কোভিডের জমানায় আমাদের জগত ক্রমে অলৌকিক, মানে অপার্থিব হয়ে উঠছে! ভাবছেন ভূতের গল্পের ভূমিকা করছি কি না? উঁহু, যা ভাবছেন তা নয়। আরে বাবা, কোভিড মানেই তো ছোঁয়াছুঁয়িতে ভয়! যাকে বলে “ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ” অবস্থা। অতএব গতবছর থেকে সবকিছুই ই-স্যাভি হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ কি না ভার্চুয়াল, যার বেঙ্গলি টার্ম হলো গিয়ে অপার্থিব! এই অপার্থিব জগতে যারা খেলতে পারছেন তাঁরা হলেন খিলাড়ি আর যারা পারছেন না তাঁরা নেহাতই আনাড়ি! দেখি তো কেমন এই অপার্থিব জগত, তবে তো বুঝবো কারা খিলাড়ি আর কারা আনাড়ি।
প্রথমেই খাওয়াদাওয়া। বাজার যাবেন? ওহ নো! মানুষের ভিড়! কে হাঁচে, কে কাশে ঠিক কী! প্রতিটি তরকা্রি, মাছ, মাংসই সন্দেহজনক! গায়ে লেগে থাকতে পারে সেই অদৃশ্য ভাইরাস! অতএব মনুষ্যগণ সবাই যার যার স্মার্ট ফোনে বা ল্যাপটপে নামিয়ে ফেলুন স্পেন্সার্স, এ-মার্ট, বি-মার্ট, কে-মার্ট, ডেলিবাজার ইত্যাদি ইত্যাদি – সবারই আছে বাহারি অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইট! তারপর কিনে ফেলুন বাহাত্তর টাকা দিয়ে একটি সবুজাভ বাঁধাকপি কিংবা আড়াইশো টাকা দিয়ে এক কিলো টুকটুকে আপেল! এবার পেমেন্টটি করে দিন ডেবিট, ক্রেডিট, নেটব্যাঙ্ক, এ-পে, বি-পে, জি-পে যা দিয়ে ইচ্ছা! এর পরেও সেই মার্ট জানাতে পারে যে তাঁদের ডেলিভারিতে এতো চাপ পড়েছে যে আগামী এক সপ্তাহে কোন ডেলিভারি স্লট নেই! অতএব থাকো এক সপ্তাহ সেদ্ধ ভাত খেয়ে! যদি এতো সব বাধার পর পেমেন্ট সাকসেস এবং স্লট সাকসেস হয়, তবে যুদ্ধজয়ের মতো বীরদর্পে বাজার শেষ!
বাজার করতে, রান্না করতে, খাবার বাড়তে ইচ্ছে করছে না? নো হেল্পিং হ্যান্ড? নো চিন্তা! অলৌকিক জগতে কোন কিছুর অভাব নেই। অতএব সেই স্মার্ট মোবাইল! সেই ডাটা, সেই নেটওয়ার্ক থাকলে বোঝ গুণী যে জানো সন্ধান। অসংখ্য রেস্তোরাঁ ও তাঁদের ফুড ডেলিভারি পার্টনার হা-পিত্যেশ করে বসে আছে এই বুভুক্ষু ব্যাকুল জনতার খিদে মেটাতে! ঢুকুন কোন এক ফুড ডেলিভারি অ্যাপে আর চটপট – “ক্যা অর্ডার করে? যো ভি! ছোলে বাটুরে!!” রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ক্যাপ্টেন! খানিক পরেই গরম খাবার হাজির! এহুম – না এগুলো ভার্চুয়াল নয়! রিয়েল! সঙ্গের ডেলিভারি পার্সনটিও! অতএব মুখে মাস্ক পরে, এক হাতে টিকটিকি মরা ফেলার মতো এক আঙ্গুলে ধরে সেই প্যাকেট টেবিলের এক কোণায় রেখে দিন এবং প্রচুর স্যানিটাইজার স্প্রে করে যা থাকে কপালে বলে প্যাকেট খুলে গরম গরম খেয়ে নিন!
নেক্সট ইন লাইন – এই জমানায় হায় – জামাকাপড়, জুতো, সাজগোজের প্রয়োজনই প্রায় ফুরিয়েছে! কারণ কেউ কোত্থাও যায় না, আসেও না। মায় অফিসও বাড়িতে। তাও যদি খুব শখ হয়, তবে সেও অনলাইন! আম জনতার জন্য জামা, জুতো, ছাতা নিয়ে ফ্লিপকার্ট, আমাজন, আরো কতজন ওয়েবসাইট খুলে বসে আছে! আমাজনের গহনে বসে মনের আনন্দে কেনাকাটা করুন এবং বাক্সটি বাড়িতে এলে মোটামুটি একটি ঘৃণ্য পদার্থ হিসাবে তিনদিন রোদে ফেলে রেখে ঘরে প্রবেশ করান।
ব্যাঙ্ক? সে তো আরো ভয়ানক বিপদজনক। সেখানে টাকা তুলতে বা রাখতে গিয়ে কতজন যে হাসপাতালে গেছেন তার ঠিক নেই! অতএব ব্যাঙ্কের মুখ দেখার প্রশ্নই নেই। কিন্তু রেস্ত তো চাই। অতএব ই-ব্যাঙ্কিং! ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপ আছে তো। ঢুকুন সেখানে আর দেওয়া নেওয়া সারুন এন ই এফ টি কিংবা আই এম পি এস করে! এ সব টার্মের মানে যারা জানেন না তারা বিলকুল আনাড়ি!
নেহাত যাদের শপ ফ্লোরে লোহা পেটাতে হয় না কিংবা চিমনিতে কয়লা দিতে হয় না অথবা হাসপাতালের ওটি তে পেট কাটতে হয় না অর্থাৎ যে সব কাজকর্ম ভদ্রভাবে টেবিলে বসে হয়, তেমন সব কাজই এখন কোলে চড়ে বসেছে! ভাবছেন সে আবার কী? কোল মশাই কোল – মানে ল্যাপ আর তার টপ অর্থাৎ সব কাজই ল্যাপটপে করতে হচ্ছে এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম মোডে। অতএব গুচ্ছ গুচ্ছ ডাটা (চিবিয়ে ফেলবেন না!) কিনুন আর বসে পড়ুন ল্যাপি নিয়ে! সবই ভার্চুয়াল। আর মিটিং? কোথায় ক্লায়েন্ট, কোথায় বস আর কোথায় আপনি – ‘মাঝে নদী বহে রে – ওপারে তুমি রাধে এ পারে আমি’! অতএব মিটিংও ভার্চুয়াল! তার জন্য এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং গুগলদেব উইথ গুগল মিট এবং পোকিং টম চায়না, হায়নার মতো নিয়ে এসেছে জুম মিটিং! যে পারো যেখান থেকে পারো প্রবেশ করো এবং ছোট ছোট খোপের মধ্যে বিচিত্রবর্ণ মুণ্ডু হিসাবে দেখা দাও! ক্যাচকোচ শব্দে বিচিত্র ক্যাকোফোনি তৈরী করে যতো পারো মিটিং করো প্রাণ ভরে। কথায় বলে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ আর এ হলো যতক্ষণ ডাটা ততক্ষণ নেটওয়ার্ক – যতক্ষণ নেটওয়ার্ক ততক্ষণ মিটিং অ্যান্ড ওয়ার্ক। অল টাইম ইস অফিস টাইম!
আর শুধু কি অফিস? অনন্তকাল ধরে ইস্কুল কলেজ বন্ধ! ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা ক্লাস থ্রি তে উঠে আবার যখন স্কুল যাবে তখন রাস্তাই ভুলে যাবে বুঝি! আর যারা দু তিন বছরের কোর্সে হায়ার স্টাডিস-এ আছেন, তারা ঢুকেছিলেন রিয়েল, বেরোবেন ভার্চুয়াল ডিগ্রি নিয়ে। মাঝে সবই অপার্থিব অনলাইন। পড়াও অনলাইন, পরীক্ষাও অনলাইন, ডিগ্রিও অনলাইন। ভরসা সেই স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, ডাটা নেটওয়ার্ক, অউর? অউর তুম – জুম! বড়ে আচ্ছে লগতে হ্যাঁয় – ইয়ে ক্যাসুয়াল ড্রেস, ইয়ে গুগল দেখকে আনসার, ইয়ে কিতাব দেখকে চোরি, অউর? অউর ভিডিও অফ করকে নিইইইন্দ! অতএব বুঝছেনই পড়াশোনার হালত কী।
এমত রূপে খাওয়া পরা হলো, কাজকর্ম হলো, পড়াশোনা, টাকাপয়সার ব্যবস্থাও হলো। কিন্তুক অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে মেকস জ্যাক এ ডাল বয় এ কথা কে না জানে? এব্বার তবে এন্টারটেনমেন্টের গল্প। হু হু বাবা, সেই তো আসল গল্প! কেউ তো আর মাঠে ফুটবল খেলতে যাচ্ছে না! এ ভাইরাস ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকেও ছাড়ে না! কেউ মঞ্চ কাঁপিয়ে অরিজিত সিং নাইটও করবে না! আর পাড়ার মাচা তো কবেই আত্মারাম খাঁচা হয়ে গেছে! সিনেমা হলও বন্ধ। শুটিং, পার্টিইং, ডান্সিং, সিঙ্গিং অল ইং বন্ধ। অতএব দুনিয়ার শিল্পী, গায়ক, নায়ক, লেখক এক হও! আর তুমি আমি যারা একটু আধটু লিখতুম কিংবা গাইতুম কিংবা নাচতুম আমাদের আশা ভরসার গুড়ে কি শুধুই বালি? উঁহু, বরং দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি ……কার আশা কিসের আশা? কিসের আবার? ফেসবুকের, হোয়াটসঅ্যাপের, মেসেঞ্জারের, ইনস্টার, স্ট্রিমইয়ার্ডের, লাইভের, ইউটিউবের! এঁরা আছেন কী করতে? একটি ইস্মার্ট ফোন এবং ল্যাপি এবং ডাটা এবং নেটওয়ার্ক থাকিলে নো চিন্তা নো ভাবনা। পাবেন অন্তহীন অপার্থিব আনন্দ! ফেসবুক খুলে দেখুন! দুপুর দুটো হইতে রাত্রি এগারোটা অবধি অন্ততঃ একশোটি লাইভ – গানের লাইভ, নাচের লাইভ, কবিতার লাইভ, গল্পের লাইভ, আলোচনার লাইভ, ভার্চুয়াল ট্রফি বিতরণের লাইভ, জাঙ্ক জুয়েলারি বিক্রির লাইভ, শাড়ি কিংবা গাউন বিক্রির লাইভ! পূর্বে একটি লাইভে একসঙ্গে একটি মানুষের আগমন হতো! কিন্তু ইদানীং স্ট্রিমইয়ার্ডের দৌলতে গুঁতোগুঁতি করে একসাথে যত জন পারে ঢুকে পড়ছে সেই অপার্থিব জগতে! সুর বেসুর অসুর কোন কিছুরই অভাব নেই! লাইক, লাভের বন্যা বয়ে যাচ্ছে! গব্বে বুক ফুলে উঠছে শিল্পীগণের! নিজেই পারফর্ম করেন, নিজেই দেখেন কেউ না থাকলে – ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে!’- ‘ কেউ কি আছেন? কেউ কি আমায় দেখতে পাচ্ছেন? শুনতে পাচ্ছেন? ঠিক আছে, আস্তে আস্তে আসুন – আমি ততক্ষণ একটু ইলেকট্রনিক হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা বেঁধে নিই!’
গান শুনুন, ভিডিও দেখুন ইউটিউবে! অথবা ল্যাপি নিয়ে সোজা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখে নিন রগরগে, কিংবা মুচমুচে কিংবা রঙ্গিন অথবা ধুমধাড়াক্কা ওয়েব সিরিজ কি সিনেমা! সন্ধেটা বোর হবার কোন চান্স আছে কি? আর টিনেজারদের জন্য অনলাইন অফলাইন গেমের দুনিয়া! সেই মুঠোফোন আর ডাটা থাকলেই বাজিমাত!
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট – যদি নেহাত, ভগবান না করুন, রাস্তায় বেরোতেই হয়, তবে পাবলিক ভেহিকল নৈব নৈব চ! ভরসা নিজের বাহনটি! বাহনে উঠেই আবার সেই অপার্থিব জগতের হাতছানি। স্মার্ট ফোনটিতে গুগল ম্যাপ অন না করে এখন গাড়ি চালায় কোন আহাম্মক? অতএব – ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা (থুড়ি গুগুলু), আমি যে এ পথ চিনি না! তোমারি উপর করিনু নির্ভর তুমি বিনে কিছু জানি না’ – আচ্ছা গানটা এমন খাপে খাপে বসে গেলো কী করে বলুন তো! এই জন্যই বলে কবিরা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হয়। গানের শেষে হয়তো দেখলেন ম্যাপ মোরে নিয়ে এলো এ কোন তিমিরে! আপনি কোন হদ্দ সরু গলির শেষে কারো রান্নাঘরের পিছনে অপেক্ষা করছেন আর ম্যাপ প্রায় নিশির ডাকের মতো ভুলভুলাইয়ায় আপনাকে ঘুরিয়ে চলেছে! তা হোক, ম্যাপ বিনে মোরা অন্ধ এখন।
এতক্ষণ পড়ে (যদি ধৈর্য ধরে পড়ে থাকেন) কী বুঝলেন? অ্যাঁ! হ্যাঁ……ঠিকই বুঝেছেন। যদি থাকে স্মার্ট ফোন আর থাকে ডাটা – কোভিডকে টাটা! পার্থিব জগতে যতই দুঃখ থাক, অপার্থিব জগতের রাস্তা খোলা। এতক্ষণ কত্তোগুলো সাইটের, অ্যাপের, ব্যাঙ্কিং প্রোটোকলের নাম বললাম বলুন তো? আর ক্ষণে ক্ষণে তো স্মার্ট মোবাইল আর ল্যাপটপের নাম করলাম! সব্বাই কি জানে কী করে এগুলি ব্যাবহার করে? এবার তবে বলি এই অপার্থিব জগতে কারা খিলাড়ি আর কারাই বা আনাড়ি!
সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে, খ্রিস্টের জন্মের আগে ও পরের মতো, স্মার্ট মোবাইল আবিষ্কারের আগের ও পরের প্রজন্মের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ! যে সব শিশু ২০১০ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের এই অপার্থিব জগতের সাথে পরিচয় জন্ম ইস্তক এবং পটুতা অভূতপূর্ব! কোলের শিশুটি এখন জন্মেই টেডি বিয়ার হাতে দিলে ছুঁড়ে ফেলে পাশ থেকে মায়ের স্মার্ট মোবাইলটি টেনে নিয়ে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে! কিছুদিনের মধ্যেই তাদের শিশুশিক্ষার পাঠ শুরু হয় ইউটিউবে ভিডিও দেখে। পাঁচ ছয় বছর বয়সের মধ্যে সর্বপ্রকার অ্যাপের নাম পরিচয় ঠিকানা এরা জেনে ফেলে এবং সাত আট বছর বয়স হওয়ার পূর্বেই আপনাকে হতচকিত করে আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি বানিয়ে দিতে পারে অথবা আপনার স্পেনসার্সের বাজারের ফর্দ সিলেক্ট করে অর্ডার করে দিতে পারে! নিজেরা অজস্র অনলাইন গেম খেলার কথা তো ধরলামই না। এরা অতি ছোট বয়সে মোবাইলের সামনে বসে অনলাইন ক্লাস করে, নিজেদের খাতা আপলোড করে, টিচারের সঙ্গে হোয়াটস-অ্যাপে চ্যাট করে। কখন সে সব শিখলো আপনি টেরও পাবেন না। অতএব যখন তখন আপনি ফোনের ওপর আপনার অধিকার হারাতেই পারেন যতক্ষণ না আপনি তাদের নিজের ফোন কিনে দেন। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ও অদ্ভুত এক ভাষায় এরা অতি দ্রুত স্মার্ট মোবাইলের কি-বোর্ডে টাইপ করতে সক্ষম! এই প্রজাতিকেই এই অপার্থিব জগতের সবচেয়ে বড় খিলাড়ি বলা যায়। এরই রেশ টেনে ২০০০ সালের পরবর্তী জেনারেশনকে অর্থাৎ যারা এখন টিন-এজার তাদেরকেও এই ব্র্যাকেটে ফেলে দিন।
এর পরেই আসে আই টি দুনিয়ার জীবেরা। সারাজীবন কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে বসে এবং ল্যাপের ওপর ল্যাপটপ চড়িয়ে কাজ করে করে এঁরা এমনিতেই দিনের আলো, রোদ বৃষ্টি দেখতে পান না। কাঁচের ঘরের দুনিয়ায় এদের অপার্থিব জগত। অতএব এই কোভিড পরবর্তী অলৌকিকতায় এঁরা সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।
সর্বশেষ খিলাড়ি হলেন ফেসবুকপ্রেমী মানুষজন। তার মধ্যে গৃহবধূও আছেন, লেখক, কবি, শিল্পীগণও আছেন, চাকুরিজীবি মানুষও আছেন। ফেসবুকের নেশায় এঁরা স্মার্ট ফোনটি শিখে নিয়েছেন এবং চ্যাটিং এ অভূতপূর্ব বুৎপত্তি লাভ করেছেন। এদের মধ্যে একটি বড় সংখ্যা আবার ওটিটি প্ল্যাটফর্মেরও বড় ভক্ত! অসংখ্য বুটিকের এবং লাইভের এরাই হোতা এবং শ্রোতা দুইই। টিভি সিরিয়ালের পাশাপাশি দিনের একটি বড় সময় তাঁরা ব্যয় করেন স্মার্ট ফোনে! এরই এক্সটেনশন হিসাবে অনলাইন কেনাকাটার জন্য ই-ব্যাঙ্কিং ও এঁরা শিখে নিয়েছেন । অতএব এদেরও বেশ রসালো খিলাড়ি বলাই যায়।
এবার দেখা যাক কারা হলেন ডাইনোসর বা আনাড়ি! অর্থাৎ এই অপার্থিব জগতে প্রায় অচল। এর মধ্যে একটি বড় অংশের জন্ম ১৯৭০ সালের আগে। অর্থাৎ কম্পিউটার পূর্ব যুগে। এঁরা এই অবস্থায় বড়ই অসহায় বোধ করেন। আমার মাতা ঠাকুরানীকে আমি অজস্রবার বলেও মোবাইলকে ভালোবাসাতে পারিনি। স্মার্ট মোবাইল ব্যবহার করতে তিনি সাফ অস্বীকার করেছেন। অতঃপর তাকে একটি ক্যারাকটার মোবাইল দিয়েছিলাম। এখন তিনি বহু কষ্টে সেটিতে ফোন রিসিভ করতে পারেন আর বারবার পুরো নম্বর টাইপ করে করে ফোন করতে পারেন। সেভড নম্বর ডায়াল করতে পারেন না। ই-ব্যাঙ্কিং এদের পক্ষে অসম্ভব! এমনকি কয়েকদিন আগে আমার ওঁর হয়ে ব্যাঙ্কিং ট্রানস্যাকশন করায় একটি ওটিপি ওঁর ফোনে যায়। প্রথমত ওটিপি কী ও কেন এবং এতে তার সব টাকা চুরি হয়ে যাবে কিনা সেই তথ্য তাঁকে বোঝাতে আমাদের কাল ঘাম ছুটে যায় এবং অতঃপর সহস্রবার নির্দেশ দিয়েও তিনি মেসেজে গিয়ে মেসেজ পড়তে এবং ওটিপি টি বলতে পারেননি। ফলে ওনার ব্যাঙ্কিং ট্র্যানস্যাকশনটি ক্যানসেল হয়ে যায়! এখনো তিনি এই অবস্থাতেই আছেন।
এমনি বহু মানুষ যাদের এমনকি চল্লিশ বা পঞ্চাশের কোঠায় বয়স তারাও অনলাইন অর্ডার, ই-ব্যাঙ্কিং কিছুই করতে পারেন না। আশ্চর্যভাবে এই দলে বহু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার টিচার বড়সড় সিনিয়র পোস্টে কাজ করা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন এক বিশাল সংখ্যক গৃহবধূ। এঁরা সম্পূর্ণভাবে ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি অথবা আই টি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। এদেরকেও আনাড়ি ছাড়া আর কী বা বলা যায়? এই পরিবর্তিত জগতে তাঁরা প্রবেশ করতে গিয়ে যেন বলেন “যাব কি যাব না ভেবে ভেবে হায়রে যাওয়া তো হলো না।“
সবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় সেই বিশাল জনতার জন্য যারা গ্রামে গঞ্জে থাকেন যেখানে আজও আলো পৌঁছোয়নি, স্মার্ট ফোন পৌঁছোয়নি, ডাটা পৌঁছোয়নি, নেটওয়ার্ক পৌঁছোয়নি, যারা অনলাইন ডেলিভারির আওতার বাইরে। এই পরিস্থিতিতে আমরা কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি দেখেছি। শহরের কোন এক স্কুলের শিক্ষকের বাড়ি গ্রামে। সেখানে নেটওয়ার্ক খুব খারাপ! অথচ স্কুলে অনলাইন ক্লাস নিতে হবে। অতএব তিনি একটি গাছে মাচা বেঁধে নিয়েছেন। সকালে উঠেই মাদুর, টিফিন কৌটোয় খাবার নিয়ে সেই গাছের মগডালে চড়ে বসেন। কারণ শুধু ঐ মগডালে বসলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় দূরের এক টাওয়ার থেকে। তিনি সেখানে স্মার্ট ফোনটি ঝুলিয়ে সারাদিন ক্লাস নেন! আর এক চাষীর ছেলে খুব মেধাবী। সে দৈনিক ছয় ঘন্টা পায়ে হেঁটে গ্রাম থেকে এক আধা শহরে যায় এক বন্ধুর বাড়ি তার স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস করার জন্য। তার গ্রামের ব্যাঙ্কে ই-ব্যাঙ্কিং হয় না বলে সে স্কুলের ফি দিতে পারেনি দীর্ঘদিন। শীঘ্রই হয়তো স্কুল থেকে বিতাড়িত হবে। আবার এর উল্টোদিকে হাসি পাবে একদল শহুরে অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত ছেলেকে দেখে যারা বাবা মার কাছ থেকে বাগিয়ে একশোটি টাকা নিয়ে নেট মেরে নেয় আর তারপর বসে যায় অনলাইনে পাবজি বা ঐ ধরণের কোন খেলা খেলতে। এরা আমাজন বা সুইগিতে ডেলিভারি করে গুগল ম্যাপ দেখে। স্মার্ট ফোনে অনায়াসে পর্নো ভিডিও পাঠায় গার্ল ফ্রেন্ডকে! নিজেদের মধ্যে বিট-কয়েন এক্সচেঞ্জ করতে পারে! এদেরকে বলি সুপার সে ভি উপর খিলাড়ি! সাধে কি বলেছে এ এক অপার্থিব জগত!
4 Comments