আলোচনাঃ আড়কাঠি

আলোচনাঃ আড়কাঠি

আড়কাঠি

উপন্যাস: আড়কাঠি
লেখক: ভগীরথ মিশ্র
প্রচ্ছদ: পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকাশনা: দে’জ পাবলিশিং
মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৯২

বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষে নানা ধরনের সমস্যা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৭ বছর পরে আজও বিভিন্ন অঞ্চলে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে না পাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক। শহুরে ঝাঁ চকচকে নিয়ন আলোর তলায় এইসব অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের চিরকালীন হাহাকারের কথা চাপা পড়ে থাকে। জমিদার প্রথা, ব্রিটিশ শাসন পার হয়ে স্বাধীনতার বর্তমান সময়েও তাদের অবস্থার কোন উন্নতি ঘটেনি। শুধুমাত্র শাসক বদল হয়েছে, শোষণের তীব্রতার ধরন বদল হয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি একই আছে। পৃথিবীর ইতিহাস তো বটেই, ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেও দেখা যায় এখানেও একসময় দাস-ব্যবসা রমরমিয়ে চলেছে। কিন্তু যদি বলি বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে আজও এই প্রথা টিকে আছে তাহলে নাগরিক সভ্যতার স্বাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত আমরা, সুসভ্য মানুষ, চমকে উঠে ভাবতে থাকি তাও কি হয়? এটাও কি সম্ভব? হ্যাঁ, দাস-ব্যবসা আজও কীভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে টিকে রয়েছে এটা সাহিত্যিক ভগীরথ মিশ্র তাঁর বিখ্যাত ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসে লিখেছেন। উপন্যাসটি ১৯৯৫ সালে সমরেশ বসু পুরস্কার লাভ করে।

উপন্যাসের পটভূমি বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, গজাশিমূল গ্রামের মানুষ এবং তাদের নিত্যদিনের জীবনযাপন। এখানকার মানুষ অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত। বসু-শবর, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রজাতির মানুষজন পাহাড়ে, অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় শিকারের সন্ধানে। দারিদ্র্যে জর্জরিত তাদের জীবন। দারিদ্র্যের সুযোগ নেয় রঙলাল, যে এই গরিব না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর চোখে রঙিন স্বপ্ন দেখাতে একদিন হঠাৎ গ্রামে এসে উপস্থিত হয়। প্রথমেই ‘রঙলাল’ নামের মধ্যে দিয়েই লেখক কোথায় যেন একটা তীর্যক ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবের প্রকাশ দেখিয়ে দিয়েছেন। যে দাদন প্রথার জন্য একসময় জমিদারদের রক্তচক্ষুর ভয়ে প্রজাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত সেই দাদন প্রথাই অন্যভাবে ঘুরে-ফিরে আসে রঙলালের হাত ধরে। খাজনা দিতে না পারার অপরাধে একসময়ে প্রজাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত, অকথ্য অত্যাচার করা হত। রঙলাল কিন্তু সে পথে যায় না। সে মিষ্টি কথায় মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের বিশ্বাস অর্জন করে তাদের ঋণের জালে ফাঁসাতে থাকে – যে ঋণ চক্রবৃদ্ধি সুদের হারে এমন একটা অংকে পৌঁছায় যা অপরিশোধ্য, আর বংশপরম্পরায় চলতেই থাকে। ফলে তার কথায় কাজের সূত্রে তারা যেতে বাধ্য হয় আসামের বিভিন্ন চা-বাগানে অথবা কোনও এক অন্ধকারের গলিতে, যেখানে গেলে ফিরে আসার আর কোনও পথ থাকে না।

এখানে সমান্তরালভাবে চলে দুটো কাহিনি। গোটা গজাশিমুলের মানুষের এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে হঠাৎ এসে পড়ে বাংলার অধ্যাপক রাজীব। লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা রাজীব এই গ্রামের মানুষগুলোকে আপন করে নিতে চেয়েছে। প্রকৃত অর্থেই সে বাংলার পুরনো হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার ব্রত নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াত। এখানকার মানুষের আচার-ব্যবহার এবং সংস্কৃতির সঙ্গেও সে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সহজ সরল লোকগুলো বাইরের শহুরে বাবুদের সহজে বিশ্বাস করতে চাইত না। তাদের ভাষায় তারা ‘কাঁকড়া।’ কিন্তু রাজীব হাল না ছেড়ে গ্রামের প্রত্যেকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সঙ্গে মিশে ক্রমে ক্রমে তাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ আর ঘরের লোকের মতোই আপনজন হয়ে ওঠে। রঙলালের কথা যখন রাজীব জানতে পারে তখন তার প্রধান উদ্দেশ্য হয় যেভাবেই হোক রঙলালের হাত থেকে এই নিরীহ মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে। পাশে পেয়ে যায় গ্রামেরই কিছুটা লেখাপড়া জানা সুচাঁদকে। রাজীব আর সুচাঁদ দুজনে আসামে গিয়ে এই গ্রামের লোকগুলোর প্রকৃত পরিস্থিতি জেনে এসে, রঙলাল যে মিথ্যে স্বপ্ন তাদের দেখাত সেই সত্য প্রকাশ করে। সবার সামনে খুলে যায় রঙলালের রংচঙে মুখোশ। কিন্তু রঙলালের লালখাতায় যারা একবার নাম লিখিয়েছে দাদনের ফাঁস থেকে যে তাদের কোনও মুক্তি নেই। রাজীব আপ্রাণ চেষ্টা করে এই মানুষগুলোর সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে বাইরে প্রকাশ করার এবং সমস্ত লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার। ধীরে ধীরে এই গ্রামের মানুষগুলোর নাচ বাইরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তারা ডাক পায়, সোনার মেডেল এবং অন্য পুরস্কার পেতে থাকে এবং কিছু কিছু করে অর্থ উপার্জন করে। সেই অর্থ দিয়ে রঙলালের থেকে ধার নেওয়া দাদন কিছুটা করে শোধ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ঋণের পরিমাণ যে জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে। তা শোধ করা তো তাদের সাধ্যের বাইরে।

এদিকে দেখা যায় রাজীবের এই লোকসংস্কৃতি মানুষের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছে ক্রমশ নেশায় পরিণত হচ্ছে। ঘটনাচক্রে ‘দ্য ফোক’ পত্রিকার সর্বভারতীয় করেসপন্ডেন্ট বিদেশিনী ক্যাথি বার্ডের আগমন ঘটে। তার উদ্দেশ্য ‘ইস্ট-ওয়েস্ট ফোক ফাউন্ডেশন’ গড়ে ভারতীয় এবং বিদেশি লোকসংস্কৃতিকে একসূত্রে বাঁধা। এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে রাজীব যুক্ত হয় এবং বাঁকুড়া শাখার চেয়ারম্যান পদে আসীন হয়। রাঢ় এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাঁওতালদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতিগুলো রাজীব যতই মানুষের দরবারে উপস্থাপন করতে থাকে এবং সাফল্য অর্জন করতে থাকে ততই কোথায় যেন রাজীবের মনের গোপনতম কুঠুরিতে একটা অন্যরকম চিন্তাভাবনা গড়ে উঠতে থাকে। এই পৃথিবীতে মানুষ শুধু অর্থলোভী নয়, নাম-যশপ্রার্থীও বটে। তাই হয়তো কোনও কোনও সময় মানুষের অজান্তেই তার মনে সেই নাম-যশের লোভ দানা বাঁধে। সেই কারণেই লেখক বলেছেন: 

মানুষের মনের মধ্যে একজন অর্থের কাঙাল থাকে, একজন নাম-যশ প্রতিষ্ঠার কাঙাল, একজন পর্যটক বাস করে, সে শুধু ডিঙিয়ে যেতে চায়, অতিক্রম করে যেতে চায় এক একটি সীমা রেখা, এক-একটি হার্ডল, এমনি এমনি, শুধু তা কারণ পুলকে…।

এক সময় রাজীবের শুধুমাত্র একটা ইচ্ছে ছিল এই প্রান্তিক অঞ্চলের লোকগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নত করার, লোকসংগীত এবং লোকনৃত্য মানুষের ধর্ম আর সংস্কারের মোড়কে যা বাঁধা পড়ে গেছে যুগ যুগ ধরে তা প্রকৃত গুণীজনের সমাদর পাওয়ার। কিন্তু রঙলালের হাত থেকে বাঁচানো ক্রমে ক্রমে তাদের সেই নিজস্ব সংস্কৃতি যা এতদিন তারা সযত্নে গোপনে লালন করে আসছিল সেটাই বিশ্বের দরবারে উন্মোচন করে দিয়ে বিপণনযোগ্য করে তোলে। একটা ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি রাজীবের নিজের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে বসত গাড়ে। ফোক কালচার নিয়ে কাজ করার সাধারণ ইচ্ছেয় একসময় গাঁজার নেশায় আক্রান্ত হয় রাজীব। রাজীব যে কখন আরেক রঙলালেরই ভূমিকা নিতে শুরু করেছে তা সে নিজেও বোঝে না। লেখকের কলম ঠিক এই জায়গায় রঙলাল আর রাজীবকে সমান্তরাল রেখায় দাঁড় করিয়ে দেন। 

লেখক দেখাতে চেয়েছেন সভ্য সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পরে মানুষ এবং মনুষ্যত্ব কেনাবেচার দালালরা, আড়কাঠিরা যুগে যুগে কালে কালেই আছে। দেবতা কানাইশর জিউকে সন্তুষ্ট করার যে পবিত্র নৃত্যকলা – জলকেলি নৃত্য – যা শুধুমাত্র একটা গোপন সংস্কৃতি ছিল, রাজীব তা খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার মতো নোংরা খেলায় মেতে ওঠে। ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে অর্থ নিয়ে দরকষাকষিতে নেমে পড়ে বাজোরিয়ার সঙ্গে। সহজ সরল মানুষগুলোর সঙ্গে এটা এক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একসময় রঙলালও যেভাবে ওই মানুষগুলোকে মিথ্যে আশ্বাস দিত, ঠিক সেভাবেই রাজীব সরল মানুষগুলোর বিশ্বাসের মূলে চরম আঘাত করে। রঙলালের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যে রঙীর জন্য রাজীব অর্থ ব্যয় করে সেই রঙীরই নগ্ন চিত্র বিদেশের খোলা বাজারে বিক্রি করে তাকে অসম্মান করে। রঙী সম্পর্কে রাজীবের মুখ থেকে বেরোনো ‘ডবকা ছুঁড়ি’ আর “ওর এক-একখানা বুকই আঠারো হাজারে বিকোবে” বলে নিজের ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় দেয়। সুনীল চরিত্রটিকে লেখক এখানে অনেকটা নাটকের ‘বিবেক’ চরিত্রের মতো ব্যবহার করেছেন।

অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষগুলোর জীবন দাস-ব্যবসায়ী রঙলালের হাত থেকে লোকসংস্কৃতিপ্রেমী রাজীবের হাতের পুতুলে কীভাবে পরিণত হয়ে কলুষিত হয় তারই এক মানবিক আখ্যান ‘আড়কাঠি’ উপন্যাস।  

—–

ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে। 

পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বিভিন্ন ধরনের বই পড়া, বেড়ান আর সিনেমা দেখা। পছন্দের ভ্রমণ তালিকায় প্রথম স্থানে আছে পাহাড়িয়া ছোট ছোট গ্রাম। আরও শখ সময় ও সুযোগ পেলেই পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে থেকে নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখা। বেড়িয়ে এসে মনের আনন্দে টুকটাক ভ্রমণকথা লেখার চেষ্টা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন, প্রবচন পত্রিকা, ‘পর্যটকের ডায়েরি’ নামক ভ্রমণ সংকলনে। পঙ্কজ উধাস, জগজিৎ সিং আর রশিদ খানের গান সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সফট রোম্যান্টিক গান বিশেষ পছন্দ। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি প্রবল ঝোঁক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *