অথ বিবাহ সমাচার
মাখনলাল সমাদ্দার কবিতা লিখছিলেন, পোস্টমাস্টারের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর সাতেক হবে। বৌ মালিনীও ঐ পোস্ট অফিসেই ছিলেন – তিনি অবশ্য দশ বছর হল রিটায়ার করেছেন। আজকাল বৌ বড় বর ছোটো কেস আকছার ঘটছে কিন্তু বছর চল্লিশ আগে ব্যাপারটা এত জলভাত ছিল না! মাখনলাল যখন মালিনী ম্যাডামের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন তখন বড়ই হুজ্জুতি পোহাতে হয়েছিল। ইউ ডি ক্লার্কের অফিসের বড়বাবু থুড়ি বড় বিবির প্রেম নিয়ে কথা ছড়াতে সময় লাগেনি, যদিও প্রেমটা প্রথম প্রথম একতরফা ছিল। যে মাখনলালবাবু সেই ছোটোবেলা থেকে যেভাবে মায়ের আঁচলের তলায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন, মা না বললে ছোটো বাইরে পর্যন্ত মুখ বুজে চেপে বসে থাকতেন সেই তাঁর পক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেম করে বৌ আনা একরকম অসম্ভব ছিল! অন্নদা, মানে মাখনলালের মা ছিলেন জাঁদরেল। বাঘে গরুতে থুড়ি বর ছেলেকে দিবারাত্র দাঁতের তলায় রাখতেন। মাখনের কাছে মা ছিলেন বিভীষিকা, এমন সব শাস্তি দিতেন যে ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতেন মাখন। একবার তো মনে আছে, মা তাঁকে খেলতে গিয়ে পাড়ার ড্রেন থেকে বল তোলার অপরাধে ভরা পৌষমাসের সন্ধেবেলায় পাতকুয়োর ঠান্ডা জলে স্নান করতে বাধ্য করেছিলেন। ক্লাস নাইনের মাখনলালের তেড়ে জ্বর এসে গেছিল। তবু, টুঁ শব্দটি করেননি তিনি। কলেজ জীবনেও মায়ের কড়া নির্দেশে সহপাঠিনীদের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারেননি।
মা বলতেন, “শোন বাবা! মেয়েরা ওই চোখের গলি পথ বেয়েই মাথায় চড়ে বসে! তাই সাবধান!”
মাখন মায়ের কথা বেদবাক্য বলে মানতেন, বি এ ক্লাসের তিন তিনটি বছর ঘাড় গুঁজে থেকে থেকে স্পন্ডেলাইটিস বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু মাতৃ আদেশ ফেলতে পারেননি। একবার তো রমলা আইচ মহা বিপদে ফেলেছিল, ইকনমিক্সের নোটস নেবে বলে সোজা বাড়ি অবধি ধাওয়া করেছিল। মায়ের সামনে রমলা যত মাখনলালের পড়ুয়া স্বভাবের প্রশংসা করে ভালো ভালো কথা বলে মাখন তত দরদর করে ঘামতে থাকেন, শেষে মায়ের সঙ্গে ঝাড়া দেড়ঘন্টা গল্প করে চা মিষ্টি খেয়ে রমলা যখন কাঙ্খিত নোটসের খাতা বগলে বিদায় নিল তখন মাখনের ভয়ে পাজামা ভিজে যাওয়ার অবস্থা। মা অবশ্য সেদিন খুব একটা বকাঝকা করেননি শুধু মাখনকে সাবধান করেছিলেন, “ঐ খাতাপত্তর নেওয়ানেওয়ি পর্যন্ত ঠিক আছে! বেশি মাখামাখি কোরো না। মেয়েবন্ধু হওয়া মানেই সমূহ বিপদ!”
মাখনলাল বাধ্য ছেলের মতো মায়ের কথায় ঘাড় নেড়েছিলেন। বাবা অবশ্য মাখনকে বিদ্রোহী হবার পরামর্শ দিতেন, নিজে অন্নদার পায়ের তলার ভোলানাথ হয়ে পড়ে থাকলেও ছেলেকে অন্তরটিপুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চাইতেন, “সারাক্ষণ ছাগলছানার মতো ম্যা ম্যা করো কেন বলতে পারো? তুমি না পুরুষসিংহ? লজ্জা করে না?”
মাখনলালের এমন কথা শুনলে ভীষণ রাগ হত, মনে হত মুখের উপর বলেন, “ছেলেটা কার শুনি? নিজে যে সারাজীবন বৌ আর বাঘিনীতে তফাৎ বুঝলে না তার বেলা?”
তা সেসব আর বলা হয়ে ওঠেনি কোনোকালে! বাবা আর ছেলে সারাজীবন মায়ের দরবারে ভক্ত হয়েই দিন কাটাবেন এমন মুচলেকা দিয়েই রেখেছিলেন। গোল বাধল চাকরিতে ঢুকে।
সেকালে চাকরি বাকরির বাজার এমন আকাল ছিল না। পাশ টাশ করে বেরোতেই ঝপ করে পোস্টঅফিসে ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন মাখন। বাড়ির ভাত খেয়ে দিব্যি দিন কাটছিল, মা ছেলেকে সংসারে জুতে দেবেন বলে পাত্রী দেখাও শুরু করেছিলেন। প্রায় প্রতি রবিবার মা অন্নদা বর আর ছেলে বগলে হবু কনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন। ঘটক দ্বারিকরঞ্জনকে মায়ের বলাই ছিল মেয়ের বয়স যেন আঠেরোর উপরে উঠতে না পায় গায়ের রংটি যেন সোনা হেন হয় আর হবু বৌ যেন বাঙাল না হয়! বাঙাল মেয়েরা বড় মুখরা আর ঝগড়ুটে হয়!
বছর দেড়েক মেয়ে দেখে দেখে আর মিষ্টিমাষ্টা খেয়ে ক্লান্ত মাখন হঠাৎ একদিন খেয়াল করলেন মালিনী ম্যাডামকে অফিসে এসে একবার না দেখতে পেলে কেমন যেন পেট গরম হয়ে যাচ্ছে, ঘন ঘন জল তেষ্টা পাচ্ছে আর মায়ের বারণ সত্বেও নিজের চোখ বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অথচ, মালিনী মোটেই তাকে পছন্দ করেন না। দেখলেই খ্যাচ খ্যাচ করেন কাজের হাজারটা ভুল ধরেন, “মাখনবাবু, আপনেরে দিয়া কোন কামটা ঠিকঠাক হয় কইতে পারেন? লেজার বুক জুইরা এত কাটাকুটি! কাস্টমার তো আপনের চামড়া তুইলা নিবো!”
মালিনী তার বাঙাল ডাইলেক্টে ঝাড়তে থাকেন আর মাখন হাঁ করে পাঁচ ফুট ছয়ের মহা স্বাস্থ্যবতী ঘোর কৃষ্ণবর্ণা মালিনীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। অফিসের, সুধাংশুবাবু একদিন টিফিন আওয়ারে চেপে ধরলেন মাখনকে,
“ভাইটি কী ব্যাপার বলো তো? লেজারের ভুলগুলো মনে হচ্ছে ইচ্ছাকৃত? মিস মালিনীর কাছে যেদিন ঝাড় খাও সেদিন তোমার মুখটা লক্ষ্য করে দেখেছি কেমন যেন ঝকঝক করে! কেসটা কী বলো তো?”
কাঁচা প্রেম আর পাকা ফোঁড়ার মধ্যে একটাই মিল দুটোই বড্ড টনটন করে। অস্থানে কুস্থানে হলেও সুযোগ পেলেই দেখাতে ইচ্ছে করে! তা সুধাংশুবাবুর কাছে প্রথমে অল্পবিস্তর ব্যথার কথা বলতেই লোকটা মাখনলালকে একরকম পেড়ে ফেলল। মহিলা বিষয়ে অফিসে সুধাংশুর একটু সুনাম-ই আছে, মানে কোন মাছ কোন চারে ডাঙ্গায় ওঠে তার হদ্দমুদ্দ সুধাংশুর প্রায় নখদর্পণে। তা, মাখনের মালিনী প্রীতি জানতে পেরেই তিনি বেশ কটা টিপস দিয়ে ফেললেন। যেমন, বাঙাল মেয়েরা রান্নার প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে! ‘দ্যাশেরলোক’ শুনলেই গলে জল হয়ে যায়! আর, এই মফস্বলে ভালো পদ্মার ইলিশ যোগাড় করে দিতে পারাটা একটা চ্যালেঞ্জ!
অফিসের রণজয় অসীম স্বপনেরা কীভাবে যেন এই একতরফা ইসের আভাস পেয়ে গেল! আর মাখনকে নানান ভাবে লক্ষ্যচ্যুত করতে উঠে পড়ে লাগল, “মাখন তুই কী পাগল? মহিলা তোর থেকে কমসে কম চারবছরের বড়! ভাই বোনকে দাঁড় করাতে গিয়ে বিয়েসাদির সময় পায়নি বুঝলি!”
“স্বপন, শুধু বয়সে বড়? কী রকম তারকারাক্ষসীর মতো চেহারা বলতো?” রণজয় প্রায় খেঁকিয়ে ওঠে।
“ওসব ধান্দা ছাড়! কচি দেখে একটা বৌ আন! বুড়িতে যে তোর কেন এত রুচি বুঝিনে!” অসীম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মাখন কিন্তু চুপটি করে থাকেন। আর তলে তলে সুধাংশুর পরামর্শ মতো এগোতে থাকেন।
মালিনী যে এই নারকেল বাগান এলাকায় একা বাবাকে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকে জানতে পেরে রোজই প্রায় ছুটির পর একগাদা কাজ নিয়ে বসেন। এই লেজার মেলাচ্ছেন তো ঐ নাম এন্ট্রি করছেন, পাশবই আপডেট একদম ফেলে রাখছেন না! মালিনীকে ছুটির পরও কাজের প্রেসারে মাঝে মাঝেই থেকে যেতে হয়। মাখনকে মন দিয়ে কাজ করতে দেখলে ভদ্রতা করে একসাথে বাড়ি ফিরতে বলতেই হয়।
“ও মাইখনবাবু আপনে অহনো অফিসি আছেন? চলেন একলগে যাই…”
এই সুযোগের-ই অপেক্ষায় থাকেন মাখন। ছোটোখাটো চেহারার ফর্সা টুকটুকে মাখন যখন দশাসই মালিনীর পাশে পাশে হাঁটেন দূর থেকে দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগে! টিকটিকি আর জলহস্তির পদচারণা মনে পড়ে যায়! গরমের দিনে ভারী শরীরে মালিনীর হাঁটতে কষ্ট হয়, হাঁপিয়ে ওঠেন। মাখন পা উঁচু উঁচু করে ছাতা ধরে ধরে রোদ আড়াল করেন, একদিন তো সাহস করে একটা রিক্সাই ডেকে ফেললেন, “ম্যাডাম উঠে পড়ুন!”
“আপনেও চলেন একলগে যাই।”
মালিনীর পাশে বহুকষ্টে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বসেন মাখন। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় রিক্সার দুলুনিতে মাখনের মনে সুবাতাস বইতে থাকে। আধঘন্টার পথ ফুস করে দুমিনিটে শেষ হয়ে যায়। বাড়ি অবধি কেউ এলে এককাপ চা না খাইয়ে কি যেতে দেওয়া যায়?
মালিনীর বাবা, হারাধনবাবুর সাথে মাখন জমিয়ে ফেলেন। মুখচোরা লাজুক মায়ের কোলঘেঁসা মাখন মরিয়া তখন। নানান ছুতোয় ঘন ঘন মালিনীর বাড়ি ছুটতে হয়। সুধাংশুর পরামর্শ মতো বাঙাল বাড়ির রান্নার প্রশংসা করতে গিয়ে টের পান বাপ মেয়ে দুজনেই ঘটিবাড়ির আলুপোস্তর জন্যে মুখিয়ে থাকেন, চিংড়ি প্রীতিও দুজনের দেখবার মতো।
“বুঝলা মাইখন! আমাগো জিহ্বায় পুস্তো বড় ভ্যালা ঠেহে! তোমার মাসিমা ও বস্তুটির রাঁধনে পটু ছিল না! চিংড়িও আমরা বাপ মাইয়া খুব খাইতে ভালোবাসি! জানো!”
বৃদ্ধের জিভে জল আসে।
মাখন মায়ের কাছে আবদার করে বসেন, অফিসের সহকর্মীদের আলুপোস্ত চিংড়ি ভাপা খাওয়াবেন। অন্নদাদেবী ছেলের জন্যে মনের মতো পাত্রী না পেয়ে পেয়ে বড় মনোকষ্টে ভোগেন, এমন সোনার টুকরো ছেলের জন্যে একটা পদের মেয়ে জোটে না? বাংলাদেশে কবে থেকে বাপু মেয়ের এমন আকাল পড়ল?বেশি কিছু তো তিনি চান না! কটা রং আর একটু কম বয়সি ঘটি মেয়ে হলেই তো চলে! তা ছেলের জন্যে আলুপোস্ত রাঁধেন, চিংড়ি ভাপে বসান। হারাধনবাবু হাত চেটে পাত চেটে খান। মালিনীর মনে অকাল বসন্ত টোকা দেয়। চিরকাল গায়ের রঙের ভয়ে লাল নীল হলুদ এড়িয়ে চলেছেন। ঐ হালকা রঙের শাড়িই পড়েছেন। আজকাল অফিসে রঙিন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মাখনলাল টুকটাক প্রশংসা করলেই মনে আলো জ্বলে।
“ম্যাডাম! আপনাকে আজ ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে! ঠিক যেন বনলতা সেন!”
মাখন উসখুস করেন। সেই কথাটা আর বলে উঠতে পারেন না। একদিন দুর্লভ মুহূর্তে জানতে পেরেছিলেন মালিনী কবিতা বড় ভালোবাসেন। মাখন আর দেরি করেননি! তেড়ে কাব্য চর্চা শুরু করেছেন। অফিস ছুটি নিয়ে কলেজস্ট্রিট দৌড়েছেন… কবিতার বই পড়বেন বলে রাত জাগতে শুরু করেছেন। এসব কান্ড বাবা একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলেন, ডাইরির পাতায় কয়েক লাইন পড়েই ছেলেকে জেরা শুরু করেন।
‘তোমার কলকাপাড়ের শাড়ির আঁচল
আমার তোমার মরণবাঁধন…’
সুরেশ চেঁচিয়ে ওঠেন,
“কে? কে সেই মেয়ে?”
মাখন চেপে যেতে চান! সুরেশও নাছোড়বান্দা! গত দেড় বছর ধরে হাজার খানেক মেয়ে দেখে দেখে তিনি ক্লান্ত! আজকাল কাঁচের প্লেটে রসগোল্লা পান্তুয়া সিঙ্গারা দেখলেই বমি পায়! স্বপ্নে সারি সারি মেয়েরা চুল খুলে হেঁটে চলে দেখায়! ঘুম ভেঙে যায়। তবু, তিনি অপারগ! বৌ বললে না করবেন এমন সাহস কোথায়? বাপের বহু অনুরোধে মাখন ধীরে সুস্থে মুখ খোলেন। মালিনীর বর্ণনা শুনে সুরেশের বুক ধুকপুক করলেও কোথা থেকে যেন একটা সাহস এসে জোটে! সেই বিয়ের পর থেকে অন্নদার ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকতে থাকতে প্রতিশোধ বাসনায় ফুটতে থাকেন। মনে পড়ে যায়, অন্নদা কীভাবে তার তাসপাশার নেশা বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডার সময় কেড়ে নিয়েছে! সিনেমা দেখতে কী ভালোবাসতেন! অন্নদা সে সুখটুকু পর্যন্ত কেড়েছে। মাস মাইনে থেকে মাত্র দশটি টাকা সপ্তাহ খরচ বলে হাতে ধরে
দিয়েছে বছরের পর বছর। কিচ্ছুটি বলতে পারেননি। এই যে একমাত্র ছেলেটা তাদের সে পর্যন্ত ভীতুর ডিম হয়ে বেড়ে উঠেছে, প্রেমে পড়েও বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে!
সুরেশ ছেলেকে বলেন, “যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া! ঐ কবিতা দিয়েই মনের কথা বলে ফেল!”
“কবিতা দিয়ে?”
“হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ! জীবনানন্দ দাশের এই যে কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ এখানাই দিয়ে ফেলো মেয়েটাকে।”
সুরেশ ছেলের টেবিল থেকে বইটি তুলে নেন।
তারপর, যে কী ঘটে আর কীভাবে ঘটে বিলকুল ভুলে গেছেন মাখনলাল সমাদ্দার!
শুধু মনে আছে, মালিনীকে বৌ হয়ে বাড়ি ঢুকতে দেখেও অন্নদা সেদিন ভির্মি খাননি। বিয়ের চল্লিশ বছর কেটে গেলেও এই এখনও পর্যন্ত সে রহস্য জানেন না মাখনলাল! শুধু জানেন, বাপ ছেলেকে কড়া চোখে দেখতে দেখতে অন্নদা লাল বেনারসি মোড়া নববধূ মালিনীকে বলেছিলেন, “শোনো! আমার হেঁসেলে শুধু কোনোদিন শুঁটকি ঢুকিও না!”
4 Comments