মেয়েদের প্রতিরোধ
“Yo, ho, ho! And a bottle of rum!” প্রমোদবিলাসী, মাতাল জলদস্যুদের উল্লসিত গানের কলি রবার্ট ল্যুই স্টিভেন্সন তাঁর ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ উপন্যাসে বিখ্যাত করে গেছেন। জলদস্যু! দিকহীন সমুদ্রে একটা জাহাজ আরেকটিকে ছলে-বলে-কৌশলে থামিয়ে লুঠ করছে – লুঠেরারা বিচিত্র জামাকাপড় পরা, তাদের হাতে খোলা তলোয়ার, কারোর বা কাঁধে বসে পোষা টিয়াপাখি। অনেকেরই অঙ্গহানি ঘটেছে, কিন্তু তাতে তারা পিছিয়ে পড়েনি। লোকগুলো সম্ভ্রান্ত নয়, কিন্তু হুল্লোড়বাজ। সামাজিক ঐতিহ্যবাহী নিয়ম উপেক্ষা করে তারা নিজেদের দলীয় নীতি অনুসরণ করে। এই লোকগুলির বিচরণভূমি উত্তাল সাগরের ঢেউ। অগুনতি জাহাজের সোনাদানা লুঠ করে জনশূন্য দ্বীপের বালিতে সেগুলো পুঁতে রাখে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে। কখন তারা লোকালয়ে আসে, কখন যায়, ডাঙার আবাসিকেরা জানতে পারে না।
জলদস্যুদের এই রোমান্টিক কল্পচিত্র রচনা করেছে তাদের অভিযান নিয়ে লেখা লোমহর্ষক গল্প-উপন্যাস, চলচ্চিত্র, আর ওয়াল্ট ডিজনির তৈরি আনন্দ-উদ্যান। তবে এদের অস্তিত্ব কাল্পনিক নয়। নানান দেশের মধ্যে জলপথে ব্যাবসা যবে থেকে চলছে, সমুদ্রে ডাকাতির ইতিহাসও ততটাই পুরোনো। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে, সামাজিক নিষেধাজ্ঞা মানতে গররাজি, স্বল্প দোষে পরিবার আর সমাজ থেকে বিতাড়িত, অত্যাচারী শাসকের দাপটে অতিষ্ঠ বহু মানুষ ডাঙা ছেড়ে জলের বুকে আশ্রয় নিত। জীবনধারণের তাগিদে এরাই দলবদ্ধ হয়ে জলে ডাকাতি করত। মাঝদরিয়া কোনও ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে পড়ে না আর আইনের হাত লম্বা হলেও অতদূর পৌঁছয় না। এই জলজ কর্মক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণভাবে পুরুষ শাসিত। সেই সময়ে মেয়েদের পায়ে সামাজিক বেড়ির নিয়ন্ত্রণ ছিল অমোঘ। তাদের ঘর থেকে বের হওয়াই দুষ্কর, জাহাজে ভেসে বেড়ানো অসম্ভব তো হবেই। তাছাড়া নৌবিদ্যায় পারদর্শী না হলে এই বৃত্তি বেছে নেওয়া যায় না – সেই বিদ্যে মেয়েদের শেখাবে কে? শরীরের অবশ্যম্ভাবী দাবিতে বছরের পর বছর জলে ভেসে বেড়ানোও মেয়েদের পক্ষে অসুবিধেজনক। তাই ইতিহাসের পাতায় নারী জলদস্যুর কথা লেখা নেই বললেই চলে। ‘জলদস্যু’ বলতে পুরুষের মূর্তিই চোখে ভেসে ওঠে।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? জলের বুকে নারী জলদস্যু কোনওদিন ছিল না? যে মেয়েরা সামাজিক অনুশাসন প্রত্যাখ্যান করত, যারা পিতৃতান্ত্রিকতার চাপ সহ্য করতে পারত না, যারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাইত, তারা কি কোনোওদিন এই জীবনযাত্রা বেছে নেয়নি?
*****
“বাবা, আমি তোমার সঙ্গে সমুদ্রে যাব।” বছর বারোর মেয়ে, গ্রেস, বাবা ওয়েন ও’ম্যালির কাছে বায়না ধরল। বাবা জাহাজিয়া – ব্যাবসার খাতিরে জলপথে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান। শুধু কি আইনসম্মত ব্যবসা? ওয়েন লুকিয়েচুরিয়ে অন্য একটা ব্যাবসাও করেন।
সময়ঃ মধ্য ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ, দেশঃ আয়ারল্যান্ড। রাজনৈতিক খাওয়াখাওয়ির ঝড়ে গোটা দেশ অশান্ত। দেশের মানুষ এক ঝান্ডার নীচে একত্রিত তো নয়ই, বরং ছোটো ছোটো গোষ্ঠীতে খণ্ডিত। প্রতিটি গোষ্ঠী (clan) কোনও একজন সর্দার বা পরিবারের নেতৃত্বাধীন। সর্বক্ষণ অশান্তির কারণ, হয় বিভিন্ন দলের মধ্যে কোঁদল, নয় উপনিবেশ বৃদ্ধির আশায় লালায়িত ইংরেজদের সঙ্গে ছুটকো লড়াই। বেশির ভাগ পুরুষ চাষবাস বা গোপালন করে জীবনধারণ করে। কিন্তু কাজগুলো ঠিকমত চালানো মুশকিল। বিরামহীন যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে নিয়মিত উপার্জনের সুযোগ খুবই কম। ফলে সমুদ্রতীরাবাসী বহু গোষ্ঠীরই রোজগারের উৎস জল। না, ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’ দর্শন তাদের নয়। তারা দেশবিদেশের মাছধরা জাহাজ আটকে তোলা নেয়, লুঠতরাজ করে। অর্থাৎ তারা জলদস্যু। ওয়েন ও’ম্যালি এমনই এক গোষ্ঠী-প্রধান এবং বেশ কিছু জাহাজ ও জাহাজির নেতা। গেইলিক ভাষায় পরিবারের নাম ‘উয়া-ওয়ালি,’ রূপান্তরে ও’ম্যালি। এই গোষ্ঠীর নীতি – ‘ডাঙা বা জল – উয়া-ওয়ালিরা সর্বদা সফল।’
একমাত্র মেয়ে জেদ ধরেছে – তাকে বাবা বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না ‘মেয়েদের সমুদ্রে যাওয়া বারণ।’ শেষে বললেন গ্রেস-এর চুল এত লম্বা যে জাহাজের যন্ত্রপাতিতে জড়িয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরেই মেয়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়াল – লম্বা লাল চুল ছেলেদের মতো ছোটো করে ছাঁটা। তাও কিশোরী মেয়েকে তো আর এক জাহাজ পুরুষের সঙ্গে লুঠ করতে নিয়ে যাওয়া যায় না! তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, মায়ের হাতে জিম্মে করে, ওয়েন ও’ম্যালি নৌবহর নিয়ে রওনা হলেন। তীর ছেড়ে দু’দিন ভেসে খালাসিরা আবিষ্কার করল কাপ্তেনের মেয়ে গ্রেস জাহাজে লুকিয়ে রয়েছে। তখন আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। ওয়েন ও’ম্যালি কৌতূকভরে ব্যাপারটা মেনে নিয়ে ঠিক করলেন মেয়েকে নৌবিদ্যা শেখাবেন। এর আগে নিজের বড়ো ছেলেকে নাবিক তৈরি করার বিফল প্রচেষ্টায় উনি বহু সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু ছেলের পছন্দ ডাঙায় চাষবাস। কে জানে, হয়তো মেয়েই হবে তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী!
বস্তুত তাই হল। নৌবিদ্যা শিখে গ্রেস কেবল দক্ষ নাবিক এবং জলদস্যু হলেন না, সেই সঙ্গে চাষবাসও চালিয়ে গেলেন। জলে ডাকাতির আয় শুধু নিজে ভোগ করলেন না, পুরো গোষ্ঠীর আর অঞ্চলের উন্নতিসাধনে ঢাললেন। ওয়েন ও’ম্যালির পরে দাদাকে ডিঙিয়ে ক্লানের সর্বাধিনায়ক হলেন গ্রেস। তাঁর নেতৃত্বে গ্রাম, গোষ্ঠী, জলযানের ব্যবসা, আর লুঠ সবই আরও বৃহত্তর আকার ধারণ করল। সেই সঙ্গে ইংরেজ ঔপনিবেশকদের বিরুদ্ধে দেশের অন্যান্য গোষ্ঠীকে একত্রিত করে উনি ক্রমাগত প্রতিরোধ চালিয়ে গেলেন। এই বিদ্রোহের ফলে কয়েকবছর কারাবাসও হল তাঁর। রানি প্রথম এলিজাবেথ-এর দরবারে ঘোষণা করা হল, চল্লিশ বছর ধরে আয়ারল্যান্ডের সব সশস্ত্র প্রতিবাদের নেতা হল গ্রেস ও’ম্যালি।
গ্রেস ও’ম্যালি বার তিনেক বিয়ে করেছিলেন – প্রথমবার ষোল বছর বয়সে। প্রতিবারই নিজের ইচ্ছেয়, নিজের পছন্দের পুরুষকে। তাঁর বাছাইয়ের পুরুষ হত অন্য কোনও ক্ল্যান-এর শক্তিশালী নেতা বা নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ও’ম্যালি গোষ্টী যাতে আরও ক্ষমতাশীল হয়ে উঠতে পারে নিজের জীবন দিয়ে গ্রেস সে চেষ্টাই চালিয়ে গেছেন। গ্রেস মারা যান তিয়াত্তর বছর বয়সে। আজকের ঐতিহাসিকদের মতে সেই সময়ে একজন বিখ্যাত জলদস্যু, ইংল্যান্ডের শত্রুর এই পরিণত বয়স অবধি বেঁচে থাকতে হলে তাকে হতে হবে কূটকৌশলী, যুদ্ধ ও সন্ধিস্থাপনে দক্ষ, সাহসী, এবং রাজনীতিবিদ। গ্রেস ও’ম্যালির সবকটি গুণই ছিল।
তবে জলদস্যুদের ইতিহাসে গ্রেস ও’ম্যালি একমাত্র মহিলা নন। যুগে যুগে বহু মহিলাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিয়মকানুনের নিগড় মানতে পারেননি। বিভিন্নভাবে তাঁরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিরোধ করেছেন। তেমনি এক মহিলা ছিলেন অ্যান বনি। আয়ারল্যান্ডের এক আইনজীবীর বিবাহবহির্ভূত কন্যা অ্যান। তাঁর বাবা তাঁকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারেননি, কিন্তু ছেলে সাজিয়ে নিজের অফিসে কেরানির কাজ দিয়েছিলেন। কিছুটা স্বাবলম্বী হয়েই অ্যান আমেরিকায় চলে এসে এক নাবিককে বিয়ে করলেন। নাবিকের সঙ্গে বিয়ে মানে জলে ভেসে বেড়ানো। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন দম্পতি বাহামা দ্বীপে পাড়ি জমালেন। সেখানে এক খ্যাতনামা জলদস্যু, ক্যালিকো জ্যাক-এর সঙ্গে অ্যানের পরিচয় হল।
সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। সেই সময় ক্যারিবিয়ান দ্বীপমালা ছিল জলদস্যুদের আড্ডা। ক্যালিকো জ্যাকের প্রণয়িনী অ্যান, তাঁর সঙ্গে জাহাজে চেপে ডাকাতিতে যোগ দিলেন। ক্যালিকো জ্যাকের স্যাঙাতদের জবানীতে অ্যান ছিলেন অকুতোভয় আর তরোয়ালবাজিতে ধুরন্ধর। সন্তানসম্ভবা অবস্থায়ও অ্যান জাহাজ লুঠ করতে গিয়ে যুদ্ধ করেছেন। পরে আরেক মহিলা জলদস্যু, মেরি রিড-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে এঁরা দু’জনে মিলে ডাকাতি করতেন। জলদস্যুদের মধ্যে মেরি রিড-এর নামও বিখ্যাত। এঁদের দু’জন ছাড়া, ইতিহাসের পাতায় আরও প্রায় চল্লিশজন নারী জলদস্যুর নজির পাওয়া যায়।
শুধু শ্বেতাঙ্গী নয়, কৃষ্ণাঙ্গী নারী জলদস্যুও কম ছিল না। ষষ্টাদশ শতাব্দীতে ধনী মুসলমান পরিবারে লাল্লা আল আলামি নামে একটি ছোট্টো মেয়ে স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে পরিবারের সঙ্গে মরক্কোতে চলে এসেছে। সেখানেই সে বড়ো হতে থাকল। ধীরে ধীরে লাল্লা পারদর্শী হয়ে উঠলেন দর্শন, ভাষা, অঙ্ক, আরও বহু বিষয়ে। বিয়েও হল নির্বাসিত এক ম্যুর-এর সঙ্গে। তাঁর স্বামীর নেতৃত্বে স্পেন থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পরিত্যক্ত টেত্যুয়ান অঞ্চলে বসবাস করার অনুমতি পেল। এদেরই প্রচেষ্টায় জায়গাটা নতুন করে গড়ে উঠল। আচমকা স্বামীর মৃত্যুতে সম্প্রদায়ের সর্বেসর্বা হয়ে লাল্লা সেই পুণর্গঠনের কাজ নিজের হাতে তুলে নিলেন। পদানুযায়ী নিজের নাম পাল্টে রাখলেন ‘সৈয়দা আল-হুড়া হাকিমিত টেত্যুয়ান।’
টেত্যুয়ান সমুদ্রের পাশে, তাই হার্মাদদের প্রকোপ ছিল যথেষ্ট। নিজের অঞ্চল সুরক্ষিত রাখতে আর সম্পদশালী করতে আল-হুড়া নিজেও জলে ডাকাতি আরম্ভ করলেন। দক্ষ নৌবাহিনীর সাহায্যে প্রায় তিরিশ বছর জাহাজ লুঠ করে নিজের বাসভূমিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন আল-হুড়া। সেই টেত্যুয়ান এখন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী মহিলা জলদস্যু হলেন চীনের চেং-ই সাও। উনবিংশ শতকের প্রথমে তিনি জীবন শুরু করেছিলেন বারবনিতা পেশায়। পরে চেং-ই নামে এক জলদস্যুকে বিয়ে করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার নাবিক এবং একশ’র মত জাহাজ নিয়ে তাঁদের অভিযান আরম্ভ করলেন। দক্ষিণ চীনের উপকূল ছিল চেং-ই দম্পতির ঘাঁটি। বিয়ের ছ’বছরের মধ্যে স্বামী মারা গেলে সাও ব্যবসার খাতিরে সখ্যতা পাতালেন আরেক জলদস্যু, চ্যাং পাও-র সঙ্গে। এই সহযোগিতায় সাও-এর ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। কয়েক বছরের মধ্যে সাও-এর নৌ-সাম্রাজ্য যে কোনও দেশের নৌবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম হয়ে উঠল। এই বিশাল সংখ্যক জলদস্যু-নাবিক সামলাতে সাও রীতিমত কঠিন নিয়মকানুনের প্রচলন করলেন। নারী ধর্ষণের শাস্তি ছিল মুণ্ডচ্ছেদ, দল ছেড়ে পালালে পলাতকদের কান কেটে নেওয়া হত। সাও-কে পরাজিত না করতে পেরে তৎকালীন চীন সরকার ব্রিটিশ এবং পর্তুগীজ নৌসেনার সাহায্য নিয়েছিল। শেষে উপায় না দেখে সাও আত্মসমর্পণ করতে রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত – সঞ্চিত ধনরত্ন তিনি সমর্পন করবেন না। ১৮৪৪ সালে ৬৯ বছর বয়সে সাও মারা যান পৃথিবীর সবচেয়ে সফল জলদস্যু হিসেবে।
ভারতবর্ষেও জলদস্যুর কমতি ছিল না। তবে লিখিত ইতিহাসে আমরা পাই শুধু পুরুষের নাম –কানোজি আংরে, ফিরোজশাহ মেহতা, অম্বাজি, মহম্মদ ইব্রাহিম, কুঞ্জলি মরাক্কার – এমনই কিছু নাম। কোনও ভারতীয় নারী জল-ডাকাতের দলে নাম লেখাননি, তা মানা যায় না। বরং মনে হয় পুরুষপ্রধান ইতিহাস এই মহিলাদের নাম জেনেবুঝে মুছে দিয়েছে। যেমন দিয়েছিল পাশ্চাত্যের ইতিহাস। ইদানীং নারীবাদী গবেষকেরা ইতিহাসের লুকোনো সময় খুঁটিয়ে দেখে মহিলা জলদস্যুদের নতুন করে আবিষ্কার করছেন।
নারী জলদস্যুদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে মধ্যযুগীয় পিতৃতন্ত্রের লৌহ শিকল ভেঙে এই মহিলারা বেরিয়ে এলেন কোন সাহসে? বুঝতে অবকাশ থাকে না সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলার কঠোর বন্ধন এঁদের পোষ মানাতে পারেনি। লিঙ্গনির্দেশিত ভূমিকা ভেঙে ফেলতে এঁরা উদগ্রীব ছিলেন। সমাজের মধ্যে বাস করে গণ্ডী ভাঙা যে দুঃসাধ্য, তাও এঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বেছে নিয়েছিলেন জলদস্যুর জীবন – মাটির সমাজ থেকে দূরে। অনেকেই নিজের লিঙ্গ লুকোতে পুরুষের পোশাক পরতেন। অবশ্য এই ছদ্মবেশের আরেকটা কারণ কাজেকর্মে ও যুদ্ধে হাত পা চালাতে সুবিধে হবে। অনেকে দুটি দিকই বজায় রাখতেন। চেং-ই সাও এবং গ্রেস ও’ম্যালি জাহাজে পুরুষের সাজ পরলেও শুকনো জমিতে গায়ে তুলতেন নারীর পোশাক। অ্যান বনি আর মেরি রিড, দু’জনকেই ছোটবেলায় ছেলেদের পোশাক পরিয়ে বড়ো করা হয়েছে।
ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে দেখা গেছে এঁরা ছাড়াও আরও কিছু মহিলা পুরুষের পোশাকে, পুরুষের পরিচয়ে, নাবিক হয়ে জাহাজে কাজ করেছেন। ১৮১৫ সালে এক কৃষ্ণাঙ্গ নাবিক স্বীকার করেন তিনি এগারো বছর ‘উইলিয়াম ব্রাউন’ নামে রয়্যাল নেভিতে কাজ করেছেন। তিনি যে আসলে নারী ধরা পড়ার পর, কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে উইলিয়ামকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়। ১৮৩২ সালে অ্যান জেন থর্নটন নিজের প্রেমিককে খুঁজতে পুরুষের পোশাকে জাহাজের ‘ক্যাবিন বয়’ হয়ে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে পাড়ি জমান। পরে অন্যান্য কয়েকটি জাহাজে রাঁধুনে হয়ে ‘জিম থর্নটন’ কাজ করে চলেন। মেরি লেসি পুরুষের ছদ্মবেশে শুধু কাজ করেননি, নাবিক ‘উইলিয়াম চ্যান্ডলার’ নামে তিনি এতই সফল ছিলেন যে অবসর নেবার পর সরকারি নৌবিভাগ তাঁকে অবসরভাতা দিয়েছিল। পরে মেরি লেসি নিজের কর্মজীবনের বৃত্তান্ত লিখে একটি বই প্রকাশ করেন।
এমনই বহু মহিলা নিজেদের লিঙ্গ আড়াল করে বিভিন্ন পুরুষপ্রধান বৃত্তিতে যোগ দিয়েছেন। এঁরা সমাজের নির্ধারিত ভূমিকার সঙ্গে আপোশ করতে চাননি, মনে করেননি মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলে গণ্ডীবদ্ধ জীবনের মধ্যে বাঁচতে হবে। কখনও স্বাধীনভাবে বাঁচার লোভ, কখনও অভিযানের উত্তেজনা বা উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের অ-সামাজিক পথে ঠেলে দিয়েছে। তাঁরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিরোধ করেছেন আচরণে, বৃত্তি নির্বাচনে। পৃথিবীর লুকোনো ইতিহাসে এমনই বহু প্রতিবাদের গল্প ছড়ানো রয়েছে, যা আজকের নারীবাদী গবেষকেরা ধীরে ধীরে সচেতনতার আলোয় ফিরিয়ে আনছেন।
———–
তথ্যসূত্র
Chakraborty, S. (2023). Adventures of Amina Al-Sirafi. NY: HarperCollins Publ.
Chambers, A. (2007). Ireland’s pirate queen: The true story of Grace O’Malley, 1530-1603. NY: MJF Books.
Duncombe, L. S. (2017). Pirate women: The princesses, prostitutes, and privateers who ruled the seven seas. Chicago, IL: Chicago Review Press.
Durn, S. (2022, January 4). “Women plundered and swashbuckled with the best (and worst) of them.” Atlas Obscura. Available: https://www.atlasobscura.com/articles/pirate-women-history
Eldridge, A. (ND). “Swashbuckling sisters: 6 Lady pirates.” Britannica. Available: https://www.britannica.com/list/6-lady-pirates
Royal Museums Greenwich. (ND). “Were there female pirates?” Available: https://www.rmg.co.uk/stories/topics/were-there-female-pirates
Wikipedia. (2024, January 10). “Women in piracy.” Available: https://en.wikipedia.org/wiki/Women_in_piracy
* ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।
1 Comment