যাতনা কাহারে বলে

যাতনা কাহারে বলে

নারীর মানসিক নির্যাতনের লিস্টি কি আর একটুখানি বাবুমশাইরা! সে কথা বলতে গেলে শব্দ কম পড়ে যাবে। কথায় বলে স্ত্রী লক্ষ্মী, সংসারের সব কিছু একা হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে সে রাখবে, এটাই তো সমাজের এক প্রকার অলিখিত নিয়ম। ভারতবর্ষে এই সমস্ত লক্ষ্মীদের হাতে হাতে কাজ করার জন্য আরো বেশ কয়েকজন লক্ষ্মীর আগমন ঘটে। তাদের সেবা পেতে গেলে গেরস্তর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কিঞ্চিৎ ধনরাশি গলে গেলেও সংসারে শান্তি বজায় থাকে। কিন্তু এই আমেরিকায় না পাবেন ওই লক্ষ্মীদের, না পাবেন গণশা, কেতো, শিবুদের, যারা টুকটাক এটা সেটা করে দেবে। এদেশে হচ্ছে টোনাটুনির সংসার। বাইরের লোকের সাহায্য নিতে গেলেই পকেটে ধস নামবে। দেশে মিঞা বিবি দুজনেই আতুপুতু করে ‘মানুষ’ হলেও বিদেশে এলে সেই গৃহিণীকেই আলস্য ঝেড়ে কোমর বেঁধে ঘরকন্নার কাজে লেগে পড়তে হয়। আহা কর্তা বেচারা আরো বৃহত্তর ক্ষেত্রে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর, বাড়িতে এটুকু বাড়তি সুবিধে তো তারা আশা করতেই পারে! এই সুবিধাবাদী শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বিবাদ নারীর‌ মানসিক নির্যাতনের অন্যতম কারণ।

 কিন্তু এই আশার চারাগাছটির গোড়ায় জল দিতে থাকলে সেটি একদিন মহীরুহে পরিণত হয়। যেমন নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি এসে যদি একবার নিটোল গোল গোল ফুলকো লুচি খাইয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়, তাহলে সারা জীবনের মতো ওই লুচিই তাকে ভাজা ভাজা করে ফেলে। সকলে বলে, “লুচি একমাত্র অমুক বউয়ের হাতেই ফোলে, আমরা বাপু হাজার চেষ্টাতেও পারি না!” 

 নাও, এখন ফোলাও লুচি সারা জীবন ধরে, বড় জা, ছোট জা, ননদ, দেওর প্রত্যেকের জন্য! তাই কক্ষনও কাউকে বলতে নেই, “আমি এটা পারি আমি ওটা পারি।” অবশ্য কাজে একটু আধটু পারদর্শিতা না দেখালেও আবার চাপ, “ইস বাপের বাড়ি থেকে কিছুই শিখে আসেনি!’

 অর্থাৎ বাবা মা কন্যাসন্তানটিকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে স্বনির্ভর করে তোলার স্বপ্নপূরণের সঙ্গে সঙ্গে তাকে গৃহকর্মনিপুণা করে তোলার বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেননি।

 নারীর মানসিক নির্যাতনের বিষয়ে বহু আলোচনা ও পড়াশোনা করে বুঝতে পেরেছি যে, এই বিষয়ে শুধু পুরুষকে দোষী ঠাওরে লাভ নেই, সেটা অন্যায় হবে। এই বিষয়ে স্বয়ং নারীর অবদান অপরিসীম। শৈশব থেকে কৈশোর অবধি সমাজের প্রতিভূ হিসেবে পাড়াতুতো কাকিমা, জেঠিমা ও মাসিমারা দায়িত্ব নিয়ে মেয়েদের চারিপাশে লক্ষণের গন্ডি টেনে দেন। কোন মেয়ে “কেলেকুচ্ছিত” আর কোন মেয়ে “বাচাল” – এই নিয়ে নির্ভীক মতামত দিতে তাঁদের কোনও অসুবিধেই হয় না। সে কথা বাতাসে ভেসে ভেসে কোনও না কোনও দিন যাদের বলা হয়েছে, সেই মেয়েদের কর্ণকুহরে এসে প্রবেশ করে। কেউ ভোগে হীনমন্যতায়, আর কেউ প্রতিবাদী হয়ে তাঁদের বিরাগভাজন হয়।

 কালে দিনে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। সেখানেও কি কম জ্বালা! প্রথমেই আসে লিঙ্গবৈষম্য, ধরেই নেওয়া হয় বিশেষ কিছু কাজ নারীর দ্বারা সম্ভব নয়। শুধু সেই ধারণা কে ভুল প্রমাণ করতে মেয়েদের অসম্ভব মানসিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আবার যে মেয়েটি নিজের কর্মক্ষমতার জোরেই টপাটপ উন্নতি করে ফেলে, তারও কিন্তু নিস্তার নেই। অফিসে কানাঘুষো চলে, “বসের নির্ঘাত নেক নজর আছে ওর ওপর এবং ওরও কি সায় নেই!” এসব মুখরোচক আলোচনায় মেয়েরাও যে অংশ নেয় না তা নয়। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতিতেই পুরুষ সহকর্মীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কদর্য রসিকতা করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। যতই ডাকাবুকো হোক সে মেয়ে, প্রতিবাদ করতেও তার রুচিতে বাধে। আসলে সবসময় শরীর স্পর্শ করেই যে মেয়েদের সম্মানহানি করা হয় তা নয়, যেন-তেন প্রকারেণ তাদের অপ্রস্তুত করেই যেন পুরুষের সুখ! সেই পুরাকালে কৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্র চুরি করে এমন একখানি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে তার থেকে মেয়েদের আর নিষ্কৃতি পাওয়া হল না।

 আমি নিজেও ভুগেছি কর্মক্ষেত্রে। একটা বদ্ধ ঘরে আমিই ছিলাম একমাত্র মহিলা কর্মচারী, যার চারপাশে অন্তত পাঁচ জন পুরুষ সহকর্মী মুহুর্মুহু সিগারেটে টান দিচ্ছেন এবং ভলকে ভলকে ধোঁয়া ছেড়ে ঘরটায় দম মারো দম গানের দৃশ্যের পুনঃ চিত্রায়ন করে আমার দম বের করে দিচ্ছেন। সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। ভাবলাম ওপরওয়ালাকে একটা ইমেইল করব আমাকে অন্য ঘরে বদলি করে দিতে। একদিন সেই ওপরওয়ালা আমাদের ঘরে ঢুকেই আমার উল্টোদিকে বসে থাকা এক সহকর্মীর থেকে সিগারেট চেয়ে নিলেন, তারপর তাতে মৌজ করে একটা টান দিয়ে আমাদের কুশল সংবাদ নিতে শুরু করলেন। আমি বুঝলাম, অভিযোগ করে চিঠি দিয়ে কিছুই হবে না কারণ সর্ষের মধ্যেই ভূত! বেশ কয়েকমাস পরে যখন আমার সকলের সঙ্গে একটু হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হল, তখন আমি মাঝে মধ্যে একটু কুঁইকুঁই করে প্রতিবাদ জানাতাম এবং মিথ্যে বলব না, তাঁরা সদয় হয়ে সারাদিনের কুড়িটা সিগারেটের মধ্যে পাঁচটা বাইরে খেয়ে এসে আমাকে কৃতার্থ করতেন। বলাই বাহুল্য, আমিও বাকি পনেরোটার ধোঁয়া মুখ বুজে হজম করে নিতাম। আমেরিকা আসার পর সে সব দিনগুলোর কথা ভাবলেও বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে একটা ব্যথা হয়। অত্যাচারিত হৃদয় তো ওখানেই রয়েছে!

 কলকাতা থেকে আমাদের দফতর সেই ২০০০ সালে গুরগাঁও শহরে বদলি হয়ে গেছিল। সেটা ছিল কর্পোরেট অফিস, আমাদের আই টি ডিপার্টমেন্টের কেবিনের উল্টো দিকেই ফাইন্যান্স ও আই টি ডিরেক্টরের কেবিন। তাঁরা মাঝে মধ্যেই হলে পায়চারি করতে বেরোতেন। সেই অফিস ছিল “নো স্মোকিং,” সকলকে বাইরে একটা প্যাসেজে গিয়ে ফুঁকে আসতে হত। আমি হাতে চাঁদ পেলাম যেন। আহ, এবার শান্তিতে কাজ করতে পারব, জামা কাপড় থেকে ভকভক করে সিগারেটের গন্ধও বেরোবে না আর হঠাৎ করে হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার সম্ভাবনাও কমবে। প্যাসিভ স্মোকিং নাকি সরাসরি ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকারক। বেশ কিছুদিন শান্তিতে কাটল। তারপর আমি খেয়াল করলাম আমার ডিপার্টমেন্ট সারাদিন ই প্রায় খালি পড়ে থাকে! কারণটা আর কিছুই না, প্রথমে রাম গেল ফুঁকতে। পাঁচ মিনিট পর শ্যাম উশখুশ করে বলল, “রাম কোথায় গেল?” আরও তিন মিনিট পর যদুও হাওয়া! এরপর তো সেই প্যাসেজে নরক গুলজার। আমি একা মাছি তাড়াই, ভাবুন কী অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা! শুধু তাই নয়, লক্ষ্য করে দেখলাম কাজ সংক্রান্ত যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও তাঁরা সেখানেই সেরে ফেলছেন! ফলে আমি তিমিরে রয়ে যাচ্ছি এবং তাঁরা উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত। নাহ্, এ তো চলতে দেওয়া যায় না। কিছুদিন পর আমিও গুটি গুটি পায়ে ওই ধোঁয়ার রাজ্যে উঁকি দিতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে শুধু আইটি নয়, প্রায় প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট থেকেই অন্তত জনা পাঁচেক পুরুষ জমা হয়েছেন। নানাবিধ আলোচনায় আসর সরগরম! অফিসে নিত্য ঘটে যাওয়া অসংখ্য চমকপ্রদ কাহিনির আলোচনা, যার বিন্দুবিসর্গও আমি টের পাইনি এতদিন। ধোঁয়া খাইনি ঠিকই, কিন্তু ধোঁয়ায় রয়ে গেছি। এরপর থেকে নিয়ম করে ওই জমায়েতে হাজিরা দিয়েছি, হাতে নিয়ে চায়ের কাপ এবং কমাতে মনের চাপ।  

 আমেরিকায় পদার্পণ করেছিলাম প্রায় পঁচিশ বছর আগে, চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। সেই সব স্বপ্নরা হঠাৎ কেমন করে যেন শুধু রান্নাঘরের চার দেয়ালে আটকা পড়ে গেল। কারণ বলতে সেই মানসিক নির্যাতন। রান্নায় অপটু আমি যখন ক্ষুন্নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে হুইট ব্রেড বা বেগেলের ওপর একটু চিজ মাখিয়ে কামড় দিচ্ছি, তখন ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে উঠছে মায়ের হাতের ফুলকো লুচি আর আলু পটলের ছেঁচকির ছবি। ভাবুন কী দুঃসহ মানসিক পীড়া! নালে-ঝোলে হতে হতে একসময় নিজেই হাতে তুলে নিলাম চাকি বেলুন; বেঁকা-ত্যাড়া এবং চুপসে-যাওয়া লুচি (?) নিমেষেই গৃহস্বামীর উদরস্থ হয়ে আমার পরিশ্রম দ্বিগুণ করে দিল। মানসিক চাপে পড়েই আমি একে একে শিখে ফেললাম তৈরি পাফের ভেতর পুর দিয়ে বিসদৃশ ‘সিঙাড়ার মাসতুতো ভাই’ বানাতে; স্টোরগুলো গোটা মাছ কেটে না দেওয়ায় ইয়াব্বড় ছুরি নিয়ে হাঁইয়া করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছকে দু ফাঁক করে ফেলতে! কিন্তু কেন আমিই এসব করতে গেলাম? নারী বলে? কেন এই সংস্কার আমার মধ্যে ঢুকে গেল? খিদে (পড়ুন নোলা ) কি আমার একলার? আমার খেতে ইচ্ছে হয়েছে তাই রাঁধলাম, কিন্তু তারপর আরেকজনের জুলজুল চাহনি অগ্রাহ্য করে সেই খাদ্য কি আমার একার পাকস্থলী অবধি পৌঁছতে পারবে? এ ক্ষেত্রে আমি নিজেই কি খাল কেটে কুমির আনলাম না?

 অনেক পুরুষ অবশ্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অন্দরমহলের দায়িত্ব নিয়ে নেন। কিন্তু সেই বিরল প্রজাতিদের চোখের সামনে দেখাটাও তো অন্য স্ত্রীদের পক্ষে এক ধরণের মানসিক অত্যাচার! তাঁরা যদি জানতে পারেন স্ত্রীর কপাল টা দপদপ করছে, অমনি ধাঁ করে রান্নাঘরে ঢুকে শাঁ করে আদা চা বানিয়ে আনেন! পরে এ ও বলেন যে রান্নায় কাজ নেই, সেদিন না হয় থাই রেস্টুরেন্ট থেকেই খাবার আসবে। অথবা এমন কোনও বাবা যখন শিশুটি ঘুমের মধ্যে কাঁদলে নিজেই উঠে বোতলে দুধ বানিয়ে আনেন, কিম্বা বারেবারে হাসিমুখে তার ডায়াপার বদলে দেন, তখন অনেক নারী, যাঁদের কপালে এই সুখ জোটেনি, আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বেশিরভাগ সংসারেই তো নারী যা করে সেটা তার কর্তব্য, আর পুরুষ করলে দয়া!

 আমেরিকান নারীদেরও মানসিক নির্যাতনের বহু গল্প রয়েছে, হাজার হোক তাঁরাও তো নারী! তবে তাঁরা তা বেশিদিন সহ্য করেন না। সঙ্গীর নাক ডাকা থেকে শুরু করে সারাদিন কাউচ আলো করে আলু হয়ে বসে নেটফ্লিক্স দেখা, ঘরের কাজে সাহায্য না করা, বাথরুম ঠিকমত ব্যবহার না করা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়কে উপলক্ষ করেই তাঁরা নির্দ্বিধায় ডিভোর্স চেয়ে বসেন। পুরুষটির অন্য সঙ্গিনীর খোঁজ পেলে তো সোনায় সোহাগা। ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ম হচ্ছে স্বামী স্ত্রী র মধ্যে যে কেউ একজন ডিভোর্স চাইলে তা হবেই হবে। এদেশে সম্পত্তি কিন্তু উভয়ের, সেটা সমান ভাবে বন্টিত হবে, যদি না খুব জটিল কোনও সমস্যা থেকে থাকে। আমার দেখা বহু নারী রয়েছেন যাঁরা প্রায় বাইশ বছর বিবাহিত জীবনের পরও ডিভোর্স চেয়েছেন এবং পেয়েছেনও। যাক বাবা নিজেই নিজেদের সমস্যার সমাধান করেছেন ভেবে খুশি হই। কিন্তু মাস খানেক পরেই তাঁরা নতুন জোটানো সঙ্গীটির নানাবিধ “গুণকীর্তনের” ঝাঁপি খুলে বসেন, অনেক সময় আবার ফ্রাইং প্যান টু ফায়ারের গল্পও শুনি। তাহলে নির্যাতনের জন্য কাকে দুষব? বেশ তো ছিলি মা! 

 কথায় বলে না, “খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার…!”

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে বসে বাংলার জন্য মন কেমন থেকেই লেখালেখির শুরু। ২০১৮ সাল থেকে নিয়মিত লেখিকা। ভূগোল নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে কাজ করেছেন। বর্তমানে উত্তর আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। স্যান ডিয়েগোর ভিস্তা শহরে একটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম বিভাগে resource specialist হিসেবে কর্মরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *