‘ডন’ যখন ছোট ছিলেন

‘ডন’ যখন ছোট ছিলেন

বাউরাল-এর ছোকরা: বেড়ে ওঠার দিনগুলো
আজ থেকে মোটামুটি সাড়ে-নয় দশক আগে ১৯২৭-২৮ মরশুমে প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটে ও ১৯২৮-২৯ মরশুমে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর আবির্ভাবের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ডন ব্র্যাডম্যান-কে নিয়ে কোনও কিছু লেখাই বোধহয় বাকি নেই। তাঁর বাল্যকাল বললেই আমাদের অনেকেরই চোখে ভাসে এই ছবিটা – একলা এক ক্ষুদে ছেলে হাতে একটা স্টাম্প নিয়ে বাড়ির পেছনের উঠোনে একটা জলের ট্যাঙ্কের দেওয়ালে গল্ফ-বল মেরে মেরে ব্যাটিং অনুশীলন করে চলেছে। কিন্তু এর বাইরে কি ‘বালক ডোনাল্ড’-এর আর কোনও অস্তিত্বই ছিল না? আসুন, একবার ফিরে দেখবার চেষ্টা করি পরবর্তীকালে “The Bowral Boy” নামে অভিহিত সেই ছেলেটার শৈশব ও কৈশোরের কিছু টুকরো টুকরো ছবি।

১৯০৮ সালের ২৭শে অগাস্ট নিউ সাউথ ওয়েলস-এর কুটামুন্ড্রা নামক এক ছোট্ট শহরে জন্ম হয় জর্জ ও এমিলি ব্র্যাডম্যান-এর কনিষ্ঠতম সন্তান ডোনাল্ড-এর, বাকিরা চার বছরের বড় দাদা ভিক্টর, আর তিন দিদি আইলেট, লিলিয়ান, ও এলিজাবেথ।

কুটামুন্ড্রা শহরের জন্মস্থান]
বাবা জর্জ
মা এমিলি

ডোনাল্ড-এর জন্মের বছর দুয়েক বাদে পেশায় কাঠের কারিগর জর্জ সপরিবারে চলে গেলেন নিউ সাউথ ওয়েলস-এর আরেক ছোট্ট শহর বাউরাল-এ, কৃষিকাজে মন দিলেন। বাউরাল-এর বাড়ির কাছাকাছি সমবয়সি ছেলেছোকরা প্রায় কেউই ছিল না। তাই ডোনাল্ড-কে তার নিজের মতন ক’রে সময় কাটানোর ব্যবস্থা নিজেকেই ক’রে নিতে হ’ল। সেখান থেকেই স্টাম্প ও গল্ফ-বল নিয়ে একা একা ব্যাটিং অনুশীলনের শুরু – চওড়া খিড়কির দরজাটাকে উইকেট বানিয়ে বাড়ির পেছনের অসমতল উঠোনে জলের ট্যাঙ্কের ইঁটের দেওয়ালে বল মেরে দ্রুত ফেরত-আসা এলোমেলো উচ্চতার লাফানো ছোট্ট বলটাকে সরু স্টাম্প দিয়ে সামলানো। সেই ক্ষুদে ছেলে তখন বুঝতেও পারেনি যে অমন অদ্ভুত অনুশীলন তার ভবিষ্যৎ ক্রিকেট-জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে!

তার বয়স তখন বছর সাত-আট। বাউরাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখনই ক্রিকেটার হিসেবে সে নাম করতে শুরু করে দিল। স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজার পর বাকি ছেলেদের মতন গল্পগুজব হাসিঠাট্টা নিয়ে সে মেতে উঠত না। তার ছিল বাড়ি ফেরবার তাড়া। বাউরাল-এর ছোট্ট জনপদের নির্জন পথঘাট ধ’রে পাঁইপাঁই ক’রে দৌড়ে শেফার্ড স্ট্রিট-এ ঢুকে, উঠোনের সাদা কাঠের বেড়া ডিঙিয়ে, সদর দরজা দিয়ে ঝড়ের মতন ভেতরে ঢুকে হলঘরে স্কুলের ব্যাগটা কোনওমতে নামিয়ে রেখেই সে তার ক্রিকেট ব্যাটটা তুলে নিত। হাঁক পাড়ত, “এসো না মা, আমাকে কয়েকটা বল করো তো!”

এমিলি ব্র্যাডম্যান মুচকি হাসতেন। পরনের গৃহকর্মের এপ্রনটা খুলে, গরম জলের কেটলিটা উনুনের ওপর বসিয়ে, ছেলের পিছুপিছু বাড়ির পেছনের উঠোনে নেমে যেতেন। তাঁর নিজস্ব-ধরণের বাঁ-হাতের বোলিং’ করতে করতে তিনি বোধহয় কল্পনাও করতে পারেননি যে তাঁর উল্টোদিকের ক্ষুদে ছেলেটা একদিন দুনিয়ার সেরা ব্যাটার হয়ে উঠবে। এমন অনুশীলনে মাঝে মাঝে ছোটোখাটো বিপত্তিও ঘটত। একবার মা-র করা একটা শর্ট বল ব্যাকফুটে জোরসে পুল করল ছেলে আর সেটা বসবার ঘরের খোলা জানলা দিয়ে সোজা ঢুকে গিয়ে আছড়ে পড়ল পিয়ানোটার ওপর। সেখানে তখন মেজদি লিলিয়ান বাজনা অভ্যেস করছিল। অল্পের জন্য তার চোট লাগেনি আর বাদ্যযন্ত্রটারও কোনও ক্ষতি হয়নি। তবে ভাই ও দিদি দুজনেরই অনুশীলনে সেদিনকার মতন ইতি পড়ে যায়।

শিশু ডোনাল্ড
পোষ্য টেডির সঙ্গে]
দাদা ভিক্টর-এর সঙ্গে আট বছর বয়সে
মেজ দিদি লিলিয়ান

এই মেজদি-র কাছেই পিয়ানো বাজাতে শিখেছিল সঙ্গীত-প্রেমী ডোনাল্ড। ছেলেবেলায় বেশ কয়েক বছর সে ছিল বাউরাল-এর সেন্ট জ্যুডস অ্যাঙ্গলিকান চার্চ-এর বালক-গায়ক-গোষ্ঠীর সদস্য। প্রতি রবিবার গির্জায় যেত, আর মাঝে মাঝেই শনিবার সন্ধেয় তাদের বাউরাল-এর বাড়িতে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গীত-আসরে গেয়ে-বাজিয়ে অংশ নিত। বড় হয়ে জাহাজে চেপে অস্ট্রেলিয়া-দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড-সফরে যাওয়ার সময় সহ-খেলোয়াড় ও সহযাত্রীদের পিয়ানো বাজিয়ে বেশ আনন্দ দিত সে। ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিডনি-র গ্র্যান্ড অপেরা হাউস-এ “বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট” পুতুলনাচের এক অনুষ্ঠানে তারই সৃষ্ট “Every day is a rainbow day for me” নামের সঙ্গীতাংশ পরিবেশন করা হয়েছিল।

ডোনাল্ড-এর ছাত্রজীবনে বাউরাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলাধুলোর ব্যবস্থা বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে, ক্লাসের ফাঁকে ও টিফিনের বিরতিতে ছেলেরা মিলে ‘ক্রিকেট’ খেলত – লাল ধুলোর পিচ, স্কুলের ঘন্টার থামের গায়ে-আঁকা উইকেট, গঁদ-আঠা গাছের কেটে-নেওয়া ডাল দিয়ে ব্যাট আর কর্ক ও রবার দিয়ে তৈরি বল। প্যাড-গ্লাভসের কোনও বালাই ছিল না। আর হেলমেট? সে তো প্রথম মহাযুদ্ধের লড়াইয়ের সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য! খেলবার জায়গাটা ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় আর উচ্চ বিদ্যালয় এই দুইয়ের মাঝখানে। বাচ্চা ডোনাল্ড প্রায়ই ঐ সীমানায় দাঁড়িয়ে ভাবত কবে সে বড়দের সঙ্গে খেলবার সুযোগ পাবে! সে সুযোগ আসতে বেশি দেরি হয়নি।

গির্জার ন’বছর-বয়সী বালক-গায়ক
১৯৩৪ সালের পিয়ানো-বাদক
বাউরাল স্কুলের মাঠ

খেলাধুলোতেও তার দক্ষতা ছিল বহুমুখী। সে স্কুল দলের হয়ে রাগবি খেলত। বয়সভিত্তিক দৌড় প্রতিযোগিতায় নানা বিভাগে – ১০০-গজ, ২২০-গজ, সিকি-মাইল, আধ-মাইল – সে ছিল চ্যাম্পিয়ন। টেনিস খেলাতেও তার হাত বেশ ভালই ছিল। তবে আসল ছিল ক্রিকেট – ১১-বছর বয়সে সে তার প্রথম উল্লেখযোগ্য ক্রিকেট-ম্যাচ খেলে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতে থাকতেই সে স্কুল ক্রিকেট দলে জায়গা ক’রে নিয়েছিল যার অধিকাংশ সদস্যই ছিল উচ্চ বিদ্যালয়ের। গ্লেবে ওভাল (পরবর্তীকালের ব্র্যাডম্যান ওভাল) মাঠে এক ম্যাচে দ্বিতীয় উইকেট পড়বার পর মাঠে নেমে, এক হ্যাট-ট্রিক বলের মুখোমুখি হয়ে প্রথম বলেই বোল্ড-আউট হ’তে হ’তে বেঁচে গিয়ে শেষতক ৫৫ রানে অপরাজিত থেকে যান।

পরের মরশুমে ডোনাল্ড হাঁকাল তার প্রথম শতরান – তার জীবনের সবরকম ম্যাচ মিলিয়ে মোট ২১১টা শতরানের সর্বপ্রথমটা। এবার সে খেলল বাউরাল ইন্টারমিডিয়েট হাই স্কুল দলের হয়ে, বিপক্ষ ছিল পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী মিটাগং স্কুল। দলের মোট ১৫৬ রানের মধ্যে তারই সিংহভাগ ১১৫ অপরাজিত। তবে একটা সমস্যা হয়েছিল। পরের দিন তাদের প্রধান-শিক্ষক ছাত্রদের এক জমায়েতে বলেন, “এটা খুবই ভাল কথা যে তোমাদের মধ্যে একটি ছেলে গতকালের ম্যাচে একটা শতরান করেছে। কিন্তু তাই ব’লে স্কুলের ব্যাটটা মাঠে ফেলে রেখে আসতে হয়!”

বিদ্যালয়ের হয়ে ডোনাল্ড-এর শেষ ম্যাচটাও ছিল মিটাগং-এরই বিরুদ্ধে। সে ৭২ রানে অপরাজিত ছিল আর ম্যাচটা বাউরাল জেতে। সে দলে থাকলে কোনও কোনও স্কুল বাউরাল-এর বিরুদ্ধে খেলতে অস্বীকার করত। এমনকি মিটাগং নাকি বাউরাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেছিল এই ব’লে যে ডন-কে বাউরাল দল থেকে বাদ না রাখলে মিটাগং ম্যাচই ছেড়ে দেবে – “অমন করলে খেলব না!”

বেরিমা জেলা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল বাউরাল শহরের দল যাদের স্কোরখাতা লিখত ডোনাল্ড, তার বয়স তখন ১২ বছর। বাবা একটা পুরনো ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যেতেন আর পেছনে একটা কাঠের বাক্সের ওপরে সে বসে থাকত। জর্জ খেলতেন বোলার হিসেবেই, তবে তাঁর ব্যাটিংটাও ছিল কাজ-চালানো গোছের। কম বয়সে তাঁর খেলার জন্য তিনি একটা সোনার পদক পেয়েছিলেন যেটা তাঁর ঘড়ির চেনে ঝুলত। মস ভেল দলের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে বাউরাল-এর একজন খেলোয়াড় অনুপস্থিত থাকায় ডন সুযোগ পেল। অষ্টম উইকেট পড়বার পরে ব্যাট করতে নেমে সে ৩৭ রান ক’রে অপরাজিত থাকল।

পরের সপ্তাহে পদোন্নতি হয়ে ইনিংসের সূচনা ক’রে সে ২৯ রানে অপরাজিত রইল। দলের বয়স্ক খেলোয়াড় ডন কিউপিট এতই খুশি হলেন যে তাকে একটা প্রমাণ-মাপের আসল ক্রিকেট-ব্যাট উপহার দিলেন। এ পর্যন্ত সে গঁদ-আঠা গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি ব্যাট দিয়েই খেলত। এবার তার আসল ব্যাট হ’ল। জর্জ সেই ব্যাটের নীচের দিক থেকে ইঞ্চি-আড়াই মতন কেটে বাদ দিলেন যাতে ছেলে তার ওজনটা ঠিকঠাক বইতে পারে।

বারো-বছর-বয়সী শতরানকারী
বাউরাল স্কুল দলের তারকা]
বারো-বছর-বয়সীর প্রথম ক্রিকেট-ব্যাট
বাউরাল ওভাল

১৯২০-২১ মরশুমে জর্জ তাকে সঙ্গে ক’রে সিডনি ক্রিকেট মাঠে অ্যাশেজ-সিরিজের একদিনের খেলা দেখাতে নিয়ে গেলেন। ট্রেনে ক’রে বাউরাল থেকে সিডনি, তারপর ট্রামে চেপে মাঠে – ১২-১৩ বছরের বালকের কাছে এ ছিল এক রোমাঞ্চকর যাত্রা।

প্যাডিংটন প্রান্তের বেড়ার পেছনের আসনে বসে সে দেখল – প্রথমে জ্যাক গ্রেগরি ও টেড ম্যাকডোনাল্ড-এর বিধ্বংসী জোর বোলিংয়ে ২০৪ রানে ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষ-হওয়া, তারপর তিন-নম্বর অজি ব্যাটার চার্লি ম্যাককার্টনি-র মন-কেড়ে-নেওয়া ব্যাটিং। চতুর ইংরেজ মিডিয়াম-পেসার পার্সি ফেন্ডার-এর বলে ম্যাককার্টনি যখন দারুণ একটা কভার-ড্রাইভ মারলেন, তখন ছেলেটার মন উছলে উঠল। চা-বিরতির সময় সে সিডনি মাঠের চারপাশে ঘুরে বেড়াল, খেলোয়াড়দের সাজঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আর বাড়ি ফেরবার পথে বাবাকে বলল, “এই মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমার মন কখনও ভরবে না!”

১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে পার্সি ওয়েস্টব্রুক-র জমি-বাড়ির ব্যবসায় খাতা-লেখার কাজ নিল ডোনাল্ড। আশ্চর্যজনকভাবে, ১৫ বছর বয়সটাতে সে একদমই ক্রিকেট খেলেনি, কেবলমাত্র টেনিস খেলত। পরের বছর অবশ্য সে আবার ক্রিকেট খেলা শুরু করল এবং ১৭ বছরে পড়বার মধ্যেই সে বাউরাল ক্রিকেট দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে উঠল।

১৯২৫-২৬ মরশুমের শেষের দিকে, বাউরাল ও উইঞ্জেলো দলের মধ্যে খেলা চলছিল। এই দুই দলের মধ্যে ছিল ভালমতন রেষারেষি। কারণ উইঞ্জেলো দলে খেলতেন ১৯ বছরের বিল ও’রাইলি, বড়সড় চেহারার আক্রমণাত্মক স্বভাবের দ্রুতগতিসম্পন্ন দারুণ এক লেগস্পিন বোলার।

স্থানীয় ক্রিকেট-দর্শকদের ঔৎসুক্যের মধ্যে ম্যাচ শুরু হ’ল। বেঢপ-মাপের প্যাড-পরা ছোটোখাটো চেহারা ডন-কে ক্রিজে আসতে দেখে বিল হেসে ফেললেও একটু পরেই বুঝলেন যে এ ‘খোকা’ সহজ ছেলে নয়। ইনিংসের গোড়ার দিকে বার-তিনেক বেঁচে যাওয়ার পর বিল-সমেত উইঞ্জেলো-বোলিংকে ঠেঙিয়ে প্রথম দিনের শেষে ডন ২৩৪ রানে অপরাজিত থাকলেন। পরপর দু’টো শনিবার ধরে চলা ম্যাচের পরের দিনটার মাঝের গোটা সময়টা বাড়ির খোলা গেট তাক ক’রে বোলিং অভ্যেস চালিয়ে গেলেন প্রতিশোধকামী বিল। দ্বিতীয় দিনের প্রথম বলেই তিনি ডন-কে বোল্ড-আউট ক’রে দিলেন। এই ম্যাচের ঘটনা নিয়ে “The Battle of Bowral” নামে একটা কবিতাও আছে।

স্কোরকার্ডে
দাদা ভিক-এর সঙ্গে, সেজেগুজে

১৯২৫-২৬ মরশুমের বেরিমা জেলা প্রতিযোগিতার ফাইনালে মস ভেল দলের বিরুদ্ধে ডন খেলল ৩০০ রানের এক ইনিংস আর দ্বিতীয় উইকেটে অধিনায়ক (ও এক কাকা) জর্জ হোয়্যাটম্যান-এর সঙ্গে ৩৭৪ রানের এক বিশাল জুটি গড়ল। তার দাদা ভিক-ও বাউরাল দলে ছিল, তবে ব্যাটিংয়ে সাফল্য পায়নি এবং আরেক কাকা ডিক হোয়্যাটম্যান পায়ের আঙুলে চোট পাওয়ায় ব্যাট করতে পারেননি। পরপর পাঁচটা শনিবার ধরে চলা ঐ ফাইনালে বাউরাল জিতল ইনিংস ও ৩৩৮ রানে। এই ম্যাচের পর থেকেই সিডনি-র সংবাদপত্র-মহলে চালু হয় “the Boy from Bowral” তকমাটা। বাউরাল দলের হয়ে নিজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ-মরশুমে ১৭ বছরের ছোকরা ডোনাল্ড-এর মোট রান ছিল ১,৩১৮ (গড় ১০১.৩০), ২৬টা ক্যাচ ধ’রে সে সেরা ফিল্ডারের খেতাব পেয়েছিল, আর মোট ৫১টা উইকেট (গড় ৭.৮০) নিয়েছিল।

এরপর বেশ তাড়াতাড়িই, ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে, সিডনি-র সেন্ট জর্জ ক্লাব দলের হয়ে খেলতে শুরু করল ডন আর ১৮ বছর বয়সে ‘এ’-গ্রেড দলের অধিনায়কের পদ পেল। নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ এক কর্মকর্তা ফ্র্যাঙ্ক ক্যাশ-এর বাড়িতে সে থাকত। দাঁতে ব্যথা হওয়ায় এক শুক্রবার সে গেল এক দন্ত-চিকিৎসকের কাছে আর বাড়ি ফিরল গোটা-কয়েক দাঁত তুলিয়ে, ফোলা মুখে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। তার অবস্থা দেখে গৃহকর্ত্রী শ্রীমতী ক্যাশ ডাক্তারকে ফোন করলে তিনি ডন-কে পরের দিনের ম্যাচটা না খেলতে উপদেশ দিলেন।

অধিনায়ক হিসেবে দলকে হতাশ করতে না চেয়ে পরদিন ডন খেলতে নামল, টসে জিতে বিপক্ষকে ব্যাট করতে দিল। সাড়ে-চারটের মধ্যে বিপক্ষ-দল অল-আউট হয়ে গেল। সেন্ট জর্জ দলের প্রথম উইকেট পড়বার পর অভ্যস্ত জায়গায় না নেমে ডন ব্যাট করতে নামল অষ্টম উইকেট পড়বার পর, দর্শকদের টিটকিরির জোর আওয়াজের মধ্যে, তবে দিনের শেষ অবধি কোনওমতে কাটিয়ে দিল। পরের শনিবার সুস্থ অবস্থায় মাঠে নেমে সে শেষ করল ১১৬ রানে অপরাজিত থেকে। দল জিতল এবং ডন-এর ভাষায়: “I went from villain to hero.”

এর অল্প ক’দিন পরেই এক ম্যাচে সে মুখোমুখি হ’ল সিডনি শহরের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া এক দলের যার অধিনায়ক ছিলেন স্বয়ং চার্লি ম্যাককার্টনি। ঐ ম্যাচে চমকপ্রদ ব্যাটিং ক’রে ডন আউট হ’ল ৯৮ রানে। ম্যাককার্টনি-র মন্তব্য ছাপা হ’ল “ইভনিং নিউজ” পত্রিকায়: “He (Bradman) played a fine innings, using his feet nicely to the first-grade slow bowler Morris, and playing the other types with easy confidence. … Bradman has every probability of being a State(-level) player in the near future and, provided he overcomes (his) faults, will be a very classy one.” 

বাউরাল-এর ছোকরা: সেন্ট জর্জ ক্লাবে
বাড়ির উঠোনে

১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি সে নিউ সাউথ ওয়েলস দ্বিতীয় একাদশের হয়ে প্রথম খেলবার সুযোগ পেল, ভিক্টোরিয়া দ্বিতীয় একাদশের বিরুদ্ধে। রাজ্যস্তরের ক্রিকেটে সেই তার প্রথম পরিচয় যদিও সেটা প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেট নয়। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৪৩ রান ক’রে সে বোল্ড-আউট হ’ল – ‘a performance entirely devoid of nerves’ (“Truth” পত্রিকার বয়ান অনুযায়ী) – তবে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮ রান করবার পর একটা বল পুল ক’রে সীমানার বাইরে পাঠাতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত উইকেটে পা ঠেকে গিয়ে আউট হয়ে গেল।

১৯২৬-২৭ মরশুমে সেন্ট জর্জ ভালই সাফল্য পেল, মাঠে নিয়মিত অনেক দর্শক আসতেন। সে মরশুমে ডন-এর ব্যাটিং-গড় হ’ল ৪৮.১৬ আর সে উপলব্ধি করল যে এবার তাকে পাকাপাকিভাবে সিডনি-তে চলে আসতে হবে। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউ সাউথ ওয়েলস শেফিল্ড শিল্ড দলের দুই অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, জ্যাক গ্রেগরি ও হ্যামি লাভ, অন্য রাজ্যে খেলতে যেতে না চাওয়ায় দলভুক্ত করা হ’ল সেন্ট জর্জ ক্লাব-এর ডন ব্র্যাডম্যান ও অ্যালবার্ট স্কেন্স এই দু’জনকে। অনভিজ্ঞ ব্র্যাডম্যান-কে করা হ’ল দ্বাদশ ব্যক্তি। প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটে ডোনাল্ড-এর সেই প্রবেশ। তখন তার বয়স উনিশ বছর চার মাস। বাকিটা …

নিউ সাউথ ওয়েলস দলের অনুশীলনে

[কৃতজ্ঞতাস্বীকার এবং তথ্যসূত্র]:

1. “Our Don Bradman” by Philip Derriman, 1943 Edition
2. “Farewell to Cricket” by Don Bradman, 1950 Edition
3. Bradman: The Illustrated Biography” by Michael Page, 1983 Edition
4. “The Art of Bradman” by Brian Clinton & Richard Mulvaney, 2003 Edition
5. “Thwak! The Glorius Sound of Summer” by Ashley Mallett, 2020 Edition

কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", এই বছর এল “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর লিখেছেন “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *