নিয়ন্তা
সে-বছর যখন চাকরির অস্থির খামখেয়ালের সঙ্গে তাল রাখতে একেবারে হিমসিম খাচ্ছি – ছুটি চাওয়া তো দূরের কথা, ডেস্ক-চেয়ার ছেড়ে নড়াটাই হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক – তারি মাঝে অগত্যা আমাকে ফেলেই গিন্নী গেলেন দেশে। আর আমি এদের ঐ ‘হ্যাং-ইন্ দেয়ার, বেবি’-র মহামন্ত্র জপতে জপতে আটটা-পাঁচটার চক্করে ঘুরে চললাম কলুর বলদের মত। আমি যেন ঠিক সেই ‘চার্জ অব্ দ্য লাইট্ ব্রিগেড্’-এ অসহায় সৈন্যদলে একজন – ‘দেয়ার’স্ নট্ টু রিজন হোয়াই, দেয়ার’স্ বাট্ টু ডু অ্যান্ড ডাই!’
ঝুলে-ঝুলে তো ক্রনিক ব্যথা হয়ে গেল হাতে আর কাঁধে – ফাঁকা বাড়ীতে ফিরে কাতরাই রোজ, আর নিষ্ফল আক্রোশে শূন্যে লাঠি ঘোরাই; সেইসঙ্গে চলে কপালের মুণ্ডপাত। যাহোক, এদিকে তো ঘরে-বাইরে এহেন বেদনার সাঁড়াশিতে হাড়-পাঁজরাগুলো ভাজা-ভাজা – ওদিকে কাল্পনিক দুর্যোগের দোহাই দিয়ে গিন্নীকে পত্রপাঠ ফেরত আনার সৎচেষ্টায় ভরা চিঠিগুলোও একের পর এক ব্যর্থ। অবস্থা সঙ্গিন বুঝে শুভানুধ্যায়ী এক সুহৃদ মোক্ষম পরামর্শ দিলে – চিঠির খামে করে লম্বা ব্লন্ড চুল পাঠাতে। বললে – “ইটস এ সিওর্ শট্; ওয়ার্কস্ এভ্রিটাইম্ ফর মি – লাইক্ এ চার্ম!” বন্ধুর এই পরম আশ্বাসবাণী শুনে, শেষমেশ সেই ব্যবস্থাই নেবো স্থির করে মরিয়া হয়ে ব্লন্ড চুলের খোঁজে লেগে গেলাম। মালুম হল, এ-কাজটাও বিশেষ সহজ নয়। আর ঠিক সেই সময়েই ঘটল ব্যাপারটা।
সাহেবদের ভাষায় ঐ যাকে সংক্ষেপে বলে – “অ্যান্ড ইট্ হ্যাপেন্ড।” মানে, সর্বদাই যা আশঙ্কা করছিলুম – কদ্দিন আর ঐ ঝুলে থাকা যায়! অবশেষে ছিঁড়ল পলকা সুতো – খোয়া গেল সাধের চাকরীটি। বাজারের অবস্থা তো মালুম ছিল আগেই – বেশ বুঝলুম, পড়েছি অথৈ জলে। গত পনেরো বছরের প্রবাসজীবনের আলোছায়ায় – আসন্ন ভবিষ্যতের বিভীষিকাময় সম্ভাবনাগুলোর একটা বিমূর্ত মন্তাজ চোখের সামনে দিয়ে ছুটে গেল ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ মোডে, সচকিত আর্তনাদে – দুঃস্বপ্নের এক চকিত মিছিলের মত। যেদিকে তাকাই, অকালের ছোট-ছোট হল্দে ফুলে ভরে ওঠে মাঠঘাট, অকারণেই – নাকি সে আমারই চোখের ভুল?
ব্যস্! দু-নৌকোয় পা দিয়ে সাবধানে ব্যালেন্স-করে-চলা এই সুদীর্ঘ সময়ের পাল্লাটা ঝুঁকে পড়ল ওদিকে। সোনালী ক্যালিফোর্নিয়ার সব সোনা মুছে গিয়ে দেখা দিল বিবর্ণ হলুদ – ঘুচে গেল যত আকর্ষণ, একে একে সব পিছুটান। বিপদে পড়লে কি ভয় পেলে অসহায় শিশু যেমন ছোটে মায়ের কোলের নিশ্চিত আশ্রয়ের সন্ধানে – তেমনি বিপন্ন মুহূর্তে দিশাহারা এই দুর্বল-চিত্তও চঞ্চল হয়ে উঠল মাটি-মায়ের কোলে ফেরার আকুতিতে। স্নেহে-ঘেরা সেই নিরুদ্বেগ শান্তির মাঝেই বুঝিবা সব মুস্কিলের আসান। বুকের মধ্যে ডানা ঝাপটালো সেই পোষ-মানানো বাসাছাড়া পাখীটা – বলল, আর ‘হেথা নয়,হেথা নয়’; ডেকে উঠল সে – ‘এবার ফিরাও মোরে।’
নরম সোফায় গা ডুবিয়ে এ-ধরণের সাধ নিয়ে সখের নাড়াচাড়া মনে-মনে যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু এহেন ‘ডিসিশন্-পয়েন্ট’-এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি আগে কখনও। তবে এ-সিদ্ধান্ত তো আমার একার নয় – নির্ভর করছে তাঁর ইচ্ছের ওপর – যাঁর সাধ না হলে সাধ্য কী আমার! তাই, বার্তা নিয়ে ছুটল পত্রদূত সাত-সমুদ্দুর পেরিয়ে –
‘আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে –
স্বল্পে-সুখী আড্ডাধারী সেই জনতার ভিড়ে।
ট্রামে-বাসে সামলে ঠেলা,
চালে-ডালে কাঁকর গেলা –
মরীচিকার মোহন টানে ডুবি স্বখাত-নীরে।।
হাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,
হোঁচট খেয়ে বাঁচি – কিংবা ষাঁড়ের গুঁতোয় মরি।
আবার তুমি মোর উদ্দেশে হেঁসেল-ঘরের নিরুদ্দেশে,
ভীষণ ঘেমে ভাপা ইলিশ সাজাও সমাদরে।।
রাজধানী বা মদ্রদেশে রুজির খোঁজে হদ্দশেষে,
নতুন করে পড়ব বাঁধা স্নেহ-মায়ার ডোরে।
পথে-চলার বিশ্বনাটে, আপন দেশের প্রেক্ষাপটে,
পথিক-সাজা সাঙ্গ হবে আধেক জগত ঘুরে।।’
চিঠি পাঠিয়ে চুপচাপ বসে কড়িকাঠ গোণার জো নেই এদেশে – সেটা শুধুমাত্র কড়িকাঠের অভাবে নয়। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিগ্বিদিগ্ ছুটে বেড়াচ্ছে সব্বাই, সেই জনতার সামিল না হতে পারলে পেছিয়ে পড়তে হবে যে। তাই আম্মো ‘রেজিয়ুমে’-টা ঘষে-মেজে ইতিমধ্যে বিলি করে বেড়াই পথে-বিপথে – চেনা অচেনা সব মহলেই। মনে-মনে মেনে নিই – ‘যস্মিন দেশে যদাচারঃ।’ সাহেবরাও তো প্রকারান্তরে আওড়ায় সেই একই আপ্তবাক্য – ‘হোয়াইল্ ইন্ রোম, ডু অ্যাজ্ রোমানস্ ডু’! সেইমতে, জুতোয় হাফসোল লাগিয়ে আমি যখন যুদ্ধযাত্রায় রীতিমত প্রস্তুত – এমন সময়ে হঠাৎই শিকে ছিঁড়ল আশাাতীতভাবে। কপালক্রমে কোনো গোপন সুতোয় বুঝি পড়েছিল সঠিক হাতের মাপা-ওজনের টান। জানতুম ‘হায়ার-ফায়ার’-এর দেশে এটাই দস্তুর – তবে আশা করতে আশঙ্কা হয়েছিল বৈকি! মনের কী বিচিত্র গতি – নিমেষেই তার মেজাজ গেল বদলে। সব রং দেখা দিল আবার – যত স্বাদ আর আকর্ষণ নিয়ে। যেই-না আভাস মিলল – এখনকার মত অন্তত সবুজের উৎস যাবে না শুকিয়ে – অমনি বুঝি ফিরে এলো এদেশের জীবনের সবটুকু মানে। ভুলে-থাকা অনেক রঙিন হাতছানিতে নতুন করে নেচে উঠল মন। অবুঝ শিশু যেন নতুন খেলনার লোভে নেমে এল মায়ের কোল ছেড়ে – ছুটল আবার বড়লোক মামার হাত ধরে। যীশুর কৃপায় জুতে গেলুম আবার চেনা ঘানিতে।
ডাক পড়ল পত্রদূতের; আবার সে পাড়ি দিল আকাশপথে – ইচ্ছে-বদলের বার্তা নিয়ে –
‘আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে –
স্বার্থসুখে সব-বিকোনো মোহের নিয়ন-পুরে ।
বাইরে-ঘরে কাজের ঠেলা,
‘সেল’-এর ঝোঁকে কুড়োই ঢেলা –
‘আরো-র মায়ামৃগীর পিছে বেড়াই বৃথাই ঘুরে ।।
‘স্ট্রেস্’-এর তাঁতে সন্ধ্যে-প্রাতে আবার যাত্রা করি,
‘জাঙ্ক’ খেয়েই বাঁচি, কিংবা গুলি খেয়েই মরি ।
আত্মশ্লাঘার ঢাক পিটিয়ে, ড্রাগ আর ‘ক্রেজ্’-এর দাম মিটিয়ে,
আবেগবিহীন গতির বেগে আবার মরি ঘুরে ।।
অর্থনেশায় সর্বনেশে ছুটব আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে,
জুতো-সেলাই চণ্ডীপাঠে আবার মানি শিরে ।
যাযাবরী জীবন-ঠাটে পরদেশের অচিন-বাটে
বাজিয়ে যাবো ছায়ানটে হৃদয়-বাঁশিটিরে ।।’
[কৈফিয়ৎ ও শ্রদ্ধার্ঘ – সুধী পাঠক-পাঠিকা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন, এই পদ্য-দুটোর কাঠামো না-বলে-চেয়ে-নেওয়া; তাই অভিযোগের মুখোমুখি হবার আগেই স্বীকার করে নিই সেটা। কলম ধরার মুহূর্ত থেকেই আমার কাছে অবশ্য ব্যাপারটা অনিবার্য – নিয়তির মত অবশ্যম্ভাবী। প্রকাণ্ড গ্রহনক্ষত্র থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা পর্যন্ত সকলের জন্যেই সূর্য যেমন শক্তির উৎস, তা-নিয়ে ভাবতে বসে না কেউই – তেমনি, বাংলা-সরস্বতীর পুজোয় অঞ্জলির উদ্দেশ্যে ফুলের ভরা-পসরা আসে যাঁর বাগান থেকে – সে-মহাজনের কাছে ঋণী দেশশুদ্ধ প্রায় সবাই। তাই ঋণশোধের অর্থহীন প্রয়াস না করে তাঁর উদ্দেশে একান্তে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম – মনে-মনেই ।। ]