আমার কালকূট ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)
প্রথমে জানতে হবে কালকূট কেন?
একটা প্রাণঘাতী বিষের নাম ছদ্মনাম হিসেবে নিচ্ছেন সেই বিষে জর্জরিত এক ব্যক্তি, চারদিকের অপ্রেমের হলাহল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রেমের অমৃত সুধা পান করবেন ও করাবেন বলে।
তা, কীভাবে অমৃতপান করতে ও করাতে চান তিনি?
সমরেশ বসু রূপে তিনি রত ছিলেন মানুষের অন্বেষণে। এই মানুষের হাত ধরেই তাঁর সাহিত্যে সোনা ফলানো। এবার কালকূট। তাঁর আরশিনগরের পড়শিটিকে আপাদমস্তক যাচাই করতে তৎপর তিনি কালকূটের আড়াল নিয়ে আরেক সমান্তরাল সাহিত্য রচনা করলেন। আরশিনগরের পড়শি অর্থাৎ তিনি নিজে।
এ ব্যাপারে লেখকের নিজের বক্তব্য আমরা শুনে নেব।
“…অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে, লেখার কথা বলার আগে নামকরণের ভাবনাটাই আগে মনে আসে। একথা বিদিত সংসারে, জানেন সর্বলোকে, ছদ্মনামের প্রয়োজন হয়, নামের আড়াল থেকে নিজেকে ব্যক্ত করা। এমন না যে, সংসারেতে এসেছিলেম কিছু কথা বলব বলে। বরং বলতে হয়, ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে / আমার ঘরের কাছে আরশিনগর এক পড়শি বসত করে’, গানখানি যে অর্থে লালন গেয়েছিলেন, বলতে গেলে একদিক থেকে আমারও সেই অর্থেই স্মরণ। …কিন্তু এমন নামটি কেন? তাহলে যে প্রাণটি খুলে দেখাতে হয়। দেখলেই বোঝা যাবে, বুক ভরে আছে গরলে, আপনাকে খুঁজে ফেরা, আসলে তো হা অমৃত হা অমৃত! বিষে অঙ্গ জর্জর, কোথা হা অমৃত! …কালকূট ছাড়া, আমার আর কী নাম হতে পারে?”
সুহৃদ সরোজকে একদিন কথায় কথায় তিনি জানিয়েছিলেন ঘুরে বেড়াতে পেলে তিনি আর কিছু চান না। “কেন পান্থ এ চঞ্চলতা” এ প্রশ্নের উত্তর তিনি খোঁজেন ভারতবর্ষের নানা মানুষের মেলায়, নানা বিচিত্রের বর্ণিল পটভূমিতে। সুতরাং সমরেশের এই নতুন সমান্তরাল সাহিত্য রচনার পটভূমি সেই ভ্রমণ পিপাসুর যাযাবরবৃত্তি ছাড়া কিছু হতে পারে না, এ তো বলা বাহুল্যমাত্র।
তবে সমরেশ যখন, তখন গতানুগতিক ভ্রমণ-বৃত্তান্ত হবে না, তাতে থিকথিক করবে জীবন আর মানুষ, আর তাই তা ছাপিয়ে যাবে এ যাবৎ ছাপা হওয়া সমস্ত ভ্রমণ বৃত্তান্ত, ভেঙে দেবে সব রেকর্ড, জানা কথা।
আর দেরি নয়, কালকূটকে কেন্দ্র করে আঁকা বৃত্তটিতে প্রবেশ করি এবার।
যাত্রাশুরু এক ভোটের প্রতিবেদন দিয়ে। “ভোটদর্পণ।” “প্রবাহ” পত্রিকায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় “ভোটদর্পণ” প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন সংক্ষিপ্ত অথচ মর্মস্পর্শী। বঙ্গের ভোট চিরদিনের রঙ্গ, তখনও। সেই বর্ণনা কালকূটের কলমে পড়ে শিউরে উঠতে হয়।
‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ থেকেই আসলে সেই ভ্রমণবৃত্তান্তের শুরু হয়। কিন্তু এই লেখাগুলিকে কি কেবল ভ্রমণ বৃত্তান্ত বা ট্রাভেলগ বলা যায়? এতেও যে মানুষ আর জীবনের থিকথিকে ভিড়। রাজরোগ যক্ষ্মায় মারা গেল কালকূটের সহযাত্রী, যে কিনা জীবনলাভের বর ভিক্ষে করতে যাচ্ছিল কুম্ভমেলায়। অন্ধ্রপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সহযাত্রী থেকে শুরু বলরাম, শ্যামা, পাঁচুগোপাল, রমণীমোহন, রামজীদাসী, প্রহ্লাদ, ব্রজবালা, পাঁচুগোপাল —-সাহিত্যিক সমরেশ মানুষের অন্বেষা জারি রেখেছেন কালকূট রূপেও। আর বর্ণনার বিশদতা মুগ্ধ না করে পারেনি, সে হোক না কেন এলাহাবাদ স্টেশনে কলেরার ইঞ্জেকশন নেওয়ার প্রহসন বা প্রয়াগের মেলায় ঢোকার মুখে ধুলোর ঝড়, প্রহ্লাদের পেছন পেছন গিয়ে তাদের ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া বা পাঁচুগোপাল বদ্যির হৃদয় জয়। মেলাতে মিলেমিশে থেকে মেলার মানুষের মনবোঝা সে তো চাট্টিখানি কথা নয়। তবু সে অসাধ্যসাধন করেছেন সমরেশ সেই মানুষ খুঁজে।
হিদের মা সাধুকে খাইয়ে যখন কড়কড়ে উনিশটি টাকা দোকানদারকে দেয়, লেখকের চোখের সামনে তখন, মেলায় পাওয়া ‘কিপটে বুড়ি’ নামের মহিলা, যে ভিক্ষাবৃত্তি করেছে লেখকের কাছেও, সে সাধারণ মহিলা থেকে মহীয়সী হয় নিমেষে। মেলা তো কেবল নতুন মানুষে মেশা নয়—ট্রেনের বলরাম, শ্যামা, লক্ষ্মীদাসীর সঙ্গে পুনর্মিলনও বটে। মেলা থেকে ফেরার দিন আকস্মিক দুর্ঘটনায় অমৃতকুম্ভের বহু তীর্থযাত্রীর সঙ্গে বলরামের মর্মান্তিক মৃত্যু কালকূটকে স্তব্ধ করে যেমন, আমাদের হৃদয়কেও দুমড়েমুচড়ে দেয় তৎক্ষণাৎ।
আমাদের সবার ছোটবেলার একটা পাহাড় আছে, হোক না কেন সে একটা উঁচু ঢিবি বা কালকূটের ধানমন্ডাইয়ের মতো চাঁদমারি। বাবা মা ছোট বলে পাহাড়ে তীর্থ করতে নিয়ে যাননি, সেই অভিমানে ডানপিটে বন্ধু বলুর সঙ্গে ধানমন্ডাইয়ের পাঁচমারি থেকে পাহাড়ের স্বাদ নিয়ে আসা কালকূট যখন বড় বয়সে সত্যি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যান, সোনার কলম দিয়ে লেখা থাকে সেই অভিজ্ঞতা ‘স্বর্ণ শিখর প্রাঙ্গণে’ তে। কেবল ভ্রমণ তো নয়, ছোট্ট কাকলি, তার মা সুমিতা, সুবীর, বিবেক, বৃদ্ধ পরমেশবাবু, মল্লিকা, মালতী, ইভা, হীরেন, বিজয়, শিল্পী গণেন – কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনার খাজাঞ্চিখানার সামনে এতগুলো চরিত্রের পরত উন্মোচন সমরেশের সোনার কলম ছাড়া করে সাধ্য কার।
হালে দার্জিলিং ঘুরে এলাম, সমতল থেকে ওপরে ওঠার সময় এই মর-জগতের বাইরে মনে হওয়া, সেই অপার্থিব শৈল জগতে প্রবেশ থেকে প্রস্থান অব্দি চোখের সামনে দৃশ্যায়িত হল ফের কালকূটের হাত ধরে।
‘সহজ ভেবে এসেছিলেম / পড়েছি অসহজের হাওড়ে, ক্ষ্যাপা পড়লি একি ফাঁপরে।’ প্রয়াগের কুম্ভমেলার যাত্রাপথ সুদূরে ছিল, তুলনায় এ তো নিজের রাজ্যে, কেঁদুলির জয়দেব স্মারক মেলা। সেই মেলা মানুষে মেশা না খেলার সার্কাস, রকমারি খাবার পসরা নাকি বাউলের সম্মেলন, বোঝা দায় হয়েছে লেখকের। ‘অমৃতকুম্ভের…’ মতো বিলোনো অমৃত না পান করতে পেলেও “খুঁজে ফিরি সেই মানুষে” আমাদের কেঁদুলির মেলার স্বরূপ চিনিয়েছে। বাউলের হাত ধরে কালকূটের আকাশ-বাউল মনকেও বটে।
‘নির্জন সৈকতে’র শুরু একটু অন্যরকম। সুখ-সোনার ঘেরাটোপ থেকে মুক্তির দিকে হাত বাড়িয়েছেন লেখক, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার সময় পাননি, এক বৃষ্টি বিধৌত সন্ধেতে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণির টিকিটে চড়ছেন ট্রেনে যা তাঁকে পৌঁছে দেবে জগন্নাথধাম, যেখানে আকাশ ছোঁয়া সমুদ্রের ঢেউ শুষে নেবে তাঁর ক্লান্তি ও দৈনন্দিনের বিষ, এই আশায়। কেমন করে ট্রেনের কামরায় উঠলেন, কীভাবে এক চিলতে বসার জায়গায় ঠেকাতে পারলেন নিজের শরীর, ‘সেজদির দল’ নামে সহযাত্রীদের কাছে কী অভিজ্ঞতা লাভ করলেন— বর্ণনার সহজতা আবারো নিমেষে পাঠককে প্রবেশ করায় কাহিনিতে। মনে হয়, যেন সহযাত্রী হয়ে চলেছে পাঠকও। এরপর জগন্নাথধামে নেমে পান্ডার প্রহসন। তারপর রিকশা করে শহরে প্রবেশ। মানুষে মেশা সমরেশের অনায়াস, তা বলে নিজের দেশের ইতিহাসেও যে এত সহজ চলন তাঁর, তা নির্জন সৈকতে না পড়লে বোঝা যেত না। জগন্নাথের মন্দির বাইরে থেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, কিন্তু জানিয়েছেন, “যে এর অভ্যন্তরে যে দেবতারূপে অধিষ্ঠিত, সে আমার চিন্তার জটিলতা।” এ যেন এক খাঁটি নাস্তিকের আসল অস্তিত্বের স্বীকৃতি।
বাসস্থান নিয়ে আরেক নাটক হয়। সঙ্গীবিহীন হওয়ার অপরাধে কোনও ধর্মশালায় জায়গা না পাওয়া কালকূট শেষে একটি ধর্মশালায় ঠাঁই পান, সিঁড়ির তলার ঘরে। সেই ঘরের সূত্রে ফের মোলাকাত হয় ট্রেনের ‘সেজদি বাহিনীর’ সঙ্গে। যে ঘর থেকে দূরে পালাবেন বলে এখানে আসা, সেই ঘরের অন্তরঙ্গতা তাঁকে পাকড়াও করে ফের। আর কালকূটের প্রথম সমুদ্র দর্শনের বর্ণনা? সেই আয়নার সামনে নিজেদের সমুদ্র দেখার বিবরণের প্রতিবিম্ব বড় তুচ্ছ হয়ে গেল, মাথা হেঁট হয়ে গেল যেন। এরপর জগন্নাথ দর্শন, সমুদ্র সৈকতে মহামহিম মহিম রায়ের বদান্যতায় একটি অত্যুৎকৃষ্ট বাসা লাভ আর সেখানে সঞ্জয়, অমৃতানন্দের মধ্যে আবার সেই মানুষের খোঁজ, ঘরের খোঁজ, বিষের মধ্যে অমৃতের খোঁজ। সত্যি কথা বলতে, ‘নির্জন সৈকতে’ ভ্রমণের আড়ালে কাহিনি না কাহিনির আড়ালে ভ্রমণ – কোনটা সেটা নিয়ে ভাবায় বেশ। তবে যখনই দেখি কালকূটের ভ্রমণ কেবল পায়ে -বেড়ানো নয়, মনে-বেড়ানো; শুধু দেশান্তরে যাওয়া নয়, মানুষ হিসেবে উত্তরণের দলিল স্বরূপও, তখন তাকে যেভাবে কালকূট বলেছেন ঠিক সেভাবেই আপন করতে আর অসুবিধে হয় না। কোনার্ক ভ্রমণেও সেই সহজিয়া সুরের আভাস। যৌনগন্ধী ইঙ্গিত দিয়ে যে অনুপম শিল্পকে দাগানো হয় তার থেকে সমাদরে তাকে তুলে এনে তিনি পরালেন রাজমুকুট। বড় ভাল লাগল। সঙ্গে ছিলেন সেজদি বাহিনী, যাঁদের সঙ্গে লিয়াখিয়া হয়ে কোনার্ক গেছিলেন কালকূট। ঘেরাটোপের অন্তরঙ্গতায় পাকড়াও হয়েও নির্মল মুক্তির উল্লাসে নিঃশব্দে চিৎকার করেছে এই লেখা, ‘নির্জন সৈকতে।’
‘বাণীধ্বনি বেণুবনে।’ কিন্তু বিহারের বেণুবনের কথা বলতে গিয়ে কালকূট নেপালের জনকপুরে যাত্রা করছেন কেন? এখানেই গল্পের শুরু বলে। ভারতের জয়নগর থেকে নেপালের জনকপুরে যাবার অদ্ভুত ট্রেনে দুটো বগী ছাড়া, বাকীটার ছাদ নেই, দেওয়াল নেই, জানলা নেই, চাকার ওপরে লোহার পাতের মেঝে। এই আঠারো মাইল ট্রেন এমন গতিতে যায় যে, যাত্রীরা প্রাকৃতিক কর্মের জন্য চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে আবার ট্রেনে উঠে পড়তে পারে। আর, নেপালে পৌঁছবার আগেই আমরা কালকূটের মুখ থেকে শুনতে শুনতে যাই মনোলোভা গল্প। সেই ট্রেন দশ মাইল গিয়ে, যেখানে দাঁড়ায় সেখানেই ভট্টাচার্য মশাইয়ের বাড়ি, সেই ভট্টাচার্য মশাই যিনি নেপালের ঐ অদ্ভুত ট্রেনের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। সেখানে আন্তরিক সমাদর পাবার পর তাঁরা ফের পা বাড়ান জনকপুরের দিকে। কিন্তু জনকপুর থেকে কালকূটকে ফিরতে হয় চূড়ান্ত অসুস্থতা আর কানের যন্ত্রণা নিয়ে। তবে সেখানে ধীরুমায়া নামে মেয়েটির যে অসামান্য সেবা পান তা পাথেয় হয়ে থাকে তাঁর। তিনি চিকিৎসা করানোর জন্য ফিরে আসেন পাটনায়, সেখান থেকে সুস্থ হয়ে যাত্রা করেন রাজগীরে। এখানে একটু ইতিহাসচারণ, ইতিহাস দর্শন ও দর্শানোর অভূতপূর্ব কায়দা। উষ্ণ প্রস্রবণে স্নানের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন। তারপর দর্শনীয় স্থানগুলি ভ্রমণ। লটঠি বন, সপ্তপর্ণী গুহা, বাণগঙ্গা, বেণুবন —-যেখানে বুদ্ধ বোধিলাভের পর এসেছিলেন, বিম্বিসার যেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, অজাতশত্রু বন্দী করার পর দিনান্তে একবার যেখানে বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিলত, পিতৃহন্তা অজাতশত্রু যেখানে নিজ কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে বুদ্ধের পাদনখকণা মাথায় নিলেন—সেইসব জায়গা নিজে ঘুরেছেন আমাদেরও হাতে ধরে ঘুরিয়েছেন। মানুষ খুঁজে বেড়ানো কালকূট যে ইতিহাসেও নিজেকে এমন খুঁজবেন তা কে জানত? অপূর্ব লাগল।
“কোথায় পাব তারে?” –কাকে? এই কাহিনিতে কার অন্বেষণ? ইছামতী পার হয়ে ওপারে যাত্রা, যার নামটুকুও জানা নেই। বসিরহাট থেকে অধর মাঝির হাতে বৈঠা, সে নিয়েছে পার করার দায়িত্ব। জানা যায় ওপারের নাম ইটিন্ডা, যার থেকে কিছুদূর এগোলেই বাংলাদেশ বর্ডার। সেখানে নেমে এক বছর দশেকের ছেলের সঙ্গে মোলাকাত কালকূটের। সেই ছেলে যে দু আনা পারানি দিয়ে ডিঙি নিয়ে বুড়িগঙ্গার খোঁজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তার বুড়ি গঙ্গায় ডিঙি বেয়ে যাওয়া হয় না। বড়সড়ো অঘটনের হাত থেকে রক্ষা করে তাকে পাড়ে পৌঁছে দিয়ে যায় বড় নৌকার মাঝিরা। কে ও? যে জীবন নদী বেয়ে ডিঙি বইয়ে অনবরত জীবনের বুড়িগঙ্গায় যেতে চেয়েছে সে নয় তো? হ্যাঁ, আসলে এটা তাকেই– কালকূটের নিজেকে খুঁজে ফেরার গল্প। সেই স্মৃতিচারণের মাঝেই তাঁর বর্তমানে প্রবেশ। এক নদী থেকে অন্য নদীতে, নৌকা থেকে লঞ্চে। পাঠিকা ঝিনিকে ছেড়ে পাড়ে নামতে বুঝিবা হৃদয় ব্যথিয়ে ওঠে তাঁর। সেই ঝিনির সঙ্গে ফের দেখা শান্তিনিকেতনে। কেন তার চিঠির উত্তর লেখক দেননি সেই নিয়ে চলে মান -অভিমানের পালা। ঝিনির সম্বন্ধে জানা হয় অনেক অজানা তথ্য।
কাহিনি থেকে কাহিনি আসে, নৌকা যেমন নদী থেকে অন্য নদীতে চলে তেমন। বাউল গোকুল -বিন্দুর সঙ্গে কালকূট পাড়ি দেন বক্রেশ্বরে। বক্রেশ্বর যাবার পথে সিউড়িতে গোকুল-বিন্দুর বাউল আখড়ায় লেখকের রাত্রিবাসের অনন্য অভিজ্ঞতা শিহরণ জাগায়। সেই রাতে গোপীদাসের কাছে আমরা শুনি পুরুষ-প্রকৃতির বাউল তত্ত্ব, যা ভারতবর্ষের সাধন তত্ত্বের অন্যতম। লেখক গোপীদাসের সঙ্গে বক্রেশ্বর যান, সেখানে অবধূতের আখড়ায় অবধূত আর যোগমায়ার মান অভিমান, সাধনভজন প্রত্যক্ষ বর্ণনা যেভাবে দেন, রোমে রোমে হর্ষ জাগে সত্যি। যোগমায়ার সাধারণ মুখে আমরা শুনি ষটচক্রের অসাধারণ বর্ণনা। এরপরের গন্তব্য কাটোয়া হয়ে অট্টহাসের মন্দির, তারপর নিরোল ও সাঁওতাল পরগনা হয়ে জয়দেব। জয়দেবে ফের দেখা ঝিনির সঙ্গে। বিন্দু গোপীদাসের অন্তরঙ্গতা জড়িয়ে ধরে ফের। বিন্দু অবাক করে মননে, সে নিতাই নামের সিঁধেল চোরকে দিয়েছিল ঘর আগলানোর দায়িত্ব, চুরি করতে বলেছিল কেবল মন। বিন্দুর আকাশস্পর্শী মন স্তব্ধ করে কালকূটকে। জানতে পারেন সে মুখস্থ বলতে পারে জয়দেবের গীতগোবিন্দ। আপন পরিবেশের মধ্যে চোখ চালিয়ে লেখকের মতো আমাদেরও মনে হয় বৈকি, বড় গরীব হয়ে আছি আমরা। সেখান থেকে ঝিনির অবুঝ গোঁ ছেড়ে আসতে হয় তাঁকে। পা চলে নবদ্বীপ, বর্ধমানের কুলীনগ্রামে। সেখান হয়ে হাড়োয়ার পথে যাত্রা, ফের সেই গাজীর সঙ্গে দেখা করার জন্য উন্মুখ তিনি। কিন্তু কৈ সে? তাকে খুঁজতে গিয়ে চমকে যান ফের ঝিনির দেখা পেয়ে। দুজনেই গাজীর খোঁজ করতে গিয়ে মর্মান্তিক সংবাদ শোনেন, গাজী আর নেই। সাক্ষাৎ পান গাজীর প্রকৃতি নয়নতারার। ফের ঝিনির নাছোড় হাত ছাড়িয়ে যাত্রা শুরু হয় সুন্দরবনের দিকে। কে যেন গাজীর গলায় গেয়ে ওঠে ভেতরে, ” ক্ষ্যাপা, তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়?”
বসিরহাটে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, তা অবিরত চলে শান্তিনিকেতন, বক্রেশ্বর, অট্টহাস জয়দেব, হাড়োয়া হয়ে ছোটে সুন্দরবনে। লোকাচার, প্রীতি, প্রেম, ঘৃণা মিলেমিশে একাকার হয় পথের ধুলোর সঙ্গে।
অবিরাম কাজে মন ক্লান্ত হয়, অবিশ্রান্ত অক্ষরযাপনেও। সেই মন মেরামতে ছুটে যেতে হয় খুব দূরে নয় অথচ খুব চেনা নয় এমন জায়গায়। কালকূট গেছেন এবার তেমনই এক জায়গায় মেমারী রসুলপুরের দিকে। রোমাঞ্চ হয় পড়ে, যেহেতু এইদিকে আমারও বাড়ি। যা হোক, সেই জায়গায় মন মেরামতের আশায় গিয়ে আদতে কী হয় সেটা জানাতেই এই কাহিনি, “মন মেরামতের আশায়।” লেখকের সানুদি নামে চরিত্র মর্ম ছোঁয় নিমেষে। অতি সাধারণ গ্রাম্যজীবন, যাপনের জন্য কোথায় নামতে হয় তার দলিল হয়ে থাকবে এই কাহিনি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল তথাকথিত ভ্রমণের কথা না বলেও যে গল্প বলার ঢঙে মানব চরিত্র দর্শানো, এও বড় কম কথা নয়।
“হারায়ে সেই মানুষে” শুরু হচ্ছে সেই বুড়ি গঙ্গার ধার থেকে। সেই যে একটা ছোট্ট ছেলে বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইবে বলে ডিঙি নিয়ে বেরিয়েও পৌঁছতে পারেনি, সেই ছেলেকে ফের খুঁজেছেন তিনি এখানে। এখানে সেই ছেলে বারো বছরের। ঢাকার বিক্রমপুর থেকে দিদির শ্বশুরবাড়ি জিয়ারনি স্টেশনে নেমে কিছু দূরের এক গ্রামে যায়। সেখানকার তাঁতবোনা, তামাক কাটা, ডিঙি বাওয়া, প্রজাপতি ধরা, হাটে হারিয়ে যাওয়া, বেদেনীদের কাছ থেকে উদ্ধার, নিজের অজান্তে হেলেন আর সরি নামে দুই কিশোরীর মনের শরিক হয়ে ওঠা, অবশেষে সেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিজ গুণে একাত্ম হয়ে তাদের কাঁদিয়ে হাসিয়ে ফের ফেরে যখন বর্ণনার গুণে পাঠকও না হেসে কেঁদে পারে না। কেবল বিদেশ- বিভুঁই নয়, নিজের ঠাঁই থেকে সামান্য সরে নড়ে গেলেও যে কত অপার্থিব সম্পদ উপভোগ করা যায়, এই কাহিনি যেন প্রতি মুহূর্তে তাই দেখিয়েছে। কালকূট নিজের ছোটবেলাকে হারিয়ে খুঁজেছেন, আমরা খুঁজেছি তার মধ্যে বড়বেলার সত্তাটিকে, এইসব প্রকৃতি ভ্রমণের মধ্যে নিহিত ছিল যার বীজ।
আবার দূরে, এবার দূরে। ইচ্ছে ‘আরব সাগরের (যে) জল লোনা’, তা দিয়ে নিজের মনপ্রাণ জারানো। নিজেকে ছেনেছেন এই লেখার প্রথমে, এই যে বেড়াতে যাওয়া, এর আসল উদ্দেশ্য যে অনাবিল আনন্দলাভ তা তো নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে তাঁর রুজি রুটি, তার কী? উত্তরও পেয়েছেন নিজের ভেতর থেকে, আনন্দ যা তা বুকের ভেতরে অক্ষয় হয়ে থাকছে, তার সঙ্গে রুজি-রুটির কোনো আপোষ নেই। ট্রেন যাত্রা আগের মতোই।
গোমেজ পদবীধারী পাঁচটি বিভিন্নবয়সী মেমসাহেবের হৃদয় জয়ের কাহিনি আর ঐ পরিবারেরই লিজা নামের কনিষ্ঠা ললনাটির সঙ্গে আন্তরিক প্রীতি বিনিময় ও ধরা দিতে না চাওয়া সত্ত্বেও কালকূট রূপে ধরা পড়ার গল্প শুনতে শুনতে আমরাও বোম্বাই পৌঁছে যাই লেখকের সঙ্গে। স্টেশনে গোমেজ পরিবারের সঙ্গে লেখকের বিচ্ছেদ বেজে ওঠে আমাদের বুকে। লেখকের সুহৃদ সুরঞ্জন তাঁকে নিয়ে যান নিজের বাড়ি। এরপরের অভিজ্ঞতা বিচিত্র বললে কম বলা হয়।
বম্বের রূপোলী জগতে যেমন ভেসে বেড়াচ্ছে রূপোর চাঁদি–কেবল ধরতে জানতে হয়, তেমনই এখানে চলে রূপের লেনাদেনা– তার ইতিহাস বড় বেদনাবহ। জুহুর বিচে কেবল আরবসাগরের ঢেউয়ের ফসফরাস জ্বলে না, জ্বলে বহু মানব হৃদয়ও তা অনুভব করিয়েছেন কালকূট ভীষণই। লেখকের বন্ধু রণোর মতো প্রতিভা গুমরে মরে, নামী পরিচালক, নামী নায়ক-নায়িকাদের নতুন রূপ প্রত্যক্ষ করি। আবার দেখা মেলে লিজার একেবারেই ভিন্নতর রূপে, তার পরিবারের সঙ্গে আলাপ ঝালানো হয় ফের। লিজা নিজের মেমসাহেবের পরিচয় ছাপিয়ে কখন এত পরিচিত ও আপন হয়ে ওঠে টেরই পাই না যেন, এমনই কালকূটের কলমের গুণ। একেবারে শেষে চোখের জল বাঁধ মানানো অসম্ভব হয়, লিজা, কৃষ্ণ, লেখকের সঙ্গে যে এই কাহিনির আন্তরিক পাঠ করে তারও। কোথায় যেন সব চোখের জল একাকার হয়ে যায় আরবসাগরের ঐ লোনা জলটার সঙ্গে।
1 Comment