সোলারিস: ভাষ্যের ভিন্নতা, চেতনার রেখাচিত্র

সোলারিস: ভাষ্যের ভিন্নতা, চেতনার রেখাচিত্র

“আমরা কেবল মানব প্রজাতিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অন্য কোন জগতের প্রয়োজন নেই আমাদের কাছে। আমাদের প্রয়োজন আয়নার। আরেকটা দুনিয়া নিয়ে কিইবা হবে তাও আমাদের জানা নেই। নিজেদের একটা জগতই যথেষ্ট আমাদের জন্য, কিন্তু সেটা ঠিক যেমনভাবে রয়েছে তেমনটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এই জগতের একটা আদর্শ প্রতিবিম্ব আমরা খুঁজে চলেছি: একটা গ্রহের, একটা উন্নত সভ্যতার সন্ধানে আমরা ছুটে যাই যার আদিরূপটা আমাদের মতই ছিল। একই সঙ্গে আমাদের মধ্যে অন্তর্লীন একটা কিছু রয়ে গেছে, আমরা যার সম্মুখীন হতে চাই না, যা থেকে আমরা নিজেদের আড়াল করে রাখতে চাই, কিন্তু তা সত্ত্বেও যা রয়ে যায়, কারণ আমরা এমন পৃথিবী ছেড়ে যাব না যা আদিম সারল্যভরা।”

— সোলারিস, ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ – দ্য লিটল অ্যাপোক্রিফা, স্তানিসোয়াভ লেম।

শব্দের মধ্যে দিয়ে দৃশ্য – শ্রাব্য জগতের বীক্ষণ আর চলচ্ছবির ব্যঞ্জনা অনেকসময়ই আলাদা রকমের হয়ে থাকে। সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে একই সুর বহিরঙ্গে নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যে প্রকাশ পায়। সেই বোধের ছবির রকমফের নিয়ে এমনকি মহতী স্রষ্টাদের মধ্যেও নানা মতবাদ, নানা ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে।

সোলারিস উপন্যাসের প্রথম ইংরেজি পেপারব্যাক সংস্করণের কভার

পোল্যান্ডের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কল্পবিজ্ঞান লেখক স্তানিসোয়াভ লেম এর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘সেলারিস’। বোধের অনেকগুলো স্তরে গভীর অভিঘাত রেখে গেছিল এই উপন্যাসের মূল সুর। এই কাহিনী ভবিষ্যতের এক মহাজাগতিক অভিযানের। উপন্যাসের বয়ান অনুসারে সোলারিস আসলে এক অসীম মহাসাগরে ঘেরা গ্রহের নাম, বহির্বিশ্বের অতিমানবিক বোধবুদ্ধি সম্পন্ন কোন এক জীবের সঙ্গে একদল মহাকাশ অভিযাত্রীর সংযোগ নিয়ে এই কাহিনী গড়ে উঠেছে। এই সংযোগ বা সংযোগহীনতা নিয়ে তাঁর এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন লেম। আসলে সেই আদিগন্ত বিস্তৃত সাগর নিজেই সেই অচিন গ্রহের মেধা সম্পন্ন সত্তার অবয়ব, যে নানা প্রহেলিকায় বুঝে নিতে চায় মানব প্রজাতিকে। বারবার গবেষকরা চান ওই জীবের সঙ্গে সংযোগ মাধ্যম গড়ে তুলতে, তাঁর ভাষা জানতে, তাঁর বোধের স্বরূপকে বুঝতে। কিন্তু কিছুতেই তা আর সম্ভব হয় না এমনকি এই উদ্দেশ্যে যখন ওই সান্দ্র মহাসাগরের থকথকে স্তরে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন এক্স-রে রশ্মি দিয়ে আঘাত করা হয় তখন তার ফল হয় বিপরীত। ওই অজানা জীব মানব অভিযাত্রীদেরই স্মৃতির ভেতর ঘরে ঢুকে টেনে আনে মৃত প্রিয়জনদের স্মৃতিকেই, সেই স্মৃতির অভিঘাত এত বেশী হয়ে যায় তাদের কাছে যে মনে হয় যেন সেই মৃত সুজনের মানবিক অবয়বের সঙ্গেই নতুন করে যেন যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। গল্পের এক অন্যতম চরিত্র ড. ক্রিস কেলভিন আচ্ছন্ন হয়ে যান তাঁর মৃতা প্রেমিকার আত্মহত্যাজনিত বিষাদের স্মৃতি নিয়ে অপরাধবোধে। এখানে লেম ইয়্যুং এর কালেক্টিভ কনসাশনেস এর এক প্রতিস্পর্ধী ভাষ্য রচনা করেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু শেষমেশ মানব চেতনার সঙ্গে সেই অপার্থিব চেতনার সংযোগ যে অসম্ভব তাই যেন ফুটে উঠেছে লেমের বয়ানে।

শব্দের মধ্যে দিয়ে দৃশ্য – শ্রাব্য জগতের বীক্ষণ আর চলচ্ছবির ব্যঞ্জনা অনেকসময়ই আলাদা রকমের হয়ে থাকে। সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে একই সুর বহিরঙ্গে নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যে প্রকাশ পায়। সেই বোধের ছবির রকমফের নিয়ে এমনকি মহতী স্রষ্টাদের মধ্যেও নানা মতবাদ, নানা ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে।

পোল্যান্ডের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কল্পবিজ্ঞান লেখক স্তানিসোয়াভ লেম এর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘সেলারিস’। বোধের অনেকগুলো স্তরে গভীর অভিঘাত রেখে গেছিল এই উপন্যাসের মূল সুর। এই কাহিনী ভবিষ্যতের এক মহাজাগতিক অভিযানের। উপন্যাসের বয়ান অনুসারে সোলারিস আসলে এক অসীম মহাসাগরে ঘেরা গ্রহের নাম, বহির্বিশ্বের অতিমানবিক বোধবুদ্ধি সম্পন্ন কোন এক জীবের সঙ্গে একদল মহাকাশ অভিযাত্রীর সংযোগ নিয়ে এই কাহিনী গড়ে উঠেছে। এই সংযোগ বা সংযোগহীনতা নিয়ে তাঁর এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন লেম। আসলে সেই আদিগন্ত বিস্তৃত সাগর নিজেই সেই অচিন গ্রহের মেধা সম্পন্ন সত্তার অবয়ব, যে নানা প্রহেলিকায় বুঝে নিতে চায় মানব প্রজাতিকে। বারবার গবেষকরা চান ওই জীবের সঙ্গে সংযোগ মাধ্যম গড়ে তুলতে, তাঁর ভাষা জানতে, তাঁর বোধের স্বরূপকে বুঝতে। কিন্তু কিছুতেই তা আর সম্ভব হয় না এমনকি এই উদ্দেশ্যে যখন ওই সান্দ্র মহাসাগরের থকথকে স্তরে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন এক্স-রে রশ্মি দিয়ে আঘাত করা হয় তখন তার ফল হয় বিপরীত। ওই অজানা জীব মানব অভিযাত্রীদেরই স্মৃতির ভেতর ঘরে ঢুকে টেনে আনে মৃত প্রিয়জনদের স্মৃতিকেই, সেই স্মৃতির অভিঘাত এত বেশী হয়ে যায় তাদের কাছে যে মনে হয় যেন সেই মৃত সুজনের মানবিক অবয়বের সঙ্গেই নতুন করে যেন যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। গল্পের এক অন্যতম চরিত্র ড. ক্রিস কেলভিন আচ্ছন্ন হয়ে যান তাঁর মৃতা প্রেমিকার আত্মহত্যাজনিত বিষাদের স্মৃতি নিয়ে অপরাধবোধে। এখানে লেম ইয়্যুং এর কালেক্টিভ কনসাশনেস এর এক প্রতিস্পর্ধী ভাষ্য রচনা করেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু শেষমেশ মানব চেতনার সঙ্গে সেই অপার্থিব চেতনার সংযোগ যে অসম্ভব তাই যেন ফুটে উঠেছে লেমের বয়ানে।

তারকোভস্কির ছবিতে উঠে আসা সেন্টিয়েন্ট সত্তার ছবি, সোলারিসের মহাসমুদ্র

বাকিটা বলার আগে ওই সময়কার বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিসরের সমীকরণগুলো একটু বুঝে নেয়া ভালো। ২০০১: আ স্পেস ওডেসি, গল্প এবং সিনেমা দুদিক থেকেই ছিল পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞান দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্যানন। বহির্বিশ্বে মানুষের পদসঞ্চার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সঙ্গে সভ্যতার দ্বন্দ্ব এমন নানা দিক নিয়ে একটা অক্সিডেন্ট রূপরেখা ছিল এই সিনেমা। কল্পবিজ্ঞানে নিবিষ্ট মানুষজনের কাছে তখন বিরাট এক সাড়া জাগিয়েছিল ছবিটা। ১৯৬১ সালে সোলারিস প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পরে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সাড়া জাগিয়েছিলেন তরুণ রুশ পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি। সেই বছর ওঁর পরিচালিত ‘ইভানস্‌ চাইল্ডহুড’ সিনেমা সেই উৎসবে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জিতে নেয় স্বর্ণ সিংহ পুরস্কার লাভ করে। সোলারিসকে নিয়ে সেলুলয়েডের একটা সিনে ক্যানভাস রচনা করার সুপ্ত একটা ইচ্ছে ছিল তারকোভস্কির। এখানে ক্যানভাসের একটা উপমা দেয়া হল ইচ্ছে করেই। আসলে সিনেমার স্বকীয় প্রকাশভঙ্গির মধ্যে দৃশ্যভাষার অভিঘাত অনেকটা বেশী সেটা সোভিয়েত মন্তাজই হোক, বা হোক না হয় পাশ্চাত্যের মিসঁ সিন প্রকরণ। কিন্তু এই দুজন মহান স্রষ্টার বীক্ষার ভুবনের বর্ণালী ছিল ভিন্ন তারে বাধা। তারকোভস্কির মনে যাই থাকুক না কেন, মস ফিল্মের সোভিয়েত কর্তাদের কাছে সোলারিসের এই সিনে নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল টু থাউজেন্ট ওয়ান এর একটা বিপ্রতীপ ছবি তুলে ধরা, যে ছবি লৌহ যবনিকার পূর্ব প্রান্তের দর্শনকেও বিনির্মাণ করবে সেলুলয়েডের ভাষায়।

মূল পোলিশ উপন্যাস সোলারিস প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর বাদে এর রাশিয়ান অনুবাদ বেরোয়, অনুবাদক ছিলেন দিমিত্রি বুস্কিন। রুশ অনুবাদে মূলের সঙ্গে মোটামুটি সাযুজ্য থাকলেও সোলারিস এই শিরোনামকে পুং লিঙ্গ হিসেবে ধরে নেয়া হয়, যেখানে মূল পোলিশ সংস্করণে তা ছিল স্ত্রীলিঙ্গের পরিচায়ক। ১৯৭৬ সালে গ্যালিনা গাডিমোভা এবং এবং ভেরা পেরেলম্যান যে অনুবাদ করেছিলেন তাতে এই মূল রূপটা ফিরে আসে। তারকোভস্কির নির্মাণের বেশ কিছুটা আগে ১৯৬৮ সালেই অবশ্য এই উপন্যাস অবলম্বনে একটা টিভি ফিল্ম তৈরি হয়, যদিও জনমানসে তেমন প্রভাব ফেলেনি সেই ছবি। এর মধ্যে তারকোভস্কিও মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করেন এই ছবি ফের নির্মাণ করার জন্য যদিও এরসঙ্গে ওঁর কল্পবিজ্ঞান প্রীতির সম্পর্ক নেই তেমন। তারকোভস্কির কাছে সোলারিস উপন্যাসের বাহ্য অবয়ব ছাপিয়ে মানবিক দ্বন্দ্বের ভাষ্যটাই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছয়ের দশকের শেষ নাগাদ বিখ্যাত লেখক এবং চিত্রনাট্যকার ফ্রিডরিশ গোরেনস্টাইনের সঙ্গে মিলিতভাবে তিনি এই উপন্যাস অবলম্বনে একটা চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। গোরেনস্টাইন একজন অভিজ্ঞ চিত্রনাট্যকার ছিলেন এবং সেইসময় সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্সিয়ার একটা বড়ো অংশ গোরেনস্টাইনের প্রতিভার প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিল। গোরেনস্টাইনের কলমের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে তারকোভস্কি লেমের মূল উপন্যাসের একটা বেশ বড়ো পূর্ব কথন বা প্রিলিউড অংশ লিখিয়েছিলেন তাঁকে দিয়ে যা ঘটে এই পৃথিবীতে। এই অংশে অভিযাত্রী ক্রিস কেলভিন সোলারিস গ্রহে অভিযানের আগে বিদায় নেয় তাঁর পরিবার থেকে। এই দৃশ্যগুলো একেবারেই ছিল না মূল উপন্যাসে। কিন্তু তারকোভস্কির কাছে ক্রিসের মানবিক অবয়বটা উন্মোচন করার একটা দায় ছিল যা পৃথিবীর সঙ্গে অপার্থিব চেতনার দ্বন্দ্বের একটা নান্দীমুখ তৈরি করবে। পৃথিবীর এই দৃশ্যগুলোকে যেভাবে অক্ষর বিন্যাসে নির্মাণ করে গোরেনস্টাইনের কলম-কালি-মন সেটা বিশেষ পছন্দ করেন তারকোভস্কি।

১৯৭৫ সালে ক্রাকাওতে নিজের রাইটিং ডেস্কে তোলা লেমের ফটোগ্রাফ, চিত্রগ্রাহক - জাকুব গ্রেলোস্কি

এরমধ্যে ১৯৬৯ সাল নাগাদ মস্কো বেড়াতে আসেন লেম। এটা ছিল তাঁর তৃতীয় সোভিয়েত সফর। সোভিয়েত ফ্যান্টাসি লেখকদের একটা অংশ এই উপলক্ষে লেম এবং তারকোভস্কি এই দুজন কৃতী মানুষকে নিয়ে একটা সভার আয়োজন করেন শহরের পিকিং হোটেলে, যেখানে লেম উঠেছিলেন সেবার। তারকোভস্কি সেই অনুষ্ঠানে তাঁর বন্ধু ল্যাজার ল্যাজারেভকে নিয়ে এসেছিলেন যিনি ছিলেন একজন কৃতী সাহিত্য সমালোচক এবং এর আগে তারকোভস্কির এক অন্যতম মাস্টারপিস ‘আন্দ্রে রুবলেভ’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পরবর্তীকালে তারকোভস্কির সামগ্রিক রেপার্টোয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটো নাম ‘সোলারিস’ এবং ‘মিরর’ এর নির্মাণেও তিনি একই ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই মিটিং এর উত্তাপ ছিল ওই ঠান্ডা যুদ্ধের আবহের মত হিম শীতল। তারকোভস্কি হয়ত একটু ছেলেমানুষি করেছিলেন প্রথমেই লেমের উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর চিত্রনাট্যের অমিলের ছবিগুলোকে তুলে ধরে, যে দৃশ্যগুলো একেবারেই মনে ধরেনি লেমের। ওঁর মতে সোলারিস উপন্যাসের অবয়ব নিজেই একটা সম্পূর্ণ স্টেটমেন্ট। মানব প্রজাতির সঙ্গে ওই মানব ওই গ্রহান্তরের চেতনার সংঘাতই যেখানে শেষকথা। সেইটুকুই এই সিনেমায় যেন উঠে আসে। অন্যদিকে তারকোভস্কির বীক্ষার মূল সুর ছিল চিত্রভাষার মধ্যে দিয়ে আসলে মানবিক দ্বন্দ্বের ছবি প্রকাশ করার। ওই মিটিং এর সময় ল্যাজারেভ লেমকে অনুরোধ করেছিলেন তারকোভস্কির কোন ছবি দেখার জন্য যাতে ওঁর মনের ছবিকে বুঝতে সুবিধা হয় লেমের। যদিও সেই প্রস্তাবে সায় দেননি লেম। আগামী কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তারকোভস্কি চেষ্টা করেছিলেন ওঁর যুক্তিকে প্রাঞ্জল করে পেশ করার জন্য কিন্তু এই দুজন শিল্পীর দর্শনের মধ্যে সংযোগ এর সুর কেটে গেছিল এর আগেই। লেম তাঁদের বলেন যে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে এই ছবি নির্মাণ করতে, এ নিয়ে তিনি মাথা গলাবেন না।

শুধুমাত্র ১৯৭২ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিশেষ জুরি গ্রাঁ প্রি পুরস্কার প্রাপ্তি নয়, সিনেমা তাত্ত্বিক এবং কল্পবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মতেও কল্পবিজ্ঞান সিনেমা হিসেবে স্তানিসোয়াভ লেমের উপন্যাস অবলম্বনে আন্দ্রেই তারকোভস্কি পরিচালিত ছায়াছবি ‘সোলারিস’ এক অন্যতম সৃষ্টি। কিন্তু স্রষ্টা লেমের কাছে এই ছবির দৃশ্যায়ন নিয়ে বেশ কিছু আপত্তির জায়গা ছিল। লেম যদিও সম্পূর্ণ ছবিটা দেখেন নি। লেমের মতে তারকোভস্কি তাঁর উপন্যাস সোলারিসের চিত্রায়ন করেন নি বরং মহাবিশ্বের ক্যানভাসে একটা ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিসমেন্ট’ নির্মাণ করেছিলেন। তারকোভস্কির নির্মাণে অভিযাত্রী ক্রিস কেলভিন তাঁর প্রেমিকাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন সেই আত্মগ্লানিই বারবার উঠে আসে তাঁর চেতনার মধ্যে দিয়ে। এমানুয়েল কান্টের দর্শনের ভাষ্যে যাকে ‘ডিং অ্যান জি’ বলা হয় সেই আত্মদর্শনের কোন ক্ষয়িষ্ণু অবশেষই ক্রিসকে বাধ্য করে বারবার তাঁর মৃত প্রেমিকাকে প্রত্যক্ষ করতে। সেটা লেমের ভাষ্য ছিল না, সোলারিসের সেন্টিয়েন্ট সাগরের জীবই তাঁর বয়ানে অভিযাত্রীদের স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে চেতন অবচেতনের আড়াল সরে যাওয়া ওই অভিজ্ঞতাগুলো নির্মাণ করছিল। অন্যদিকে পোলিশ সংবাদপত্র Tygodnik Powszechny কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তারকোভস্কি বলেছিলেন কেলভিনের সঙ্গে স্পেস স্টেশনে তাঁর মৃত প্রেমিকার সাক্ষাৎকার আসলে নিজের বিবেকের প্রক্ষেপণ।

উপন্যাসে সোলারিসের জীবের সঙ্গে এই সংযোগ সাধনের ধারাকে লেম নাম দিয়েছিলেন ‘সোলারিস্টিক্স’ যা নিয়ে উপন্যাসে অনেকটা অংশ বর্ণনা করা হয়েছে তেমনই অনেকটা জায়গা নিয়েছিল সোলারিসের সেই সেন্টিয়েন্ট চেতনাময় সান্দ্র, থকথকে মহাসাগরের বর্ণনা। কিন্তু এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়েই তারকোভস্কির সিনেমা অনেকটা নৈর্ব্যক্তিক। লেমের একটা বড়ো রাগের কারণ ছিল সিনেমার প্রথমাংশ দেখানো কেলভিনের আত্মীয়দের পরিমণ্ডলকে। তাঁর মতে এখানে তারকোভস্কি যেন মাদার রাশিয়াকেই তুলে এনেছিলেন। আসলে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এই প্রোলগ অংশকে একেবারেই মেনে নিতে পারেননি লেম।

সোলারিসকে নিয়ে এই দুজন বড়ো মাপের স্রষ্টার বীক্ষার ভিন্নতা এখনও প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্নের ঢেউ তোলে। লেমের অনুরাগীরা আপত্তি জানান যে কাছে তারকোভস্কির সিনেমা সংস্করণ ওই অপার্থিব সত্তাকে ভুলে গিয়ে কেবল মানুষের পক্ষ নিয়েছে, সোলারিসের ওই সেন্টিয়েন্ট সাগরও যেখানে লেমের বয়ান ভুলে আমাদের আত্মদর্শনের এক নির্দয় আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্তানিসোয়াভ লেম তাঁর সোলারিসে দেখিয়েছিলেন কিভাবে অপার্থিব এক সত্তার সঙ্গে সংযোগের চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হয়েও দমে যায় না মানুষ, দমে যায় না তাঁর অজানাকে জানার স্পৃহা। পার্থিব এবং অপার্থিব সত্তার মধ্যেকার এই যোগাযোগের একটা বিস্তৃত টেস্টামেন্ট ছিল লেমের সোলারিস। সেই অপার্থিব সত্তা অভিযাত্রী মানুষদের মনের দোর থেকে টেনে টেনে বের করছিল স্মৃতির ছবি, যে ছবি অনেক সময় পীড়া দেয়। ওই ছায়া স্মৃতিগুলোর সঙ্গে অভিযাত্রীদের কথোপকথন আসলে ওই ভিনগ্রহীদের সাথে সংযোগেরই ছবি। কিন্তু তারকোভস্কির সোলারিসে সেই থকথকে জেলির মত সান্দ্র সমুদ্র আসলে আমাদের পাপ পুণ্য বোধের ছবি তুলে ধরে, যেমন এই পৃথিবীর মাটিতেই আমাদের বিবেকদর্শন হয় ‘মাঝে মধ্যে’। এছাড়াও ওই বিস্তৃত সাগরের মধ্যে কিছুটা খ্রিস্টীয় ডুমস’ ডের অভিঘাতও যেন এই ছবিতে উঠে এসেছে বলে তারকোভস্কি বিশেষজ্ঞেরা দাবী জানিয়েছেন।

 

সোলারিস ছবির সেটে কলাকুশলীদের সঙ্গে পরিচালক আন্দ্রে তারকোভস্কি

হয়ত এই প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হবেনা রবীন্দ্রনাথের একটা গানের উদাহরণ দিলে। ‘আমার মনের মাঝে, কী গান বাজে; শুনতে কি পাও গো?’
তাঁদের দর্শন, তাঁদের বীক্ষার ভুবন আলাদা হলেও লেম এবং তারকোভস্কি দুজনেই বিরাট মাপের স্রষ্টা। সোলারিসকে কেন্দ্র করে তাঁদের মনের ছবিটা ছিল বহিরঙ্গে আলাদা কিন্তু সেই ভিন্নতার মধ্যেই হয়ত সংস্কৃতির কোন এক একাত্মবোধের সুরই ভেসে আসে। কে জানে হয়ত আগামীদিনে কোন কল্পবিজ্ঞানের নিষ্ঠ পাঠক এই সুরকে খুঁজে বের করতে পারবেন তাঁর মননের দোরে।

তথ্যঋণ:

    • https://culture.pl/en/article/lem-vs-tarkovsky-the-fight-over-solaris
    • Sculpting in Time: Reflections on the Cinema – Andrey Tarkovsky.
    • Solaris: Stanislaw Lem.

 

সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায় পেশায় প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষক হলেও মন পড়ে থাকে সংস্কৃতির সাতরঙা আঙিনায়। সঙ্গীত, সাহিত্য এবং বিশ্ব – সিনেমার নিষ্ঠ অনুরাগী। মূলত গদ্যসাহিত্যেই স্বচ্ছন্দ। নানা পত্রিকা এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ এবং গল্প প্রকাশিত হয়েছে এবং যুগ্মভাবে সম্পাদনাও করেছেন সংকলন গ্রন্থের। ‘সৎ সাহিত্য’ - এই আবছায়াতে শব্দের ব্যারিকেড গড়ে নিতে পারার তীব্র আকাঙ্খা সন্দীপনের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *