মেহেরগড়- লুপ্ত সভ্যতার গুপ্তধন

মেহেরগড়- লুপ্ত সভ্যতার গুপ্তধন

সিন্ধু-সভ্যতা: হরপ্পা ও মহেঞ্জাদারো

মানসভ্যতার বিকাশের ইতিহাসে দেখা গেছে, সাধারণতঃ গ্রামভিত্তিক সভ্যতা উন্নতিপ্রাপ্ত হয়েই শহরের উত্থান হয়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে এর উল্টো ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগর-কেন্দ্রিক ও উন্নত পরিকল্পনাযুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক কারণে এই পরিকাঠামো ভেঙে পড়লে পরবর্তীকালে বৈদিক সভ্যতা বিকশিত হয় মূলত গ্রাম-কেন্দ্রিক রূপে।

এককালে লোকের ধারণা ছিল যে ভারতীয় সভ্যতার পত্তন হয় বৈদিক যুগে আর্যদের দ্বারা। কিন্তু সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ দেয় যে আর্যরা আসার অনেক আগে থেকেই ভারতে নগরভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল। ১৮২৬ খ্রীস্টাব্দ থেকেই পশ্চিম পঞ্জাবের হরপ্পা অঞ্চলে ছোটখাটো পুরাকালীন বস্তু আর ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন পাওয়া যেতে থাকে। পরে জেঃ কানিংহ্যাম নামে এক বৃটিশ অফিসার, ১৮৭৫ সালে এ নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে পুরাতাত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই তথ্য অনুসরণ করে প্রত্নতত্ববিদ রায় বাহাদুর দয়ারাম সাহানি (১৮৭৯-১৯৩৯) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের মন্টগমারি জেলায় সিন্ধুর উপনদী ইরাবতী(রাভি)র তীরে হরপ্পা সভ্যতা নামে এক উন্নত নগর সভ্যতার সন্ধান পান। প্রায় একই সময়ে ১৯২২ সালে বিশিষ্ট বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুনদের পশ্চিমতীরে সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো (সিন্ধি শব্দ, অর্থ ‘মৃতের স্তূপ’) নামক স্থানে এক উন্নত সভ্যতা আবিষ্কার করেন। এই দুটি সভ্যতা অন্ততঃ খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ সালের বলে প্রমাণিত হয়। সিন্ধুনদের তীরে স্থিত বলে আগে এই সভ্যতাকে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ বলা হত, তবে সাম্প্রতিক কালে সিন্ধুতট অতিক্রম করে ভারত ও ভারতের বাইরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে এই সভ্যতার প্রায় ১৫০০টিরও অধিক কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে, এই কারণে এখন আর সিন্ধু সভ্যতা না বলে প্রথম আবিষ্কৃত স্থানের নাম অনুসারে একে হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়। হরপ্পা-সংস্কৃতি মানবসভ্যতার বিকাশের এক উন্নততর ক্রমকে অনুসূচিত করে। এসময় উন্নত নগরায়ণ, গৃহনির্মানে পাথর ও কাদামাটির যথাযথ ব্যবহার, স্নানাগার, শস্যাধার, সভাগৃহ নির্মাণ, জলনিকাশ আর পয়ঃপ্রণালীর সুচারু প্রয়োগ দেখা যায়। 

মেহেরগড়

মেহেরগড়ের মানচিত্র

মেহেরগড়ও এই হরপ্পা সভ্যতার একটি কেন্দ্র। কিন্তু এর অন্য কিছু নজিরহীন বৈশিষ্ট্য আছে। বোলান গিরিপথের কাছে সিন্ধুর উপনদী বোলানের তীরবর্তী অঞ্চলে কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে বালুচিস্তানের কাচ্চি সমভূমিতে ৫০০ একর ব্যাপ্ত মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৭৪-১৯৮৫তে বিশিষ্ট ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজের নেতৃত্বে এখানে খননকার্য চালানো হয়। পরে তিনি ১৯৯৬-১৯৯৭ সালেও এখানে খনন চালিয়ে ২০০০ সালে খননকার্য সমাধা করেন। এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রগুলি হল কিলে গুল মহম্মদ, কোটদিজি, গুমলা, মুন্ডিগাক, রানা ঘুনডাই, আনজিরা, এবং মেহেরগড়। সাতটি স্তরবিশিষ্ট এই প্রত্নক্ষেত্রের প্রথম তিনটি স্তর হল নব্যপ্রস্তর যুগের। চতুর্থ থেকে সপ্তমকে অন্যভাগে বিভক্ত করব। এই সাতটি স্তরে ভ্রাম্যমান পশুপালকের জীবন থেকে শুরু করে নাগরিকতায় উত্তরণের প্রতিটি দশার সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়।

প্রথম থেকে তৃতীয় পর্যায়

(রেডিও কার্বন-১৪ পদ্ধতির দ্বারা পরীক্ষিত)

১) প্রথম মৃৎশিল্পপূর্ব নব্যপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়ের (Aceramic Neolithic founding) period 7000-5500 BC.

২) দ্বিতীয় নব্যপ্রস্তরযুগীয় (Neolithic Period) 5500–4800 BC.

৩) তৃতীয় তাম্রাশ্মযুগীয় পর্যায়ের (Chalcolithic Period) 4800–3500 BC। এই সময়কালের পরেই হরপ্পা সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়।

১) মেহেরগড়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় কিলি গুল মুহাম্মদ নামক আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সমকালীন, তাই এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পপূর্ব নব্যপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়কে (৭,০০০-৫,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ‘কিলি গুল মুহাম্মদ পর্যায়’ বলা হয়। মেহেরগড় সভ্যতার প্রথম পর্যায় ছিল প্রাক্‌মৃৎশিল্প নব্যপ্রস্তরযুগীয় (aceramic neolithic)। প্রথম পর্যায়ের থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো থেকে অনুমান করা যায় যে এই এলাকাটি প্রথমে ছিল যাযাবর গোষ্ঠী, অর্থাৎ শিকারি ও ভ্রাম্যমান পশুপালকদের অস্থায়ী আবাসস্থল। পরে প্রথম পর্যায়ের মধ্যেই প্রমাণ মেলে স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে ওঠার ও কৃষিভিত্তিক জীবনচর্চার বিকাশের। কিছু অর্ধ-যাযাবর জাতি গম ও যব চাষ এবং ভেড়া, ছাগল ও গবাদিপশু পালনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের প্রাথমিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এখানকার বাসস্থানগুলি নির্মিত হত কাদামাটির তৈরি রোদে শুকোনো সমান মাপের ইট দিয়ে, আর অধিকাংশই ছিল চার কামরাবিশিষ্ট। বাড়িতে ঘর গরম করার জন্য চুল্লী বা আগুন জ্বালাবার স্থান ছিল। অনেক বাড়িতে শস্য মজুত করবার জন্য একটি কক্ষ ব্যাবহার করা হত। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল গরু, ভেড়া, ছাগল, শূকর ও ষাঁড়। মনে করা হয়, কুকুরও এই সময় পোষ মেনেছিল। এই সময় নানা প্রজাতির খেজুর, বার্লি, যব, ও গমের চাষ হত। এই পর্বের মধ্যে মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া না গেলেও, মিলেছে কিছু ছোট ছোট মানবমূর্তি। পন্ডিতদের অনুমান সম্ভবত এগুলি ভারতীয় ভাস্কর্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।

এখানে বেশকিছু কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার ভেতরে ছিল ঝুড়ি, পাথর এবং হাড়ের সরঞ্জাম, জপমালা, চুড়ি, দুল এবং মানুষ ছাড়াও মাঝেমধ্যে বলি দেওয়া পশুর কঙ্কাল ইত্যাদি। এখানে উদ্ধার করা প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে ঝিনুকের খোল, চুনাপাথর, টারকোয়েজ, ল্যাপিস লাজুলি, এবং বেলেপাথরের অলঙ্কার, বিভিন্ন প্রাণী ও নারীমূর্তি ইত্যাদি। সমুদ্রতীর ও বর্তমান আফগানিস্তানের বাদাখশান (ল্যাপিস লাজুলির মূল উৎস) থেকে এত দূরে ঝিনুকের খোল ও লাপিস লাজুলির প্রাপ্তি ওই সব অঞ্চলের সঙ্গে এই সভ্যতার যোগাযোগের প্রমাণ দেয়। একটা কবরের মধ্যে একটা এবং উপর থেকে আরও বেশ কয়েকটা একপৃষ্ঠীয় প্রস্তর কুঠার (single ground stone axe) পাওয়া গিয়েছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাপ্ত এজাতীয় বস্তুর প্রাচীনতম নিদর্শন। শিকার করা পশুদের মধ্যে ছিল কৃষ্ণসার হরিণ, চিঙ্কারা, নীলগাই, সম্বর, চিতল, বন্য মহিষ, বন্য-বরাহ ও হাতি।

এখানে সাধারণত দুটি বা দুই সারি বাড়ির মধ্যের অংশ সমাধিক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করা হত। মৃতদেহগুলিকে একপাশে এবং হাঁটুমুড়ে সমাধিস্থ করা হত। সমাধিতে মৃতের সঙ্গে দেওয়া হত সামুদ্রিক ঝিনুকের লকেট, ঝিনুক জাতীয় অন্যান্য জিনিস বা মালা, পাথরের লকেট, বৈদুর্যমনি, নীলকান্তমনি, প্রভৃতি। সম্ভবত মধ্য এশিয়া বা পারস্য থেকে নীলকান্তমনি ও আফগানিস্তানের থেকে বৈদুর্যমনি আমদানি করা হত। বোঝা যায় যে আজ থেকে ৭০০০ বছর আগেও হস্তশিল্প, বাস্তুশাস্ত্র, কৃষিকার্য, আর মৃতের সৎকারের প্রণালীর মধ্যে যে মিল দেখা গেছে তাতে মেহেরগড়ের সঙ্গে তৎকালীন মেসোপটেমিয়া ও সুমের সভ্যতার যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল।

মেহেরগড় সাইট

দিলীপ কুমার চক্রবর্তী তাঁর ভারতের প্ৰাগিতিহাস পুস্তকে লিখেছেন, “মৃতের সঙ্গে দেওয়া জিনিসের পার্থক্য থেকে অনুমান করা যায় যে, সে যুগে সামাজিক পার্থক্যও ছিল।” ড: ইরফান হাবিবও এখানে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। সমাধিতে দ্রব্য দেওয়ার রীতি থেকে অনুমান করা যায় তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর বিশ্বাস রাখত। মোটামুটি এই সময় থেকে মেহেরগড় ধীরে ধীরে নগরায়নের পথে অগ্রসর হতে শুরু করে।

২) দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায় প্রথম ধাপের ধারাবাহিকতার সঙ্গে বেশ কিছু পরিবর্তন ও নূতনত্ব। এই পর্বে প্রচুর পোড়া তুলো-বীজ পাওয়া গেছে। এখান থেকে প্রমাণ হয় যে হরপ্পা সভ্যতারও দুই হাজার বছর আগে তুলার চাষ শুরু হয়। এছাড়া গম, বার্লি ও তুলার চাষ জলের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ করে। এছাড়া মাটির পাত্রের ব্যবহার ব্যাপকতর হয়। প্রথমে এগুলো হাতে তৈরি হত, কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০-অব্দ নাগাদ সুমের থেকে আসে কুমোরের চাক, ফলে যুগান্তর এল মৃৎশিল্পে। এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের পাথর ও শাঁখের অস্তিত্ব দূরপাল্লার বাণিজ্যের ইঙ্গিত দেয়।

কামরায় বিভক্ত বাড়ি

৩) তৃতীয় পর্যায়ে কর্ষিত শস্যের বিরাট তালিকা দেখে কৃষির অগ্রগতির কথা বোঝা যায়। এ সময় গণ-শস্যাধারের উদ্ভব হয় যা উন্নততর সমাজব্যবস্থার দ্যোতক। মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি দেখা যায়। চাকে তৈরি ও চুল্লির আগুনে পোড়ানো নানা রঙের মৃৎপাত্রের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। মাটির পাত্রগুলিতে নানাপ্রকার জ্যামিতিক নকশা, পশু-পাখি, গবাদি পশু, এবং গাছপালার ছবি দেখা যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি তামার পুঁতি ও আংটি পাওয়া গিয়েছিল। তৃতীয় পর্বে পাওয়া যায় তামা গলানোর জন্য অন্তত চোদ্দটি পোড়ামাটির পাত্র বা মুচি। এ সময় যে ব্যাপক তামার ব্যবহার শুরু হয়েছিল, এ তারই প্রমাণ। এছাড়া এই পর্বে পাওয়া গেছে তামার ছুরি, বঁড়শি, সূচ, প্রভৃতি। পাথর কেটে অলংকার তৈরিতেও মানুষ এই সময় দক্ষ হয়ে ওঠে। বহির্বাণিজ্যেরও বিস্তার ঘটে।

চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়

৪) তাম্রাশ্ম পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৩২৫০) (Chalcolithic Period IV),

৫) তাম্রাশ্ম পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫০-৩০০০) (Chalcolithic Period V)

৬) তাম্রাশ্ম পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০-২৮০০) (Chalcolithic Period VI)

৭) তাম্রাশ্ম-নব্য ব্রোঞ্জ পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০-২৬০০) (Chalcolithic to Early Bronze Age Period VII)

৪) তাম্রাশ্ম-পর্যায় ৪-এ মৃৎশিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়। টেরাকোটা শিল্প, মাটির শিল্পে নান্দনিকতার ছাপ ও রঙের ব্যবহার ব্যাপক হয়। এছাড়া দৈনন্দিন জীবনে প্রথম কাঠের ব্যবহার দেখা যায় আর বানিজ্যিক আদানপ্রদান শুরু হয়। এই সময় সেচের জন্যে প্রচুর খাল খনন করা শুরু হয় আর সেই খাল দিয়ে চতুষ্কোণিক শ্রেণীনিবদ্ধ এলাকাগুলোকে পৃথক করে তাতে বসতবাড়ি, ক্ষেত-খামার, শস্যাধার ইত্যাদি তৈরি করা হত।

৫ থেকে ৭) এই সময়কালে মেহেরগড়ের বস্তুগত সংস্কৃতি আরো পরিণতি লাভ করে। মাটির পাত্র নির্মাণে নানা ধরণের বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন রঙের ব্যবহার দেখা যায়। পোড়া মাটির নারীমূর্তি ও সিলমোহর তৈরি হতে থাকে যা হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত নারীমূর্তি ও সিলমোহরের পূর্ব-নিদর্শন। পাথরের তৈরি ধারালো ও ছুঁচলো অস্ত্র-শস্ত্র-যন্ত্রপাতি, ধাতুর কাজ বিশেষত তামা আর ব্রোঞ্জের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। গোযানের জন্যে ব্যবহৃত কাঠের চাকায় তামার বেড় পরানোয় চাষবাস ও যান-বাহন ব্যবস্থায় উন্নতি হয়। শস্যক্ষেত্রে জলসেচের জন্য খাল কাটার প্রমাণ পাওয়া যায়। মেহেরগড়-এর নগরায়নের সূচনা অনেক আগেই হয়েছিল। এই পর্বে তার বিকাশ নজরে পড়ে। মানুষের জীবনযাত্রার ছাপ, রুচির বিকাশ, রাস্তাঘাটের উন্নতিতে তার ছাপ স্পষ্ট হয়। এই সময় সব থেকে প্রাচীন দাঁতের চিকিৎসার নিদর্শন পাওয়া যায়। সমাধিক্ষেত্র থেকে এমন অনেকগুলি দাঁত পাওয়া গেছে যেগুলিতে নিরাময়ের জন্য ধারালো সরঞ্জাম দিয়ে ফুটো করা হয়েছে। এবং তা করা হয়েছে মানুষের জীবিত অবস্থায় কারণ সেখানে খাবার পিষ্ট হবার চিহ্ন পাওয়া গেছে।

মেহরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য

মেহেরগড়ের খননকার্যের ফলে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে চাষবাসের কিছু প্রমাণ মিলেছে এবং বহু দূরদেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্কের প্রমাণও পাওয়া যায়। এখানকার মানুষ যে ঘরবাড়ি তৈরি করে গ্রাম স্থাপন করেছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য তার প্রমাণ দেয়।

মেহরগড়ের ঘরবাড়ি

প্রাচীন পর্যায়ে রোদে শুকোনো ইটের বাড়ি তৈরি করা হত। এ সময় মানুষ চাষবাস, পশুপালন আর শিকার করত। মৃতদেহ সমাধিস্থ করার প্রথা ছিল, আশ্চর্যজনকভাবে মৃতদেহ হাঁটু মুড়ে বসিয়ে সমাধিস্থ করা হত। তাই কংকালগুলি পাওয়া গেছে কোঁকড়ানো অবস্থায়। পরের দিকে মনে হয় জমি-কর্ষণের উপায় উদ্ভাবন হওয়ায় কৃষিকার্য ও পশুপালনের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। এই সময় তারা মাটির ও পোড়ামাটির ব্যবহার শুরু করে, বাড়িগুলোও আকারে বড় হতে থাকে। এইসব বাড়ি থেকে পাথরের শিলনোড়া, উনুন, হাড়ের তৈরি অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি পাওয়া গেছে। সমাধিগুলোর মধ্যে ঝিনুকের লকেট, পুঁতি ও ঝিনুকের মালা, পাথরের লকেট, হাড়ের আংটি, পালিশ করা পাথরের কুড়ুল ইত্যাদি পাওয়া গেছে। মেহরগড়ের মানুষ যব, গম, কুল, খেজুর, ইত্যাদির চাষ করত। হরিণ, হাতি, নীলগাই, বুনো ভেড়া, ছাগল, শুয়োর, গরু ইত্যাদির হাড় পাওয়া গেছে। গরু, ভেড়া, ছাগল, শুয়োর আর হয়তো কুকুর পোষা হত। সেসময় ব্যবসা বাণিজ্যেরও মোটামুটি বিকাশ হয়। সামুদ্রিক ঝিনুকের প্রাচুর্য দেখে মনে হয় যে সিন্ধু বা ইরানের সমুদ্রকূলবর্তী স্থানের সঙ্গে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। মেহেরগড়ে যে সব দামি পাথর পাওয়া গেছে তাতে ধরে নেওয়া যায় তাদের ব্যবসায়িক যোগসূত্র আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, সুমের, মেসোপটেমিয়া বা ককেশাস পর্যন্ত ছিল, যদিও সেসময় মধ্যপ্রাচ্যে উন্নততর সভ্যতা একমাত্র অসুর আর সুমেরদের মধ্যেই ছিল। মেহেরগড়ের পরের পর্যায়ে পাথরের সঙ্গে সঙ্গে তামার ব্যবহারও শুরু হয়, সেজন্য এই ক্রমকে চ্যাল্কোলিথিক পর্যায় বলা হয়।

মেহরগড় সভ্যতার গুরুত্ব

মেহরগড় সভ্যতা সম্বন্ধে জানতে পেরে পুরাতাত্বিকদের বেশ কয়েকটি ধারণা পুষ্ট হয় ও বেশ কিছু ভুলও ভাঙে। প্রথমতঃ এটা পরিষ্কার হয় যে হরপ্পারও আগে ভারতীয় উপমহাদেশের বালুচিস্তানে এক উন্নত গ্রামভিত্তিক মানবসভ্যতার বিকাশ হয়েছিল যারা খ্রীষ্টের জন্মেরও অন্তত চার হাজার বছর আগে পাথরের সঙ্গে সঙ্গে তামা, সিসা প্রভৃতির ব্যবহার কিছুটা হলেও জানত। এখানে গম আর যব চাষের যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় যে এই দুটি শষ্য পশ্চিম এশিয়া থেকে আমদানি করা হয়নি। তখনকার মানুষ বোলান গিরিপথের ব্যবহার করে বহির্বাণিজ্যে সক্ষম হয়েছিল। এখানে কাঁচামাটির পুরুষমূর্তি আর পোড়ামাটি দিয়ে গড়া নারীমূর্তি পাওয়া গেছে। তাতে বোঝা যায় যে মাটির ব্যবহার মেহরগড়ের বাসিন্দারা ভালই জানত, তবে এই সব মূর্তির সঙ্গে ধর্মের কতটুকু সম্পর্ক ছিল তা বলা যায় না।

এই সভ্যতা আবিষ্কারের আগে অবধি মনে করা হত, সিন্ধু সভ্যতা ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা, কিন্তু মেহেরগড় এর আবিষ্কার প্রমান করেছে যে, সিন্ধু-পূর্ব যুগে ভারতে এক উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। অনেকদিন অবধি মনে করা হত যে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছিল মেসোপটেমিয়ার উপনিবেশের বিস্তার, তারই অংশবিশেষ। এখন এই আবিষ্কারের পরে দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টারা বহিরাগত নন – তাঁরা এই ভারতীয় উপমহাদেশেরই মানুষ। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর উন্নত নগর সভ্যতা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয় – মেহেরগড় ও সন্নিহিত অঞ্চলে মানবসভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছিল, হরপ্পা সভ্যতা তারই এক পরিপূর্ণ রূপ।

মেহরগড়ের শিল্প
টেরাকোটা শিল্প

২০০১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রাচীন মেহেরগড় সভ্যতার দু’জন লোকের দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণাকালে আবিষ্কার করেন, এই সভ্যতার লোকেরা আদি দন্তচিকিৎসা সম্পর্কে জানতো। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে বৈজ্ঞানিক জার্নাল “নেচারে” ঘোষণা করা হয়, জীবিত মানুষের দাঁত বাঁধানোর প্রাচীনতম (এবং প্রথম প্রারম্ভিক নবপ্রস্তরযুগীয়) প্রমাণ মেহেরগড়ে পাওয়া গেছে। লেখকদের মতে, তাঁদের আবিষ্কার ওই অঞ্চলের প্রারম্ভিক কৃষিভিত্তিক সভ্যতার আদি দন্তচিকিৎসার ঐতিহ্যের নিদর্শক। এখানে পাকিস্তানের নবপ্রস্তরযুগীয় গোরস্থানে আবিষ্কৃত নয়জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির এগারোটি বাঁধানো দন্তমুকুট (Dental crown) বর্ণনা করা হয় যা ৫,৫০০ থেকে ৯,০০০ বছর আগের। এগুলো প্রারম্ভিক কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় এক প্রকার আদি দন্তচিকিৎসার দীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রমাণ।

জীবিত মানুষের দাঁত ড্রিল করে বাঁধানোর মেহেরগড়ে পাওয়া প্রাচীনতম (এবং প্রথম নব্যাশ্মযুগীয়) নিদর্শন।

দাঁতে ড্রিল করে বাঁধানোর নিদর্শন

মেহরগড়ের পতন

খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে সম্ভবত ভূমিকম্পের ফলে, বোলান ও জোব নদীর খাত ঘুরে যায় বা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে জলের পরিমাণ কমে যায়; ফলে মেহেরগড় অঞ্চলের চাষবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে মৌসুমী হাওয়ার দিকপরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের অনিয়ম, শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি, হরপ্পা, কোটদিজি, ও মহেঞ্জাদারোর নতুন অঞ্চলে উপযুক্ত জলের সুবিধা, উর্বর ভূমি এসব পাওয়ায় তারা ধীরে ধীরে বাসস্থান-পরিবর্তন করে। এভাবেই মেহেরগড় সভ্যতার পতন হয় এবং সম্ভবত এখানকার অধিবাসীরা অন্যত্র চলে যায়।

তবু ‘ডন’ পত্রিকার তদন্তে প্রকাশ পায় যে শিবি ও ধাদাড় অঞ্চলের যাযাবর সম্প্রদায় আজও ওই একই পদ্ধতিতে কৃষিকাজ ও পশুপালন, চর্ম আর মৃতশিল্পর কাজ করে চলেছে। ব্যবহারিক জীবনে তারা এখনও অতীত-বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্রের সেতুটি অক্ষত রেখেছে।

বর্তমান অবস্থা

‘ডন’ পত্রিকার সাংবাদিক, মোঃ আকবর নোটজাই, ২০১৭র গোড়ায় পাকিস্তানের বালুচিস্তানের কুয়েটা শহর থেকে বোলান গিরিবর্ত্ম গাড়িতে অতিক্রম করে ১৩৮ কিমি দূরের শহর ধাদাড়ে পৌঁছোন। সেখান থেকে সামান্য দূরত্বে শিবি-র কাছে মেহেরগড়ের সাইট। ১৯৭৪এ আবিষ্কৃত উপমহাদেশের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন আজ সরকারি ঔদাসীন্যে চরমতম অবহেলার শিকার। মেহেরগড়- বালুচি ভাষার যার অর্থ ‘প্রেমের স্বর্গ’, আজ কে বলবে? জ্যাঁ-ফ্রাঁকো জারিজ ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন সেখানে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত খননকার্য চালান, তারপর ১৯৯৭এ ফিরে এসে ২০০০ সালে খনন শেষ করে দেশে ফেরেন। তার পর থেকে পাক-সরকারের উদাসীনতায়, যাযাবর শ্রেণীর উৎপাতে আর বৃষ্টিপাতের আধিক্যে সবকিছু নষ্ট হতে থাকে। ইতিমধ্যে প্রচুর প্রত্ন-বস্তু যাযাবর ও স্থানীয় বাসিন্দারা কুড়িয়ে পায় বা অনধিকৃতভাবে হস্তগত করে। ২০১৪তে তাদের বেশ কিছু নিদর্শন ইতালির বিভিন্ন মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুতঃ এগুলির অভাবে বহু তথ্য, যেমন মেহেরগড়ে ঘোড়া ছিল কিনা, তারা তামাকের ব্যবহার বা পিতলের কথা জানত কিনা, এসব কিছুই প্রমাণ করা আজ আর সম্ভব নয়। তাই হয়ত চিরকাল এক অন্ধকার রহস্যের কুয়াসার মধ্যেই রয়ে যাবে পৃথিবীর মানবজাতির অন্যতম প্রাচীনতম লুপ্ত সভ্যতার গুপ্তধনের চাবিকাঠি।

———–

তথ্য সূত্র

   চক্রবর্তী, দিলীপ কুমার। (২০১৫, ৬ষ্ঠ পুনর্মুদ্রন)। ভারতের প্ৰাগিতিহাস কলকাতাঃ আনন্দ পাবলিশার্স।

     Coppa, A., Bondioli, L., Cucina, A., et al. (2006, April 5). Early Neolithic tradition of dentistry. Nature. Available: https://www.nature.com/articles/440755a.

     Hirst, K. K. (2019, May 30). Mehrgarh, Pakistan and life in the Indus Valley before Harappa. ThoughtCo. Available: https://www.thoughtco.com/mehrgarh-pakistan-life-indus-valley-171796.

     ‘Indus Valley Civilization.’ (ND). History of India. Available: http://indiansaga.com/history/indusvalley.html.

     Jarrige, C., et al. (Ed.). (1995). Mehrgarh field reports 1974-1985 from Neolithic times to the Indus civilization, xiii, 1-562, 683-688.

     ‘Mehrgarh.’ (2021, September 17). Wikipedia. Available: https://en.wikipedia.org/wiki/Mehrgarh.

     ‘Mehrgarh and the dawn of civilisation (8000-2500BCE). (2020, February 7). Video (Restricted to members). Available: https://www.livehistoryindia.com/story/lhi-circle/mehrgarh-the-dawn-of-a-civilisation-8000-bce-2500-bce/#:~:text=Mehrgarh%20and%20the%20Dawn%20of%20Civilisation%20(8000%20BCE%20%E2%80%93%202500%20BCE)&text=Mehrgarh%20on%20the%20foot%20of,subcontinent’s%20most%20exciting%20archaeological%20finds.&text=The%20site%20of%20Mehrgarh%2C%20in,not%20a%20really%20impressive%20mound.

     Notezai, M. A. (2017, March 10). ‘The lost civilization of Mehrgarh: A treasure in ruins.’ Dawn. Available: https://www.dawn.com/news/1316715.

     Shakil, H. (2020, November 12). ‘Mehrgarh artifacts (6000-7000BC).’ Quora. Available: https://ivccontinuum.quora.com/Mehrgarh-artifacts-6000-7000-BC?ch=1&oid=8024256&share=b4a1ab43&target_type=post.

     “Stone age people in Pakistan were using dental drills made of flint 9,000 years ago, according to researchers.” (2006, April 6). BBC News.  See, http://news.bbc.co.uk/2/hi/science/nature/4882968.stm

ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত 

শিক্ষা- ইঞ্জিনিয়ারিং, কর্মসূত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের পেট্রোলিয়াম তৈলখনি অঞ্চলে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখি শুরু হয় ২০১১তে কম্প্যুটারে বাংলা ফন্টের আমদানির সূত্র ধরে, ‘অবসর’ সমেত বিভিন্ন নেট-পত্রিকা ও বম্বে ডাক, পশ্চিমঘাট ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায় গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গত ২০২২ থেকে তিনটি ছোটগল্পের ও একটি প্রবন্ধের সঙ্কলন প্রকাশিত হয় এযাবৎ। দুটি নেট পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *