মনের ওপর দখলদারি

আলোচনাঃ মনের ওপর দখলদারি

You Are The Placebo

বই: You Are The Placebo: Making Your Mind Matter
লেখক: ডঃ জো ডিস্পেঞ্জা (Dr. Joe Dispenza)
ভাষা: ইংরেজি
প্রকাশনা: হে হাউজ, ২০১৪
মুদ্রিত মূল্য: ২৪ ডলার
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৪৮

কিছু কিছু বই আছে যা মানুষের চিন্তাধারা, এমনকি তার জীবন পালটে দেয়। তেমনই একটা বই ডঃ জো ডিস্পেঞ্জা’র You are the placebo: Making your mind matter বইটির নামকরণই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বইটি কেমন হতে পারে। বইটির বিষয়ে বলার আগে ‘প্লাসিবো এফেক্ট’ সম্পর্কে একটু বলতেই হয়। ‘Placebo’ শব্দের অর্থ মিথ্যে-ওষুধ অর্থাৎ রোগীর মন রাখবার ওষুধ, যা আসলে নিস্ক্রিয় পদার্থ। ‘প্লাসিবো’ ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ হল ‘I shall please’ অর্থাৎ মনের ভালোলাগার সঙ্গে জড়িত। ‘প্লাসিবো’ এমন একটি ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মধ্যে বাস্তবভাবে তথাকথিত কোনও ওষুধের গুণ নেই, কিন্তু রোগীর অজান্তে তার ওপর কাজ করে। রোগী বিশ্বাস করে তার রোগ সেরে যাচ্ছে এবং সে ভালো হয়ে ওঠে। এর পেছনে কাজ করে রোগীর আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক দৃঢ়তা। একেই ‘প্লাসিবো এফেক্ট’ বলে। 

এবার বইটির প্রসঙ্গে আসি। বইটির শিরোনামই সহজভাবে বলে দিচ্ছে, তুমিই ‘প্লাসিবো,’ তোমার মনই সবকিছু করতে পারে। তোমাকে ভালো রাখতে পারে, আবার খারাপও রাখতে পারে, এই ভালো-খারাপ ব্যাপারটা অবশ্যই নির্ভর করবে সম্পূর্ণভাবে তোমার ওপর।

প্রথমেই ভূমিকা নিয়ে বলি। আমি মুগ্ধ, বিস্মিত। এটা কি সম্ভব? সাধারণ বুদ্ধি বলে, না, অসম্ভব। এখানে লেখক তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। শরীর এবং মন পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং শুধুমাত্র মনের চিন্তাই যে আমাদের ভালো-থাকা, মন্দ-থাকা, শারীরিক রোগ-নিরাময়, আমাদের ভবিষ্যৎ – এ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে, এই সত্য লেখক অনুভব করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন তাঁর নিজের জীবন দিয়ে।

ভূমিকায় লেখক তাঁর জীবনের এক মর্মান্তিক এবং একইসঙ্গে আনন্দময় অভিজ্ঞতা বিশদ করেছেন। পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য সেই বিষয় একটু বলতেই হচ্ছে।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে লেখক এক মারাত্নক বাইক দুর্ঘটনার শিকার হলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পেছন থেকে ৫৫ মাইল বেগে ছুটে আসা একটা ব্রঙ্কো গাড়ি লেখকের বাইকে আঘাত করল। এর ফলে ওঁর মেরুদন্ডের ছ’টা হাড় ভেঙে গেল, লাম্বার ১-এ কমপ্রেশন ফ্র্যাকচার। ডাক্তারের নির্দেশে হাসপাতালে লেখকের সমস্ত রকমের রক্তপরীক্ষা হল, সেইসঙ্গে এক্সরে, ক্যাট স্ক্যানিং, এম আর আই, এবং রিপোর্টে বলা হল, শিরদাঁড়ার ওপর হাড়ের টুকরোগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় রেখে জোড়া লাগানোর জন্য অস্ত্রোপ্রচারের প্রয়োজন এবং দুটো ১২ ইঞ্চি স্টেনলেস স্টীলের পাত ঢুকিয়ে কাজটা করতে হবে। খুবই জটিল অস্ত্রোপ্রচার এবং এর ফলে ভবিষ্যতে হাঁটার সম্ভাবনা থাকলেও সারাজীবন মাঝেমাঝেই তাঁকে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। আর, যদি অপারেশন না করা হয়, তবে চিরকালের জন্য লেখককে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী হয়ে থাকতে হবে। লেখক শেষ পর্যন্ত অপারেশন না-করারই সিদ্ধান্ত নিলেন। আসলে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা অদৃশ্য চেতনা আছে, একটা সর্বশক্তিমান, সর্বজয়ী বুদ্ধিমত্তা আছে যা তাকে প্রতি মুহূর্তে রক্ষা করে, যা-কিছু অসুন্দর তা উচ্ছেদে সাহায্য করে। এই জন্যেই প্রতি মুহূর্তে আমাদের হৃদস্পন্দন সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়, আমাদের শরীরের প্রতি কোষে প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ রাসায়নিক ক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সংঘটিত হয়। সেই সংকটময় মুহূর্তে লেখকের মনে হল, বহির্জগত থেকে সরে এসে দৃষ্টি ফেরানো উচিত ভেতরে, অন্তরে, এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত সেই কালজয়ী মহাশক্তির সঙ্গে। লেখক ভাবলেন, সেই উচ্চশক্তির যথাযথ প্রয়োগ তাঁর নিজের শরীরে করতে হবে, তাঁর হাতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে অকপটে ছেড়ে দিতে হবে। তবেই হয়তো সত্যিকারের নিরাময় সম্ভব। যেহেতু সেই মুহূর্তে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই, লেখক তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি দুটো জিনিস করবেন।

১) নিজের সক্রিয় চেতনা সংহত করে মনঃসংযোগ করা সেই মহাশক্তির ওপর, নিরাময়ের ভার সম্পূর্ণভাবে তাঁর হাতে সঁপে দিয়ে,
২) নেতিবাচক সমস্ত চিন্তা যা বিচ্যুত করতে চাইছে এই পথ থেকে, তা নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান।               

তিনি হাসপাতাল থেকে চলে এলেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে এবং তিন মাস সেখানেই কাটালেন। প্রত্যেকদিন দু’ঘণ্টা করে দুবার তিনি নিজের ভেতর বাড়িতে প্রবেশ করতেন, সক্রিয়ভাবে যেন তৈরি করতেন, কল্পনা করতেন তাঁর মেরুদন্ডের সব হাড় সম্পূর্ণভাবে জোড়া লেগে গেছে। একটা সুস্থ শরীর সবসময় চোখের সামনে রাখার চেষ্টা করতেন। তবে এও বলেছেন, এই সুখকল্পনা থেকে তিনি বারবার সরে আসছিলেন, মনঃসংযোগ হারিয়ে ফেলছিলেন, এবং যতবার তাঁর পদস্খলন হচ্ছিল, ততবারই গোড়া থেকে শুরু করতে হচ্ছিল। অর্থাৎ মেরুদন্ডের হাড়ের স্তরে স্তরে পুনর্গঠনের ছবি আবার কল্পনায় সৃষ্টি করতে হচ্ছিল। এই পর্যায়ে চরম হতাশার মধ্যে তাঁকে দিন কাটাতে হচ্ছিল। শেষমেষ ছ’সপ্তাহের যুদ্ধের পর তিনি চেতনার এমন একটা স্তরে পৌঁছলেন যে তাঁর মনে হল, তিনি একটা শৃঙ্গ জয় করেছেন। এর পর থেকে সুন্দর সুগঠিত মেরুদন্ডের পুনর্গঠনের কাজটা তাঁর কাছে সহজ হয়ে গেল। কিছু লক্ষণীয় শারীরিক পরিবর্তনও নজরে এল। তখন তাঁর আত্নবিশ্বাস তুঙ্গে এবং যে কাজ করতে আগে ২-৩ ঘণ্টা লেগে যেত, সেটাই অতি অল্প সময়ে করতে সক্ষম হলেন। নানারকম সুখচিন্তা আসতে লাগল – কীরকম হয়, যদি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করে আসা যায়, কিংবা জলের মধ্যে সূর্যাস্তের প্রতিচ্ছবি উপভোগ করা … এরকম টুকরো টুকরো সুখভাবনা তাঁর মধ্যে আসতে লাগল।

দুর্ঘটনার সাড়ে নয় সপ্তাহের মাথায় তিনি উঠে দাঁড়ালেন কোনো অস্ত্রোপচার ছাড়াই। দশ সপ্তাহের পর থেকে তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করে দিলেন আগের মতো। শুধু তাই নয়, সেই দুর্ঘটনার তিরিশ বছর বাদে তিনি সততা এবং পূর্ণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, তার পর থেকে তিনি পিঠে কোনোরকম ব্যথাই অনুভব করেননি।

সত্যিই অবিশ্বাস্য! ভাবা যায় না। Dr. Dispenza তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিজের জবানিতেই খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করেছেন। কোনোরকম সার্জারি বা ওষুধপত্র ছাড়া কীভাবে শুধুমাত্র মনঃসংযোগ, আত্নবিশ্বাস, এবং মনের জোর সম্বল করে এই নিরাময় সম্ভব, তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা বুঝতে হলে এই বইটি পড়া বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। মোট বারোটি পরিচ্ছেদ আছে বইটিতে। এই কর্মকান্ডের পেছনে যে বিজ্ঞান কাজ করছে, যথাসম্ভব সহজ করে তার একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছে আট নম্বর অধ্যায়ে। এখানে সেই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু বলতে চাই। অধ্যায়ের নাম হল কোয়ান্টাম মাইন্ড।

কোয়ান্টাম মাইন্ড (Quantum mind)

‘বাস্তব’ (Reality) সম্পর্কে খুব সহজ ধারণা হল যা কিছু পূর্বনির্দিষ্ট, স্থির এবং সহজে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাকেই একমাত্র বাস্তব বলে আমরা বিশ্বাস করি। বাকি সব ‘অবাস্তব।’ এই ‘বাস্তবতা’র ধারণা আমরা রেনে ডেকার্ট এবং স্যার নিউটনের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে পাই। নিউটনিয়ান পদার্থবিদ্যা বা ক্ল্যাসিকাল পদার্থবিদ্যা বস্তুসমূহের ধর্ম এবং তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে চর্চা করে। এককথায় যা-কিছু পূর্ব-নির্ধারণযোগ্য (যেমন, সূর্যের চারিদিকে গ্রহের গতিপ্রকৃতি) তা সঠিকভাবে আমরা নিউটনের সূত্র থেকে জানতে পারি। অর্থাৎ এসবই নিউটনিয়ান ফিজিক্সের আওতায় পড়ে। কিন্তু অণু-পরমাণুর গতিপ্রকৃতি এবং ধর্ম, তাদের ব্যবহার, শক্তি-সম্পর্কিত আলোচনা, এসব ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিকাল পদার্থবিদ্যা খাটে না। এসব কোয়ান্টাম ফিজিক্সের আওতায় পড়ে। এককথায় পরমাণুর অভ্যন্তরে অবস্থিত ইলেকট্রন, প্রোটন অর্থাৎ অবপারমাণবিক জগতের ব্যবহার দৃশ্যমান বস্তুজগতের ব্যবহারের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। অথচ মজার ব্যাপার, এইসব অণু-পরমাণু নিয়েই আমাদের বস্তুজগত তৈরি।

কোয়ান্টাম পদার্থবিদদের মতে, পরমাণুর অভ্যন্তর প্রায় আক্ষরিক অর্থেই ফাঁকা। আসলে, সেই স্থান শক্তিপুঞ্জে  ঠাসা। তাঁদের সিদ্ধান্ত, যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের এই পরিচিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং তার মধ্যেকার প্রত্যেকটা জিনিস, তারা যতই আপাতভাবে কঠিন দেখাক না কেন, সেসবই নিছক শক্তি বা তথ্য ছাড়া কিছুই নয়। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। কোয়ান্টাম পদার্থবিদরা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে অবপারমাণবিক জগতের কণাসমূহের ধর্ম বা প্রকৃতির সঙ্গে কোনওভাবেই আমাদের আজন্মপরিচিত বস্তুর প্রকৃতির কোনও মিল নেই। তাদের চলাফেরা এলোমেলো (chaotic) এবং পূর্ব-নির্ধারণযোগ্য নয় (unpredictable)। 

এছাড়াও বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম বিশ্ব (Quantum Universe) সম্পর্কে আরও তথ্য আবিষ্কার করলেন। তাঁরা দেখলেন, যখনই এইসব অবপারমাণবিক স্তরের কণাসমূহের অবস্থান সুনির্দ্দিষ্ট করা হয়, তাদের প্রকৃতি বদলে যায়। তাদের অবস্থান কখনও এখানে আবার কখনও অন্য কোথাও অর্থাৎ সতত পরিবর্তনশীল। এর পেছনে একটাই কারণ, তা হচ্ছে, একই সময়ে তারা এক অদৃশ্য এবং অসীম কোয়ান্টাম পরিসরে সর্বত্র বিরাজমান। আর যদিবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তাদের অবস্থান প্রত্যক্ষ করছি, তাদের আবির্ভাব ঘটবে না, তারা শক্তির ছদ্মবেশেই অবস্থান করবে। আমরা মনোনিবেশ করলেই তাদের পদার্থরূপ প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। তাহলে বলাই যায়, যে-কোনও বাস্তব দৃশ্যমান বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঘটনার সঙ্গে আমাদের মনোজগত বা চেতনা জড়িয়ে আছে। ঠিক সেইভাবে আমরা যদি কল্পনা করি আমাদের ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন, যা আমাদের জীবনে প্রতিফলিত করতে চাই, তবে সেটাও দেশকালের সীমানার বাইরে কোয়ান্টাম পরিসরের কোথাও-না-কোথাও একটা ‘সম্ভাবনা’ (possibility) হয়ে অবস্থান করবে এবং তা অপেক্ষা করবে বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য। আমাদের সংঘটিত চিন্তা এবং অনুভূতিই হবে সেই কাজের প্রধান সহায়ক বা হাতিয়ার। তবে এর জন্য মানসিক অভ্যাস বা মহড়ার (rehearsal) প্রয়োজন আছে। যা আমি অন্তর থেকে চাইছি তাকে গভীর উপলব্ধি এবং ভালোবাসা দিয়ে চাইতে হবে, স্মরণে মননে ভাবতে হবে তাকে, যা চাইছি না তাকে অগ্রাহ্য করা শিখতে হবে সম্পূর্ণভাবে। তবেই অসীম সম্ভাবনার মধ্য থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু বা ঘটনা হাজির হবে আমাদের জীবনে।

কী সাংঘাতিক কথা, কোথা থেকে কোথায়!

পরমাণু মাত্রই তার কম্পনের কারণে সবসময়ই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ (বা শক্তি) বিকিরণ করে। কম্পাঙ্কের মান অনুযায়ী সেই বিকিরণ দৃশ্য (visible) বা অদৃশ্য (যেমন, এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি, আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি, রেডিও রশ্মি ইত্যাদি) হতে পারে।

একটা উদাহরণ দিয়ে সুন্দর বোঝানো হয়েছে বইটিতে। একটা ফ্যান ঘুরছে। যখন সেটা আস্তে ঘুরছে (কম কম্পাঙ্ক) তখন একটা কম শক্তির বাতাসের ঘূর্ণি তৈরি করছে এবং তখন সহজেই ফ্যানের ব্লেডগুলো দেখা যাচ্ছে। সেই অবস্থায় ফ্যানের ব্লেডগুলোর পদার্থধর্ম (material property) প্রবল। ফ্যানটা খুব জোরে ঘুরলে (উচ্চ কম্পাঙ্ক) একটা উচ্চ শক্তির বাতাসের ঘূর্ণি তৈরি হয় এবং তখন ফ্যানের ব্লেডগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। সেই অবস্থায় ফ্যানের ব্লেডের তরঙ্গধর্ম (Wave property) প্রবল হয়। অর্থাৎ কম্পাঙ্কের কম-বেশির ফলে একই বস্তুতে কখনও কণাধর্ম (Particle property) এবং কখনও বা তরঙ্গধর্ম (Wave property) প্রবল হয়। একইরকমভাবে, যখন একটি পরমাণু কম কম্পাঙ্কে কম্পিত হয় তখন অল্প মাত্রার শক্তি (Weak field) বিকিরিত হয়, কম্পাঙ্ক বেশি হলে বেশি মাত্রার (Strong field) শক্তি তৈরি হয়। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ একটি বস্তুকে একটা কঠিন কণা (Solid particle) বলে ভাবেন। যখন তার বস্তুধর্ম প্রবল হয় (অর্থাৎ যখন সেটা সাধারণভাবে দৃশ্যমান হয়), তখন সেটা কম কম্পাঙ্কে থাকে এবং বাস্তবভাবে দৃশ্যমান হয়। আবার যখন বেশি কম্পাঙ্কে থাকে তখন তার বাস্তব অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয় না। তখন তার তরঙ্গধর্ম প্রবল হয়। একটা বস্তুখণ্ড, যদিও সেটা শক্তিপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়, আমাদের কাছে কঠিন মনে হয় এই কারণে যে তার সমস্ত পরমাণুর মিলিত কম্পনের বেগ আমাদের সাপেক্ষে স্থির অর্থাৎ শুন্য। (এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছোটবড় প্রত্যেক বস্তুকে আপাতভাবে মনে হয় কঠিন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা পদার্থ এবং শক্তির সমন্বয়ে একসূত্রে গাঁথা এবং কখনোই তাদের অস্তিত্ব পরস্পরের থেকে আলাদা নয়)। যেহেতু প্রত্যেকটা পরমাণু তাদের নিজেদের কম্পাঙ্ক অনুযায়ী শক্তি বিকিরণ করে এবং পরমাণুর মিলিত শক্তিতেই অণুর সৃষ্টি, সুতরাং সেই সৃষ্ট অণু স্বাভাবিকভাবেই এক সম্মিলিত কম্পাঙ্কে শক্তি বিকিরণ করবে। আর, যেহেতু এই বিশ্বের সমস্ত বস্তুই অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি, আমরাও প্রত্যেকেই আমাদের নিজের নিজের সত্তা ও চেতনা অনুযায়ী শক্তি বা তথ্য সম্প্রচার করে থাকি। আমরা যদি আমাদের আজন্মলালিত বিশ্বাস বা বোধশক্তির (perception) পরিবর্তন ঘটাতে পারি, তাহলে সক্রিয়ভাবে এবং সচেতনভাবে আমরা আমাদের দেহের অণু-পরমাণুর কম্পাঙ্ক সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়িয়ে ফেলতে পারি। এর ফলে আমরা প্রত্যেকে হয়ে উঠব উচ্চশক্তিসম্পন্ন বিকিরণের প্রকৃষ্ট আধার। আর, এই বিশ্বাস বা বোধশক্তির পরিবর্তন তখনই সম্ভব যদি আমরা ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতাবোধ, অনুপ্রেরণা, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অজেয় মনোভাব – এইসমস্ত গুণাগুণ জীবনে সাদরে গ্রহণ করি এবং সর্বাগ্রে স্থান দিই। যত আমরা এইসব গুণের অধিকারী হতে পারব, আমরা দেখব, আমাদের শরীর এবং মন ততই উচ্চশক্তি গ্রহণের সহায়ক হয়ে উঠছে। নিজস্ব চেতনার সক্রিয় প্রচেষ্টায় এবং সর্বোপরি বিশ্বচেতনার (Universal consciousness) আনুকূল্যে, যা আমাদের সবসময়েই ঘিরে রাখে, যার মধ্যে এবং যাকে নিয়ে আমরা বাস করি – আমরা ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চতর মন বা চেতনার অধিকারী হতে থাকব।

ওপরের সমস্ত কথাই বইটির ওই বিশেষ অনুচ্ছেদে বিশদ লেখা আছে, আমার নিজের নয়। অন্যান্য অধ্যায়ে আরও বিস্তৃতভাবে সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গোটা বিষয়টি বলা আছে। আমার বিশ্বাস, এই বইটি পড়লে একটা মানুষের চিন্তাভাবনা এবং তার জীবনযাপন নিশ্চিতভাবে পালটে যাবে, যদি সে ঠিক ঠিক অনুশাসন মেনে আত্নবিশ্বাসী হয়ে শুধুমাত্র মনের জোর সম্বল করে জীবনের চলার পথে এগিয়ে যায়।

—–

ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইয়ের রিভিউ। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। এছাড়া খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *