বরদাপ্রসাদের রেনেসাঁ
(মুখবন্ধ
মহুলপাহাড়ির ঢেন্ডুংরি টিলার কাছারিবাড়িতে সাড়ে চার বছর হয়ে গেল। এখানে এসেছিলাম দেশে করোনা ভাইরাসের আগমনের মাস খানেক আগে। নিজেকে বিভ্রান্ত অসহায় বোধ করছি ঢেন্ডুংরি-যাপনের শুরু থেকেই। ইদানীং তার প্রকাশ এতটাই যে, স্থানীয়রা আমাকে ডাকে পাগলাবাবু। বিষয়টি জানিয়ে সুবিচারের আশায় একাধিক পত্রপত্রিকায় চিঠি লিখেছি। পাষাণহৃদয় সম্পাদকেরা সেসব আবেদন কল্পকাহিনি ধরে নিয়ে, চিঠির বক্তব্য গল্প বিভাগে প্রকাশ করেছেন। পাঠককুল স্বভাবতই আমার ক্রন্দনমুখর আকুতির গুরুত্ব দেননি। তাই, আমার বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন এমন একটি পত্রিকায় পেশ করছি যেখানে গল্প ছাপা হয় না। আশা আছে, খরদৃষ্টি সম্পাদকের নজরে এটি আদ্যোপান্ত নন-ফিকশন সাব্যস্ত হবে। অতঃপর তাঁর সম্মতির সিলমোহর-প্রাপ্ত এই বাস্তব বৃত্তান্তকে কল্পকথা বলে কারও ভুল করার কোনও সম্ভাবনাই থাকবে না। পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ পাঠান্তে নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, রিয়েলিটি ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আর, যদি তা না হয়, যদি এরপরও কারও সন্দেহ জাগে এটি লেখকের স্বকপোলকল্পিত এক কাহিনি, তাহলে প্রবল হতাশায় ভেঙে পড়তে পড়তেও মেনে নিতে হবে যে, বরদাপ্রসাদের কালা জাদু শুধু আমাকে নয়, আমার সূত্রে বাকিদেরও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে।)
ঢেন্ডুংরি টিলার কাছারিবাড়ির মালিক আমি, কেবল খাতায়কলমে। কাছারি শাসন করেন আমার ঠাকুর্দার-ঠাকুর্দা বাবু বরদাপ্রসাদ রায়, তাঁর অনুগত পাইক সর্দার কালাচাঁদের সাহায্যে। রোজ সন্ধেয় কাছারিবাড়িতে দাবার আসর বসে। খেলার নিয়ম প্রচলিত দাবার তুলনায় কিছু আলাদা। গত কয়েক বছরে দাবার নেশা আমায় পেয়ে বসেছে। রোজই হারি। তবুও রোজ সন্ধেয় যখন কাছারিবাড়ির দরবারে রঙিন আলোগুলি জ্বলে ওঠে, গিয়ে বসি দাবার আসরে আমার আসনটিতে। প্রতিবারই বাজি রাখি কাছারিবাড়িতে আমার মালিকানা। সেদিন কী হল, আমি বাজি মাত করে বসলাম। লাফিয়ে উঠে বরদাপ্রসাদকে বললাম, “এবার দিন, আমার সম্পত্তি ফেরত দিন।”
বরদা আমার থুতনি নেড়ে দিয়ে বলেন, “কোন খুশিতে, পাগলাবাবু?”
“কেন, আমি যে বাজি জিতলাম!”
“কিন্তু, আমি তো বাজিতে কাছারিবাড়ি পণ রাখিনি।”
“কী রেখেছিলেন তবে?”
“কিছুই না।”
“তার মানে, বাজি জিতেও আমি কিছু পাব না!”
“পাওয়ার কথা নয়”, বরদাপ্রসাদকে ভাবুক দেখায়, “তবে, তুমি হলে গিয়ে আমার নাতির-নাতি বা, ওইরকম কিছু একটা। তাই, তোমার আবদার কিছুটা মেটাতে আমার আপত্তি নেই। কী চাও বলো, কাছারিবাড়ির মালিকানা ছাড়া?”
ভাবলাম, বরদাপ্রসাদ আমার ঠাকুর্দার-ঠাকুর্দা হলে, তিনি ১৯৪৭-এর বহুকাল আগের কোনও আমলের লোক, একটু জব্দ করা যাক। পরক্ষণেই মনে হল, শয়তানি বিদ্যা জানা লোকটার অসাধ্যও কিছু নেই। সেক্ষেত্রে, দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে, নাকের বদলে নরুনই সই ভেবে বললাম, “আমি দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার দিনটি দেখতে চাই।”
বরদা কালাচাঁদের দিকে চান, কালাচাঁদ বরদার দিকে। বরদা ভ্রূ কুঁচকে বলেন, “কোন দেশের?”
পত্রপাঠ জবাব দিই, “ভারতবর্ষের।”
“কার কাছ থেকে?”
“ইংরেজের কবল থেকে।”
বরদা অট্টহাস্য করেন। বলেন, “সেটা কি স্বাধীনতা পাওয়ার দিন? না কি, দেশ ভাঙার দিন?”
“ওই হল”, কাঁধ ঝাঁকাই, “একই তো ব্যাপার।”
“কখনওই না”, বরদা জোরে জোরে মাথা নাড়েন, “দেশ ভাঙার পর তুমি আর তার সঙ্গে বর্ষ যোগ করতে পারো না। ভারতবর্ষ নয়, বলো যে ভারতের স্বাধীনতার প্রথম দিবসটি প্রত্যক্ষ করতে চাও।”
ফিচেল বুড়ো বরদাপ্রসাদের সঙ্গে কূটতর্কে পেরে উঠব না জানি। জবাব দিলাম, “ইয়েস, ওই দিনটিতে পৌঁছতে চাই।”
বরদাপ্রসাদ উঠে দাঁড়ান। “কালাচাঁদ, ছোকরার ইচ্ছেপূরণ করা যাক।”
“হুজুরের হুকুমে হাকিম হাজির হয়। আমি কোন ছাড়! আসেন।” সিড়িঙ্গে কালাচাঁদ দুই হাতে দুটি রনপা নিয়ে তৈরি। একঝটকায় বরদাপ্রসাদ আর আমাকে নিজের দুই কাঁধে তুলে রনপায় উঠে দাঁড়ায়। চকিত গতিতে কাছারিবাড়ির দরবার ঘর থেকে বেরিয়ে পৌঁছয় টিলার সবচেয়ে উঁচু জায়গাটিতে। সেখান থেকে ঝাঁপ দেয়। আমি ভয়ে চোখ বুজি। কোথাও আছড়ে পড়ি না, মরিও না। চোখ খুলে দেখি, কালাচাঁদের রনপা দুটি বন বন করে হেলিকপ্টারের পাখার মতো ঘুরছে। আকাশ, সমুদ্র, জঙ্গল, মরুভূমি, আলো, অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কালাচাঁদ এবং তার কাঁধে সওয়ার বরদাপ্রসাদ ও আমি কোথায় চলেছি কে জানে! ভাবতে ভাবতেই পাখির চোখে দেখি নীচে এক আলোকসজ্জিত শহর। কানে আসে দূরাগত কণ্ঠস্বর–
“Long years ago we made a tryst with destiny, and now the time comes when we shall redeem our pledge, not wholly or in full measure, but very substantially. At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom …”
কালাচাঁদ ঝুপ করে নামল ও থামল এক বাড়ির তেতলার একটি ঘরের দরজার বাইরে ঝুলবারান্দায়। বরদাপ্রসাদ রেলিংয়ে ঝুঁকে ঘোষণা করলেন, “দ্যাখো। কলকাতা। সাল ১৯৪৭। চোদ্দোই আগস্টের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা …” বরদাপ্রসাদের ঘোষণা শেষ হতে না হতে গির্জার ঘড়ির ঘণ্টা ঢংঢং করে বেজে উঠে ১৪ আগস্টের শেষ এবং ১৫ আগস্টের সূচনা ঘোষণা করে মধ্যরাতে। মহানগর কলকাতা জেগে আছে। আলোয় সেজে উঠেছে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজধানী। ময়রারা মিষ্টি গড়ছে, ফুলের কারবারিরা সাজাচ্ছে ফুলের তোড়া এবং মালা। দর্জিরা স্বাধীন ভারতের পতাকা বানাচ্ছে। সূর্যের আলো ফুটলেই শুরু হবে স্বাধীন দেশের প্রথম দিনের প্রভাত ফেরি। উৎসবের আবহাওয়ার মধ্যেও অনুভূত চাপা থমথমে কী হয় কী হয় ভাব। খবর আছে, বেলেঘাটায় হায়দারি মঞ্জিলে উপস্থিত মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী এবং হুসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দি। সবার আশা, মহাত্মার উপস্থিতিতে এবং ইতিহাস হয়ে যাওয়া অবিভক্ত বাংলার সদ্য ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবে, গত বছরের এই সময়ের পুনরাবৃত্তি হবে না, শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটবে না।
“কিন্তু, ওই বক্তৃতার আওয়াজ কোথা থেকে আসছে!”
বরদাপ্রসাদ আমার কাঁধে টুসকি দিয়ে পিছনে অলিন্দের লাগোয়া দরজা দেখান। দরজা খোলা। ঘরের ভিতরে এক প্রৌঢ়, এক প্রৌঢ়া। বরদা ফিসফিসিয়ে বলেন, “আমার নাতির-নাতি আর নাতবউ।”
“আপনার নাতির-নাতি!” প্রতিবাদী স্বরে বলি, “সে তো আমি! আমি তো বিয়েই করিনি। আপনার নাতবউ আসছে কোত্থেকে?”
বরদাপ্রসাদকে বিপন্ন দেখায়, ঘুরে রনপারোহীকে বলেন, “কালাচাঁদ!”
কালাচাঁদ তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে, “এতটা লেখাপড়া আমার নাই, আজ্ঞে। আপনারাই বিচার করেন।”
বরদা আমার দিকে ঘোরেন, গর্জন করেন, “তুমি আমার কে হে?”
অবাক হয়ে বলি, “আপনার নাতির-নাতি।”
“কে বলেছে?”
“আপনি স্বয়ং।”
“ভুল বলেছি”, বরদাপ্রসাদ বোঝান, “এমন হয়। বয়স ধরো আমার কম হল না। এই বয়সে স্মৃতিবিভ্রম যদি না হয়, আর কবে হবে!”
“তাহলে”, ঘরের মধ্যে সোফায় বসা পুরুষটিকে দেখিয়ে বলি, “উনি আপনার নাতির-নাতি?”
“দ্যাটস রাইট!”
“আর, ওঁর পাশে বসা ওই মহিলা …”
বরদা একগাল হেসে বলেন, “নাতির-নাতির বউ।”
“তাহলে, উনি আপনার নাতবউ নন?”
বরদা কয়েক মুহূর্ত এদিক-ওদিক দেখে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “তুমি তো আচ্ছা আহাম্মক! তোমার পরিচয়ের মূলে পৌঁছতে গেলে আমাকে নাতির-নাতির-নাতির-নাতির … রেলগাড়ি চালাতে হবে। তোমার বউ, যে এখনও নেই, কখনও হবে বা হবে না, যদি হয়, তার ক্ষেত্রেও রওনা করতে হবে আর এক রেলগাড়ি! আমাকে ভাবোটা কী! না হয় বুড়ো ভামই ভাবলে, কিন্তু এই তথ্য তুমি যাদের জানাচ্ছ তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় থাকবে শেষ স্টেশনে পৌঁছে তোমার কাহিনির শেষটা জানতে! তার আগেই ‘গুলি মারো গল্পের’ বলে চেন টেনে কোথাও নেমে যাবে না?”
“গল্প নয়”, আমি গম্ভীর স্বরে বলি, “বাস্তব। ইতিহাস।”
“সে না হয় তাই হল। কিন্তু, পরিচয়পর্ব ইতিহাসের বারো আনা দাঁড়ালে, পাঠক চেন টানবে কি টানবে না?”
পরীক্ষিত সত্য যে, এর জবাব একটাই। নতমস্তকে বলি, “টানবে।”
“এই!” বরদাপ্রসাদ পাছা চুলকে বলেন, “এই কারণেই আমি আমার উত্তরপুরুষদের সবাইকে নাতি, নাতির-নাতি ইত্যাদি বলি এবং তাদের সবার স্ত্রী-ই আমার চোখে নাতবউ। বুঝলে না, অবাঞ্ছিত জটিলতা এড়াতে এটাই আমার পলিসি।”
“গুড পলিসি”, জিজ্ঞেস করি, “ওই সামনে সোফায় বসা উনি, আপনার নাতি, নাতির-নাতি, তস্য … যা-ই হোন, নাম কী? কী করেন?”
“ও হল অচিন্ত্যপ্রসাদ রায়, আইসিএস”, বরদাপ্রসাদ জানান, “ওর পাশে ওর বউ প্রভা, বিদুষী মেয়ে।”
“আপনার নাতবউ?”
“ওই আর কী”, বরদাপ্রসাদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, “নাতি, নাতির-নাতি, তস্য, তস্য-তস্য … সম্পর্কিত কেউ একজন”, পরক্ষণেই মহাবিরক্তিভরে প্রশ্ন করেন, “তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো হে! ভারতের স্বাধীনতার প্রথম দিনটি প্রত্যক্ষ করা? না কি, আমার বংশলতিকা যাচাই করা?”
এই রে! বরদাপ্রসাদ চটে যাচ্ছেন। গলায় মধু ঢেলে বলি, “ওই প্রথমটা।”
“তাহলে, বাজে কথায় সময় ব্যয় না করে, যা দেখার দেখে নাও।”
অচিন্ত্য ও প্রভার সামনে ক্যাবিনেটে এক ঢাউস রেডিয়ো। রেডিয়োতে বাজছে– “And to India …”
বরদাপ্রসাদ আমার কানে কানে বলেন, “স্বাধীন ভারতের গণপরিষদে স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বক্তিমে করছে।”
“চুপ করুন তো মশায়”, ধমকে বলি, “শুনতে দিন।”
“And to India, our much loved motherland, the ancient, the eternal and the ever-new, we pay our reverent homage and we bind ourselves afresh to her service.” বক্তৃতা শেষ হল।
দীর্ঘশ্বাস পতনের আওয়াজ। অচিন্ত্য স্বগতোক্তি করেন, “বাংলা শেষ হয়ে গেল। বাঙালিদের, অন্তত নদীর এপারে, মেরুদণ্ড ভেঙে গেল। এই জাতিটা আর কখনও উঠে দাঁড়াতে পারবে!”
“কী অলক্ষণে কথা বলছ!” মৃদু তর্জন করেন প্রভা, “আজ এই শুভ মুহূর্তে …”
“সরি, প্রভা”, বিষণ্ণ শোনায় বংশের প্রথম আইসিএস অফিসারকে, “আমার মনে আনন্দ নেই একটুও।”
“মহাত্মা গান্ধীও গত কাল একই কথা বলেছেন”, নরম গলায় বলেন প্রভা, “তাঁর মনে আনন্দ নেই। তিনি আজ উৎসবে সামিল হবেন না। কিন্তু, তিনি দুঃখিত দেশটা ভাগ হয়ে গেল এবং ভাগ হল ধর্মের কারণে বলে। সে-কথা অবশ্য বাংলার ক্ষেত্রেও সত্যি। কিন্তু, এছাড়া তো কোনও উপায়ও ছিল না।”
“সারা দেশ আর বাংলার পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা আলাদা। স্বাধীন দেশে অন্যদের ভবিষ্যৎ আর বাঙালির ভবিষ্যৎ একরকম হবে না।”
ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বদলির চাকরি। অবিভক্ত ভারতের বহু জায়গায় কাজ করেছেন অচিন্ত্য। সহধর্মিণী প্রভাও সেসব জায়গা দেখেছেন তাঁর সঙ্গে। অচিন্ত্য চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন প্রায় বিশ বছর আগে। তবু, খবর রাখেন। বাড়িতে অনেকগুলি সংবাদপত্র আসে। রেডিয়োয় খবর শোনেন নিয়মিত। ছেলে বিনয়ও আইসিএস অফিসার। সে বাড়ি এলে বাপ-ছেলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়, তর্কবিতর্কও। আজ বিকেলেও বিনয় ফোন করেছিল। সে দিল্লিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার উৎসব উদযাপনের আয়োজনে ব্যস্ত। অচিন্ত্য খবর রাখেন। হয়তো তাঁর উদ্বেগ অমূলক নয়। প্রভা নরম গলায় বলেন, “কে জানে তুমি কী ভাবছ! ক্ষতি তো হলই। এর জন্যে দায়ী রাজনীতি, দায়ী জিন্না আর হয়তো নেহরুও খানিকটা।”
অচিন্ত্য হাত ঝাড়া দিয়ে বলেন, “জিন্না আর নেহরু! একা ওরা কী করতে পারে!”
“করল তো”, প্রভা যুক্তি দেন, “দেশের মানুষও ওদের কথায় নেচে উঠল। মুসলমানরা চাইল পাকিস্তান আর হিন্দুরা ইন্ডিয়া নামে ভারত।”
“দেশের মানুষ!” অচিন্ত্য মাথা নাড়েন, “না, এ দেশের মানুষের রায় নয়। একা জিন্না বা নেহরুর ক্ষমতা ছিল না দেশ ভাগ করার।”
“তা ঠিক”, প্রভা সায় দেন, “মূলে ষড়যন্ত্র তো ব্রিটিশদের। ওরাই সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুলের কৌশলেই যাওয়ার আগে দেশটা দু’ভাগে কেটে দিয়ে গেল।”
“না। ব্রিটিশদের উপরে দায় চাপিয়ে দেওয়া মুর্খামি।”
প্রভা হাসেন, “তুমি ব্রিটিশের চাকরি করেছ, ওদের নুন খেয়েছ। তোমার এই আবেগ স্বাভাবিক।”
“না, প্রভা”, অচিন্ত্য মাথা ঝাঁকান, “আবেগের বশে আমি কিছুই বলছি না। যুক্তির কথাই বলছি। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবে, দেশভাগের আসল কারবারি ওরা নয়।”
অবাক চোখে চান প্রভা, “তাহলে, কারা?”
“প্রভা, হিন্দু আর মুসলমান এদেশে প্রায় হাজার বছর পাশাপাশি বাস করেছে। ব্রিটিশ আমাদের শাসন করতে ডিভাইড অ্যান্ড রুল প্রয়োগ করেছে এ-কথাও ঠিক। ইংরেজ শাসনের আগে চোখে পড়ার মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর তেমন নেই। কিন্তু, ইংরেজের নীতির ফলে দাঙ্গার প্রকৃতি আর গত কয়েক বছরের সাম্প্রদায়িক অসদ্ভাব আর দাঙ্গার প্রকৃতির মধ্যে অনেকটাই ফারাক আছে।”
প্রভা জিজ্ঞাসু চোখে চান। অচিন্ত্য ব্যাখ্যা করেন, “গত বছর এই সময়ে কলকাতায় যে দাঙ্গা হল, তাতে শহরের ক’জন মুসলমান হিন্দুকে মেরেছে, শহরের ক’জন হিন্দু মুসলমান মেরেছে?”
“তাহলে, কারা মেরেছে?”
“ভেবে দেখো, উত্তর পাবে। লরি ভর্তি করে শহরের বাইরে থেকে গুন্ডা এসেছিল, তাদের আনা হয়েছিল। দাঙ্গা যে হবে তার প্রচার হয়েছিল। সাম্প্রতিক দাঙ্গাগুলো সব ক’টাই পরিকল্পিত, রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত। চার দিকে তাকিয়ে দেখো, যেখানে প্রচার নেই, পরিকল্পনা নেই, রাজনৈতিক সংগঠন নেই, সেই সব প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে দাঙ্গা হয়নি।”
“তাহলে, নোয়াখালি কীভাবে ঘটল?”
“একইভাবে।”
“কী বলতে চাইছ তুমি?” প্রভা সবিস্ময় প্রশ্ন করেন।
“নোয়াখালিতে হয়েছে, বাংলার সর্বত্র তো হয়নি। দাঙ্গার পরিকল্পনা করতে, প্রচার করতে, দাঙ্গা সংগঠিত করতে টাকা লাগে। লরি ভর্তি করে গুন্ডা আনতে টাকা লাগে। একটু আধটু নয়, লাখ-লাখ কোটি-কোটি টাকা। রাজনৈতিক দলগুলো এই টাকা পায় কোত্থেকে?”
“কোত্থেকে?”
“ব্যবসাদারদের কাছ থেকে, কারবারি, শিল্পপতিদের কাছ থেকে”, অচিন্ত্য বলেন, “জিন্নার পিছনে আছে মুসলমান কারবারিরা, মূলত করাচির শিল্পপতিরা। নেহরুর পিছনে তেমনই ভারতীয় শিল্পপতিরা, বেশিরভাগই মাড়োয়ারি আর গুজরাতি। দেশ ভাগ হলে লাভ যেমন রাজনৈতিক নেতাদের, তেমনই শিল্পপতিদের। ইংরেজ শাসকের ফেলে যাওয়া শাসন দখল করে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় আসবে, মন্ত্রী হবে। আর, ইংরেজ কারবারির ফেলে যাওয়া কারবার দখল করে ভারতীয় শিল্পপতিরা আরও বেশি মুনাফা কামাবে।”
“কেমন কম্যুনিস্টদের মতো কথা বলছ!” অনুযোগ করেন প্রভা, “তুমি কি মনে করো ইংরেজের শাসনটাই ভাল ছিল?”
“না”, মাথা নাড়েন অচিন্ত্য, “তা আমি মনে করি না। আমরা কম্যুনিস্টও নই। আমি ছিলাম আইসিএস অফিসার, আমাদের ছেলেও তা-ই। আমি ব্রিটিশের অধীনে কাজ করেছি। আমার ছেলে গত কাল পর্যন্ত আদেশ পালন করেছে ব্রিটিশ শাসকের, আজ থেকে করবে ভারতীয় শাসকের। আমাদের নাতিও হয়তো সিভিল সার্ভিসে আসবে। আমাদের কাজের ধারা বদলাবে না। স্বাধীন ভারতে নির্বাচন হবে, পালা বদল হবে, এক সরকার যাবে, আর এক সরকার আসবে। আমরা শাসনতন্ত্রের কলকব্জা, নাট-বল্টু হিসাবে আমাদের কাজ করে যাব। কিন্তু, যেভাবে স্বাধীনতা এল তাতে সাধারণ মানুষের চিন্তা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গা নেই। অথচ, তাদেরই দোহাই দেওয়া হবে। তাদের একটা অংশ উৎসবও করবে আজ ভোর থেকে। সবাই বোকা বনে গেল, প্রভা, দুঃখটা এখানেই। আরও দুঃখ যে, সবচেয়ে বোকা বনল বাঙালি।”
প্রভা স্তব্ধ বসে থাকেন। অচিন্ত্য বলেন, “আজ উৎসব হবে। কিন্তু, এখনও দুই দেশের সীমানা ঘোষিত হয়নি। দেখে নিয়ো, সেই ঘোষণার পর কী হয়! নিজের দেশ বিদেশ হয়ে যাবে হঠাৎ।
কে যে উদ্বাস্তু হবে তা এখনও ঠিক করে জানে না অনেকেই। জানার পর যে আঘাত নেমে আসবে, হাহাকার উঠবে, সেই ক্ষতের নিরাময়, সেই শোকের প্রশমন কখনও ঘটবে বিশ্বাস হয় না। প্রভা, এ অতি কঠিন অসুখ। দুরারোগ্য এই ব্যাধিতে আক্রান্ত দেশের উপশমের ওষুধ কারও কাছে নেই। থাকার কথা নয়।”
আমি শিউরে উঠে বলি, “কী ভয়ংকর!”
“ভয়ংকরের দেখেছো কী!” বরদাপ্রসাদ মন্তব্য করেন, “ভয় দেখতে যেতে হবে অন্যত্র। আমার অন্যান্য উত্তরপুরুষদের মহল্লায়।”
“কোথায়?”
বরদা হাঁক পাড়েন, “কালাচাঁদ! নদী পেরিয়ে একটা দিন পিছনে চল।”
১৯৪৭। ১৪ই আগস্ট। গ্রাম জগদীশপুর, জেলা শ্রীহট্ট। ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে আজ। ব্রিটিশ ভারতবর্ষের আরও একটি টুকরো ইন্ডিয়া আগামীকাল না কি স্বাধীনতা পাবে। মুসলমান বাড়িগুলিতে স্বাধীন পাকিস্তানের ঝান্ডা উড়ছে সকাল থেকে। সবুজ কাপড়ে সাদা চাঁদ-তারা আঁকা। হিন্দু পরিবারগুলিকেও অনেকেই বলে গিয়েছে পতাকা ওড়াতে। শুভাকাঙ্ক্ষী মুসলমান সজ্জনেরা বলেছেন, “ঝামেলায় গিয়ে কী কাজ! কে কোথায় কী কানাকানি করবে, কী ব্যাখ্যা করবে তার ঠিক কী! ফ্ল্যাগ লাগিয়ে নাও বাড়িতে। ঘরে না থাকলে, আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি, আমাদের কাছে আছে।”
একটু বেলার দিকে হিন্দু বাড়িগুলিতেও স্বাধীন পাকিস্তানের পতাকা উড়তে শুরু করে। পরিবারগুলিতে গত কয়েক মাস ধরে চলে আসা বিভ্রান্তি তাতে থামে না। বরং, চাপা স্বরে জল্পনা বেড়ে ওঠে। শোনা গিয়েছে র্যাডক্লিফ সাহেব মানচিত্রে কলমের দাগে দেশ কেটে ভাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু, ঠিক কোথায় কীভাবে কাটলেন, কার ভাগে কী পড়ল, সে এখনও সবটা জানা যায়নি।
রায়বাড়ি জগদীশপুর গ্রামের পরিচিত হিন্দু পরিবার। অনেকটা জায়গা নিয়ে তাদের বসতবাড়ি। একালের কর্তারা বলেন, সেকালে কর্তাদের আমলে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ, চার দিকে মাটির পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সামনে প্রাঙ্গণ ছিল প্রকাণ্ড, যেন ফুটবল খেলার ময়দান। তারপর কবে একান্নবর্তী পরিবার ভিন্ন হয়েছে, বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের মাঝ বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমে টানা মাটির পাঁচিল উঠেছে। পাঁচিলের দু’দিকেই উঠোন ছোট হয়ে গিয়েছে। তবুও যা আছে এখনও, সেও খুব কম নয়। পাঁচিলের উত্তরে যেমন, দক্ষিণেও তেমনই পারিবারিক বাস্তু এলাকার প্রান্তবর্তী অঞ্চলে একটি করে লম্বাটে মাটির বাড়ি। পাঁচিলের দু’পাশের দুই বাড়িই কিছুটা খড়ে, কিছুটা টিনে ছাওয়া। দু’দিক থেকেই নিজের নিজের অংশের পশ্চিমের দরজা পেরলেই লাগোয়া জমিতে আম, কাঁঠাল, লেবু, কলা ইত্যাদি ফল এবং জারুল, কাঞ্চন, বেলি, কামিনী, টগর প্রভৃতি ফুলের গাছ। আগাছার জঙ্গলও আছে কিছু। তারমধ্যেই সরু পথ চলে গিয়েছে পুকুরপাড়ে। পুকুরের জল দুই বাড়ির লোকেই ব্যবহার করে। পাঁচিলের দক্ষিণে বাড়িটি বড় তরফের কর্তা ফণীন্দ্রর। তাঁর সহোদর ভাই মণীন্দ্র ও ভ্রাতৃবধূ সুভাষিণী দুজনেই গত হয়েছেন। উত্তরে ছোট তরফের কর্তা তাই এখন তাঁদের সন্তান ব্রজেন্দ্র। বয়স উনচল্লিশ। সংসার আলাদা হলেও, জেঠা ফণীন্দ্রকে তিনি অভিভাবক মানেন। কাজেকর্মে তাঁর পরামর্শ নেন। মণীন্দ্রও দাদাকে মান্য করতেন। পারিবারিক শিক্ষার কারণেই ব্রজেন্দ্র মণীন্দ্রকে বলতেন বাবা আর জেঠা ফণীন্দ্রকে বড়বাবা, জেঠিমা ননীবালাকে বড়মা। ফণীন্দ্রর পুত্র সমরেন্দ্র ওদিকে খুড়ো মণীন্দ্রকে সম্বোধন করতেন ছোটবাবা। ব্রজেন্দ্র সমরেন্দ্রকে ডাকেন বড়দা। উত্তরাধিকারসূত্রে ব্রজেন্দ্রর কিছু চাষের জমি আছে, একটি মুদি দোকানও আছে গ্রামে। সমরেন্দ্র ডাক বিভাগে চাকরি করেন, শ্রীহট্ট শহরে একাই থাকেন। সপ্তাহান্তে গ্রামে আসেন। জমিজমা তাঁদেরও কিছু আছে। ফণীন্দ্রর বৈঠকখানায় কথা হচ্ছিল। ব্রজেন্দ্রকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তিনি বলছিলেন, “বড়বাবা, কী হবে বলুন তো? সিলেট কি ইন্ডিয়ায় থাকবে, না কি পাকিস্তানেই যাবে?”
ফণীন্দ্র হুঁকোয় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটু কেশে নিয়ে বলেন, “এইটা বলা মুশকিল। থাকা তো উচিত ইন্ডিয়ায়। কারণ, কাল অব্দিও সিলেট তো ছিল আসামের পার্ট। আসাম ইন্ডিয়াতেই যাবে। কিন্তু …”
“সিলেট পাকিস্তানেই যাবে”, মাথা নাড়েন সমরেন্দ্র, তিনি বয়সে ব্রজেন্দ্রর চেয়ে কিছু বড়, যুক্তি দেন, “শুধু সিলেট ধরলে, মুসলিমরা মেজরিটি। মুসলিম লিগ জোর প্রচার করেছে, গত মাসে গণভোটেও ম্যাসিভ মার্জিনে জিতেছে। ওরা তো চেয়েছিল গোটা আসামকেই পাকিস্তানে নিতে। সে হবে না। কিন্তু, সিলেট ওরাই নেবে। কংগ্রেসও তো ভুল করল। কয়েক বছর আগে যখন ফজলুল হক কৃষক প্রজাপার্টির নেতা ছিলেন, প্রস্তাব দিয়েছিলেন আসামের অন্তত বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বাংলার অংশ মানা হোক। কংগ্রেস সেই প্রস্তাব কানে তোলেনি। তুললে, আজ সেই জায়গাগুলোর সঙ্গে সিলেটেরও ইন্ডিয়ায় যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকত। সে আর নাই।”
“তাহলে”, ব্রজেন্দ্র আকুল হয়ে প্রশ্ন করেন, “আমরা কোথায় যাব, বড়দা?”
সমরেন্দ্র জবাব দেন না। তাঁকেও চিন্তিত দেখায়। ফণীন্দ্র গম্ভীর হয়ে বলেন, “যাবি আর কোথায়! এখানেই থাকবি। সিলেট ইন্ডিয়ার হোক আর পাকিস্তানের, আমাদের তো মাতৃভূমি। মাকে ছেড়ে যাব কোথায়। সবাই এখানেই থাকব।”
“বলছেন, বড়বাবা!” ব্রজেন্দ্রকে কিঞ্চিৎ আশান্বিত দেখায়।
সমর বলেন, “ব্রজ, আর ক’টা দিন দেখ। তারপর যা হয় করা যাবে।”
“কী করার কথা বলছিস তুই, সমরা!” চটে ওঠেন ফণীন্দ্র।
সমরেন্দ্র জবাব দেন না। ইশারা করেন খুড়তুতো ভাইয়ের দিকে। ব্রজেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসেন জেঠামশায়ের বাড়ি থেকে।
১৫ আগস্ট সকালে জগদীশপুরে কোনও বাড়িতে ভারতের তেরঙা পতাকা উড়ল না। সিলেটের কোথাওই ওড়েনি শোনা গেল। রায়বাড়ির দুই তরফেই থমথমে ভাব। আকাশ চিরে ফিনকি দিয়ে ছোটা বিদ্যুল্লতা আগেই দেখা গিয়েছিল। দেশ ভাগ তো হবেই, হয়েওছে। ভাগাভাগির বজ্রগর্জন শোনা গেল দু’দিন পরে, আগস্টের ১৭ তারিখে। আকাশ ভেঙে মাথায় বাজই পড়ল যেন। সমস্ত কল্পনা পিষে দিয়ে কোথা থেকে নেমে এল দৈত্যের মতো বাস্তব। ঝলসে দিয়ে গেল পদ্মার পূর্বপারে সংখ্যালঘুর আশার শেষ মিনারটিকে। র্যাডক্লিফ লাইন ঘোষিত হয়েছে। মানচিত্রে শ্রীহট্ট দ্ব্যর্থহীন চিহ্নিত পাকিস্তানের অংশ।
“কিন্তু, বড়দা”, ব্রজেন্দ্র বলেন, “আমাদের এই দিকটা তো হিন্দু মেজরিটি!”
“ওভাবে হয় না, ব্রজ”, বোঝান সমরেন্দ্র, “চারদিকে মুসলিম মেজরিটি, মাঝখানে এক-আধটা হিন্দু পকেট, দেশের ভাগাভাগি ওভাবে হয় না। ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রেও এমন অনেক হয়েছে, হিন্দু মেজরিটির মধ্যে মুসলিম পকেটগুলো ইন্ডিয়াতে পড়েছে।”
“আমরা কী করব, বড়দা?”
সমরেন্দ্র ভাইকে দেখেন কয়েক মুহূর্ত। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, “দেশ ছাড়তে হবে, ব্রজ। আমি কলকাতায় পোস্টিং চেয়ে অ্যাপ্লিকেশন করেছি মাস খানেক আগেই। আমাদের ইন্ডিয়াতেই যেতে হবে।”
“ইন্ডিয়ায় কোথায় যাব!” ব্রজেন্দ্র কাতরে ওঠেন, “ওখানে আমাদের কে আছে? কী আছে?”
“সে এক-আধ জন চেনাজানা হয়তো পাওয়া যাবে। সেটা বড় কথা না। কারও ভরসায় নয়, ব্রজ, আমাদের পালাতে হবে নিজের দায়িত্বে, জান-মান বাঁচাতে।”
“এখানে কোনওমতেই থাকা যায় না?”
“তোর কী মনে হয়?” সমরেন্দ্র ধীরে ধীরে বলেন, “আজ মামুদ এসেছিল, নুরুল চাচা এসেছিলেন। ক’দিন আগেও ওরা বলেছিল, কোথাও যাওয়ার দরকার নাই, এখানেই থাকবা তোমরা। আজ বলে গেল, চলেই যাও, সময় খারাপ, কখন কী হয় বলা যায় না।”
ব্রজেন্দ্র মাথা নামান, “আমার কাছেও এসেছিল”, পরক্ষণেই মুখ তুলে বলেন, “কিন্তু, বড়বাবা রাজি হবেন?”
সমরেন্দ্র মাথা দোলান, “বাবাকে নিয়েই তো সমস্যা! দেখি, বুঝিয়েসুঝিয়ে। চারদিকে সব দেখেশুনে বাবাও হয়তো শেষপর্যন্ত মত দেবে।”
“কবে যাব আমরা? জোগাড়যন্ত্র তো আছে। যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না!”
“হুট করেই যেতে হবে, ব্রজ। আমার একটু সময় লাগবে। বাবাকে বোঝানোর ব্যাপার আছে, ছেলেটা কলেজে পড়ছে, সিলেট টাউনে হস্টেলে থাকে, ওকে আনানোর ব্যাপার আছে। আর, ব্যাংকের ক’টা টাকা যদি … আমার ক’দিন দেরি হবে। তুই চলে যা, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করিস না।”
“আমরা একসঙ্গে যাব না!” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন ব্রজেন্দ্র।
“না”, মাথা নাড়েন সমরেন্দ্র, “বাবা যদি এখনই রাজি থাকত, ছেলে যদি গ্রামে থাকত, ব্যাংকের টাকাটা হাতে থাকত, তবুও দুই বাড়ির দুটো সংসার একসঙ্গে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া নির্বোধের কাজ হত।”
কারণটা যে ব্রজেন্দ্র বোঝেন না তা নয়। তবু বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করেন, “কেন, বড়দা?”
“সবাই জানতে পারবে যে!” সমরেন্দ্রকে দুঃখিত দেখায়, তিনি বোঝান, “সঙ্গে টাকাকড়িও তো কিছু নিতে হবে। তারপর ধর, মেয়েদের গায়ের গয়না। এতটা রাস্তা, কোথায় কী হয়, কার মনে কী আছে!”
“আমি তবে আগে চলে যাব?”
“যা।”
“কবে যাব?”
সমরেন্দ্র হাসেন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তৈরি থাকলে, আজই যা।”
আরও ক’দিন যায়। নানা খবর আসতে থাকে গ্রামে। নানা কানাকানি। কতটা তার সত্য, কতটা মিথ্যা বোঝার উপায় নেই। একদিন পাশের গ্রামে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠার খবর এল। ব্রজেন্দ্রও দেখলেন মাঠের আলে দাঁড়িয়ে, দূরে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দুলতে দুলতে উঠছে আকাশে। বাতাসে অস্পষ্ট আর্তনাদ। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে সমরেন্দ্রকে বলতে এলেন, “বড়দা, …”
সমরেন্দ্র থামিয়ে দিলেন ভাইকে। “না, কিচ্ছু বলবি না, কাউকে না, আমাকেও না। যা কর্তব্য বুঝবি, করবি, নিজের দায়িত্বে করবি”, মুহূর্ত খানেক থেমে বলেন, “পাশে কেউ নাই রে!”
সে-দিনই ভারত রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ব্রজেন্দ্র। রাতেই জগদীশপুর ছাড়বেন। ক’দিন ধরেই আলোচনা চলছিল বাড়িতে। মানসিকভাবে সকলেই প্রায় প্রস্তুত। ব্রজেন্দ্র পই পই করে বললেন স্ত্রী রাধামণিকে যে, যথাসম্ভব হালকা হয়ে যেতে হবে, সঙ্গে জিনিসপত্র যেন প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছু নেওয়া না হয়। সন্ধেয় প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে চোখ কপালে ওঠে তাঁর। আধ ডজন পেল্লাই আকারের পুঁটলি, সমসংখ্যক বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি, গুটি তিন প্রমাণ সাইজের স্টিলের ট্রাংক। মাথা চাপড়ে বলেন, “পাগল হয়েছ! এত বোঝা! কে নিয়ে যাবে? কীভাবে নিয়ে যাবে?”
রাধামণি পুঁটলি বাঁধতে বাঁধতে বলেন, “সবই তো ফেলে যাচ্ছি। এই ক’টা জিনিস নেব না!”
“কী আছে এগুলোতে?”
“জামা-কাপড়, চাল-ডাল-তেল-নুন-চিনি-মশলা, গাছের ফলমূল কিছু …”
“ফেলে দাও”, হাঁক পাড়তে গিয়ে থমকান ব্রজেন্দ্র, দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, “ফেলে দাও। সব ফেলে দাও বলছি!”
“ও মা! ফেলব! ঘরের জিনিস!”
“ঘরের জিনিস! বলে ঘর ফেলে যেতে হচ্ছে, আর ইনি দেখাচ্ছেন ঘরের জিনিস! ফেলবে না তো কি মাথায় বয়ে নিয়ে যাবে এত সব?”
“আহ্! আমরা বইব কেন!” রাধামণি বোঝান, “যাব তো গরু গাড়িতে। সব ধরে যাবে, দেখো।”
“যাব তো গরু গাড়িতে!” ভেঙান ব্রজেন্দ্র, “জগদীশপুর থেকে ইন্ডিয়া যাবে গরু গাড়িতে! আর, গরু গাড়ি জুতলে লোকে জানবে না! গরু হাম্বা হাম্বা করবে না! চাকায় ক্যাঁচর ক্যাঁচর আওয়াজ হবে না! সারা গ্রামের লোক জেনে যাবে আমরা পালাচ্ছি।”
“তাহলে?” গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন রাধামণি।
ব্রজেন্দ্র কথঞ্চিৎ শান্ত হয়ে বলেন, “গরু গাড়ি নয়। সবাই নদীর ঘাট পর্যন্ত হেঁটে যাব। তারপর নৌকায়, স্টিমারে, রেলে। তুমি, আমি, ছেলে-মেয়েগুলো যে যতটুকু বইতে পারে, ততটুকু জিনিসই নেবে শুধু। তাও খুব ভারী যেন না হয়। কখন কোথায় কতটা হাঁটতে হবে ঠিক নাই। বোঝা বেশি হলে চলবে না। আমরা পালাচ্ছি, রাধা। বেড়াতে যাচ্ছি না।”
পথে নেমে ব্রজেন্দ্রর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলতে দেখা গেল। চুপি চুপি নৌকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তারপর যথারীতি স্টিমার, রেল এবং পদব্রজে যাত্রা। সর্বত্র দিশাহীন দৌড়োদৌড়ি। যেন পূর্ব পাকিস্তান উজাড় করে মানুষ চলেছে ইন্ডিয়ায়। ক’জন জানে সেটা কোথায়! তার উপর ঘাটে ঘাটে, বন্দরে বন্দরে, স্টেশনে স্টেশনে খানাতল্লাশি। সঙ্গের পুঁটলি, বাক্স, টাকাপয়সা বেশিটাই বাজেয়াপ্ত হল, ভিড়ের মধ্যে খোয়া গেল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তিতে, দৌড়তে দৌড়তে ব্যস্ততায়, হাত থেকে, কাঁধ থেকে পুঁটলি খসে পড়ল। এরমধ্যেই আতঙ্কের অভিঘাতে, ত্রাসের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে, ধাক্কাধাক্কি করে এগোতে এগোতে, মেঠো রাস্তায় খান সেনার নজর বাঁচিয়ে লুকিয়ে চলতে চলতে, চোখের সামনে সঙ্গীদের বেঘোরে কোতল হতে দেখে, গ্রামের শান্ত মানুষগুলো অশান্ত হয়ে উঠল, মনের সারল্য গুঁতিয়ে চেপে বসল সন্দেহ। বুঝে গেল সবাই, কেউ কাউকে এক বিন্দু জায়গা ছাড়বে না। জায়গা আদায় করে নিতে হবে, প্রয়োজনে ছিনিয়ে নিতে হবে। দেশ ছাড়ার পর, কলকাতার উদ্বাস্তু শিবিরে প্রতিদিন মরমে মরে যেতে যেতে এল লড়াইয়ের মানসিক প্রস্তুতি, ইস্ট-মোহন খেলার মাঠেও ঘটল তার প্রকাশ– “মাইর্যা, কাইট্যা ফেলামু!”
“যে বাঙালির রক্তে আছে ঊনবিংশ শতকের রেনেসাঁ”, আক্ষেপ করি, “তার আজ এই পরিণতি!”
“রেনেসাঁর তুমি দেখেছো কী হে?” বরদাপ্রসাদ বাজখাঁই স্বরে জবাব তলব করেন।
“মানে!”
“বাঙালির রেনেসাঁ নামে যার উল্লেখ তুমি করছ, সীমাবদ্ধ ছিল শহর কলকাতায়, উচ্চ আর মধ্যবিত্ত মহলে। তার বাইরে কোথাও তা পৌঁছতে পারেনি। কলকাতার রেনেসাঁ! এক ঝলক দেখবে না কি?”
মাথা দোলাই, “দেখব।”
“কালাচাঁদ!”
কালাচাঁদ আমাদের এনে ফেলে পদ্মা পেরিয়ে এপারে। আর এক কিংবা, একই নদীর পাড়ে। সাল ১৮৪২। উত্তর কলকাতার কাশীপুরে গঙ্গার ধারে এক বাগানবাড়ি। বাড়ির বাসিন্দা ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন। ভিতরে তাঁর বসার ঘরে আসর জমে উঠেছে।
“ইটস নট ইন দ্য স্টার্স টু হোল্ড আওয়ার ডেস্টিনি বাট আওয়ারসেলভ্স।”
“ইউ মিসকোটেড ইট, ডিয়ার অমর!” বলে ওঠেন মধুসূদন দত্ত। তাঁর পাশেই বসে আছেন রাজনারায়ণ বসু। একটু দূরে অমরপ্রসাদ রায়।
“অমর! আমার নাতি!” বলে ওঠেন বরদাপ্রসাদ।
“আপনি নিশ্চিত উনি আপনার নাতি?”
“দ্যাখো”, বরদাপ্রসাদ বলেন, “বংশতালিকা মুখস্থ রাখা কার পক্ষেই-বা সম্ভব! আমার মতো মরে ভূত বয়সের গাছ-পাথরহীন বৃদ্ধের পক্ষে তো অসম্ভব। আমার ছেলের পরে তাই সবাই আমার চোখে আমার নাতি।”
“আচ্ছা, বেশ।”
“বড় কথা হল ওরা তিন জনই কালেজ বয়”, বরদাপ্রসাদ ব্যাখ্যা করেন, “হিন্দু কলেজের ছাত্র।”
“হিন্দু কলেজের ছাত্র!” আমি প্রতিধ্বনি করি। তিন জনেই হিন্দু কলেজের ছাত্র। তাঁরা এসেছেন প্রিয় শিক্ষক ডিএলআর, ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনের বাড়ি। সঙ্গে উপহার এনেছেন নক্ষত্র-মার্কা বিলিতি সুরা। আসর জমে উঠেছে। সেখানে উপস্থিত আছেন আরও একজন, বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেন জর্জ বায়ার্স মেনারিং। রিচার্ডসন সম্পাদিত পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করেন। পান করছেন অধ্যাপক রিচার্ডসন এবং তাঁর দুই ছাত্র মধুসূদন ও রাজনারায়ণ। আলাপনে লেগেছে উত্তেজিত প্রাণের সজীব ছোঁয়া। অমরপ্রসাদ ও ক্যাপ্টেন মেনারিং সবিনয় পানীয় প্রত্যাখ্যান করেছেন। মধুসূদন ও রাজনারায়ণ তাঁদের বোঝাচ্ছেন যে, মদ্যপানে হৃদয় প্রসারিত হয়, দৃষ্টিভঙ্গিতে লাগে ঔদার্যের ছোঁয়া, গোঁড়া সংকীর্ণ হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস জাগে, চেতনার উৎকর্ষ বাড়ে, মহৎ কার্যসাধনের ইচ্ছা বলবতী হয়। মেনারিং হাসেন। অমরপ্রসাদ বলেন, “আমাদের জ্যোতিষশাস্ত্রীরাও ভাগ্যগণনা করে বিধান দেন নক্ষত্রদের তুষ্ট রাখার। রত্নধারণের পরামর্শ দেন। তোমাদের কথা তাঁদেরই মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু বন্ধু, কপালের দাগে জীবন লেখা থাকে না। জীবনে দাগ আমরাই রেখে যাই”, অমরপ্রসাদ সুরার বোতল এবং তাতে আঁকা নক্ষত্রের ছাপ দেখিয়ে বলেন, “ইটস নট ইন দ্য স্টার্স টু হোল্ড আওয়ার ডেস্টিনি বাট আওয়ারসেলভ্স।”
তৎক্ষণাৎ ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র, রিচার্ডসনের প্রিয়পাত্র মধুসূদন অমরপ্রসাদের উদ্ধৃতির ভুল ধরেন– “ইউ মিসকোটেড ইট, ডিয়ার অমর!”
মধুসূদনের বয়স আঠেরো। রাজনারায়ণ ষোল বছরের তরুণ। ক্যাপ্টেন মেনারিং সতেরো। অমরপ্রসাদ তিন জনের চেয়েই বয়সে কিছু বড়। তিনি বিশ বছরের যুবক।
মধুসূদন শ্রদ্ধেয় ডিএলআর-এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চান। ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন শুধু হিন্দু কলেজের নক্ষত্রপ্রতিম অধ্যাপক নন, তিনি ইংরেজি সাহিত্যের স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফোর্ট উইলিয়াম সুপ্রিম কাউন্সিলের আইন-সদস্য টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, যিনি ভারতের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন এবং ভারতীয় সাহিত্যের দৈন্য নির্দেশে বলেছিলেন যে, যাবতীয় ভারতীয় সাহিত্য জমা করতে ইওরোপের যে-কোনও গ্রন্থাগারের একটিমাত্র তাকই যথেষ্ট, তিনি রিচার্ডসনের বিষয়ে শংসাজ্ঞাপন করে গেছেন। বলেছেন, ভারতে তাঁর সমস্ত অভিজ্ঞতা ভুলে গেলেও, রিচার্ডসনের শেক্সপিয়ার পাঠ ও ব্যাখ্যা শ্রবণের অনুভূতি কখনও ভুলবেন না।
রিচার্ডসন ট্যাঁকের ঘড়ি দেখেন। তাঁকে আবার রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়ি যেতে হবে। সেখানে জলসায় নিমন্ত্রণ আছে। কিন্তু, প্রিয় ছাত্র মধুসূদনের প্রশ্নের জবাবও দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত, বেয়াড়া অমর অযথা স্পর্ধাপ্রকাশ করেছে। ডিএলআর বলেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মধু। অমর ভুল উদ্ধৃতি দিয়েছে। শেক্সপিয়ার তাঁর ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে ক্যাসিয়াসের সংলাপে লিখেছিলেন “দ্য ফল্ট, ডিয়ার ব্রুটাস, ইজ নট ইন আওয়ার স্টার্স, বাট ইন আওয়ারসেল্ভস”।”
“সরি, স্যার। আমি ভুল বলেছি। কিন্তু”, অমরপ্রসাদ প্রশ্ন করেন, “অর্থ কি তাতে বদলায়?”
“না”, ডিএলআর ঘাড় নাড়েন, “তা বিশেষ বদলায় না অবশ্য।”
“তাহলে দাঁড়ায়, নিজের ভাগ্য মানুষ নিজেই গড়ে?”
“তা দাঁড়ায়। কিন্তু”, ডিএলআর রূঢ় স্বরে বলেন, “তাই বলে শেক্সপিয়ারের রচনা নিয়ে খেলা করা যায় না।” রিচার্ডসন উঠে দাঁড়ান, “বয়েজ, ইউ মে প্লিজ লিভ মি নাউ। আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।”
ক্যাপ্টেন মেনারিং এবং তিন ছাত্র ডিএলআর-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। অনতিবিলম্বে পালকি চড়ে বাড়ি থেকে বেরন ডিএলআর। গন্তব্য শোভাবাজার। রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে আজ গান গাইবে বাইজি হীরা বুলবুল। রিচার্ডসন তার গান ভালবাসেন। ভালবেসে তাকে ডাকেন ‘দি ইন্ডিয়ান নাইটিঙ্গেল’। ভবিষ্যতে এই হীরা বুলবুল তার ছেলেকে ভর্তি করবে হিন্দু কলেজে। প্রতিবাদে কলকাতার সমাজপতিরা তাঁদের সন্তানদের হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নেবেন এবং প্রতিষ্ঠা করবেন হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ। তাঁদের নেতৃত্ব দেবেন রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ছাড়াও বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও অনেকে। কলেজের অধ্যক্ষ হবেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন। অবশ্য, তার এখনও এগারো বছর দেরি আছে।
ঊনবিংশ শতকের চল্লিশের দশকে কলকাতার রাজপথে গোরা সার্জেন্টদের কুচকাওয়াজ চলছে। সে-দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন মেনারিং শুনছেন তাঁর পাশে দাঁড়ানো তিন নেটিভ সহপাঠীর আলোচনা। কলেজ-বয়রা বাংলা কম বলেন। অনেকে বাংলা লিখতেই পারেন না। তাঁদের আলাপচারিতা চলে মূলত ইংরেজিতেই। মধুসূদন নিয়মিত এই ভাষায় কাব্যরচনা করে থাকেন। ঘোষণা করেন, ইংল্যান্ড যাবেন এবং ইংরেজি সাহিত্য রচনা করে কবি বায়রনের মতো বিখ্যাত হবেন। রাজনারায়ণ বলেন, তিনি সমাজসংস্কারের কাজে ব্রতী হতে চান। অমরপ্রসাদ ইতিমধ্যেই ফোর্ট উইলিয়ামের এক সাহেবের বেনিয়ানগিরি শুরু করেছেন। পরনের পোশাক দেখেই বোঝা যায় কারবারি মানুষ। তাঁকে শহরের অনেকেই চেনেন। তিনি জানান, ব্যবসায় আরও মন দেবেন, কারবার বাড়াবেন।
“ব্লাডি বানিয়া!” কথাটা কে যে বলে, কুচকাওয়াজের শোরগোলে বোঝা যায় না। মধুসূদন! রাজনারায়ণ! না কি, ক্যাপ্টেন মেনারিং! কিংবা, কোনও গোরা সার্জেন্ট হয়তো। ওদিকে রাজপথে হেঁটে আসছেন আর এক যুবক, পায়ের জুতোয় তাঁর মণিমাণিক্যের ঝিলিমিলি আলো।
বরদাপ্রসাদ বলেন, “দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর! কলকাতার বাবুদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কাপ্তেন। অন্যেরা সোনা-রূপা-রত্নাদি গলায় ঝোলায়, শিরে ধারণ করেন। ইনি ওসব জিনিস পরিধান করেন পায়ের জুতোয়।”
“বটে! এটাই রেনেসাঁ?” আমি বিভ্রান্তিভরে প্রশ্ন করি।
“হয়তো কিংবা, হয়তো নয়”, বরদাপ্রসাদ হাঁক পাড়েন, “কালাচাঁদ!”
আবার কালাচাঁদের কাঁধে চড়ে আমরা গতিপ্রাপ্ত হই। চালান হই সময়ান্তরে।
সাল ১৮৭০। রাজনারায়ণ বসুর বয়স চুয়াল্লিশ। প্রায় দু’দশক মেদিনীপুরের স্কুলে শিক্ষকতার শেষে অবসরগ্রহণ করেছেন। প্রবল বদহজমের ব্যারামে আক্রান্ত। কলকাতায় চিকিৎসা করাচ্ছেন। দেবেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ, ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করছেন। ধর্মতত্ত্বের বই ও আত্মজীবনী লিখছেন। মধুসূদন দত্ত ছেচল্লিশ। তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য বাংলায় রচনা করে ফেলেছেন ‘হোম’ ইংল্যান্ডে রওনা হওয়ার আগেই। সেখান থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরেছেন। দক্ষ আইনজীবী নন বলে বদনাম রটেছে। কলকাতার অভিজাত অঞ্চল লাউডন স্ট্রিটে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। স্ত্রী হেনরিয়েটা ও তিন সন্তানকে নিয়ে তাঁর সংসার। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অপরিমিত মদ্যপান করেন। বিপুল ঠাটবাট। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। যকৃতের রোগে আক্রান্ত। তিন বছর পরে মারা যাবেন। বছর আটচল্লিশের অমরপ্রসাদ মুস্তাফি বড় কারবারি বনেছেন।
“কালাচাঁদ!” ডাক দেন বরদাপ্রসাদ। আমরা পৌঁছই পাহাড়ে।
“It’s not in the stars to hold our destiny but ourselves.” শান্ত স্বরে উচ্চারণ করেন এক পুরুষ। প্রায় নির্জন পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তিনি। পরনে তাঁর হাঁটু ছাপিয়ে ঝোলা থক্রো-দাম্। কোমরবন্ধ জড়ানো না থাকলে দেখতে লাগত ছোট আলখাল্লা। দু’পায়ে হাঁটুর নীচ অবধি ঢাকা চামড়ার জুতো। মাথায় থাক্তপ টুপি। টুপিটার কাঠামো বাঁশের ছিলায় গড়া। তার উপরে জড়ানো লাল-কালো ডোরাকাটা রেশমি কাপড়। কোমরবন্ধে আঁটা বাঁশের কোষে রক্ষিত ছোরা বান্পক। মানুষটি আপাদমস্তক লেপচা পোশাকে সজ্জিত হলেও, জাতিতে ইংরেজ। জেনারেল জর্জ বায়ার্স মেনারিং, বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির এক অধিনায়ক। বয়স পঁয়তাল্লিশ। তিন বছর আগে, ১৮৬৭ সালে, এসেছেন দার্জিলিংয়ে। উদ্দেশ্য, লেপচা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষা এবং এই ভাষার ইতিহাস ও ব্যাকরণ রচনা করা।
তাঁর সামনে এক নারী আপন খেয়ালে কর্মরত। তাঁর পরনে কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি বিস্তৃত ঘাগরা গড়নের বস্ত্র দাম্দিয়াম্। তাতে আঁকা বিবিধ পশুর ছবি। ঊর্ধ্বাঙ্গে লম্বা হাতা ঢোলা জামা তুগো। বাঁ’কাঁধ থেকে কোমরের ডান দিক অবধি আড়াআড়িভাবে নেমে এসেছে রেশমের ফিতে। ফিতের শেষে বাঁধা একটি রেশমের থলি। একইভাবে, ডান কাঁধ থেকে বাঁধা ফিতের শেষে কোমরের বাঁ’দিকে ঝুলছে আর একটি থলি। দুটি থলিতে রাখা আছে বিভিন্ন বস্তু– নানা জাতের পাখির পালক, পাখির ঠোঁট, হরিণের, বাইসনের, ভালুকের, বাঘের চামড়া, শুয়োরের দাঁত, হাতির দাঁত, মাছের কাঁটা, কিছু হাড়গোড়, বিভিন্ন গাছের শিকড়, বাকল, বীজ, পাতা, ঘাস, শুকনো শাক, আরও বহু কিছু। নারীর মাথায় সবুজ পাতা আর পাখির রঙিন পালকে গড়া মুকুট। ইনি লেপচা সমাজে পরিচিত মুন-দে-মেম নামে। মুন অর্থাৎ, নারী-পুরোহিত, ইহলোক ও পরলোকের মধ্যে সংযোগস্থাপনকারী, মধ্যস্থতাকারী। সমতলের মানুষ হয়তো বলবে ওঝা কিংবা, গুনিন। নারী বলে জাদুকরী, ডাইনিও বলতে পারে। দে বোঝায় বিনাশিনী, অশুভের বিনাশকারিনী। মেম কারণ, জেনারেল জর্জ বায়ার্স মেনারিং সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। সাহেবের সঙ্গিনীকে স্থানীয়রা মেম বলে। যদিও, মুন-দে-মেম, অশুভের বিনাশিনী মেম নারী-পুরোহিত, জন্মসূত্রে নির্ভেজাল লেপচা। গত তিন বছর যাবত তিনি মেনারিং সাহেবকে লেপচা ভাষা এবং সংস্কৃতির পাঠ দিচ্ছেন। বিনিময়ে শিখছেন ইংরেজি ভাষা। একটি গাছের বাকল ছাড়িয়ে সঙ্গের দুটি ঝুলির একটিতে রেখে সাহেবকে প্রশ্ন করেন, “কথাটার অর্থ কী?”
“কোন কথাটার?” জেনারেল মেনারিং কাঞ্চনজঙ্ঘার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চান মুনের দিকে।
“ওই যে, এখনই বললে, ইটস নট ইন দ্য স্টার্স …”
“ও”, মেনারিং মাথা নাড়েন, “কপাল বলে কিছু নেই, মানুষ নিজেই তার ভাগ্য গড়ে নেয়। তুমি অবশ্য এমন একটা ধারণায় বিশ্বাস করো না।”
“কেন করব না!” মুন-দে-মেম বলেন, “ভুল তো কিছু নেই। বিধাতা চান এক রকম, মানুষ করে আর এক রকম। ঈশ্বরের ইচ্ছায় বিশ্বসংসার চলে না।”
মেনারিং সবিস্ময় বলেন, “তুমি নিজে একজন মুন হয়ে এই কথা বলছ! মানুষ তোমাকে ঈশ্বর আর তাদের মধ্যে বার্তা বিনিময়ের দূত মেনে সম্মান করে। তোমার মুখে এমন কথা কি ধর্মবিরোধী নয়?”
“না। মুন বলেই এ-কথা বলছি। মানুষ ঈশ্বরের নির্দেশিত, তাঁর অভিপ্রেত পথে চলে না বলেই সমাজের আমাকে প্রয়োজন হয়। মানুষের হয়ে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয় আমাকে। তাদের অপরাধের দণ্ড লঘু করতে যাগযজ্ঞ করতে হয়।”
মেনারিং মন্তব্য করেন না। তাঁকে ভাবুক দেখায়। লেপচা নারী-পুরোহিত মুন-দে-মেম হেসে হারিয়ে যান ভূর্জ বনে। বার্চ গাছের জঙ্গলে পা’য়ে পা’য়ে তাঁকে খোঁজেন বেঙ্গল আর্মির জেনারেল জর্জ বায়ার্স মেনারিং। তিনি অনুসন্ধানে সফল হবেন। লিখবেন লেপচা ভাষার ব্যাকরণ এবং অভিধান। লেপচা সমাজ তাঁকে আখ্যা দেবে ‘থিকুং জেনারেল’, শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞাবান অধিনায়ক।
“কী হে!” বরদাপ্রসাদ বলেন, “যাবে না কি আরও একটু পিছিয়ে উইলিয়াম জোন্স, জেমস প্রিন্সেপ, রামমোহন কিংবা, বিদ্যাসাগর, বেথুনের কালে? কিংবা, সামান্য এগিয়ে ফ্রান্সিস এডওয়ার্ড ইয়ংহাজব্যান্ড, আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম, উইলিয়াম উইলসন হান্টার কি এলএসএস ও’ম্যালির কারবার দেখতে?”
হাতজোড় করে বলি, “আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে।”
বরদাপ্রসাদ চোখ কপালে তুলে বলেন, “সে কী! রেনেসাঁ ইতিহাসের বাকিটা জানতে চাও না? সে তো তুমি মাইকেল, রাজনারায়ণ কিংবা বঙ্কিমে নির্ভেজাল পাবে না। যেতে হবে সেই ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের কাছেই।”
“নিঃসন্দেহে, আপনি সেকেলে ইংরেজভক্ত মানুষ। দেশভক্তি বলে কিছু আপনার বিন্দুমাত্র নেই। তবু”, গলা নামিয়ে বলি, “যাব, অন্য কোনও দিন।”
বরদাপ্রসাদ অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন। হাসতেই থাকেন।