লর্ডস দর্শন: ইডেনে খেলা-দেখা ও নিজে-খেলা এক ক্রিকেটপ্রেমীর চোখে

লর্ডস দর্শন: ইডেনে খেলা-দেখা ও নিজে-খেলা এক ক্রিকেটপ্রেমীর চোখে

ইডেন-এর স্মৃতিকণা ও লর্ডস-এর দর্শনেচ্ছা

নিজের শহর কলকাতার (সঙ্গের ছবি দেখে চেনা কষ্টকর) ইডেনের স্টেডিয়ামে ঢোকার শুরু ১৯৬৪ সাল থেকে, শেষ ১৯৮৭ সালে – অধিকাংশই ক্রিকেট-ম্যাচের দর্শক হিসেবে। তবে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এই দু’বছর সিএবি-পরিচালিত গ্রীষ্মকালীন স্কুল-ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় নিজের স্কুল-দলের হয়ে সেখানে খেলবার সৌভাগ্যও হয়েছিল। সুযোগ হয়েছিল প্যাগোডা-প্রান্তের ঐতিহাসিক পুরনো প্যাভিলিয়ানের হলঘরে বসবার ও ঘোরাঘুরি করবার। ১৯৭৬-৭৭ মরশুমে ক্লাব-হাউস চালু-হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচে ঐ প্যাভিলিয়ানের শেষবার ব্যবহার হয় ১৯৭৪-৭৫ মরশুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সফরকালে।

অতএব বরাবরই একটা ইচ্ছে ছিল একবার স্বচক্ষে লর্ডস-টা দেখবার। কিন্তু ছাত্রজীবনে তো বটেই, এমনকি কর্মজীবনেও কখনও লন্ডন যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বিদেশযাত্রা বলতে গেলে তো সবই অ-ক্রিকেটীয় দেশ – জাপান, জার্মানি, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অ্যামেরিকা – ঐ বাবদে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, গণ্য ছিল না নব্বই দশকের শেষলগ্নের নেপাল-ও। একমাত্র ১৯৯৮ সালের গোড়ার দিককার বাংলাদেশ-কে কিঞ্চিৎ জোর ক’রে ধরলেও ধরা যেতে পারে। তাই সে সাধ অপূর্ণই থেকে যাচ্ছিল।

কিন্তু গত জুলাই মাসে জামশেদপুরের ম্রিয়মাণ কিনান স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকে সেখানকার সবুজরঙা ঘাসের গালচের ওপর দাঁড়িয়ে কেন জানি না আমার সেই লর্ডস-বাসনা যেন পুরনো গেঁটে-বাতের ব্যথার মতন চাগিয়ে উঠল। সঙ্গে হয়ত পোঁ ধরলেন ডয়েল-ডাক্তার-এর সৃষ্টি গোয়েন্দাপ্রবর হোমস। আর মক্কেলহীন উকিল সিডনি কার্টন-এর স্রষ্টা ডিকেন্স-সাহেব যেন বলে উঠলেন: it is the age of wisdom, it is the age of foolishness,” সুতরাং “আমারে ডাক দিল কে লর্ডস-পানে!”

লন্ডন-এর লর্ডস নাকি লর্ডস-এর লন্ডন

লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হ’ল। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের “লন্ডনের অবশ্য-দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ”-এর তালিকায় ছিল না বাকিংহাম প্যালেস, টাওয়ার ব্রিজ, ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে, মাদাম তুসোঁ প্রদর্শনশালা বা লন্ডন আই। বদলে সেখানে ছিল লর্ডসের মাঠ, হোমস প্রদর্শনশালা, জাতীয় চিত্র সংগ্রহশালা, গ্রিনিচ মানমন্দির ও ডিকেন্স প্রদর্শনশালা – তালিকার প্রথম নামটাই আমার কাছে এক ছ’দশকব্যাপী আকাঙ্ক্ষাপূরণের ইঙ্গিত। হোমস ও ডিকেন্স এঁদের প্রতি মনের টানের আরম্ভ আরো বছর সাত-আট পরে, কিশোর বয়সে।

বরিষ্ঠ ভারতীয় নাগরিকের এই সুপরিণত বয়সে এসেও স্বীকার করতে আমার কোনও সঙ্কোচ নেই যে Lord’s was, has been, and still is my first love for London … অতএব “ক্রিকেটর মক্কা” দর্শন করবার মৌকা নিয়ে খবরাখবর নেওয়া শুরু করলাম Internet-এর মাধ্যমে। পেলাম সেই খবর এবং লন্ডন-যাত্রার দিনসাতেক আগেই MCC-পরিচালিত এক Lord’s Tour-এর জন্য সংরক্ষণ ক’রে ফেললাম – এই বছরের Ashes series উপলক্ষে “The Australian Special” নামক এক আড়াই-ঘন্টাব্যাপী guided-সফর – শুভ কাজে নাকি বিলম্ব করতে নেই!

লন্ডন পৌঁছোবার পরের দিনই ছিল দ্বৈত-আকর্ষণ – সকালে ২২১বি বেকার স্ট্রিট এবং দুপুরে সেন্ট জন’স উড রোড, আমার ‘To Visit List’-এর সেরা দুই দ্রষ্টব্য। প্রথমটা সেরে হাতে যথেষ্ট সময় আছে দেখে মনোরম আবহাওয়ায় ধীরগতিতে হেঁটেই চলে গেলাম লর্ডস-এর সামনে। পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম (১৯৮৭ সালে) উদ্বোধন-করা দ্বিশতবার্ষিকী দেউড়ি বা Bicentenary Gate, যার উদ্বোধক ছিলেন তৎকালীন এমসিসি সভাপতি প্রিন্স ফিলিপ বা ডিউক অফ এডিনবরা।

লর্ডস-এর সামনে
Bicentenary Gate

পাঁচিলের চৌহদ্দির গা ঘেঁষে বেশ খানিকটা হেঁটে এলাম বিখ্যাত লর্ডস ট্যাভার্ন-এর সামনে, পাশেই আমাদের জন্য নির্ধারিত গ্রেস গেট প্রবেশ-দ্বার। খিদে-তেষ্টা দুইই পেয়েছিল আর হাতে খানিকটা সময়ও ছিল, অতএব ট্যাভার্ন-এ বসে হাল্কা মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলাম। তারপর যথাসময়ে উপস্থিত হলাম গ্রেস গেট-এর সামনে, প্রবেশপত্র দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম – বেলা তখন আড়াইটে।

ট্যাভার্ন-এ ব’সে হাল্কা মধ্যাহ্নভোজন
গ্রেস গেট
শুরু হল স্বপ্নের সফর

আমাদের সঙ্গে ছিলেন আরো ডজনখানেক উৎসাহী দর্শনার্থী, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ড-নিবাসী এক অজি-দম্পতি, অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী এক ভারতীয়-দম্পতি ও ইংল্যান্ড-নিবাসী এক মার্কিন-দম্পতি। আমাদের গাইডের সঙ্গেও আলাপ হ’ল – তিনি একজন ক্রিকেটোৎসাহী এমসিসি-সদস্য, কর্মজীবনে যিনি ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক-দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এমসিসি-র কাজে (অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা সমেত) বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন।

এক পাত্র সৌজন্য-শ্যাম্পেন হাতে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই ঘন্টার সামনে, যেটা বাজিয়ে ম্যাচের উদ্বোধন করেন বিখ্যাত ব্যক্তিরা। তারপর গিয়ে দাঁড়ালাম মাঠের সেই সাদা বেড়ার ধারে, আর একটু পরে সেই বিখ্যাত ইটরঙা ব্যালকনিগুলোর সামনের সাদা গ্যালারিতে। তাহলে এই সেই সেন্ট জন’স উড রোড-এর ‘জনস্থান-মধ্যবর্তী’ ক্রিকেটের মক্কা!

সেই ঘন্টার সামনে
মাঠের সেই সাদা বেড়ার ধারে
সামনের সাদা গ্যালারিতে

লর্ডস-এর ইতিহাস লিখতে আমি বসিনি – তার জন্য তো অনেক বই-পত্রিকা-ইন্টারনেট আছে – এটা ক্রিকেটপ্রেমী এই অধমের এক তীর্থযাত্রার সমান। ১৯৬৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ১৩ই অগাস্ট, প্রায় ছয় দশক লাগল আমার ইডেন থেকে লর্ডস পৌঁছতে – “দের আয়দ, দুরস্ত আয়দ” এই কাবুলি-প্রবাদটা পড়েছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলি সায়েব-এর “দেশে বিদেশে” বইতে, মনে পড়ল।

‘জনস্থান-মধ্যবর্তী’ ক্রিকেটের মক্কা

এবার গন্তব্য এমসিসি-র সংগ্রহশালা। দেখলাম অনেক কিছু – অ্যাশেজ-সিরিজের আসল ট্রফি, ক্রিকেট-বলের আঘাতে মৃত চড়াইপাখির স্মরণিকা, বিশ্বকাপ ট্রফি, পতৌদি ট্রফি, বিখ্যাত ক্রিকেটারদের (যেমন ডবলু জি গ্রেস, ভিক্টর ট্রাম্পার, হেডলি ভেরিটি, অ্যালান নট,বব ম্যাসি, শেন ওয়ার্ন, সৌরভ গাঙ্গুলি ইত্যাদি) ব্যবহৃত জামা-ব্যাট-বল-প্যাড-গ্লাভস – কয়েকটার ছবি রইল এখানে।

 

সংগ্রহশালার বিভিন্ন দেখলাম দেয়ালে-টাঙানো কিছু হাতে-আঁকা প্রতিকৃতি – ডবলু জি গ্রেস, সিডনি বার্নস (২৭ টেস্টে ১৮৯-টা উইকেট-শিকারি, মনে করিয়ে দিই), ভিভ রিচার্ডস, শেন ওয়ার্ন এঁদের।

 

লেগ-স্পিন খেলতে অপেক্ষাকৃত-দুর্বল ব’লে অভিহিত ভিভ হয়ত ভাবছেন কেমন ক’রে ওয়ার্নি-কে ঠ্যাঙাবেন, আর শেন হয়ত গুগলি বা ফ্লিপার দিয়ে ভিভ-কে ঠকাবার ফন্দি আঁটছেন – কী জানি! (নীচের ছবি)

 

একটা ছবি (নীচে) দেখে প্রথমে মুষ্টিযোদ্ধা ব’লে মনে হ’লেও তৎক্ষণাৎ চিনে ফেললাম তাঁকে, যাঁর শক্ত মুষ্টিতেই আজও ধরা টেস্ট-ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস চারশো নট-আউট-এর খেতাবটা।

 

তারপর ঢুকলাম সুবিখ্যাত লং রুম-এ, দলের সাজঘর থেকে বেরিয়ে এমসিসি-র ঝানু সদস্যদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যে হলঘর পেরিয়ে ব্যাটারদের মাঠে নামতে হয়েছে – হবস-হ্যামন্ড-ব্র্যাডম্যান-হাটন-কম্পটন-ওরেল-হার্ভে-হানিফ-সোবার্স-কানহাই-জাহির-বিশ্বনাথ-চ্যাপেল-গাভাস্কর সবাইকেই।

ঐ লং রুম-এই আছে Lord’s Honours Board – লর্ডস-এর মাঠে টেস্ট বা ওডিআই ম্যাচে ইংল্যান্ড ও সফরকারী দলের খেলোয়াড়দের শতরান করা বা ইনিংসে-পাঁচ-উইকেট নেওয়ার ‘ছাপ।’ এখানে নাম তুলতে পারা যেন প্রতিটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের সযত্নলালিত ক্রিকেটীয়-স্বপ্নগুলোর অন্যতম। গত তিন/সাড়ে-তিন দশকের ভারতীয় ক্রিকেটের অবসরপ্রাপ্ত ধনুর্ধরদের মধ্যে সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা হয়ত আছে তেন্ডুলকর, কুম্বলে ও ধোনি এঁদের। কোহলি কী পারবেন – দেখা যাক!

 

বড় আনন্দের কথা, ১৯৩২ থেকে আরম্ভ ক’রে ২০২১-২০২২ এই দীর্ঘ ন’দশকে ভারতের ইংল্যান্ড-সফরের টেস্ট-ইতিহাসে মোট ১৯-টা দফায় ১৯৭১ ও ২০১৮ ছাড়া প্রতিটি টেস্ট-সিরিজেই কোনও না কোনও ভারতীয়, ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক [১৯৭৯-তে বিশ্বনাথ ও ভেঙ্গসরকার, ১৯৮২-তে ভেঙ্গসরকার ও কপিল, ১৯৯০-এ আজহারউদ্দিন ও শাস্ত্রী, ২০১৪-তে ঈশান্ত. রাহানে ও ভুবনেশ্বর], এই তালিকায় নাম তুলেছেন – আর হ্যাট-ট্রিক করেছেন ভেঙ্গসরকার, ১৯৭৯, ১৯৮২ ও ১৯৮৬ এই তিনবার তিনটে শতরান ক’রে। তবে ১৯৫২-র ভিনু মানকড়-এর মতন গৌরবজনক চৌকস প্রদর্শন বোধহয় আর কোনও ভারতীয়েরই নেই। দেখলাম লং রুম বহন করছে এই ভারতীয় কৃতিত্বের ছবি, আক্ষরিক অর্থেই – রয়েছেন ভেঙ্গসরকার ও কপিল।

 

স্টেডিয়াম-চত্বরের নতুন সংযোজন হ’ল ২০২১ সালে উদ্বোধন-হওয়া গ্যালারির গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড ও কম্পটন স্ট্যান্ড এর পেছনের Father Time Wall (বা সময়ের দেওয়াল)। সেখানে ক্রিকেট-ইতিহাসের ‘স্মরণীয়তম শতসংখ্যক মাইলফলক’গুলোর মধ্যে রয়েছে এই দুটোও – দেখে বড় ভাল লাগল, আর ১৯৮৩-র ২৫শে জুন-এর সেই রাত মনে এল, “সে কী ভোলা যায়!”

 

দেখা হ’ল ইংল্যান্ড দল ও সফরকারী দলের জন্য বরাদ্দ সাজঘর (ছবি তোলা নিষেধ) ও তৎসংলগ্ন ব্যালকনি দুটো, যাদের মধ্যে দ্বিতীয়টা (অনেক কিছু ঘটনার সঙ্গে) ‘দাদাগিরি’রও সাক্ষী – সেই জার্সির ছবি তো দিয়েছি! এবার দিলাম ঐ দুই ব্যালকনির মধ্যবর্তী প্রধান ব্যালকনি ও তার ঠিক নিচের গ্যালারির ছবি – ১৯৭৫ ও ১৯৭৯-র ক্লাইভ লয়েড, ১৯৮৩-র কপিল দেব, ১৯৯৯-এর স্টিভ ওয়, ২০০২-এর সৌরভ গাঙ্গুলি, ২০১৯-এর অঈন মরগ্যা্ন, এঁদের ছবিগুলো মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল ঐখানে বসে। সেই অনুভূতি লিখে হয়ত ঠিক প্রকাশ করতে পারছি না, তেমন কল্পনাশক্তি বা কলমের জোর তো নেই – নেভিল কার্ডাস নিশ্চয়ই পারতেন, সেই ১৮৮২-র ওভাল টেস্টের গ্রেস বা স্পফোর্থ এঁদের যেমন করে দেখিয়েছিলেন!

 

এবার একটু ‘গুরুদেব’কে স্মরণ করতেই হ’ল, কয়েকটা শব্দ বদলানোর জন্য আগেভাগেই ক্ষমা চাইছি: “…(ক্রিকেটের কয়েক) শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত।“ আজ্ঞে হ্যাঁ, এমসিসি লাইব্রেরি-তে পা ফেলেই আমার এই কথাটা মনে পড়ল। এই অধমের ব্যক্তিগত সাড়ে-ছ’শোরও বেশি ক্রিকেটীয় ‘পুস্তকসংগ্রহ’ যে এর তুলনায় কতটা নগণ্য, তাও বোধগম্য হ’ল। এক আলমারি ভর্তি Wisden Almanack-এর এমন সংগ্রহ তো অভাবনীয়!

শুনলাম এমসিসি-র সংগ্রহের বই-পত্রিকা-দলিলগুলোর একটা বড় অংশই আলাদাভাবে অন্যান্য ঘরে রাখা থাকে – এই লাইব্রেরিটা আসলে নাকি সদস্যদের বসে-পড়বার-ঘর বা reading room – দেখলাম অ্যাশেজ-সিরিজ-সংক্রান্ত কিছু স্কোর-খাতা এবং বডিলাইন-সিরিজ-সংক্রান্ত দুয়েকটা ‘বিস্ফোরক’ চিঠি ও তারবার্তা যাতে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া এই দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরবার সম্ভাবনারও উল্লেখ ছিল। ক্রিকেটীয় কৌশল বড় প্রভাব ফেলেছিল কূটনীতির ওপরেও।

 

স্কোর-খাতাগুলোর মধ্যে দু’টোর ছবি সঙ্গে দিলাম – দু’টোই দুই অ্যাশেজ-সিরিজের তৃতীয়-টেস্টম্যাচ থেকে, তবে পাঁচ দশকের ব্যবধানে – ১৯৩২-৩৩ মরশুমের বডিলাইন-সিরিজের অ্যাডিলেড-টেস্টে ম্যাচের-তথা-ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের, আর ১৯৮১ মরশুমের হেডিংলি-টেস্টে ম্যাচের-চতুর্থ-তথা-অস্ট্রেলিয়ার-দ্বিতীয় ইনিংসের। প্রথম ম্যাচটায় লারউডের বলে বুকে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন অজি-অধিনায়ক ওপেনার বিল উডফুল ও মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন অজি-উইকেটরক্ষক বার্ট ওল্ডফিল্ড। দ্বিতীয়টা Botham’s Test নামে বিখ্যাত ম্যাচে বব উইলিস-এর অসাধারণ বোলিংয়ের ছাপ।

 

বিগত প্রায় সিকি-শতাব্দী যাবৎ লর্ডস-এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছে তার মিডিয়া সেন্টার। এখান থেকে প্রচারিত হয় ম্যাচের টিভি ও রেডিও ধারাবিবরণী। এখানে ব’সেই দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা তাঁদের ম্যাচ-রিপোর্ট লেখেন। এখানেই নেওয়া হয় অনেক সাক্ষাৎকার। অনেক তাবড় তাবড় ক্রিকেট-বোদ্ধা সাংবাদিক, লেখক, প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় এখানে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন।

 

সেখানেও ঢোকবার সুযোগ হ’ল। দেখলাম বিবিসি-র বিখ্যাত “টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল” (টিএমএস) অনুষ্ঠানের ঘর, আর স্কাই স্পোর্টস-এর ধারাভাষ্য-কামরা। জন আর্লট, ব্রায়ান জনস্টন ও বিল ফ্রিন্ড্যাল এঁদের স্মৃতি-বিজড়িত টিএমএস-র মঞ্চ এবং বিখ্যাত সব ধারাভাষ্যকারদের ব্যবহৃত আসনগুলো দেখে রোমাঞ্চিত হলাম। সেখান থেকে দেখলাম লর্ডস-এর বাইশ-গজি পিচগুলো এবং প্রায় ৮৫ মিটার (লম্বালম্বি) ও প্রায় ৭০ মিটার (আড়াআড়ি) বাউন্ডারিগুলো।

 

শেষ করবার আগে এবার একটু অন্যরকম একটা প্রসঙ্গ তুলি। লেখাটা লিখতে ব’সে আমাদের লোকসভায় সম্প্রতি অনুমোদিত মহিলা-সাংসদ-আসন-সংরক্ষণ বিলের নিরিখে এটার কথা মনে এল।

প্রথম ক্রিকেট-বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা হয় ইংল্যান্ডে, ১৯৭৩ সালে – অংশগ্রহণ করেন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-ত্রিনিদাদ-জ্যামাইকা এইসব দেশের মহিলারা – চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড, রানার্স-আপ হয় অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডে প্রমীলা-ক্রিকেটের প্রচলন নাকি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, ১৭৪৫ সালে।
অথচ ১৯৯৮ সালের আগে পর্যন্ত (লর্ডস-এর স্বত্বাধিকারী সংস্থা) এমসিসি-র একুশ দশকেরও বেশি সময়কার ইতিহাসে মহিলা-সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির প্রচলন ছিল না। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, এবং পরে সেপ্টেম্বর মাসে, দু’টো সদস্যসভায়, কলিন ইঙ্গ্লেবি-ম্যাকেঞ্জি-র সভাপতিত্বে মহিলা-সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে এমসিসি মহিলা-সদস্য নেওয়া চালু ক’রে।
একজন মহিলা-ক্রিকেটার ও ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়িকার সম্মানার্থে, দেরিতে হ’লেও, লর্ডস কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে – এই প্রবেশ-পথটা ও লং রুম-এর দেওয়ালের এই ছবিটা বোধহয় তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 

মিডিয়া সেন্টার-এর পিছনদিকে ভেতরের ঢাকা ব্যালকনি থেকে দেখলাম নার্সারি গ্রাউন্ড যেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় বিরতিতে খেলোয়াড়রা মাঝেমধ্যে অনুশীলনও করে থাকেন। আর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে উপস্থিত হলাম দর্শকদের গ্যালারিতে. প্রথমে কম্পটন স্ট্যান্ড ও পরে গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড। উইকেটের কোণাকুণি বা আড়াআড়ি থেকে মাঠটাকে দেখলাম – ৩৬০-ডিগ্রি না হলেও প্যাভিলিয়ন, মিডিয়া সেন্টার ও গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড মিলিয়ে প্রায় ২৭০-ডিগ্রি দর্শন হ’ল ‘মক্কার মাঠ’-এর।

 

এবার ফেরবার পালা। লিফটে চেপে নিচে নেমে সামনেই চোখে পড়ল লর্ডস-এর ‘সময়ের দেওয়াল’ যেখানে রয়ে গেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপের পরপর ১২ বারের চেষ্টায় প্রথমবার বিশ্বকাপ-বিজয়ী ইংল্যান্ড দল। মনে পড়ল ইংরেজদের অবশেষে-হারিয়ে-দেওয়া স্কটিশ রাজা রবার্ট ব্রুস-এর গল্পটা – অদম্য অধ্যবসায়, অসীম ধৈর্য, আন্তরিক প্রচেষ্টা এইসবের জয় – কেবলমাত্র সাফল্যের উচ্ছ্বাস নয়, এই বার্তাটা কি কোথাও একটা রয়ে গেল ঐ দেওয়ালে?

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এডরিচ স্ট্যান্ড-এর পেছন দিককার স্যুভেনির শপ থেকে এমসিসি-র লোগো-ওয়ালা একটা ক্যাপ কিনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম সেন্ট জন’স উড রোড-এ, বাস ধরে হোটেলে ফেরবার জন্য। মনের ক্যামেরা আর হাতের মোবাইলে ধরা রইল ঐ ঘন্টা-তিনেকের স্মৃতি, সারা জীবনের মতন।

 

কৃতজ্ঞতা-স্বীকার: লর্ডস ও এমসিসি কর্তৃপক্ষবৃন্দ

ছবি:
• লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
• ইডেন গার্ডেনস – “Remarkable Cricket Grounds”, Brian Levison
• Lord’s Guide

তথ্যসূত্র:
• লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
• https://www.lords.org
• Lord’s Guide

কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", এই বছর এল “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর লিখেছেন “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে।

4 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Paramita Roy , October 16, 2023 @ 10:16 am

    খুব সুন্দর স্মৃতিচারণ। পাঠকেরও যেন লর্ডস দর্শন হয়ে গেল।

  • T Kar , October 16, 2023 @ 10:25 am

    It’s not just depiction of Lords, it is also a fantastic diary of going down the memory lane of cricket and the legends of the great game! A great depiction and very enjoyable!

  • Susanta Majumdar , October 18, 2023 @ 1:52 pm

    খুব ভালো লাগলো। আসলে লর্ডস চত্বরটা কেমন তার আন্দাজ পাওয়া গেল।

  • Subhransu Roy , October 20, 2023 @ 5:29 pm

    পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন নিজেই পৌঁছে গেছি লর্ডসের ব্যালকনিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *