স্মৃতির অলিন্দে ফুলেল সুবাস
প্রতিদিন ভোরে আমাদের চৌকো উঠোনটাতে এক বিশ্রী গন্ধ দাপিয়ে বেড়াত। আধোঘুমের ভিতর থেকে সেই কটু গন্ধ আমার নাড়ি জড়িয়ে টেনে নিয়ে আসতে চাইত। কাঁঠালকাঠের চৌকি ছেড়ে নেমে আসতাম। আমাদের বাড়ির লাগায়ো দুটো উঠোন – একটা মণ্ডপ উঠোন আরেকটা ভিতরবাড়ির। অনেকটা ত্রিভুজের মতো আকৃতি ছিল পুরো বাড়িটার। জমিটা অবশ্য চারকোণা। ব্যাপারটা যে গোলমেলে, সে আমি অনেক ছোটো থাকতেই বুঝেছিলাম। যদিও আমার মাথার ব্যামো নিয়ে বড়রা বেশি চিন্তিত ছিল। তাদের মনে হয়েছিল আমার অলীক কল্পনা একদিন বটগাছ হয়ে আমার ভিতর ঝুরি নামিয়ে দেবে। তবু বাড়ির মানুষের সঙ্গে গাছপালাগুলোও আমায় টানতে থাকত। তাকে উল্টেপাল্টে দেখাতেই আমার সুখ। সহজ করে বলতে গেলে গোটা বাড়িটার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে আমাদের থাকার বাড়িটা মাঝখানে এবং সামনের দিকে। তার ডানদিকে মণ্ডপ উঠোন আর বাঁদিকে বড়জেঠুদের বাগান। যার পিছনে বড়জেঠুদের বাড়ি। আর তারও পিছনে আরো বেশ খানিকটা জমি। যেটা আবার আমাদের বাড়ির পর ভিতরবাড়ির উঠোন টপকে মেজজেঠুদের বাড়ির পিছন অবধি বয়ে গিয়েছিল। মেজজেঠুদের ঘর ছিল মণ্ডপের পিছনে। ভিতরবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আমি ত্রিভুজটা দিব্যি বুঝতে পারতাম। আর ভালো লাগত এই ভেবে আমরা মাঝের বাড়িতে থাকি। হাত ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে বলতাম, দুইপাশে দুই কলাগাছ / মধ্যিখানে মহারাজ। যদিও কারো কানে গেলে উল্টে শুনতে হত, দুইপাশে দুই সেফটিপিন / মধ্যিখানে গুয়ের টিন। তখন আমার বমি পেত। ঠিক যেমন এই সকালের কটু গন্ধটাতে পেত।
বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেতাম সাদা শাড়িতে ঝাঁটা হাতে উঠোনের গায়ে গোবরের প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছেন বছর পঁয়ষট্টির ঋজু ক্ষীণকায়া এক রমণী। আমার নাক সিঁটকানো দেখে চমৎকার বুলি আওড়াতেন, ‘গোবরের ছড় / শুদ্ধ করে ঘর।’ আজ অবধি বুঝে পাই না এমন বিচ্ছিরি বাসে কী উদ্ধার হয়! আমাদের বাড়ির লাগায়ো বড়জেঠুদের বাগানটি ছিল আমাদের সবচে’ বড় আশ্রয়। বিকেলের খেলা মণ্ডপ উঠানে জমলেও বাগান ছিল ফুল কুড়োবার আর গাছে চড়বার আনন্দ নিকেতন।
আমাদের বাড়ির শিউলিগাছটি বিশাল বড়, ইয়া মোটা তার গুঁড়ি, এখন শহরতলির লিকলিকে ছোটো শিউলি গাছের তুলনায় সে ছিল মহীরূহ। আর এর মুখোমুখি ছিল একটু খর্বকায়, কিন্তু শক্তপোক্ত গন্ধরাজ ফুলের গাছ। আমার ছোড়দি শিউলিগাছের মগডাল পর্যন্ত টারজানের মতো উঠে যেত। আমার ওই মাটির তিনহাত উপরে ঈষৎ বাঁকা গন্ধরাজের ডাল অবধিই দৌড় ছিল। শরৎকালে শিউলিতলা ভরে থাকত কমলা-বোঁটার পুরুষ্টু ফুলে। গন্ধরাজ গাছের পদ্মের মতো কুঁড়ি জমাটি সাদা, তার গন্ধ এখনও জোরে শ্বাস নিলে অনুভব করি। এই শিউলিতলা দিয়ে কোন এক দুর্গাপুজোর সময় অপরূপা কমলাদিদি ষষ্ঠীর দিন নাকি এসেছিলেন। সম্ভবত মেজজেঠু তাকে দেখেছিলেন, কিন্তু ঠাকমাকে খবর দিয়ে আনার পর সারাবাড়িতে আর তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের বাড়ি নিয়ে এমন অনেক গল্পকথা প্রচলিত ছিল। তার ঠিক বেঠিকের হিসেব আমি কখনো করিনি, বরং শিউলি ফুটলে কমলাদিদির অপেক্ষায় থেকেছি। প্রতিরাতে আমাদের মণ্ডপ থেকে বাঁশির শব্দ আসে কিনা, এই বুঝি নূপুর বেজে উঠল – এইসব অপেক্ষাই আমার প্রিয় ছিল। এই বাগানের একেবারে শেষের দিকে জোড়া নারকেল গাছ ছিল, দুটির ভারি ভাব। এতটাই কাছাকাছি যে আমাদের বড়ো পিঁড়িটা ওদের মাঝে এঁটে যেত, মাটির থেকে খানিকটা উপরে। তার উপরে বসতে আমার খুব ভালো লাগত। আর ছিল ডবল টগর ফুলের ছোট্ট ঝাপড়া গাছ। একটা ডুমুর গাছও ছিল। তাতে অনেক ফল হত। কিন্তু আমরা কেউ ডুমুর খেতাম না, তাই ফলগুলো কে বা কারা পেড়ে নিত তার খোঁজ কখনো রাখিনি। আমাদের পাঁচিল বিহীন বাগানগুলোতে বন্ধুবান্ধবেরা যেখান দিয়ে খুশি প্রবেশ করতে পারত।
আরেকটি গাছের আমার জীবনে বিশেষ ভূমিকা ছিল। আজ অবধি তাকে আমি ভুলিনি। সে হল আমাদের মণ্ডপের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানহাতে থাকা মস্ত ভেটুলগাছ। তার ছোটো ছোটো হলুদ ফুলে সারা উঠোন ভরে থাকত। আমি কল্পনায় ভেসে যেতাম সেই ফুলের সাহচর্যে। কী এক বুনো গন্ধ যে আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখত তার মুগ্ধতা আজও ভীষণ টাটকা। ফুলগুলো যেদিন ঝেঁটিয়ে উঠোন পরিষ্কার করা হত, আমার খুব কান্না পেত। বড় হয়ে রবিঠাকুরের বলাই পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল আমার এই দুঃখের কথা। আমাদের অনেকের ভিতরেই যে বলাই লুকিয়ে আছে এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
আমাদের নিম্নবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবার, তার না ছিল দালানকোঠা, না তেমন কোনো উচ্চমার্গের সংস্কৃতি সাধনা। কেবল আমার মায়ের সাধারণ হারমোনিয়াম বাজিয়ে নজরুলগীতি গাওয়া সুরেলা কণ্ঠটি চোখে স্বপ্ন এঁকে দিত। আজও মনে পড়ে মা আমায় হাত ঘুরিয়ে পা তুলে, ‘আমি পাহাড়ি ঝরনা রুমঝুমঝুম নূপুর বাজাই বাজাই গো ‘ নাচ শিখিয়ে দিচ্ছেন। সেই যে শুরু হল নাচ, এখন পর্যন্ত তার মোহপাশে বন্দী হয়ে রয়েছি। সন্ধ্যেবেলায় কাঁসর বাজিয়ে ঠাকমার সঙ্গে সুর মেলাতাম, ‘ছাড়ো রে মন ভবের আশা অজাপা নামে করো গো নেশা।’ এইসব গান গাইতে বসলেই আমার চোখে জল ভরে উঠত, কেন জানি না। হরেকৃষ্ণ গাইতেও ভারি সুখ অনুভব করতাম। মনে হত আমিও বুঝি চৈতন্যের মতো ভাবে লীন হয়ে যাব একদিন। যদিও তেমন ভক্তি আর পরবর্তীকালে টিকে থাকেনি। সম্ভবত ঠাকমার মৃত্যু আমায় সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে এনেছিল।
আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের গানের নিবিড় ভাবে পরিচয় হয়েছিল অনেক পরে। শহরে মেয়েদের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ভর্তি হবার পর। গানের দিদিমণি সবিতাদি প্রথম শেখালেন, ‘ধ্বনিল রে, ধ্বনিল রে, ধ্বনিল আহ্বান, মধুর গম্ভীর প্রভাত অম্বর মাঝে’ – হ্যাঁ, আমি আহ্বান শুনলাম। শিকড় ছাড়িয়ে ডানা মেলে উড়বার আহ্বান, এই বিশ্বজগতের মাঝে আপনাকে মিলিয়ে দেবার আহ্বান।
বোধনতলার বুড়ো বেলগাছের গায়ে লাল বাঁধানো শান করে দিয়েছিলেন আমার বাবা। সেই বোধনতলার বেলগাছের ডাল আমাদের ছাদের উপর লুটিয়ে পড়ে বিশ্রাম নিত। ভালো মন্দ কত কথা মনে উঁকি দিত। ঠাকমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এই মানুষটি জীবনে কখনো কোনও নেতিবাচক কথা আমায় বলেছেন, মনে পড়ে না। বলেছিলেন, “ভালো মন্দ তোমার উপর নির্ভর করে। এ জীবনে সব ভালো হতে পারে না, মন্দের ভিতর থেকে জেগে ওঠাই বড়ো কথা। পড়াশোনা করো, নিজেকে দেশের দশের এক করে তোলো। একটা বেলগাছের তোমার মাথায় থাকা না থাকা কোনো বিষয় নয়।”
এখনও যখন রাতের সঙ্গে সখ্যতা বাড়তে থাকে, ঘুম এক চিরশত্রুর মতো দূরে দাঁড়িয়ে আক্রমণের পথ খোঁজে তখন আমি চোখ খুলে অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যাওয়া বাড়িতে খালি পায়ে ঘুরতে থাকি। অনেকটা উপর থেকে নিজের উপর লক্ষ্য রাখি। মন দিয়ে দেখেছি, শিউলিতলায় এলে আমার পরনে সবুজ সুতির ছিটের উপর লালের দাগকাটা জামাটা পরা থাকে। ওটা সেজপিসি দিয়েছিলেন কোনো এক পুজোতে। আমার আর বোনের এক রকম। আমার রোগাভোগা, সরল মায়াবী চোখের বোনটিকে আমি চোখে হারাতাম। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে বেশিদূর যেতে দিতাম না, ভয় হত, যদি ডুবে যায়! আসলে জানতাম না, সব ডুবে যাওয়ার হাত থেকে আমি ওকে রক্ষা করতে পারব না। তবু অক্ষম প্রচেষ্টা চিরকাল জারি আছে। আমার বোনের ফুল কুড়োনোর এক আজব নেশা ছিল। ও আর ছোড়দি গভীর রাতে উঠে লোকের বাড়ি ফুল কুড়োতে চলে যেত। মনে আছে একবার পাড়ার মোড়ের বিখ্যাত মিষ্টি বিক্রেতা লক্ষ্মণজেঠুর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল ফুল কুড়োতে সুবিধা হবে বলে! নাহ্ আমাদের মেয়েকালে মেয়েদের নিজেদের নিয়ে এত আতঙ্ক ছিল না। ভোররাতে ভূত দেখা ছাড়া আর কোনো ভয় আমরা পেতাম না। অবশ্য আমার বোন আর জেঠতুতো দিদিকে অনেকে চোর বা ভূত বলে ঠাওরাত, আদপে ওদের ক্রিয়াকলাপ যে ভূতেদের মতোই ছিল, এ কথার মান্যতা সকলেই দেবে। সেসব দিন একঝুড়ি ফুলের পবিত্রতা নিয়ে আমার স্মৃতির বারান্দা আলো করে রাখে।
স্মৃতিপথে গন্ধরাজ গাছে উঠলেই আমার বান্ধবী সরস্বতীর আবছা মুখটা ভেসে আসে। আর ভিতর বাড়ির উঠোনে এলেই আমি এখনকার আমিকে দেখতে পাই। যে কেবল খুঁজেই চলে, ছায়ার ভিতর, শ্যাওলা ধরা টিউবওয়েলের পাশে, পেয়ারাগাছের বাকল খসা সাদাটে ডালে, তুলসীমঞ্চের পাটকাঠিতে বাঁধা ধারাজলের কলসে, আমগাছ কাঁঠালগাছের ছায়ায়, ভেটুল গাছের মায়ায়, কোথায় আছে তার ঠাকমা! কোথায় আছে স্নেহের সেই অমৃত কলস। একবার যদি পাই, ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরি তাকে, বুকে মুখ গুঁজে বলি, “জুড়িয়ে দাও, জুড়িয়ে দাও।”