পর্তুগালের পথে ও প্রান্তরে - দ্বিতীয় পর্ব
কইমব্রা , অক্টোবর ১৩, ২০২২
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ড এর মত কইমব্রা বিশ্ব বিদ্যালয় পর্তুগালের এক বুক-ফোলানো গৌরব। ইয়োরোপের প্রাচীনতম ইউনিভার্সিটির একটি প্রধান এই কইমব্রা ইউনিভার্সিটি। নাম শুনেছিলাম। অনেক প্রাচীন নথিপত্র এখনও নাকি রাখা আছে এর বিশেষ লাইব্রেরিতে।
আভেরো থেকে কইমব্রা ট্রেনে ঘণ্টা খানেকের পথ দক্ষিণে। হোটেল ছাড়ার পর সময় আছে আজ আমাদের হাতে প্রচুর, কোন তাড়া নেই। একটা রেস্টুরেন্টে কফি খেতে খেতে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছি হোটেলের ছেলেটির সঙ্গে। সেও ঐ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র। কেবল কিছু পয়সা জমানোর জন্য এই সেমিস্টারটা অফ নিয়েছে।
বেজায় আওয়াজ হচ্ছে কনস্ট্রাকশনের। তার মাঝে অদূরে একটি মেয়ে হাঁকছে নৌকো ভ্রমণের টিকিট বিক্রির জন্য।
পর্তুগালে ট্যাক্সির আ্যপ গুলো দারুণ সস্তা ও ভাল। আমাদের ‘উবেরের’ মত ওদের ‘ফ্রি নাও’ আ্যাপ লাগিয়ে দিলে একেবারে কোথায় আছি, কোথায় যাব, কত সময় লাগবে, কত পয়সা, এক মিনিটে জানা যায়। পর্তুগীজ ভাষা জানার দরকার নেই। এমন আ্যাপ লাগিয়ে ডাক পাঠালাম। সংগে সংগে খবর— ‘মার্কো আসছে চার মিনিটের মধ্যে।’ চার মিনিট পেরিয়ে গেল, এবার দেখি লেখা— ‘সরি, মার্কো ডিক্লাইনড, বাট হোসে কামিং ইন সিক্স মিনিট।’
ছ মিনিট পরে হোসে ডিক্লাইনড। কুকি ঘুরছে তো ঘুরছেই।এদিকে আমাদের ট্রেনের আর তের মিনিট মাত্র বাকি। নার্ভাস হয়ে সেই নৌকোর মেয়েটাকে ধরি। সে বলল, “মার্কো, হোসে, এরা সব আমার বন্ধু । এরকম তো হবার কথা নয়।” যেন তার ই লজ্জা। কাকে যেন ফোন করল এবং উত্তর — “‘ট্যাক্সি দের এখানে ঢুকতে দিচ্ছে না, সিনোরা, কন্সট্রাকশনের জন্য। তোমরা ঐ বড় রাস্তায় দাঁড়াও গিয়ে।”
তখন এক রাফালো এসে আমাদের উদ্ধার করল। এবং প্রায় জেমস বন্ডের স্টাইলে বেজায় স্পিডে গাড়ি চালিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিল। বলল, “প্ল্যাটফরম মিলিয়ে নিও তবে আমি নিশ্চিত তিন নম্বর । লাক ভাল হলে একনম্বর ও হতে পারে, তা হলে তোমাদের আর ওপর -নিচ করতে হবে না।”
এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দেখি দিব্যি একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। জানা গেল এটা কইমব্রা যাবে। ট্রেনে কেউ নেই। নেই সিট নম্বর । আমাদের দেখে এক আলাপী ভদ্রলোক, টিকিট চেকার গোছের, একমুখ হেসে বললেন, “হায় দেয়ার।”
যাক ইংরেজি বলতে পারে দেখে আমি জিগ্যেস করি, “ট্রেন তো আর এক মিনিটে ছাড়বে, কেউ নেই কেন?”
তিনি বললেন, “কে বলেছে এক মিনিটে? এই ট্রেন আধ ঘণ্টা পর যাবে।”
আমাদের টিকিট দেখে ভদ্রলোক আঙুল তুলে দেখালেন, “ঐ যে, তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে”। দেখি তা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে।
“তা হলে কী হবে?” আমরা জানতাম পর্তুগালে ট্রেন বিভিন্ন কোম্পানির হয়। এক ট্রেনের টিকিট আরেক ট্রেনে বদল হয় না। ভদ্রলোক বললেন, “দেখি কী করা যায়, আমার বস যদি ও কে করে।” টিকিটটা নিয়ে চলে গেলেন।
কাঁচের ওপার দিয়ে দেখছি এক নাদুস নুদুস ভদ্রলোক পা তুলে আরামসে কার সংগে সেল ফোনে খুব গল্প করছেন। এঁর ডাকে বাধা পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ও অর্ধেক শুনে মাছি তাড়ানোর মত বিদায় করলেন।
কাঁচের দরজা সরিয়ে ভদ্রলোক এসে আবার একগাল হাসলেন।
“ইটস ওকে।” তারপর দেখি তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
“হাঃ দেবে না? তোমরা ঐ ট্রেনে এগারো ইউরো দিয়ে টিকিট কিনেছ, আর এ তো তিন ইউরোর টিকিট। মজা না কি?” যেন কার ওপর উনি খুব একটা শোধ নিয়েছেন। তাঁর মুখের পেশী কঠিন। অধস্তন কর্মীর মনের এ অবস্থা আমাদের অপরিচিত নয়। কেবল আজ তাঁর ক্ষণিক সাফল্যে সাক্ষী হতে পারলাম। বলি,
“কোথায় বসব?”
“ম্যাম, ইটস অল ইয়োরস।এনি সিট ইন দিস হোল ট্রেন।” হাত এলিয়ে এমন একটা ভাব যেন আমি কোথাকার রানি।
ধীরে ধীরে এই ট্রেনটাও চলতে শুরু করল।
কইম্ব্রা বিশ্ব বিদ্যালয় ও জোয়ানিনা লাইব্রেরি, অক্টোবর ১৪, ২০২২
সাতশ বছরের পুরনো কইমব্রা ইউনিভার্সিটি যেমন একদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ভরা তেমনি আধুনিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বিশাল বিল্ডিং গুলি আর্ট ডেকো কোনটা, কোনটা বা গথিক ছাঁদের।
পুরনো কালচার যেন শুকিয়ে না যায় তার উদাহরণ দেখলাম — মেরামতের জন্য একটা বিল্ডিং এর অংশ বিশেষ বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু সেখানে কেমন করে পুরনো টাইলের কাজ অপরিবর্তিত থাকবে তার ছবি এবং নোটিশ ঝুলছে। এরা এদের নিজস্ব কৃষ্টির সম্মান দেয় গর্ব ভরে।
বিশাল চত্বরে একটা ছায়া খুঁজে বসলাম। এখন কলেজের সেশন চলছে, ছাত্ররা ব্যস্ত ক্লাসে যেতে। কেউ কেউ টাই পরা এবং এই টাই য়ের রং দেখে নাকি বোঝা যায় কে কোন ফ্যাকাল্টির। মানে আইন বা ল এর রং লাল, এডুকেশন ও সাইকোলজি — কমলা, ইত্যাদি।
অনেক অনেক দিন আগে যখন ছাত্ররা এক গাদা বই নিয়ে চলা ফেরা করত তখন বিভাগ অনুযায়ী তাদের সেই রঙের ফিতে দেওয়া হত। এখন ও হয়। এই ফিতের আবার বিশেষ মূল্য ।
কিন্তু গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের দিন নাকি এটি পুড়িয়ে ফেলা একটা রেওয়াজ।সেদিন টিন টেনে বাজিয়ে বেজায় আওয়াজ করে ছাত্ররা জাহির করে যে এবার তাদের ছাত্র জীবন শেষ, এবার তারা বড়দের জগতে প্রবেশ করছে। এ অনুষ্ঠান নাকি এত পপুলার যে দূর দূরান্ত ইয়োরোপের অন্যান্য দেশ থেকে পর্যন্ত ছাত্ররা আসে মজা দেখতে।
এইসব শুনছিলাম যে ভদ্রলোক আমার পাশে এসে বসলেন সিঁড়ির ওপর ছায়ার ভাগ নিতে তাঁর কাছ থেকে। দেখি, তাঁর পায়ে প্লাস্টার বাঁধা, হয়ত কোন আঘাতে । তাঁর অতিথিরা টিকিট কিনতে গেছে। অফিস ঘর আবার ঐ চড়াই ভাঙা পাহাড়ের ওপরে। অমিত ও গেছে সে কথা শুনে, কোথায় লাইব্রেরি দেখার টিকিট কিনতে পাওয়া যায় তার খোঁজে।
কইমব্রার জোয়ানিনা লাইব্রেরি একটা বিশেষ দ্রষ্টব্য জিনিস। কয়েক শতকের পুরনো বই ও পুঁথি এখানে রাখা আছে, এবং তা কী করে সংরক্ষিত তা জানলে অবাক লাগে। সারা পৃথিবীর লোক লাইন লাগায় এই লাইব্রেরি দেখতে টিকিট কিনে।
জানা গেল এক সংগে ষাট জন মোটে যাবার ছাড়পত্র পাবে। থাকার মেয়াদ মাত্র কুড়ি মিনিট। আধ ঘণ্টার বিরতি। তারপর আবার আরেক দল ছাড়পত্র পাবে। কোন কিছু ছোঁওয়া যাবে না। তবু অত ভিড়? কী এমন আছে দেখার? ভাবি। আবার ছবি তোলাও বারণ।
“তা হলে ছাত্ররা কোন লাইব্রেরি যায়?” প্রশ্ন করি আমি।
“ঐ দূরে জেনারাল লাইব্রেরি।” তার ব্যবস্থা যেকোন আধুনিক গ্রন্থাগারকে হার মানায়।
অবশেষে এল আমাদের প্রতীক্ষিত সময়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে, মাটির তলা দিয়ে পৌঁছলাম লাইব্রেরিতে। প্রথমে ঢুকে মনে হল গ্রামের কোন মাটির বাড়িতে ঢুকেছি বুঝি। অমন সোঁদা গন্ধ, আর বিশাল উঁচু উঁচু ধাপ। পেরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি, কিচ্ছু নেই। প্রায় ঘুটঘুটি অন্ধকার।মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় বিভিন্ন ঘরে। না হলে ছাত ঠোক্কর দেয় মাথায়। ঘাড় গুঁজে বেরিয়ে আসি। শোনা গেল এটা হল শাস্তি পাওয়া ছাত্রদের জন্য জেলখানা।
লাইব্রেরির সংগে শাস্তি ও জেলখানা কথাটা আমার ভাল লাগল না। তারপর ওপর তলায় পৌঁছলাম যখন তখন তার জাঁকজমক দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
নানান দেশের বিশেষ করে প্রাচ্যের নানান অলংকরণ যা তারা দেখে এসেছে সেই সব দেশে গিয়ে, তা কাজে লাগান হয়েছে। ইতালিয়ান শ্রেষ্ঠ কারিগররা এসেছিল তাদের বিশিষ্ট হাতের কাজের সুবাদে। এল ব্রেজিলের সর্ব শ্রেষ্ঠ কাঠ আর সোনার গিলটির আল্পনা দিয়ে তৈরি হল তাকগুলি।
মস্ত টেবিল পাতা বিশাল ঘরের মাঝখানে । তার ওপর রূপোর দোয়াত। এক কালে থাকত কালি। শোনা গেল পনেরো শ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ২৫,০০০ মত বই আছে এখানে সংরক্ষিত এবং তার অনেক গুলিই হাতে লেখা।
এসব বই সংরক্ষণের জন্য বিশেষ যত্নবান এরা। লাইব্রেরি দরজা ব্রাজিলিয়ান ওক কাঠের । ভিতরে একটা আশ্চর্য সুন্দর মিঠে গন্ধ, খানিকটা ধূপের মত আবার বনের কাঠের গন্ধ মেশা। লোক ঢুকিয়েই সংগে সংগে দরজা বন্ধ করে দেয়, যাতে জলীয় হাওয়া না থেকে যায়।
এই পুরনো বই কেমন করে আগলে রাখে এরা পোকার হাত থেকে ?
বাদুড় পুষে। রাত্তির বেলা তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় পোকা খাওয়ার জন্য। এইভাবে কোন কেমিক্যাল ব্যবহার না করে বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক উপায়ে বইপোকা সমস্যার সমাধান করে এরা।
ছবি তোলা বারণ। যে ছবি দিলাম তা সংগৃহীত, আমার তোলা নয়।
শুনেছিলাম প্রথম বাংলা গদ্যের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পর্তুগালের নাম। যিনি লেখেন তাঁর নাম দম এন্টোনিও রোজারি। পর্তুগীজ নাম মনে হলেও তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। দম এন্টোনিওর সে বই কিন্তু পর্তুগীজ ভাষায় ছাপা হয়নি। তাঁর কথা বলব পরে।
সে নাম হয়ত আমরা তেমন জানিনা, যা জানা যায় তা, আরেক পর্তুগীজ মিশনারির নাম —ম্যানুয়েল দা আসামসাও এবং প্রকাশক ফ্রানসিসকো দা সিলভার কথা, আর এ বই প্রকাশ হয়েছিল ১৭৪৩ সালে, লিসবনে। লিসবনের বহু বই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে পরে।
সে বইটি কী তবে ওখানে আছ? ঐ তাকগুলির কোন খাপে? জানার উপায় নেই।
“এগিয়ে চল এগিয়ে চল” — শুনতে পেলাম আর দেখি মানুষের ভীড়ের ধাক্কায় কখন বাইরে এসে পড়েছি।
লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালে চোখে পড়বে অনেক বাড়ির ছাদ। বেশির ভাগ বাড়িগুলির রং সাদা আর তাদের ছাদগুলি লাল রঙের টালির। একটা স্লেট নীল নদী সর্পিল আমেজে এঁকে বেঁকে চলে গেছে। তার ওপর একটা ব্রিজ । এত ওপর থেকে খেলা ঘরের মত দেখাচ্ছে সব। ঐ দূরে একটা ক্যাথেড্রালের চুড়ো। এর একটা গল্প আছে।
একটি প্রেমের গল্পঃ ইনাস ও পেডরো
রোমিও জুলিয়েটের ও আগে ছিল কইম্ব্রার ইনাস আর পেডরোর প্রেম। শোনা যায় পরবর্তী যুগে তা না কি সেকসপিয়র কে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর যুগান্তকারী প্রেমের গল্পটি লিখতে। আর এই পর্তুগীজ গল্প কোন বানানো গল্প নয়, ঐতিহাসিক সত্য।
যুবরাজ পেডরোর তখন ২০ বছর বয়স। রাজা আলফানজো (পঞ্চম) স্থির করলেন ভাল ঘরের একটি মেয়ে কনস্ট্যান্স এর সংগে ছেলের বিয়ে দেওয়া যাক। এর পিছনে ছিল রাজনৈতিক কূটনীতি । কনস্ট্যান্সের সংগে এল সঙ্গিনী ইনাস। সে গ্যালিসিয়া দেশের মেয়ে যাদের সংগে তখন কার পর্তুগালের চেয়ে স্পেনের ঘনিষ্ঠতা বেশি। ষোড়শী ইনাস অপূর্ব সুন্দরী । অনেকেরই মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত রূপ। যুবরাজ পেডরোও বাদ পড়লেন না। দুজনেই পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ হলেন।
এদিকে পেডরোর সংগে বিয়ে হবার পর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কনস্ট্যান্স মারা যান। এখন তো রাস্তা খোলা। ইনাসের প্রতি গোপন প্রেম প্রকাশ করার সময় এসেছে মনে করলেন পেডরো। ইনাসকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীকারোক্তি দেওয়ার এখনই সময়।
রাজা আলফানজো ছেলের এই মনোভাব মোটেই ভাল চোখে দেখলেন না। এদিকে পেডরো প্রেমে হাবুডুবু। রোজ ইনাস কে চিঠি লেখেন আর তাঁদের দুজনের বাড়ির সামনে দিয়ে যে ছোট নদীটি বয়ে গেছে তাতে ভাসিয়ে দেন। প্রেমপত্র পাহাড়ি নদীর স্রোতে লাফাতে লাফাতে পৌঁছে যায় ইনাসের কাছে।
যুবরাজ পেডরো আর না থাকতে পেরে কইম্ব্রায় বাস নিলেন। নিয়ে আসলেন তাঁর প্রেমিকাকে এবং গোপনে বিয়ে করে বসবাস শুরু করলেন। এখন তাঁদের চারটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে হয়েছে।
কিন্তু রাজা এ ও ভাল চোখে দেখলেন না। এরপর তো ঐ ইনাসের ছেলেরাই সিংহাসনের উত্তরাধিকার পাবে। তার মানে পর্তুগালের সংগে স্পেনের সম্পর্ক ঘোলাটে হয়ে যাবে। হয়ত স্পেনের আধিপত্য বাড়বে। এ হতে দেওয়া যায়না ভাবলেন রাজা আলফানজো।পেডরো রাজা হবার আগেই ঠিক করলেন ইনাস কে সরাতে হবে।ষড়যন্ত্র চলতে লাগল।
ইনাসকে হত্যা করা হল । আর শোনা যায় তাঁদের শিশু সন্তানদের সামনে সেই মর্মান্তিক হত্যাটি সম্পন্ন হয়েছিল। ইনাসের প্রার্থনার সে করুন দৃশ্যটিকে অপূর্ব রূপ দিয়েছেন পরবর্তী কালের শিল্পী, তাঁদের আঁকা ছবিতে।
পেডরো বাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে উদ্যত হন, রানী মা তাঁকে তখনকার মত নিরস্ত করেন। কিন্তু যুবরাজ পেডরো সিংহাসনে আসীন হয়েই প্রথম যে কাজটি করেন তা মৃত ইনাসের শরীর কোনমতে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকে রানীর মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সংগে জড়িত ছিল তাদের ইনাসের মৃত হাতে চুমু খাইয়ে ইনাসের রানির পদ মর্যাদা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। এরপর ঐ হত্যাকারীদের নৃশংস ভাবে হত্যা করে তাদের বুক চিড়ে হৃৎপিণ্ড বার করেন। এইজন্য তাঁর অবশ্য একটা নাম ইতিহাস না উল্লেখ করেই পারেনা —‘the cruel’ — নিষ্ঠুর।
ইনাসের সমাধির সামনে, ঠিক তার মুখোমুখি এক সমাধি স্থাপন করেন পেডরো। যেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সেখানে রাখা হয় তার ব্যবস্থা । এ জীবনে যা হল না, মৃত্যুর পর যেন তাঁরা মিলিত হতে পারেন।
শোনা যায়, কুইনটাস ডি লাগরি মার্স, যেখানে ইনাস খুন হন সেখানে পাথরের বুকে আজও ইনাসের রক্তের দাগ দেখা যায়। এত শত বছরেও কালের স্রোত তা ধুয়ে দিতে পারেনি। ঐ নদীর দুপাশে যে ঘাস জন্মায় তা যেন ইনাসের চুলের মত নরম সোনালি। আজও কান পাতলে সেখানের হাওয়ায় না কি তাঁদের প্রেমের গানের ধুন শোনা যায়।
ইনাস আর পেডরোর প্রেমের ইতিহাস বানানো রোমান্টিক গল্পকেও ছাড়িয়ে যায়। কত ছবি, গান, অপেরা যে রচিত হয়েছে এঁদের জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে তা জানলে সত্যি তাক লেগে যায়।
ফাদো গান
পর্তুগালের আরেক বিশেষ অবদান তার গান। ফাদো গান। ফাদো কথাটির ব্যুৎপত্তি গত অর্থ Fate, ল্যাটিন থেকে আসা। ভাগ্য বা নিয়তি।
যদিও ১৮২০ নাগাদ এর প্রথম স্বীকৃতি, মারিয়া সেভের নাম ধরে, ফাদো গান হয়ত ছিল তার ও আগে। ঘরছাড়া নাবিকের জীবনের কথা দিয়ে হয়ত এর শুরু, সুঁড়ি খানায়, পরবর্তী যুগে তা শোনা যায় মেয়েদের গলায়, বিরহের গানে। কোন বিধবার মৃত স্বামীর জন্য শোক, যে নাবিক আর ফিরে এল না, তার জন্য কান্না ভেজা দুঃখের তানে।
একদিকে আবিষ্কারের যুগে যেমন পর্তুগাল ফুলে ফেঁপে উঠছিল, নাবিক পাঠাচ্ছিল দিক দিগন্তে, আরেক দিকে তাকে দিতে হয়েছে তার মাশুল। অনেক নাবিক আর ফিরে আসেনি। অনেক ঘর ভেঙে গেছে পথের ধূলিতে। এর ঢেউ বিশেষ করে ধাক্কা দিয়েছে তাদের দরিদ্র নারী সমাজকে।
বিধবা বউটি, পুত্রহারা মা, পিতৃহীন কন্যার আর কী বা সম্বল তখন? তখন তারা গান গেয়েছে নিঠুর নিয়তিকে কেন্দ্র করে। হাহাকারের গান। তাই ফাদো গানের সুর করুণ রসে সিক্ত, মেলানকলিক।
এই গান লিসবনের সেইসব পাড়াতেই হত, রেস্টুরেন্টের সামনে, ব্রথেল ঘরের সিঁড়িতে যেখানে গান শুনে কেউ দু চার পয়সা দেবে। তাই ফাদো অনেক দিন সে মর্যাদা পায় নি সংগীত শিল্প হিসাবে। এর শিল্প সত্তা দাবি করলেন প্রথমে মারিয়া সিভের এবং আরো পরে তাকে একটা আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান আমালিয়া রড রি গারস। এর মাঝে আছেন আরো অন্যান্য ফাদিস্তারা।
প্রথম নজরে আসে মারিয়া সিভেরার (১৮২০ নাগাদ) ফাদো গান। ফাদো গান স্বতঃস্ফূর্ত, সব যে আগে থেকে ঠিক থাকবে এমন না। সুরের সংগে সংগে কথা ও সুর তৈরি হতে পারে গায়কের তাৎক্ষণিক মেজাজে। বলা হয় ফাদো একটা অভিজ্ঞতা বিশেষ । সে ক্ষেত্রে খানিকটা আমাদের মার্গ সংগীতের মত। সেখানেও যেমন তান বিস্তারের সুযোগ আছে, একটা রাগ যে প্রতিবার অবিকল এক রকম করে গাইতে হবে এমন না, তেমন ফাদো গানেও শিল্পীর সে স্বাধীনতা থাকে । আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে এ ই বুঝলাম।
জিপসি ঘরের মেয়ে মারিয়া এক কাউন্টের প্রেমে পড়েছিলেন। সে প্রেমের কোন পূর্ণতা বা সফলতার আশা ছিল না। ব্যর্থ বোবা কান্না গানের ধারায় বেরিয়ে আসত তার তানে, লিসবনের লাল আলো- আঁধারি পাড়ায়, গলির রেসতোঁরা গুলি থেকে। তখন ঐ দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন চলত মারিয়ার। কিন্তু ইতিহাস তাঁর প্রাপ্য মূল্যায়ন ও অবদান স্বীকার করতে ভুলে যায়নি। আজ ফাদো গানের ইতিহাসে মারিয়া সেভার্সের নাম জ্বল জ্বল করে।
বারো তারের এক ম্যান্ডোলিন জাতীয় গিটার বাজিয়ে মারিয়া গাইতেন সে গান। ঐতিহাসিকরা বলেন সে গিটার হয়ত এসেছিল মু্রদের কালচার থেকে। বাদ্য যন্ত্র নিয়েও অনেক আলোচনা আছে লিসবনের ফাদো মিউজিয়ামে। আমি সে গভীরতায় যাচ্ছি না।
কেউ বলেন আফ্রিকান ক্রীতদাসদের থেকে এসেছিল এ গানের ধারা। ঘরছাড়া নাবিক আর সবহারা মানুষের নিয়তির প্রতি নালিশ আর জীবনের উত্তর খোঁজার গান এর কথায় আর সুরে ।কিন্তু শুধু তা নয় — লিসবনের উত্তরে কম্ব্রিয়ার ছাত্র সমাজ আনল তার আরেক ধারা। সেখানে অত্যাচার আর অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা ও সুর ফাদো গানে। সেখানের ফাদো আশার, শক্তির গান। করুণ কান্না ভেজা নয়। অনেকটা আমাদের আই পি টি এর “ঢেউ উঠছে, কারা ছুটছে… ” টাইপের ব্যাপার। এ গান কইম্ব্রায় সব সময়ে পুরুষের গলাতেই শোনা যায় এখন পর্যন্ত ।
কইম্ব্রার ফাদো গান ও সে সম্বন্ধে তার মূলগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঘরোয়া আলোচনা শোনার একটি দারুণ সুযোগ পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছিলাম। মাত্র দু রাত্রি আমরা ছিলাম কইম্ব্রায়। তাতে এমন সুযোগের যোগাযোগ সত্যি কাকতালীয় ও মহা ভাগ্যের ব্যাপার।
কইম্ব্রার উঁচু নিচু পাথুরে গলির মধ্যে গুহার মত এক ফোকর। সেখানে এক ছোট পরিত্যক্ত ক্যাথিড্রাল — এখন তা একটি কফি বার রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে। সেখানে রাতে ফাদো গান শোনবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা খুবই ঘরোয়া পরিবেশে।
শিল্পী বলেছিলেন যে ফাদো গান একটা অভিজ্ঞতা বিশেষ। একটা মেজাজ। এর চলন স্বতঃস্ফূর্ত। বাজিয়েদের অবদানও একে আরেক রকম পূর্ণতা দেয় ও সমৃদ্ধ করে। সাধারণত দশ বা বারো তারের গিটার, আর ছ তারা ভায়োলা ব্যবহার হয়। এছাড়া ট্রাডিশনাল পর্তুগীজ ম্যান্ডোলিনের চলন ও দেখা যায় যার করডোফোন অংশটি ডিম্বাকৃতি, ঠিক গোল নয়, আর তাতে থাকে আট টি তার।
এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও জানার অবকাশ। যা জানলাম তা আমার কাছে এখন জলের ওপর বরফ চাঙর দেখার মত।
ভুলে যাবার আগে যাঁর নাম বিশেষ উল্লেখ যোগ্য, যিনি ফাদো সংগীতকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর নাম আমালিয়া রড্রিগারস। তাঁকে বলা হয় ফাদো গানের রানি। এত জনপ্রিয় ছিলেন যে ১৯৯৯ সালে তাঁর মৃত্যুতে পর্তুগাল তিন দিন শোক পালন করেছিল। এঁর একটি গানের (পর্তুগীজ ভাষা থেকে ইংরেজি) লিরিক জেনে ও কেবল মাত্র গানটি শুনে আমার যা মনে হয়েছিল তাকে বাংলায় রূপ দেবার চেষ্টা করেছি। তাই দিয়ে আজকের দিনলিপি শেষ করছি।
তুমি চলে যাবে
তুমি চলে যাবে, আমি তা জানতাম
তাই তো চাইনি কাছে আস।
এসেছিলে।
তবু তুমি এসেছিলে কাছে।
তোমার জাহাজের মাস্তুল মিলিয়ে গেল বিন্দুতে
কালি- নীল জলে
ঢেউয়ে ডুব দিল দিগন্তে।
ওরা বলেছিল তুমি আর ফিরবে না।
আর ফিরবে না তুমি।
ওরা কী জানে?
উন্মাদ, আহাম্মক ওরা।
ওরা বলে তুমি ফিরবে না। হাঃ!
কী জানে, ওরা?
তুমি তো যাওনি।
তুমি আস।
আমার কাজ-অকাজের অবসরে
তুমি আস।
তুমি আস বারবার
আমার ঘুমে
আমায় চুমে
আমার স্বপনে।
তুমি আছ
সমুদ্রের নোনা হাওয়ায়
আমি পাই তোমার স্বাদ
তোমার হাসির শব্দ
শুনি ঢেউয়ের কলতানে
মুঠির বালিতে তোমার গায়ের গন্ধ
কে বলে তুমি চলে গেছ?
তুমি তো আছ আমায় ঘিরে।
যতদিন বাঁচব কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবেনা তোমাকে।
কইম্ব্রা থেকে আরো দক্ষিণে আলগারভে এলাকা। এবার আমরা পৌঁছেছি তারই এক রিসর্টে — আলবুফেরা শহরে। এক সময়ে এ ছিল মাঝি মাল্লাদের জায়গা, সমুদ্রের একেবারে কাছে, পর্তুগালের একেবারে দক্ষিণে। এখন মাছ- অলার দেখা তেমন পাইনি, আর সে পুরনো আমেজ ও উধাও। এখন সাজগোজ করে এ শহর প্রস্তুত টুরিস্ট ভুলোতে, রিসোর্ট কালচার চারদিকে। ঝাঁ চকচক পরদেশী এক্সপ্যাট জনতায় ভরা।
সমুদ্রের মাঝে গুহা — বেনাগিল
আলবুফেরা থেকে মাত্র ৩০কিলো মিটার দূরে, (নৌকো করে গেলে চল্লিশ মিনিটের পথ) বেনাগিল কেভ। সমুদ্রের মধ্যে দেখা যাবে অদ্ভুত পাথুরে সব গুহা। আশ্চর্য তাদের গঠন। আর তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর বেনাগিল গুহা ।
পৃথিবীর বিস্ময়কর কয়েকটি দ্রষ্টব্য জায়গার একটি। কারণ এর ওপরের ছাতটিতে চোখের আকারের একটি গর্ত। ফলে দিনের সূর্যালোক আশ্চর্য সব রং আর প্যাটার্ন সৃষ্টি করে গুহার মধ্যে। সেখানের জলে এমারেল্ড রং। কখনো পান্না- সবুজ, কখনো বা তুঁতে নীল।
আমরা সেখানে গিয়েছিলাম নৌকো করেই। আমার মনে নানান প্রশ্ন আসছিল কেমন করে হল এই আশ্চর্য ব্যাপারটা। সংগে একটি বছর দশেকের ছেলে ছিল, তার নানান প্রশ্ন থেকে অনেক কিছু জানা গেল।
“কেমন করে হল এমন জিনিস?” উত্তরে শুনলাম — গলিত লাভা, সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল আর জীবাণু এই হোল মাল মশলা।
শোনা গেল বহু বহু বছর আগে এক সময়ে এখানে ডাইনোসররা চড়ে বেড়াত। তাদের ফসিল, সামুদ্রিক প্রবাল, এই সব দিয়ে তৈরি ঐ পাহাড়ের মত পাথরের গা । বড়রা ছেলেটিকে সেডিমেনটারি রক সম্বন্ধে বোঝাতে লাগলেন। কিন্তু যখন শুনলাম একটা ছোট্ট ফাটল থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এই বিশাল গুহাকন্দরটি তখন আমিও তার মত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
সবচেয়ে আশ্চর্য গুহার ভেতরের রং। তার বৈজ্ঞানিক কারণ — ওখানকার পাথরে আরাগনাইট ক্রিস্টালের অস্তিত্ব। তাই গুহার ভিতরের রং কখনো ডিমের কুসুমের মত কমলা হলুদ, কখনো তাতে দারুচিনি রঙের রেখা, কখনো কামরাঙা রং ফোঁটার ডিজাইন। ।
সমুদ্রের ঢেউ দিনের পর দিন ক্রমাগত আছড়ে পড়ে পাথরের বুকে এনেছে পেলব মসৃণতা, কোথাও সময়াভাবের তা রুক্ষ। বৃষ্টির জল ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে ওর মাথায় অমন জানালা বানিয়েছে। যা দেখলে মনে হয় দারুণ পোক্ত আজ, কালের কবলে আগামীতে তা ভঙ্গুর। একদিন যে তা ভেঙে যাবে তা নিশ্চিত। ঠিক যেমন করে প্রকৃতি মা নিপুণ করে গড়েছেন এ অপূর্ব সৌন্দর্য, তেমনি একদিন ভেঙে ফেলার খেলাতেও তিনি তেমনই মত্ত। রক্ষার ব্যাপারে তেমনই উদাসীন। এ যেন এক মহান শিশু শিল্পীর বালির দুর্গ গড়া খেলা।
“ঐ গুহার ভিতরে যাওয়া যায়? আমরা যাব না।” ছেলেটির প্রশ্ন ।
“যায় বৈ কি। কিন্তু আমাদের যাওয়া হবে না, কারণ ভাঁটা লেগে গেছে। এত বড় নৌকো যেতে পারবে না।” দেখা গেল ছোট ছোট ডিঙি নৌকো নিয়ে অনেকেই ভিতরে যাচ্ছে।
“ডলফিন আসে?”
শোনা গেল আর কদিন আগেও ডলফিন দেখা দিত অনেক। সেপ্টেম্বর মাস থেকে কমে যায়।
“এখানে সার্ক আছে? ” জানতে চায় ছেলেটি।
“আছে, তবে ভয়ংকর মানুষ মারা সার্ক খুব কম। বরং মানুষ ই তাদের মারতে আসে।”
আলবুফেরা, অক্টোবর ১৫, ২০২২
পর্তুগালের একেবারে দক্ষিণে আলবুফেরা শহর ।এককালে ছিল মাছধরা জেলেদের গ্রাম। আজ কোথায় জেলেরা? এখন এ পৃথিবীর সেরা টুরিস্ট স্পট। সামারে এখানে মাছি তাড়ানো ভিড়। নাইট লাইফ গম গম। সারাদিন সমুদ্রের পারে কেউ সূর্য সেবন করে, ট্যানিং তেল মেখে, কেউ বা ঢেউ এর সংগে পাল্লা দিয়ে সার্ফিং।
সংগে সংগে গড়ে উঠেছে স্ন্যাক বার আর রেসতোঁরা। তবে এর বীচ অপূর্ব সুন্দর। আকোয়া মেরিন জলের রং, কোথাও তুঁতে নীল, রোদ লেগে বালিভূমি সোনার মত ঝিকমিক করে।
পুরনো শহর পাহাড়ের উপর। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে বা লিফটে চড়ে নামতে হয় জলের সমতলে। পাহাড় আর সমুদ্রের এমন ব্যবধান এতটুকু জায়গার মধ্যে দেখে খানিকটা তাক লেগে যায়। এমন আমি কোথাও দেখিনি।
মেরিনার জলের ধারে নতুন বাড়ি গুলো রঙ বেরঙের। ছোট ছেলের খেলার লেগো যেন। একটু জবরজং ই ।
মুশকিল হল এখানে আসা আমাদের সাময়িক আবাসটি থেকে । বাসের ব্যবস্থা আছে যদিও এবং ট্যাক্সি ও খুবই সস্তার অন্য জায়গার সংগে তুলনা করলে, কিন্তু মনে হয় কেমন যেন কমার্শিয়াল কালচারে বিকিয়ে গেছে এর পুরনো চরিত্র । এখন কীসে টুরিস্টদের সুবিধা হবে সে দিকেই বেশি মন আলবুফেরার। এখানে এখন বিদেশি ফরেনারদের, আর আমার মত টুরিস্ট দের ই ভিড় বেশি।
আমাদের রিসোর্ট থেকে গাড়িতে পনের মিনিটের পথ। রিসোর্ট টা যেন একটা ছোটখাটো ভিলেজ। তার ভিতরেই খাবার দোকান আছে, আছে সুইমিং পুল ও রেস্তরাঁ। কিন্তু ভাবখানা, তোমরা এখানেই থাকো না কেন, আর খরচা পাতিও এখানেই কর যা পার।
কিন্তু তা হলে আর এতদূরে এলাম কেন?
ভিলেজ খুবই সুন্দর আর মানুষ জন ও খুবই ভাল কিন্তু এখান থেকে কোথাও যাওয়া আসা বেশ ঝামেলার।
দু দিন বৃষ্টি গেল। সবাই ভীষণ খুশি। বুকে হাত ঠেকিয়ে বলে, আরো বৃষ্টি চাই…
আমরা তা জানি। পরিবেশ দূষণ কাকে বলে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসছি। বৃষ্টির অভাবে শহর কে শহর পুড়ে যেতে দেখেছি। মরা পোড়া গন্ধ, ঘর বাড়িতে ছাই উড়ে এসেছে পঞ্চাশ ষাট মাইল দূর থেকে। আকাশে বাতাসে সে বিকট রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ২০২০ তে।
দেখি অদ্ভুত দেখতে একটা পাখি টুকিয়ে টুকিয়ে ঘাস থেকে কিছু খাচ্ছে। বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখতে পেলাম, মাথায় কেমন ঝুঁটি! আমাদের শালিক পাখির সাইজ।গায়ের রং হলদেটে, আবার কত বাহার তাতে – সাদা কালো ডোরাকাটা।
এ পাখির ছবি আমি দেখেছি, এমন কি পোস্টাল স্ট্যাম্পেও। জানলাম এর নাম হুপি পাখি। এ পাখি নাকি খুব লক্ষ্মীমন্ত, দেখলে নাকি দিনটা ভাল যায়। পরে আমার এক বাঙালি বন্ধু ছবি দেখে বলল, “আরে এ তো আমাদের মোহন ঝুঁটি। কেউ কেউ বলে ঝগরুটি পাখি।” যাঃ আমার সব রোমানটিসিসম এক ফুঁ য়ে এ খতম।
পাখির কথায় মনে পড়ল এখানে আরেকটা পাখি, মানে স্রেফ আমাদের ঝুঁটিঅলা মোরগ দেখেছি অনেক স্যুভেনির দোকানে বা অন্য জায়গায়। পর্তুগালের সংগে তার যোগাযোগ কী? জানলাম একটা লোকগাথা জুড়ে আছে এর সাথে।
অনেক অনেক দিন আগে একটা লোক তীর্থ করে ফিরছিল। এমন সময়ে ভিন দেশি দেখে তাকে চুরির দায়ে গ্রেফতার করে স্থানীয় গ্রামবাসীরা। তীর্থ যাত্রীর একমাত্র দোষ সে ভিন গাঁয়ের লোক, কেউ তাকে চেনে না। সে যতই বলে, “আরে আমি চোর নই !”— কেউ শুনবে না। তখন লোকটি বলে, “বেশ, আমাকে নিয়ে চল তোমাদের বিচারকের কাছে, তিনি বুঝবেন।”
বিচারক তখন সবে নৈশ আহারে বসছেন। টেবিলে শোভা পাচ্ছে চিকেন রোস্ট। সব শুনে বললেন,
“ও ই দোষী। বেটাকে দাও ফাঁসি।”
লোকটি বলে, “হুজুর, আমি পাপী নই। আপনার … আপনার পাতের ঐ মোরগ টা পর্যন্ত শুনলে তা বিশ্বাস করত না।”
বিচারক বাঁকা হাসি হেসে বললেন, “হাঃ, তাই নাকি?”
লোকটাকে ফাঁসিতে চড়ানো হল।
কিন্তু, কিছুই হল না ।(ফাঁসির দড়িটা আলগা ছিল বোধ হয়) এদিকে যত মোরগ ছিল ডেকে উঠল “কককর কঁ!”
বিচারক তো তাজ্জব। বুঝলেন তাঁর ভীষণ ভুল হয়েছে। তাড়াতাড়ি লোকটাকে খুলে নিস্তার দিলেন।
ধর্মপ্রাণ তীর্থ যাত্রী পরে একটি চার্চ বানায় যার মাথার উপরে ঐ মোরগ ক্রসের মতন রাখা হয়। সেই থেকে এটা পর্তুগালের একটা বিশেষত্ব ।
অনেক চার্চের মাথায় এই মোরগ দেখেছি। দিনটা খুব মেঘে ঢাকা ছিল।
পরে জেনেছিলাম এর মধ্যে অনেক ধর্মের ব্যাপার আছে।ক্যাথলিক প্রটেস্টান্ট ইত্যাদি। কিন্তু সে সব কচকচির মধ্যে না গিয়ে এই সরল লোকগাথাটি আমি তুলে নিলাম আমার গল্পের ঝুলিতে।
লাগোস, অক্টোবর ২০,২০২২
আলবুফেরা থেকে গাড়িতে এক ঘণ্টার পথ লাগোস। মাইল চল্লিশ পশ্চিমে। লাগোস শহর ঐতিহাসিক চরিত্রে ভরপুর। দক্ষিণ পর্তুগালের আলগারভে এলাকার এই প্রাচীর ঘেরা পুরনো শহরটির একটা অনন্য চার্ম। কারো কাছে তা এর বেলা ভূমি, অতলান্তিক সাগরের ঢেউ-আছড়ে -পড়া সোনালী তটরেখা, কারো কাছে দূরে সমুদ্রের বুকের আশ্চর্য গুহা গুলি। কাঠের ধাপ ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে ওপর থেকে জলের ধারে। অনেক তফাতে একটা লাইট হাউস, একটা চার্চ আরেক দিকে, ইগরেজা দ্য সানটো আন্তোনিও। আজ ভাবলে অবাক লাগে এক সময় এই বেলা ভূমিতে নামত জাহাজ, রমরমা তখন এর অবস্থা। সে তো পনের শো শতাব্দীর কথা । তারপর এ হল টুনা মাছ চালানের ব্যাপক ব্যবসার জায়গা।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম একটা মাছের বাজারে। কত রকম মাছ! তবে মাছের বাজার আমার কোন দিনই তেমন প্রিয় জায়গা নয় যদিও মাছ খেতে ভালবাসি। আর পর্তুগালে কত যে মাছের পদ। এ ব্যাপারে বাঙালিদের সংগে এদের খুব মিল।
অনেক রকম মাছের পদের মধ্যে যা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে তা মাছের ক্রোকে— আমাদের মাছের চপ। আর আরেকটা পদ খেয়েছিলাম, মাছের ঝোল সংগে ভুট্টার ব্রেড।আশ্চর্যের কথা— স্বাদটা বহুদিন আগে আমার মা’র হাতে বানান কষা মাংসের একটি পদ মনে পড়িয়ে দিল। সংগে ছিল বড় বড় আলু, যা ভাঙে না, কিন্তু মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়।
আশ্চর্য বলছি, কারণ মা’র রান্না পদটা ছিল মাটন, মাছ নয়। আর এটা খাচ্ছি প্রায় চল্লিশ বছর পরে পর্তুগালে বসে। রেস্টুরেন্টের মেয়েটিকে সে কথা বলায় ও মৃদু হেসে বলল, “মশলা গুলো তো এসেছিল তোমাদের দেশ থেকেই, তাই না?”
আমি বললাম, “তুমি কোথাকার?”
“অরিজিনালি ব্রাজিল, তবে আমি এখানেই জন্মেছি।”
পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম এক চত্বরে। নাম ‘দম হেনরিক প্লাজা’। চত্বরের ঠিক মধ্যিখানে দম হেনরির মূর্তি শোভা পাচ্ছে। এ ই সে “ন্যাভিগেটার”। ইতিহাস এঁর দুটি অবদান আমাদের ভুলতে দেবেনা।
এক— কলোনাইজেশন বা সামন্ততন্ত্রের ইনি হলেন হোতা। নৌ গড়ন পালটে, জলদস্যুবৃত্তিতে চরম সাফল্য এনে, সমুদ্রের ম্যাপ এঁকে, এমন কি একটা নৌ বিষয়ের ইস্কুল খুলে ইনি তৈরি করেছেন কী করে জাহাজ ভিড়িয়ে দেশ বিদেশ জয় করা যায়।
দুই — মানুষকে কী করে পণ্য রূপে ব্যবহার করা যায়। ক্রীতদাস প্রথার পাওনিয়ার হলেন ইনি। কলকাঠি সব নেড়েছেন কিন্তু ঘরে বসে। কোথাও যান নি সশরীরে। পর্তুগালকে শিখিয়েছেন কী করে দেশ বিদেশ জয় করা যায়। এবং তার পর অন্যান্য দেশ ও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে।
দু পা এগিয়ে গেলে পড়বে সেই মর্মান্তিক বাড়িটি যার নাম Slave Market. তার তলায় দাঁড়িয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
মনে পডল ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি।
“এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।”
শোনা যায় প্রথম আফ্রিকার ধরা মানুষের সংখ্যা ছিল ২৩৫ জন। সময়টা ১৪৪৪। তাদের ইচ্ছা করে আলাদা করা হত। স্বামী স্ত্রী, মা-মেয়ে, ভাই বোন, এমন কি কাছের প্রতিবেশী জানতে পারলে তাদেরকেও, যাতে ওদের মানবিক দিকটা মানুষ ভুলে যেতে পারে। তারা কেবল মাত্র পণ্য এখন।
এইসব কথা লেখা আছে সংলগ্ন মিউজিয়ামটিতে। সেখানে সংগৃহীত আছে পঞ্চদশ শতকের কয়েন, মুদ্রা, আফ্রিকান সেরামিক বিডস, আর একটি স্কেলিটন, স্থানীয় কোন ভাগারে ফেলে দেওয়া কংকাল বিশেষ। অনেক গুলির মধ্যে একটি যে কোয়ারানটিনের পর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
১৪৪৪ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে ১০০,০০০ মানুষ বিক্রি হয় এই থামটার সামনে যেখানে আমি আজ দাঁড়িয়ে আছি। লেখা আছে, ফাদার হেনরি দ্য ন্যাভিগেটার বলেন এই সব মানুষদের ধর্মান্তরিত করে তাদের আত্মাকে উন্নত ও উদ্ধার করেছেন তিনি। প্রগলভতা বটে!
‘সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পুজোর ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
সুন্দরের আরাধনা।’
রাজার কড়া হুকুম ছিল, যে দেশ বিজয় করতে যাচ্ছ সেখানকার একটু মাটি, কিছু উদ্ভিদ এবং হ্যাঁ, সেখানকার মানুষ ধরে আনবে। বিক্রীত মানুষের কুড়ি পারসেন্ট যেত ফাদার হেনরির পকেটে।
শোনা যায় ধীরে ধীরে এ অঞ্চল ভরে যায় এই ভিন দেশি মানুষে। মেয়েদের লাগানো হল মাছ বেচা, রাস্তা ঝাড় পোঁছ করার কাজে, পুরুষদের কয়লা ভাঙা, কুলির মাল বহন আর দৈহিক শ্রমে।
ষোড়শ শতকে আলগারভে এলাকা ভরে যায় ক্রীতদাস মানুষে।
এখন এই জমজমাট সৌখিন চারপাশ দেখলে কে বলবে এর কান্নার ইতিহাস কথা? দূরে দেখলে দেখি পান্না রং সমুদ্র, আর নীল আকাশ — পৃথিবী একরাশ সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে।
সেদিনের সেই ধরা- পড়া নির্দোষ কালো মানুষ ও তো তাই দেখেছিল ? তবে? আরেক দল মানুষ কেবল নিজের লোভে কেন তা কেড়ে নেয়?
এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর ঠিক এমন সময় গুরুগুরু স্বরে ডেকে উঠল মেঘ, ফোঁটা ফোঁটা জলে ধরিত্রী মাও যেন কেঁদে উঠলেন সে লজ্জার দিনের মূক- সাক্ষী থাকার স্মৃতিতে, আমায় জড়িয়ে।
আমরা ছুট লাগালাম টুরিস্ট ভ্যানের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
4 Comments