দুই নারীর দৃষ্টিতে নারী

দুই নারীর দৃষ্টিতে নারী

[ভূমিকা: ১৯৮৪ সালের কথা। আমেরিকায় কলেজে পড়ার পাট সবে শেষ করেছি। হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল – মহিলাদের জন্যে ‘সুকন্যা’ নামে একটা নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হবে কলকাতায়। এই ধরনের পত্রপত্রিকা এখন জলভাত হয়ে গেলেও ১৯৮০র দশকের প্রথম দিকে ব্যাপারটা ছিল অভিনব। (‘সানন্দা’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৬ সালে।) প্রকাশনা সংস্থাও নতুন – ইত্যাদি প্রকাশনী। কী মনে হল, নারীবাদী লেখা পাঠাতে চাই জানিয়ে একটা চিঠি লিখলাম। তখন ইমেল ছিল না। চিঠি গেল একেবারে হাতে লিখে, খামে ভরে, ডাকটিকিট সেঁটে। উত্তর পাব আশা করিনি। কী আশ্চর্য, উত্তর এল। সম্পাদক জানালেন প্রথমে একটি লেখা পাঠাতে, তারপর ভালো লাগলে আরও চাইবেন। এর পর নারীবাদী বিষয় নিয়ে সুকন্যার প্রতি সংখ্যায় লিখেছি প্রায় এক যুগ ধরে – যতদিন না প্রকাশনীটি বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৮৫ সালে কলকাতায় কাটাচ্ছি সারা গ্রীষ্ম। তখন কলকাতায় গেলে বেশির ভাগ সময় কাটাতাম মা-বাবার সঙ্গে, নাকতলায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একদিকে এগোলেই পড়ত প্রিয় লেখিকা প্রতিভা বসুর বাড়ি। ওপথে হাঁটলে দেখতাম মাসিমাকে, আর তাঁর পোষ্য কুকুরকে। রাস্তায় মানুষ দেখলেই আহ্লাদী চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত। সেই সময়ে মাসিমা ডেকে আলাপ করেছিলেন। মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে একটু কথা বলে যেতাম।

ঠিক উল্টোদিকে হাঁটলে, পদ্মশ্রী সিনেমাহলের সামনে একটা বাড়ির দোতলার বারান্দায় মাঝেমধ্যে এসে দাঁড়াতেন আর এক যশস্বী মহিলা – আশাপূর্ণা দেবী। তাঁর সঙ্গে কোনোদিন কথা হয়নি।

একদিন ভাবলাম এই দুই অসামান্যা লেখিকার সাক্ষাৎকার নিলে কেমন হয়! নাঃ, ওঁদের বই বা লেখা নিয়ে নয়, সেরকম ইন্টারভ্যু বহু আছে। জানতে চাইব নারীবাদী আন্দোলন সম্পর্কে এঁদের কী মতামত।

মাসিমাকে (প্রতিভা বসু) চিনতাম। গিয়ে বললাম সাক্ষাৎকার নিতে চাই। উনি রাজি হলেন। এক সকালবেলা আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ির দরজায় টোকা দিলাম। কী সৌভাগ্য, উনি নিজের হাতে দরজা খুললেন। সাক্ষাৎকার নিতে চাই শুনে বললেন তক্ষুণি হবে না, একটু ব্যস্ত আছেন। তবে দুপুরে এলে কথা বলার সময় নিশ্চয়ই হবে।

ইন্টারভ্যু নেবার সময় দুই মাসিমাই চা-মিষ্টি খাইয়েছিলেন। ঠা-ঠা গরমের দুপুরে আশাপূর্ণা দেবী নিজের হাতে চা করছেন দেখে আপত্তি জানিয়েছিলাম। মাসিমা উড়িয়ে দিলেন।

“মাসিমা বলে যখন ডেকেছ, একটু মিষ্টিমুখ তোমাকে করতেই হবে।”

চলে আসার সময় সই করে একটি বই উপহার দিলেন।

লেখাটা ছাপা হবার পর পত্রিকা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম ওঁদের বাড়ি। দুই মাসিমাই ততদিনে পত্রিকার সংখ্যাটি পেয়ে গেছেন। প্রতিভা বসু প্রশংসা করে বলেছিলেন লেখাটি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাক্ষাৎকার। এ আমার পরম প্রাপ্তি। সুকন্যা ছাড়াও সাক্ষাৎকারটি হিন্দিতে অনূদিত হয়ে হিন্দি ‘পরিবর্তন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রতিভা বসু এবং আশাপূর্ণা দেবী দুজনেই আর নেই। সুকন্যা নেই, ইত্যাদি প্রকাশনী নেই। আজ অবসরের পাতায় পুরনো, সংরক্ষিত লেখা হিসেবে সেই সাক্ষাৎকারটি পেশ করলাম। বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বানান পরিবর্তন করেছি।]

আজকের নারী – প্রগতিশীল, স্বনির্ভর, স্বাধীন। বিংশ শতাব্দীর আশির কোঠায় এসে এই ছবিটিই চোখে ভাসে। নারীস্বাধীনতা আজ কল্পনাপ্রসূত অলীক চিন্তা নয়। এ নিয়ে গভীর ভাবনা চলছে সমাজের নানা স্তরে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা বের হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু নারীমুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা তো নতুন কিছু নয়! সময় সময়ে বুদ্ধিজীবী সমাজসংস্কারকেরা এ নিয়ে বহু আলোচনা করেছেন। জোর গলায় উচ্চারণ করেছেন নারী জাগরণের বাণী। দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ লেখা বা ভাবনাই এসেছে পুরুষের কাছ থেকে। এ ব্যাপারে কিছু নারী যে এগিয়ে আসেননি তা নয়, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই কম। আকাশছোঁয়া প্রতিকূলতার বেড়া ডিঙিয়ে এগিয়ে আসতে ক’জনই বা পেরেছেন! তবে এই পূর্বসূরিদের অবদান নেহাত ভুলে যাওয়ার মতও কিছু নয়। এঁরাই আজকের নারী আন্দোলনের পথ পরিষ্কার করেছেন। ভবিষ্যতের সুষম সমাজ এঁদের কাছে তাই কৃতজ্ঞ।

এমনই দুই দলছুট মহিলার কাছে গিয়েছিলাম তাঁদের গল্প শুনতে। দুজনেই লেখিকা হিসেবে সম্মানিতা। দেশে বিদেশে বাঙালি সমাজের কাছে আদৃতা। এঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে শুধু আজকের মেয়েদের জীবনকথাই নেই, তাদের মা আর দিদিমার খবরও আছে। এই দুই নারীর চোখে নারীমুক্তি কী, এর মূল্য আছে কি নেই, জানতে চেয়েছি। তার চেয়ে বেশি, শুনতে চেয়েছি এঁদের ঘরগেরস্থালির গণ্ডির বাইরে পা বাড়ানোর অভিজ্ঞতা।

আশাপূর্ণা দেবী (ছবিঃ লেখিকা)

আশাপূর্ণা দেবীর লেখা গল্পের স্বাদ আমি পেয়েছিলাম আমার মা’র কাছ থেকে। আমার মা আশাপূর্ণা দেবীর বই পেলে আর কিছু চান না। মা বলেন ওঁর লেখা বুকের মধ্যে গিয়ে লাগে। স্কুলের কোনো এক ফাংশানে ওঁকে একবার দেখেছিলাম। আমাদের একটি গল্প বলেছিলেন সেদিন। বহুদিন আগের কথা, গল্পটা একেবারে ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে অল্প করে মাথায় কাপড় দিয়ে স্টেজে আসন করে বসা এক ঘরোয়া মহিলার ছবি, আর গল্পটা ভালো লাগার অনুভূতি। মনে হয়েছিল, ‘এ মা! এত বড় লেখিকা, ইনি তো আমার মা-মাসির মতই দেখতে!’ এরপর নিজের মনের তাগিদেই আশাপূর্ণা দেবীর লেখা পড়েছি। অনেক সময় কেটে গেছে, বয়স বেড়েছে। মেয়েদের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা করতে আরম্ভ করেছি বহুদিন। আমার সঙ্গে আরও অনেক মেয়ের জীবন মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি। এই সময়েই হাতে পেয়েছি আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি – ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি,’ ‘সুবর্ণলতা,’ আর ‘বকুল কথা।’ নারীমুক্তি নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে দেশি বিদেশি বহু বই পড়েছি আমি। কিন্তু এই তিনটি বইয়ের মতো নাড়া দেয়নি কিছু। তথ্য বা তত্ত্বকথায় নয়, শুধু গল্পের মধ্যে দিয়ে নারীমুক্তি আন্দোলনের গূঢ় বক্তব্য এত সহজে বোধহয় আর কেউ বলেননি। প্রতিবাদ সাহিত্যের অপূর্ব নিদর্শন এই ট্রিলজি।

আশাপূর্ণা দেবীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়েদের জীবন নিয়ে এ ধরণের চিন্তা এল কবে থেকে?’ বললেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের সামাজিক অবস্থার প্রতি বিদ্রোহ মনে জেগে উঠেছিল।’ নিজে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, লেখাপড়া বাড়িতেই করেছেন। বাড়ির চৌহদ্দির মাঝে বড় হতে হতে বাইরের অন্যান্য মেয়েদের জীবন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন। নারীর সামাজিক অধিকারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই ঘরে লেখা শূন্য। এমন কেন? নারী পুরুষ দু’জনেই মানুষ, দু’জনকে নিয়েই সমাজ। তবে কিছু রীতিনীতির জন্যে সমাজে নারী মূল্যহীন কেন? এই পরস্থিতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জেগে উঠল ছোট্ট আশাপূর্ণার মনে। শুধু তাই নয়, আশাপূর্ণা লক্ষ্য করলেন অনেক ক্ষেত্রে নারীই নারীর অধিকার খর্ব করছে। একজন মেয়ে বা বউয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে সবসময় পুরুষ দৌড়ে আসে না; মা, শাশুড়ি, মাসি-পিসিই এই কাজটি করেন।

লেখিকাকে আশাপূর্ণা দেবীর দেওয়া উপহার

বিষণ্ণ গলায় আশাপূর্ণা বললেন, ‘মেয়েদের সামাজিক মূল্য তাদের প্রতিভা বা গুণপনায় বিচার হয় না। সমাজে এগুলোর স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। এজন্যেই বলা মেয়েদের লেখাপড়া শিখে লাভ নেই – মুখে মুখে চোপা করবে।’ মেয়েদের পৃথিবী ছিল সন্তান আর রান্নাঘর ঘিরে। তাহলে এই বাঁধা জীবনে লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম হল কী করে? বললেন সাহিত্যপ্রীতি পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। বাড়িতে বই ম্যাগাজিনের অভাব ছিল না। আশাপূর্ণার পড়া বা লেখায় বাধা আসেনি এতটুকু। ওঁর মা বলতেন, ‘বই পড়লে কেউ খারাপ হয় না।’

বিয়ের আগে থেকেই লিখেছেন। পত্রপত্রিকায় গল্প-উপন্যাস ছাপাও হয়েছে প্রচুর। বস্তুত, আশাপূর্ণা দেবীর কোনো লেখা এখনও পর্যন্ত অমনোনীত হয়নি। বিয়ের পরে স্বামী উৎসাহ দিয়েছেন লেখার কাজ চালিয়ে যেতে। সংসারের ফাঁকে ফাঁকে লেখা এগিয়ে গেছে আপন বেগে। এই লেখার জন্যে আশাপূর্ণা সংসারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেননি কখনও। সারাদিন কাজ করেছেন, সকলে শুতে যাবার পর রাত্রে লিখতে বসেছেন। লিখতে লিখতে রাত কেটে গেছে। ভোরের আলোর সঙ্গে সঙ্গে লেখা তুলে রেখে আবার সংসারের কাজে হাত লাগিয়েছেন। আশাপূর্ণা দেবীর মতে, ‘সময়টা কিছু নয়। প্রেরণা থাকলে সব করা যায়।’

লিখতে গিয়ে কলমে এসেছে মেয়েদেরই কথা। তাদের বঞ্চনা, অধিকার, ছোটখাট সুখদুঃখের খুঁটিনাটি। এমনই করেই জন্ম নিয়েছে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র নায়িকা সত্যবতী – প্রতিবাদের প্রতিমূর্তি এক নারী। সেই সময়, সেই কাল, কিছুটা অনুমান করা, কিছুটা মা-দিদিমার মুখে শোনা। কিছুটা আশাপূর্ণার নিজের চোখে দেখা। আশাপূর্ণা দেবী বললেন, ‘কোনো যুগই সময়ের খাতা থেকে একেবারে মুছে যায় না, পরের প্রজন্মের জন্যে কিছু অন্তত রেখে যায়।’ সত্যবতী তার জীবনের সত্য রেখে গিয়েছিল সুবর্ণলতা আর বকুলের জন্যে।

কিন্তু এত যুগের রক্তক্ষরণেও কি মেয়েরা তাদের সামাজিক অধিকার পেয়েছে? বকুল কি সত্যিই আজ সমানাধিকার লাভ করেছে? আশাপূর্ণার মতে, তা এখনও হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে যা মুক্তি, তা একটা মেকি খোলসমাত্র। বাড়ির মধ্যে বন্দি থাকা আর একা একা বাসে চড়ে অফিস করার মধ্যে তফাত নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মুক্তি একে বলা যায় না। সমাজের কর্তৃত্ব এখনও পুরুষেরই হাতে। সমান মানসিকতার অধিকার মেয়েরা এখনও পায়নি। এই মানসিকতাই হল আসল মুক্তি। আশাপূর্ণা দেবী মনে করেন স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক এখনও খাদ্য-খাদকের। সখ্য এখানে কোথায়! পুরুষের চোখে মহীয়সী হবার জন্যে মেয়েরা এখনও সর্বস্ব ত্যাগ করে, পুরুষের ভালোবাসা চেয়ে স্বাধিকার ভুলে যায়। কিন্তু এই সম্পর্কে মর্যাদার বড় অভাব। একজন আশ্রিত, অন্যজন আশ্রয়দাতা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। যতক্ষণ এই সম্পর্ক অটুট থাকে ততক্ষণ শ্রদ্ধা না থাক, সোহাগ আছে। কিন্তু মেয়েদের এই আসন বড় ঠুনকো। আগেকার দিনে কিছু দোষ হলে তারা ভয় পেত স্বামী আর একটা বিয়ে করবে। এমনকি দোষ না ঘটলেও সেই ভয় ছিল। এই রকম অসহ্য অপমান আর অসহায়তার মধ্যে দিন কাটাত সব মেয়েরা। এখন অবশ্য তারা বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারটুক পেয়েছে। কিন্তু তাতে অসহায়তা কমেছে কি? নারীর সামাজিক মর্যাদা এখনও পুরুষের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। নইলে পণপ্রথা আর নারী নির্যাতন এখনও এমনভাবে চলত না। আরও আশ্চর্য কথা এই যে, এ শুধু আমাদের দেশের পরিস্থিতি নয়। ‘আগে মনে হত বিদেশি পশ্চিমি মেয়েরা এই লাঞ্ছনার হাত থেকে মুক্ত। অথচ দেখা গেল নারীমুক্তি আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যেই।’ আশাপূর্ণা বললেন, ‘পশ্চিমি মেয়েদের সামাজিক অধিকারেও তবে ফাঁকি ছিল। আসলে পুরুষালি মূল্যবোধে গড়া পৃথিবীতে নারীর স্বীকৃতি নেই।’

আশাপূর্ণা দেবী মনে করেন মেয়েদের এই সামাজিক অবস্থার জন্যে দায়ী দুটি জিনিস। প্রথমত তাদের শারীরিক দুর্বলতা। তারা ধর্ষিত হতে পারে, ফলে তাদের একজন পুরুষ প্রতিরক্ষী দরকার। আর দ্বিতীয়ত নারীর সন্তানস্নেহ। পুরুষের জনক হতে বিশেষ কষ্ট করতে হয় না, কিন্তু মায়েরা দশ মাস সন্তানকে নিজের শরীরে লালন করে। তাই সন্তানের সুখের জন্যে তারা সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এই স্নেহের খাতিরেই মেয়েরা অনেকটা অসহায়। তবে আজ সচেতন হবার দিন এসেছে। ভালোবাসা প্রার্থনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সম্মান। তাই সামাজিক মর্যাদা এখন মেয়েদের অর্জন করে নিতে হবে। নারী মোহিনীরূপে ক্ষণিকের জন্যে মন ভোলাতে পারে, কিন্তু সম্মান আসে কীর্তিতে, ক্ষমতায়। নারী পুরুষের সম্পর্ক হওয়া উচিত মধুর সখ্যের, প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক নয়। এমনকি নিজের অধিকার অর্জন করে নিতে, দরকার হলে জায়গায় জায়গায় নারীকে লড়াকু হতে হবে বইকি! তবে অকারণ লড়াই আশাপূর্ণা চান না। ‘কিন্তু মর্যাদা খুইয়ে সুখেরও দরকার নেই।’ বললাম, ‘হয়তো আমাদের বিবাহ পদ্ধতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে অধীনতার বীজ, কর্তা-অনুগতের ভূমিকা।’ জিজ্ঞেস করলাম ওঁকে, ‘তবে কি সংসারে বিবাহ ব্যবস্থাই তুলে দেওয়া দরকার?’ নাঃ, তা মনে করেন না আশাপূর্ণা। মানুষ জন্তুর মতো জীবনযাপন করবে কেন! সন্তান বড় করার জন্যে বাবা-মা দুজনেরই উপস্থিতি কাম্য। শুধু জৈবিক কারণে সহাবস্থান মানুষকে পশুর স্তরে নিয়ে যাবে। জীব থেকে শিবে পরিণত হবার চেষ্টা করতে হবে, তার উল্টোটা নয়। বিবাহ প্রথা বাদ দিলে চলবে না। এই বিবাহের মধ্যে দিয়েই আসে মাতৃত্ব, নারীর আসল রূপ। পরবর্তী সমাজকে আমরা আমাদের সন্তান উপহার দিয়ে যাই। আগামী সমাজের পরিবর্তন বা গঠন আমরা এই সন্তানের মাধ্যমেই করি। স্ত্রী-পুরুষের এ বড় গুরু দায়িত্ব।

আশাপূর্ণা মনে করেন পুরোপুরিভাবে মুক্ত হতে গেলে নারীকে এখনও অনেক বদলাতে হবে। মেয়েরা এখনও যথেষ্ট উদার নয়। বহুযুগের বঞ্চনা তাদের মনের প্রসার ঘটতে দেয়নি। তাদের মধ্যে কল্যাণবোধ জাগাতে হবে। নিজেদের অধিকার আর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। পুরুষ শাসনের সমাপ্তি ঘটবে তখনই। স্ত্রী-পুরুষ, ‘গাড়ির দুটো চাকা। একটা ছোট হলে গাড়ি চলবে না।’ আজকের নারীকে আশাপূর্ণা দেবী শ্রদ্ধা করেন। কর্ম, ধর্ম, দুই-ই তারা সমানভাবে সামলাচ্ছে। বাইরের আর ঘরের দায়িত্ব দুই-ই মেনে এগিয়ে চলেছে। নারীমুক্তি আন্দোলন তাদের সে ক্ষমতা দিয়েছে। নারীকে এখনও বহুদূর যেতে হবে। আশাপূর্ণা দেবী মনে করেন পথ সঠিক, এখন শুধু জোর কদমে এগিয়ে চলা।

প্রতিভা বসুর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল বয়ঃসন্ধির সময়। ওঁর লেখা রোমান্টিক গল্প তখন গোগ্রাসে পড়েছি। বুঝিনি এ শুধু প্রেমের গল্পই নয়, এতে আছে সাধারণ মেয়েদের জয়ের ইতিবৃত্ত। সেই সময়ে এই বোধটা সজাগ না হলেও গল্পগুলোর সঙ্গে কোথায় যেন আত্মীয়তা খুঁজে পেয়েছিলাম নিজের অজান্তেই।

প্রতিভা বসু (ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত)

প্রতিভা বসুর বইয়ের নায়িকাদের তুলনায় ওঁর জীবনে বাধা এসেছে অল্পই। লেখাপড়ার ব্যাপারে বাড়ি থেকে কোনদিন বাধা আসেনি। প্রথম জীবনে ঢাকায় গায়িকা ছিলেন। রেকর্ড করতে কলকাতায় আসতেন প্রায়ই। সে সময় ভদ্র পরিবারের মেয়েদের তবলার সঙ্গে গান গাইবার প্রথাটিই বিজাতীয় ছিল। কিন্তু বাবা-মায়ের উৎসাহে তাও সম্ভব হয়েছিল প্রতিভার জীবনে। ‘মেয়েদের জোরে হাসা, গান গাওয়া, বাড়ির বাইরে যাওয়া, সবই বারণ ছিল। তাদের জীবন কাটত পূর্ণ অধীনতায়।’ প্রতিভার সৌভাগ্য তাঁর পরিবার এ ধরনের বাধানিষেধের বেড়া দিয়ে তাঁকে বাঁধেনি কোনদিন। ঢাকাতেই দিলীপকুমার রায়ের মধ্যস্থতায় বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়েছিল। পরে কলকাতায় একটি গানের আসরে সে আলাপ জোরদার হল। নিজেরাই ঠিক করলেন বিয়ের পাত্রপাত্রী। তখনকার দিনে স্বনির্বাচিত পাত্র – ‘সে পৃথিবীর সেরা পাত্র হলেও মা-বাবার কাছে হয়ে দাঁড়াত অযোগ্য।’ কিন্তু এ ব্যাপারেও কোনো বিশেষ সমস্যা দেখা দেয়নি। এরপর তো লেখার ব্যাপারে কোনো বাধা ওঠার প্রশ্নই আসে না। বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসুর বাড়ি হয়ে উঠল নতুন চিন্তা, নতুন মতের গর্ভকক্ষ।

নিষেধের মধ্যে নিজে বড় না হলেও আশেপাশের জীবন থেকে প্রতিভা সমাজে মেয়েদের পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছিলেন। খুব ছোটবেলাতে মায়ের সঙ্গে পাড়াপড়শির বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখতেন বাড়ির কর্ত্রী তাঁর স্বামীর পরিচয়েই ধন্যা। এমনকি এঁদের প্রতাপও ছিল স্বামীর কাছ থেকে ধার করা। দারোগার স্ত্রী প্রায় দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী আধা ম্যাজিস্ট্রেট। নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বা অস্তিত্ব বলতে মেয়েদের কিছুই ছিল না। ‘মেরুদণ্ড ভেঙে ভেঙেই মেয়েদের বড় করা হত।’ ছোটবেলাতেই মনে প্রশ্ন জেগেছিল প্রতিভার, কেন এমন হবে? বিয়ের পরে বুদ্ধদেবের বাড়িতে এসে ওঁর স্বাধীনতা কোনদিন ক্ষুণ্ণ হয়নি ঠিকই, তবু সে স্বাধীনতার সীমানা ছিল সেদিনের পরিবেশের বেড়ার মধ্যে বাঁধা। ‘আমরা ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকতাম কে কোথায় নিন্দা করে, কোথায় কী ভুলচুক হয়ে যায়!’ আজকের নারী নির্যাতন, বউ পোড়ানো নতুন কিছু নয়। প্রতিভা বললেন, ‘তখনও এসব পুরোদমে ছিল। শুধু সব কথা চাপা থাকত প্রতিটি বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে।’ মেয়েদের দুঃখের কথা কেউ বলত না, এমনকি মেয়েরা নিজেরাও নয়। প্রতিভা বসুর মতে এটিই মেয়েদের প্রধান ত্রুটি।

নারীর এই অধিকারহীন সামাজিক অবস্থার আরম্ভ কেমন করে হল, আলোচনা করতে গিয়ে প্রতিভা বসু দায়ী করলেন আর্য সভ্যতাকে। মহাভারতের নজির টেনে প্রমাণ করলেন তাঁর বক্তব্য। মহাভারতের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে নারীর অবমাননা আর নির্যাতন। জড়বুদ্ধি, উন্মাদ, নারী এবং নিম্নবর্ণ, এরা ছিল সমগোত্রীয়। তাই মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার এদের ছিল না, পুরুষেরা এদের সমানাধিকার দেবার কথা ভাবতেও পারত না। মহিলাদের জীবনে এই-ই হল আর্য সভ্যতার দান। বস্তুত অনার্য রমণী সত্যবতীর সাহস এবং পরাক্রম আর্য মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তিনি তাঁর পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে সমাজে সম্মানের আসনে বসাতে পেরেছিলেন। অথচ আর্য নারী কুন্তী রানি হয়েও তাঁর সন্তান কর্ণকে লোকনিন্দার ভয়ে সহজেই ত্যাগ করে গিয়েছিলেন। তবে প্রাচীন কাব্যের সঙ্গে সঙ্গে এই সমাজব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটেনি। আর্য সভ্যতার উত্তরসূরি পাশ্চাত্যের নারী আজ হয়তো ভারতীয়ার চেয়ে স্বাধীন। কিন্তু এ শুধু অধীনতার ডিগ্রির তফাত। দুজনই পুরুষশাসিত; কম আর বেশি।

প্রতিভার মতে মেয়েদের স্বাধীনতার চাবিকাঠি হল অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন। রোজগারি মেয়ের আদর হয়তো বাড়ে না, তবে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথটি সুগম হয়। ‘নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত হলে তবেই লোকে বাড়তে পারে।’ তবে নারীর কৃতিত্বের সঠিক সম্মান দিতে এখনও পৃথিবী কৃপণ। আমাদের দেশে লেখক লেখিকাদের মধ্যে পুরুষের সমান সম্মান মেয়েরা পায় না। নিজের লেখক জীবন সম্পর্কে গল্প করতে গিয়ে প্রতিভা বসু বললেন তাঁর লেখার প্রেরণা এসেছে বিয়ের আগেই। তবে ‘ডাকাবুকো সাহিত্যিকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে ওদিকে বহুদিন একদম ঘেঁষিনি।’ হুমায়ুন কবিরের অনুরোধে আবার লিখতে আরম্ভ করলেন নতুন করে। এরই মাঝে ছেদ পড়ল তাঁর প্রথম বৃত্তি, গানে। প্রতিভা বললেন, ‘আর্থিক ভাবে স্বাধীন হবার তাগিদ মনে মনে অনুভব করতাম।’ তাই রোজগারের দিকে মন দিলেন উনি। ‘মনের ময়ূর’ প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে লেখার চাহিদা বাড়ল, সুতরাং সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ হতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। নিজের উপার্জিত অর্থ, আর স্বামীর রোজগারের তফাত প্রতিভা বুঝতেন। ‘যতই আদরিনী হও না কেন, স্বামীই যদি পরিবারে একমাত্র রোজগেরে হন, তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করা স্ত্রীর পক্ষে আজকের যুগেও সম্ভব নয়।’ প্রতিভা বসুর এই কথার সত্যতা সব মেয়েই বোঝেন, বিশেষ করে যে মহিলারা নিজে উপার্জন করেন তাঁরা তো বটেই। প্রতিভার স্বামী বুদ্ধদেবের জগত ছিল বইকে ঘিরে। অর্থাৎ সংসারে প্রতিভার ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহত, ‘তবু আমি পরাধীনই ছিলাম।’

প্রতিভা বসু বললেন, ‘নারীমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হল মেয়েদের মধ্যে সচেতনতার উন্মেষ। প্রতিটি নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, তবেই পূর্ণ মুক্তি সম্ভব।’ শারীরিক শক্তি নয়, মনের শক্তিই হবে নারীর হাতিয়ার। দৈহিক শক্তি সমাজে প্রধান হলে বাঘ সিংহের রাজত্বে বাস করা উচিত। তাই দুর্বলতার দোহাই দিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। এর সঙ্গে নারীমঙ্গল, নারীমুক্তির জন্যে ব্যাপক সংগঠন প্রয়োজন। দু’একজনের প্রচেষ্টায় হাজার বছরের অন্ধকার সরে যাবার নয়। আশাপূর্ণা দেবীর মতো প্রতিভা বসুও সমস্যার সমাধান যুদ্ধে শেষ হবে ভাবেন না। উনি বললেন, ‘একজনের অপমান ঘোচাতে অন্যকে অপমানের ধুলোয় টেনে নামাবার দরকার কী? এতে সংসারে অপমানিতের সংখ্যা বাড়বে, এইমাত্র।’

প্রতিভা বসু, আশাপূর্ণা দেবী – বাংলা সাহিত্যের দুই কৃতী মহিলা। এঁরা আশির দশকের নারীমুক্তির আবহাওয়ায় বড় হননি, কিন্তু আজকের দিনের বহু মহিলার তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল। মনের দিক থেকে এঁরা মুক্ত। এঁদের লেখা আমাদের সম্পদ। তবু অনেক সময় অনেককে বলতে শুনেছি আশাপূর্ণা দেবী বা প্রতিভা বসু বড় মেয়েলি লেখেন। এই ‘মেয়েলি’ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক অবহেলা, অনেক উপেক্ষা। অর্থাৎ মেয়েলি বা মহিলা সম্পর্কিত কিছু ভাল হতে পারে না। জাতে উঠতে হলে চাই পুরুষালি ঢঙ। তাই কোনো মহিলার লেখার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশংসা হল উনি একদম পুরুষের মত লেখেন। পুরুষালি মূল্যবোধ আমাদের শিখিয়েছে নারীকে এমনই করে হেলা করতে। আশাপূর্ণা দেবী এবং প্রতিভা বসু শান্ত ভঙ্গিমায় আমাদের জানিয়েছেন নারীর জগতেরও মূল্য আছে, তার হাসিকান্না একান্ত বিদ্রূপের নয়। এঁদের লেখায় মেয়েরা নিজেদের কথা পড়ছে, নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এঁদের লেখা শুধু মেয়েদের জন্যেই নয়। পৃথিবীর মানুষের এক অর্ধাংশকে আশাপূর্ণা ও প্রতিভা আহ্বান জানিয়েছেন, তারা এসে দেখুক অন্য অর্ধাংশ কেমন করে বেঁচে থাকে।

সম্পাদকীয় সংযোজন

এই প্রসঙ্গে ‘অবসর’ পত্রিকার পাঠকবর্গকে জানাই, পুরোনো ‘অবসর’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় ( ১৫ই এপ্রিল, ২০১৮) প্রকাশিত প্রবন্ধে শমীতা দাশ দাশুপ্ত লিখেছিলেন আশাপূর্ণা দেবীর সৃষ্ট চরিত্রের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা। আগ্রহী পাঠকমণ্ডলীর জন্য রইল সেই লেখার ঠিকানা-
https://abasar.net/abasarold/abasar/PriyaCharitra_Shamita.htm

শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। বিগত পাঁচ দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অপরদিকে গোয়েন্দা গল্প রচনাতেও সুপটু। প্রথম উপন্যাস ‘দ্বন্দ্ব’ সানন্দা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। নিয়মিত লেখালেখি করে চলেছেন ‘সাপ্তাহিক বর্তমান,’ ‘সুখী গৃহকোণ,’ ও বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *