কিক অফ –
গেছেন পিকে, গেছেন চুনী, গেলেন বলবীর,
স্বর্গের মেন স্টেডিয়ামে বাড়ছে ক্রমেই ভীড়।
ইন্দ্রজ্যেঠু করো কিছু লাইভ টেলিকাস্ট,
আমরা যাতে দেখতে পারি সেই গ্লোরিয়াস পাস্ট। __
“ছড়াbituay”: ২৬শে মে, ২০২০ [বলবীর সিং মারা যাওয়ার পরদিন]
ফেসবুকে ওপরের এই পোস্টটা করেছিলাম – ওটা ছিলো আমার বহুমুখী এবং বহু-বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া। সুবিমল (চুনী) গোস্বামী যে আর ইহজগতে নেই, এই সত্যিটা হজম করতে আমার এতোটা অসুবিধে হয়েছিলো কেন জানিনা। তবে ‘জানিনা’ এই শব্দটা পুরোপুরি ঠিক বলছি কি – সত্যিই কি জানিনা? মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই – গড়পড়তা পঞ্চাশোর্ধ কলকাত্তাইয়া বাঙ্গালীর থেকে এই ব্যাপারে আমি [বা হয়তো আমার মতো আরো কিছু ‘তীর্থপতি প্রাক্তনী’] একটু আলাদা। এমনটা কেন? তা জানতে গেলে একটু ধৈর্য ধরে কষ্ট করে আমার এই ধান ভানতে শিবের গীত শুনতে হবে।
থাকতাম টালিগঞ্জ থানার-এর কাছে, সাদার্ন মার্কেটের পেছন দিককার ভবানন্দ রোডের ভাড়াবাড়িতে। ১৯৬৭-র গোড়ায় সেটি ছেড়ে রাসবিহারীর ত্রিকোণ পার্কের কাছেই আরেক ভাড়াবাড়িতে এলাম। সঙ্গে ছেড়ে এলাম টালিগঞ্জের রেলব্রিজের গা-ঘেঁষা আমার ছোট্ট প্রাথমিক স্কুল – যোগেন্দ্র শিশু ভবন। ভর্তি হলাম দেশপ্রিয় পার্ক আর প্রিয়া সিনেমার উল্টোদিকের তীর্থপতি ইনস্টিট্যুশনে। তখন আমি সবে ক্লাস থ্রিতে উঠেছি – নতুন ছাত্র হিসেবে গেলাম বি-সেকশন, রোল নম্বর ২২।
“যার নেই কোন গতি / সে যায় তীর্থপতি”।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কিছু আত্মীয়স্বজন এবং নতুন পাড়ার সমবয়সী নতুন বেশ কয়েকজন বন্ধু ‘আওয়াজ’ দেওয়া শুরু করলো। সেই ছড়া তখন, এবং তারপরেও বহুদিন, বেশ প্রচলিত ছিল – এখনো আছে বোধহয় অল্পবিস্তর। মিথ্যে বলবো না, শুনতে একটু খারাপই লাগতো সেই বয়সে।
তারপর হঠাৎই একদিন স্কুলে গেমস্ পিরিয়ডের শুরুতেই ‘ড্রিল-স্যার’ শিব-বাবু (শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) বললেন, “আজ তোরা দেশপ্রিয় পার্কে গিয়ে ফুটবল খেলবি, দেখি কেউ চুনীর মতো খেলতে পারিস্ কিনা। জানিস্, চুনী গোস্বামী আমাদের ছাত্র, এখানেই পড়তো!” আমি তো চমৎকৃত, রোমাঞ্চিত! দুদিন আগেই বাবার বন্ধুদের আড্ডায় বাষট্টির এশিয়ান গেমসের ফুটবলে স্বর্ণপদক জয়ের কথা শুনেছি – সেই দলের ক্যাপটেন, ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত ফুটবলার আমার স্কুলের ছাত্র! বেশ মনে আছে, সেদিন বিকেলে আমার পাড়ার সেই ‘নেই কোন গতি’ বলা বন্ধুদের ‘স্পিকটি নট্’ করে দিয়েছিলাম। নাঃ, ফুটবল খেলে নয়, চুনীর নাম শুনিয়ে।
১৯৬২-র জাকার্তা এশিয়াডে ভারতীয় দলের সঙ্গে চুনী গোস্বামী
চুনী গোস্বামী ((বসে বাঁদিক থেকে দ্বিতীয়), ১৯৬৪-তে তেহরানে প্রি-ওলিম্পিক খেলায় মাঠে ঢোকার পূর্বমুহূর্তে
[Photo: ‘The Hindu’ archives]
খেলা শুরু –
আমি বরাবর ক্রিকেটক্ষ্যাপা। কদিন বাদে, পাড়াতুতো এক ক্রিকেটভক্ত (কট্টর-মোহনবাগানী-অতএব-আবশ্যিক-চুনীভক্ত) প্রশান্তদার থেকে জানতে পারলাম যে আমার ক্রিকেট-ভগবান গারফিল্ড সোবার্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সাম্প্রতিক ভারত-সফরে একমাত্র হারের পেছনেও চুনীর প্রচুর অবদান ছিলো। শুনে তো আমি হতবাক, চুনী তো ফুটবলার, সে কি করে কানহাই-হল-গ্রিফিথ-লয়েডদের হারায়!
[অভিজ্ঞ পাঠক বুঝতেই পারছেন আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ-এর ১৯৬৬-৬৭ ভারত সফরের সেই ইন্দোরে হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম পূর্ব-মধ্যাঞ্চলের সম্মিলিত দলের খেলার কথা বলছি।]
বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলায় বাবাকে ধরলাম। মাসখানেক আগেই বাবা “এন্ড অফ অ্যান ইনিংস” থেকে ডেনিস কম্পটনের নিজের কথা পড়ে শুনিয়েছেন। আর তারপরেই আমি নিজে নিজে পড়ে নিয়েছি শঙ্করীপ্রসাদ বসুর “ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট” থেকে – নিউজীল্যান্ডের বিরুদ্ধে কম্পটনের জীবনের প্রথম টেস্ট এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম টেস্ট সিরিজের বর্ণনা। চুনীও কি তবে কম্পটনের মতো ক্রিকেটার-ফুটবলার দুটোই? “বাংলার ডেনিস কম্পটন”?
বাবা তখন শোনালেন চুনীর জীবনের প্রথম রঞ্জি খেলার কথা। ১৯৬৩-র সেই বাংলা বনাম হায়দ্রাবাদের ইডেনের কোয়ার্টার ফাইন্যাল যা আজও বোধহয় বাংলা ক্রিকেটের অন্যতম লোকগাথা হয়ে রয়েছে। যে খেলার বীর-নায়ক গোলগাল চেহারার চশমাধারী সেই ওপেনিং জুটিতে ভারতের প্রায়-সাড়ে-পাঁচ-দশকের বিশ্বরেকর্ডের ভাগীদার পঙ্কজ রায়। চুনী তখন সদ্য জাকার্তা এশিয়াড থেকে ফুটবল-সোনা জিতে আনা ভারতীয় ফুটবল দলের অতি জনপ্রিয় অধিনায়ক।
সেই খেলায় চুনী রান করেছিলেন ৪১ এবং ০, বল করে নিয়েছিলেন ২ উইকেট, ২৩ রানে এবং ১ উইকেট, ২২ রানে। হায়দ্রাবাদের দ্বিতীয় ইনিংসে লেস্টার কিং এর বলে আবিদ আলির ক্যাচ ধরেছিলেন। মোটামুটি সাফল্যময় অভিষেকই বটে। এই খেলার বর্ণনা শঙ্করীপ্রসাদ বসুর “নট আউট” বইতে পরে নিজে পড়েছি। অনেক পরে গৌতম ভট্টাচার্যের “পঙ্কজ” বইতে এবং সবশেষে (কিছু অনাবশ্যক ভেজালসহ) জয়সীমার আত্মজীবনী “My Way”-তে আবার পড়তে পেরেছি।
চুনীকে আমার প্রথম চাক্ষুষ করা ১৯৬৯ (বা ১৯৭০) সালে – আমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া-প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন, সঙ্গে সম্ভবত সুকুমার সমাজপতিও ছিলেন। তারপর আবার সামনা-সামনি দেখি ১৯৭১ সালে – আমার বিবেকানন্দ পার্কের খেলার মাঠের বন্ধু আশিস্ (বাবু) সিদ্ধান্তর পৈতের নেমন্তন্নে। বাবুর বাবা প্রোফেসর সিদ্ধান্ত ছিলেন চুনীর আশুতোষ কলেজের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ‘স্যার’। বেশ মনে আছে বাবুকে চুনী উপহার দিয়েছিলেন চমৎকার একটা ফুল-সাইজ ক্রিকেট ব্যাট। পরে আমি মাঝে-মধ্যেই নেট প্র্যাকটিস করার সময় নিজের ব্যাট ছেড়ে বাবুর ঐ ব্যাটটা একটু চেয়ে নিয়ে কয়েকটা বল খেলে নিতাম। ক্রিকেটক্ষ্যাপা, ক্লাস সেভেনে পড়া, আমার কি তখন মনে হতো যে বাংলার হয়ে নেট প্র্যাকটিস করছি? হবেও বা!
আমার দুর্ভাগ্য যে চুনীকে ফুটবল খেলতে আমি কখনো দেখিনি। শুধু তাই নয়, আমার বাবা বা এক জ্যাঠা (বাবার ঠিক ওপরের দাদা), যাঁদের মুখে তাঁদের দেখা অনেক চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের বিখ্যাত ফুটবলার এবং ক্রিকেটারদের কথা শুনেছি, তাঁরাও দেখেননি। [আমার এলাহাবাদ-প্রবাসী টেলিগ্রাফ-অফিসে-কর্মরত এই জ্যাঠা খেলাধুলোর সঙ্গে কিঞ্চিৎ সাহিত্য-নাটক-চর্চাও করতেন বলেই বোধহয় তাঁর বর্ণনা একটু বেশি চিত্তাকর্ষক ছিলো আমার বাবার অলঙ্কার-বর্জিত সোজা-সাপটা বিবরণের থেকে।]
কলকাতা রাজ্য পরিবহন (CSTC) একাদশের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন চুনী। উপলক্ষ ছিল বার্ষিকী উদযাপন। সেই ম্যাচে মাটিতে পড়ে গোলে ধাবমান বলকে লক্ষ্যরত চুনী
[Photo: ‘The Hindu’ archives]
কেমন ফুটবলার ছিলেন চুনী? এ নিয়ে কোনো আলোচনা করার যোগ্যতা বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। অনেক তাবড় খেলোয়াড়, সাংবাদিক ও ফুটবল-বোদ্ধা চুনীর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর অনেক কিছু লিখেছেন / বলেছেন। আমি শুধু ২০১৫-র মে মাসে এক বিখ্যাত ওয়েব-ম্যাগাজিনে চুনীর দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে উল্লেখ করি – “I don’t brag about it, but arguably I was the best footballer in the country.”
হাফ-টাইম-
আমি চুনীকে দেখেছি ক্রিকেট খেলতে, ১৯৭১-৭২-৭৩ সালে। কখনো গ্রীষ্মের সকালে দেশপ্রিয় পার্কে, মিলন সমিতি / দক্ষিণ কলকাতা সংসদের নেটে, সঙ্গে থাকতেন দেবু মিত্র, দীপঙ্কর সরকার, গোপাল বসু, (কখনো) রাজা মুখার্জী, রাজু মুখার্জী, প্রকাশ পোদ্দার, এইসব বাংলা রঞ্জি দলের খেলোয়াড়রা। আবার কখনো দেখেছি শীতের বেলায় বা দুপুরে লীগ ম্যাচ খেলতে, সঙ্গী বা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতেন অম্বর রায়, অশোক গান্দোত্রা, দিলীপ দোশী, কল্যাণ (ভাইটু) চৌধুরী, নন্দু চন্দ্রভারকর (কি দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিলেন!), পলাশ নন্দী, প্রলয় চেল, রণবীর সেন, রুসি জিজিবয়, সমর (চাকু) চক্রবর্তী, সুব্রত গুহ, তপনজ্যোতি (TJ) ব্যানার্জী, ৬০ / ৭০ দশকের বাংলা / পূর্বাঞ্চলের হয়ে রঞ্জি / দলীপ ট্রফি খেলা সব ক্রিকেটাররা। অম্বর, গান্দোত্রা ও সুব্রত তো টেস্টও খেলেছেন, আর জিজিবয় ১৯৭১-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকারী দলে ছিলেন (কিন্তু টেস্ট খেলেননি), দোশী যদিও অনেক পরে খেলেন।
কেমন ক্রিকেটার ছিলেন চুনী? একঝলক দেখে নেওয়া যাক ওনার ১৯৬২-৬৩ থেকে ১৯৭২-৭৩ ব্যাপী প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের পরিসংখ্যান।
ব্যাটিং-ফিল্ডিং –
৪৬টি ম্যাচের ৬৩ ইনিংসে (৭টি নঃ আঃ) মোট রান ১৫৯২ গড় ২৮.৪২ সর্বোচ্চ – ১০৩ একটি শত রান, ৭টি অর্ধ শত রান, ক্যাচ ধরেছেন ৪০টি।
বোলিং-
৪৬টি ম্যাচে ২৯১৭ বল করে ১১৩২ রান দিয়ে ৪৭টি উইকেট। গড় ২৪.০৮, সেরা ৪৭ রানে পাঁচ উইকেট।
১৯৭১-৭২ এ রঞ্জি ফাইন্যালে মুম্বাইয়ের বিরুদ্ধে বাংলার অধিনায়ক ছিলেন।
কি আর এমন আহামরি! কিন্তু ভুলবেন কি করে যে এই ‘চুনী’ ব্যক্তিটি ক্রিকেট খেলতে মন দেন ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরে। ততোদিনে তাঁর গোটা পঞ্চাশেক আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে ১৯৬৬-৬৭-তে পূর্ব-মধ্যাঞ্চলের সম্মিলিত দলের হয়ে দুরন্ত খেললেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অবশ্য তাঁর ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে ওঠা হয়নি।
ডেনিস কম্পটন তাঁর ২২ বছরব্যাপী ক্রিকেট জীবনে তাঁর কাউন্টি মিডলসেক্স এর ক্যাপ্টেন ছিলেন দুবছর, ১৯৫১ ও ১৯৫২, আর তাঁর ১৩ বছরব্যাপী সিনিয়র ফুটবল জীবনে আর্সেনালের উইঙ্গার হয়ে গোটা ষাটেক অফিসিয়াল ম্যাচ (এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে দেশের হয়ে ডজনখানেক আন-অফিসিয়াল ম্যাচ) খেললেও কখনো আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেননি।
বেশ কিছু মিল পেলেন কি? তাইতো বলেছিলাম “বাংলার ডেনিস কম্পটন”!! [‘পরিশিষ্ট’ দ্রষ্টব্য]
“আনন্দমেলা” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিলো চুনীর আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিচারণ (সম্ভবত 1982 সাল থেকে – সঠিক মনে নেই), আগ্রহভরে পড়তাম নিয়মিত। পরে এটি বই হয়ে বেরিয়েও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো বলে শুনেছি। এলো 1983 – চুনী পেলেন ভারত সরকারের “পদ্মশ্রী” সম্মান, ক্রীড়াপ্রেমী ভারতীয় এবং বাঙ্গালী বলে গর্ব তো হয়েছিল বটেই, আরো খুশী হয়েছিলাম তীর্থপতি প্রাক্তনী হিসেবে।
[এইখানে ছোট্ট করে ছুঁইয়ে রাখি আমার ক্লাস টেনের সহপাঠী বিশ্বজিৎ (বিশু) ভট্টাচার্যের নাম – সেও বাংলার নামী ফুটবলার হয়ে উঠেছিলো এবং ১৯৮২ এশিয়াডে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলো – একই স্কুল থেকে দুই প্রাক্তনীর ভারতীয় ফুটবল অধিনায়ক হওয়া খুব সাধারণ নজির নয় কিন্তু।]
এপ্রিল ২, ১৯৮৩ – রাষ্ট্রপতি জৈল সিং এর হাত থেকে পদ্মশ্রী গ্রহণ [Photo: ‘The Hindu’ archives]
চুনীকে “পদ্মশ্রী” ‘পাইয়ে দিয়ে’ আমি ১৯৮৩ সালে যাদবপুর থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলি-কম্যুনিকেশনে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়লাম। আশির দশকের শেষদিক থেকে যোগ হলো বেশ কিছু পারিবারিক দায়িত্ব, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে কর্মজীবন, পরিবার এবং সাংসারিক নানা পাকেচক্রে খেলাধুলোর জগতের সঙ্গে যোগসূত্র হয়ে রইলো খবরের কাগজের পাতা, টিভির খবর, আর মাঝে-মধ্যে সুযোগ পেলে টিভির লাইভ খেলা দেখা। সেই আবেগ চাপা পড়ে গিয়ে কেমন জানি অভ্যাসে বদলে গেলো। চুনীকে খবরে পেতাম টাটা ফুটবল একাডেমির (TFA) পরামর্শদাতা, মোহনবাগানের কর্মকর্তা, ফুটবল বিশেষজ্ঞ, এবং পরে কিছুদিন শহরের শেরিফ রূপে, যদিও সচেতনভাবে নিজেকে প্রচারের আলোয় আনার চেষ্টা চুনী বিশেষ করতেন না।
এইভাবে দিন গড়িয়ে এসে পড়ল ২০০৫ সাল। চুনীকে আবার চাক্ষুষ করলাম নিজের নতুন বাসস্থানের দোরগোড়ায় – আমাদের নতুন হাউসিং কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে এলেন লোকসভার তৎকালীন স্পীকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কোলকাতা পুরসভার তৎকালীন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। সঙ্গে কোলকাতার কয়েকজন দিক্পাল প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ – লেসলি ক্লডিয়াস, গুরুবক্স সিং, জয়দীপ মুখার্জী, ভেস পেজ এবং অবশ্যই চুনী গোস্বামী।
অন্যান্য বিশিষ্টরা চটপট চলে গেলেও চুনী থাকলেন বেশ খানিকক্ষণ। নিজে খেলে উদ্বোধন করলেন আমাদের টেনিস কোর্টের আর বললেন, “… I hope that another Sania Mirza will come out from this court“. তাঁর সে আশা আদৌ কোনোদিন পূরণ হবে কিনা জানিনা, কিন্তু বিগত মার্চ পর্যন্ত (কোভিড এর আগে) ওই কোর্টে সাত-আট থেকে বারো-তেরো বয়সের ডজনখানেক ছেলে-মেয়ে নিয়মিত কোচিং নিতো, প্র্যাকটিস করতো – এটাই বড়ো কথা – আশা করি করোনার ভ্রূকুটি কমলে সেই প্রয়াস আবার চালু হবে।
[২০০৫ এর সেইদিনে তোলা কিছু ভিডিওর সামান্য এক অংশ এখানে দিলাম, ভিডিওটি যেহেতু প্রাইভেট, তাই চালিয়ে দেখবার সুযোগ দিতে পারছিনা।]
শেষের বাঁশি –
চুনীকে শেষ চাক্ষুষ দেখা ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে- আমাদের “তীর্থপতি প্রাক্তনী”-র তরফে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। স্কুলের ভেতরকার পুরনো সেই উঠোনেই হয়েছিলো অনুষ্ঠান। অসুস্থতা সত্ত্বেও এসেছিলেন, সময় কাটিয়েছিলেন অন্যান্য প্রাক্তনীদের সঙ্গে – তাঁরাও খুব খুশী হয়েছিলেন ‘The most famous alumnus of our Tirthapati Institution’-কে নিজেদের মধ্যে পেয়ে। সেই অনুষ্ঠানে তোলা কয়েকটি ছবি সঙ্গে দিলাম।
লেখা শেষ করতে গিয়ে মনে পড়ছে “খেলতে খেলতে” ধারাবাহিকের সেই বিশেষ জায়গাটা। জাকার্তায় ফুটবল ফাইন্যাল জেতার পর চুনী, পিকে, অরুণ ঘোষ, প্রশান্ত সিনহা, প্রদ্যোৎ বর্মণ সমেত ভারতীয় দলের হৈহৈ করে গাওয়া (অতুলপ্রসাদের) সেই গান “বলো বলো বলো সবে … ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”। সেটা ছিল ১৯৬২ আর আজ ২০২০ চলছে। আরো মনে পড়ছে ১৯৮০-র পর থেকে অলিম্পিক হকিতে সোনা আসেনি।
লেখা শুরু করেছিলাম আমার একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে – ‘সেই গ্লোরিয়াস পাস্ট’ – শেষ করছি এই আশা নিয়ে যে বেঁচে থাকতে থাকতে এশিয়াডের ফুটবলের সোনা বা ফুটবল বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশগ্রহণ বা অলিম্পিক হকিতে সোনা, একটা কিছু দেখে যাবো যাতে চুনীকে (পিকে বা বলবীরকেও) সেই গল্প শোনাতে পারি। দেখা যাক ‘অতুলবাবুর প্রসাদ’ আজও কাজ করে কিনা …!!
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও তথ্যঋণ]:
- “Eden Gardens: Legend & Romance” by Raju Mukherji
- “en/wikipedia.org”
- “ESPNcricinfo.com”
- “facebook.com/groups/westwindians”
- “facebook.com/tirthapati.praktoni”
- “খেলতে খেলতে” by চুনী গোস্বামী
- “Mysepik.com” – “বছর পঁয়তাল্লিশ পরে, চুনীবাবুর তীর্থপতির ট্রফি-ঘরে” by অধ্যাপক মাল্যবান চট্টোপাধ্যায়
- “Sportstar” magazine from The Hindu – online version, dated 30-Apr-2020
পরিশিষ্ট
তখন তীর্থপতির ক্রিকেট দলের একজন কম পড়েছে। একটি ছেলে এগিয়ে এসে বললো ‘আমায় দিয়ে কি হবে?‘
দলের ক্যাপ্টেন বুদ্ধ। বন্দুক চালাতে পারে। দু-এক বার সামনে বাঘ-টাঘ দেখেছে তখনই (‘জঙ্গল মহল’ দ্রষ্টব্য) । বলল ‘শোন, এ তোর ফুটবল নয়‘। বলার কারণ ছেলেটি তখনই মোহনবাগান জুনিয়র খেলে। যাই হোক দলে তাকে নেওয়া হলো। তখন স্কুল ক্রিকেট জমিয়ে হতো কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতা লীগ আলাদা হতো। ছেলেটি প্রথম ম্যাচেই ৪৭ রান করে আর ০ রানে ৪ উইকেট নেয়। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ডাক আসে কোচবিহার ট্রফির বাংলা স্কুল দলের সিলেকশনে।
স্পোর্টিং ইউনিয়নের মাঠে চলছিল বাংলা স্কুল দলের সিলেকশন। দুজন সাহেব মন দিয়ে দেখছিলেন। একজন সাহেব একটি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি করা হয়? ব্যাট?’ ছেলেটি উত্তর দিল ‘হ্যাঁ, বলও করি, লেগ ব্রেক’। সাহেব চমৎকৃত হয়ে বললেন ‘আচ্ছা, লেগ স্পিন – তা দেখাও দেখি’।
ছেলেটি দেখালো। সাহেব খুব খুশি। ছেলেটির লেগ স্পিন বল করার ভঙ্গির সাথে তিনি এক কিংবদন্তি ব্রিটিশ লেগ স্পিনারের মিল খুঁজে পেলেন। তিনি ছেলেটিকে সেই নামেই ডাকতেন। অপর সাহেবটিও।
সেই সাহেবটি ছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেট-কোচ বার্ট ওয়েনসলি। আর অপর সাহেবটি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, পিয়ার্সন সুরিটা। প্রাক্তন ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার।
যাঁর বল করার ভঙ্গীর সঙ্গে মিল পেয়েছিলেন, সেই লেগ স্পিনার ছিলেন বিখ্যাত ‘টিচ’ ফ্রিম্যান। আজ্ঞে হ্যাঁ, যিনি এক মরশুমে বহুবার ইংল্যান্ডে ২০০ উইকেট নিয়েছেন। নিয়েছেন ২৫০, এমনকি ৩০০ উইকেটও।
আর ছেলেটি? তিনি পরে স্পিনের থেকে মিডিয়াম পেস বেশি করতেন।
এমনই ভাগ্য বিশ্ববিদ্যালয় দলকে ভারত-সেরা করিয়েছেন অধিনায়ক হয়ে ফুটবলে, অধিনায়ক হয়ে রানার্স-আপ ক্রিকেটে, আবার বাংলাকে অধিনায়ক হয়ে ভারত-সেরা করেছেন ফুটবলে, অধিনায়ক হয়ে রানার্স-আপ ক্রিকেটে। একই রনজি ফাইনালে দুটি শতরান মাঠে রেখে এসে তিরস্কৃত হন বিনু মানকাদের কাছে। গুলাম আহমেদ বলেছিলেন (পঙ্কজ রায়ের মতো) ফুটবল ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ক্রিকেট খেলতে। ওয়েসলি হল আর রয় গিলক্রিস্ট দুজনকেই খেলেছেন, কিন্তু আলাদা ম্যাচে। সান্নিধ্যে এসেছেন বিজয় মার্চেন্টের। প্রথম ডিভিশনে খেলার আগে আই এফ এ দলে খেলেছেন।
ছেলেটির প্রথম স্কুল ক্যাপ্টেন আজও রয়ে গেছেন। একবুক স্মৃতি নিয়ে। তিনি আর কেউ নয়, আমাদের সবার প্রিয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। ‘ঋজুদা’-র স্রষ্টা।
আজ আর সেই ছেলেটি নেই। কিন্তু আছেন হৃদয় জুড়ে, সুবিমল ‘চুনী’ গোস্বামী।