ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের পল্লী ভ্রমণ – দ্বিতীয় পর্ব
একাদশ দিন (স্কটল্যান্ড)
লক্-নেস (অনেকে লচ্-নেস বলেন কিন্তু স্থানীয় উচ্চারণ লক্-নেস) জলদানবের গল্পকথা ছোটবেলায় পড়েছি। কিছু কিছু গল্পগাথা লোকমুখে তিল থেকে তাল হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে কিছুদিন পর লোকে সেটা বিশ্বাস করতে ভালবাসে। ঐ দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে যাবার মত ব্যাপার। লক্-নেস জলদানবের গল্প স্কটল্যান্ডে সেই সাতশো খ্রিস্টাব্দ থেকে চলে আসছে। এই জলদানবের এক আদরের নাম আছে – নেসি। এই জলদানবকে নাকি শেষ দেখা যায় ১৯৩৩ সালে। এক দম্পতি লক্-এর কাছে একটি প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো একটি বিশাল প্রাণীকে রাস্তা পার হতে দেখেছেন বলে প্রকাশ। পরের বছর এক স্থানীয় সার্জন নেসির ছবিও তুলেছিলেন যাতে দেখা গেছিল লক্-নেসের জলের মধ্যে থেকে লম্বা ঘাড় আর ড্রাগনের মত লেজ বার করে উঁকি মারছে নেসি। খবরটায় এমন উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল যে নেসিকে দেখবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে জলের নীচে ক্যামেরা বসানো হয়েছিল, কিন্তু নেসির দর্শন মেলেনি। পরে জানা গেছিল যে ঐ সার্জনের ছবিটি আসলে ফোটোগ্রাফির কারসাজি। কিন্তু তাতে কী, ওখানে লোকে বিশ্বাস করে যে নেসি ঐ হ্রদের জলের নীচেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। আবার বিজ্ঞানমনস্ক লোকেরা বিশ্বাস করেন নেসি আসলে একটি দৈত্যাকার ঈল বা একটি স্টার্জন বা ডাইনোসর যুগের প্লেসিওসর গোষ্ঠীর একটি লম্বা গলার সামুদ্রিক সরীসৃপ। তবে নেসি না থেকেও যে লক্-নেসে ভালোমত প্রকট তাতে সন্দেহ নেই…
তা স্কটল্যান্ডে এসে লক্-নেস না দেখে চলে যাবো তাই কি হয়? ম্যাপ বলছে বাড়ি থেকে দুশো মাইল। ইনভারনেস হয়ে যেতে হয়। তাতে কি? এদ্দিনে বেশ বুঝে গেছিলাম যে এদেশে লম্বা গাড়ি চালানোতে ক্লান্তি তো আসেই না, বরং এক অ্যাড্রেনালিন সঞ্চারক। ছোটালাম গাড়ি। উত্তর-সাগরের খাঁড়ি মোরে ফার্থের তীরে অবস্থিত ছবির মতন বন্দর নগরী ইনভারনেস। সেখান থেকে লক্ নেসের দূরত্ব চোদ্দ মাইল মতন।
লক্ নেসে পৌঁছে চোখ জুড়িয়ে গেল। বরফ শীতল শান্ত হ্রদ, দূরে দুই পাহাড়ের কোলে যেন কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। আলো আঁধারি কনকনে ঠান্ডা পরিবেশে হ্রদ টি ভয়াবহ রকমের সুন্দর। জলদানবের অভ্যুদয়ের আদর্শ জায়গাই বটে। ওখানে দেখলাম আধ ঘন্টা বাদে বাদে নৌকা বিহারের বন্দোবস্ত আছে। আমরাও টিকিট কেটে বসে পড়লাম। বেশ কিছুটা দূরে লক্ নেসের একপাশে একটা একহাজার বছরের দুর্গের ধ্বংসস্তূপ, যার নাম Urquhart (উচ্চারণ অওকট) কাস্ল । ইচ্ছে করলে সেখান থেকে বোটে নেমে গিয়ে ঐ কাস্লে ঘোরা যায়। কাস্লের ভাঙ্গা সিঁড়ি বেয়ে ওর টাওয়ারের মাথা থেকে লক্ নেসের দৃশ্য উপভোগ করে পরের বোটে ফেরত আসা যায়। বোটের পিছনদিক বা স্টার্নে দাঁড়িয়েছিলাম। শক্তিশালী প্রপেলরে ঘন নীল রঙের জলে গাবিয়ে উঠছে সফেন ঢেউ। মনে হচ্ছিল যেন এই বুঝি নেসি মাথা চাড়া দিয়ে জল থেকে উঠবে… খানিক বাদেই মেঘে ঢেকে গেল আকাশ, হ্রদের জল ম্যাজিকের মত রং বদলে কালো…
লক্ নেসে একটাই মাত্র দোকান কাম রেস্তোরাঁ। গাড়ি পার্কিং, টয়লেট ইত্যাদির বন্দোবস্ত সেখানেই। দোকানে দেখলাম অনেক ছোটোবড়ো প্রত্নবস্তু ও উপহার দেবার সামগ্রী। তবে সবথেকে জনপ্রিয় ঐ নেসি, ড্যাবড্যাবে চোখ নিয়ে ঢেউ খেলানো ল্যাজ দুলিয়ে মজা করে তাকিয়ে আছে…
লাঞ্চ করে ফের বাড়ির পথে রওনা দিলাম…
রাত্তিরবেলায় আহার সেরে ইচ্ছে হলো ডানফার্মলাইনের নির্জন রাস্তায় পায়চারী করার। আমাদের এলাকাটা সমতল থেকে বেশ কিছুটা উচ্চতায়। তিন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করলাম সমতলের আলোর ঝিকিমিকি। ঝিকিমিকি আকাশেও, তারার। আমাদের দেশে এরকম ঝকঝকে আকাশ দেখেছিলাম এক শীতের রাতে কসৌলি-তে। মুম্বইয়ের প্যাচপ্যাচে গরমের মানুষ তো, তাই শীতের জায়গায় গেলে শীতের জন্য একটু অতিরিক্ত অভিযাত্রীসুলভ হয়ে উঠি। ঘন্টাখানেক পর ঘরে ফিরেই প্রথম হাঁচিটা এল… হ্যাঁচ্চো। শুনতে পেলাম শ্রীমতির গলা, আগেই বলেছিলাম এতো ঠান্ডায় না বেরোতে…
দ্বাদশ দিন
এডিনবরার রেল স্টেশনের নাম ওয়েভারলি। আমাদের বাড়িওয়ালি স্যামান্থা বলেছিল ওয়েভারলিতে নাকি ফ্রি পার্কিং পাওয়া যায়। ভুল তথ্য। আজ আমাদের এডিনব্রা শহর ঘোরার প্ল্যান। সকাল সকাল ওয়েভারলি পৌঁছে পার্কিং পেতে হিমসিম অবস্থা। বিশাল পার্কিং-এর চত্বর কিন্তু জায়গা একটাও খালি নেই। সাধারণত এই সব পার্কিং-এ জায়গা না থাকলে বাইরেই বৈদ্যুতিন ডিসপ্লে থাকে। এখানে ছিল না। স্লট খুঁজতে অনেকটা সময়ের অপব্যবহার হলো (বড়ো শহরের প্রতি আমার বিতৃষ্ণার অন্যতম প্রধান কারণ – এ ব্যাপারে কলকাতা, মুম্বই, লন্ডন, প্যারিস সব এক)। তারপর দৈবাৎ একজনকে বেরোতে দেখে সুৎ করে সেই স্লটটাতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম। আমার তড়িঘড়ি দেখে যে মহিলা গাড়ি বার করছিলেন, মুচকি হাসলেন।
ওয়েভারলি স্টেশন থেকে এডিনব্রা সিটি-সেন্টার এবং বিখ্যাত এডিনব্রা কাস্ল কাছেই। হেঁটে দশ মিনিট। উঁচু নীচু পাহাড়ি কব্ল-স্টোন বাঁধানো রাস্তা। দিনটা ছিল দারুণ, ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ, ঝলমলে সোনা রোদ। তবে এডিনব্রা কাস্ল চত্বরে পর্যটকদের ব্যাপক ভিড়। আর অতিরিক্ত ভিড় দেখলেই আমার সেই জায়গাটার প্রতি আপনাআপনি অনীহা জন্মে যায়। জায়গাটা থেকে পালানোর জন্য মন ছটফট করে ওঠে। তাছাড়া শরীরটাও ভালো লাগছিলো না, আগের রাতে বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস হওয়ার পরিণাম…
সাড়ে দশটার সময় আমাদের একটা হুইস্কি ট্যুরের বুকিং ছিল। স্কটল্যান্ডের হুইস্কি জগদ্বিখ্যাত এ কথা সবাই জানে। তা সেটাকে পর্যটকদের সামনে আরো ভালো করে বিপণন করার উদ্দেশ্যে এখানে অনেকগুলো হুইস্কি ট্যুর আছে। অনলাইন টিকেট বুক করা যায়। সত্যিকথা বলতে কি, আমি ভেবেছিলাম যে আমাদের হয়তো কোনো ডিস্টিলারি – মানে যেখানে স্কচ তৈরি করে – তার পরিদর্শনে নিয়ে যাবে। ভুল ভেবেছিলাম। আসলে এটা একটা বিরাট স্কচ হুইস্কির দোকানের উপরের তিনতলা জুড়ে থ্রি-ডি স্ক্রিনে হুইস্কিদের বার্লি থেকে বোতল বন্দি হবার জীবন বৃত্তান্ত। সঙ্গে ছিলেন একজন সুন্দরী তরুণী সঞ্চালিকা (আজকাল কি সঞ্চালিকা কথাটা ব্যবহার করা যায়? সঞ্চালক, অভিনেতা ইত্যাদি শব্দগুলো তো আজকাল শুনি জেন্ডার নিউট্রাল করে দিয়েছে…), মার্কিনি – তবে এখানে এক স্কটের সাথে ঘর বেঁধে এডিনবরাতে থেকে গেছে। গোলাকার প্রজেকশন রুমে আমরা – শ্রীমতি আর আমি ছাড়া ছিল আর একজন অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক – কখনো বার্লির ক্ষেতে, কখনো প্রাকৃতিক জলধারার স্রোতে আবার কখনো আমেরিকা এবং স্পেন থেকে আমদানি করা আগুনে জ্বলতে থাকা ওক কাস্ক। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, ওক কাঠের কাস্কগুলো এরা প্রথমে আগুনে খানিক জ্বালিয়ে দেয়। ওদিকে ফার্মান্টেশন ট্যাঙ্কে তারপর পিষ্ট অঙ্কুরিত বার্লি (এরই অন্য নাম ‘মল্ট’) ইস্ট দিয়ে গাঁজানো হয়। এই উৎসেচিত মণ্ড এবং তার থেকে উদ্ভূত তরল কোহল পাঠানো হয় তামার পাতন-পাত্রে। পাতনের (ডিস্টিলেশন) দ্বারা কোহল থেকে বাকি বর্জনীয় বস্তু আলাদা করা হয়। এইবার সেই কোহল রেখে দেওয়া হয় আধ-জ্বলা ওক-কাস্কে পরিণত (ম্যাচিওর) করার জন্য। পরিমিত তাপমান এবং আর্দ্রতায় পরিণত হতে থাকে ঐ অ্যালকোহল – কমসে কম তিন বচ্ছর। জ্বলে যাওয়া ওকের পোড়াটে গন্ধ সিংগল মল্ট ম্যাচিওর করার সাথে সাথে তার অণু-পরমাণুতে মিশতে থাকে…
স্কচ হুইস্কি সম্বন্ধে সারগর্ভ জ্ঞান আহরণ এবং ফ্রি পাওয়া একপেগ আইলে সিংগল মল্ট গলাধঃকরণ করে ঘন্টা খানেক পর বেরোলাম। বেরোনোর পথে ঐ বিশাল স্কচের দোকানটা দিয়েই বেরোতে হয়। মাত্র খান দশেক সিঙ্গল মল্টের নাম জানতাম। এখানে দেখলাম অন্তত সাত-আট হাজার ব্র্যান্ড। এই প্রসঙ্গে সদ্য আহরিত জ্ঞান থেকে একটা ট্রিভিয়া শেয়ার না করে পারছি না। স্কটল্যান্ডের মূলত পাঁচটি অঞ্চলে স্কচ হুইস্কি তৈরি হয়, এবং স্বাদে, গন্ধে এরা প্রত্যেকে অনন্য অথচ ভিন্ন। এই পাঁচটি অঞ্চল হলো স্পে-সাইড (সবথেকে জনপ্রিয় অঞ্চল), হাইল্যান্ড (উঁচু পাহাড় এলাকায়), লো-ল্যান্ড (সমুদ্রপৃষ্ঠতলে), আইলে বা আইলা (স্কটল্যান্ডের একদম দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বীপাঞ্চল – এখানকার স্কচ তার পিটি বা পোড়া কাঠকয়লার ফ্লেভারের জন্য বিখ্যাত), এবং স্কটল্যান্ডের একেবারে পশ্চিমে অবস্থিত ক্যাম্পবেলটাউন – যা একসময় হুইস্কির রাজধানী বলে জগৎখ্যাত ছিল।
এডিনব্রা কাস্লে ঢোকার লাইন দেখে সেখানে ঢোকার বাসনা চলে গেছিলো। তাই ফের ছাদ-খোলা বাসে চেপে বসে এডিনব্রা দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। এডিনব্রা কাস্ল আর শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য জায়গা সম্বন্ধে ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে। আমি বরং আর একটা ট্রিভিয়া জানিয়ে এডিনব্রা পর্ব শেষ করি। সকালে সিটি-স্কোয়ারে দেখলাম এক স্কটিশ ব্যাগপাইপার পাইপ বাজিয়ে চলেছে। সামনে টুপিতে পাউন্ড-পেন্স দিয়ে যাচ্ছে শ্রোতারা। চার ঘন্টা বাদে জায়গাটাতে ফিরে দেখি তখনো বাজিয়ে চলেছে সেই ছেলেটি…
ওখানেই একটা ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ করে হেঁটে ফিরলাম ওয়েভারলি। চোদ্দ পাউন্ড পার্কিং-ফি দিয়ে ফিরলাম ডানফার্মলাইন। বিকেলে (লম্বা বিকেল, প্রায় নটা অবধি আলো থাকে) ধারে কাছের পার্কগুলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ততক্ষণে আমি ঠান্ডায় নাকের জলে চোখের জলে একাকার। বাড়িতে বসে ওয়াইন খেলাম… পরদিন আবার লম্বা ড্রাইভ – ইংল্যান্ডের ফিরতি পথ ধরতে হবে।
ত্রয়োদশ দিন (স্কটল্যান্ড – ইংল্যান্ড)
স্কটল্যান্ড ভ্রমণ পর্ব শেষ করে এবার যুক্তরাজ্যের দক্ষিণে, লন্ডন ফেরত যাবার পালা। এদ্দিনে বুঝে গেছি যে এখানে একদিনে টানা গাড়ি চালনাটা এমন কিছু শ্রমসাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনামত এডিনব্রা থেকে লন্ডন যাবার পথে মাঝামাঝি একটা ছোট্ট বন্দর-শহর – সান্ডারল্যান্ড – এ আমাদের একরাতের স্টপ-ওভার বুকিং ছিল।
সান্ডারল্যান্ড যাবার পথে টাইন সুরঙ্গ পার করার সময় ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে প্রথম টোল দিলাম। আমাদের দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের মত এখানে অটোমেটিক স্ক্যানার এবং ফাস্ট-ট্যাগের ব্যাপার নেই। টোল-গেটও নেই। পরিবর্তে যা আছে তা হোলো বড়ো বোর্ডে লেখা সাবধানবাণী, এবং গুচ্ছের ক্যামেরা। গাড়িচালকদের উদ্দেশ্যে বড়ো বোর্ডে লেখা যে সেদিন রাত বারোটার মধ্যে অনলাইন টোল না ভরলে একশো পাউন্ড জরিমানা…
কনসেপ্টটা কিন্তু দারুণ। আমাদের হাইওয়েতে ফাস্ট-ট্যাগ থাকা সত্ত্বেও অনেকসময়তেই গাড়ির ভিড় জমে যায় (মুম্বই-আমেদাবাদ হাইওয়ে-তে তো যায়ই), কারণ কোথাও স্ক্যানার খুব ঢিমে, কোথাও স্বয়ংক্রিয় প্রতিবন্ধক ওঠে না, কোথাও বুথের কর্মচারীদের সঙ্গে কোনো টেঁটিয়া চালকের বচসা… তার চেয়ে ঐসব বুথ-টুথ উঠিয়ে ক্যামেরা বসিয়ে দাও। মাঝরাতের মধ্যে টোল না ভরলে দশ-হাজারি চালানের চোথা পাঠাও। আজকাল তো গাড়ির নম্বর প্লেট থেকে তার সব নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলা যায়।
উইয়্যার নদীর ঠিক উপরে আমাদের ছোট্ট হোটেলের নাম ‘দ্য বোর্স হেড’ – বুনো শুয়োরের মাথা। জন্তু জানোয়ারের নাম দিয়ে এলাকা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান ইত্যাদির একটা ঝোঁক ইংরেজদের মধ্যে প্রবল। যেমন লিঙ্কনে একটা রেস্তোরাঁর নাম দেখেছিলাম ‘এলিফ্যান্ট অ্যান্ড স্নেক’ – হস্তি এবং সর্প। রিপনের পাব ‘দ্য র্যাট হোল’ এর কথা আগেই লিখেছি। মধ্য লন্ডনে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অঞ্চলের নাম ‘এলিফ্যান্ট অ্যান্ড কাস্ল’।
আমাদের হোটেলটা তিনশো বছরের পুরোনো। অনেকবার সংস্কার হয়েছে কিন্তু ঘরের মধ্যে তিন শতাব্দীর পোড় খাওয়া কড়ি বরগাগুলো এখনও দৃশ্যমান। গিয়ে দেখি হোটেলে কেউ নেই। নীচতলার রেস্তোরাঁ এবং বার বন্ধ – বোর্ডে টাঙ্গানো নোটিশ বিকেল চারটের পর খুলবে। অগত্যা হোটেলের মালকিন – মিসেস ডিয়ানাকে ফোন করলাম। ফোন তুলে বললেন, ও আপনারা এসে গেছেন! আপনাদের তো দুটোর সময় আসার ছিল। ইউ আর আর্লি। ঠিক আছে, আমি আসছি – দশ মিনিটের মধ্যে।
তার আগেই একটা ছোট্ট সুইফট সুজুকি চালিয়ে চলে এলেন এক পক্ককেশ, রীতিমত দীর্ঘাঙ্গী এবং টানটান বুড়ি। প্রথমেই নির্ধারিত সময়ের মাত্র আধঘন্টা আগে চলে আসার জন্য আমাদের কপট বকা দিলেন। উনি তো আর জানেননা যে হাতে সময় নিয়ে বেরোনোর অভ্যেস আমাদের ধমনীতে ঢুকে আছে। তারপর পিছনের একটা দরজা দিয়ে আমাদের ভিতরে ঢোকালেন। বললেন, সাবধানে ওঠো। এই হোটেলের সিঁড়িগুলো একদম সাবেকী অ্যামস্টারডামের বাড়ির সিঁড়ির মতো সরু। আমরা ভারত থেকে এসেছি দেখে যুগপৎ আশ্চর্য এবং খুশী হলেন। উত্তর ইয়র্কশায়ারের এইরকম ছোটছোট শহরে উপমহাদেশের পর্যটক দেখা যায় না বললেই চলে। আমরা ব্যতিক্রম। বললেন, তোমাদের রুম আমি আপগ্রেড করে দেবো। আমাদের সবথেকে বড়ো ‘লরেল অ্যান্ড হার্ডি’ স্যুইটে তোমাদের আপগ্রেড করে দিচ্ছি। বললাম, বাঃ। আমরা লরেল-হার্ডির অনেক সিনেমা দেখেছি। আমাদের বিশেষ প্রিয়। অবিশ্বাস্যরকম অবাক হলেন ডিয়ানা। বললেন, তোমরা লরেল-হার্ডির নাম শুনেছো? ওঁদের চেন? বললাম, ওনারা জগদ্বিখ্যাত। ওঁদের চিনবো না? এখনও টিভি ঘোরাতে ঘোরাতে ওঁদের ছবি চলতে দেখলে চোখ আটকে যায়। রিয়েলি? – বলল বুড়ি – জানো একসময় ওনারা এই হোটেলের নৈমিত্তিক অতিথি হতেন। হোটেলের আগের মালিক, মানে যাঁর থেকে আমার স্বামী এই প্রপার্টিটা কিনেছেন, তার সাথে ওঁদের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। নীচে চলো তোমাদের ছবি দেখাচ্ছি। ফের নীচে গিয়ে দেখলাম সত্যিই পূর্বের মালিকের সাথে স্ট্যান লরেল এবং অলিভার হার্ডির ছবি বাঁধানো। পাশে ‘দ্য বোর্স হেড’ – এর এক বাঁধানো শংসাপত্র। দুই মূর্তির সই সহ… ভেবেছিলাম ওটার একটা ছবি তুলবো, কিন্তু তালেগোলে গেলাম ভুলে।
আমাদের কামরায় প্রচুর লরেল-হার্ডির ছবি। রুমের ঠিক বাইরে ছাদের পাশে ওদের দুজনের লাল কোট আর কালো স্যুট পড়া কাঠের মূর্তি। রুমের সামনে জানালা দিয়ে উইয়্যার নদীর মনোরম দৃশ্য। দূরে দেখা যায় মোহনা – যেখানে উইয়্যার গিয়ে উত্তর সাগরে মিশেছে। নদীর ওপারে ‘দ্য স্টেডিয়াম অফ্ লাইটস’ ফুটবল স্টেডিয়াম যা সান্ডারল্যান্ডবাসীদের অত্যন্ত গর্বের। ডিয়ানা আমাদের কথায় কথায় জানিয়ে দিলেন যে ঐ স্টেডিয়ামে প্রতি শনি রবিবার ফুটবল ম্যাচ হয়। দূর দূরান্ত থেকে টিম আসে খেলতে। সান্ডারল্যান্ড এখন যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ডিভিশনে নেই সেই কথাটা আর বুড়িকে জানালাম না। বুড়ি ফুটবল না বুঝলেও, সান্ডারল্যান্ডকে খুব ভালোবাসে।
ভালোবাসার মতই জায়গা। Sunderland কে বাংলায় সুন্দরল্যান্ড বলাই যায়। চেক্-ইন করে গেলাম মাইল তিনেকের দূরত্বে নর্থ-সির পাশে সান্ডারল্যান্ড সমুদ্র সৈকত। চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো জায়গা। যথারীতি দূরে দাঁড়িয়ে প্রহরারত বাতিঘর। বিচের পাশ দিয়ে বাঁধানো ফুটপাথ, পাশে টানা পার্ক। ঝলমলে রোদের মধ্যে হুহু করে বইছে হাড় কাঁপানো হাওয়া। হাওয়ার বিরুদ্ধে উড়ে পণ্ডশ্রম করছে কিছু অর্বাচীন গাংচিল। নাকি ওটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করছে এক্সারসাইজের নিমিত্ত? ঐ ঠান্ডাতেও শর্টস আর টি-শার্ট পড়ে দৌড়োদৌড়ি করছে জগাপাগলারা। আর প্রায় সবার সাথেই একটা ডগি। মহা খুশি মনে মালিক-মালকিনদের পিছন পিছন দৌড়ে বেড়াচ্ছে তারা। পথে কোথাও পটি করলে মালিক সেটা তুলে প্লাস্টিক বন্দি করে পাশে রাখা বিনে ফেলে দিচ্ছে। ঝকঝকে মন ভালো করা পরিবেশ। অনেকটা হাঁটলাম। মনে হচ্ছিল হেটেই যাই, কিন্তু হাওয়ার প্রকোপ এতটাই তীব্র যে আমাদের ধড়াচূড়া ভেদ করে ঢুকছিল ঠান্ডা। তাই খানিক পর মনে হচ্ছিল গাড়ির মধ্যে ঢুকে হিটার চালাই…
একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া দিয়ে সান্ডারল্যান্ড পর্ব শেষ করবো। গাড়ি রেখেছিলাম সমুদ্র সৈকতে রাস্তার পাশে স্লট করা কার-পার্কে। খানিক দূরে দূরে রাখা পার্কিং পাউন্ড ভরার মেশিন। পার্ক করে পয়সা দিতে গিয়ে দেখি কোনো মেশিনে ক্যাশের স্লট কাজ করে না। আমার ফোরেক্স কার্ডে দেবার চেষ্টা করলাম। মেশিন সেই কার্ড স্বীকার করে না। আমার ‘ইন্টারন্যাশনাল’ ডেবিট কার্ড দিলাম। মেশিন সেটা নিতেও নারাজ। প্রসঙ্গত জানানো দরকার ভারত থেকে ফোরেক্স কার্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাঙ্কের অধিকর্তারা যা যা প্রমিস করেন তার সবগুলোই কিন্তু ঠিক নয়। এই সমস্যা আমার ইন্দোনেশিয়াতেও হয়েছিলো। তাই কিছু ক্যাশ রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এখানে তো দেখি ক্যাশের স্লটে ‘নট ওয়ার্কিং’ নোটিশ লাগানো। মহা সমস্যা। পার্কিং ফি না দেবার একশো পাউন্ড ফাইন ভরতে আমি নারাজ। অগত্যা মেশিনের গায়ে লেখা হেল্পলাইন নাম্বারে ফোন ঘোরালাম। ফোন তুলল এক ভারি গলার লোক – নির্ঘাত একজন হুমদো পুলিশ। হোয়াট্স উপ – তীব্র ইয়র্কশায়ারি অ্যাকসেন্টে জিজ্ঞাসা করলো। এরা সবাই ইউ কে উ বলে – জিওফ্রে বয়কট সাহেবের ‘প্রিন্স অফ ক্যালকুটা’-র কথা মনে পড়লো। আমি আমার বঙ্গ অ্যাকসেন্টে বললাম – আমি হুইটবার্ন পার্কিং (নামটা মেশিনে ভাগ্যিস লেখা ছিল) থেকে বলছি। ইয়েস, ইয়েস, আই নো – অসহিষ্ণু উত্তর এলো। বললাম – ইয়ে, এখানে পার্কিং মেশিন কাজ করছে না। ইয়েস, ইয়েস, আই নো – ফের অসহিষ্ণুতা – ইউজ কার্ড। সেটাও কাজ করছে না, ইন্টারন্যাশনাল ফোরেক্স কার্ড – সবজায়গায় তো চলছে, এখানে কেন নিচ্ছে না জানিনা। খানিক চুপচাপ। তারপর শুনলাম – তুমি টুরিস্ট? কোত্থেকে এসেছো? ইন্ডিয়া, মুম্বই – ইয়ে বম্বে – বললাম আমি। প্রশ্ন এলো, গাড়ির নম্বর কি? রেজিস্ট্রেশন নম্বর? – বোকার মতন জিজ্ঞাসা করলাম আমি। ইয়েস, ইয়েস, হোয়াট এল্স – স্বরে আবার ধৈর্যহীনতা। বললাম। উত্তর এলো – ঠিক আছে, আমি নোট করে রাখলাম। তুমি গাড়ি রাখো, পয়সা দিতে হবে না…
অবাক হয়ে গেলাম ইয়র্কশায়ারি বদান্যতায়। সেটা আমাদের অসহায়তায় নাকি ঋষি সুনাকের দেশের লোক বলে বলতে পারবো না। তবে আমার প্রতিটা কথা শুনলো এবং বিশ্বাস করলো। কোনো প্রমাণ না চেয়ে। আমি ওর জায়গায় থাকলে কি বিশ্বাস করতাম? মনে হয় না। প্রথমেই লোককে অবিশ্বাস করার মারাত্মক একটা রোগ আমাদের মধ্যে যে বাসা বেঁধেছে তা কি এতো সহজে যাবার?
রাতে খানিকক্ষণ উইয়্যার নদীর তীরে বসে উপভোগ করলাম শান্ত নৈসর্গিক পরিবেশ। না নৈসর্গিক বলা যাবে না বরং বলা উচিৎ শুনশান অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশ। বাতাসের দাপট কমে এসেছে। কালো কাচের মতো বয়ে চলেছে বয়ে চলেছে নদী, অদূরেই আলোকিত মোহনার দিকে…
শেষ ছ-দিন লন্ডন ও তার শহরতলীতে
রিচমন্ড পার্ক – কেমব্রিজ – লিঙ্কন – রিপন – ডানফার্মলাইন – গ্লেনকো – ইনভারনেস – লক্-নেস – এডিনব্রা – সান্ডারল্যান্ড পর্ব শেষ করে, পূর্ব পরিকল্পনামত সকালে সান্ডারল্যান্ড থেকে গাড়িতে সোজা লন্ডন। লন্ডনের উত্তরপশ্চিমে কলিনডেল নামের একটা এলাকাতে আমরা একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট বুক করেছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই এ যাবত যে কটি হোটেল এবং অ্যাপার্টমেন্টে থেকে এসেছি, এটি তার মধ্যে নিকৃষ্টতম। মাত্র সাড়ে তিনশো স্কোয়ার ফুট জায়গায় বিছানা – যেটা গোটালে সোফা – রান্নাঘর এবং সংলগ্ন বাথরুম, সব ঠেসে ঢোকানো। ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, ওয়াশিং মেশিন সবই আছে। মালিক – অথবা কেয়ারটেকার – একজন দীর্ঘদেহী আফ্রিকান, অলিভার। ওর গোল গোল অ্যাকসেন্টের ইংরাজি উচ্চারণ শুনে পরিষ্কার বোঝা যায় যে অলিভারের জন্ম এখানে হয়নি, ও আফ্রিকান ইমিগ্র্যান্ট। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সব আদব কায়দা বুঝিয়ে দিয়ে বলে গেল যাবার দিন চাবিটা একটা নির্দিষ্ট লেটারবক্সের মধ্যে ফেলে দিয়ে যেতে।
আমাদের আবাসন থেকে কলিনডেল আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন – যদিও এই স্টেশনটা মোটেও আন্ডারগ্রাউন্ড নয় – হাঁটা পথ। লন্ডনে মেট্রো কথাটার চলন নেই, তবে সুবিধার জন্য আমি এখানে মেট্রো শব্দটাই ব্যবহার করবো। কলিনডেল জায়গাটাও একটু ছা-পোষা। রাস্তা ঘাট দোকান বাজারে আমাদের মত বাদামি চামড়ার এবং চিন কোরিয়ার প্রচুর লোক চোখে পড়লো। কৃষ্ণাঙ্গও প্রচুর। লন্ডনের অপেক্ষাকৃত সস্তার অঞ্চল।
আমাদের স্যুটকেসগুলো ফ্ল্যাটে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম হিথরোর হলিডে-ইন হোটেলে, যেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করেছিলাম। আজ সন্ধে ছটার মধ্যে গাড়ি ফেরত দেবার চুক্তি ছিল, তা ছটার আগেই ফেরত দিলাম। গত দু সপ্তাহে প্যজোট-টার সাথে একটা আত্মার সংযোগ হয়ে গেছিল, তাই ওকে ছেড়ে আসতে একটু কষ্টও হচ্ছিল। হলিডে-ইন থেকে বাসে করে হিথরো টারমিনাল ২ – সেখান থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড (মেট্রো) ট্রেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, লন্ডনের গণপরিবহন ব্যবস্থা অনায়াসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। লন্ডনের যে কোনো জায়গায় এই ওদের মেট্রো, বাস, ফেরি এবং জাতীয় রেল পরিষেবা (ন্যাশনাল রেল) দ্বারা পৌঁছে যাওয়া যায়। এবং সেটা ব্যবহার করতে গেলে যে কোনো মেট্রো স্টেশন থেকে সাত পাউন্ড দিয়ে একটা অয়েস্টার কার্ড কিনতে হবে, তারপর সুবিধেমত, সময় সময় তাতে পয়সা টপ আপ করতে হবে। এই ব্যবস্থা আমাদের কলকাতাতেও আছে। তবে তফাৎ টা হোল, এই কার্ড দ্বারা ওদের প্রায় সব পরিবহন পরিষেবার সুযোগ নেওয়া যায়। মেট্রো, বাস, ফেরি, ওভারগ্রাউন্ড রেল – সব। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো হিথরো এক্সপ্রেস এবং এলিজাবেথ লাইনের ট্রেন।
লন্ডনের বিখ্যাত জায়গাগুলো নিয়ে বেশি লিখবো না, কারণ ঐ সব জায়গার প্রচুর তথ্য এবং ছবি ইন্টারনেট ভরে আছে। টাওয়ার ব্রিজ, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি, টাওয়ার অফ লন্ডন, লন্ডন আই, হাইড পার্ক, সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল, বাকিংহ্যাম প্যালেস… আমি এগুলোর কথা লিখবো না। বরং আমি লিখবো এমন কয়েকটি তথ্য যা সাধারণত উইকিতে পাওয়া যায় না…
আবহাওয়া ভালো ছিল। ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে সাইট-সিয়িং হপ-ইন-হপ-অফ বাসের ছাদে চড়ে দু-দুবার সব ঘুরলাম। এবারে দশ পারসেন্ট কম ভাড়ায়, কারণ কেমব্রিজে এই একই বাসে ঘোরার সময় ড্রাইভার আমাদের বলেছিল ভবিষ্যতে ওদের বাস-সার্ভিস নিলে ইওরোপের যে কোনো শহরে দশ শতাংশের ছাড় পাওয়া যাবে। সর্বত্র ব্যাপক ভিড়। বাকিংহ্যাম প্যালেসে তো দেখলাম কুম্ভ মেলার ভিড়। এপ্রিলেই এই অবস্থা, মে-জুনে না জানি কী হবে? আমাদের বাসের টিকেটে থেমস নদীর উপর একটা নৌকা-বিহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই টাওয়ার অফ লন্ডনের স্টপে বাস থেকে হপ-অফ্ করে টাওয়ার মিলেনিয়াম পিয়ের থেকে ফেরি নিলাম। আবহাওয়া ভালো থাকলে এটা সত্যিই অসাধারণ। ঝকঝকে রোদে, গাঢ় নীল আকাশের নীচে থেমসের জল কেটে ওয়েস্টমিনস্টারের দিকে এগিয়ে চলেছে ফেরি। সঙ্গে লাইভ ধারাবিবরণী। দুপাশে লন্ডন নগরীর সাবেকী এবং আধুনিক সংশ্লেষণ। লন্ডন আই (যা আসলে খুব ঢিমে লয়ে ঘুরতে থাকা এক বিশালাকায় ফেরিস-হুইল বা নাগরদোলা। যেখান থেকে লন্ডন নগরীর দূর দূরান্ত পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। দুবাই এবং সিঙ্গাপুরেও এইরকম ‘আই’ দেখেছি), টাওয়ার অফ লন্ডন, একদম আধুনিক ইমারৎ ভাঙ্গা কাচের শৈলীতে বানানো দ্য শার্ড, খানিকটা দূরে সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের গোম্বুজাকার মাথা ইত্যাদি দেখতে দেখতে নৌকা ভ্রমণ বেশ লাগছিল। আমার সবথেকে ভালো লাগলো ফেরি থেকে ব্রিজগুলোর দৃশ্য। টাওয়ার পিয়ের থেকে ওয়েস্টমিনস্টার পিয়েরের আধঘন্টার সফরে আমরা পাঁচ-পাঁচটা ব্রিজের তলা দিয়ে গেলাম। টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন ব্রিজ, সাউথওয়ার্ক ব্রিজ, ব্ল্যাকফ্রাইয়ারস ব্রিজ আর মিলেনিয়াম ব্রিজ। এই প্রত্যেকটা ব্রিজের খুব সম্পদশালী ইতিহাস আছে, বিশেষ করে সবথেকে প্রাচীন লন্ডন ব্রিজের। এগুলো সব ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। তবে একটা মজার তথ্য দিতেই হবে।
সুবিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজের জলপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা তুলনামূলক ভাবে কম। তবে সেতুটা মাঝখানে থেকে বিভাজিত। দুপাশ থেকে এই বিভাজিত অংশ টেনে তুলে দেওয়া যায়। থেমস নদীতে উঁচু জাহাজ এবং স্টিমার যাতায়াত করার জন্য এই ব্যবস্থা। তবে সে নাকি এক মহাযজ্ঞ। সেইজন্যে জাহাজ কোম্পানিকে চব্বিশ ঘন্টা আগে নোটিশ দিতে হয়। পৌরসভাকে তখন নগর পরিবহন দপ্তরকে নোটিশ পাঠাতে হয়; খুব ব্যস্ত সেতু, এর উপর দিয়ে যানবাহনের যাতায়াতও কম নয়। তারপর প্রশিক্ষিত শ্রমিকবাহিনীকে যোগাড় করা (স্রেফ এই কাজের জন্য তো আর চব্বিশ ঘন্টার লোক রাখা যায় না), আশেপাশের সবাইকে জানান দেওয়া, পুলিশ এবং দমকল দপ্তরকে অবহিত করা, জাহাজ মুভমেন্টের সাথে এই সব কিছুর সমন্বয় করা – মানে পুরো এক্সারসাইজটা যাকে বলে লজিস্টিক্যাল দুঃস্বপ্ন। আর এই বিশাল দক্ষযজ্ঞের জন্য লন্ডন পৌরসভা জাহাজ কোম্পানির কাছ থেকে কতো পাউন্ড ফি নেয়? আন্দাজ করা কঠিন, কারণ সংখ্যাটা শূন্য। এই পুরো পরিষেবা লন্ডন পৌরসভা দেয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। দুহাজার চব্বিশে বসে ভাবা যায়? বিশেষ করে লন্ডনের মতো জায়গায় যেখানে প্রতি মিনিটের পরিষেবার মূল্য নির্ধারিত…
শহরের একদম কেন্দ্রে পার্লিয়ামেন্ট স্কোয়্যার দিয়ে বাস ঘোরার সময় দেখলাম উইনস্টন চার্চিল সাহেবের বিশাল স্ট্যাচু। ১৯৪৩-এ বাংলার মন্বন্তর ঘটানোর পিছনে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। লোকটা বাদামি ত্বকের ভারতীয়দের মানুষ হিসেবেই গণ্য করতো না। কিন্তু চার্চিল সাহেব ইউ-কে তে অত্যন্ত বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। মূল কারণটা অবশ্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের হাতে জার্মানদের পরাজয়, যার মূল কাণ্ডারি ধরা হয় চার্চিলের কূটনীতি এবং ব্রিটিশ বাহিনীর পরাক্রম। পার্লিয়ামেন্ট স্কোয়্যারে চার্চিলের ভাস্কর্যের উপর নাকি নিয়ন্ত্রিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে কাকে-চিলে তার উপর না বসে সেটাকে পুরীষ-কলুষিত করতে না পারে। আর একটা ভালো কনসেপ্ট। কলকাতায় আমাদের নেতাজী, বিদ্যাসাগর, রবিঠাকুরের উপর এর প্রয়োগ মন্দ হবে না…
মাদাম তুস্যো-তে চিক্না শাহরুখ খানের আদলের একটা লোক আর প্রায় বক্ষোন্মুক্তা প্রিয়াঙ্কার মতো এক মহিলাকে দেখে পয়সা নষ্ট করলাম। তার চেয়ে ঢের ভালো পিকাডিলির বিখ্যাত হার্ড রক কাফেতে বসে স্যভনন ব্লাঁ-তে চুমুক দিতে দিতে সেখানকার পরিবেশ উপভোগ করা, বা অক্সফোর্ড সার্কাসে উইন্ডো শপিং করা।
একদিন ট্রেনে চেপে চলে গেলাম গ্রেনিচ্ (Greenwich এর শুদ্ধ উচ্চারণ গ্রিনউইচ্ নয়)। যে জায়গা থেকে সারা বিশ্বের সঠিক সময় নির্ধারিত হয়, যে রেখা বা মেরিডিয়ান পৃথিবীর পূরব-পশ্চিম নির্ধারণ করে, সেই জায়গাটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ওয়াটারলু স্টেশন থেকে ইউ.কে-র জাতীয় রেলপথে মাত্র আধঘন্টার পথ। ফেরিতেও যাওয়া যায়।
গ্রেনিচ্ স্টেশন থেকে হাঁটা দূরত্বেই একটি পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত রয়্যাল অবজারভেটরি। একটা খুব সুন্দর সবুজ পার্ক অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছতে হয়। লন্ডন এতো জনবহুল জায়গা হওয়া সত্ত্বেও এখানেও যত্রতত্র সবুজের সমারোহ – মানে আমাদের মুম্বই-কোলকাতার মতো সেগুলো প্রোমোটারদের খপ্পরে চলে যায়নি। এই পার্কগুলোতে হাঁটাটাও উপভোগ্য। হাঁটতে হাঁটতে আমরা টিলা বেয়ে পৌঁছে গেলাম রয়্যাল অবসারভেটরিতে। টিলার উপর থেকে লন্ডন নগরীর একাংশ এবং থেমস নদী দেখা যায়…
গ্রেনিচ্ মিন টাইমের কথা কে না জানে? এই সেই জায়গা যা বিশ্বের পূরব-পশ্চিম নির্ধারিত করে। সমন্বিত গ্লোবাল টাইমকিপিংয়ের ভিত্তি, গ্রেনিচ্ গড় সময় (GMT)। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি তৈরি এই অবজারভেটরি – বিশ্বের প্রাইম মেরিডিয়ানের আঁতুড়ঘর – যার দ্রাঘিমাংশ ঠিক শূন্য ডিগ্রি শূন্য মিনিট শূন্য সেকেন্ড। অবসারভেটরির ঠিক মাঝামাঝি পাহাড় বেয়ে নেমে গেছে একটি তামার পাত, খুব বেশি হলে ফুটদেড়েক চওড়া। সেই পাতের একদিকে হলো পূর্ব – মানে ভারত, চিন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য। আর একদিকে হলো পশ্চিম – মানে আমেরিকা, কানাডা, ব্রাজিল আর পাশ্চাত্য। তামার পাতের দুপাশে পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু স্থানের দ্রাঘিমাংশ পাথরে খোদাই করে সাদা পেন্ট দিয়ে লেখা (ছবি দ্রষ্টব্য)।
এ ছাড়াও রয়্যাল অবসারভেটরিতে সুরক্ষিত রয়েছে মহাকাশবিদ্যা (অ্যাস্ট্রোনমি) পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নত বিভিন্ন উন্নত যন্ত্রাদি। রয়্যাল অবজারভেটরির প্রধান ফটকের বাইরে দেয়ালে লাগানো এক মহা খটমট ঘড়ি যার নাম ‘শেফার্ড গেট ক্লক’। ১৮৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সময়নিরূপক যন্ত্রটি গ্রিনউইচ গড় সময় (GMT) প্রদর্শনের জন্য প্রথম সর্বজনীন ঘড়ি। ঘড়ির ডায়ালটি খুব গোলমেলে লাগে কারণ এর অনন্য বৈশিষ্ট্য; এটি একটি ২৪-ঘন্টা ডায়াল ব্যবহার করে। খেয়াল করে দেখলে দেখবেন দুপুর বারোটার কাঁটাটি নীচে, সন্ধ্যে ছটার জায়গায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মহাকাশবিদ্যার সময় দেখা শুরু হয়েছিল দুপুর বারোটায়, মধ্যরাতে নয়। কারণটা ঠাউর করতে পারলাম না, কারণ গ্রহ-তারকারা তো রাতেই দৃশ্যমান। সে যাইই হোক ঘড়িটি একটি জনপ্রিয় ল্যান্ডমার্ক এবং সমগ্র বিশ্বের সময়নির্ধারক মানদণ্ডের প্রতীক।
মগজে ইতিহাস ঠেসে গ্রেনিচ্ পিয়ের থেকে ফেরি ধরলাম লন্ডন আই-এর উদ্দেশে…
এর মধ্যে একদিন ওয়াটারলু স্টেশন থেকে উইন্ডসোরের ট্রেনে চেপে বসলাম। ঘন্টাখানেকের পথ। এমন সুন্দর কোচের ট্রেন এখন আমাদের ভারতেও আছে, তবে ‘কোয়ায়েট কোচ’ এর কনসেপ্টটা আছে কি? অথচ ব্রিটেনে এই রকম ‘কোয়ায়েট বা নীরব কোচ’ আমি ২০০৬ সালেও দেখেছি। মানে এই বগিতে মোবাইলে কথা বলা নিষিদ্ধ। কথা বলতে হলে সিট ছেড়ে বগির ভেস্টিবিউলের কাছে গিয়ে নিম্নস্বরে কথা বলতে হবে। মনে পড়েছিল আমাদের শতাব্দী এক্সপ্রেসের পরিবেশের কথা। কিছু লোকে এত চেঁচিয়ে কথা বলে যেন বগির বাহাত্তর জন যাত্রী যদি তাদের হাঁড়ির খবর না শোনে প্রলয় ঘটে যাবে। আমাদের দেশে এই নিয়ম জারি করলে অবশ্য প্রথমেই এক শ্রেণীর জনতা এর মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে গণতন্ত্রকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র দেখে দ্বিগুণ উদ্যোগে বগির মধ্যে চেঁচামেচি এবং তাণ্ডব শুরু করে দেবে। সে যাক্। ওসব ভেবে আমি মনখারাপ করতে চাই না। মনখারাপের অন্য একটা কারণ একটু পরেই ব্যক্ত করছি।
উইন্ডসোরে পৌঁছে চোখ জুড়িয়ে গেল। এখানে এসে টের পেলাম ব্রিটেনের রানি কেন বেশিরভাগ সময় বাকিংহ্যাম প্রাসাদ ছেড়ে উইন্ডসোর কাস্লে সময় কাটাতেন। স্টেশন থেকে উইন্ডসোর দুর্গ হাঁটা পথ। দুপুর বারোটার এন্ট্রি টিকিট আমরা অন-লাইন কিনে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা আধঘন্টা আগেই পৌঁছে ঢুকবো কি ঢুকবো না এই ধন্দে পড়েছিলাম। গেটে গিয়ে দেখলাম ওখানকার অধিকর্তারা বেশ খুশিই হলো এবং স্বস্তি পেলো। বলল – এসেছেন, বাহ্, ভালো করেছেন। এমনিতেই আজ প্যালেসে আজ দুপুর বারোটার পর প্রোগ্রাম আছে। কোনো পূর্বঘোষিত অনুষ্ঠান নয়। বারোটা থেকে এন্ট্রি বন্ধ। যান, চটপট যান। গেলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে কাস্লে ঢুকলাম। এই কাস্ল এখনও ব্রিটেনের রাজপরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। আমাদের টিকিটের সাথে কাস্লের ভিতরে রাজপরিবারের অন্তঃপুরের ট্যুর ছিল।
কাস্লটি বাইরে এবং ভিতর থেকে নিঃসন্দেহে অনবদ্য। ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম চার্লসের রাজত্বের সময় থেকে ব্রিটেনের রাজপরিবারের ইতিহাসের সব বিখ্যাত কীর্তিনামার ইতিহাস ছবি (পেইন্টিং), আসবাবপত্র এবং অন্যান্য আর্টেফ্যাক্ট দ্বারা সুরক্ষিত। সূক্ষ্ম শোপিস, চায়না (চিনেমাটির বাসন), স্বর্ণ ও রৌপ্য, টেপেস্ট্রি, শিল্পকর্ম এবং অস্ত্রাগার দিয়ে রাজকীয় কক্ষগুলিকে সুসজ্জিত। এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষ, সেখান থেকে অন্য কক্ষ। কখনো রাজার সভাগৃহে, কখনো রানির শয়নকক্ষে, কখনো রাজার অফিসঘরে, গোসলখানায়… প্রতিটি প্রদর্শন ইতিহাস এবং উপাখ্যান সমৃদ্ধ। সাথে হেডফোনের অডিও গাইড ছিল। সেখানে ঐ এক্সিবিট গুলোর বৃত্তান্ত শুনছিলাম মুগ্ধ হয়ে। কিন্তু খানিক বাদেই দেখলাম ভেতরের অফিসিয়ালরা আমাদের ভাগানোর জন্যে উশখুশ করছে। বাইরে লনে সেই অঘোষিত অনুষ্ঠান শুরু হবে, তার আগে ওদের কাস্ল খালি করতে হবে। পর্যটকদের তাড়া দেবার মাত্রাটা ক্রমেই বাড়তে বাড়তে শেষমেশ তো প্রায় ঘাড় ধাক্কা দেবার উপক্রম, যদিও মুখে ‘ভেরি সরি, ভেরি সরি’-র বুলির খামতি ছিল না। তাই সাততাড়াতাড়ি কাস্লের অন্তঃপুরের ভ্রমণ শেষ করে বাইরে, দূরে লনে ঘটতে থাকা রয়্যাল প্যারেড দেখলাম। কেন, কী কারণে ঐ অনুষ্ঠান কিচ্ছু জানিনা। জানার চেষ্টাও করিনি। কাস্লের মধ্যে এতো প্রদর্শনের বস্তু ছিল এবং তার বর্ণনা গুলো এতই সুখ শ্রাব্য ছিল যে অনায়াসে আরো দু ঘন্টা ভিতরে সময় নিয়ে সবকিছু ভালো করে দেখা যেত। অতৃপ্তিতে বিষিয়ে উঠেছিল মন।
এবার ব্রিটেনের রাজপরিবারকে আমার প্রশ্ন – আপনারা যদি জানতেন যে আপনার একটি ইভেন্ট আছে তাহলে কেন সেদিনের টিকেট বিক্রি করলেন? টিকেট মোটেও সস্তা নয়। যুক্তরাজ্যের অন্য সব কিছুর মতো যথেষ্ট ব্যয়বহুল। এবং এই টিকেট বিক্রির টাকা রাজপরিবারের অন্যতম প্রধান উপার্জনের উৎস। যে দর্শনার্থীদের প্রদর্শন দেখার জন্য উপযুক্ত সময় না দেওয়া কি অনৈতিক নয়? টিকিট বিক্রির পর অঘোষিত অনুষ্ঠান শুরু করে দেওয়াটা কি প্রতারণা নয়?
তিক্ত অনুভূতি নিয়ে ক্যাসেল ত্যাগ করলাম। লাঞ্চ শেষ করে ইটন নদীতীরে গিয়ে বসলাম। ইওরোপের যে কোনো নদীর ধারে গিয়ে বসলেই মন ভালো হয়ে যায়। ওখানে বসতেই আমাদের ঘিরে ধরল একঝাঁক রাজহাঁস, তাদের রাজকীয় মহিমা নিয়ে। উইন্ডসোরে সবই রাজকীয়। এমনকি ঐ জলপক্ষীগুলোও… সাধে কি আর এলিজাবেথ এখানে পালিয়ে আসতেন – কথাটা দ্বিতীয়বার মনে এলো…
উইন্ডসোর কাস্ল। এখনো এখানে ব্রিটেনের রাজপরিবারের এটা সেটা অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।
লন্ডনে আরো চারটি ঘটনার কথা লিখে আমার এই ভ্রমণ বৃত্তান্তে ইতি টানবো।
দিনটা ছিল সোমবার। বাবা ভোলানাথের দিন। আমরা ঐদিন আমিষ ভক্ষণ করি না। পরের পরদিন আমাদের দেশে ফেরার টিকেট। সেদিন কিছু করার ছিল না; আমাদের ছুটির মধ্যে ছুটির দিন। শ্রীমতির সাথে কলিনডেলের নির্জন রাস্তায় পায়চারী করতে করতে শীত উপভোগ করছিলাম, দুদিন পরেই তো ফিরে গিয়ে গরমের মধ্যে পড়তে হবে। ফ্রিজার থেকে সোজা ফারনেসে। দেখি একটি বাস-স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে এক ছোটোখাটো চেহারার প্রৌঢ়া। দেখে মনে হয় ভারতীয়। আমাদের দেখে হাসলেন। আমরা গিয়ে আলাপ করলাম। ভদ্রমহিলা গুজরাতি। প্রায় চল্লিশ বছর হলো লন্ডনের এই শহরতলীর বাসিন্দা। ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক পরিচয়ের পর জানতে চাইলেন আমরা সেদিন কী করছি। কিছুই করছি না জেনে বললেন এখান থেকে কিছুটা দূরেই একটি স্বামীনারায়ণ মন্দির আছে। দেখে আসুন না। ভালো লাগবে। ৮৩ নম্বর বাস, মাত্র পাঁচটা স্টপ। বাস থেকেই মন্দিরটা দেখতে পাবেন। তারপর সেখান থেকে ঐ একই বাসে চেপে চলে যেতে পারেন ওয়েম্বলে। ওখানে একটি সনাতন হিন্দু মন্দির রয়েছে। সেটাও দেখে আসতে পারেন। খুব সুন্দর।
কিছু করার ছিল না। তাই তিরাশি নম্বর ডাবল-ডেকারে চেপে বসলাম। কলিনডেলের স্বামীনারায়ণ মন্দির খুব বড়ো নয় তবে সুন্দর। সেখানে এক ভারতীয় তরুণীর সাথে আলাপ হলো। সে স্বামীনারায়ণ প্রতিষ্ঠান নিয়ে রিসার্চ করছে, ভাবা যায়?
স্বামীনারায়ণ দর্শন করে ফের তিরাশি নম্বরে চেপে বসলাম।
ওয়েম্বলে অঞ্চলে রাস্তায় বাস দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো গুজরাতের কোনো ঠান্ডা শহরে ঢুকে পড়েছি। ধোকলা, থেপলা, খাখড়া আর চুরমুরার দোকানে ভর্তি। রেডিমেড জামাকাপড়, মনিহারি দোকান, মিষ্টির দোকানও কম নেই। একটা বড়ো খাবারের দোকানের নাম দেখলাম ‘গুজ্জু ধাবা অ্যান্ড বার’, নিচে ছোট হরফে লেখা ‘শুদ্ধ শাকাহারি’। এই প্রথম গুজ্জু ‘বার’ দেখলাম। বাসের দোতলাতে বসে দূর থেকে সনাতন হিন্দু মন্দির শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধে হলো না।
সত্যিই দুর্দান্ত মন্দির। দৃষ্টিনন্দন তার বাইরের কারুকার্য। হেন হিন্দু দেবদেবী নেই যাঁদের বিগ্রহ সেখানে অনুপস্থিত। গণেশ, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মা কালী, শ্রীকৃষ্ণ, বজরংবলী তো আছেনই – এছাড়াও মধ্যমণি হয়ে রয়েছে ঝকমকে অলংকার ভূষিত রাম-সীতা-লক্ষ্মণের সামনে করজোড়ে বসে থাকা হনুমানের বিগ্রহ – রাম দরবার। এছাড়া রয়েছেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আরো অনেক রূপ, যেমন শ্রীনাথজি, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, বালাজী, ইত্যাদি। রয়েছেন শ্রীজলারাম বাপা, শ্রীসহজানন্দ স্বামী, শ্রীসিমন্ধর স্বামী ইত্যাদি ভারতের নানান বিখ্যাত ধর্মগুরুর বিগ্রহ। আর মন্দিরের প্রবেশদ্বার ছাড়ালেই এক কক্ষে বেশ বড়ো শিব লিঙ্গ। পাশে দুটি বালতিতে রাখা দুধ এবং জল এবং ছোট ছোট ঘটি। ইচ্ছেমত মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে বাবা ভোলানাথের মাথায় দুধ এবং জল ঢেলে তাঁর কাছে নিজেদের মনোবাঞ্ছা পেশ করছেন। আমরাও শিবকে স্নান করিয়ে প্রণাম করলাম। ভাবছিলাম, কি অদ্ভুত এই যোগাযোগ। সোমবার দিন সুদূর বিদেশে বাবা ভোলানাথের মাথায় জল ঢালার সুযোগ কে করে দিল? কেন দেখা হয়েছিল নির্জন রাস্তায় ঐ গুজরাতি প্রৌঢ়ার সাথে? আমি অন্ধবিশ্বাসী নই, কিন্তু আমার জীবনে এরকম বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে যার ব্যাখ্যা মেলা ভার। তৃপ্ত মনে ওয়েম্বলে সেন্ট্রাল থেকে লন্ডন ব্রিজ স্টেশনের ট্রেন ধরলাম…
ওয়েম্বলের সনাতন হিন্দু মন্দিরের বাইরের দৃশ্য। ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ।
ইংরেজরা খুব ভয় পেতে এবং ভয় দেখাতে ভালোবাসে। লন্ডন জুড়ে তাই অনেক ‘হরর-শো’ দেখতে পাবেন, যেখানে এরা অতীতের কুখ্যাত খুনি, ধর্ষণকারী, বিকৃতমস্তিষ্ক পাগল ইত্যাদি চরিত্র গুলোর মডেল তাদের গা-শিরশিরে ইতিহাস সযত্নে লালন এবং প্রদর্শন করে। লন্ডন ডান্জিওন, জ্যাক-দ্য-রিপার শো, লন্ডন ব্রিজ শো – এইরকম কতগুলো শো। প্রায়ান্ধকার কক্ষের মধ্যে দিয়ে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় – দুপাশে শো কেসের মধ্যে সেই সব কুখ্যাত ভিলেনদের মোমের মূর্তি। কোথাও আবার জ্যান্ত অভিনেতা অভিনেত্রী। যেতে যেতে দেখতে পাবেন সারা অঙ্গে রক্ত মেখে শব ব্যবচ্ছেদ করে উল্লাসে মত্ত কোনো পাগল ডাক্তার, ব্যবচ্ছেদ টেবিলের নিচে পড়ে লাশটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কোথাও আবার অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আততায়ী লাফ দিয়ে আক্রমণ করতে এরে পিলে চমকে দেয়। টুপি দিয়ে চোখ ঢাকা জ্যাক-দ্য-রিপার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই তার সাথে আচমকা বয়ে আসে হিমশীতল বাতাস। আগে আমি দ্য লন্ডন ডানজিওনের শো দেখেছিলাম। এবারে পয়সা খরচা করে লন্ডন ব্রিজ শো দেখে যেচে পড়ে খানিক ভয় পেলাম।
ভয় পাওয়া এবং দেখানো ছাড়াও ইংরেজরা ভালোবাসে আরো একটি জিনিস। মার্ডার-মিস্ট্রি। সর্ব প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ দুই রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের স্রষ্টা স্যর আর্থার কোনান ডয়েল এবং ডেম (Dame) আগাথা ক্রিস্টি দুজনেই ছিলেন খাঁটি ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত। বলাবাহুল্য, এঁরা দুজনেই আমার খুব প্রিয় লেখক-লেখিকা। ইদানীংকালে আমি যাঁর রহস্য-রোমাঞ্চের বিশেষ ভক্ত, তিনিও ইংরেজ – অ্যান্থনি হরোউইট্জ। এত কথা বললাম কারণ আমাদের আগাথা খ্রিস্টির বিখ্যাত উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘দ্য মাউস ট্র্যাপ’ দেখার প্রোগ্রাম ছিল। এক বন্ধুর কাছ থেকে এই নাটকটার কথা শুনে গেছিলাম, তাই করকরে একশো ত্রিশ পাউন্ড দিয়ে দুটো টিকিট অনলাইন কেটে রাখা ছিল। নাটকটি টানা বাহাত্তর বছর ধরে চলছে। আমাদের শো-টা ২৯৫৭৫ তম! লেস্টার স্কোয়্যারে সেন্ট মার্টিন্স থিয়েটারে চলছে। একটু সময় নিয়েই পৌঁছে গেলাম। আমি জানতাম, লন্ডনে শো শুরু হয়ে যাবার পর কাউকে হলে ঢুকতে দেওয়া হয় না। টিকেট থাকলেও। দেরি করে গেলে ইন্টারমিশনের জন্য বসে থাকতে হবে। সবথেকে অবাক হলাম ‘দ্য মাউস ট্র্যাপ’ এর জনপ্রিয়তা দেখে। উইক-ডে, ম্যাটিনি, বাহাত্তরতম বছরে বাইরে দেখলাম হাউজ-ফুল এর বোর্ড। শেষ কবে কোথায় ‘হাউজ ফুল’ এর বোর্ড দেখেছি মনে করতে পারলাম না। থিয়েটারের ভিতরটা আমাদের স্টার থিয়েটার মনে পড়ায়। কলকাতায় একসময় পেশাদারি থিয়েটারের রমরমা ছিল। এখন সে সবই স্মৃতি। অথচ লন্ডন কিন্তু তাঁর প্রতিটি পুরোনো ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। লাল রঙের পাবলিক টেলিফোন বুথ গুলো এখনও রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায়। ডবল ডেকার বাসগুলো উঠে তো যায়নিই, উলটে আরো আধুনিক করা হয়েছে। সে যা হোক, ভিতরে গিয়ে দেখি খচাখচ ভিড়, কেবল আমাদের সামনের দুটো সিট খালি। অনেকদিন পর প্রথম বেল, দ্বিতীয় বেল শুনলাম। রহস্য রোমাঞ্চ শুরু হবার আগেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল। তৃতীয় বেল বাজতেই আলো ঢিমে হয়ে ড্রপ স্ক্রিন উঠল। শুরু হল নাটক। মাঝপথে আর একটা খুন হতেই বিরতি। দেখলাম আমাদের সামনের সিট দুটোতে লোক এসে গেছে – দেরি করেছিল, শো চলাকালীন ঢুকতে দেয় নি। নাটক শেষ হলো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, মন ভরলো না। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হলো ভালো নাটক, তবে বাহাত্তর বছর চলার মতন নয়। আসলে নাটকের হাইপ শুনে আমাদের প্রত্যাশা হয়তো একটু বাড়াবাড়িরকমের বেশি ছিল, তাই কোনোকিছুতেই বেশি প্রত্যাশা করতে নেই। জীবনের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। তবে একটা জিনিস যেটা ভালো লাগলো, তা হলো নাটক শেষ হলে সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী রা (জানি অভিনেত্রী কথাটা আজকাল ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু আমি একটু সেকেলে) সামনে এসে বো করে তুমুল করতালির মধ্যে দর্শকদের ধন্যবাদ জানালেন। তারপর যিনি নায়ক, উনি বললেন – তাহলে আপনারা এখন জেনে গেলেন প্রকৃত খুনি কে। অনুরোধ করব এই রহস্যটা আপনাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে, যাতে ভবিষ্যতের দর্শক দ্য মাউস ট্র্যাপের পুরো আনন্দ নিতে পারেন। থ্যাঙ্ক ইউ ওয়ান্স এগেইন…
ভালো লাগলো…
পরদিন হিথরো থেকে মুম্বইয়ের উড়ান ধরলাম। লন্ডনে উবর ট্যাক্সি ক্যাশ নেয় না। ফোরেক্স কার্ড চলে না। বুক করা ব্যাপক ঝামেলা – তাই জানিয়ে রাখলাম। কলিনডেলের এক দোকানের গুজরাতি মহিলাকে অনুরোধ করতে বুক করে দিলেন, আমরা তাঁকে ক্যাশ দিলাম। পঞ্চাশ পাউন্ড।
হিথরো-তে সিকিউরিটির পর ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল খুঁজতে গিয়ে দেখি তার দেখা নেই। বিমানবন্দরের এক আধিকারিককে তার সন্ধান জিজ্ঞাসা করতে ও বলল – এখানে ঐ সব ফালতু সময় নষ্ট আমরা করিনা। তার চেয়ে বরং ডিউটি ফ্রি দোকানগুলোতে শপিং করুন। প্রথমে অবাক হলাম। আন্তর্জাতিক ডিপার্চারে পাসপোর্ট কন্ট্রোল নেই? সে আবার কী কথা? পরে ভেবে দেখলাম, একদম হক কথা। কারা আমাদের দেশে ঢুকল তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা থাকা উচিৎ, কারা দেশ ছেড়ে বেরোল তাতে আমার কী? দেশ ছেড়ে যত ভাগে ততই মঙ্গল। যে দেশে যাচ্ছে মাথাব্যথাটা তাদের হওয়া উচিৎ। আমাদের প্রস্থানের খবর তো বোর্ডিং পাস স্ক্যান করার সময়েই নথিভুক্ত হয়ে যায়। কে কবে দেশ ছেড়ে গেল তাতো সব কম্প্যুটারে বন্দি। তাহলে, কি দরকার পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে একটা পাতা নষ্ট করার?
আট ঘন্টা পর নামলাম মুম্বই, ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে। ফ্রিজার থেকে সোজা ফারনেসে…
সমাপ্ত