্ষণ হল প্রতিদিন নানা মানুষের দেখা পাওয়া যায়। একদিন জনৈক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমার চেম্বারে ঢুকলেন। বলি, ‘বসুন।’ তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘কিছু টাকা রাখবো। একটা খাতা খুলে দেবেন?’ বলি, ‘নিশ্চয়ই। আপনি বাইরে অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেবের কাছে যান। আমি বলে দিচ্ছি।’
‘না, না, ওখানে খুব ভিড়। আপনিই একটু সাহায্য করুন।’
অনুমান করি, তিনি নিশ্চয়ই পেশায় ব্যবসায়ী। একটি ছেলেকে ডাকি। তাঁর কাজটি আমার সামনে বসেই করে দিই। তিনি নগদে জমা করেন তিন লাখ টাকা। তিরিশ-বত্রিশ আগেকার কথা। তখন ও টাকার দাম ছিল।
বলি, ‘ম্যাডামকে নিয়ে আসবেন। খাতাটা দুজনের নামে থাকা দরকার।’
একটু দোনামোনা করে তিনি রাজি হয়ে যান। কয়েকদিন পরে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে আসেন। আরও বেশ কিছু টাকা জমা করেন।
আমি বলি, ‘এত টাকা। সেভিংসে রাখবেন না। আমি ফিক্স করে দিচ্ছি।’
তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘ম্যানেজার সাহেব এক্ষুনি করে দিন। এঁকে বললে বলেন শেষে টাকাটা আটকে যাবে।’
তখন ভদ্রলোক বলেন, ‘এই টাকাগুলো’ই তো সম্বল। আমার তো কোনও সন্তান নেই।’
স্ত্রী তাঁর মুখের দিকে তাকান। তার পর আমাকে বলেন, ‘আমাদের চারটি মেয়ে আছে।’
আমি ভদ্রলোককে একটু ভর্ৎসনার সুরেই বলি, ‘কী যা তা বলেন মশাই। বাড়িতে চারটি লক্ষ্মী।’
তিনি একটু বিপন্ন মুখে বলেন ‘পুত্র না হলে আর সন্তান কীসের?’

চতুর্থ দৃশ্য-
তখন পাটনায়। অফিস থেকে ফিরতে যত দেরিই হোক না কেন, সন্ধেবেলা হাঁটতে বেরোনোর অভ্যেসটা ছাড়তে পারি না। ফেরৎ পথে রোজ দেখি আমার এক সহকর্মী, কাছেই থাকেন, বালক পুত্রটিকে নিয়ে একটি মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে মিষ্টি খাচ্ছেন। তিন মেয়ের পর ছেলে। তিনি চোখে হারান।
আমি বলি, ‘ক্যা বাত হ্যাঁয়। অভি মিঠাই খা রহে হ্যাঁয়।’
তিনি বলেন, ‘মেরা বেটা কো হর শাম মিঠাই চাহিয়ে। উস লিয়ে আনা পড়তা।’
বলে নিজেই আরো একটি মিষ্টি গলাধঃকরণ করলেন।
আমি বলি, ‘বেটি লোঁগ আয়ি নহি।’
তিনি নাক দিয়ে একটা ফুৎকারের মতো শব্দ করে বলেন, ‘উতনা প্যয়সা নহি মিলতা।’

পঞ্চম দৃশ্য-
বাবা’র এক পরিচিত ভদ্রলোক ছিলেন। পেশায় শিক্ষক। ভাগলপুরের বাবুসাব। মানে রাজপুত জাতির লোক। এম-এ, এম-এড। বয়সে বাবার থেকে ছোটো’ই হবেন। কিন্তু ষোলো-সতেরো বছর বয়সে বিয়ে-থাওয়া হয়ে যাওয়ায় তাঁর বড়ো মেয়ের বয়স তখন বাইশ-তেইশ। তার পর আরও চার মেয়ে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আমর তখন বাল্য বয়স। একদিন সন্ধেবেলা দেখি ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছেন। ভদ্রলোকের চোখমুখ বিপন্ন। তাঁর স্ত্রী, পাঁচ মেয়ের মা রীতিমতো কান্নাকাটি করছেন। আমাদের বৈঠকখানার দরজা বন্ধ করে কিছু আলোচনা চলছে। সরাসরি তো কিছু জানা যাবে না। বাবা-মার টুকরো টুকরো আলোচনা থেকে বুঝতে পারলুম শিক্ষক মশায়ের পিতাঠাকুর আল্টিমেটাম দিয়েছেন পুত্রসন্তান না এলে তাঁরা ছেলে’র আবার বিয়ে দেবেন। একবছর সময়। ইতোমধ্যে তাঁর দ্বিতীয় কন্যারও বিবাহ সম্পন্ন হলো। এখন কী করা যায়?

কী আর করা? সেই ভদ্রমহিলা আবার অন্তঃসত্ত্বা হলেন। এবার তাঁর বড়ো মেয়ের সঙ্গে। অনেক ঠাকুরদেবতা ঘুষঘাস পেলো। শেষে তিনি একটি পুত্রসন্তানের মা হলেন। তাঁর সপ্তম সন্তান। এক সন্তান শিশু বয়সে মারা গিয়েছিলো। সঙ্গে ডবল ইঞ্জিন ধমাকা। তাঁর বড়ো মেয়েরও একটি পুত্রলাভ হলো। সে বেচারারও প্রথম সন্তান মেয়ে। তাকেও নিত্য হুমকি শুনতে হত।

গত বছর দশেক ধরে যেসব ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ ভারতবর্ষের ইতিহাস নতুন করে লেখার প্রয়াস পাচ্ছেন তাঁদের বক্তব্য, এদেশে নারী নির্যাতনের পরম্পরা শুরু হয়েছে তুর্কি শাসনের সময় থেকে। সেই বৈদিক যুগ থেকে এদেশে ‘নারীজাতির সম্মান’ এতো বেশি ছিল যে আর্যজাতির পুরুষরা ঘরণীদের জন্য মন্দির বানিয়ে দিতেন। কারণ যেখানে নারীর পূজা হয়, সেখানেই দেবতার বাস। তাঁরা ‘দেবী’র সম্মান পেতেন। পাগলে কী না বলে? তাদের মার্জনা করা যায়। কিন্তু শয়তান অজৈব কিম্পুরুষদের কী আর বলা যেতে পারে?

গ্রহণযোগ্য ইতিহাসবেত্তারা বলেন, এদেশে ঋগ্বেদ সংকলিত হতে শুরু করে মোটামুটি বারোশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বৈদিক সাহিত্যের অর্বাচীনতম সংকলন ‘বেদাঙ্গসূত্র’ রচিত হয়েছিল আনুমানিক তৃতীয় থেকে পঞ্চম খ্রিস্টীয় শতকে। ঋগ্বেদ যখন থেকে সংকলিত হওয়া শুরু হয়, তখন থেকে ‘বেদাঙ্গসূত্র’-এর কালটি বৈদিক যুগ। অর্থাৎ, সতেরো থেকে আঠেরোশো বছর জোড়া এই সময়কালটি ছিল ভারতীয় জ্ঞানচর্চার আদিপর্ব।

বেদাঙ্গ মানে বেদের পরিশিষ্ট অংশ। বেদ-কে ঈশ্বরকথিত ‘শ্রুতি’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বেদাঙ্গ মানুষের সৃষ্টি। এই জন্য বেদাঙ্গ প্রভৃতি শাস্ত্রগুলিকে ‘শ্রুতি’ নয়, ‘স্মৃতি’ বলা হয়। ‘স্মৃতির ছয়টি শাখার নাম ‘কল্প-সূত্র।’ তার মধ্যে ‘কল্প-সূত্র’-এর তিনটি সূত্রে তিন রকম বিষয় নিয়ে চর্চা করা হয়েছে। যথা, যজ্ঞ ও বলি প্রথা নিয়ে ‘শ্রৌত-সূত্র।’ গার্হস্থ্য রীতিনীতি নিয়ে ‘গৃহ্য-সূত্র’ এবং জীবনযাপন প্রণালী নিয়ে ‘ধর্মসূত্র।’

সঙ্গত কারণেই সতেরো-আঠেরোশো বছর ব্যাপী দীর্ঘসময়ে সমাজে নারীদের অবস্থান একই রকম ছিল না। প্রথম যুগে নারীদের দায়িত্বের মধ্যে নানা ধরনের গৃহকর্মের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে অংশগ্রহণও ছিল। সে সময় দেব ও পিতৃগণকে জল দেবার সময় তিনজন নারীর উদ্দেশেও জল নিবেদন করা হতো। ঋষি বশিষ্ঠের পত্নী অরুন্ধতী সবার শ্রদ্ধেয় ছিলেন। আর্য বসবাস শুরু হবার পর প্রথম কয়েক দশক নারীর উপনয়ন ও স্বাধ্যায়ের অধিকার ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আর্যজাতির পুরুষরা আর্যেতর জাতির নারীদের পত্নী হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করে। বিবাহ করলেও অনার্য নারীদের জন্য ‘পবিত্র পাঠ্য’ ও স্বাধ্যায়ের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। আর্য মুনিঋষিরা তাঁদের কন্যাদের বিবাহপূর্ব জীবনে শাস্ত্রশিক্ষা দিতেন। গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপালা, ঘোষা, গোধা প্রভৃতি ঋত্রির নাম শোনা যায় বটে, কিন্তু তাঁদের অধিকার ক্ষেত্রটি বিস্তৃত ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ, তর্কে কোণঠাসা হয়ে যাবার পর ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য পত্নী গার্গীকে বলেছিলেন, ‘স্তব্ধ হও, নচেৎ তুমি শিরচ্যুত হবে।’ সে সময় যাবতীয় আচার অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল পুত্রসন্তান লাভ।

বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের সময় থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীশিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। শিক্ষিতা নারী সম্বন্ধে কটাক্ষ করে বলা হতে থাকে ‘আসলে পুরুষ’ এবং মেয়েদের ‘শ্বশুরকুলের সম্রাজ্ঞী হও’ বলে আশীর্বাদ করার প্রথা শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, বৈদিক যুগের প্রথম দুই শতকের মধ্যেই সমাজে নারীদের ভূমিকা গৃহকোণের ভিতর সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। না মনের উপর, না দেহের উপর তাঁদের কোনও অধিকার ছিল। শিক্ষার অধিকার হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবন দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। পিতৃগৃহ ও শ্বশুরগৃহ। বিবাহিতা নারী কোনও কারণে পিতৃগৃহে গেলে লোকনিন্দা হত। বেদাঙ্গ রচনার কালে নারীর পিতৃগৃহে ফিরে আসার ঘটনা বা অবিবাহিতা কন্যাদের প্রতি সমাজের কঠোর মনোভাব নেওয়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। কন্যাসন্তানকে ‘দায়’ বলে ভাবার মনোবৃত্তি এই যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল। ঋগ্বেদের কালে সতীদাহের প্রচলন ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ তখন বিধবা নারীর দেবরের সঙ্গে বিবাহ প্রশস্ত মনে করা হত, যেহেতু নারীর অস্তিত্বের প্রধান কারণ ছিল ‘বংশবৃদ্ধি।’ দেখা যায়, অথর্ববেদের সময় থেকে সহমরণ ও সতী দাহ করার প্রথা শুরু হয়েছিল। যদিও ইন্দো-য়ুরোপিয় আর্যজাতির মধ্যে সতীদাহের কোনও প্রচলন ছিল না। কিন্তু ভারতবর্ষে তার প্রকোপ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে নারীর বহুবিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। কারণ বিবাহিত নারীকে যদি কোনও ব্রাহ্মণ কামনা করতো তবে বিবাহে বাধা ছিল না। অন্যদিকে পুরুষের দারপরিগ্রহে কোনও বাধা ছিল না। চারটি বিবাহ বৈধ ছিল এবং তার উপরেও রাজাদের অসংখ্য বিবাহ ও উপপত্নী গ্রহণ সাধারণ ব্যাপার ছিল। প্রসঙ্গত, শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে ব্যক্তির সমৃদ্ধি বিচার হয় যখন কারও গোধনের সংখ্যা স্ত্রীধনের থেকে অধিক হওয়ার নিরিখে। স্পষ্ট বোঝা যায় সামাজিক বিধি অনুযায়ী একজন পুরুষের অসংখ্য নারীর প্রভু হবার অনুমতি ছিল। এই সেদিন পর্যন্ত বাংলায় কুলীন ব্রাহ্মণদের এই রীতি অনুসরণ করে চলার ইতিহাস পাওয়া যায়।

মহাভারতে ‘সতী’ স্ত্রীর লক্ষণ ধার্য করা হয়েছে। যে পত্নী স্বামীকে তুষ্ট করতে পারে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর সঙ্গে কদাপি তর্ক করে না, সে-ই সতী। বলা হয়েছে, পুরুষের সম্মুখে নারীর ভোজন অনুচিত কার্য। ‘উত্তমার্ধ’ হলেও ধর্মাচরণে নারীর প্রত্যাশিত স্বাধীনতা ছিল না। নারীর জন্য কোনও রকম মন্ত্রোচ্চারণ নিষিদ্ধ কর্ম ছিল। যজ্ঞে আহুতি দেবার অধিকারও ছিল না নারীর। তার প্রধান কর্তব্য পুত্রের জন্ম দেওয়া। সেই কাজে বিফল হলে পত্নীকে ত্যাগ করার বিধান ছিল। শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের জন্ম দিলে বারো বছর পরে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা ছিল শাস্ত্রসম্মত বিধান।

মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের নির্দেশ অনুযায়ী কোনও স্ত্রী যদি স্বামীর সম্ভোগ ইচ্ছা অস্বীকার করতে চায়, তবে স্বামী প্রথমে নরমভাবে বোঝাবে। তাতে ফল না পেলে উপহার কিনে দিয়ে আবার প্রয়াস করতে হবে। তাতেও যদি স্ত্রী অরাজি থাকে তবে হাত বা দণ্ড দিয়ে প্রহার করে স্ত্রীকে বশ করার অনুমতি আছে। অথর্ববেদে বলা হয়েছে, স্ত্রী পুরুষের ‘সঙ্গিনী।’ তবে গূঢ়ার্থে সেই স্ত্রী যতক্ষণ পুত্রের জন্ম দেয় ততক্ষণই সে এই সম্মানের অধিকারিণী। অন্যদিকে কন্যাসন্তানকে ‘অভিশাপ’ ও পুত্রকে ‘স্বর্গের আলোক’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

বৈদিক যুগ থেকেই নারীকে ‘পাপ’এর হেতু হিসেবে গণ্য করার প্রয়াস শুরু হয়ে যায়। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, নারী, কুকুর ও কালো পাখি (কাক) দেখা অমঙ্গল সূচক। কারণ এদের দেখলে পুণ্য ও পাপ, জ্যোতি ও অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যার জ্ঞান অবলুপ্ত হয়। যজুর্বেদের কালে বলা হতো ‘নারী আসলে মিথ্যামায়া। দুর্ভাগ্য, মদ ও জুয়ার মতো নেতিবাচী ব্যসন মাত্র।’ বেদাঙ্গসূত্রে বলা হয়েছে কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো, কুকুর, শূদ্র ও নারী হত্যার পর একদিন প্রায়শ্চিত্ত করলেই যথেষ্ট। তৈত্তিরীয় সংহিতা বলছে ‘সর্বগুণসমন্বিতা নারীও অপকৃষ্টতম পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট।’ এই শাস্ত্রেই বলা হয়েছে নারী সম্ভোগের হেতু। নিছক ভোগসামগ্রী। তার দেহ, শ্রম ও অস্তিত্ব শুধুমাত্র প্রভুর সন্তুষ্টির জন্যই নিবেদিত থাকে। তাকে কেনা যায়, বন্ধক রাখা যায়, দক্ষিণা-যৌতুক-উপহার হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

ভারত ইতিহাসের পরবর্তী পর্বে, অর্থাৎ, উত্তর-বৈদিক ও পুরাণযুগে এদেশের প্রধান স্মৃতিশাস্ত্রটি সংকলিত হয়েছিলো। এই উপমহাদেশের আর কোনও দৈবী শাস্ত্রগ্রন্থ এমত গগনচুম্বী প্রভাব বিস্তার কদাপি করতে পারেনি। সংগ্রহটির নাম ‘মনুস্মৃতি’। সংকলিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

‘মনুস্মৃতি’ সংকলিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

যতদিন গেছে, ভারতীয় সমাজে মনুস্মৃতির বিধান মতো বর্ণাশ্রমী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব দৃঢ়তর হয়ে উঠেছিলো। এই সংকলন উক্ত নির্দেশগুলিকে এদেশে নারী ও শূদ্র জাতির অবমাননার গ্রন্থিত উৎস বলা যায়। এর পাপ এখনও ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে বহন করে চলতে হচ্ছে। বেদাঙ্গের গৃহ্যসূত্রই মূলত ‘মানবধর্মশাস্ত্র’ বা ‘মনুস্মৃতি’র ভিত্তি। অধিকাংশ সূত্রই অবলুপ্ত হয়ে গেছে। মোটামুটি ভাবে চারটি সূত্র উদ্ধার করা গিয়েছিলো। যথা, আপস্তম্ব, গৌতম, বৌধায়ন, এবং বশিষ্ঠ সূত্র। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত আরও অনেক গৃহ্যসূত্র আংশিক ভাবেও পাওয়া গেছে। উত্তর বৈদিক যুগে নারীজাতির অবস্থা ও সম্মান বুঝতে গেলে এই সূত্রগুলিই প্রধান আকর সংকলন।

ঋষি ও তাঁর শিষ্যবৃন্দ, ব্রহ্মেশ্বর, ভুবনেশ্বর, একাদশ শতক

মনুস্মৃতির ভিত্তি বর্ণাশ্রমী সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এদেশে গৌতম বুদ্ধের আমল থেকেই শুরু হয়ে যায়। সম্রাট কনিষ্কের কাল থেকে আর্যধর্মের মূলস্রোত ব্রাহ্মণ্য ও মহাযানী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু পুরাণযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় মহাযানী বিশ্বাসের ভাঁটার দিন আসে। তবু সমাজে বিকল্প সমতাবাদী ধারা প্রচলিত ছিল। বর্ণাশ্রমী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী প্রয়াস শেষ হয়ে যায়নি কখনও। একেবারে আধুনিক কালে ১৯২৭ সালে বাবাসাহেব আমবেদকর মনুবাদী মানসিকতার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে ‘মনুস্মৃতি’র একটি সংকলন অগ্নিসমর্পণ করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতীয় সংবিধানের একটি প্রস্তাবিত মুসাবিদা পেশ করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসি নেতৃত্ব এই মুসাবিদাটি অতি মাত্রায় রাডিক্যাল মনে করে স্বীকার করে না। ১৯৪৫ সালে তেজবহাদুর সপ্রু কমিটি গঠিত হয়। তাঁদের প্রস্তাবটি আসে ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭ সালের ২৯শে অগস্ট বাবাসাহেব আমবেদকরের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি ভারতীয় সংবিধান রচনার দায়িত্ব পান। ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে সেটি পেশ করা হয়। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সেটি গৃহীত হয়।

আমবেদকরের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি ভারতীয় সংবিধান রচনার দায়িত্ব পান।

এই সংবিধানের আদর্শ ছিল ফরাসি ও আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ-উত্তর মুক্ত সমাজের উপলব্ধি ও ইংরেজদের সংসদীয় ঐতিহ্য। এছাড়া সঙ্গে ছিল ভারতবর্ষের নানা স্থানীয় আইন কানুনের পরম্পরা। এই সমস্ত আদর্শের মুখ্য অভিমুখ ছিল দেশের প্রতিটি মানুষকে সমান মাত্রায় অধিকার অর্পণ করা। ভারতীয় সংবিধানের মূল উদ্দেশ্য এদেশ থেকে দু’হাজার ধরে চেপে বসা মনুস্মৃতি নির্দেশিত ভারতীয় বর্ণাশ্রমী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে লোপ করা। আইনগত ভাবে বর্ণাশ্রমী ব্যবস্থা অবলুপ্ত হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এদেশে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়, অর্থাৎ সবর্ণ হিন্দু সমাজের কাছে দল নির্বিশেষে এই পরিবর্তন বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের শূদ্র ও নারী নির্যাতনের ‘ট্র্যাডিশন’ সমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই সমান প্রতাপে বহাল থাকতে দেখা যায়। সংবিধান প্রবর্তনের পর চুয়াত্তর বছর কেটে গেলেও বর্ণাশ্রমী পরম্পরা ব্যবহার করে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যমে ভাঁটা পড়েনি। রাজনৈতিক সংরক্ষণে মনুবাদী আদর্শের প্রচার, প্রসার আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের বীজতলা। পিতৃতান্ত্রিক বর্বরতার ধাত্রীগৃহ।

‘মনুস্মৃতি’ সংকলনটি প্রায় ছ-সাতশো বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরোহিততন্ত্র ও রাজশক্তির সমবায়ে গ্রন্থিত হয়েছিল। এর বহু ধরনের সংস্করণ রয়েছে। কখনও বিপরীতমুখী, কখনও স্ববিরোধী। কিন্তু শূদ্র ও নারী নির্যাতনের প্রশ্নে সব শেয়ালেরই এক রা। আমাদের দেশে ‘মনুস্মৃতি,’ পণ্ডিত কুল্লুকভট্ট ও তাঁর অনুগামীদের প্রস্তাবিত ধারাটিই অনুসরণ করে। এই বিপুল শাস্ত্রগ্রন্থটি বিশদভাবে অধ্যয়ন করা শ্রম, সময় ও অধ্যবসায় সাপেক্ষ। শুধু মাত্র নবম অধ্যায়টি পাঠ করলেই নারীজাতি সম্পর্কে বর্ণবাদী পুরোহিত শ্রেণির মনোভাবটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটির উল্লেখ করা যায়। যথা,

পৌংশ্চলাচ্চলচিত্তাচ্চ নৈঃস্নেহ্যচ্চ স্বভাবতঃ।
রক্ষিতাযত্নতোহপীহ ভর্তৃষবেতাবিকুর্বতে।।'(৯ / ১৫)

(স্ত্রীলোক স্বভাবত পুংশ্চলী। যে কোনও পুরুষ মানুষ চোখে পড়লেই এদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। সেই পুরুষের সঙ্গে কীভাবে সম্ভোগ করবো- এই চিত্তবিকারে ভোগে। তাদের চিত্ত চঞ্চল হওয়ার জন্য ধর্মকার্য বা কোনও শুভ উদ্যমে চিত্তের স্থিরতা দেখা যায় না। উপরন্তু তারা স্নেহহীন। এসব কারণে যত্নসহকারে রক্ষা করা হলেও তারা স্বামীর প্রতি বিরূপতা পোষণ করে।)

অথবা,

নাস্তিস্ত্রীণাং ক্রিয়ামন্ত্রৈরিতি ধর্মেব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়াহ্য মন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।। (৯/১৮)

(নারীদের মন্ত্রপাঠ বা জাতকর্ম করার কোনও অধিকার নেই। ধর্মব্যবস্থা এই কথাই বলে। স্মৃতি বা বেদ ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্র বা মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই। এই কারণে শাস্ত্র অনুযায়ী নারী জাতি মিথ্যা ও অপদার্থ।)

বোঝা যায়, উত্তর ভারতে কথায় কথায় মেয়েদের ‘অওরত জাত’ বলে উপেক্ষা করার রীতি এই সব উক্তি থেকেই শক্তি সংগ্রহ করে। নারীজাতির স্বাধীনতাকে মনুস্মৃতিতে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‌্য অর্জন করতে দেওয়া অনুচিত কার্য। যথা,

অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃকার্যাঃ পুরুষৈ স্বৈর্দিবানিশম্।
বিষয়েষুচ সজ্জন্তঃ সংস্থাপ্যা আত্মনোবশে।।(৯/২)

(‘আত্মীয় পুরুষ’, অর্থাৎ পিতা, স্বামী, পুত্র ইত্যাদি পুরুষদেরই নারীদের রক্ষা করার অধিকার আছে। নারীদের দিন ও রাত্রির মধ্যে কোনও সময়েই স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করতে দেওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ স্ত্রীলোকেরা যেন নিজেদের ইচ্ছামতো ধর্ম, অর্থ ও কাম প্রভৃতি কর্মে প্রবৃত্ত না হয়। অস্যার্থ, নারীরা যদি সঙ্গীত-বাদ্য বা অন্যান্য কাজে আসক্ত হতে চায় তবে তাদের নিবৃত্ত করে নিজের (পুরুষের) বশে রাখতে হবে)

মনুস্মৃতির সর্বত্র নারীর মৌল, প্রকৃত প্রস্তাবে একমাত্র কর্তব্য হিসেবে পুত্রসন্তানের জন্ম ও প্রতিপালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু এসেছে অতিথিসেবার দায়িত্ব। মনে হতে পারে তালিবান ঐতিহ্য শুধু আফগানিস্তানের একচেটিয়া অধিকার নয়। তবে এখানেই শেষ নয়। সন্তান উৎপাদনযন্ত্র হিসেবে নারীকে একতরফা ব্যবহার করার বিধানও মনুস্মৃতির জরুরি অংশ।

উৎপাদনমপত্যস্য জাতস্য পরিপালনম্।
প্রত্যহং লোকযাত্রায়াঃ প্রত্যক্ষং স্ত্রীনিবন্ধনম্॥ (৯/২৭ )

(নারীজাতির (অস্তিত্বের) প্রত্যক্ষ কারণ সন্তানোৎপাদন, জাতসন্তানের প্রতিপালন ও প্রত্যহ অতিথিসেবা জাতীয় লোক-ব্যবহার।)

মনুস্মৃতির নির্দেশ অনুযায়ী সন্তানের প্রতি মায়ের অধিকার পরোক্ষ। সন্তানের অধিকার পিতারই অধিগত থাকে। কারণ, ক্ষেত্র বা যোনি এবং বীজের মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ।

বীজস্যচৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।
সর্বভূত প্রসূতির্হি বীজলক্ষণ লক্ষিতা।।’ ((৯/৩৫)

(বীজ এবং যোনি এই দুই বস্তুর মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ। কারণ, সর্বত্র সন্তানের মধ্যে বীজের লক্ষণই লক্ষিত হয়)

বিবাহের ক্ষেত্রে বয়স নির্দেশ করার মধ্যে পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস দেখা যায়। বিবাহকালে পুরুষের বয়স নারীর তিনগুণ হওয়াই প্রশস্ত বলে বিবেচিত হয়েছে।

ত্রিংশদ্বর্ষোদ্বহেৎ কন্যাং হৃদ্যাংদ্বাদশবার্ষিকীম্।
ত্র্যষ্টবর্ষোহষ্ট বর্ষাংবাধর্মেসীদতি সত্বরঃ।। (৯/৯৪)

(ত্রিশ বৎসর বয়সের পুরুষ বারো বৎসর বয়সের মনোমত কন্যাকে বিবাহ করবে। চব্বিশ বছর বয়সের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। এটাই উভয়ের বিবাহযোগ্য কাল বলে মনে করা হয়। তিনগুণ অধিক বয়সের পুরুষ একগুণ বয়স্কা কন্যাকে বিবাহ করবে। এর থেকে কম বা বেশি বয়সে বিবাহ করলে ধর্ম নষ্ট হবে)

বিভিন্ন মন্দির ও গুহাতে অঙ্কিত  কিছু ছবি নীচে উদাহরণ স্বরূপ পেশ করা হল। তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে কিছু সাধারণ ধারণা পেতে সহায়তা করে জন্য।

আদিনাথ মন্দির, খাজুরাহ, একাদশ শতক
সপ্তমাতৃকা, রাবনফাড়ি গুহাচিত্র, ষষ্ঠ শতক
বাদামি গুহা, ষষ্ঠ শতক
বাদামি গুহা, ষষ্ঠ শতক

পুত্রসন্তান উৎপাদনের জৈব প্রয়োজন বাদ দিলে গত প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এদেশের পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি মানুষের নারীসত্ত্বার জন্য দুটি মাত্র মেরুবিন্দু নির্দিষ্ট করে রেখেছে। হয় ‘দেবী,’ নয় ‘বাঁদি।’ মনুবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক আখড়াগুলি নিজস্ব সুবিধে অনুসারে এই দুই বিন্দুর মধ্যে দোলাচল চালিয়ে যায়। এ বিষয়ে উত্তর বা দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির ধ্বজাধারীদের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। প্রয়োজন পড়লে পলিটিক্সওয়ালা’রা মনুস্মৃতিরই একটি উক্তির সন্দর্ভ নিয়ে আসে। যথা,

যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতাঃ।

(যেখানে নারীর পূজা হয়, সেখানে দেবতারা বাস করেন)

আবার প্রায় একনিঃশ্বাসেই তারা বলতে পারে,

নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিস্তিঃ
সুরূপং বা বিরূপংবা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে॥ (৯ /১৪)

(এরা (নারীরা) রূপ বিচার করে না, (যৌবনাদি) বয়সে এদের আদর নেই, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে।)

‘দেবী’ ও বাঁদি’র নির্দিষ্ট ঘেরাটোপের বাইরে থাকেন শতকরা নিরানব্বই জন নারী। যাঁদের পরিচয় শুধু মাত্র মানব, যাঁরা মানুষের মৃত্যুর পরেও রয়ে যান। কিন্তু শুধু এদেশের সামাজিক ব্যবস্থা নয়, সারা বিশ্বের মানবিক স্পেসে দেখা যায় তাঁদের অধিকার এখনও সীমাবদ্ধ। যাবতীয় আধ্যাত্মিক বিচারের পরিসরে অর্ধেক আকাশের ভূমিকা এখনও উপযুক্ত স্বীকৃতি পায়নি। মনুস্মৃতি না হয় দু হাজার বছর পুরোনো ডিসকোর্স। তথাকথিত ‘আলোকপ্রাপ্ত’, ‘প্রগতিশীল’ তকমায় উদ্ভাসিত-অহম বাঙালি জাতি, এপার বা ওপারে, নিজস্ব আধ্যাত্মিক পরিসরে এই মুহূর্তেও নারীদের কীভাবে রূপায়িত করেন? গুরুজি-বাবাজি অথবা মওলবি-হুজুরদের মধ্যে আপাতভাবে যতই লাঠিবাজি চলুক না কেন, নারীসত্ত্বার সমান অধিকার ও স্বীকৃতির প্রশ্নে তাঁরা বিস্ময়কর ভাবে একই বিন্দুতে অধিষ্ঠান করেন।

প্রাচীন বা অর্বাচীন, যে সভ্যতাই হোক না কেন, তার মানচিত্র আঁকা হয় পুরুষকেন্দ্রিক কলমে। সেই জন্য নারীকেন্দ্রিক ভাবনাগুলির মধ্যে প্রতি পদে দ্বিচারিতা চোখে পড়বে। প্রাচীন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস-কেন্দ্রিক সভ্যতাগুলির কথা যদি ছেড়েও দিই, নারীদের ভোটাধিকার পেতে ‘উদারবাদী’ ‘নতুন বিশ্ব’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় দেড়শো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

উদার অর্থনীতির যুগে সারা বিশ্বকেই ‘একটি গ্রাম’ হিসেবে প্রচার করা হয়। তবে এই মতের উদ্গাতা ও প্রচারক কিন্তু স্বার্থপরায়ণ ‘সর্বশক্তিমান’ বণিক সংস্কৃতি। সার্বভৌম বিশ্বে ‘অর্ধেক আকাশ-এর ন্যায্য অধিকার ও স্বীকৃতি নিয়ে বণিক শক্তিকে সরব হতে বিশেষ দেখা যায় না। বণিকদের প্রাথমিকতায় নারীসমাজের বৃহত্তর পরিচয় বিশেষ কিছু নির্দিষ্ট ভোগ্যপণ্যের অনুগত ক্রেতা হিসেবেই বাঁধা রয়ে যায়। কিছু বিক্ষিপ্ত ব্যতিক্রমী ঘটনাক্রম বাদ দিলে মানুষজাতির অর্ধেক অংশের যাপন ও অভিজ্ঞতার খতিয়ানকে এখনও হয়তো ‘যাতনা-সংহিতা’ বলা যেতে পারে।

…যে সূর্য অয়নে নেই কোনো দিন,
– মনে তাকে দেখা যেত যদি
-যে নারী দেখেনি কেউ – ছ’সাতটি তারার তিমিরে
হৃদয়ে এসেছে সেই নদী।
তুমি কথা বল- আমি জীবন-মৃত্যুর শব্দ শুনি:
সকালে শিশির কণা যে-রকম ঘাসে
অচিরে মরণশীল হয়ে তবু সূর্যে আবার
মৃত্যু মুখে নিয়ে পরদিন ফিরে আসে।

(অনেক নদীর জল- বেলা অবেলা কালবেলা: জীবনানন্দ)

 

ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *