হাতিবাগানের ‘থ্যাটার’

হাতিবাগানের 'থ্যাটার': যেন এক স্বপ্নেগড়া কাগজের নৌকা

“অন্ধ জনে দেহো আলো,
মৃত জনে দেহো প্রাণ …
কে দেবে আলো? কে দেবে প্রাণ?”
(চরিত্র : মনমোহন মিত্র
অভিনেতা : উৎপল দত্ত
ছায়াছবি : আগন্তুক
পরিচালক : সত্যজিৎ রায় )

বেয়াদবের ডাইরি
— এই জানিস তো, এ বছর আমাদের বাড়ী থেকে নতুন নাটক হচ্ছে নীলদর্পণ, বাবা বলেছে এটা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প, স্বাধীনতার আগের যুগের কথা। দারুন অ্যাকশন আছে ফাইটিং আছে। হ্যাঁরে তোদের বাড়ীতে কোন নাটক হচ্ছে?
— দিদিমনি দেখুন ও আমাকে কী বলছে! নাটকের কথা জিজ্ঞাসা করছে!
— কী! নাটকের কথা! ক্লাসে বসে নাটকের কথা! এটা কি নাট্যশালা? সাহস তো মন্দ নয়! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা…”

এর পরেই কানমলা ও ঠাস ঠাস ঠাস চপেটাঘাত। কিন্তু আমার কী দোষ! আমি তো জানি সকলের বাবা থিয়েটার করে, সকলের বাবা ছবি তোলে (ফটোগ্রাফি)। কতই বা বয়স তখন আমার, মেরেকেটে বছর পাঁচেক কী ছয়। প্রাথমিক শ্রেণীর ছাত্র, ক্লাস ওয়ান বা টু তে পড়ি বড়জোর। কিন্তু নিয়মের নিগড় যে বড় শক্ত, তার নড়চড় হবার উপায় নেই। “অপরাধী জানিল না কী তাহার অপরাধ, বিচার হইয়া গেল।” স্মৃতি সততই সুখের। চল্লিশ বছর আগে বুকের মধ্যে ঢিলের মত জমাট বেঁধে থাকা সেই কষ্টের কথা মনে পড়লে আজ বেশ পুলক অনুভব করি বটে। আর যাকে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করতে দেখে সব দুঃখ এক লহমায় ভুলে যেতাম, মোহময় মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো আমার কৈশোর, বাল্য ও তারুণ্যের সেই সোনালি দিনগুলি, তিনি নট, নাট্যকার, পরিচালক ও সংগঠক শ্রী সুপ্রিয় পাঠক, স্বয়ং আমার বাবা। হ্যাঁ বাবার কথাই তো বলছি, যিনি সেই কোন ছেলেবেলায় আমার কানে যেন বীজমন্ত্র দিয়েছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সিনেমা, থিয়েটার – এ সবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, বলা ভালো হাতেখড়ি দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন জীবনের ঊষালগ্নে। ২০১১ সালের জুন মাসে ৭৭ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। এখনো কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাথে পুরোনো বইয়ের দোকানে সন্ধান করলে হয়তো কোনো কোনো নাটকের বইতে প্রথম রজনীর অভিনয় সূচিতে সুপ্রিয় পাঠক নামটি নজরে পড়তে পারে। বাবা নেই, সেই থিয়েটারের দল নেই, নেই নাটকের মহড়া দেওয়ার সেই জমজমাট সন্ধ্যাগুলি, এখন আছে শুধু রোমন্থন করার মতন উপযুক্ত কিছু মণিকণিকা। এই ‘নেই’ এর তালিকায় আরো অনেক কিছুই আজ আর নেই। এবার সেই মূল বিষয়ের অবতারণা করি।

শতাব্দীর সিকিভাগ
আমার জন্ম থেকে ২৫ বছর অর্থাৎ যৌবনের প্রারম্ভিক কাল পর্যন্ত কেটেছে সিকদার বাগান স্ট্রিটের ভাড়া বাড়ীতে যৌথ পরিবারের আবহে। অনাদি অকৃত্রিম উত্তর কলকাতা বলতে যা বোঝায় আমি আদতে সেই জায়গার বাসিন্দা। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় ও হাতিবাগান মোড়ের মধ্যবর্তী বিধান সরণির ট্রাম লাইন, ঠিক মাঝ বরাবর একদিকে শ্যামপুকুর স্ট্রিট, অন্যদিকে সিকদার বাগান স্ট্রিট। সেই সময় আমাদের বাড়ীর দেড় থেকে দুই কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ছিল এগারোটি সিনেমা হল ও সাতটি থিয়েটার হল। সামান্য কিছুটা এদিক ওদিক এগোলে, অর্থাৎ হাঁটা পথের দূরত্ব অতিক্রম করলে আরো দুটো সিনেমা হাউস ও পাঁচটা থিয়েটার অডিটোরিয়াম পাওয়া যেত। নিঃসন্দেহে সগর্বে ও সোচ্চারে বলার মতন পরিসংখ্যান বটে। একমাত্র বিলেতের ব্রড স্ট্রিটের সঙ্গে তুলনীয়, তা ব্যতীত এহেন অনন্যসাধারণ ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমাদের দেশে আর কোথায় আছে, আমার অন্তত জানা নেই। এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় যেহেতু থিয়েটার, তাই নাটকের প্রেক্ষাগৃহগুলির প্রসঙ্গে আসি। হাতিবাগানের মোড়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন স্টার থিয়েটার, বিধান সরণি ধরে একটু এগোলে স্কটিশ চার্চ স্কুলের আগেই পড়ছে রংমহল। তার ঠিক আগেই বাম দিকে যে রাস্তা চলে গেছে যার নাম রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট, সেই পথে দু’ পা এগোলেই বাম হাতে স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত বেদান্তমঠ আর ডান হাতে বটতলাথানা, ঠিক তার পাশেই বিশ্বরূপা থিয়েটার। আরো দু’ চার পা এগোলেই বয়েজ ওন লাইব্রেরি। এই গ্রন্থাগারের নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ আছে, খুব ছোট্ট কিন্তু ইউথ কালচারের জন্য খুবই উপযোগী। আরো কিছুটা সোজা গেলেই বাম দিকে সারকারিনা ও তার পাশে বিজন এবং উল্টো দিকে রঙ্গনা থিয়েটার। অর্থাৎ মাত্র দশ বারো কি সর্বাধিক পনেরো মিনিটের ব্যবধানে সাতটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল এক সময়। এছাড়া বাগবাজারে গিরিশ মঞ্চ, বিডন স্ট্রিটে মিনার্ভা থিয়েটার, মানিকতলা মোড় থেকে বাগমারি সেতু পার হলেই বাম দিকে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ, আবার ঐ মানিকতলা মোড় থেকেই শিয়ালদহের দিকে এগোলে সুকিয়া স্ট্রিট মোড়ে এ পি সি রোডের ওপর রামমোহন লাইব্রেরি মঞ্চ। রাজাবাজার মোড় পেরিয়ে ট্রাম ডিপোর উল্টো দিকে প্রতাপ মঞ্চ।

আমার বাবা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী। থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণ তরুণ বয়েসেই। যুক্ত হয়ে পড়েন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। প্রান্তিক ও লোকরঞ্জন শাখার একনিষ্ঠ কর্মী ও অভিনেতা হয়ে কাজ করছেন প্রায় দুই দশকেরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী সংগঠনের সাংস্কৃতিক শাখার সম্পাদক ছিলেন। সিনিয়র কলিগ শ্রী শশাঙ্ক গঙ্গোপাধায়ের পরিচালনায় মাদারিকা খেল, সংলগ্ন সংলাপ, ঘন্টা ফটক, ফেরারী ফৌজ ইত্যাদি একাধিক নাটকে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ও প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। আমাদের পুরনো পাড়ায় আজ থেকে ৫০ বছর বা তারও আগে তৎকালীন সমাজের বিশিষ্ট, সম্ভ্রান্ত ও বয়ঃজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের অনুরোধে প্রতিষ্ঠা করেন সিকদারবাগান সাধারণ নাট্যসমাজ। প্রথম সম্পাদক বলা বাহুল্য, স্বয়ং তিনি। সেই শুরু, প্রতি বছর নিয়মিত অভিনয় হত নাটক। শুনেছি প্রথম যে নাটক অভিনীত হয়েছিল, তা হল ‘যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ’, আমি ছেলেবেলায় এই নাটকের একাধিক অভিনয় দেখেছি। এরপর ছোটোদের জন্য বাবা আরো একটি নতুন দল গড়েন – ‘বয়ম’। একেবারে কচিকাঁচাদের নিয়ে যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথের রথের রশি আবার একদল চ্যাংড়া ছোঁড়ার দলকে নিয়ে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া তৈরি করার মতনই ঐ রবি ঠাকুরকে আশ্রয় করেই মঞ্চস্থ করেছেন বৈকুণ্ঠের খাতা। ওদিকে যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দল তৈরি হল তারাই বা বাদ পড়ে কেনো? তাই প্রাপ্তবয়স্ক গ্রুপের জন্য ও প্রাপ্তমনস্ক দর্শকদের জন্য ছিল সূচ, সকালের জন্য, টাকার রং কালো কিম্বা হারানের নাতজামাইয়ের মতন জমজমাট সব নাটক। বাড়ীতে আক্ষরিক অর্থে চোখের সামনে থিয়েটার তৈরি হতে দেখেছি। শুধু যে রিহার্সাল দেওয়া তাই নয়, সেট, মেক আপ, কস্টিউম, মিউজিক ধাপে ধাপে সব কিছুর ক্রমান্বয়ে নির্মাণ পর্বের সাক্ষী থেকেছি। আর সেই নাটকগুলি মঞ্চস্থ হত কোথায়? নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রেক্ষাগৃহগুলিতে। বাবার নাটকের সুবাদে ঐ সব হলগুলির অন্ধিসন্ধিতে ঘুরে বেড়িয়েছি সেই শিশুকাল থেকেই। এক কথায় বলতে গেলে প্রতিটি হলের প্রতিটি ইঞ্চি এক সময় আমার নখদর্পণে ছিল।

ভাঙনের শব্দ
সেই সব প্রেক্ষাগৃহগুলি আজ হয় মৃত অথবা অর্ধমৃত, এ বড় দুঃসহ যন্ত্রণা, শ্বাসরোধ হয়ে আসে। বর্তমানে উপরোক্ত প্রেক্ষাগৃহগুলির মধ্যে মাত্র তিনটি সচল আছে যথা, গিরিশ মঞ্চ, মিনার্ভা থিয়েটার ও স্টার থিয়েটার। প্রথম দুটি রাজ্য সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের দায়িত্বে আছে, ফলে বাকি অনেক হলের মতনই এখানে নিয়মিত অভিনয় হয়। স্টার এখন মূলত সিনেপ্লেক্স, মালিকানা কলকাতা পৌরসভার হাতে। শর্ত সাপেক্ষে বেসরকারি সংস্থাকে লিজ দিয়ে চালানো হয়, এখানে কালেভদ্রে থিয়েটার হয়। এই নিবন্ধের মূল আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে যারা, হাতিবাগানের সেই বাকী হলগুলির মধ্যে তিনটি হল অধুনা অবলুপ্ত যথা, রংমহল এখন এফ বি বি শপিংমল, বিশ্বরূপা বহুকাল আগেই আবাসনে রূপান্তরিত হয়েছে, প্রতাপ মঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়েছে এখন তার চারদিকে উঁচু পাঁচিল। সেখানে কী বস্তু মাথাচাড়া দেয়, সেটাই দেখার অপেক্ষা। অন্য হলগুলি প্রেতপুরীর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নামকাওয়াস্তে। বলেছিলাম না যে ‘নেই’ এর তালিকা দীর্ঘ, মিলিয়ে নিলে দেখা যাবে সেই হাতিবাগান পাড়ার ‘থ্যাটার’ আর নেই। “দেহপট সনে নট সকলি হারায়!”

রোমন্থন
আবার একটু পুরোনো কথায় ফিরি।
পরিসংখ্যানগত তথ্য হয়ত অনেকেরই জানা। কিন্তু যে কথা কারুর জানার কথা নয়, যে কথা একান্ত আমার নিজস্ব তাই কিছুটা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে বড় মন চায়। নাগালের মধ্যেই এতগুলি সিনেমা হল থাকলেও আমি কিন্তু অল্প বয়েসে থিয়েটারের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করেছি। মাধ্যমিক পরীক্ষার পাট চুকিয়ে একা একাই টো টো করে ঘুরে বেড়িয়েছি শহরের পথে পথে আর সামান্য কিছু পয়সা জমাতে পারলে দেখেছি নাটক। এক জীবন্ত শিল্প, সপ্রাণধর্মিতা যার প্রধান বৈশিষ্ট্য। মঞ্চের ওপর চরিত্রগুলির দেবত্বপ্রাপ্তি ঘটছে চোখের সামনে, সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। বাবার মুখেই শুনেছি, স্টার থিয়েটারে তখন রমরমিয়ে চলেছে শ্যামলী নাটক। উত্তম-সাবিত্রী জুটির এই মঞ্চসফল নাটক তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কথিত আছে, গুরুকে এক ঝলক চোখের দেখা দেখতে হাজারো মানুষ নাকি তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে থাকত। রাস্তায় যানজট সামলাতে ট্রাফিক পুলিশের নাজেহাল অবস্থা। সেই কিংবদন্তি স্টার থিয়েটারের কী ভয়াবহ পরিণতি হল চোখের সামনে! মালিকানা তখন রঞ্জিতমল কংকরিয়ার হাতে, ১৯৯১ সালের অক্টবর মাস, পুজোর আর অল্পদিন বাকী। এল সেই অভিশপ্ত রাত, আগুনে ভষ্মীভূত হলো স্টার থিয়েটার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ও নির্দেশিত নাটক ঘটক বিদায় তখন চলছে জোরকদমে, একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর, সঙ্গে অনুপকুমারের হাস্যরস। বাবা কথা দিয়েছিলেন পুজোর ভিড়টা কেটে যাক, তারপর আমরা সপরিবারে একদিন দেখতে যাব। সে সুযোগ আর আসেনি। বলতে গেলে প্রায় নিজের পাড়ায় কী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল! কানে শোনা মাত্রেই আমরা সদলবলে দৌড় দিলাম, যে যেমন ভাবে পারি আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি প্রাণপণে। দশ বছর পর স্টার ফিরে এল, কিন্তু সে তখন ভোল পাল্টেছে।

স্বর্ণযুগের সাক্ষী
তখন রংমহলে দুর্বার গতিতে চলছে অমরকণ্টক। সর্বেন্দ্র-সাবিত্রী জুটির এই নাটক আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলার জোগাড় করেছে। স্টেজের ওপর চলন্ত জিপগাড়ী পাহাড়চূড়া থেকে খাদে পড়ে যাচ্ছে! কাগজের বিজ্ঞাপনে বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে তার উল্লেখ থাকত! মনে আছে ফুল হাউসে শো চলছে, বাবার হাত ধরে একটি বালক উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। টিকিটের যতই হাহাকার থাক না কেন আমার নাটক দেখায় কোন বাধা নেই। টিকিট কাটারই তো বালাই নেই, কারণ পাঠকবাবুর ছিল সর্বত্র অবারিতদ্বার। এই রংমহলেই দেখেছি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রচিত নির্দেশিত ও অভিনীত : নামজীবন। মুখ্য ভূমিকায় : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও মাধবী মুখোপাধ্যায়। এই নাটকের ত্রিস্তরীয় মঞ্চ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ না করলে তা হবে অপরাধ। স্টেজের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে শহরের এক জনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি অঞ্চল। সেখানে রস্টামের সাহায্যে ডেপথ ক্রিয়েট করা হয়েছে। পিছনে দোতলায় নায়কের ঘর, রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে। চরিত্রটি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই সামনের ফোর্থ ওয়াল উপরে উঠে যায় এবং নায়কের ঘর দৃশ্যমান হয়। সে যে কী অভিনব এক আর্ট এ্যান্ড ক্রাফ্ট! চাক্ষুষ না দেখলে হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব।
রঙ্গনা থিয়েটারে গণেশ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে নির্মিত বিলকিশ বেগম দেখা কিম্বা অভিনেতা ইন্দ্রজিৎ দেবের স্মরণ সভায় প্রেসের প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত থাকা, স্মৃতি আজও অমলিন। বছর বারো তেরো আগে শেষ বারের মতো গিয়েছিলাম। স্থানীয় একটি দল আমাকে দায়িত্ব দেয় মাল্টিক্যাম সেটআপে তাদের স্পেশাল শোটি ক্যামেরা বন্দী করার। তারা সাহিত্যিক মতি নন্দীর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বিজলিবালার মুক্তি নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিল, লেখক স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মুখর ছিল সেই সন্ধ্যা। আবার রঙ্গনাতেই দেখেছি হাজার রজনী অতিক্রম করা তুমুল জনপ্রিয় নাটক জয় মা কালী বোর্ডিং। মুখ্য ভূমিকায় বাংলার প্রবাদ প্রতিম কৌতুক অভিনেতা শ্রী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজন, বয়েজ ওন তো যাকে বলে প্রায় ঘরবাড়ির মতন ছিল। নিজেরা কত নাটক করেছি আর কত যে দেখেছি, তা গুনে শেষ করা যাবে না। বিজন থিয়েটারে সায়কের দুই হুজুরের গপ্পো কিম্বা সুন্দরমের পুঁটি রামায়ণ থেকে শুরু করে অগুন্তি নামী অনামী দলের কাজ এখানেই দেখা। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় সার্কারিনা প্রেক্ষাগৃহের কথা। নাট্যপ্রেমী অমর ঘোষ স্বশিক্ষিত অভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক ছিলেন। একাধারে নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মী ও পেশায় স্থপতি। অর্থাৎ আর্কিটেক্ট, প্ল্যানার এ্যান্ড ইন্টিরিয়ার ডিজাইনার। অদম্য জেদি ও অসীম সাহসী এই মানুষটি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন নতুন ও অভিনব এক মঞ্চের। প্রাচীন রোমান অ্যামফিথিয়েটারের ভাবনা মাথায় রেখে তৈরী করেন সার্কেল প্লাস এরিনা: সার্কারিনা। একটি স্টেডিয়াম বা গ্যালারির মতন বাস্তুকলা। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গোলাকার স্টেজের ওপর অভিনয় হবে, দৃশ্য শেষ হলে আলো নিভে যাবে এবং স্টেজ ধীরে ধীরে উপরের তল থেকে নিচে নেমে যাবে, মঞ্চ সজ্জা ও অভিনেতাদের বদল ঘটবে এবং স্টেজ আবার উপরে উঠে আসবে, পুনরায় আলো জ্বলবে ও অভিনয় শুরু হবে। গোটা বিষয়টি ভ্যাকুয়াম ও পুলি সিস্টেমের মাধ্যমে কার্যকর হবে। ১৯৭৬ সালে নির্মিত এই মঞ্চে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতন অসংখ্য নাটক অভিনীত হয়েছে। তুষার যুগ আসছে, সম্রাট ও সুন্দরী কিম্বা জোছন দোস্তিদারের গদ্য পদ্য প্রবন্ধ সহ বহু নাটক। আমার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আছে শাবাস পেটো পাঁচু নাটকটি আর শো শুরুর আগে অভিনেতা নির্দেশক রবি ঘোষের সঙ্গে বাবার খোশগল্পের কথা। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, গোটা দেশে এই অভিনব মঞ্চায়নের ব্যবস্থা সেই প্রথম। আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো স্থানে তা চালু হয়েছে কিনা এমন খবর কর্ণগোচর হয়নি। অথচ পরম আক্ষেপের কথা হল, শুরু হওয়ার মাত্র দুই দশকের মধ্যেই অস্তিত্বের সংকটে পড়তে হয়, নতুন শতক বা সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় এসে নাভিশ্বাস ওঠে, বর্তমানে সার্কারিনা কঙ্কালসার শরীর নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। কথায় কথা বাড়ে, কিন্তু না বলেও তো থাকা সম্ভব নয়! প্রযুক্তিগত অভিনবত্বের নিরিখে রংমহল ও রঙ্গনা সে যুগে তো বটেই সমসাময়িক কালে ভুভারতের বহু থিয়েটার হাউসকে টেক্কা দিতে পারে। রিভলভিং স্টেজ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাট্যামোদী মানুষ সেই প্রথম দেখল ১৯৩১ সালে রংমহলে, তারপর ১৯৭৪ সালে রঙ্গনাতে। ঘূর্ণায়মান এই মঞ্চের সুবিধা হলো দৃশ্যান্তরের সময় অন্ধকারে সেট প্রপস ইত্যাদি পাল্টাবার প্রয়োজন নেই। সম্পূর্ণ স্টেজটি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দর্শকের সামনে নতুন দৃশ্য উপস্থিত করবে। থিয়েটারের ক্ষেত্রে এ যে কী অসামান্য ও অতুলনীয় প্রয়োগবিধি, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

১৯৩২ সালে নির্মিত নাট্য নিকেতন ১৯৪২ সালে এসে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী মহাশয়ের হাতে পড়ে শ্রীরঙ্গম নাম নিয়ে নবকলেবরে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু মাত্র দেড় দশকের বেশী তিনি ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়, দায়িত্ব নেন রাসবিহারী সরকার। আবার নাম পাল্টায়, এবার নাম হল বিশ্বরূপা থিয়েটার। উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলেজে অ্যাডমিশন নিয়ে হঠাৎ করেই একলাফে নিজেকে যেন বেশ বড় হয়ে গেছি এরকম মনে হতে লাগল এবং যথা সময়ে দুটো ডানাও গজাল। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযোগী সংস্কৃতির চর্চা করা দরকার এই ভাবনায় তাড়িত হয়ে ঐ বিশ্বরূপাতেই পর পর দেখে ফেললাম রমাপ্রসাদ বণিক পরিচালিত ঘেরাটোপ, ভালো খারাপ মেয়ে ইত্যাদি নাটক। আবার সেই সঙ্গে দেখেছি নান্দীকারের ফেরিওয়ালার মৃত্যু। প্রখ্যাত মার্কিন প্লে রাইটার আর্থার মিলারের ডেথ অফ্ এ সেলসম্যান অবলম্বনে তৈরি এই নাটকের ভাষান্তর ও পরিচালনা করেন শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। শোয়ের শেষে সটান হাজির হলাম তাঁর সামনে, মাথার মধ্যে গজগজ করছে হাজারো প্রশ্ন…
— স্যার, পুরোটা ঠিক বুঝতে পারলাম না!
— কী করা হয়?
— ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।
— কোন কলেজ?
— বিদ্যাসাগর।
— কী কম্বিনেশন?
— পলিটিক্যাল সায়েন্সে, হিস্ট্রি, বেঙ্গলি আর কম্পালসারি ইলেকটিভ ইংলিশ।
— হুম্ বেশ, কিন্তু মুশকিল হল এখন এখানে এই মুহূর্তে সব কিছু বুঝিয়ে বলা তো সম্ভব নয়।
— তাহলে কোথায় কবে কখন সম্ভব হবে বলুন?
— চলে এসো সময় করে আমাদের রিহার্সাল রুমে, কথাবার্তা বলা যাবে’খন।
আমি গিয়েছিলাম, হ্যাঁ উনি কথা রেখেছিলেন। প্রগাঢ় প্রজ্ঞার সম্মুখীন হয়ে শুধু এই উপলব্ধি হয়েছিল যে ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’! এত কথা বলার উদ্যেশ্য একটাই, তা হল সম্পর্কের সূত্রপাত যেখানে, সেই নাট্যমঞ্চের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

আত্মহত্যা
কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ এখন বিভিন্ন দলের সেট মেটিরিয়াল রাখার স্টোর রুম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কদাচিৎ কোনো দল মহড়া দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে বটে, তবে শেষ কবে অভিনয় হয়েছে বলা মুশকিল। বিজন থিয়েটারে এখন আক্ষরিক অর্থে ছুঁচোর কেত্তন চলে, হরি সাহার হাটের হকারদের গোডাউনে পরিণত হয়েছে। এর চাইতে লজ্জার আর কিছু হতে পারে কি? ঠিক এই অবস্থান থেকেই হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে আসে। কলকাতার প্রফেশনাল বোর্ড থিয়েটার কেন বিলুপ্ত হয়ে গেল? কী ভাবে গ্রুপ থিয়েটার অল্টারনেটিভ থেকে মেইন স্ট্রিম হয়ে উঠল? এগুলি আলোচ্য বিষয় নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে বলা যায় এই বোর্ড থিয়েটারই এককালে জনগণের বা সাধারণ দর্শকদের প্রধান বিনোদন ছিল। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ধারাবাহিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসের মূক সাক্ষী ছিল তারা। অথচ এদের অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে কেউই বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। ১৯৮৬ সালের ১লা জুলাই বাগবাজারে সাড়ম্বরে নবনির্মিত গিরিশ মঞ্চের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। এর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই হাতিবাগানের থিয়েটার গভীর সংকটে পড়ে। কিন্তু তৎকালীন সরকার তখন যেমন উদাসীন থেকেছে, এত বছর পর বর্তমান সরকারও অবশিষ্ট প্রেক্ষাগৃহগুলির পুনরুদ্ধারে সমান ঔদাসীন্য দেখায়। গত বছর নভেম্বর মাসে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হল উনিশতম নাট্যমেলা। আয়োজক পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমি। অর্থাৎ পূর্বতন সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে এই উৎসব। কিন্তু দৃষ্টি ভঙ্গির বদল ঘটল কই? একদিকে রবীন্দ্রসদনে চোখ ধাঁধানো আলোর রোশনাই আর অন্য দিকে হাতিবাগানপাড়া নিকষ কালো ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত। নাট্যকলাকে পঞ্চমবেদ নামে অভিহিত করা হয়, তবে তো এই সীমাহীন দুস্তর দুরতিক্রম্য বৈষম্য সভ্যতার গ্লানি ছাড়া আর কিছুই নয়! প্রশ্ন তৈরী হয় – এই বাংলায় নাটকের চর্চা কি বন্ধ হয়ে গেছে? রথী মহারথীরা কি সব বানপ্রস্থে গেছেন? উত্তর হল – না, তাঁরা নামী থেকে আরো নামী, দামী থেকে আরো দামী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত অথবা সমষ্টিগত কোনো রকম উদ্যোগ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। এই পথ তাঁরা ভুলে গেছেন। গত বিশ পঁচিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে নাটকের দল ও নাট্য উৎসবের সংখ্যা অন্তত চতুর্গুণ বেড়েছে। তুলনায় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বেড়েছে কয় শতাংশ? প্রাপ্তির ভাঁড়ারে প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। একাডেমি অফ্ ফাইন আর্টসের ডেট পাওয়া নিয়ে মারমার কাটকাট অবস্থা হয়ে থাকে। সরকারি হল পেতে গেলে অন্য সমীকরণ আছে, তাও সকলের জানা। তবুও এই অচলায়তন অনড় অটল! বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি ঐতিহ্য ধ্বংসের ব্যাপারে খুব ওস্তাদ, তারা শুধু পায়রার খোপ আর জমাকাপড়ের দোকান বানাতে জানে। অডিটোরিয়ামগুলিও যে লাভজনক উৎস হতে পারে সেটা মুনাফাখোরদের ভাবনা চিন্তায় একেবারেই আসে না। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি – একথা সবাই জানে, সবাই একবাক্যে মানেও বটে! তবে কি কালক্রমে সেটাই শ্লাঘার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে?

আশার কথা এই যে অতি সম্প্রতি উত্তর কলকাতার তুলনামূলক একটি ছোট নাট্যদল রামমোহন মঞ্চে চারদিনব্যাপী নাট্য উৎসবের আয়োজন করেছিল, মোট সাতটি নাটক প্রদর্শিত হয় সেখানে। বয়েজ ওন লাইব্রেরি হলে এখন কিছু কিছু সংস্থা অডিশনের ব্যবস্থা করে থাকে। আবার প্রশ্ন তৈরি হয় – তামাম বাংলার নাট্যপ্রেমী দর্শকদের জন্য হাতিবাগানকে নতুন গন্তব্য স্থল হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা কি একেবারেই অসম্ভব?

শুরুটা করেছিলাম উৎপল দত্তের সংলাপ উদ্ধৃত করে, শেষটা সে ভাবেই করি তাহলে! মনে পড়ে তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি টিনের তলোয়ার নাটকে বেণীমাধব চাটুজ্জের মুখে সেই যুগান্তকারী সংলাপ?
“আমি ব্রহ্মার মুখের ওপর তর্জনী নেড়ে বলব নাট্যশালায় সৃষ্টি করেছি এমন জগৎ, যা তোমার চার মাথার একটিতেও আসেনি ভগবান…।”

কিন্তু সেই নাট্যশালাই যদি না থাকে তবে ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরী হবে কোথায়?
রাত কত হল?
উত্তর মেলে না।

ছবি: অন্তর্জাল থেকে

দমদম, কলকাতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *