সুমিতের স্মৃতি আমার মানসচোখের আকাশে কয়েক গুচ্ছ মেঘের মালা। কোথাও একত্রে জড়ো, কোথাও আবার পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যে থেকে কীভাবে পুরো সুমিতকে তুলে ধরি?
সুমিতের সঙ্গে যোগাযোগের শুরু B.E.College-এ প্রথম বর্ষে, ১৯৫৬ সালে জুলাই মাসে। তা চলে ১৯৬০ পর্যন্ত এক নাগাড়ে। এর পরের যোগাযোগটা টুকরো-টুকরো। অর্থাৎ ছুটি-ছাটাতে। এর মধ্যে বসুশ্রী কফি হাউস একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। কলেজ জীবন থেকেই প্রতি বছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমীতে ওর বাড়ির পুজোয় দুপুরের ভোগ ছিল। ব্যাপারটা চলেছিল ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৪ সালের শেষার্ধে আমি দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগি এবং তখন থেকেই যোগাযোগ চ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই পর্বটা আমার বন্ধুদের কাছে আমার অজ্ঞাতবাস বলা চলে। এর পরে হঠাৎ আমার বন্ধুদের খেয়াল হয় আমি বোধহয় ধরাধামে এখনও বহাল। মধ্যবর্তী কালে মাত্র দু-তিনজন আমার সঙ্গে যোগযোগ রাখত। এর মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থানে ছিল Toronto-প্রবাসী পার্থসারথি ওরফে ‘পারু।’
‘সুমিত রায়’ নামে একজনের কথা আমি জানতে পারি ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরুনোর পর। হরিশ মুখার্জী রোডের মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল এবং জেনেছিলাম সে স্বনামধন্য অভিনেতা বিকাশ রায়ের সন্তান। যথারীতি সে ভর্তি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং আমি যাই বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে। আবার সুমিতের নাম খবরের কাগজের পাতায় ওঠে যখন সুমিত ১৯৫৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে I.Sc পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং তার অবস্থান ছিল প্রথম চার জনের মধ্যেই। পরীক্ষায় সহজ ভাবে আগের দিকে থাকাটা সে বোধহয় তার নিজস্ব অধিকার করে নিয়েছিল। তাই যখন সে B.E.College Admission Test-এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করল, আদৌ আশ্চর্য হইনি।
তবে সুমিতকে প্রথম লক্ষ্য করলাম এবং সে যে কত সহজে নিজের ছাপ রাখে বুঝলাম – তারিখটা মনে আছে চৌঠা জুলাই (১৯৫৬) বুধবার সন্ধায় আমাদের ‑ইন্সটিটিউট হলে, Freshers’ Gathering অনুষ্ঠানে। আগের রাতে ragging পর্ব হয়ে গেছে, আমরা কলামবদ্ধ হয়ে হাজির হলাম বধ্যভূমিতে। সে এক বিচিত্র আয়োজন; এক এক জনের নাম ডাকা হচ্ছে আর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সে হয়তো একটা কিছু উত্তর দিচ্ছে, কিন্তু তার মাইক অকেজো করে রাখা হয়েছে আর উইংস থেকে তার হয়ে একটি জবাব দিচ্ছে কোনো এক দাদা, যা যথেষ্ট অপ্রস্তুতকর এবং সকলের কাছে আমোদের, এমন কী আমাদেরও।
সব শেষে ডাক পড়ল সুমিতের। তার পরিচিতি দেওয়া হল ‘দেখা গেল এই ছেলেটিই চালু, মানে গড়িয়ে দিলে চলে।’ তার উপর আদেশ হল ‘হুলাহুলা’ নাচ দেখাবার। জবাবে সুমিত সপ্রতিভভাবে এবং সহজ আমুদে গলায় প্রশ্ন করলো, “’হুলাহুলা’ নাচ সম্বন্ধে আপনাদের কোনও আইডিয়া আছে?” জবাব হল সমস্বরে “না।” সুমিত বললো, “যাক, আপদে শান্তি। হুলাহুলা নচে একজন পার্টনার লাগে, আমি কি একজন পার্টনার ডেকে নিতে পারি?” এবং সম্মতির অপেক্ষা না রেখে স্টেজে উঠে গেল অজিত মুখার্জী। তারপর শুরু হল নাচ সঙ্গে গান ‘ছোড় চলে প্যারে দুনিয়াকো।’ বুঝলাম সুমিত সকলের চেয়ে আলাদা। তার কাছে কোনও পরিস্থিতি, কোনও সমস্যা দুরূহ নয়। সে অবলীলায় সব অতিক্রম করতে পারে।
তার মানদণ্ডের পরিচয় আর একবার পেয়েছিলাম বসুশ্রী কফি হাউসে আমাদের আড্ডায়। আমাদের নিয়মিত বসার টেবিল ছিল একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। নানা রকম গল্প, ঠাট্টা ইত্যাদি ছিল। আর ছিল একটি Quiz যার নাম ছিল ‘Who is the person?’ সর্বাধিক কুড়িটি প্রশ্ন করা যাবে যার উত্তর হবে ‘Yes’ বা ‘No।’ রোজই উত্তর বেরিয়ে যেত কুড়ির সীমানা ছোঁয়ার আগেই। ঘায়েল করে দিল সুমিত, Francis Gary Powers-এর নাম ভেবে। কিছুতেই বার করা গেল না আমাদের ছ’সাতজনের চেষ্টাতেও।
আগেই বলেছি, ১৯৬৪ সাল থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’ বলে আমার জীবনে ফিরে এল ২০০৭ সালে নতুন বেশে, যা আগে সুমিতের সম্বন্ধে ভাবতে পারিনি। আমার যোগসূত্র পেয়ে নিয়মিত সংলাপ চলতে লাগল ফোন ও মেল মারফত। এর পর জানতে পারলাম ও ‘অবসর’ নামে একটি আন্তর্জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত তার জন্মলগ্ন থেকে। শুধু জনক হিসেবে নয়, নিয়মিত লেখা পাঠায়। লেখার ঢঙ সৈয়দ মুজতবা আলীর মতই। পড়ে প্রচুর রস আস্বাদন করতাম। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত, দেখতে পেলাম আমাদের বিশেষ পছন্দ এক। গুরু রবীন্দ্রনাথকে এর মধ্যে হিসেবে আনছি না, সেটা স্বতঃসিদ্ধ; পরশুরাম, সুকুমার রায় এবং লীলা মজুমদার। গানের চর্চাও চলতে লাগল। এর মধ্যে সে এক আমার পক্ষে দুঃসাহসিক অভিযানের প্রস্তাব দিল- “তুই অবসরের জন্য ভারতীয় রাগ সঙ্গীত সম্বন্ধে লেখ।” আরে দেখ, এ পাগলা বলে কী! আমি লিখব রাগসঙ্গীতের উপরে! মোল্লা তো তবু মসজিদ পর্যন্ত দৌড়োতে পারে| আমার নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা দুই খেপে চার বছর, তাও রাগের উপর বা কণ্ঠ সাধনা দেড় বছর কুল্লে। হ্যাঁ, গান আমি শুনতাম প্রচুর, এমনকি গান তুলতে পারতামও বহু সংখ্যায়। গাইতামও সভায়-টভায়। তাই বলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর লেখা!
বললাম, “অসম্ভব; গান শুনি, তাই বলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর লেখা। ও আমার দ্বারা হবে না।” শুনে সুমিত বলল, “তুই অনেকের চেয়ে ভালো জ্ঞান রাখিস।” আমি নাকি ওর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে বিয়ের আসরে সানাই শুনে বলেছিলাম সানাইটা ‘মারুবেহাগ’ রাগ বাজাচ্ছে। আর ওর কোনো কাকা নাকি তারিফ করেছিলেন ছোকরা জানে বটে। দূর! আমার মনেই পড়ে না, কিন্তু সুমিত নাছোড়বন্দা। অগত্যা মল্লভূমিতে নামতে হল।
এখন ঠাকুর বলেছিলেন – নিজেকে মারতে নরুণই যথেষ্ট, পরকে মারতে গেলে দা, সড়কি, বল্লম, তরোয়াল লাগে। তাই অস্ত্র সন্ধানে ITC Sangeet Research Academy নামক অস্ত্রভাণ্ডারে নিয়মিত যাওয়া আরম্ভ করলাম – তার লাইব্রেরিতে এবং ওয়েবসাইটে। তার পর আরম্ভ করলাম অবসর পত্রিকায় ক্রমিক লেখা ‘রাগসঙ্গীত প্রবেশিকা’ নামে। চৌদ্দ কিস্তি লিখেছিলাম, কেউ খিস্তি শুরু করার আগে দাঁড়ি টেনে দিলাম।
আমার এই উদ্যোগে অবসর পত্রিকার কিছু উপকার হয়েছিল কিনা বলতে পারব না; তবে আমার প্রচুর হয়েছিল। আগে যেখানে দূর থেকে মহাসাগর দেখতাম, সেখানে রসের সাগরে অবগাহন করলাম এবং আজও নিত্য করে চলেছি। সুমিতকে এক দিন বলেছিলাম, “চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যের মত বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমি তোকে খুন করে তোর প্রতিমা গড়ে পূজা করব। তুই আমাকে এ কী মাদকের জগতে ছেড়ে দিলি।’”
এটাই ছিল সুমিতের স্বভাব। শুধু নিজের উন্নতি নয় অপরকে শ্রেয় জগতে নিয়ে এসে সঙ্গে থাকা, চলা।
আজ সুমিত নেই, নিজের মধ্যে একটা গভীর শূন্যতা অনুভব করছি। আবার একই সঙ্গে ওরই ভাষায় নিজের মধ্যে সুমিতকে আবিষ্কার করছি। সুমিত আমার জীবনে এসেছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে রয়ে গেছে।
4 Comments