‘খেলা খেলা সারাবেলা...’
মানব বিকাশে খেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত আমরা ধরেনি খেলা শুধু ছোটোদের জন্যেই উপযুক্ত, তা কিন্তু একেবারেই নয়। খেলা বড়োদের জীবনেও একটা বিশেষ দিক জুড়ে থাকে। অনেক প্রাপ্তবয়স্করা মনে করেন খেলা শুধুমাত্র বিনোদন – ধারণাটা সঠিক নয়। দাবা, লুডো, হাডুডু, খো-খো, ইত্যাদি খেলা মজাদার তো বটেই, সেই সঙ্গে এর মধ্যে থাকে যে কোনো বয়সের খেলোয়াড়ের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, ও শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ। ক্রিকেট, সকার (আমাদের দেশে ফুটবল), বেসবল, ফুটবল (আমেরিকান), রাগবি ইত্যাদি খেলা নিয়ে ছোটো এবং বড়োদের মাতামাতি দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না খেলা মানুষের জীবনে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই খেলার জনপ্রিয়তা সময় সময়ে পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়!
শিশুদের জীবনে খেলা আরও উল্লেখযোগ্য। স্নেহ, পুষ্টি, ও স্বাস্থ্যর পরই শিশু-জীবনে খেলা কেন্দ্রস্থান অধিকার করে রয়েছে। ‘কাজ’ বলতে মানুষের জীবনযাত্রায় যা বোঝায়, ছোটোদের ক্ষেত্রে তাই হল খেলা। শিশুর বিকাশে খেলা শুধু সাহায্য করে না, পরবর্তী জীবনে তার জীবিকা ও সামাজিক ভূমিকা শিখতে সাহায্য করে। এই খেলার মধ্যে দিয়েই ছোটোরা শেখে দৈনন্দিন জীবনের মোকাবিলা। সব সংস্কৃতির, সব শ্রেণীর শিশুর জন্যে এ-ই বাস্তব। শুধু মানুষ কেন, প্রাণী জগতের প্রতি স্তরে ছোটোরা খেলার মধ্যে দিয়ে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে শেখে।
খেলার উপকরণ হল খেলনা। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শিশুর জীবনে খেলনার প্রয়োজন হয়। বড়ো হতে হতে এর চাহিদা বাড়ে। দোলনায় শোয়া ছোট্ট শিশুর সামনে মা-বাবা ঝুমঝুমি নাচান। সেটাই হয় শিশুর প্রথম খেলনা। তারপর নিজের আঙুলে ধরতে শিখলে শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হয় নানান ধরনের খেলনা। যে পরিবারে খেলনা কেনার সামর্থ নেই, সেখানে বাচ্চারা নিজেরাই খেলনা তৈরি করে – কদমফুল দিয়ে বল লোফালুফি খেলা, বাতাবি লেবুর ফুটবল, কাপড়ের পুঁটলি-পুতুলের বিয়ে, গোলপাতার লুচি ভাজা। এছাড়াও সাইকেলের টায়ার গড়িয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা, ইট সাজিয়ে পিট্টু, ডাংগুলি, এসব সমবেত খেলা তো আছেই। যাঁদের টাকাপয়সা আছে, তাঁরা সন্তানকে ঝকঝকে সুন্দর খেলনা কিনে দেন। উদ্দেশ্য শুধু মনোরঞ্জন নয়, বাচ্চাকে কিছু শেখানো। বয়সোপযোগী ‘এডুকেশানাল’ খেলনা এখন অত্যন্ত লাভজনক ব্যাবসা। আর আধুনিক সেল ফোনের যুগে ‘ইলেক্ট্রনিক গেমস’-এর তো অন্ত নেই। সেই খেলা আজকাল অনেককেই নাওয়া খাওয়া ভুলিয়ে দিয়েছে।
খেলার জগতে একটা জটিল সমস্যা হল লিঙ্গবিচার। অর্থাৎ কোন খেলনা ছেলেদের আর কোনটি মেয়েদের জন্যে উপযুক্ত সে ব্যাপারে দৃঢ় সামাজিক মতবাদ ও রীতি রয়েছে। বেশির ভাগ বড়ো দোকানে ছেলেদের আর মেয়েদের খেলনা রাখা থাকে আলাদা জায়গায়, আলাদা তাকে। নিউ ইয়র্কের বিশাল পাঁচতলা খেলনার দোকান, এফ.এ.ও. শোয়ার্টজ-এর প্রতি তলা ছেলে এবং মেয়েদের জন্যে আলাদাভাবে চিহ্নিত। অর্থাৎ দু’জনের খেলনা একেবারে আলাদা। আর ছোটো দোকানে খেলনা কিনতে গেলে দোকানি জিজ্ঞেস করেন, ‘ছেলে না মেয়ে, বয়স কত?’
দেখা যায় লিঙ্গ অনুসারে খেলনার রঙ পর্যন্ত পাল্টে গেছে। ছেলে হলে নীল রঙের খেলনা আর মেয়ে হলে গোলাপি। অন্য রঙ কী দোষ করল কে জানে! আমাদের দেশে এই রঙের প্রভেদ এসেছে পাশ্চাত্য থেকে। তবে পাশ্চাত্যেও শিশুর লিঙ্গ অনুযায়ী নীল-গোলাপির প্রভেদ খুব বেশি দিনের প্রথা নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই এই প্রচলন ছড়িয়েছে। রঙ-বিভেদ বেশি পুরনো না হলেও লিঙ্গ অনুযায়ী পৃথক খেলনার চল কিন্তু ঐতিহাসিক। উপযুক্ত খেলনা হিসেবে মেয়েদের দেওয়া হয় বাড়ির কাজের জিনিসপত্র (রান্নার সরঞ্জাম, নকল খাবার দাবার), নানান ধরণের পুতুল, সাজগোজের উপকরণ (লিপস্টিক, পরচুলো, হাই হিল জুতো, পোশাক-আশাক), কাল্পনিক চরিত্র (পরি, ইউনিকর্ন জাতীয় কাল্পনিক জন্তু), গয়নাগাটি (মুকুট, হার, চুড়ি)। ছেলেদের জন্যে থাকে গাড়ি ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম, যান্ত্রিক খেলনা (এরোপ্লেন, ট্রেন, মেশিনযুক্ত পুতুল), কাল্পনিক চরিত্র (কল্পবিজ্ঞান সম্পর্কীত, সুপার হিরো), বিজ্ঞানজাতীয় খেলা (রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষার উপকরণ, দূরবীন), নির্মাণের উপকরণ (ব্লক, লেগো, মেকানো সেট), ইত্যাদি। ছেলেদের খেলনা হয় যন্ত্র, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সংক্রান্ত আর মেয়েদের খেলনা ঘরগৃহস্থালি নিয়ে – রান্না, শিশু লালন, সৌন্দর্য বাড়ানোর কৌশল শেখা, ইত্যাদি। অর্থাৎ সমাজের মতে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং নারীর যা ভূমিকা হওয়া উচিত, খেলনাগুলো তারই ইঙ্গিত বহন করছে। আর একটা ব্যাপারও লক্ষ্য করার মত। ছেলেদের খেলনা সাধারণত আত্মনির্ভরতা শেখায়, যা মেয়েদের খেলনা এবং খেলায় পাওয়া যায় না। একটা উদাহরণ দিই।
ধরা যাক দুটি ছেলে গাড়ি রেস করছে। দু’জনের ছোট্ট গাড়ি খুব ছুটেছে। কার গাড়ি আগে যায়, কার গাড়ি জেতে! শেষে সমাপ্তি-রেখা প্রথম পার করে একটি গাড়ি জিতল। এই রেসে হারজিত নিয়ে অন্য কারোর মতামতের দরকার নেই। প্রতিযোগিতার ফল নিরপেক্ষ, মীমাংসা আপনা থেকেই হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তের জন্যে খেলোয়াড়দের কারোর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ব্রিজ বা বাড়ি বানানো, ইত্যাদি প্রতিটি খেলনাই মোটামুটিভাবে খেলোয়াড়কে এমনই ধরনের স্বনির্ভরতা শেখায়। এর বিপরীত হল মেয়েদের খেলনা এবং খেলা। খুকু রান্না করছে, সাজছে, পুতুল খেলছে – প্রতিটি ব্যাপারেই অন্যের অনুমোদন দরকার। কাউকে বলতে হবে, ‘বাঃ, খুব ভালো রেঁধেছ,’ বা ‘খুব সুন্দর দেখাচ্ছে,’ বা ‘পুতুল-বেবিকে দারুণ যত্ন করছ।’ অর্থাৎ, মেয়েদের খেলায় বেশির ভাগ সময় প্রয়োজন অন্য কারোর পিঠ চাপড়ানি। মেয়েটিকে অন্যের পরিতুষ্টির ওপর ভরসা করতে হবে।
সাধারণত সকলে বিশ্বাস করেন ছেলেমেয়েরা নিজেদের লিঙ্গ অনুসারে খেলনা বেছে নেয় – এ একটি সহজাত প্রক্রিয়া। এ ব্যাপারে একটা উল্লেখযোগ্য গবেষণার কথা বলি।
১৯৭৪ সালে মার্কিন মনোবৈজ্ঞানিক রুবিন ও তাঁর সহকর্মীরা[i] সদ্যোজাত শিশুর বাবা-মায়ের মনোভাব নিয়ে একটি পরীক্ষা করেন। তাঁদের অনুসন্ধিৎসা, সন্তানের জন্মগত বৈশিষ্ট্য বাবা-মা কী চোখে দেখেন। শিশুর জন্মের পর গবেষকরা বিভিন্ন হাসপাতালে তিরিশটি পরিবার বেছে নিলেন। এদের মধ্যে পনেরোজনের কন্যা ও বাকি পনেরোজনের পুত্রসন্তান জন্মেছিল। তিরিশটি শিশুই ওজন এবং লম্বায় এক, এবং শারীরিক বিকাশের মূল্যায়নে অভিন্ন।[ii] তারপর গবেষকরা বাবা-মাকে তাঁদের সন্তানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে বললেন। দেখা গেল, কন্যার বাবা-মা সন্তানকে বর্ণনা করতে ‘নরম-সরম, শান্ত, হালকা স্বভাবের, কমনীয়, মিষ্টি,’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করছেন, আর পুত্রকে তার বাবা-মা বলছেন, ‘শক্তপোক্ত, জেদি, সজাগ, মতলবি, চটপটে,’ ইত্যাদি। অথচ বৈজ্ঞানিক মতে এই দুই দলের শিশুর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। তার মানে জন্মের পরপরই সমাজের প্রতিভূ বাবা-মা শিশুকে সামাজিক প্রত্যাশা অনুযায়ী বিচার করতে আরম্ভ করেছেন। ১৯৯৫ সালে আর এক দল গবেষক এই একই গবেষণার পুনরাবৃত্তি করে একই ফল পেয়েছেন।[iii] মানে, কুড়ি বছরেও এ ব্যাপারে মার্কিন সমাজ খুব একটা পাল্টায়নি। অতএব ধরে নেওয়া যায়, ছেলে এবং মেয়েদের জন্যে যে খেলনা তাদের পরিবার বেছে নেবে, স্বাভাবিকভাবেই তার ধরন হবে ভিন্ন – সামাজিক প্রথা অনুসারে লিঙ্গ উপযুক্ত।
এই বিষয়ে আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচ মাস বয়সে শিশু খেলনার লিঙ্গ উপযোগিতার প্রতি দৃকপাত করে না। কিন্তু দেড় বছর বয়সের মধ্যে এ ব্যাপারে তার পছন্দ-অপছন্দ গাঢ় হয়ে ওঠে এবং তা পরিষ্কার বোঝা যায়। শিশুর জন্ম থেকে দেড় বছর বয়স অবধি পরিবার তাকে কী ধরনের খেলনা দিয়েছে এবং আশেপাশে সে কী খেলনা দেখেছে তার ওপরেই এই নির্বাচনের পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়। অর্থাৎ শিশুর সরাসরি ও পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা খেলনা সম্পর্কে তার মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে।[iv]
তা হলই বা ছেলে-মেয়েদের খেলনা ও খেলায় লিঙ্গ প্রভেদ – তাতে কী আসে যায়! এতো হই চই করার দরকার কী? দরকার আছে। শিশুর বিকাশ নিয়ে যে বৈজ্ঞানিকেরা মাথা ঘামান, তাঁদের মতে এই লিঙ্গ বিভেদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ছেলেরা যে ধরনের খেলনা নিয়ে খেলে, তাতে তারা স্থান-সম্পর্ক (spatial relations) খুব সহজে শেখে। এর ফলে যুক্তিবিদ্যা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, নির্মাণবিদ্যার সঙ্গে অল্পবয়সেই তাদের পরিচিতি হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ছেলেরা পায় সামাজিক অনুপ্রেরণা ও অনুমোদন। মেয়েরা পড়ে পিছিয়ে। আবার যে ছেলেরা সমাজের ছকে বেঁধে দেওয়া গণ্ডীর মধ্যে না থেকে সাহিত্য ও শিল্পকলা (মেয়েদের জন্যে বাঁধা শিক্ষা) নিয়ে আগ্রহী হয়, তাদের কপালেও জোটে সামাজিক অনুকম্পা। মেয়েরা যে এই সব বিষয় শিখতে পারে না তা নয়, তবে তা শেখে দেরিতে, বহু সামাজিক অনুশাসন ভেঙে। কাজের জগতে এই বৈষম্য মেয়েদের খুবই ক্ষতি করে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকশক্তির প্রায় ৪৮ শতাংশ হল নারী, কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং অঙ্ক (STEM) বিষয়ক জীবিকায় তাদের উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ।[v] ভারতে মহিলা STEM স্নাতকের সংখ্যা পৃথিবীর সর্বাধিক (৪৩ শতাংশ) হলেও কর্মক্ষেত্রে তার প্রতিফলন পড়ে না। ভারতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ও অঙ্ক (STEM) বিষয়ক কাজে নিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন মাত্র ১৪ শতাংশ মহিলা।[vi] আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে মেয়েরা পিছিয়ে পড়েছেন। ২০১৫ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতকের মাত্র ১৮% হল মহিলা।[vii] ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে তথ্য প্রযুক্তি কর্মীদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ নারী।[viii]
তবে কি ছেলে এবং মেয়েদের খেলা এবং খেলনা এক হলেই এই অবস্থার উন্নতি হবে? আসলে মেয়েরা যে ছেলেদের মত হই-হুল্লোড় করে খেলাধুলো করবে বা যান্ত্রিক খেলনা নিয়ে খেলবে, তা অনেকেই পছন্দ করেন না। সক্রিয়, জোরদার খেলাধুলোকে ঠিক ‘নারীসুলভ’ ভাবা হয় না। তাই বহু দেশে ছেলেদের স্কুলে খেলার ভালো ব্যবস্থা থাকলেও মেয়েদের স্কুলে সেই ব্যবস্থা নামমাত্র রয়েছে বা একেবারেই নেই। অনেক সময়ই মেয়েদের স্কুলে খেলার জন্যে বিশেষ টাকাপয়সা বরাদ্দ করা হয় না, ফলে খেলার সরঞ্জাম কেনা যায় না। যে স্কুলে ছেলে-মেয়ে দু’জনেই পড়ে (কো-এডুকেশানাল) সেখানেও এর অন্যথা হয় না। পড়াশুনা একসঙ্গে হলেও খেলার সময় দু’দলকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে খেলা অনুচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই ব্যবস্থা ছিল এবং তা নিয়ে প্রচুর বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ হয়েছে। ১৯৭২ সালে মার্কিন সরকার খেলায় লিঙ্গ সমতা আনতে ‘টাইটেল ৯’ নামে একটি আইন পাশ করে। এই আইনানুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের জন্যে খেলার ব্যবস্থা সমতুল হতে হবে, দু’দলকে একই সুযোগ সুবিধে দিতে হবে। এই আইনের দৌলতে আমেরিকার খেলার জগতে এখন অনেক বেশি মেয়েরা প্রবেশ করেছে এবং পেশাদারী হিসেবে খেলছে। আগে যেখানে মাত্র ৪ শতাংশ মেয়েরা খেলাধুলোয় যোগ দিত, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪০ শতাংশ। তাছাড়া সব বাধাবিপত্তি সরিয়ে আজকাল অনেক দলেই ছেলেমেয়েরা একই টিমে সহযোগী হয়ে খেলছে।
ভারতে খেলার ইতিহাস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত। দেখা যায় উনবিংশ শতকের শেষে, ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে প্রশিক্ষিত বিত্তবান পরিবারের মহিলারা ঘোড়ায় চড়া, স্কি, টেনিস, গল্ফ, তির-ধনুক চালানো, ইত্যাদি খেলায় যোগ দিতেন। খোলাখুলি প্রতিযোগিতায় নাম না লেখালেও, খেলার মাধ্যমে ভারতীয় নারী ব্রিটিশ অধিবাসীদের কিছুটা কাছাকাছি পৌঁছতে পারতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সমাজে চিরাচরিত লিঙ্গ অসাম্যের ফলে সব শ্রেণির মেয়েরা খেলায় যোগ দিতে অপারগ ছিলেন। একে তো টাকাপয়সার অভাব, তার ওপর বৈষম্যমূলক মনোভাব মেয়েদের খেলার জগতে ঢুকতে দেয়নি। তাও কি কিছু মেয়ে এই সব বাধা ডিঙোয়নি? অবশ্যই! বহু মহিলাই নিজের অধ্যবসায়ে খেলার জগতে সাফল্য অর্জন করেছেন – অনেকেই প্রতিযোগিতামূলক খেলায় খ্যাতি পেয়েছেন। আজকের মহিলা খেলোয়াড়দের মধ্যে বিখ্যাত হয়েছেন প্রণতি নায়েক, পিঙ্কি প্রামাণিক, বুলা চৌধুরী, হিমশ্রী রায়, মেরি কোম, সানিয়া মির্জা, পি.ভি. সিন্ধু, সাইনা নেহওয়াল, ভারতের ক্রিকেট এবং হকি টিম, প্রমুখ আরও অনেকে।
খেলা যে মেয়েদের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে তাতে সন্দেহ নেই। নিয়মিত খেলার ফলে শরীর সুঠাম হয়, আত্মপ্রত্যয় বাড়ে, এমনকি পড়াশোনায় মনঃসংযোগ বেশি হয়। দল গড়ে খেললে খেলোয়াড়রা জয়ের কৌশল শেখে আর অন্যের সঙ্গে সহযোগিতায় দক্ষ হয়ে ওঠে। ভারতে অনেক সংস্থাই এখন মেয়েদের মধ্যে খেলার প্রচলন আনার চেষ্টা করছেন। এমনই এক ক্রীড়া সংগঠনের কথা বলি।
২০১৭ সালে গ্রামে স্বাস্থ্য পরিষেবা বণ্টনের কাজে ব্যস্ত দুই ভাই, শিবশঙ্কর ও হরিশঙ্কর দাশগুপ্ত, স্থির করলেন শুধু পরিষেবা দিয়ে গ্রামীণ মহিলাদের পরিস্থিতি পরিবর্তন করা যাবে না। তাঁদের স্বনির্ভর, স্বাবলম্বী, ও প্রত্যয়শীল করে তুলতে প্রয়োজন শারীরিক শক্তি ও কাজে দক্ষতা বাড়ানো। দুই ভাই-ই ভালো খেলতেন, তাই তাঁরা ভাবলেন অল্পবয়স থেকে মেয়েদের ফুটবল খেলতে শিখিয়ে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা যেতে পারে। সৃষ্টি হল ‘সৃজা ইন্ডিয়া।’[ix] প্রথম দিনেই প্রকল্পে নাম লেখাল পঞ্চাশ জন কিশোরী। ইদানীং বীরভূমের গ্রামবাসী, আদিবাসী মেয়েদের নিয়মিত ফুটবল খেলতে এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে সৃজা উদ্বুদ্ধ করছে। সেই সঙ্গে অংশগ্রহণকারী মেয়েরা স্কুলে পড়াশোনা করছে, বাড়িতে সবজির চাষ করছে, শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিখছে। সৃজার মেয়েরা ‘খেলো ইন্ডিয়া’য় প্রতিনিধিত্ব করেছে, বিভিন্ন সংগঠন থেকে মানপত্র পেয়েছে, নিজেদের গ্রামে বিভিন্ন ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একটি গ্রাম থেকে সৃজা এখন বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অংশগ্রহণকারী কিশোরীর সংখ্যাও বেড়েছে অনেক।
খেলার জগতে মেয়েরা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়, এবং তারা পরিবার বা সমাজের কাছ থেকে সবসময় অনুমতি বা উৎসাহ পায় না। সে বাধা অতিক্রম করে খেলায় অংশগ্রহণ করলেও তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পায় না, প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার সুযোগ পায় না, খেলার সরঞ্জাম পায় না, পুষ্টি পায় না। এত সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পেশাদারী দলে যোগ দেবার পরেও দেখা যায় মহিলা খেলোয়াড়ের পারিশ্রমিক সমপর্যায়ের পুরুষ খেলোয়াড়ের অর্ধেক বা তারও কম। ভারতের সফল মহিলা ও পুরুষ ক্রিকেট টিমের উপার্জন তুলনা করলে কথাটা সহজেই বোঝা যায়। এছাড়াও পার্থক্য থেকে যায় সামাজিক সম্মান ও জনপ্রিয়তায়। আরও দেখি, সক্রিয় থাকাকালীন বা অবসর নেবার পর, সাধারণত কোনো না কোনো সংগঠন বা ব্যবসায় পুরুষ খেলোয়াড়দের সাদরে ডেকে চাকরি দেয়। মহিলাদের বেলায় তা ঘটে না। সুতরাং সারা জীবন তাঁরা পর্যাপ্ত আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়াও ক্রীড়াজগতে সক্রিয় থাকাকালীন মহিলা খেলোয়াড়দের নানান কুৎসা, নিপীড়ন, ও বৈষম্যের মধ্যে তালিম নিতে এবং সফলতা পেতে হয়। এত অন্তরায় ঠেলে সরিয়ে মেয়েরা যে খেলার জগতে উৎকর্ষতা অর্জন করতে সচেষ্ট, তা খেলার প্রতি তাঁদের একনিষ্ঠতারই প্রমাণ!
*****
[i] Rubin, J. Z., Provenzano, F. J., & Luria, Z. (1974). The eye of the beholder: Parents’ views on sex of newborns. American Journal of Orthopsychiatry, 44, 512–519.
[ii] এই মূল্যায়ন করা হয় APGAR পরীক্ষা দিয়ে। আমেরিকা ও ইয়োরোপের হাসপাতালে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতকের স্নায়ু, পেশি, স্পন্দন, ও সক্রিয়তার মাত্রা নির্ধারণ করে অ্যাপগার স্কোর (০-১০) দেওয়া হয়। এতে শিশু কতটা সুস্থ্ তা বিচার করা যায়।
[iii] Karraker, K. H., Vogel, D. A., & Lake, M. A. (1995). Parents’ gender-stereotyped perceptions of newborns: The eye of the beloder revisited. Sex Roles, 33, 687-701.
[iv] Boe, J. L., & Woods, R. J. (2018). Parents’ influence on infants’ gender-typed toy preferences. Sex Roles, 79, 358-373.
[v] United States Census Bureau. Available at: https://www.census.gov/library/stories/2021/01/women-making-gains-in-stem-occupations-but-still-underrepresented.html
[vi] Agrawal, S. (2021, July 23). ‘Women in STEM: The growing numbers, challenges and whether it translates into jobs.’ The Print. Available at: https://theprint.in/india/education/women-in-stem-the-growing-numbers-challenges-and-whether-it-translates-into-jobs/700564/
[vii] Needle, D. (2021, July 2). ‘Women in tech statistics: Latest research and trends.’ WhatIs.com. Available at: https://whatis.techtarget.com/feature/Women-in-tech-statistics-The-latest-research-and-trends
[viii] Forbes India. (2021, March 8). ‘Women in technology.’ Available at: https://www.forbesindia.com/article/brand-connect/women-in-technology/66853/1#:~:text=As%20per%20the%20Zinnov%2DIntel,representation%20in%20non%2Dtechnical%20roles
[ix] https://www.shreeja.org/index.php