সুমিতদা চলে গেলেন। বিশ-বিশের ফাঁড়া কাটিয়ে দিব্যি কাটছিল দিন, হঠাৎ অন্তর্ধান। ভেবেছিলাম প্রায় পেরিয়ে এসেছি দুর্যোগের দিনগুলো, শেষরক্ষা হল না।
সুমিতদা-বীথি আমাদের বহুদিনের বন্ধু। আমাদের ছেলেমেয়েরা সেই বয়ঃসন্ধির সময় থেকে একসঙ্গে খেলে, দুষ্টুমি করে, বড় হয়েছে। এই বিদেশে বসে বীথির হাতেমাখা দুর্দান্ত ঝালমুড়ি, চা, একসঙ্গে খেয়ে আড্ডা দিয়েছি, এক গাড়িতে বেড়াতে গেছি, এক ছাদের তলায় থেকেছি। খেয়াল করিনি সময় কখন কেটে গেছে। কালের গতি টের পেয়েছি সন্তানদের পরিবর্তন থেকে – তাদের কলেজ, চাকরি, বিয়ে, ছানাপোনার আগমন তা নিয়ম মাফিক জানান দিয়েছে। একে অন্যের চুলে পাকধরা দেখেছি, কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি আমাদের মধ্যে একজন সবার আগে চলে যাবে। প্রায় চল্লিশ বছরের সম্পর্ক – রক্তের না হলেও ঘন বইকি।
সুমিতদা গুণী মানুষ ছিলেন – প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু সব দক্ষতা ছাপিয়ে উঠেছিল ওঁর বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি প্রেম। সেই আত্মসমর্পণ সারা জীবন অনড়, অচল থেকেছে। সুমিতদার জীবনের প্রতিটি ছত্রে জড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ – আমরা খেপাতাম ‘টেগোরাইটিসে ভুগছ’ বলে। কথাটা শুনে সুমিতদার ঠোঁটে সামান্য ব্যঙ্গ মেশানো হাসি ফুটত – মানে, ‘ওরে অর্বাচীন!’ তবে সুমিতদার সাহিত্যপ্রীতি বা জ্ঞান নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ দেবার অনেক কুশলী রয়েছেন। সুমিতদার গুণমুগ্ধের অন্ত নেই। সে সব ছাড়াও আমার কাছে যে কয়েক টুকরো আলাদা স্মৃতি পড়ে আছে, তাই নিয়ে বলি।
সুমিতদা খাদ্যরসিক ছিলেন। বেশি খেতেন না, কিন্তু বাঙালি রান্না ভালোবাসতেন। এক গরমকালে সুমিতদার মা নিউ জার্সিতে বেড়াতে এসেছিলেন। ছেলেকে ভালোবেসে এদেশের উপকরণে নানান উপাদেয় রান্না রাঁধতেন মাসিমা। আড্ডা, মাসিমার স্নেহ, আর খাবারের লোভে প্রায়দিনই আমরা সেখানে উপস্থিত হতাম। দেখতাম সুমিতদা পরম তৃপ্তিতে ডাল, চচ্চড়ি, মাছের ঝাল খাচ্ছেন। মায়ের হাতের রান্না বলে কথা! এদেশের বিতিকিচ্ছিরি সামুদ্রিক মাছ থেকে কী করে যে অমন স্বাদ বের করতেন মাসিমা, জানি না। জিজ্ঞেস করার আর উপায় নেই, উনিও বহুদিন আগে হাঁটা দিয়েছেন ওপারে।
মাসিমা চলে যাবার অনেকদিন পরে একবার মাছের কালিয়া রেঁধেছিলাম। পরিমিত বাক্যব্যয়ে বিশ্বাসী সুমিতদা বললেন, ‘বাঃ!’
বলেছিলাম, ‘তোমার তো ভালো লাগবেই – মাসিমার রেসিপি!’
মুখটা একটু উদ্ভাসিত হল, ‘তাই!’
একবার আমাদের বন্ধু মুমু জুকিনি কষিয়ে একটা দারুণ সরষে-চচ্চড়ি রাঁধল। সবাই হাপুস-হুপুস খাচ্ছি। মুচকি হেসে সুমিতদা হাততালি দিলেন, ‘কয়েক বছর পরে এটা লোকমুখে ফিরবে, ‘চচ্চড়ি খেয়েছিলুম বটে বোস-গিন্নির হাতে। তিন সের জুকিনি কষে এক পোয়া করলে মাইরি…!’’
সুমিতদার কথায় সাবেকি বৈঠকি ঢঙ প্রায়ই সুর টানত।
সুমিতদা নিজেও রাঁধতে ভালোবাসতেন। চলে যাবার মাসখানেক আগে একদিন ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সরষে বাটছি, কিন্তু তেতো হয়ে যাচ্ছে। কী করি বল তো?’ মাঝেমধ্যে সুজনকেও উদ্বুদ্ধ করে রান্নায় হাতেখড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
মানুষটা রুচিবাগীশ ছিলেন – সে রান্নাই হোক আর লেখা। বাংলা লেখায় অতিরিক্ত ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে বিরক্ত হতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতে অর্কেস্ট্রার বাহুল্য থাকলে অপ্রসন্ন হতেন, ওয়েবসাইটে গোঁজামিলের কাজ দেখলে ডিজাইনারের বাপান্ত করতেন। এক্কেবারে নিখুঁতবাদী (পিওরিস্ট)! সুমিতদা বলতেন এই একটি ব্যাপার উনি নিজের ‘বাবু’র কাছ থেকে শিখেছেন – দর্শক (বাবার কাছে) এবং পাঠকের সঙ্গে (সুমিতদার কাছে) তঞ্চকতা করা চলবে না। যা দেবার তা সম্পূর্ণ মনপ্রাণ দিয়ে দিতে হবে। অল্প খেটে নাম কেনা হল ফাঁকি দেওয়ারই নামান্তর – তা যেন কখনও না ঘটে।
এই ‘তঞ্চকতা’র ব্যাপারে সুমিতদা ছিলেন কট্টর। অনেকবার দেশের নামিদামি লেখকেরা এখানে নানান সম্মেলনে এসে ‘বোকা অভিবাসী’দের সামনে যা হোক একটা কিছু বলে নিজেদের দায়িত্ব মিটিয়েছেন। পরিষ্কার বোঝা গেছে যে উদ্দেশ্যে এখানে আমন্ত্রণ জানানো, সেই আলোচনা তাঁদের কাছে গৌণ। বিদেশভ্রমণ এবং কিছু ফুর্তি করাই লক্ষ্য। এ সব জায়গায় একেবারে প্রথম সারিতে বসে সুমিতদা খোলাখুলি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এঁদের সম্বন্ধে ‘পন্টক’ শব্দটা সুমিতদাকে বারবার উচ্চারণ করতে শুনেছি। [চতুর ইঙ্গিত! শব্দটা অভিধান বহির্ভূত হলেও ‘কণ্টক’-এর সঙ্গে মিলিয়ে এর চলিত রূপ ভাবুন!] সুমিতদার বিরক্তি জাগিয়ে ইংরেজিতে বলি, ‘he didn’t suffer fools gladly।’ এই সততার শিক্ষা খুব বড় শিক্ষা।
এখনও সুমিতদার অনেক ইমেল আমার মেলবক্সে জমা রয়েছে। ভালো রাজনৈতিক বই, বর্ণবৈষম্য সংক্রান্ত বই পড়ে আমাকে তার রেফারেন্স পাঠাতেন। বর্ণবৈষম্যের অন্যায় নিয়ে খুবই সচেতন, সহানুভূতিশীল ছিলেন। বেল ল্যাবে চাকরি আরম্ভ করে বর্ণ সম্পর্কিত সংবেদনশীলতার ট্রেনিং নিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছিল আন্তরিক পত্রিকায় – ‘টিম হার্ভি’ প্রবন্ধে। কী গভীর সেই উপলব্ধি! গত চার বছরে আমেরিকার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু তর্কবিতর্ক আমাদের চলেছে ইমেলে। মতের অমিল নেই, শুধু আরও প্রাঞ্জল বিশ্লেষণের চেষ্টা। কিছুদিন আগে আমি একটা আধুনিক রহস্যকাহিনির রেফারেন্স দিয়েছিলাম। পড়ার পরে ইমেলে সুমিতদার উক্তি, ‘পবিত্র গরু!’ বুঝলাম খুব ভালো লেগেছে।
অসুস্থতার খবর শুনে সুমিতদাকে বলেছিলাম, নিউ ইয়র্কে চিকিৎসার জন্যে এলে যেন আমাদের কাছে থাকেন। বলেছিলাম, ‘সুমিতদা, তোমাদের খুব যত্ন করে রাখব। কোনো কষ্ট হবে না। এস…’
স্নেহের সুরে বললেন, ‘জানি বুই, জানি। “তোমারে যতনে রাখিব হে, রাখিব কাছে…”’
সেই আমাদের শেষ কথা। কিছুটা শান্তি পাই যখন ভাবি রবীন্দ্রনাথ শেষ অবধি সুমিতদার সঙ্গেই ছিলেন।
4 Comments