পর্তুগালের পথে ও প্রান্তরে - প্রথম পর্ব
অক্টোবর ৬, ২০২২,
লিসবন
বেড়াতে যাই দেশ দেখতে, কিন্তু আবিষ্কার করি নিজেকে। অচেনা দেশের অজানা ভাষার মানুষের মাঝে এই বিপুল বিশ্বে ‘আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।’
যাত্রার আগে পড়াশোনা করে তৈরি হয়ে ছিলাম, কি দেখব, কেমন করে দেখব, প্রতিদিনের প্ল্যানে ছকে। এবার সত্যি সত্যি কী হয়েছিল তা নিয়েই এ ভ্রমণ কাহিনি। আমরা কোন টুরিস্ট কোমপানির সঙ্গে যাইনি কাজেই নিজেদের ঘাড়ে অনেক ঝক্কি ফেলেছি এবং অনেক চমকও।
রাত দশটায় পৌঁছলাম লিসবন এয়ারপোর্টে। খুব কাছেই হোটেল ঠিক করেছিলাম বুকিং ডট কমে। কিন্তু সে যে এত কাছে বুঝতে পারিনি। ঝাঁ চকচক এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখি নিয়ন আলোয় আমাদের হোটেলের নাম ঝিলিক মারছে, কিন্তু যাব কী করে সেখানে?
সামনে গোল গোল হয়ে গাড়ি ঘুরে চলেছে পথ ধরে, নিয়ম মাফিক। কোথাও পার হবার উপায় নেই। স্বল্প ঝগড়া ও কথা কাটাকাটির পর কর্তার ইচ্ছাই কর্ম। কোনক্রমে পৌঁছলাম হোটেল লবিতে। জানা গেল এরকম ভাবেই লোকে চলাফেরা করে।
ঘরটা চলনসই। পরদিন সকালের ফ্রি ব্রেকফাস্ট উল্লেখযোগ্য। আমাদের আমেরিকান হোটেলের থেকে ঢের ভাল। কত রকম পেস্ট্রি!
এবার আমাদের যেতে হবে আরেক হোটেলে যেটা শহরের মাঝখানে, চলাফেরার সুবিধার জন্য। হোটেলের রিসেপশনিস্ট সুন্দরী আমার স্বামীকে বুঝিয়ে দিল একটা লিসবন সিটি কার্ড কিনতে, তাতে যতখুশি ঘোরা যাবে। ঠিক হল আমি হোটেলের লবিতে মাল পাহারা দেব, আর অমিত এয়ারপোর্টে গিয়ে কিনে আনবে লিসবন কার্ড। ঐ তো পাঁচ মিনিটের পথ।
আধ ঘন্টারও পর যখন ও ফিরল দেখি ঘেমে নেয়ে মুখ লাল। রোদের তেজ খুব বেশি আর যাতায়াত ব্যাপারটায় যে এতটা চড়াই পথ বোঝা যায় নি কাল। লিসবনের চড়াই উৎড়াই পরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। এ শহরের বৈশিষ্ট্যই তাই – সাত পাহাড়ের দেশ কি না।
শহরের মাঝে ‘হোটেল টুরিম আইবেরিয়া’ বেশ জমজমাট। ডাউন টাউন এলাকায় – আমাদের এসপ্ল্যানেডের মত। চারপাশ দিয়ে গেছে বাস, পাতাল রেল, দোকান বাজার।
মেয়েটিকে জানালাম আজ আমাদের প্ল্যান ‘ভাসকো দ্য গামা’ দেখতে যাবার — বেলেম এ। বেলেম লিসবন শহর থেকে বড়জোর ঘন্টা খানেকের পথ, পশ্চিমে। তার জন্য ইচ্ছে ‘কেইস দু সুদরি’ (Cais de Sodré) এলাকা থেকে তে ১৫ই ট্রামে করে জলের পাশ দিয়ে যাওয়া। আর ভাল কথা —ঐ সঙ্গে জেরেনিমো মনাসট্রি টাও চুকিয়ে দিতে চাই আজই। মেয়েটি খানিক আমার মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল। (পরে অবশ্য বুঝেছিলাম বিধাতারই মুচকি হাসি ছিল ওটা।)
“হবে না কেন?” বড় একটি ম্যাপ এনে তাতে হলুদ কালিতে দাগ টেনে দিল মেয়েটি। আরেকটি ম্যাপে পাতাল রেলের খবর এবং কী করে যেতে হবে তার নির্দেশ। আমার ডিরেকশন জ্ঞান ভীষণ খারাপ, কিছু বুঝলাম না। কিন্তু আমার পার্টনার কনফিডেনট, অন্তত মেয়েটির সামনে।
‘চিচিঙ ফাঁক’ লিসবন কার্ড দেখিয়ে বেশ খানিক এলোপাথাড়ি ঘুরে একটা মেট্রো সাইন দেখা গেল বটে। মেট্রো ট্রেনে চেপে এবং যথাস্থানে নেমে দেখি মস্ত এক চত্তরের সামনে এসে পড়েছি। তার মাঝখানে এক সিংহ বাহিনী মূর্তি। জানলাম এঁর নাম ‘মারকুইস পমবাল।’
এর সম্বন্ধে পডেছি বৈকি। ১৭৫৫ সালের পয়লা নভেম্বর এক ভীষণ ভূমিকম্প হয় লিসবনে, সেই সংগে ভয়াবহ সুনামি। সেদিন বহু লোক এসেছিল চার্চে। মোমবাতির শিখায় সেই ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে প্রচণ্ড আগুণ লাগে। বহু বহু মানুষ মারা যায়। লিসবনের দুই তৃতীয়াংশ পুড়ে, ডুবে ছারখার হয়ে যায়। রাজা ভয়ে কাঁপতে থাকে। এ কী অশুভ, অশনি সংকেত?
লিসবন গড়ে তোলার ভার পড়ে মারকুইস পমবালের ওপর। লিসবনকে ঢেলে তৈরি করেন তিনি। বাড়িগুলি যেন ভূমিকম্প সইতে পারে, রাস্তা ঘাট নতুন ভাবে তৈরি হয়। পমবালিন আরকিটেকচার -একটি নতুন ধারণা আনে শহর পরিকল্পনার দিগন্তে। এই সেই পমবাল যাঁর বিখ্যাত উক্তিঃ
“Now what? Bury the dead and feed the living.” যা গেছে তারপর যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য লড়। তিনি তাকিয়ে আছেন যে পথের দিকে তার নাম ‘Avenida da Liberdade’— ‘ স্বাধীনতার পথ’। এ রাস্তা চলে গেছে টাগস নদীর দিকে।
এ পথের কথা আমার জানা ছিল না। পরে জেনেছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে পশ দোকানগুলো এর চার পাশ ঘিরে। রোলেক্স, লুই ভিটুই, কারতিয়ের, কী চাও?
কিন্তু যে অংশে আমরা হেঁটেছিলাম এই দেড় কিলোমিটার লম্বা রাস্তার, আমি যা দেখেছিলাম তা — দু পাশে জাকারানদা গাছে নীল ফুলের সমারহ আর আশ্চর্য সুন্দর মৃদু একটি গন্ধ। মাঝে মাঝে পার্কে মূর্তি, এদের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের স্মারক চিহ্ন। মাটিতে তাকালে দেখি, টালির কাজের আল্পনা, মূলত লতা পাতা আঁকা। সে এক অপূর্ব কাজ। মাঝে মাঝে বেঞ্চি পাতা, একটু জিরিয়ে বসার। তবু হাঁটতে হাঁটতে এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আর দেখি ঠিক আমার সামনে ৭৩৫ নম্বর মার্কা এক চমৎকার বাস এসে দাঁড়াল। উঠে পড়লাম।
“আরে কোথায় চললে?” বলে উঠল অমিত।
“এ বাস যেখানে যায়।”
‘চিচিঙ ফাঁক’ টিকিট দেখিয়ে জানলার ধারে সিট দেখে বসে পড়ি। শহরের মধ্যে দিয়ে, এক মস্ত জলাশয় (টাগস নদী, না সমুদ্র জানিনা) পাশ ঘেঁষে বাস চলল। মাঝে মাঝে শহরের দেওয়ালে নানান ছবি আঁকা, গ্রাফিতি না গ্রাফিক আর্ট বুঝতে না বুঝতেই বাস ঢুকে পড়ে গলিতে। এত বড় বাস কী করে যে অমন সরু গলি দিয়ে যায় ভেবে পেলাম না। মাঝে মাঝে সমুদ্রের ছবি ঝিলিক দিয়ে যায় দুটি গলির ফাঁক গলে। বাড়িগুলোর ছাতে, বারান্দায় কাপড় জামা শুকোচ্ছে। হঠাৎ কলকাতার কথা মনে পড়িয়ে দেয়, আবার উঁচু নিচু পথ আর সমুদ্রের ঝিলিক ছবি মনে করায় সান ফ্রানসিসকোর কথা। পাহাড় ঘিরে বাস অনেক ওপরে উঠে এক ছোট চার্চের সামনে এসে থামল। এই তার শেষ গন্তব্য। চার্চ বন্ধ হয়ে গেছে। বাস থেকেও সবাই নেমে গেছে।
ঐ বাসই খানিক পরে ঘন্টা বাজিয়ে আবার নিচে নামল। তখন কেইস দু সুদরি(Cais de Sodré), জলের ধারে নেমে আমরা আরেক চত্বরে এসে পড়লাম। ম্যাপ দেখে বুঝলাম এটা Parque de Commercio – কমার্স পার্কে এসে পডেছি।
এককালে এ ছিল রাজবাড়ির চত্বর। ভূমিকম্পের পর রাজা ভয়ে পালিয়ে যায়। এটা পরিণত হয় জন সাধারণের ব্যবসা বাণিজ্যের ময়দান। মধ্যিখানে রাজা (Jose I — Zoসে উচ্চারণ) এর মূর্তি, যার এক পাশে হাতি, এশিয়ার প্রতিপত্তির স্মারক, মস্ত গেটের ওপরে একদিকে পমবাল অন্য দিকে ভাস্কো দ্য গামা।
চত্বরটার সামনে রাস্তা পেরলেই টাগস নদী। নদীর বুকের ওপর তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। প্লাজায় এক শিল্পী গীটার বাজিয়ে চমৎকার সুর তুলেছে আর ছোট্ট একটা মেয়ে টলমল করে তার সামনে নাচছে।আকাশের লালিমা মেখে এক প্রেমিক জুটি সেলফিতে নিজেদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
দিনের শেষ সূর্যকে প্রণাম জানিয়ে আজকের দিনলিপি এখানেই শেষ করলাম, এই শিক্ষা নিয়ে — যা পরিকল্পনা করা যায় তা হয়ত ঠিক তেমন করে হয়না কিন্তু দিনের দেবতা তার চেয়েও হয়ত বেশি কিছু দেন যা আমার জানার বাইরে।
অক্টোবর ৭, ২০২২
আবিষ্কারের যুগ
লিসবন শহর থেকে বেলেম ঘন্টা খানেকের পথ -পশ্চিম মুখো। পরদিন বেলেমে আমাদের যাওয়া আর এগুলি দেখার সুযোগ হয়েছিল। বেলেম টাওয়ার আর জেরেনিমো মনাসট্রি। কিন্তু ১৫ই ট্রামে চড়ে নয়। প্রচন্ড ভিড়। আবার একটি বাসে উঠে পড়ি। ভুল বাস, খানিক দূর গিয়ে নেমে জিজ্ঞাসা করি এক দোকানে, “ঐ যে লেখা আছে বেলেম যাচ্ছে — তা কোন বাস?”
দোকানটা প্রায় আমাদের কলকাতার পাড়ার পান বিড়ি বেচা গোছের ছোট্ট দোকান, কিছু সস্তার সুভেনির ও আছে, যাকে বলে একদম দেওয়ালে-গর্ত দোকান। দোকানী আমাদের ভাষা বুঝতে না পারলেও হাব ভাবে সমস্যা বুঝতে পারে। বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় বাস স্ট্যান্ডে এবং দু দুবার আমাদের উঠতে না গিয়ে ঠিক বাসে তুলে তবে শান্তি পায়। এর জন্য হাসিটুকু ছাড়া কিছুই দিতে পারলাম না।
‘অবরিগাতা’ মানে থ্যাংক য়্যু – কথাটা তখনও শিখিনি। এরপর আলাপ হয় UCLA মার্কা টি শার্ট পরা একটি ছেলের সঙ্গে, যে আমেরিকা থেকে পর্তুগালে এসেছে পড়তে, এক বছরের জন্য। তার সাহায্যে ঠিক জায়গায় নেমে দেখি মস্ত সে মনাসট্রি। এবং প্রায় এক মাইল লম্বা লাইন পড়েছে। আছে ছোটতর লাইন — তাতেও জনা পঞ্চাশেক লোক দাঁডিয়ে গরমে গলদঘর্ম। এদের অনলাইন টিকিট কেনাই আছে। আমাদের নেই।
আমার ইচ্ছে উবে গেল। ভেতরে কী আছে তা তো জানা। ভাসকো দ্য গামার কবর, রাজা ইম্যানুয়েল ও রাজ পরিবারের সমাধি, কবি ফারনানডো পেসোয়া আর লুই কামোজ যিনি তাঁর কলমের টানে ভাসকো দ্য গামাকে অমর করে রেখে গেছেন।
ফারনানডো পেসোয়াকে সেখানে গিয়ে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাতে পারলাম না বলে মনে মনে ক্ষমা ভিক্ষা করি। তাঁর কবিতা আমি পড়েছি। তাঁর বিখ্যাত উক্তি:
“Life is what we make of it.
Travel is the traveler.
What we see isn’t what we see but what we are.”
― Fernando Pessoa.
মনাসট্রির বাইরের রূপ তাক লাগিয়ে দেবার মত। বিশালতায় এবং সৌন্দর্যে। ম্যানুইল আরকিটেকচার। মাঝে মাঝে নটিক্যাল মোটিফ, সমুদ্র অভিযানের সাক্ষর। নোঙর আর দড়ি। আর সাপের প্যাঁচ। শোনা যায় একশো বছর লেগেছিল এ বানাতে। মূল টাকা এসেছিল আমাদের ভারতবর্ষের মশলার ট্যাক্সে, চুরি করে, ও অন্যান্য দেশ শোষণ করে।
এক একটা গোল মরিচের দানা না কি ঐ মাপের রূপোর থেকেও দামি তখন। নানান মশলার স্বাদ, গন্ধ এবং সব চেয়ে দামি কথা – মশলার সংরক্ষণ গুণ (preservative quality) তখনকার ফ্রীজ হীন দুনিয়ায় মহা মূল্যবান। পরতুগাল সে সুযোগ লুফে নিল।
আর মনাসট্রির কথায় — শোনা যায় ঐ মনাসট্রিতে সেই সব সাধু সন্তদেরকেই একমাত্র ঢুকবার অনুমতি দেওয়া হত যারা হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর এবং অন্য রাজা রাজড়াদের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতেন। প্রার্থনাতেও হুকুম? ভেবে অবাক লাগে।
জেরেনিমো মনাসট্রির অনেক গপ্পো। এখানের নান ও পাদরীরা নাকি তখন জামায় মাড় দিতে ব্যবহার করতেন ডিমের সাদা ভাগ। ডিমের কুসুম জমল অনেক। এর আগে চিনির দারুন অভাব ছিল পর্তুগালে। চিনিকে আজকের মত বিষ মনে করা হত না। বরং চিনি ছিল মহার্ঘ ঔষধ। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কেবল মাত্র অসুস্থ, দুর্বলদের জন্য তোলা থাকত।
ব্রাজিল জয়ের পর পাওয়া গেল প্রভূত পরিমান চিনি। বস্তা বস্তা চিনি এল, দারুচিনি এল এশিয়া থেকে আর ময়দা ও ডিম তো ঘরেই মজুত।উপোস দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত নানরা তা দিয়ে সৃষ্টি করলেন এক অপূর্ব মিষ্টি। তার নাম প্যাস্টেল নাটা। সেই প্যাস্টেল নাটার ট্রাডিশন নাকি আজও চলছে বহাল তবিয়তে ঐ মনাসট্রির দোকানে। তবে সেখানে আমাদের তা পরখ করা হয় নি। প্যাসটেল নাটা পরে খেয়েছি। গজার মধ্যে কাস্টার্ড। অপূর্ব স্বাদ সত্যি এবং যখনই সুযোগ পেয়েছি লুফে নিয়েছি শেষ দিন পর্যন্ত।
রাস্তা পেরিয়ে চোখে পড়ল মনুমেন্ট অব ডিসকভরি। এর ছবি তো দেখা। চিনতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু সহজে যাবার উপায় নেই। যেতে হবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাটির তলায়, এক সুড়ঙ্গ দিয়ে হেঁটে পেরিয়ে আবার উঠতে হবে। তাই সই।
দেখি, দূরে একটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। এর নাম ’25th Avril’ বা ‘২৫ শে এপ্রিল’ সেতু। এমন অদ্ভুত নাম কেন?
এক ট্যুর গাইড বোঝাচ্ছিল ইয়োরোপের সবচেয়ে লম্বা সাসপেনশন ব্রিজ না কি এটা। দোতলা দিয়ে যায় গাড়ি আর এক তলায় ট্রেনের লাইন। আর তার নাম কেন এমন? কারণ আগে এর নাম ছিল সালাজার ব্রিজ। আন্তোনিও দ্য অলিভেরা সালাজার এক নাগাড়ে বহুদিন ডিকটেকটারশি জ্বালানোর পর জনসাধারণ তিতি বিরক্ত হয়ে বিদ্রোহ জানায়। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ২৫ শে এপ্রিল সে বিদ্রোহের জয় হয় সাধারণ মানুষের সপক্ষে। তার নাম ‘কার্নেশান রেভলিউশন’। সেদিন নাকি লিসবনের মানুষ সৈনিকদের বন্দুকের মুখে কার্নেশান ফুল গুঁজে এই বিজয় উৎসব উৎযাপন করে। ঐ দিন থেকে সালাজার ব্রীজের নাম হয় ‘২৫ শে এপ্রিল ব্রিজ’। স্বাধীনতার সেতু।
মনোরম সেতু টি তারিফ না করে পারি না। অনেকটা সান ফ্রানসিস্কোর গোল্ডেন গেট ব্রিজের মত। অমন কমলা রঙ, অমন সরল সৌন্দর্য।
সেদিক পিঠ ফিরিয়ে মনুমেন্ট দেখলে চোখে পড়বে এক দঙ্গল লোক চলেছে কোন অভিযানে। দ্য এজ অব ডিসকভারি। আবিষ্কারের যুগ।
দলের প্রথমে যিনি, তিনি ভাসকো দ্য গামা, চোখ তাঁর সুদূর দিগন্তে, হাতটি তলোয়ারে ছোঁয়া। ম্যাগেলান ধরে আছেন একটি বৃত্ত, পৃথিবী যে আসলে গোলাকার একথা যেন তাঁরা ভুলে না যান, তাই বোধ হয়। তার পিছনে পেডরো কারবাল, বুকে হাত, আর আছেন আরো সব পাদ্রী (বা জলদস্যুর দল) যাঁরা এ অভিযানের অংশ বিশেষ।
উলটো দিকে যেতে মাটিতে তাকালে মনে হবে ঢেউ এর মাঝে চলেছি। অপটিকাল ইল্যুশন। বেশ ঘাবড়ে যাবার মত ব্যাপার। এদিকে যাঁরা আছেন তাঁরা সশরীরে না গেলেও এ স্বপ্নের ভাগীদার।
মাস্টার মাইন্ড —এঁদের দলপতিকে প্রথমেই নজরে পড়বে – হেনরি, দ্য নেভিগেটর। ইনি জলপথের ম্যাপ বানিয়ে, জাহাজ বানানোর ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে তৈরি করেছেন নাবিকদের। সেই সঙ্গে মিশনারি কাজ।কী করে মানুষকে ধর্মান্তরিত করা যায় তার ফন্দি।
তার পিছনে আছেন রাজা এম্যানুয়েল, যিনি দিয়েছেন টাকা, হাতে তাঁর আরমিলারি গোলক ধরা। এঁর পিছে কবি লুইস কামোজ, পাণ্ডুলিপিটি বাগিয়ে ধরে রেখেছেন। আরো আছেন অনেকে। একটি মাত্র মহিলা চরিত্র — তিনি নেভিগেটর হেনরির বৃটিশ মা, ফিলিপপা। আজ গর্ব ভরে পর্তুগাল জানায় এঁরাই ছিলেন সেই আবিষ্কার যুগের বিশেষ জন।
আমার মনে পড়ছিল শরদিন্দুর লেখা ‘রক্তসন্ধ্যা’ গল্পটির কথা।
শান্তিপূর্ণ কালিকটের তীরে তিনটি ফিরিঙ্গি জাহাজ এসে ভিড়েছিল একদিন। কেমন করে বিষিয়ে দিয়েছিল সব। মানসচক্ষে দেখতে পেলাম ভাসকো দ্য গামার সংগে সেই মুরের লড়াই। এক জীবন পরে মাংস বেচা কষাইয়ের ভূমিকায় যে তার শোধ নিয়েছিল। কী দাম দিয়ে! কেউ তাকে বুঝতে পারেনি সেদিন, তার অদ্ভুত নৃশংস হত্যার মানসিকতা। বেচারির ফাঁসি হয়েছিল। তার মস্তিষ্কের কোন খাঁজে যে জাতিগত প্রতিশোধ স্পৃহার সে বীজ লুকিয়ে ছিল তা সে বেচারা নিজেও হয়ত জানত না!
তীর্থযাত্রীর জাহাজ লুটে, মিথ্যা বলে কেমন করে ভাসকো দ্য গামা সেদিন জিতে গেছিল। আর তার পাল্টা নিয়েছিল এই মানুষটি আরেক জীবন পরে — আরেক যুগে। সে এক আশ্চর্য গল্প। দিনের সূর্য মুখ লুকিয়ে ছিলেন সেদিন লজ্জায় সাগরের বুকে।
আজ সাতশ বছর পর আমি সে ইতিহাস পরখ করছি ট্যুরিস্টের ভূমিকায়। শোষণের সে ইতিহাস, যা আদিম, ‘সেই ট্রাডিশন চলেছে সমানে।’
মাঝে মাঝে মনে হয় তাই কী ১৭৫৫ সালে ভীষণ ভূমিকম্প ও সুনামি হয়েছিল? প্রকৃতি মা এ দেশকে শাস্তি দিয়েছিলেন, তার উৎকট লোভের জন্য? না, তা হাস্যকর ভাবা। দুনিয়ার নিয়ম এত সহজ নয়। আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের বোঝার অনেক ঊর্ধ্বে।
অক্টোবর ৯, ২০২২
পোর্ত
লিসবন থেকে শ-দুই মাইল উত্তরে পোর্ত। গিয়েছিলাম ট্রেনে। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন ট্রেন আমাকে যতটা অবাক করেছে তার বেশি করেছিল লিসবনের ওরিয়েন্ট স্টেশন, যেখান থেকে ট্রেন ধরেছিলাম। বিশাল স্টেশনটির তলা দিয়ে গেছে মেট্রোর লাইন। আর ওপরে দূর পাল্লার যাত্রার রেল। খাওয়া দাওয়ার স্টল, ওয়েটিং রুম, সব ব্যবস্থাই আছে।
সানতিয়াগো কালিত্রাভা, যিনি এর ডিজাইন করেছেন আজ দশ জন পৃথিবী বিখ্যাত জীবিত আরকিটেকটদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর হাতের ডিজাইন দেখতে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিল। আমার ইনজিনিয়ার বাবার কথা মনে পড়ছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্য এর দেওয়ালের কারুকার্য— এখানের আরেকটি মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালেও এমন আধুনিক টালির কাজ দেখেছি। ওপরে তাকালে দেখা যাবে মাছের আঁশ দিয়ে যেন তৈরি ছাদটা, যা আসলে কাঁচ আর ধাতুর কাজ। বাসের গুমটি ও এখানেই। পর্তুগাল নানান জায়গা তো বটেই স্পেনে যাওয়ার বাসও পাওয়া যাবে।
পাশে বসা মেয়েটি ছেলেটিকে বলল – “জানলা!” আর ঠিক তখনই অমিতও বলে ওঠে, “আরে, ‘জানেলা’ লেখা, পর্তুগীজেও জানলা!” বাংলায় কথাটা হয়ত পর্তুগিজ ভাষা থেকেই এসেছে, যেমন ‘বারান্দা’ কথাটা, কিংবা পেরেক।
মেয়েটি বলে, “আপনারা বাঙালি?”
জানা গেল ওরাও বাঙালি, যদিও অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম ও বড় হওয়া। ছোটবেলায় ওদের বাবা মাও আমাদের মত ওদের প্রতি রবিবার ধরে ধরে বাংলা ইসকুলে নিয়ে যেতেন। যদিও নিজেদের মধ্যে ওরা ইংরিজি বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ, আজ কিন্তু আমাদের সঙ্গে চেষ্টা করল বাংলা বলারই। অস্ট্রেলিয়া থেকে হানিমুন করতে এসেছে। বেশ মানিয়েছে দুটিতে।
ঘন্টা তিনেক পরে যখন পৌঁছলাম পোর্ত তখন দিনের আলো কমে এসেছে। যদিও ট্যাক্সি এগুচ্ছে শামুকের গতিতে, বুঝি দিনশেষের জ্যাম, আরেক দিকে তাকালে দেখি এক অপূর্ব নদী, তার সীসা নীল জলের ওপর দিনের শেষ লাল সূর্য ডুব দিচ্ছেন।
আমাদের থাকার ঘরটি খুব পছন্দ হয়েছে আমার। বেশ ছড়ান ছিটানো, বড় ঘর। ঝাঁ চকচক নতুন কায়দায় বোকা বানাবার চেষ্টা নেই — (যে সব জায়গায় জলের কল কী করে খুলব ভেবে হীনমন্যতায় ভুগতে হয়, এ সেরকম নয়।) এর একটা দরাজ বনেদিয়ানা আছে। ছিটকিনি দেওয়া জানলার পাল্লা খুললে চোখে পড়ল একটি পুরানো চার্চ বিশেষ। তার ওপারে সবুজ লনের এক ফালি। পেরিয়ে গেলে নদীর তীর। ডুয়ারো নদীরই আরেক দিক। গেছিলাম সেই পরিত্যক্ত বাড়িটির কাছে। তার দেওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে কামান বসান। এখন সে কামান কাজ করেনা। ফুটোয় চোখ রাখলে দেখি একটি টেনিস কোর্ট – টক টক টক টক আওয়াজ। টেনিস বলের। আজকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরেকরকম।
অক্টোবর ১০, ২০২২
ডুয়ারো ভ্যালি
ডুয়ারো ভ্যালির ছবি দেখে মজেছিলাম। কিন্তু আজ টুরিস্ট অফিসে কোন মতে পৌঁছে থেকেই দেখছি ঝির ঝির বৃষ্টি। বাসে ওঠার পর নামল মুশল ধারায়। গাইড বাবাজি বলে যাচ্ছেন নানান উপত্যকার কথা “ঐ যে দেখছ…”। কিন্তু জানলার বাইরে চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কখনও মনে হচ্ছে মেঘের দেশে এসেছি। ‘পুঞ্জপুঞ্জ ভারে ভারে নিবিড় নীল অন্ধকারে’ তারা এগিয়ে আসছে, আর অতি সন্তর্পণে আমাদের ভ্যান পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ঘুরে চলেছে। এমন দিনে সব বরবাদ ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল।
এবার বিপুল জোরে নামল বৃষ্টি, গাইড চুপ করে রইলেন খানিক, তারপর একটা গান চালালেন। গানটা আমার অচেনা কিন্তু অনেকেই তালে তালে যোগ দিল… আর কী আশ্চর্য একটু পরেই নীল আকাশে মেঘের ঘোমটা খুলে মুখ তুলল রোদ্দুর। হলদে আলোয় তখন যা দেখলাম তা বর্ণনা করার মত কলমের জোর আমার নেই।
সবুজের নানান পরত, কত রকম শ্যেড, ধাপে ধাপে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে জলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঐ ডুয়ারো নদীর বুকে। ধাপে ধাপে সিঁড়িতে যে রংবদল তা আঙুর ক্ষেতের, আর অলিভ গাছের। কোন কোন আঙুরের গায়ে হৈমন্তী সোনার রং ধরেছে।
পোর্ত বিখ্যাত তার পোর্ট ওয়াইনের জন্য। এক সময় আমাদের বাস থামল এক ওয়াইনারির সামনে। ওয়াইনারির ভেতর কেমন করে ওয়াইন তৈরি হয় তার গল্প শোনায় ট্যুর গাইড। এখন যন্ত্রের যুগ, তবু আশ্চর্য— দেখা গেছে আঙুর পিষে যে রস বেরয় তার জন্য মানুষের পায়ের দাপাদাপি নাকি সবচেয়ে ভাল। কোন যন্ত্র আজ পর্যন্ত তা করতে পারেনি। বেশি চাপ হলে বিচি ভেঙে তিতকি স্বাদ হয়ে যায়। কম হলে রস বার হয় না। এই কাজে লোক লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলে।কিন্তু আজকাল ছেলেরা সবাই সফট ওয়ারের দুনিয়ায়। যদি বা লোকাল লোক পাওয়া যায়, তখন দিনের শেষে, সপ্তাহের পর উৎসব চলে। গাঁয়ের লোক যোগ দেয়, কোমর ধরে ঘিরে ঘিরে নাচে। কিন্তু ওয়াইনারির মালিকরা আগে দেখে নেন আসল কাজটা ঠিকমত হয়েছে তো? আঙুর পিষ্ট রস বেরচ্ছে তো ঠিক?
এরপর পোর্ত চেখে পরখ করা — রুবি পোর্ত, রোজি পোর্ত, গ্রীন পোর্ত অনেক কিছু শিখলাম। স্বাদটা কতটা অপূর্ব এবং বিভিন্ন বোতলের ওয়াইনের পার্থক্য কী, কেন ইত্যাদি বিশেষত্ব গুলি আমার নাগালের বাইরে, জেনে অবাক হলাম এটুকু জায়গার মধ্যেও এখানে নানান মাইক্রো ক্লাইমেট আছে এবং তা নির্ধারণ করে রসে চিনির ভাগ।
শোনা গেল কাছেই পাহাড় ও পাথরের গায়ে আঁকা অনেক ছবি পাওয়া গেছে না কি। হাজার হাজার ছবি। যা নাকি দশ থেকে বাইশ হাজার খৃষ্ট পূর্ব সময়ের নিরিখে। পাওয়া যায় ‘কোয়া’ ‘নদীর ভ্যালিতে। ১৯৯০ সালে নদীতে বাঁধ বসানোর কাজের সময় তা আবিষ্কার হয়। বাঁধ বসানোর প্রকল্প সে জন্য বন্ধ হয়।এখন তা UNESCO র অন্তরভুক্ত।
ট্যুর বাস আমাদের একটি চমৎকার হোটেলে নিয়ে এল যেখানে আমরা পর্তুগিজ কড মাছ ও আরো রুবি পোর্ত দিয়ে লানচ সেরে গেলাম ডুয়ারো নদীতে নৌকো ভ্রমণে। এবার ভ্যালির আরেক রূপ নদীর বুক থেকে।
কালকের ট্রেনের সেই নব দম্পতির সঙ্গে আবার হঠাৎ দেখা। ওরাও এসেছে এমন ট্যুরে আরেক কোম্পানির সঙ্গে। দিনের শেষে বেশ ঝলমলিয়ে রোদ উঠেছে।
অক্টোবর ১১, ২০২২
লেলো লাইব্রেরিঃ Livraria Lello
এ নাকি হ্যারি পটারের জন্ম স্থান। জে কে রোল্যানড এক সময়ে পোর্ত তে থাকতেন এবং এ লাইব্রেরিতে বসে লিখে ছিলেন হ্যারি পটারের গল্প। সেই খবর ভাঙিয়ে দারুণ মারকেটিং করছে এই বইয়ের দোকানটি। কেবল ঢুকতেই মাথাপিছু পাঁচ ডলার লাগবে, এবং তা অনলাইনে আগে থেকে কিনে রাখতে হবে।
অনেক পর্বত লঙ্ঘন করে, প্রচুর চড়াই ভেঙে সে তীর্থস্থানের সামনে এসে পৌঁছলাম। যদিও বাইরে থেকে নেহাত মামুলি বইয়ের দোকান কিন্তু তা দেখতে দেখি বিশাল লাইন পড়েছে। জমাট ভিড়। একসময় আমাদের জন্য দ্বার খুলল। অবাক হয়ে দেখি মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত বই, বই আর বই। চমৎকার একটি সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে উঠে গিয়ে দেখতে হয়। দেখে চমৎকৃত হলাম।
বইগুলি কিন্তু সব পর্তুগিজ ভাষায় লেখা। আর জানা গেল হ্যারি পটারের লেখিকা না কি স্বীকার করেননি যে ঠিক এখানেই তিনি হ্যারির জন্ম দিয়েছেন! বলেছেন ‘তা হলে বেশ হত।’ যদিও দু একবার যে গেছেন তা অস্বীকার করেন নি।
লাইব্রেরির পাশেই একটি আইসক্রিমের দোকান। এরা বলে ‘জেলাতো’। আমি নিঃসন্দেহ যে এতদূর এসে লেখিকা নিশ্চয় এই আইসক্রিমের দোকানে বাইরের এই চেয়ারটিতে একটু বসেছিলেন। একটি জেলাতোও খান নি? এমন হতেই পারে না। তাই আমরাও তা পরখ করলাম। নানান রকম মানুষ দেখার এ দারুণ স্পট।
রীতা
এক লহমার জন্য ধরা দিয়েই মেয়েটি সরে যায় ফ্রেম থেকে। রেস্টুরেন্টের সামনে বসা গায়ক জুটির ভিডিও করছিলাম আমি।
“সরি”, বলে হাত নাড়ে মেয়েটি।
লেলো লাইব্রেরি থেকে আসার সময় এবার ছিল উজানের পথ। এর আগে হৃৎপিন্ডটি ধক ধক শব্দে বিদ্রোহ জানিয়েছে চড়াই ওঠার পথে, এবার জানান দিচ্ছে হাঁটু। উৎরাই ও যে এমন কষ্টকর ব্যাপার এর আগে তেমন মালুম হয়নি, তাই স্ন্যাক – বারের খোলা চেয়ার গুলি পেয়ে আর গিটারে গানের সুর যখন আমাদের নিমন্ত্রণ পাঠাল, ফেলি কী করে। একটা চেয়ার টেনে বসি। মেয়েটি শুধোয় অমিত কে,
“কী আনব, সিনর?”
“একটা বিয়ার।”
“আর সিনোরা?” আমি আমতা আমতা করতে থাকি। মেয়েটি বলে ওঠে,
“আচ্ছা, আমিই ঠিক করে দিচ্ছি। সানগ্রিয়া? রুবি পোর্ত দিয়ে?” চোখ সরু করে মাথা এলিয়ে জানতে চাইল।
“রুবি পোর্ত? না, না, দিনের বেলায় এই গরমে এলকোহল চলবে না।”
“হুম।” এক মুহূর্ত ভাবল ঠোঁটের একদিক কামড়ে।
“বেশ, একটা নতুন জিনিস বানিয়ে আনছি। কেবল তোমার জন্য। নতুন রেসিপি। খেয়ে তুমি বলবে, ‘আহা সে খেয়েছিলাম বটে, রীতা ফ্রম পোর্ত বানিযেছিল, হা হা!’” বলে নিজের মনেই হেসে গোড়ালির ভরে একপাক ঘুরে নিল। চলে গেল মেনু কার্ড আনতে। মাঝ পথে ফিরে এসে বলে,
“তবে হ্যাঁ, ভাল না লাগলে কিন্তু বলবে। স্পষ্ট বলবে। ঠিক তো? আমি দাম নেব না।”
আমি তাকে আশ্বস্ত করি, “তা বলব।”
“ঠিক? প্রমিজ।”
“প্রমিজ!”
নাচতে নাচতে চলে যায়, গলায় সুর তুলে। দুদিকে মাথা দোলাতে দোলাতে। বেশ মজার তো মেয়েটি, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, ভাবি আমি।
গায়ক গান ধরেছে গিটারে, তার সঙ্গী তাল রাখছে এক মস্ত ড্রামে। অদূরে এক টেবিলে জনা পাঁচেক বর্ষীয়সীর দল তারাও যোগ দিয়েছে, সঙ্গে হাতে তালি। কোন পর্তুগিজ পপুলার গান বোধ হয়। একটু পরে মেয়েটি ফিরে আসে, হাতে ট্রে। তাতে পানীয়। অত বড় বিয়ারের মগ আমি জীবনে দেখিনি, সংগে একটি বড় ওয়াইন গ্লাসে আমার জন্য হাল্কা গোলাপী এক পানীয়, তাতে কয়েক কুচি স্ট্র বেরি, এক ফালি পেয়ার ফল এবং একটি লম্বা দারুচিনি শোভা পাচ্ছে।
“ত্রে ফরমিদাব, আঁ।” সপ্রশ্ন দৃষ্টি। আমার চুমুক দেবার অপেক্ষা কেবল। চুমুক দেবার পর আমার মুখ দেখেই সে তার উত্তর পেয়ে গেছে। বলি,
“এই রেসিপিটার পেটেন্ট নিতে পার।”
“ইয়স!” বলে ওঠে সে পা ঠুকে।
“আর আমি ভুল করব না। আর সেই বোকা ছেলেমানুষ নই আমি। নাও আই নো বেটার।”
“তুমি এখনও ছেলেমানুষ।” বলে অমিত।
“না, না, মোটেইনা। সেরকম ইয়াং, নাইভ, ষোল বছরের বোকা রীতা নই আর। এখন আমার ছাব্বিশ বছর বয়স, বুঝলে। দশ বছর অনেক কিছু শিখিয়েছে।” বলে সে কাঁটা চামচ প্লেট গুছিয়ে দিয়ে মাথা নাড়ে। কী যেন উত্তর দেয় স্প্যানিশ না পর্তুগিজ ভাষায় আরেক টেবিলে।
আমি ভাবি, পাগলি। এমন বয়স জাহির করার কোন দরকার ছিল কী? হঠাৎ অমিতের দিকে তাকিয়ে আঙুল তোলে সে ওর মাথার টুপির দিকে নজর করে।
“৪৯ র ফ্যান, সান ফ্রানসিসকো?”
“আরে তুমি তাও জান?”
“অফকোর্স, জানব না, আমার এক্স ছিল যে…।”
কী বলব ভেবে পেলাম না আমরা।
সোনালী চুলের বেনী সামনে এনে চশমাটা ঠিক করে নিল। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি চকচক করে উঠল, “নাথিং রং। এখন আমরা বন্ধু, ভাল বন্ধু। সে আরেক রীতাকে খুঁজে পেয়েছে, এই যা। আচ্ছা বলত, পোর্ত শহরে রীতা নামের ছাড়া আর কী কোন মেয়ে নেই?” কোমরে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়ায়। “তবে আমাকে দিয়ে গেছে একটি উপহার। একটি পুত্রসন্তান।” মুচকি হেসে জল ভরে দেয় আমাদের গ্লাসে। মেয়েটার চলনে কেমন একটা ছন্দ আছে। নাচতে নাচতে চলে যায়, ঠোঁটে শিএ তুলে। ঘাড় উঁচু, ব্যালেরিনার মত।
গান শুরু হয়।তার সংগে গিটার। করুণ টানা সুর। বলি, ‘ফাদো’বুঝি?” ফাদো গান পর্তুগালের বিশেষত্ব। ক’দিন এ নিয়ে একটু চর্চা করেছিলাম। তাতে যত না জেনেছি তার চেয়ে না জানাই বেশি।
রীতা বলে ওঠে, “না, না, এটা ফাদো নয়। সওদাদো।”
“সেটা আবার কী?”
“মন কেমন করা দুঃখের কবিতা বলতে পার।”
বলি, “তুমি এতগুলো ভাষা শিখলে কী করে বলত? একসঙ্গে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান, পর্তুগিজ চালিয়ে যাচ্ছ?”
“কেন? রোজেটা স্টোন, ইউ টিউব, ভিন দেশের বন্ধু বানানো, এইসব? এ তো আমাদের শিখতেই হয়। এ না হলে পর্তুগালে বাঁচা মুশকিল।”
একটু থেমে, “এত করে দু দুটো কাজ চালিয়েও রীতা মেক্স মিনিমাম ওয়েজ, লা … লালা লা লা।” শেষ অংশ সুরে। ফিরে এলে বলি, “আবার কী কাজ কর তুমি?”
“আই লারন এ আই, আরটিফিশিয়ৈল ইনটিলিজেনস। মিডজারনি, ড্যাল ই।”
“সে আবার কী?”
“রোবট কে কাজ শেখাচ্ছি। এ গুলো আরটিফিশিয়াল ইনটিলিজেনস প্রোগ্রাম। আমি গ্রাফিক আর্টিস্ট। বইয়ের মলাট বানাই। ঠিক শেখাতে পারলে কেবল হুকুম করলেই কাজ বেরিয়ে আসবে। খালি বলতে হবে ঠিক কী চাই।”
“আশ্চর্য!”
ম্লান হাসে রীতা। “মানুষের চেয়ে বেটার পারে।” বলে আমাদের খাবার এনে দেয়।
“আচ্ছা রীতা, এত ভাল ইংরিজি শিখলে কী করে বলত, তুমি?” বলি আমি।
“টিভি, মিস ডিটা। লুনি টুন কার্টুন। আমার মা বলতেন ঐ টিভি তোদের মাতৃভাষা কেড়ে নেবে।ঘর বাড়ি নিয়ে নেবে দেখিস ভিন দেশের মানুষ।” বলেই আবার সে অন্তর্হিত হয়। ফিরে এলে অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।
“তাই? কী করে?”
“তাই তো। মা তো খুব ভুল বলেনি। টিভি ইংরিজি শিখিয়ে অবশ্য আজ আমার রুজির ব্যবস্থা করেছে। সেই পয়সায় ছেলের মুখে রুটি তুলে দিতে পারি আজ, তবে বিদেশীরা যে আমাদের ঘর গ্রাস করেছে এ কথা তো মিথ্যে হয়নি।”
“কী রকম?”
“শুনবে? একদিন এক সুদর্শন যুবক এল সান ফ্রানসিসকো থেকে। এসে আমার বাবাকে বলল তার একটা ঘর চাই। একটা মাত্র ঘর। সে ঘরের জন্য যা টাকা অফার করল তাতে গোটা বাড়িটা ভাড়া নেওয়া যায়। আমার বাবা সামলাতে পারলেন না। সে চাইল শুধু একখানি ঘর। এ রুম উইথ এ ভিউ। সে ঘরটা ছিল আমার। তারপর যা হয়, মানি টকস লাউডার।
আমি দেখতাম ওপরের বারান্দা থেকে ওকে। নিচের উঠোনে কখনো তার শরীর চর্চা, কাঁচা রোদ্দুরে গলে পড়ছে ঘাম, কখনো কমপুটরের কি বোর্ডে টকাটক শব্দে আঙুলের খেলা। পৃথিবীর যেকোন জায়গায় বসে সে কাজ করে পয়সা বানাতে পারে। সে বেছে নিয়েছিল আমার ঘরটি। আমার তখন ষোল বছর বয়স। ঐ বয়সের ভুল, আমাকে ও টেনে নিল। তারপর শুধু এক খানা ঘর নয়, গোটা বাড়িটাই চলে গেল নাগালের বাইরে। বিকিয়ে গেলাম আমরা। শহর থেকে, আমার প্রিয় নদী তীর থেকে সরে গেলাম ভিতরে। অনেক ভিতরে। এটা এখানে খুবই কমন ব্যাপার।” রীতা চলে যায়।
ফিরে এলে অমিত বলে ওঠে, “একদিন দেখ, একজন ঠিক আসবে যে তোমাকে চায়।” ঘুরে দাঁড়ায় রীতা সোজা হয়ে।
“তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই, সিনর। ঐ যে দেখছেন দোকানটি, রেস্টুরেন্টের পাশেই, ওখানে তিন জন, আর যে গান শুনলেন, দুজনেই … আর কত বলব? সুযোগ পেলেই ‘রীতা, শনিবার ফ্রি আছ?’” মুখ হাতে আড়াল করে ওদের গলা নকল করে।
“কথা হল, রীতা কাকে চায়। রীতাকে কে চায়, না, সিনোর। না কি রীতা কাউকেই চায় না? শনিবার রীতা ছুটি পেলে ডেট করবে তার সাত বছরের ছেলের সঙ্গে। তাকে নিয়ে যাব আমি বল খেলার মাঠে, কিনে দেব আইসক্রিম কোন।” বলে একমুখ কনফিডেনট হাসি উপহার দিয়ে এগিয়ে দেয় ক্রেডিট কার্ড যন্ত্রটি।
“কিন্তু তুমি খুশি।”
“কী করে জানলেন?”
“এই যে তোমার হাসি খুশি চলনে বলনে!”
“হা হা, আই ট্রিকড ইউ। ওটা মুখোশ। ক্লাউনের যেমন থাকে।”
অমিত বলে, “তুমি খুব কাজের মেয়ে রীতা, খুব ভাল মেয়ে। তোমার বস কই? তাকে বলে যাব রীতার রেজ হওয়া উচিত। কই তোমার মালিক?”
“আমার মালিক? নেই।” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার অভিনয় করে।
“তবে আপনি সবাইকে বলে দেবেন, ফেসবুক, আর ঐ সবে। রীতাদের রেজ হওয়া উচিত, শোন তোমরা – পোর্তর রীতাদের রেজ হওয়া উচিত।”
তারপর দুহাত ওপরে তুলে আঙুলে থালার চাকতি ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে চলে যায়।
অক্টোবর ১২, ২০২২
সাও বেনটো স্টেশন
পোর্ত থেকে ঘন্টাখানেকের পথ ট্রেনে আভেরো, দক্ষিণ বরাবর নামলে। কিন্তু যা আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করল তা পোর্তর সাও বেনিটো স্টেশন, যেখান থেকে ট্রেন ধরেছিলাম। এক কালে এটি ছিল কনভেনট। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর সেরা রেল স্টেশনের একটি এবং একটি UNESCO heritage site ও বটে।
স্টেশনটির দেওয়ালে, মাথার ওপর ছাতে অপূর্ব টালির কাজ। মূলত সাদা ও নীলের নানান শ্যেডের অঙ্কন শিল্প। তাতে কোথাও ঐতিহাসিক গল্প, কোথাও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের ছবি। ডুয়ারো নদীর তীরে মাছ ধরা-বেচা, কোথাও চাষীর জীবনের, পরিবারের ঘনিষ্ঠ ঘরোয়া ছবি।
টালিগুলি ছ-ইঞ্চি সমান চৌকো ছাঁদের প্রতিটি। এগুলো এক একটা হাতে করে বানান, তারপর তা বিশেষ উনুনে ঝালিয়ে বা কিলনে (kilne) বেক করে এখানে লাগান হয়। প্রায় বিশ হাজার টাইলের কাজ এখানে এবং চোখে না দেখলে তার ব্যপকতা আন্দাজ করা যাবে না।
এই টাইলের কাজকে বলে ‘আজুলেহ’। যা প্রথমে আসে মুর দের কাছ থেকে। কিন্তু ইসলামি শিল্পী সেখানে জয়গান গেঁথেছেন রেখার অলঙ্করণে, আনেন নি কোন প্রতীক, অবয়ব। পরেকার খৃস্টান শিল্পীরা ভাঙলেন তা। কিন্তু আজুলাহের মূল পদ্ধতি ধর্ম নিরপেক্ষ। দুই ধর্ম শিল্পের আঙিনায় এক হয়ে গেছে। নেই কোন বিরোধ।
আর্ট ধর্মের ওপর দিয়ে যায়, – এ কথাটাই মনে হল আমার সে ঘরে দাঁড়িয়ে।
এ কোন মিউজিয়াম না, কোন আর্ট গ্যালারি নয়। সাধারণ একটি রেলওয়ে স্টেশন মাত্র যেখানে একটু পরেই আমাদের ট্রেন ধরতে হবে। অথচ কী অপরিসীম শিল্প সমৃদ্ধ, সুন্দর। পোর্ত আসলে আর কিছু না দেখলেও ডুয়ারো নদী আর এই স্টেশনটি না দেখে যাবেন না।
শুনেছি যে শিল্পী এর ভার নিয়েছিলেন, জর্জ কোলাচো (Jorge Colaco), তাঁর সময় লেগেছিল বারো বছর — ১৯০৪ থেকে ১৯১৬।
আভেরো
শুনেছিলাম আভেরো হল পর্তুগালের ভেনিস। খালে বিলে ভরা। কিছু গনডোলা জাতীয় নৌকার ছবি দেখে ভুলেছিলাম। কিন্তু গিয়ে পড়ে বেশ নিরাশ হলাম। একটা খাল মত আছে বটে, কিছু লাল নীল নৌকো টুরিস্টদের ছেলে ভুলানো মত, কিন্তু চার পাশে ভাঙাচোড়ার কাজ চলছে। ফলে পথ ঘাটের নির্দেশ জি পি এস গুলিয়ে ফেলে যা তা অবস্থা।
কোনমতে আমাদের বেড এ্যানড ব্রেকফাস্টের ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম আর সেখানেও বেশ ধাক্কা পেলাম। ঘরটা এত ছোট, যদিও সুরুচিপূর্ণ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টার ত্রুটি নেই তবু মন খারাপ হয়ে গেল।
প্রথমত নিজেদের অসুবিধা, দ্বিতীয়ত মনে পড়ল সেই পোর্তোর রীতার কথা। নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে এ বাড়ির বাসিন্দারাও হয়ত তার মত ছেড়ে দিয়েছে তা টুরিস্ট দের জন্য, রোজগারের তাগিদে।
মেয়ে দুটো বড়ই ভাল, নিজে হাতে রেঁধে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়েছে, বাগানের ফলের রস এনে দিয়েছে, ঘরে বানানো জ্যাম খাইয়েছে। কত দূর থেকে না এসে এসব করে ওরা, তাই ভাবলে আর নিজেদের সামান্য অসুবিধা বড় হয়ে দাঁড়ায় না।
একটা ওয়াকিং ট্যুর নেওয়া ঠিক হল। তার গাইড কে খুঁজে বার করাও একটা গপ্প। তবে তিনি অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাই তাঁর জন্য মাথার টুপি খুলতেই হয়।
আভেরোর সম্পদ এর নুন — ‘সল্ট এন্ড দ্য সী।’ মোটাসোটা গাইড ভদ্রলোক এ কথা বলে গম্ভীর। এখানের সামুদ্রিক লবণ অতি উৎকৃষ্ট। তার উৎপাদন এক কালে যা হত তা শুধু পর্তুগাল নয়, দূরদূরান্তে পৌঁছে যেত। উত্তর গোলার্ধে স্কান্দেনাভিয়া পর্যন্ত। মাছ নুন দিয়ে জারিয়ে রাখা একটা অপরিহার্য ব্যাপার ছিল সে যুগে। আজও এখানকার লবনের দারুন দাম কুইলিনারি এক্সপার্ট দের মূল্যায়নে। উঁচুদরের মিহি কোয়ালিটি আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর উপকারিতার জন্য।
একসময় এর ভেরি বা খালগুলি বুঁজে যায়। সে কয়েক শতক আগের কথা। আভেরোর অর্থনৈতিক অবস্থা চরমে উঠল। ভূতের শহরে পরিণত হয় রমরমা আভেরো। তখন এখানে রেল রোড বসানো ঠিক হল যা লিসবন ও পোর্তর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে। যিনি এই যুগান্তকারী সমাধানটি আনেন তাঁর একটি মূর্তি আছে স্কোয়ারে। এমন নানান গল্প শুনতে শুনতে চললাম। যেগুলো মনে ধরেছিল তার দু একটা শোনাই।
“ঐ যে বাড়িটা দেখছেন, ওর একটা গল্প আছে।” গাইড সাহেব আঙুল তুলে দেখালেন একটা বাড়ি, মোড়ের মাথায়।
একবার এক বিশেষ কেউকেটা (নাম ভুলেছি) ঠিক করলেন একটা চৌকো ময়দান বানাবেন। তাঁর নিজস্ব গভর্নমেন্ট অফিস থাকবে একপাশে, মাঝখানে তাঁর মূর্তি। এমন একটা বর্গক্ষেত্র জন সমাবেশের জন্য উপযুক্ত হবে, মনে হল তাঁর।
পাশ দিয়ে গেছে একটা সরু রাস্তা যা বর্গক্ষেত্রটার চেহারা পালটে দেয়। তার একটা বাহু আর কিছুতেই সমান্তরাল রাখা যাচ্ছেনা। এদিকে এ গলিটি পুরানো। দোকান আছে কয়টা, তারা না হয় গরীব লোক, তুলে দেওয়া অসুবিধা নয়। কিন্তু গলির মুখের ঐ বাড়িটি?
নোটিশ গেল। বাড়ির মালিক হাত জোড় করে অনেক কাকুতি মিনতি জানালেন। বাড়িতে বেশ কিছু ভাড়াটেও ছিল। মালিক একেবারে হাঘরে দরিদ্র না হলেও আবার মস্ত বড়লোকও নন। তাঁর মাথায় এক আইডিয়া এল। সেই চিরন্তন সমাধান— মানি টকস। বললেন, ‘আমাকেও এই পরিকল্পনার একজন মনে করুন না। আমাকেও কিছু করার সুযোগ দিন, এই চত্বরটার সৌন্দর্য বর্ধন করার জন্য।’
– ‘কী রকম?’
– ‘স্যর, এর দেওয়াল আমি টালির প্যাটার্ন দিয়ে মুড়ে দেব, বাড়ি ভাঙার কী দরকার? সাদা নীল এমন টালি দেব যে তাই লোকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। গলি সমান লাইনে আছে না বাঁকা, তা চোখেই পড়বেনা। এ টালি পর্তুগালের গর্ব। আপনার গর্ব। দাঁড়ালেই চোখে পড়বে। আপনার নাম গাইবে ইতিহাস, স্যর।’
রাজি হল উপরওযালা-অফিসার। আজ এই বাড়িটি একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। টুরিস্টরা তার ছবি তোলে আর হোমলেস দুস্থ মেয়েরা টেম্পোরারি শেলটার নিতে পারে যতদিন না কোন কাজ পায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে।”
এরপরে একটি অভিজ্ঞতার কথা লিখে আজকের ডাইরি শেষ করব। একটি গ্রেভ ইয়ার্ড বা কবরখানায় গিয়ে একটি মূর্তি দেখে আমার যা মনে হয়েছিল।
কৈফিয়ৎ
“চল, সময় হয়েছে।” গর্জে ওঠে আওয়াজ।
“কে তুমি?” মেয়েটির আকুল প্রশ্ন।
“আমি মৃত্যুর দূত। এসেছি তোর পাপের সাজা গুণতে।”
“পাপ? কীসের পাপ?”
“তুই জানিস না তুই কে? কী করেছিস?”
“অনাথ আমি, মহানুভব, তাই জানতাম শিশু কালে। কতদিন পরম পিতা কে শুধিয়েছি, ‘কে আমি, পিতা, কোথা থেকে এলাম? কে আমার বাপ মা?’ উত্তর দিতে পারেন নি। পাথরের মত ছিলেন নিশ্চুপ।”
“তিনি ই তো তোর পিতা, আহাম্মক!” ভ্রু কুঞ্চিত করে দূত।
“তবে যে ওরা বলে আমি বেজন্মা? বাপ মায়ের ঠিক নেই?” গলা চড়ায় মেয়েটি।
“খামোশ! সারা জীবন করেছিস কী?”
“এই মন্দির চত্তরেই বড় হয়েছি, মহানুভব। এর মাটি, এর প্রাঙ্গণ ধুয়ে মুছে নিকিয়ে দিন কাটিয়েছি।”
“মন্দিরের সেবা? তাঁর কাজ। তা তাঁকে ভালবেসেছিলি?”
মাথা নিচু করে থাকে মেয়েটি।
“কী বললাম, ভালবেসেছিলি তাঁকে?”
“ভালবাসা কী জানিনা প্রভু।”
“বেশ, মন্দির চত্তরে নেচেছিলি না?”
“আজ্ঞে, সেদিন তা উন্মুক্ত ছিল সবার আনন্দের জন্য!”
“হাঃ, আনন্দের জন্য! তা সেদিন রাত কাটিয়েছিলি না রাজ চক্কোত্তির সঙ্গে?”
মেয়েটি মাথা নাড়ে। “টাকা দিয়েছিলেন, নিয়েছিলি তো?”
“আজ্ঞে, আমি গরীব মানুষ, তিনি দিলেন…”
“তা কেমন লেগেছিল?”
মেয়েটি লজ্জায় মিশে গেল যেন মাটিতে।
“একদম মিছে কথা বলবি না।আমি ঠিক ধরে ফেলব। আমি মৃত্যুর দূত। ভাল লেগেছিল, কি না?”
মেয়েটি মাথা নাড়ে। “লেগেছিল।”
হা হা করে উৎকট হেসে ওঠে দূত।
“ওই খানেই তোর পাপ। তুই মেয়ে মানুষ তোর আবার সঙ্গমে আনন্দ কী রে? তোর তা প্রাপ্যই নয়।… ভাল কথা, আর কবার এসেছিলেন তিনি?”
“আর আসেন নি, মহানুভব।”
“কিন্তু তোর ভাল লেগেছিল?” বাঁকা হাসি হেসে দূত শুধায়, “ভালবেসেছিলি?” গলার স্বর নামিয়ে।
মেয়েটি চমকে ওঠে। “ভালবাসা কী আমি জানি না প্রভু।” বলে, মুখ তুলে।
“তোর পাপের মূল্য ধরে দিয়েছিলি কোন দিন? পয়সা কড়ি?” আঙুল ঘষে দেখায়।
“আজ্ঞে না।”
“তবে পিঠ খোল। তোর জমেছে একশো চাবুক মাসুল আর এক মন ঘৃণার বোঝা বইতে।”
মেয়েটি শিউরে ওঠে। মাথাটা টলে, তারপর এক আশ্চর্য নির্লিপ্তি যেন অবশ করে দেয় তাকে। মোমবাতির মত যেন সে গলে যাচ্ছে। শেষ শিখাটি দপদপ করে, সে বলে ওঠে,
“কিন্তু আমার নাগাল পাবেন না আপনি, চাবুক যে মারবেন। আমার শরীর নেই, মন নেই, ব্যথা নেই। নভোনীল ছায়াপথে নক্ষত্রের ধুলিকা আমি, চললাম মাতৃগর্ভের উষ্ণ নিরাপত্তায়, আপনার নাগালের ঊর্ধ্বে।