প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২২)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩)
(২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

বদরিনাথ

২৯ মে, শুক্রবার। কাঠের একটা সাঁকো দিয়ে অলকানন্দা পার হয়ে ধীরে ধীরে বদরিনাথে প্রবেশ করলুম। আঘাতের পর প্রতিঘাত স্বাভাবিক নিয়ম। বদরিনাথের পথে যখন চলছিলুম, তখনকার সেই উৎসাহ, আগ্রহ; মনের ভয়ানক আবেগ, অভীষ্ট স্থানে এনে সে সমস্তই যেন সংযত হয়ে গেল। এই রকমই হয়ে থাকে।
পথে যখন অবিশ্রান্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে, তখন মনে হয়েছিল এই নিদারুণ যুদ্ধের অবসানে এমন একটা কর্মশীলতার মধ্যে গিয়ে পড়বো, যেখানে পূজার্চনার অবিরাম কলরবে, মানব হৃদয়ের সুখদুঃখ ও হর্ষের বিপুল উচ্ছ্বাসে এক সুগভীর কল্লোল উত্থিত হচ্ছে। নদীর জলপ্রবাহ সমুদ্রের ফেনিল ঊর্মিরাশির নির্বোধ নৃত্যের মধ্যে মিশে গিয়ে যেমন হারিয়ে যায়, সেরূপ হিন্দুর মহাতীর্থে, নারায়ণের পুণ্য পীঠতলে, দেবমহিমার এক অনন্ত প্রশান্তির মধ্যে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের ব্যাকুল-বাসনা ও অশ্রান্ত উদ্বেগও সমাহিত হবে। কিন্তু এখানে পৌঁছে কেমন নিরাশ হয়ে পড়লুম।

বদরিনাথে প্রথম প্রবেশ করেই চারিদিকে একটা নিরুদ্যম, একটা উদাসীন ভাব চোখের সম্মুখে পড়লো। মনে হলো, এ উদাসীনতা বুঝি হিন্দুধর্মের মর্মে মর্মে বিজড়িত। তীর্থযাত্রীদের উদ্যম উৎসাহে কি হবে, একটা অলস কর্মহীনতা তীর্থস্থানে যেন চিরস্থায়ী রকমের আড্ডা বেঁধেছে। অলকানন্দা অতি নিরুদ্বেগে মন্থর গমনে বরফরাশির নীচ দিয়ে চলে যাচ্ছে; শহরের অধিকাংশ ঘরবাড়ি এখন পর্যন্তও বরফের তলায় পড়ে আছে। যে কয়খানা ঘর দেখা যাচ্ছে, তাদের অবস্থাও অতি শোচনীয়; তাহা কতক বরফের প্রসাদাৎ, আর কতক আমাদের পূর্বাগত সন্ন্যাসী মহাশয়দের কৃপায়, আর কতকগুলি ঘর এই তিন বৎসরকাল ধরে বন্ধ থাকাবশত নষ্ট হয়ে গেছে; বিশেষ সন্ন্যাসী মহাশয়েরা ক্ষতি করেছেন কিছু বেশি। ঘরের দরজা-জানালাগুলি বেবাক অন্তর্হিত হয়েছে। অবশ্য সেগুলি যে সশরীরে স্বর্গে গিয়েছে, তা নয়; যে সকল সন্ন্যাসী সর্বপ্রথমে এখানে এসেছিলেন, তাঁরা দেখেছিলেন তখনও হাট বাজার বসেনি সুতরাং জ্বালানি কাঠ পাওয়া অসম্ভব; তাই আপনাদিগকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য এই সমস্ত জানালা দরজা ব্রহ্মাকে উপহার দিয়েছেন, এবং তীর্থস্থানে এসে পরের জিনিসপত্র নাশ করে "আত্মানং সততং রক্ষেৎ" এই মহানীতি-বাক্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার জন্যে তাঁদের মহৎ হৃদয় যে কিরূপ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল-এই সমস্ত জানালা দরজার অভাব তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কিন্তু পরে যে সকল যাত্রী আসবে, তারা এই বরফ-রাজ্যে এসে এদের অভাবে যে কত কষ্ট পাবে এ কথা চিন্তা করবার বোধ করি তাঁদের অবসর হয় নি।

পুরপ্রবেশ করার আগে যে সকল পাণ্ডা আমাকে পেয়ে বসেছিল, তাদের হাত থেকে যে রকম ভাবে অব্যাহতি পেলুম, সে কথা পূর্বেই লিখেছি। বদরিনারায়ণে এসে কোথায় উঠবো তা লছমীনারায়ণ আমাদের দেবপ্রয়াগেই বলে দিয়েছিল। যাঁর শ্রী হস্তলিখিত সেই ঠিকানা এখনও আমার ডায়ারি বইয়ে আছে; তা এই - "কূর্মধারিকি উপর মোকাম, লছমীনারায়ণ পাণ্ডা, বেণিপ্রসাদ রামনাথকী চাচী।" - প্রথম কথাগুলির অর্থ বুঝেছিলুম যে কূর্মধারার উপরে লছমীনারায়ণ পাণ্ডার বাড়ি, আর সেখানে বেণিপ্রসাদ আছেন। তা সে বেণিপ্রসাদ মানুষই হোন আর লছমীনারায়ণের গৃহবিগ্রহই হোন। কিন্তু শেষের দিকটার অর্থ নিতান্ত হেঁয়ালির মত বোধ হওয়াতে সে অর্থ নিষ্কাশনে অসমর্থ হয়ে তখনই লছমীনারায়ণকে সে কথা জিজ্ঞাসা করেছিলুম; কিন্তু কি কারণে জানিনে, উক্ত পাণ্ডা শ্রেষ্ঠ ঐ কথা কয়টির অর্থ সম্বন্ধে আমাকে সজ্ঞান কারানোর আবশ্যকতা মোটেই অনুভব করে নি। আমার কৌতূহল প্রবৃত্তির আগ্রহাতিশয্য দেখে উপরন্তু বলেছিলেন, "বস্ উয়ো বাৎ বোলনেসেই ডেরা মালুম হোগা" - সুতরাং কথাটা আর মোটেই বোঝা হয় নি। কিন্তু এখনও মনে পড়ে সেদিন সমস্ত অপরাহ্নটা এই কথার অর্থনির্ণয়ের জন্যে বৈদান্তিক ভায়ার সঙ্গে কিরূপ অনর্থক বাক্যব্যায় করতে হয়েছিল। বৈদান্তিক শুধু তার্কিক নন, একজন ভারি সুরসিক ও সমজদার লোক; তাই তাঁর প্রথমেই সন্দেহ হলো এই বেণিপ্রসাদ লোকটা লছমীনারায়ণের হয় শ্যালক, না হয় ভগিনীপতি। সম্বন্ধটা কিছু মধুরসাত্মক বলেই পাণ্ডার পো আমাদের কাছে তার মর্মভেদ করা বাহুল্য জ্ঞান করেছিল। যা হোক বৈদান্তিক শুধু এই অনুমানের উপর নির্ভর করে ক্ষান্ত হলেন না, এবং আমিও এই অনুমানের বিরুদ্ধে কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করেছিলুম, সুতরাং তিনি কথাটার ধাতু ও শব্দগত অর্থ বের করবার জন্য প্রস্তুত হলেন। গভীর গবেষণা ও প্রচুর চিন্তার পর শেষে তিনি এই স্থির করলেন যে, সেখানে বেণিপ্রসাদ আছে এবং রামনাথের খুড়ি আছেন, কেন না "চাচী" শব্দের অর্থ খুড়ি ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না; কাজেই "রামনাথকি চাচী" এক সম্পূর্ণ পৃথক ব্যক্তি। তবে স্ত্রীলোকের নাম ধরে আড্ডা খুঁজতে হবে, এই যা মনের মধ্যে একটা খটকা লেগে রইল। বৈদান্তিক বলে বসলেন, জায়গায় জায়গায় অমনতর দুই একটা স্ত্রীলোক থাকে, পুরুষের চেয়ে তাদের খ্যাতি অনেক জেয়াদা। বলা বাহুল্য স্বয়ং লছমীনারায়ণ আমাদের সঙ্গে আসতে পারে নি, কারণ সে আরও কয়েকদিন দেবপ্রয়াগে না থাকলে অনেক নূতন যাত্রী তার বেদখল হয়ে যাবে, তার এই ভয় ছিল;তবে সে আমাদের ভরসা দিয়েছিল যে শীঘ্রই সে আমাদের সঙ্গে এসে মিশবে। যা হোক বদরিনাথে এসে সেই "রামনাথকি চাচী"Y অনুসন্ধানে বেশি নিগ্রহ ভোগ করতে হয় নি; সকল পাণ্ডাই তীর্থের কাকের মত রাস্তায় বসে থাকে; যখন তারা শুনলো যে আমরা লছমীনারায়ণের লোক, তখন তাদের মধ্যে একজন এসে নিজেকে বেণিপ্রসাদ বলে পরিচয় দিলে। বেণিপ্রসাদের আকার প্রকার কি রকম তা আমরা কেউই জানতুম না, সুতরাং কলিকাতা, কালীঘাট, কি ঐ প্রকার কোন স্থানে হলে স্বঃতই সন্দেহ হতো যে, হয়ত বা একটা জাল বেণিপ্রসাদ এসে আমাদের স্কন্ধে ভর করেছে এবং গোলযোগের মধ্যে যখন আসল বেণিপ্রসাদটা বেরিয়ে পড়বে তখন আমাদের এক বিষম মুশকিলে পড়তে হবে। কিন্তু বদরিনাথের মত স্থানের এখনও অতটা অধঃপতন হয় নি ! সুতরাং ঐ লোকটা বেণিপ্রসাদ বলে পরিচয় দেবামাত্র আমরা অসংকোচে তার সঙ্গে চলতে লাগলুম।

কিন্তু বেণিপ্রসাদ বেচারিও আমাদের নিয়ে মহা বিপদে পড়লো। তাদের ঘরবাড়ি এখনও বরফে ঢাকা, আরও পনেরো ষোলো দিন না গেলে তারা বরফস্তূপের মধ্যে হতে প্রকাশ হচ্ছে না। বেণিপ্রসাদ নিজে অন্য লোকের একটা কুটির দখল করে বাস করছে; সুতরাং এ রকম অবস্থায় সে আমাদের কোথায় রাখে, এই ভাবনাতে অস্থির হযে পড়লো। যা হোক, শেষে সে পাহাড়ের উপর আর একজনের একটা ঘরে আমাদের আড্ডা স্থির করে দিলে। এই ঘর যার সে তখনও এখানে এসে পৌঁছে নি; আমাদের আশঙ্কা হতে লাগলো, ঘরওয়ালা হঠাৎ এসে আমাদের প্রতি অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা না করে, কারণ, এরা বিলক্ষণ অতিথিপরায়ণ হলেও অতিথিসেবার পুণ্যটুকু তাদের জন্যে রেখে অন্য লোকে যে তার অর্থগত উপস্বত্বটুকু ভোগ করবে, এদের পক্ষে তা অসহ্য। কিন্তু অনর্থক উদ্বিগ্ন হওয়াতে কোন লাভ নেই, ভেবে আমরা সেই ঘরেই আড্ডা গাড়বার জোগাড় করে নিলুম। ঘরটি বেশ লম্বা চওড়া বটে, কিন্তু তার আভ্যন্তরিক অবস্থা অতি শোচনীয়, দ্বারগুলি পূর্বাগত সন্ন্যাসীদের অগ্নিসেবায় লেগেছে। রাত্রে দুর্জয় শীত আসছে; তখন এই ঘরে কি করে তিষ্ঠানো যাবে, এখন এই চিন্তাতেই আমরা সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লুম। সন্ধ্যা হতেও আর বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যার সময় একবার নারায়ণ দর্শনে যাব - ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শুনলুম অপরাহ্নেই নারায়ণের দ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সুতরাং রাত্রিযাপনের জন্যে আগুনের জোগাড়ে প্রবৃত্ত হওয়া গেল। সন্ধ্যার পূর্ব হতেই বড় শীত বোধ হতে লাগলো এবং সর্ব শরীর পুরু কম্বলে ঢাকা থাকা সত্বেও শীতে সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে এল। শুনেছি মহাকবি কালিদাসকে কে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল "মাঘে শীত না মেঘে শীত ?" - তার উত্তরে কবিবর নাকি বলেছিলেন, "্যত্র বায়ু তত্র শীত।" তখন বদরিকাশ্রম দর্শন করতে এলে কালিদাস তাঁর এই উত্তরের অসারতা বুঝে নিশ্চয়ই লজ্জিত হতেন। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ে বায়ু প্রবাহশূণ্য স্থানেও যে রকম তীর্থযাত্রী এ সকল স্থানে আসে , তাহারাই তা মর্মে মর্মে অনুভব করে। তবু ত মে মাস, মাঘমাসে প্রবল শীত অনুভব করবার শক্তি মানুষের নাই। আমরা বহু কষ্টে কাষ্ঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বাললুম এবং তার পাশেই শয্যারচনা করা গেল। সে রাত্রে কিছুই আহার হল না।

হিমালয় পর্বতের মধ্যে এতদূরে জনমানবশূণ্য চিরতুষাররাশির ভিতরে এতখানি সমতলভূমি দেখলে প্রাণে বড়ই আনন্দ বোধ হয়। হরিদ্বার থেকে যাত্রা করে এতদূর এসেছি, এর মধ্যে যা কিছু অল্প সমতল জমি দেখেছি তা শ্রীনগরে ভিন্ন সমস্ত জায়গাই "কুব্জপৃষ্ঠ ন্যুব্জদেহ" অষ্টাবক্রবিশেষ। হরিদ্বার হতে বদরিকাশ্রম দুই শত মাইলেরও বেশি। একে তো হিমালয় প্রদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য বড় গম্ভীর; এ গাম্ভীর্যের সহিত স্বঃতই সাগরের গাম্ভীর্য তুলনা করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু এই দুই জিনিসের মধ্যে আশ্চর্য রকমের তফাৎ। একটি মহা ডvচ্চ, অসমান, সুদীর্ঘ শ্যামল বৃক্ষশ্রণীর চিরন্তনের বাসভূমি - আর একটি সুগভীর নীলিমায় সমাচ্ছন্ন, তবু এ দুইয়ের মধ্যে কেন যে তুলনার কথা মনে আসে, তা ঠিক বলা যায় না; বোধ করি, এই উভয়কে দেখেই আর একজনের কথা মনে পড়ে; এই মহান সৌন্দর্যের মধ্যে বিশ্বপিতার মহিমা ব্যাপ্ত আছে, তাই একটি দেখে আর একটির কথা মনে উদয় হয়। হিমালয়ের একেই ত গম্ভীর দৃশ্য তার উপর বদরিকাশ্রমের দৃশ্যটা আরও গম্ভীর। দুই দিকে দুইটা পর্বত একেবারে আকাশ ভেদ করে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের স্তব্ধ ছায়া বদরিকাশ্রমকে ঢেকে ফেলেছে। পাণ্ডাদের মুখে শুনলুম, এই দুইটি পর্বতের একটির নাম 'নর'অপরটির নাম 'নারায়ণ'। আরো শুনলুম এই পর্বতদ্বয়ের অঙ্গ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। শাস্ত্রে না কি লেখা আছে, ক্রমে এরা বর্ধিত কলেবর হয়ে নারায়ণের মন্দির ঢেকে ফেলবে সুতরাং বদরিকাশ্রম তীর্থ চিরদিনের মত হিমালয়ের পাষাণ-বক্ষে লুকিয়ে যাবে। তবে পাণ্ডারা এই ভরসা করে যে দুই চারিশত বছরের মধ্যে সে রকমের দুর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই; কাজেই আশু দরিদ্রতার আক্রমণ সম্বন্ধে তারা নিরাপদ; তবে তাদের ভবিষ্যদ্বংশীয়দের যথেষ্ট আশঙ্কা রইল বটে।

যে উপত্যকার উপর বদরিকাশ্রম প্রতিষ্ঠিত, তা অতি সুন্দর। শুধু ভক্তের নয়, কবিরও এখানে উপভোগের যথেষ্ট সামগ্রী আছে। এই পুণ্যভূমি ভেদ করে অলকানন্দা প্রবাহিত হচ্ছে; কিন্তু বছরের বেশি সময়েই তা বরফে আচ্ছন্ন থাকে, এখনও ইহা বরফে ঢাকা। আরও কিছুদিন পরে বরফ গলে তার ললিত তরল স্রোতে ভেসে যাবে ! সে দৃশ্য ভারি সুন্দর।

বদরিকাশ্রম উত্তর দক্ষিণে লম্বা; দীর্ঘ বোধ হয় ৪০০ ফিটের বেশি নয়, কিন্তু অসমান পাহাড়ের মধ্যে এই স্থানটুকু খুব দীর্ঘ বলে বোধ হয়। দীর্ঘে এতখানি হলেও প্রস্থে বেশি নয়, আরও দেখলুম প্রস্থদেশ খানিকটা ঢালু, কিন্তু বিশেষ মনযোগ দিয়ে দেখলে তবেই তা বুঝতে পারা যায়, নহিলে সহসা বোধগম্য হয় না। দূরের পর্বত হতে অনেকগুলি ঝর্না বের হয়ে অলকানন্দায় পড়েছে এবং নদীর বরফ ভেদ করে সেই জল ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। উপরে যে কূর্ম-ধারার কথা বলেছি, তা এই বদরিনাথের বাজারের মধ্য দিয়ে নেমে নদীতে পড়েছে। এই ঝরনাতে বাজারের লোকের যথেষ্ট উপকার হয়। কূর্মধারা ছাড়া বাজারের পাশেই আর একটা ঝরনা আছে। বাজারে যে কতগুলি দোকান আছে, প্রথম দৃষ্টিতে তা ঠিক বুঝতে পারলুম না; এখনও অনেকগুলি দোকান বরফের নীচে সুপ্তাবস্থায় লুপ্ত আছে, কিন্তু সমস্ত ঘর বাড়ির একটা সঠিক ধারণা না হলেও বোধ হলো পাণ্ডাদের বাসস্থান ও দোকান সবশুদ্ধ ত্রিশ পঁয়ত্রিশখানা ঘরের বেশি হবে না। বাজারে দরকারি জিনিসপত্র সকলই পাওয়া যায়; তবে দরকার অর্থে যদি কেহ অনুমান করে থাকেন জুতা, ছাতা, সাবান, পমেটম ইত্যাদি শৌখিন রকমের জিনিসপত্র সব পাওয়া যায়, তবে আমি কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। পাহাড়ের মধ্যে এসে অনাবশ্যক বহুবিধ দরকারি জিনিসের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম; আবশ্যক বোধ হতো আটা, ভাল ঘি, লবণ লংকা, আর কাঠ। আর বাঙালি মানুষ অনেকদিন উপরি উপরি ডাল রুটির শ্রাদ্ধ করতে করতে এক এক দিন চাট্টি ভাতের জন্য প্রাণ আকুল হয়ে উঠতো, সুতরাং মধ্যে মধ্যে চাউলের খোঁজও না হতো এমন নয়। তার উপর যে দিন বড়ই নবাবি করার প্রবৃত্তি হতো, সেদিন গোটা দুই চারি 'পেড়া'Y (সন্দেশ) আয়োজন করা যেত; কিন্তু এ রকম দুঃসাহস প্রকাশ করতে প্রায়ই ভরসা হতো না - কারণ, সে সকল সন্দেশের জন্মদিন ঠিক করতে হলে বহুদর্শী প্রত্নবিৎ পণ্ডিতকে যত্নপূর্বক ইতিহাস অনুসন্ধান করতে হয়; কত কীটই যে তার মধ্যে বাসা বেঁধে বংশানুক্রমে বাস করছে তার ঠিক নেই। এখানে যে কয়খানা দোকান আছে, তার সকলগুলিতে কিছু না কিছু খাদ্যদ্রব্যের জোগাড় থাকে, আর প্রত্যহ ছাগলের পিঠে বোঝাই দিয়ে অনেক জিনিসের আমদানিও হয়। আমাদের দেশে যেমন গাড়ি কি বলদ বা ঘোড়ার উপর জিনিসপত্র চাপিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, এ দেশে সে রকম হবার জো নেই। পাহাড়ে ঘোড়াই হোক আর বলদই হোক, এই সকল দুর্গম পথে তারা বোঝা বইতে সম্পূর্ণ অশক্ত। একে পথ দুরারোহ, তার উপর এত সংকীর্ণ যে, বৃহৎকায় পশু সে সকল পথে চলাফেরা করতে পারে না; আর যদি বা তা সম্ভব হয় ত শীঘ্রই তারা হাঁপিয়ে পড়ে। ক্ষুদ্রকায় কষ্টসহ ছাগলজাতিই এ পথের একমাত্র অবলম্বন; এবং তাদের উপরই এ দেেশর লোকের জীবন নির্ভর করছে। বাংলাদেশে যখন ছিলুম, তখন জানতুম, মা দুর্গার কাছে বলি দেওয়া ছাড়া ছাগলের ছাগজন্ম সার্থকের আর কোন পথ নাই, এমন কি ছাগমাংসে উদর পরিতৃপ্তির আশায় মুগ্ধ গুপ্ত কবি লিখে গিয়েছেন, "যেমন পাঁঠার নাম যে রেখেছে বোকা, শুধু সেই বোকা নয়, তার ঝাড়ে বংশে বোকা।" উদর-পরায়ণতার বশবর্তী হয়েই তিনি রহস্যপূর্বক মানবসন্তানকে লক্ষ্য করে উক্তপ্রকার মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। এতদ্ভিন্ন কবিরাজ মহাশয়ের বৃহৎ ছাগলাদ্য ঘৃত সেবনে দেহ পুষ্ট এবং ছাগলদুগ্ধ পানে উদরাময় নিরাকৃত হয়, এরূপও শুনা গিয়েছে। এই জন্যই আমাদের দেশে ছাগবংশের প্রতি যা কিছু কৃতজ্ঞতা; কিন্তু এই বরফরাজ্যে এসে দেখি ছাগলের দ্বারাই এখানে রেলওয়ের কাজ চলছে এবং ছাগলই এ দেশের সুখসমৃদ্ধির কারণ হয়ে রয়েছে। প্রতিদিন কত ছাগলের পিঠে কত জিনিস চাপিয়ে পাহাড় হতে পাহাড়ান্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; কিন্তু কোনোদিনও তাদের পদস্খলণের কথা শুনতে পাওয়া যায় নি। তবে এরা যেমন ছোট জানোয়ার, তেমনি অল্প বোঝা বয়। ছাগলের পিঠে দশ সেরের বেশি বোঝা চাপাতে দেখি নি, কিন্তু তার চেয়েও ভারি বোঝা বইতে পারে। বোধ হয় অনেকদূর চলতে হয় বলে বোঝা লঘু করা হয়। আর যখন দলে দলে ছাগল এই কাজে লাগান হয়, তখন বোঝা ছোট হওয়াতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না, বরং বেশি বোঝা দিলে যদি কোন ছাগল পথের মধ্যে অক্ষম হয়ে পড়ে ত বিপদের কথা। এই সকল ছাগল যে শুধু এই তীর্থস্থানের ও হিমালয় প্রদেশের লোকের খোরাক বয় এমন নয়, ভোট ও তিব্বতের লোকেরাও লবণ প্রভৃতি তাদের দুষ্প্রাপ্য জিনিস কেনবার জন্যে দলে দলে ছাগল নিয়ে আসে। চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং আষাঢ়ের কয়েকদিন পর্যন্ত প্রতিদিন দলে দলে লম্বকর্ণ বৃহদাকৃতি ছাগল যাতায়াত করে। তারপর যখন বর্ষা নামে, তখন স্থানে স্থানে বেগবতী ঝরনা সকল হতে অবিশ্রাম জল ঝরতে থাকে; পথও দারুণ পিচ্ছিল হয়। তখন চলাচল এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠে। তারপর শীতকাল - তখন ত বরফে রাস্তাঘাট একেবারে বন্ধ হযে যায়, সুতরাং যা কিছু কেনা-বেচা তা এই কয় মাসের মধ্যেই শেষ করে নিতে হয়।

বদরিনাথে একটি মন্দির আছে। মন্দিরটি দেখতে তত পুরাতন বলে বোধ হয় না; তবে অল্পদিনের তাও নয়। মন্দিরের বাহিরে চারিপাশে সামান্য একটা উঠান। এই উঠানের চারিদিকের একটা একমহল ছোট চক, তাতে অনেক ছোট দেবতার অধিষ্ঠান আছে। নারায়ণের সঙ্গে এই সকল দেবতার কোন পার্থিব সম্বন্ধ নেই, এইগুলি পাণ্ডাঠাকুরদের রোজগারের অবলম্বন মাত্র। নারায়ণের প্রাঙ্গণে যখন এদের স্থান হয়েছে তখন এঁরা মাহাত্ম্য অংশে নিতান্ত খাটো নয়, এই হেতুবাদে পয়সাওয়ালা অনেক যাত্রী এই সকল বিগ্রহের মাথায় দুই এক পয়সা চড়ায় (অর্থাৎ প্রণামি দেয়)। মন্দির-প্রাঙ্গণে প্রবেশ করবার একটা দ্বার আছে, তার কপাট অতি প্রকাণ্ড। মন্দিরটি আমাদের দেশের মন্দিরের মতই। মন্দিরের গায়ে বিশেষ কোন কারুকার্য দেখলুম না; আমাদের দেশের সাধারণ মন্দিরগুলি যে রকম বৈচির্ত্য-বিহীন, এও তাই ; তবে দেবমাহাত্ম্যেই এর মাহাত্ম্য এত বেশি। উঁচুতে কালিঘাটের মন্দিরের চেয়েও খাটো বলে বোধ হলো; মতবে এটি আগাগোড়া পাথরের গাঁথা, এ পাথরের রাজ্যে পাথরের উপর যে মন্দির নির্মিত, তার পক্ষে এটা কিছু আশ্চর্য কথা নয়, বরং ইষ্টকনির্মিত হলেই একটু আশ্চর্য হবার কারণ থাকতো। এদিকে যতগুলি মন্দির দেখলুম সবগুলিই পাথরে গাঁথা।

মন্দিরটি জীর্ণ হয়েছে; কিন্তু আগেই বলেছি বাহ্যদৃশ্যে তেমন জীর্ণ বলে বোধ হয় না। সকলের বিশ্বাস এ মন্দির শঙ্করাচার্যের প্রতিষ্ঠিত। এ কথা অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই; ইহা বহু প্রাচীন জনপ্রবাদ, এবং তার কতক প্রমাণও যে নেই এমন নয়। কিন্তু মন্দিরটি দেখলে কেহই বিশ্বাস করবেন না যে, এটি শঙ্করাচার্যের প্রতিষ্ঠিত - এমন আধুনিকের মত দেখায় ! আমি প্রথমে একটু আশ্চর্য হয়েছিলুম, কিন্তু পরে ভেবে দেখলুম, যে মন্দিরটি বছরে আট মাস বরফের মধ্যে ঢাকা থাকে, রৌদ্র-বৃষ্টির সঙ্গে বড় একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না, সুতরাং তার উপরের দিকে ময়লা ধরবার অতি অল্পই সম্ভাবনা। কিন্তু আর বেশি দিন বে-মেরামত অবস্থায় রাখা উচিত নয় ভেবে মন্দিরাধ্যক্ষ এর মেরামত আরম্ভ করেছেন। তবে কতদিনে যে এই কাজ শেষ হবে, কখনও হবে কি না, তা ভবিষ্যৎ-জ্ঞান না থাকলে শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে বলা ভারি শক্ত। হয় ত মেরামত শেষ হতে না হতে আরও দু'চারজন মহান্তের জীবনকাল কেটে যাবে; কারণ একে ত বছরের দু তিন মাসের বেশি কাজ হবার জো নেই, তার উপর যে রকম 'গদাইলস্ক'Y ভাবে কাজ চলছে, তাতে একদিক গড়ে তুলতে আর এক দিক ভেঙে না পড়ে। হায় কলিকাল ! স্বয়ং বিশ্বকর্মা থাকতে নারায়ণের মন্দির মেরামতের জন্য আজ কিনা সামান্য রাজমিস্ত্রিরা তাদের দুর্বল হাতে ছোট ছোট পাথরের চাপ নিয়ে টানাটানি করছে এবং যতটুকু কাজ করছে তার চেয়ে অনেক বেশি পয়সা ফাঁকি দিয়ে খাচ্ছে, এদের নরকেও স্থান হবে না।

এখন পর্যন্ত অদৃষ্টে নারায়ণ দর্শন ঘটেনি ; কিন্তু বাল্যকাল হতে শুনে আসছি, বদরিকাশ্রমের নারায়ণের মূর্তি, পরশ পাথরে নির্মিত। স্পর্শমণি উপকথার বস্তু, কল্পনা ও কবিতাতে কখন কখন তার শক্তি অনুভব করা যায় বটে; কিন্তু এই পৃথিবীতে যদি সে রকম একটা জিনিসের অস্তিত্ব থাকতো, তা হলে এই ঘোর জীবনসংগ্রামের দিনে অনেকের পক্ষে সুবিধার কথা ছিল। বাটা বিভ্রাটের ভয়টা ত কমে যেতই, তা চাড়া ইনকামট্যাক্সের জন্যও এত কষ্ট পেতে হতো না, এবং অনাহারে থেকে ভদ্রতার দণ্ডস্বরূপ ঘটি বাটি বিক্রয় করে ট্যাক্স দেবার দায় হতেও অনেকাংশে নিষ্কৃতি পাওযা যেত। কিন্তু কবিতায় ও কল্পনাতে যা মেলে, এ নিäফলতার পৃথিবীতে তা কোথা হতে মিলবে ? দেশে থাকতে কতদিন শুনেছি, কখনো ঠাকুমার কাছে কখন বাচস্পতি মহাশয়ের বত্তৃÝতাতে যে, - হিমালয় পর্বতে এমন সব যোগী ঋষি আছেন , যাঁরা যোগবলে ভস্মকে কাঞ্চন এবং বিষয়কে অমৃত করতে পারেন। কিন্তু দুরদৃষ্টবশত এ পর্যন্ত বিষের জ্বালা অনেক সহ্য করলুম বটে , কিন্তু অমৃতের আস্বাদন ত বড় একটা হলো না; তা হলে বোধ করি আবার এ সংসারের কর্মভোগের মধ্যে এসে পড়তে হতো না। তবে এইটুকু বলা যেতে পারে যে, অমৃতের আস্বাদ না পাই, এমন এক আধজন সন্ন্যাসী দেখা গিয়াছে বটে, যাঁরা সচ্চিদানন্দের করুণামৃত-ধারা পান করে জীবনকে কৃতার্থ করেছেন; কিন্তু তাঁদের কোন কথা জিজ্ঞাসা করা ঘটে নি, তাঁদের স্বর্গীয় জ্যোতির সম্মুখে উপস্থিত হলে সাংসারিক আসক্তিপূর্ণ বাসনা ও চিন্তা ভস্মীভূত হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের পাপ-হৃদয়ে যে আশ্বাসবাণীর ঘোষণা হয়, আমরা তার উপযুক্ত নই, সুতরাং দু দিনের মধ্যে সে কুহকও অন্তর্হিত হয়ে যায়। তখন বাস্তবিকই একটা অনন্ত যাতনায় প্রাণ আকুল হয়ে উঠে, এবং কাতর হৃদয় বিদীর্ণ করে স্বতঃই ধবনিত হয় -

"যাহা পাই তাহা ঘরে নিয়ে যাই, আপনার মন ভুলাতে,
শেষে দেখি হায় ! ভেঙে সব যায়, ধূলা হয়ে যায় ধূলাতে।
সুখের আশায় মরি পিপাসায়, ডুবে মরি দুখপাথারে;
রবি শশী তারা কোথা হয় হারা, দেখিতে না পাই তোমারে।"

রাত্রে শুয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কত কথাই ভাবতে লাগলুম। বৈদান্তিকের সুখনিদ্রাটা আমার কাছে নিতান্ত চক্ষুশূল বলে বোধ হচ্ছিল। বিশেষ যতক্ষণ ঘুম না আসে চুপ করে পড়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করার চেয়ে ততক্ষণ কথা বলাতে বোধ করি একটু বেশি আরাম আছে; কিছু না হোক, কথাবার্তায় শীতের প্রকোপ অনেক কম বিবেচনা হয়। অতএব বৈদান্তিকের ক্লান্তিকর নিদ্রাটুকু বিনষ্ট করতে মনে কিছুমাত্র দ্বিধা উপস্থিত হলো না। কাঁচা ঘুম ভাঙাতে বৈদান্তিক বোধ করি আমার প্রতি কিঞ্চিৎ উষ্মাযুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু আমি তাঁকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলুম "াচ্ছা নারায়ণের দেহ যে, পরশ-পাথরে নির্মিত বলে, এ কথাটার অর্থ কি ? আমি ত অনেক ভেবে কিছু-ই ঠাহর করতে পারলুম না, সত্যি সত্যি পরশ পাথর ত আর নেই !" - আশু তর্কের একটি সুন্দর সম্ভাবনা দেখে ভায়ার নিদ্রা ও বিরক্তি দুইই এককালে দূর হয়ে গেল ! তিনি সোৎসাহে পার্শ্বপরিবর্তন করে বলতে লাগলেন যে, পরশ-পাথর কথাটার অর্থ নিয়েই আমি গোল করছি। আমাদের দেশের সকল বিষয়েরই এক একটা অর্থ আছে - যাকে আজকাল আমরা আধ্যাত্মিক অর্থ বলে থাকি; এবং বৈদান্তিকের মতে কেহ কেহ তার প্রতি অন্যায় কটাক্ষপাতও করে থাকে। বোধ হয় তিনি আমার উপর কটাক্ষ করেই কথাটা বললেন; কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে তিনি গুরু, আমি শিষ্য, সুতরাং কোন রকম উচ্চবাচ্য না করে শুনতে লাগলুম। তিনি অর্ধরাত্রব্যাপী সুদীর্ঘ বত্তৃÝতাদ্বারা যা বুঝালেন, তার মোদ্দাখানা এই যে, পরশ-পাথরের গূঢ় অর্থ ধর্ম। কারণ কল্পিত পরশ-পাথর স্পর্শে যেমন লোহা সোনা হয়ে যায় - তেমনি ধর্মের সংস্পর্শে তুচ্ছ দ্রব্যও মূল্যবান হয় এবং যা নিতান্ত মলিন, তাও উজ্জ্বল ও তেজোময় হয়ে উঠে; লোকে তখন তা আগ্রহ ভের কণ্ঠে ধারণ করবার জন্য আকুল হয়। নারায়ণের দেহ পরশ-পাথরে নির্মিত , তার অর্থ কি না, তিনি ধর্মস্বরূপ; তাঁকে স্পর্শ দূরের কথা, দর্শনমাত্র মানুষ খাঁটি সোনা হয়ে যায়। পাপ মনকে যে স্পর্শমণি নিষ্পাপ, পবিত্র করে তুলতে পরে - লোহাকে তুচ্ছ সোনা করার পরশমণি তার কাছে কোথায় লাগে ?

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, বাস্তবিক বৈদান্তিক ভায়ার এই বত্তৃÝতা আমার অতি মিষ্ট লেগেছিল। এমন একটা সার কথা তাঁর কাছে থেকে আমি মুহূর্তের জন্যও প্রত্যাশা করি নি; কিন্তু তাঁর কথা শুনে আমার হৃদয়ে আর একটা নতুন চিন্তার উদয় হলো-হায় ! দেবতার পদতলে এসেও আমার এই জীবনব্যাপিনী চিন্তা দূর হয় নি। আমার মনে হলো এ সংসারে রমণী হৃদয়ই একমাত্র স্পর্শমণি ! দেবতার মহিমা যেখানে প্রবেশ করতে অক্ষম, সেখানেও সে আপনার উজ্জ্বল মহিমা বিকাশ করে এবং পুরুষের কঠোর হৃদয়কে পুণ্যময় ও পবিত্র করে তোলে। আমার একখানি স্পর্শমণি ছিল, হঠাৎ তা হারিয়ে ফেলেছি। দেখি, যদি এই হিন্দুর মহাতীর্থে আর একখানি স্পর্শমণির সন্ধান পাই - যাতে এই পাপভারানত ধূলিম্লান জীবনকে সজীব, উজ্জ্বল ও পবিত্র করে তুলতে পারি !

(চলবে)

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.