সুজনের কথা
নতুন অবসর-এর সম্পাদক ভাস্কর-এর কাছ থেকে হুকুম এসেছে তথ্যের পুরোনো ওয়েবসাইট অবসর.নেট (abasar.net) -এর গোড়ার কথা লিখতে – কবে শুরু হল, কেন হল, পনেরো ষোলো বছর চালাতে কী অভিজ্ঞতা আমাদের হল, এই সব নিয়ে। সত্যি কথা বলতে কী, খুব চিন্তা ভাবনা করে অবসর শুরু হয়নি। সেসব করা সম্ভব যখন বাংলা ওয়েবসাইট তৈরি করার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো (এক্ষেত্রে টেকনোলজি) পাকাপোক্ত অবস্থায় থাকে। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় অবসর-এর জন্মলগ্নে সেই টেকনোলজিই ঠিকমত প্রতিষ্ঠিত হয়নি – নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা তখনও চলছে। যেমন, কম্পিউটারে বাংলা লেখা আর ছাপার ব্যাপারটা। তাই অবসর ওয়েব সাইট সম্পর্কে লিখতে হলে আরও বছর কুড়ি আগে আশি দশকে চলে যেতে চলে যেতে হবে। কম্পিউটারে কী করে বাংলা অক্ষর ছাপা যায়, সেই ইতিহাসটা সুমিতদাই বলুক।
সুমিতের কথা
সত্তরের দশকে সুজন আর সুমিত, আমরা দুই বঙ্গসন্তান আমেরিকায় বেল ল্যাবোরেটরিজ (Bell Labs) কোম্পানিতে চাকরী করতে ঢুকলাম। সেটা একটা আহামরি কিছু ব্যাপার নয়, আমাদেরও কিছু চক্রান্ত ছিল না, আমাদের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল কিনা তাও মনে করতে পারছি না এখন। খবর যেটা, সেটা হল টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা আর তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তখন বেল ল্যাবরেটরিজের খুব রমরমা। কম্প্যুটারের ক্ষেত্রে আইবিএম (IBM) তখনো সম্রাট, কিন্তু টেলিফোন বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে বেল ল্যাবরেটরিজের মালিক কোম্পানি, এটিঅ্যান্ডটিই (AT&T) আছে সবার আগে। তার ফলে তখনকার বেল ল্যাবরেটরিজ অবশ্যই সংযোগ প্রযুক্তির কাজে বিশেষ ব্যস্ত কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে কম্প্যুটার, আর আরো বড়ো কথা যে তার ব্যবহারের জন্য উপযোগী সফ্টওয়্যার নিয়েও কাজের খুব ধুমধাম। আমাদের মতো পুরনো কালের লোক যাঁরা ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম (Unix Operating System) আর সি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ (C Programming Language) জানেন, তাঁদের স্মরণে আসতে পারে। সেই পরিবেশে আমরা দুজনেই সায়েব খেদাবার ফাঁকে আমাদের নিজের নিজের খেলাঘরে সেসব মন্ত্র প্রয়োগের অন্ধিসন্ধি শিখে নিলাম।
এভাবে রত্নভাণ্ডার ভর্তি করার পর মণিকাঞ্চন যোগটা ঘটলো বছর দশেক পরে, আশির দশকের প্রথমার্ধে, যখন আমরা দুই বঙ্গসন্তানই নিউ জার্সির বেল ল্যাবরেটরিজে বদলী হয়ে এলাম। সত্তরের দশক থেকে মার্কিন সরকার অভিবাসনের রাস্তা খুলে দেবার কারণে এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে যেসব বাঙালী সপরিবারে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন, তাঁরা ততোদিনে চাকরী খোঁজা, বাড়ি খোঁজা, ছেলেমেয়েদের ইস্কুল খোঁজা, এসবের পাট চুকিয়ে বেশ শেকড় গেড়ে বসেছেন। চমৎকারা অন্নচিন্তার স্থান নিয়েছে সাংস্কৃতিক অন্যচিন্তা, সরস্বতী পুজোর পদোন্নতি হয়ে দুর্গাপুজোয় বিকশিত, ইংরেজি পড়ে আর শুনে প্রাণ ও কান দুইই ঝালাপালা, তাই ইস্কুল খুলছে গানের, পুজোয় সাংস্কৃতিক আর নাট্যানুষ্ঠান, পুজোর ব্রোশিওরে (Brochure) জ্বলন্ত রচনা, তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাময়িকপত্র প্রকাশের চেষ্টা।
এর সব কিছুতেই বাংলা ছাপা পেলে ভালো হয়, কিছু তো আবার না পেলে অচল। সমাধানের তিনটি উপায়, প্রথমটি “মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যাৎ”, ছাপার বদলে হাতে লেখা, তাতে বেশ একটা অন্তরঙ্গতার ভাব আসে। সামাজিক ক্রিয়াকর্মে তা চলতে পারে তবে দু’এক পাতার পরেই চোখ জ্বালা করে, পাড়ায় পাড়ায় লিপিকারও বহাল নেই আর হাতে লেখা পত্রিকা লোকে কেনা দূরে থাক, ফ্রিতে দিলেও পড়বে না। দ্বিতীয়টা হলো দেশ থেকে ছাপিয়ে আনা, তাতে খরচের ব্যাপারটা সামলাতে পারলেও সময়ের ব্যাপারটা একেবারে বলগা-ছাড়া। সেই প্রাক-ইন্টারনেটের যুগে কলকাতা থেকে কিছু অর্ডার মাফিক এসে পৌঁছানো, সময়মাফিক এসে পৌঁছনো, এবং আদৌ এসে পৌঁছনো – এর কোনোটারই বিশেষ স্থিরতা থাকত না।
আর বাকি রইলো তৃতীয় পন্থা, দুর্গা বলে ঝাঁপ দেওয়া, অর্থাৎ এদেশেই ছাপার কিছু ব্যবস্থা করা। এইখানে সুজন আর সুমিতের বেল ল্যাবরেটরিজে ঘানি টানার অভিজ্ঞতাটা কাজে লেগে গেলো। সায়েব তাড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আমরা বুঝে গেছি যে কম্প্যুটারের কানে ঠিকমতো মন্ত্র দিলে সে-ই ছাপাছাপির কাজ উদ্ধার করে দিতে পারবে। সাল ১৯৮৪, আমরা দুজনেই নিউ জার্সিতে নবাগত, পাড়ার বাঙালীদের ক্লাব আর রাজনীতির চক্রে কল্কে পাইনে, সপ্তাহান্তে হাতে অনেক সময়। অবশ্য তখন হাতে হাতে স্মার্টফোন নেই, ঘরে ঘরে নেই কম্প্যুটার, কিন্তু অফিসে অফিসে ডেস্কটপ আস্তে আস্তে দেখা দিচ্ছে। আমাদের অফিসে তো বটেই। অর্থাৎ বেড়াল, ঘণ্টা, আর বাঁধবার লোক, সবই পাওয়া গেলো, এখন জয় মা বলে লাফ দিলেই হয়।
এবার এই বাংলা ছাপার কাঠামোটাকে যদি পায়ের দিক থেকে দেখতে শুরু করি তাহলে প্রথমেই আসবে কালি ধ্যাবড়ানোর আসল কল, অর্থাৎ প্রিন্টার। যে ভাষায় যে ছাঁদের অক্ষর লেখা হবে, তার প্রতিটি অক্ষরের ছবিতে একটা নম্বর সেঁটে (টাইপরাইটারের চাবির মতো; নম্বরকে বলা হয় কোড, Code) সেই প্রিন্টারে রাখা আছে। বড়ো কম্প্যুটার থেকে সেই অক্ষর ছাপতে চাইলে সেই কোডটি প্রিন্টারে পাঠালেই চলবে, প্রিন্টার তার পুঁজি খুঁজে সেই অক্ষরটি ছেপে দেবে। একটা ভাষায় একটা ছাঁদে লিখতে যতো এমন অক্ষর লাগে তাদের সব ছবি (আর বিরাম চিহ্ন এবং আরো কিছু যান্ত্রিক নির্দেশক) মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তাকে বলে একটা ফন্ট (font)। আমরা যখন কাজ শুরু করলাম তখন এক একটা ফন্টে ১২৮-টি অক্ষর থাকতে পারতো। ইংরেজি বর্ণমালা নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই, বড় আর ছোটো হাতের মিলিয়ে বাহান্নটি অক্ষর, দশটি সংখ্যা — এই সব ভর্তি করার পরেও বিরাম চিহ্ন আর খুচখাচ অন্য অক্ষর ভরার অনেক জায়গা থাকে। বাংলা বর্ণমালায় পঞ্চাশটি বর্ণ, কাজেই ঠিকঠাক অক্ষরের ছবি বানাতে পারলেই তো চুকে গেল। কিন্তু এবার এক সেকেন্ড চিন্তা করলেই বোঝা যায় ব্যাপারটা বেশ জটিল। বাংলায় বড়ো হাতের ঝামেলা নেই বটে কিন্তু আছে -কার (আ-কার, ই-কার, ইত্যাদি), আছে -ফলা (র-ফলা, য-ফলা, রেফ, ইত্যাদি), এবং যুক্তাক্ষর। বাংলায় আবার দেবনাগরীর মতো উদোর অক্ষর বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে যুক্তাক্ষর করা যায় না, প্রায় প্রতিটি বাংলা যুক্তাক্ষরের একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আছে বলা যায়। খানদানী বাংলা অক্ষরে তো য-ফলা আর উ-কারেরও অক্ষরবিশেষে চেহারা পালটায় — শ-য়ে হ্রস্বউ বা হ-য়ে য-ফলার কথা ভাবুন।
তখন নিরুপায় হয়ে বাংলা লিখতে একটার বদলে দুটো ফন্ট ব্যবহারে সম্মত হতে হল। যিনি ব্যবহার করছেন, তাঁর কিছু কষ্ট করতে হত না, কম্প্যুটারই সব সাজিয়ে নিত, কেবল ছাপতে সময় লাগত বেশী। সুজনের আঁকাজোকায় হাত খোলে, ও ভেবে চিন্তে সব অক্ষরের ছবি বানাল আর সুমিত সেসব দুটো ফন্টে ভাগ করে প্রিন্টারে পাচার করল, কল টিপলে তখন বাংলা ছাপা বার হয়। দুটো ফন্টের যন্ত্রণা বেশী দিন সইতে হয়নি কেননা সায়েবদের কোনো কোনো ফন্টেও একশো আঠাশের বেশী অক্ষর লাগছিল, সায়েবরা তাড়াতাড়ি ফন্টের মাপ বাড়িয়ে দুশো ছাপ্পান্ন করে দিলেন। অনেক পেন্সিল চিবিয়ে আমরা বাংলা ভাষাকে একশো বিরানব্বইটা মুক্ত আর যুক্ত অক্ষরে বেঁধে ফেললাম, ব্যস, ছাপার দিকে কাম ফতে। আহ্লাদ করে নাম দেওয়া হলো “হরফ।” তারপর সেই হরফ ত্রিশ বছরের কিছু বেশী সময় সসম্মানে সুধীজনের তাঁবেদারি করে এল। এদিক ওদিক ছুটছাট চিঠিপত্র লেখা ছাড়াও কিছু পত্রিকা, অসংখ্য পুজোর ব্রোশিওর, অনুষ্ঠানের বিবরণী আর স্মারক সংখ্যা, এমনকি গোটা দু’তিন বইও মার্কিন মুলুক আর কলকাতায় হরফের মাধ্যমে প্রকাশিত হল।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বই
আর অবসর তো আছেই, সেই একেবারে জন্মের থেকে। তারপর একদিন কালের নিয়ম মেনে হরফকে পিঁজরাপোলে পাঠাতে হলো, তা সে বছর পাঁচছয় তো হবেই। কেন, সে কথা পরে বলা হবে। হরফ কোনো সন্তানসন্ততি রেখে যায়নি, কাজেই ওখানেই ইতি।
কাঠামোর মাথার দিকের প্রশ্ন হচ্ছে, ছাপার জন্য যে বাংলা বয়ানটি, সেটিকে কী করে কম্প্যুটারের শামিল করা যাবে? ইংরেজি কিবোর্ডের (Key-Borad) চাবিতে বাংলা অক্ষর লাগিয়ে — যথা k-তে ‘ক’ – টাইপ করার কথা প্রথম মনে আসবে। মুস্কিল হচ্ছে বাহান্নটা অক্ষরের কোনটাকে কোন চাবিতে লাগানো হয়েছে, সেটা মনে রাখা। মনিটরে বাংলা কিবোর্ডের ছবি দেখিয়ে সে সমস্যার কিছু সমাধান হয়, কিন্তু ইংরেজি কিবোর্ডে ইংরেজি অক্ষর যেমন ঝড়ের বেগে টাইপ করা যায় তেমনটি করা যায় না (অন্তত বেশ কড়া মাপের ট্রেনিং না নিলে — যাতে কারুরই তেমন উৎসাহ দেখা গেলো না)। আর ওই অক্ষর খুঁটে খুঁটে টাইপ করে “পত্রপাঠ টাকা পাঠাইবে” লিখতেই রাত কাবার, মহাকাব্য লেখার তো কথাই ওঠে না। তখন আমাদের মাথায় এল যে ইংরেজের দাসত্ব করার একটা সুফল হয়েছে যে আমরা সবাই আমাদের নাম লিখতে শিখেছি ইংরেজিতে, আমরা সেই প্রথাটাই চালু করি না কেন – একটু ঘষামাজা করে। “স-উ-ই-ম-ত” লিখতে চাইলে s-u-m-i-t, আর “স-উ-জ-ন”-এর বেলায় s-u-j-(a)-n – এ তো জলবৎ তরলম্। কিন্তু শ্রেয়াংসি তো বহুবিঘ্নানি, আমরা ভেবেছিলাম লেখক যখন বাংলা শব্দটা ইংরেজিফাই করবেন তখন তা করবেন বানানমাফিক, কিন্তু কাজের সময় দেখা গেলো তাঁরা উচ্চারণমাফিক ব্যবহার বেশি পছন্দ করছেন। তার ব্যবহারিক সুবিধে অনেক আর তাতে ভুল বানানের দায়টা চট করে কম্প্যুটারের ঘাড়ে চাপানো যায়। এদিকে ঝামেলা হলো ইংরেজরা আবার বানান আর উচ্চারণে একটু আলাভোলা, যেমন একই “a” ব্যবহার করে fall – অ-কার, father, – আ-কার, fate -এ-কার, এমনকি fat – য-ফলা+ আ-কার – সব লেখা যায়, কেবল প্রয়োগটা আপনাকে সঠিক জানতে হবে। তার ফল হচ্ছে “মুরদ থাকলে”-কে মুরাদ টাক্লা, murad Takla [mura (a as in fall) d T (t=ত, তাহলে T হবে থ) a (a as in father) kla (a as in fate)] লেখা। আমাদের এক পরিচিত আমাদের ধমকেছিল এই বলে যে আমার মাকে তো এমন করেই চিঠি লিখেছিলাম, তিনি তো ঠিক বুঝে গেলেন। অবশ্যই সেই রত্নগর্ভার সঙ্গে মূর্খ কম্প্যুটারের কোনো তুলনাই হয় না, এ বলেও মাপ পাওয়া গেলো না। যাই হোক, আমরা ভেবেচিন্তে এই বাংলা-ইংরেজির একটা তালিকা বানিয়ে ফেললাম, তার নাম দিলাম হরফ-রোমান। যাঁরা একটু কষ্ট করে হরফ-রোমানের নিয়ম কানুন শিখে ফেললেন তাঁদের কষ্ট মোটামুটি সার্থক হলো। এইতো, আমাদের দিদিমণি ঝড়ের বেগে হরফ-রোমান টাইপ করতেন, বোঝাই যেত না যে ইংরেজি লিখছেন না।
এবার হরফ-রোমানের লেখা আর হরফে ছাপার মধ্যে কিছু কম্প্যুটার প্রোগ্রাম ঢোকানো গেলো। তাদের নাম দেওয়া হলো “পার্সার” (parser), তাদের কাজ হলো টাইপ করা ইংরেজি অক্ষরের বাংলা নম্বর (আবার সেই কোড) বসানো আর বাংলা ভাষার নানান উদ্ভট রীতির – যথা, হ্রস্ব-ইকার অক্ষরের আগে বসবে, কোথায় যুক্তাক্ষর হবে আর কোথায় হবে না, য-য়ে রেফ ও থাকবে, র-য়ে য-ফলাও থাকবে, – সৎকার করা। হরফ-রোমান, পার্সার আর হরফ টাইপ – সব কিছু একটা প্রোগ্রামের প্যাকেটে মুড়ে, লাল ফিতে বেঁধে আমাদের মেশিনে বাংলা লেখা চালু হলো। সাল ১৯৮৪। এই “রোমানাইজ” করার কৌশলটা আমরাই প্রথম চালু করলাম। এই টেকনিক সাধারণে গৃহীত হতে আরো বিশ বছর লাগলো, অপেক্ষা করতে হলো বাংলা ইউনিকোডের জন্ম আর বাংলাদেশ থেকে “অভ্র” (AVRO) – আদি পার্সারের ব্যাপক সুলভতার জন্য। আমরা এর মধ্যে হরফ প্যাকেজ বিতরণের চেষ্টা করেছিলাম, তখন পশ্চিম বঙ্গে কম্প্যুটার সবে ছড়াচ্ছে, ফন্টের চাহিদা তেমন জমে ওঠেনি, আর আমাদের কোম্পানি এসব ব্যাপারে সম্মতি দিতে চায়নি।
সুজনের কথা
যদিও সুমিতদা লিখেছে ‘রোমানাইজ করার কৌশল আমরাই চালু করলাম’, ওটা গৌরবে বহুবচন। কাজটা সুমিতদার, আমি ছিলাম শুধু সাউন্ডিং বোর্ড।
এবার আসছি অবসর-এর প্রসঙ্গে। একটা কথা বলতে পারি – অবসর-এর পেছনে মহাভারত-এর একটা অবদান ছিল। মহাভারত? একটু বিশদ করেই বলি। হরফ ফন্ট দিয়ে কম্পিউটারে চিঠি লিখে ম্যাগাজিন, বই ছাপিয়ে কেটে গেল বছর বারো তেরো। এর মধ্যে কেন জানি না, মহাভারত পড়ার একটা প্রবল ইচ্ছে জাগল। সাক্ষর প্রকাশনার পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত অবহেলিত হয়ে বেসমন্টে পড়েছিল বহুদিন। সেটাকে ঝেড়েঝুড়ে তুলে এনে বসলাম। পুরনো দিনের সাধু ভাষায় লেখা – সুপাঠ্য কোনো মতেই বলা চলে না। তার ওপর এতগুলো চরিত্র – কিছুক্ষণের মধ্যেই কে যে কে, গুলিয়ে যেতে লাগল! সুধীর চন্দ্র সরকারের একটা পৌরাণিক অভিধান ছিল শুনেছিলাম, হাতের কাছে থাকলে হয়তো কিছুটা সুবিধা হত। তখনই জিনিসটা মাথায় এল। বসে বসে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে (MS-WORD) চরিত্রগুলোর একটা লিস্ট বানাতে শুরু করলাম। তারপর তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে বইয়ে যেখানে যা পেলাম আলাদা আলাদা পাতায় সেগুলো তুলতে লাগলাম। এবার লিস্টের নামগুলোর সঙ্গে একটা হাইপারলিংক দিয়ে সেই নামের পাতার তথ্যগুলো জুড়ে দিয়ে বেশ ফুর্তি হল। যাকে পাই, তাকেই দেখাই। কিন্তু ক-জনকে এভাবে দেখানো যায়? মহাভারতের এই চরিতাবলীকে কি ওয়েবে তোলা যায় না? তাহলে তো ইন্টারনেটে ঢুকে সবাই এটা দেখতে পাবে! অবসর.নেট-এর সূত্রপাত এই খেপামি থেকেই। সুমিতদাকে ধরলাম, কিছু একটা করা যাক।
সুমিতের কথা
আগেই বলেছি যে বেল ল্যাবরেটরিজে কাজ করার জন্য কম্প্যুটার, সফ্টওয়ার, নেটওয়ার্ক — এসব একেবারে হাতে গরম পাওয়া যেত। কাজেই নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেট চালু হবার সময় থেকেই হরফের কল্যাণে আমরা অনলাইন বাংলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছি। তারপর ২০০০ সালে যখন অবসর সাইট খোলার কথা উঠল তখন হরফ হুজুরে হাজির। অবসর চালাতে গিয়ে হরফ নিয়ে তিনটে সমস্যার সমাধান করতে হয়। হরফের প্রধান প্রকাশ এখন আর প্রিন্টারে নয়, মনিটরে, সারা অফিসের একটা প্রিন্টারে নয়, প্রতিটি কম্প্যুটারের সংলগ্ন মনিটরে। তার প্রথম সমস্যা হলো এই যে হরফ ফন্টের সব অক্ষরের ছবি আর চাবি (সব মিলিয়ে এদের ফন্টই বলা হয়), এটিকে কী করে কাঁহা কাঁহা মুলুকে কোন কম্প্যুটারে কে অবসর পড়ছেন, তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। সেই অন্ধকার যুগে “ফন্ট ডাউনলোড (download) করুন, ইন্স্টল (install) করুন,” এসব দেখলে ব্যবহারকারীর শরীর খারাপ লাগতে পারত বা তিনি ধুত্তোর বলে অন্য পাতায় চলে যেতে পারতেন। তারপর যত দিন যেতে লাগল, বাজারে তত নতুন নতুন ব্রাউজার আর মনিটর আসতে শুরু করল। হরফের কাজ হল ব্রাউজার-মনিটর (browser-monitor) নির্বিশেষে সব সময় ফার্স্ট ক্লাস না হোক একটা দৃষ্টিনন্দন ছবি পেশ করা। এছাড়া ইন্টারনেটের ব্যবহার তখন খাণ্ডবদাহনের মতো বাড়ছে, মালিকরা নাম আর জান বাঁচানোর জন্য ঝড়ের বেগে নানান সংস্কার করে যাচ্ছেন, আমাদেরও তার সঙ্গে তাল রেখে যেতে হয়েছে। সেটা একদিক থেকে ভালোই, কেননা অবসর তো আমাদের অবসরের ফসল, এতদিন ধরে আপিসের দোহাই দিয়ে বাড়ির যত সব কাজে ফাঁকি দিয়েছি, সুযোগ পেয়ে গিন্নিরা শুরু করেছেন সেসব কাজ ধরাতে। এই হরফ আর অবসরের দৌলতে জাভাস্ক্রিপ্ট (Java script), সিএসএস (CSS), ইওটি (EOT) ইত্যাদি সব গালভারী শব্দ দিয়ে সেই আক্রমণ ঠেকানো গিয়েছে।
সুজনের কথা
ইওটি (EOT বা embedded open type font format) কথাটা কী একটু বুঝিয়ে বলি। বাংলা ফন্ট দিয়ে ওয়েবসাইট সৃষ্টি করার প্রযুক্তিগত যে সমস্যার কথা সুমিতদা সংক্ষেপে বলেছে, সেটা ওয়েবসাইট বানানো নিয়ে নয়, ওয়েবসাইটটিকেও ঠিক মতো দেখতে পাবার সমস্যা। দেখতে হলে কম্পিউটারে ঠিক সেই বাংলা ফন্টটা থাকা চাই। ফন্ট ডাউনলোড করতে যে জ্ঞান থাকা দরকার সে সময়ে অনেকেরই তা ছিল না। যাঁদের ছিল, তাঁরাও আজেবাজে ফন্ট দিয়ে কম্পিউটার ভরাতে চাইতেন না – কী থেকে কী হয়ে যায় … ভাইরাস ঢোকার ভয়ও থাকে। এটা পাশ কাটানোর অবশ্য একটা পথ ছিল, সেটা হল মাইক্রোসফট-এর font embedding technology-র ব্যবহার। নব্বই দশকের একেবারে শেষাশেষি এটা চালু হয়েছিল। এই টেকনোলজি দিয়ে ফন্ট embed করে ওয়েবসাইট বানালে, সেখানে কেউ ঢুকলে সেই ফন্ট আপনা আপনিই ডাউনলোড হয়ে যেত। তারপর সেই সাইট থেকে সরে গেলে ফন্টও কম্পিউটার থেকে অদৃশ্য হত – অর্থাৎ স্থায়ীভাবে থাকত না। একটাই সমস্যা ব্রাউজারটি মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার (Internet Explorer) হতে হবে (কয়েক বছর পরে অবশ্য অন্যান্য দু-একটি ব্রাউজারেও ইওটি কাজ করতে শুরু করল)। যাক সে কথা, সুমিতদাকে দুয়েকবার তাড়া দিয়ে সাড়া না পেয়ে নিজেই ফন্ট embed করতে গেলাম। একেবারে ফেল নয়, কিন্তু পাশও হল না। যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততোটা নয়। কিন্তু কাজের মধ্যে যেটা হল, ব্যাপারটাতে সুমিতদার উৎসাহ জাগল। প্রথমবার একটু জন্যে ফেল, কিন্তু তারপর বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও এ-কার ই-কার নিয়ে দুয়েকটা গণ্ডগোল থেকেই গেল।
“আচ্ছা, ওগুলো ফন্টের যে খুপরিতে রয়েছে, সেখান থেকে সরিয়ে অন্য কোনও খুপরিতে রেখে দেখলে পারো না?”
কী বললাম নিজেই জানি না। ফন্টের ব্যাপারে অজ্ঞ বলেই এ ধরণের প্রশ্ন কারো মাথায় আসতে পারে। সুমিতদাও এরমধ্যে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। বলল, “বেশ, তুই যখন বলছিস তাই করা যাক।”
কী আশ্চর্য! এবার ফুল মার্কস পেয়ে পাশ! (কেন এটা হয়েছিল, আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। এর বেশ কয়েক বছর পরেও ‘আজকাল’, ‘বর্তমান’ ইত্যাদি পত্রিকাগুলোর ওয়েব সংস্করণ যখন শুরু হয়, তখন তাদেরও এই সমস্যায় কিছুদিন ভুগতে দেখেছি।)
বাঁচা গেল! ওয়েবে উঠল মহাভারতের চরিতাভিধান। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখলাম সার্চ এঞ্জিন সাইটটার খোঁজ পেয়ে গেছে। সপ্তাহ দুয়েক বাদে হিট কাউন্টার লাগিয়ে দেখলাম দুয়েকজন দেখতেও আসছে। উৎসাহিত হয়ে সুমিতদাকে বললাম, “তথ্যের একটা ওয়েবসাইট বানালে কেমন হয়?”
“কিসের তথ্য?”
“এই ধর, কলকাতার তথ্য, ঢাকার তথ্য।”
“সেরকম সাইট তো ইংরেজিতে দুয়েকটা আছে। ওটা আর নতুন কী!”
কথাটা ভুল নয়, কিন্তু বাংলায় তথ্যগুলো থাকার ব্যাপারটা একটু অন্য। যাইহোক, সুমিতদার আগ্রহের অভাব দেখে, নিজেই বাড়ি ফিরে চিন্তাভাবনা শুরু করলাম। তথ্য জোগাড়ও শুরু হল। একটা নামও ঠিক করে ফেললাম অবসর – যার অর্থ সুযোগ, ছুটি, অবকাশ, ফুরসত, কর্ম বা চাকরি থেকে বিদায় – অনেক কিছুই। মনে মনে ভাবছিলাম একটা বড় ওয়েবসাইট গড়ে তুলতে গেলে আমার একার মুরোদে কুলোবে না। সুমিতদাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারব জানতাম, কিন্তু দুজনও তো যথেষ্ট নয়। এখন অবসর-প্রাপ্ত দুয়েকজন লোক যদি সঙ্গে জোটে! আর কমবয়সী দু’চারজন যদি তাদের ফুরসত মত কিছু সাহায্য করে, তাহলে তো কথাই নেই!
নামটা রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে দেখি .কম (.com) টা আগেই কেউ রেজিস্টার করে ফেলেছে। .নেট(.net) নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
এবার ওয়েবসাইটটা ডিজাইন করতে হবে। মহাভারতের দৌলতে ড্রিমউইভার (Dreamdriver) আর ফটোশপ (Photoshop) সফটওয়্যার আগেই জোগাড় করা ছিল। একটা পাতা বানিয়ে ফেললাম। অতি সাদামাটা পাতা। সেটাই কপি করে বেশ কয়েকটা পাতা বানিয়ে তাতে নানান তথ্য ভরলাম। মহাভারতের জন্যে সার্ভার স্পেস ভাড়া করাই ছিল, সেখানেই তুললাম।
সুমিতদা দেখে প্রশ্ন করল, “লোকে দেখবে?”
“কেন দেখবে না!”
“পাতাটা আরও অ্যাট্রাক্টিভ করতে হবে। রংফং লাগা।”
বুঝলাম সুমিতদার একটু একটু উৎসাহ জাগছে।
“গল্প-কবিতা ছাপবি?”
“খেপেছ!”
(একটা সাহিত্য-পত্রিকা কয়েক বছর চালিয়ে তার হ্যাপার কথা হাড়ে হাড়ে জানি! বহু অক্ষম লোক লেখা পাঠাবেন, আর না ছাপালে বাপান্ত করবেন।)
“সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
এছাড়া সুমিতদা আর কিছু বলল না।
আমার স্ত্রী শমীতা দাশ দাশগুপ্ত ফেমিনিস্ট – বহু বছর ধরে নারী নির্যাতনকে কেন্দ্র করে মেয়েদের ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, আইন-সচেতনতা নিয়ে লড়াই চালাচ্ছে। অবসর নিয়ে আমার খেপামি দেখে বলল,
“যখন কম্পিউটার নিয়েই পড়ে আছ, তাহলে কিছু কাজের কাজ কর – নারী সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে জোর দাও।”
কথাটায় একটু খোঁচা ছিল, কিন্তু মনে ধরল। আরও মনে ধরল এই জন্যে যে, দেশে গিয়ে দেখেছিলাম, চেনাজানা যাদের বাড়িতে কম্পিউটার আর ইন্টারনেট কানেকশন এসেছে, সেসব বাড়িতে বড়দের মধ্যে ছেলেরাই ইন্টারনেটে ঢোকেন বেশি, মহিলারা নন। বাড়ির গৃহিণীরা ইংরেজি জানলেও অনভ্যাসের ফলে বোধহয় বাংলাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাংলা পত্রপত্রিকাও মহিলারাই বেশি পড়েন। বৈজ্ঞানিক কোনও সমীক্ষা নয়, বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে সেরকমই মনে হয়েছিল। তখন মহাভারত সাইট ইন্টারনেটে ঢুকলে দেশেও দিব্বি পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন মহিলাকে সেটা দেখাতে তাঁরা বেশ অবাকই হয়েছিলেন।
“বাংলাতে এরকম আরও সাইট আছে?” সে প্রশ্নও অনেকে করেছিলেন।
ব্যাস, তথ্য নিয়ে আর সমস্যা নয়। এখন সেগুলো লেখা নিয়েই সমস্যা। নারী নির্যাতন ও সেই সংক্রান্ত কিছু আইন নিয়ে ব্রোশিওর এর আগেই মানবী নামে একটি সংস্থার জন্যে ‘হরফ’ ফন্ট দিয়েই তৈরি করেছিলাম, সেগুলো সোজা ঢুকিয়ে দেওয়া গেল। এরপর শুরু হল ইংরেজিতে আইনের নানান ওয়েবসাইটে গিয়ে সেগুলোর অনুবাদ করা আর বিভিন্ন স্বাস্থ্যের ইংরেজি সাইটে গিয়ে বাংলায় তার সারাংশ লেখা। মোটমাট বেশ ঘোরের মধ্যেই কয়েক মাস কাটল। এরমধ্যে এক ক্লাবের ফাংশানে সুমিতদার সঙ্গে দেখা।
“সাইট তো বেশ বাড়ছে দেখছি, কিন্তু দুয়েকটা বিনোদনের জিনিস রাখ?”
বিনোদনের একটা পাতা ছিল, কিন্তু সেখানে ধাঁধা ছাড়া আর কিছুই পোস্ট করার সময় পাইনি। আমি একটু চটেই বললাম,
“তুমি তো কিছুই আর করছ না!”
“করছি না মানে! ফন্টটা কে করে দিল তোকে? টেকনোলজির ব্যাপারটা কে দেখছে?”
“আরও তো করতে পারো।”
“শোন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছে – সাইটে বাংলা ফিল্মের একটা ডেটাবেস রাখ।”
খ্যাতনামা অভিনেতা বিকাশ রায়ের ছেলের কাছ থেকে এরকমই কিছু একটা আশা করা উচিত ছিল।
“তথ্য কোথায় পাবো, আর ডেটাবেস ডিজাইনই বা করবে কে?”
“তথ্য তোকে আমি দেবো, আর ডেটাবেস ডিজাইনও আমি করে দেব। তুই বল, সেটা সাইটে তুলবি কিনা?”
“নিশ্চয় তুলব। আর জানো, গতকাল অবসর-এ একশোটা হিট হয়েছে?”
“সে তো তোর নিরানব্বইটা আর আমার একটা। এ নিয়ে এত গর্ব করার কী আছে!” (এই না হলে আমার সুমিতদা!)
ডেটাবেসটা সুমিতদা চমৎকার তৈরি করল। যে কোনও বছর ঢোকালে, সে বছর কী কী সিনেমা তৈরি হয়েছিল, তাদের কুশীলব কারা ছিলেন – তার লিস্ট, গল্পের নির্যাস। লিস্টে কারো নাম টিপলে – ছবিসহ তাঁর জীবনী, আর কোন কোন ফিল্মে তিনি অভিনয় করেছেন তার লিস্ট। প্রতিটি তথ্যই প্রতিটির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া সরাসরি কোনও সিনেমার নাম দিলে বা অভিনেতার/অভিনেত্রীর নাম দিয়ে খোঁজ করলে সে ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য উঠে আসত। তথ্যগুলো তোলা ছিল একটা বিশাল কাজ। দেখতে দেখতে কুশীলবদের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়ালো। ধীরে ধীরে কাজটা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। অনেক সময় দিয়েও ১৯৩১ থেকে ১৯৬০-এর বেশী এগোতে পারলাম না। অনেক তথ্যই ঢোকাতে পারলাম না। আরও যদি লোক পাওয়া যেত। কিন্ত কে আসবে বেগার খাটতে?
অবসর-এর ডেটাবেস থেকে অভিনেত্রী শীলা হালদারের তথ্য
কয়েক বছরের মধ্যে অবসর-এ আসা পাঠকদের সংখ্যা বেশ বেড়ে উঠল। আনন্দ পেলাম, মাইনে বাড়লে যেরকম আনন্দ হয়। এদিক ওদিক থেকে যা মনে হচ্ছে জানার মত তথ্য – তাই ঢুকিয়ে ফেলছি। এরমধ্যে সুমিতদা একদিন বলল,
“এবার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ‘ভারতকোষ’ অবসর-এ তোল, তাহলেই এটা সত্যিকারের এনসাইক্লোপেডিয়া জাতীয় কিছু একটা হয়ে উঠবে।”
কথাটা মন্দ নয়। কিন্তু অনুমতি মিলবে কোত্থেকে?
“সেটা তোর ভাবনা। ডেটাবেস আমি বানিয়ে দেব।”
কলকাতায় গিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পবিত্র সরকার মহোদয়ের কাছ থেকে অনুমতি মিলল – তিনিই তখন পরিষদের কর্তা।
পবিত্র সরকার লিখিত ‘অনুমতি পত্র’
এর মধ্যে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত শঙ্করদা (ডঃ শঙ্কর সেন, বি ই কলেজের মাস্টারমশাই, পরে যাদবপুরের ভাইস চ্যান্সেলর ও তারও পরে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎমন্ত্রী হয়েছিলেন) এই খেপামিতে যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন বি ই কলেজের আরেক অধ্যাপক দীপক সেনগুপ্ত। ভারতকোষের তথ্যগুলো বহু পুরনো, সেগুলোকে আপডেট করা প্রয়োজন। সেই দায়িত্ব মূলত তাঁরাই পালন করলেন। শঙ্করদার বিশেষ আগ্রহ পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে। পরিবেশের তথ্যভাণ্ডার প্রধানত তাঁর প্রচেষ্টাতেই শুরু হল। আরও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য এই সাইটে রাখা যেত সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে – স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিবহন, বিনোদন, ইত্যাদি বিষয়ে। অবসরের হাজার কুড়ি-তিরিশ পাতার সাইট, বেশ কয়েক লাখ পাতায় পৌঁছতে পারত!
মূল সমস্যা হল তথ্যগুলো সংগ্রহ করে টাইপ করা। তার জন্য টাকা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। অর্থাৎ এই বিনি পয়সার কাজে কার আর আগ্রহ থাকবে? বাংলায় এক ওসিআর (OCR – Optical Character Reader) থাকলে, কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত। বইয়ের যেসব তথ্য কপিরাইট সংরক্ষিত নয়, সেগুলো স্ক্যান করে ওয়ার্ড প্রসেসর-এ কপি, এডিট, ইত্যাদি করে অবসর-এ তোলা যেত।
ছায়াছবির ডেটাবেসের কাজটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল যাদবপুরের ফিল্ম স্টাডিজ-এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপকের সঙ্গে। এ ব্যাপারে শঙ্করদাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অবসর-এ তোলা ফিল্ম ডেটাবেস দেখে অধ্যাপক মশাই মুগ্ধ।
‘এরকম যে কিছু একটা আছে – সেটাই তো জানতাম না’, ‘আমরা নিশ্চয় এই কাজ যোগ দেব’, ‘ছাত্রদের লাগিয়ে এটাকে আপ-টু-ডেট করে ফেলব,’ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক আশার বাণী শুনেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। সেটা কতটা আন্তরিক আর কতটা শঙ্করদার মন রাখতে – আমার পক্ষে বোঝা অসম্ভব। একমাত্র মৃণাল সেনই সোজাসুজি আমাদের বলেছিলেন – এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহই তাঁর নেই। পুরনো বাংলা ফিল্ম নিয়ে গর্ব করার কিছুই নেই, আর তার ইতিহাস ধরে রাখা সময়ের অপচয়। সোজাসাপটা কথা। বক্তব্যের সঙ্গে আমি দ্বিমত হতে পারি, কিন্তু উনি আমাদের ঘোরাননি।
সে সময়ের বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গেও শঙ্করদার মাধ্যমে অবসর-এর প্রসার নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু ফলের খাতায় সেই শূন্য। এগুলো কয়েকটা উদাহরণ মাত্র। সার কথা হল, দেশে বহু সময় জলে গেছে, প্রচুর পেট্রল পুড়েছে, কারণ লোকের মনের ভেতরের কথাটাই ধরতে পারিনি।
‘বেশ তো ব্যাপারটা’, ‘কালকে চলে আসুন, হ্যাঁ আমরা সঙ্গে আছি’, ‘চেষ্টা করব’, ‘এখন একটু ব্যস্ত – দিন দুয়েক সময় দিন’।
এসব হচ্ছে পাশ কাটিয়ে যাবার টেকনিক। বহু বছর বিদেশে বাস করে দেশের এইসব সূক্ষ্ম কায়দা কানুনগুলো ভুলে গিয়েছিলাম! লাভের মধ্যে আমাদের এই পাগলামির খবর পেয়ে স্টেটসম্যান পত্রিকায় ২০০৭ সালে এ নিয়ে একটা বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। হরফ-এর অবসর নিয়ে এটাই মনে হয় কোনো বড় পত্রিকায় একমাত্র লেখা।
স্টেটসম্যান পত্রিকায় ২০০৭ সালে অবসর নিয়ে প্রতিবেদন (ছবিটা কাট এন্ড পেস্ট করা – লেখাটা ছিল প্রথম পাতার নীচের দিকে)
সুমিতের কথা
ইন্টারনেটের গোড়ার যুগে এই ফন্টের রাজ্যে মাৎস্যন্যায়, এ ভাষার সঙ্গে ও ভাষার বনে না, একই অক্ষর কিন্তু বিভিন্ন ফন্টে তার বিভিন্ন কোড, -কার আর -ফলার কোনো দিক্বিদিক নেই, এমনিতরো আরো অনেক। এর প্রতিকার করার জন্য ইন্টারনেট বোর্ড একটা উপায় করলেন, বললেন যে ইন্টারনেটে যেসব ভাষা ব্যবহার করা হবে তার প্রতিটি অক্ষরের একটি স্বতন্ত্র ও অদ্বিতীয় কোড থাকবে (unique code তাই unicode)। শুধু তাই নয়, যেখানে দরকার হলো সেখানে তাঁরা অক্ষরের প্রয়োগরীতিও বাৎলে দিলেন, যথা, ই-কার আগের অক্ষরের আগে যাবে, ও-কার আগের অক্ষরকে বেষ্টন করবে, ইত্যাদি, অক্ষর যুক্ত করার হদিশও বলে দিলেন। ফন্টের রাজ্যে যুগান্তকারী ব্যাপার। তবু ১৯৯১ সালে বাংলা ইউনিকোড (Unicode) প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও তার ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হতে লাগলো আরো পনেরো বছর। বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, তাঁদের সরকারের আনুকূল্যে তাঁরা বাংলা ইউনিকোডের বহু ফন্ট ও তা ব্যবহারের কিবোর্ড বানিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ আরম্ভ করলেন। সুলভতা ছাড়াও ইউনিকোডের আরো কিছু সুবিধা ছিলো – সহজ বর্ণানুক্রমিক বিন্যাস, পার্সারের অনেকটা কাজ ফন্টের মধ্যেই করে নেওয়া, আর ওয়েব পৃষ্ঠায় নির্দেশিত ইউনিকোড ফন্টটি যদি আপনার কম্প্যুটারে না থাকে তাহলে ব্রাউজার নিজের থেকেই তার কাছাকাছি কোনো ফন্ট আপনার কম্প্যুটার থেকে খুঁজে নেবে। যে প্রতিবন্ধকতায় হরফ নাকানিচোবানি খাচ্ছিলো, এটি হলো তার বিশেষ প্রতিষেধক। আমরা অবশ্য অতো চট করে হরফকে ছাড়িনি। তার একটা কারণ অবশ্যই অপত্যস্নেহ। আরেকটা কারণ ওয়েব পৃষ্ঠা থেকে হরফের ছাপা টুকলি করা যেত না। তার ভালোমন্দ দুদিকই আছে, আমরা ভালোর দিকটাই বেশী করে দেখতাম। তারপর স্মার্টফোন, আইওএস, অ্যান্ড্রয়েড – এদের সুনামি থেকে হরফকে আর রক্ষা করা গেলো না, বছর পাঁচেক আগে আমরা অবসরকে ইউনিকোডে নিয়ে গেলাম। অবসরের সেই পুরনো হরফ সংস্করণ আজও এই অবসরের কোণে “মরে গিয়ে ঝিল্লিস্বনে কাঁদায় রে নিশার গগন।”
অবসর তার হরফ ফন্ট, তার ওয়েব পৃষ্ঠা, তার ডেটাবেস, এসব নিয়ে ইন্টারনেটের পাশে পাশে বড়ো হয়েছে – আমাদের মতোই। অবসরের এইসব পাতা ক্রমান্বয়ে দেখে গেলে ইন্টারনেটের বিবর্তনের ছবিই নজরে পড়বে। আজ প্রায় পঁচিশ বছর পর্যন্ত পিছিয়ে যাওয়া মানচিত্র দেখে অবাধ্য টেকনোলজির পেছনে রাত জেগে ধাওয়া করার ক্লেশ মনে আসে না, একটা নতুন কিছু হচ্ছে তার রোমহর্ষক উত্তেজনার কথা মনে আসে। অনেক অনেক দিন পরে কোনো ইন্টারনেট-ঐতিহাসিক অবসরে এরকমের মূল্যবান কিছু পেতে পারেন।
সুজনের কথা
কর্মজীবনে অফিসের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু তারপর? বাণপ্রস্থ যাওয়ার রেওয়াজ এখন আর চালু নেই। এখন কেউ বাগান করি, পাড়ার ক্লাব নিয়ে মেতে থাকি, আড্ডায় বসে পৃথিবীর নানান সমস্যার সমাধান করি – কিছু না কিছু করে নিজেকে ভুলিয়ে রাখি। হরফ ফন্ট ব্যবহার করে অবসর বানানোও ছিল ওই রকমই একটা নেশা। তবে আমি বিশ্বাস করতাম, এখনও করি – যাঁরা ইংরেজি ভালো জানেন না, তাঁদের জন্য এই ধরণের বাংলা ওয়েবসাইটের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সেইজন্যেই এ ব্যাপারে যখন অন্যদের সাড়া পেতাম না, হতাশ হতাম। মনে পড়ে একাধিক বার শঙ্করদার গলফ গ্রিনের বাড়িতে এই নিয়ে যখন আফসোস করেছি, শঙ্করদা গেয়ে উঠতেন,
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।”
অমূল্য উপদেশ।
4 Comments