প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২৮)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩)
(২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

অদ্য ৫ জুন, শুক্রবার - নন্দপ্রয়াগ ত্যাগ করে আমরা তিনটি মানুষ ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলাম; কারও মনে প্রসন্নতা নাই। কেমন একটা গভীর বিষাদ বুকে করে আমরা নিঃশব্দে পথ বেয়ে চললাম, পা দুখানি যেন কলে চলছে। মুখে কথা নেই। এমন অবসাদ নিয়ে কি বেশি পথ চলা যায়; কাজেই বেলা যখন দশটা, তখন আমরা সবে চার মাইল রাস্তা এসে কালকাচটিতে বাসা নিলাম। এখন পথ-ঘাট সব চেনা; যে চটিতে আমরা যাবার সময় বাস করে গিয়েছি, সে চটিওয়ালাকে পর্যন্ত বেশ ভাল করে মনে করে রেখেছি। বিদ্যাবুদ্ধি মোটেই নেই, টাকা-কড়ি দিযে যে লোককে বশ করবো তাও তেমন ছিল না; তবে একটি জিনিস সম্বল করে এ পথে বেরিয়েছিলাম, সেটি শীতল বুলি। একটা দোঁহা আমি সর্বদাই আবৃত্তি করতাম এবং জীবনে সেটিকে কার্যে পরিণত করবার জন্য অনেক চেষ্টাও করেছি; সে চেষ্টা যে নিতান্তই বৃথা করি নি তার প্রমাণ এই নারায়ণের পথে পেয়েছি। দোঁহাটি ঠিক হবে কি না বলতে পারি না, তবে আমি তাকে এই আকারেই পেয়েছি -

"ইয়ে রসনা বশ কর, ধর গরিবি বেশ,
শীতল বুলি লেকে চলো, সবহি তুমহারা দেশ।"

এই 'শীতল বুলি' - এই মিষ্টি কথাতেই সকলের সঙ্গে মিলে মিশে চলে এসেছি। আমার ত এই অভিজ্ঞতা জন্মেছে যে, পথে ঘাটে চলতে হলে টাকায় কুলোয় না, মান মর্যাদা, গর্ব অহঙ্কার পদে পদে বিড়ম্বিত হয় ; তারা কোনদিনই পথের সঙ্গী নয়, তা এই পাহাড়ের মধ্যেই হউক, আর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির রেলের গাড়ির মধ্যেই হউক। নিজের ধন, মান, মর্যাদা, বংশগৌরব নিজের গ্রামে বা আশ্রিতমণ্ডলীকে বেশ গুছিয়ে আপন আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, পথে ঘাটে তা বিশেষ অসুবিধাই ঘটিয়ে দেয়। এই মিষ্ট বাক্যে সকল চটিওয়ালাকেই বাধ্য করে আমরা পথ চলেছি।

কালকা চটিতে আমরা পৌঁছিলে চটিওয়ালা আমাদের দেখে বড়ই আনন্দিত হল। কতদিন সে কতজনের কাছে আমাদের কথা বলেছে; প্রতিদিনই আমাদের প্রত্যাগমনের পথের দিকে চেয়ে থাকত। তার কথাগুলি শুনে আমাদের মনে বড়ই আনন্দ হল ! আমরা কোথাকার কে, কবে এক রাত্রির জন্যে তার দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, আর সে আমাদের কথা মনে রেখেছে, এ কথা শুনে বড়ই আনন্দ হল।

আমরা চটিতে বিশ্রাম করছি, দোকনদার আমাদের আহারাদির আয়োজন করছে। সে দিন আমরা ব্যতীত সে চটিতে আর কোন যাত্রী বাসা নেয় নি; তাই দোকানদার তার যা কিছু সম্বল সমস্তই আমাদের সেবায় নিযুক্ত করেছে। বেলা যখন প্রায় ১১ টা সেই সময় নীচের দিক থেকে একজন বৈষ্ণব সাধু এসে ঐ চটিতে উপস্থিত হলেন। তাঁর ভাব দেখে বোধ হলো, তিনি আজ অনেক পথ হেঁটেছেন। তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় লোকটি নেই। আমাদের দেশের বৈষ্ণবের মত বেশ; স্কন্ধে একটি ছোট রকমের ঝুলি আছে। তিনি দোকানে প্রবেশ করেই নিজের ঝুলিটি নামিয়ে রেখে একেবারে মাটির উপর শুয়ে পড়লেন, এবং কতকক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। তাঁর ভাব দেখে বোধ হলো, এমনি করে শুয়ে তিনি বেশ আরাম বোধ করছেন। তাঁর সে আরামে বাধা দিয়ে কথাবার্তা বলা সঙ্গত নয় মনে করে আমরাও চুপ করে বসে রইলাম। একটু পরেই তিনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন এবং স্বামিজীর দিকে চেয়ে বললেন, "পথশ্রমে বড়ই কাতর হয়ে পড়েছিলাম, তাই আপনার সঙ্গে কথা কইতে পারি নি, কিছু মনে করবেন না।" স্বামিজী অবাক হয়ে গেলেন; তাঁর সেই আজানুলম্বিত দাড়ি এবং গৈরিক বস্ত্রের প্রকাণ্ড উষ্ণীষ সত্বেও কি করে বৈষ্ণব তাঁকে বাঙালি ঠাউরে নিয়ে বেশ দিব্বি বাংলায় কথা বললেন, এই স্বামিজীর বিস্ময়ের কারণ। কিন্তু বৈষ্ণব মহাশয় তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন; কারণ পরক্ষণেই তিনি বললেন, " আপনি সন্ন্যাসীর বেশেই থাকুন, আর যাই করুন, আপনার দাড়ি আমরা কোনদিন ভুলব না। আপনার হয় ত মনে নাই; কিন্তু আপনারা যখন মুঙ্গেরে ছিলেন, আমি তখন জামালপুরে থাকতাম।" স্বামিজী তাঁকে চিনতে পারলেন না। বৈষ্ণব শেষে আত্মপরিচয় দিলেন। তিনি জামালপুরে কোনো অফিসে চাকরি করতেন। যখন মুঙ্গেরে কেশব বাবু, সদলবলে অবস্থান করছিলেন, সে সময়ে ঐ অঞ্চলে খুব একটা ধর্মান্দোলন উপস্থিত হয়েছিল। অনেক শিক্ষিত যুবক ব্রাহ্মসভা, সংশোধনী-সভা প্রভৃতি স্থাপন করে খুব একটা সোরগোল উপস্থিত করেছিলেন। তার পর কেশব বাবুরা চলে গেলেন; কিন্তু ধর্মের আন্দোলন সহজে মুঙ্গের জামালপুর ত্যাগ করল না; কতকগুলি যুবক যথারীতি ব্রাহ্মধর্ম অবলম্বন করলেন; কেউ শৈব হলেন; কেউ বৈষ্ণব হলেন; পরিব্রাজক শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেন, যিনি পরে কৃষ্ণানন্দ স্বামী নাম ধারণ করেছিলেন, তিনি সেই মুঙ্গেরের যুবকদলের একজন উত্সাহী নেতা ছিলেন। কতকগুলি যুবক ধর্মের জন্যে চাকুরি আদি ত্যাগ করলেন। শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেন হিন্দুধর্মের প্রচারক হয়ে দেশে দেশে ফিরতে লাগলেন, তাঁর বত্তৃÝতা শুনে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল ! আমাদের সঙ্গে যে বৈষ্ণবের সাক্ষাত্ হল, তিনি কিছুদিন সেই দলেই ছিলেন, কিন্তু শেষে নিজের রুচি অনুসারে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে যথারীতি ভেক নিয়ে এখন বৃন্দাবনে বাস করছেন। নারায়ণ দর্শন উদ্দেশ্যে তিনি এদিকে আসেন নাই। তাঁর একজন বাঙালি বন্ধু কানপুরে থাকেন; সেই বন্ধুটির একমাত্র পুত্র কোথায় চলে গিয়েছে। তাঁরা কেমন করে সন্ধান পেয়েছেন যে,সে ছেলেটি বদরিকাশ্রমের দিকে এসেছে; তাই এই বৈষ্ণব সেই ছেলের অনুসন্ধানে এসেছেন। বৃন্দাবনে বসেও প্রভুর নাম করছিলেন, পথেও তাঁরই নাম করবেন; বন্ধìর ছেলেটি যদি পাওয়া যায়, তা হলে বন্ধìর যথেষ্ট উপকার করা হবে বন্ধìপত্নীও প্রাণ পাবেন। পরের উপকারের জন্যই সাধু বৈষ্ণব এই ভয়ানক পথে এসেছেন।

আমরা ত তাঁকে একেবারে নিরাশ করে দিলাম। তিনি যে লোকের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তার চেহারা যে ভাবে বললেন, তাতে তেমন চেহারার লোক ত আমাদের নজরে পড়ে নাই। একটি ছেলেকে আমরা সেদিন ডাক্তারখানায় রেখে এসেছি, তাকে দেখে আমাদের বাঙালি বলে বিশ্বাস হয়েছে; সে কথা তাঁকে জানিয়ে দিলাম। তিনিও সেদিন যে করে হোক, সেই ডাক্তারখানা অবধি যাবেন। যখন এতদূর এসেছেন, তখন আর নারায়ণ দর্শন না করে শ্রীধামে ফিরবেন না। লোকটি বড়ই সুন্দর প্রকৃতির। চৈতন্যদেব উপদেশ দিয়েছিলেন -

তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা,
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরি।

সে উপদেশ আধুনিক বৈষ্ণব মহাশয়েরা কতদূর পালন করে থাকেন সে বিষয়ে সন্দেহ আছে; আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা তাতে বলতে পারি বৈষ্ণব মহাশয়েরা উপদেশের শেষাংশ পালন করে থাকেন, সর্বদা হরিনাম কীর্তন তাঁরা করে থাকেন; তবে তার কতখানি হরির জন্য, আর কতখানি ভিক্ষার জন্য, পদ-প্রসারের জন্য, তা তাঁরা এবং তাঁদের হরিই বলতে পারেন। বৈষ্ণব নাম শুনলেই তার সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলি কথা, অনেকগুলি ভাব, আমাদের মনে এসে পড়ে, সেগুলি নামের সঙ্গে এমন দৃঢ়রূপে জড়িয়েছে যে, তাদের স্থানচ্যুত করা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়েছে। ভাল বৈষ্ণব বড় একটা নজরে পড়ে না। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে যে বৈষ্ণব দেখতে পাই, তারা শুধু ভিক্ষা পাবার জন্যই তিলক-মালা ধারণ করেছে বলে মনে হয়। বৈষ্ণবদের কথা বলতে বলতে একটা অনেকদিনের কথা আমার মনে পড়ে গেল। যিনি সে কথাটি বলেছিলেন, তিনি আজ স্বর্গে; এখন তাঁর কথা আর প্রতিদিন মনে হয় না। তিনি আমার স্বর্গীয়া মাতৃদেবী। তিনি যদিও হিন্দু পরিবারের মধ্যে বর্ধিত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ধর্মভাব সার্বভৌমিক ভিত্তির উপর সংস্থাপিত ছিল। তিনি কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের গোঁড়ামি দেখতে পারতেন না। তিনি একদিন বৈষ্ণবদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, আমরা সংসারের মধ্যে থেকে হরিনাম অনেক সময় ভুলে যাই; সুতরাং আমরা পাপী তার আর সন্দেহ নেই; কিন্তু এই বৈষ্ণবগুলো সংসারটাকে এতই ভালবাসে যে, তাকে একদণ্ড কাছছাড়া করতে পারে না; তাই তারা তাদের সংসারের উনকোটি চৌষট্টি ঝুলির ভিতর পুরে দিনরাত কাঁধে করে, পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এই ঝোলাই বইবে, না হরিনাম করবে ! কথা কয়টি বড় ঠিক। বৈষ্ণব সাধু-সন্ন্যাসী আমি জীবনে অনেক দেখেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই প্রাণের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা সংসার। তারা যে কেমন করে, সংসার বাসনা ঝুলিতে বোঝাই করে নিয়ে বেড়ায়, তাই ভেবে উঠা যায় না।

সে কথা যাক। আজ এই চটিতে যে বৈষ্ণবের সঙ্গে দেখা হলো, তাঁর উপরে এত কথা খাটে না। তাঁকে দেখে সেই অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাতে বলতে পারি লোকটা বেশ ধার্মিক; আর তিনি সত্যসত্যই ধর্মের জনই এই আশ্রমে প্রবেশ করেছেন। তিনি এত বেলায় রান্না করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমরা আর তাঁকে সে কষ্ট পেতে দিলাম না; আমাদের জন্যে যে খাবার তৈয়েরি হয়েছিল, তাই তাঁর সঙ্গে ভাগ করে গ্রহণ করা গেল।

আহারান্তে তিনি আর একদণ্ড বিশ্রাম করলেন না; আমরা যে দেশ ছেড়ে এসেছি, তিনি সেই দেশের দিকে চলে গেলেন। আমার প্রাণের মধ্যে আবার বাসনা জেগে উঠল। মনে হতে লাগলো, নেমে কোথায় যাব ? আমার আবার প্রত্যাবর্তন কেন ? বেশ ত গিয়েছিলাম ! নেমে আসবার কি এমন একটা দরকার হয়েছিল, তা ত আজ বুঝতে পারি না। কি মনে করে যে এতটা রাস্তা এসেছি, তা আজ মোটেই মনে আনতে পারলাম না। বড়ই ইচ্ছা হলো বৈষ্ণবের সঙ্গে আবার নারায়ণের পথে চলে যাই; সেখানে গিয়ে শেষে যা হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। যে কথা সেই কাজ, আমি তখনই কম্বল কাঁধে করে বের হবার উদ্যোগ করছি দেখে স্বামিজী নিষেধ করলেন, এত রৌদ্রে বাহির হয়ে কাজ নেই। আমি তাঁকে জানিয়ে দিলাম যে আমি আবার নারায়ণের পথে যাচ্ছি; নীচে ফিরে যাবার মত পরিবর্তন হয়েছে। স্বামিজী শুনে একেবারে অবাক; সত্যসত্যই তিনি হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন; দেখে যেন বোধ হলো যে, হয় তিনি আমার কথা মোটেই বুঝতে পারেন নি, আর না হয় তিনি আমার মস্তিষ্ক বিকৃতির কথা ভাবছেন। আমি তাঁকে এই অবস্থায় দেখে নিজেই নীরবতা ভঙ্গ করে দিলাম "তা হলে আসি", এই বলে যখন আমি পা বাড়িয়েছি, তখন সেই সন্ন্যাসী, সেই সংসারত্যাগী সর্বত্যাগী সাধু এসে একেবারে দুই হাত দিয়ে আমাকে আটকিয়ে রাখবেন বলে মনে করলেন। শুধু তাই নয়, নির্বাক সন্ন্যাসী দুই চারিবিন্দু চোখের জল ফেললেন। হায় কপট সন্ন্যাসী, হায় ভণ্ড সাধু, আজ তুমি বাহুবন্ধনে ও চোখের জলে ধরা পড়েছ। তোমার গৈরিকবসন, দণ্ড কমণ্ডুল ও তোমার এই কষ্ট স্বীকার, এত সাধন ভজন মিথ্যা, তুমি ঘোর সংসারী; তুমি এক সংসার ছেড়ে এসে আর এক সংসারে পড়েছ। তুমি ভগবানের দ্বারে পৌঁছতে পারছ না। এত যার স্নেহ মমতা, এত যার মানুষে উপর টান, সে ভগবানকে ডাকে কি করে ? আমি সন্ন্যাসীর সেই বাহুবন্ধনে মহা বিপন্ন হয়ে পড়লাম, তাঁর চোখের জল দেখে আমার সব ঘুরে গেল। আমি আর কথাবার্তা না বলে সেখানে বসে পড়লাম। স্বামিজীও আমার কাছে বসে সস্নেহে আমার দীর্ঘ কেশ, রুক্ষ মস্তকে হাত বুলাতে লাগলেন। আমার আর নারায়ণের পথে যাওয়া হল না; কিন্তু তখনই সকলে মিলে সে চটি থেকে বেড়িয়ে পড়া গেল। সন্ধ্যার সময়ে কর্ণপ্রয়াগে এসে নীরবে নিঃশব্দে একটা দোকানঘরে রাত্রিবাস করা গেল। কর্ণপ্রয়াগে পেড়া কিনতে পাওয়া যায়; সে পেড়া খেয়েই সে রাত্রি কাটিয়ে দেওয়া গেল।

৬ জুন। - প্রাতে উঠে দেখি আকাশ একেবারে মেঘে ছেয়ে ফেলেছে, আর ধীরে ধীরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড় অঞ্চলে এ রকম বৃষ্টি দেখলেই বুঝতে হবে যে, সে দিন বৃষ্টি বড় শীঘ্র থামবে না। আমার আর এ বৃষ্টির মধ্যে বার হবার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, আবার বেশ গুছিয়ে কম্বলখানা মুড়ি দিয়ে শয়ন করতে যাচ্চি, এমন সময় বৈদান্তিক ভায়া বাধা দিলেন; তিনি বললেন, "এ রকম বাজারে জায়গায় আর এক বেলাও থেকে দরকার নই, যদি এক আধবেলা বিশ্রাম করা নিতান্তই দরকার হয় ত পাহাড়ে মধ্যে কোনো একটা নির্জন চটিতে দুই একদিন কাটিয়ে দেওয়া ভাল।" বৈদান্তিক ভায়ার কখন যে কি মত হয়, তা দেবতারাও ঠিক করে বলতে পারেন না। যেখানে বেশি জিনিসপত্র পাওয়া যায়, সেখানে থাকতে ইতিপূর্বে কোনো দিনও তাঁর কোনো প্রকার আপত্তি হয় নি; কিন্তু আজ তিনি জঙ্গলের মধ্যে জনহীন পর্বতগহবর , কি সামান্য চটিতে বিশ্রাম ভাল বলে মত প্রকাশ করলেন। হয় তিনি আমাকে বার হতে অনিচ্ছুক দেখেই বার হবার জন্য প্রস্তুত হলেন, না হয় আজ বৃষ্টির মধ্যে বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায় কিঞ্চিত্ কষ্টভোগ আমাদের অদৃষ্টলিপি ছিল, তাই বৈদান্তিক আজ সকলের আগে কম্বল কাঁধে করে বেড়িয়ে পড়লেন। আমি বাক্যব্যয় না করে তাঁর অনুবর্তী হলাম।

খানিকটা দূর এগিয়ে এমন ঝড়ে আটকিয়ে যাওয়া গেল যে, আর এক পা অগ্রসর হবার শক্তি রইল না। মড় মড় করে বড় বড় গাছ সব ভেঙে পড়তে লাগলো, প্রতি মুহূর্তে বোধ হলো যেন এই বারেই হয় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে, বা উপর থেকে হয় গাছ ভেঙ্গে না হয় পাহাড়ের ধস্ নেমে আমাদের সন্ন্যাসীগিরি জন্মের মত ঘুচিয়ে দেবে। আমরা তখন এক জায়গাতেও নেই যে, একত্রে জড়িয়ে পড়ে থাকব। কে যে কোথায়া, তা আর সেই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দেখতে পাওয়া গেল না। আমি একে নিজের প্রাণ নিয়ে ব্যস্ত তার মধ্যে আবার স্বামিজীর কথা মনে হতে লাগলো। একটা গাছের শিকড় প্রাণপণে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আমি শুয়ে পড়েছি। মাথার উপর দিয়ে কত কি বয়ে যাচ্ছে, একবার একটা হয় ত প্রচণ্ড ডালই হবে, আমার মাথার কাছ দিয়ে চলে গেল। কম্বলখানি দুই তিন জায়গায় ছিঁড়ে গেল, গানের বইখানি কিন্তু বুকের মধ্যে আছে। ঝড় আর থামে না, তবু একটু নরম হয়ে গেল; বৃষ্টি খুব কম হয়ে গেল। বৃষ্টি খুব হওয়াতে কিছু এলো গেল না; তার চাইতে যদি বাতাসটা কমে গিয়ে বৃষ্টি সমভাবেই থাকতো তাতে আমার কোনোই ক্ষতি ছিল না; কাপড় ও কম্বল যতটা ভিজে গিয়েছিল তার চাইতে বেশি ভিজবার জো ছিল না। এভাবে আমাকে অধিকক্ষণ আর থাকতে হয় নি। অচ্যুত বাবাজী আমার সম্মুখে কোথায় ছিলেন; তিনি বিপুল বিক্রমে বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমার কাছে এসে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর সেই বিশাল দেহ দিয়ে আমাকে আবৃত করে বসলেন। আমার মনে পড়ে যখনই ঝড় বৃষ্টি হয়েছে, তখনই বৈদান্তিকের নির্মম কঠোর বক্ষতলে আমি আশ্রয় পেয়েছি। পক্ষীমাতা যেমন নিরাশ্রয় শাবককে বিপদকালে নিজের পাখা দুইখানির নীচে লুকিয়ে রাখে, বৈদান্তিকের সেই বিপুল বক্ষ তেমনি আমাকে অনেক বিপদের সময়ে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেছে। আমি বিপন্ন হলে কোনো দিনই সে মায়াবাদের আশ্রয় গ্রহণ করে আমাকে উড়িয়ে দিতে পারে নি। এ মানুষটি এতদিন আমাদের সঙ্গে রইল, তবু এর ভাবগতিক আমি ত মোটেই বুঝতে পারলাম না; তার মতামতের একটা সামঞ্জস্য কখনও দেখা গেল না। কি একটা এলোমেলো হৃদয় নিয়ে সে যে দেশত্যাগ করেছে তা আর বলতে পারি নে; সে বোধ হয় এত দিনেও তার প্রাণের বিক্ষিপ্ত জিনিসগুলিকে একত্র সংগ্রহ করে একটা বুদ্ধি স্থির করতে পারে নি।

আর একটু পরেই ঝড় থেমে গেল। স্বামিজী আমাদের পশ্চাতে আছেন, তাঁর উদ্দেশ করা দরকার হয়ে পড়লো; কারণ এখনও তাঁর কোনো খোঁজ-খবরই নেই। আমরা দুই জনে তাঁর বিলম্ব দেখে বড়ই ব্যস্ত হয়ে যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে ফিরে যেতে লাগলাম। বেশি দূর যেতে হল না; একটু পথ যেতে না যেতেই দেখি তিনি ভারি ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছেন। আমাদের দুই জনকে দেখে একেবারে বসে পড়লেন। তাঁর এই প্রকার হঠাত্ বসে পড়া দেখে আমরা বেশ বুঝতে পারলাম, তিনি অনেক দূর থেকে ঊধর্বশ্বাসে আমাদের যে কি দশা হলো তাই জানবার জন্য বিশেষ আকুল হয়ে আসছিলেন, সম্মুখে আমাদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমরা তাঁর কাছে গিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। তিনি যখন একটু কথা কইবার মত হলেন, তখন আমরা কি করে কোথায় আশ্রয় পেয়েছিলাম, তাই জানবার জন্য উত্সুক হলেন এবং আমাদের ভিজে কাপড় ও কম্বল দেখে দুঃখ করতে লাগলেন। তাঁর নিজের শরীরে মোটেই জল লাগে নি; তিনি ভগবানের কৃপায় একটি প্রশস্ত গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে ঝড় বৃষ্টি মোটেই ঢুকতে পায় নি। আমাদের অবস্থা শুনে তিনি ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানালেন; আজ যে ঝড় জল, তাতে ভগবানের কৃপা না হলে আমরা বাঁচতাম না। স্বামিজী ভগবদ্প্রেমে এতটাই বিগলিত হয়ে পড়লেন যে সেখান থেকে যে তিনি শীঘ্র গা ঝাড়া দিয়ে উঠবেন, তেমন রকমটা মোটেই বোধ হলো না। প্রথমে তিনি চক্ষু মুদ্রিত করে বসলেন, আমরা দুইটি হতভাগ্য পাষাণ হৃদয় জীব হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। একটু পরেই তিনি গান আরম্ভ করে দিলেন। - আমার উপর তাঁর একটা আদেশ ছিল যে যখনই তিনি যে অবস্থায় গান ধরবেন, তাতে আমাকে যোগ দিতেই হবে। আমার ভাগ্যক্রমে তিনি কখনও এমন কোনো গান ধরেন নি যা আমি জানিনে; গাইতে যদিও ভাল জানি না - ভাল কেন, নিজের তৃপ্তি ব্যতীত আমার গান শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তির তৃপ্তি জন্মাবার দুরাশা আমিও কোন দিনও মনে স্থান দিই নি, কিন্তু তা বলে আমার গানের তহবিল শূণ্য নয়। গাইতে পারি আর না পারি, গান আমার সংগ্রহ আছে; আর তা না হলে যদিও কম্বল ও যষ্টি সম্বল করে পথে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু আমার পরমারাধ্য কাঙাল ফিকিরচাঁদের গানের বইখানি কোন দিনও ছাড়ি নি, সেখানিকে বৈষ্ণবের জপমালার মত বুকে করে নিয়ে বেড়িয়েছি।
স্বামিজী গান ধরলেন; তার সবটা মনে নেই। তবে তার মুখখানি মনে আছে, পাঠকগণের মধ্যে যাঁদের জানা আছে তাঁরা সবটা গেয়ে নেবেন গানটি এই -“হরিসে লাগি রহো রে ভাই।”

এই গানটি মীরাবাইএর রচিত। স্বামিজী যখন-তখনই এই গানটি গাইতেন। তিনি যেভাবে উল্টে-পাল্টে গানটি গাইতে লাগলেন, তাতে কতক্ষণে যে তিনি গান ছেড়ে দেবেন তা মোটেই বুঝতে পারা গেল না; এদিকে বেলাও হয়ে উঠতে লাগল। অগত্যা আমি গান ছেড়ে দিলাম; তাঁর স্বর ধীরে ধীরে নামতে লাগল, শেষে একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গেল। কিন্তু তখনও তিনি উঠলেন না। গান শেষ হয়েছে দেখে আমরা দুইজনে উঠে এদিক ওদিক করতে লাগলাম। কিচুক্ষণ পরে তিনি আপন মনেই চলতে লাগলেন; আমরা দুইজনে ধীরে ধীরে তাঁর পশ্চাতে যেতে লাগলাম।

আজ দুই প্রহরে যে চটিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম তার নামটি আমার খাতায় লেখা নেই, সেই জায়গাটা ফাঁক রয়েছে; বোধ হয় সেই দুই প্রহরে কোন নূতন চটিতে ছিলাম, তার নামটি শুনে নিতে মনে ছিল না, বিশেষতঃ এই প্রত্যাবর্তনের সময়ে আমার ডাইরীটা তেমন নিয়ম মত লেখাই হতো না; তার কারণ হচ্ছে এই যে, নারায়ণে যাবার সময় যেমন একটা স্ফূর্তি নিয়ে বেরিয়েছিলাম আসবার সময় তার সম্পূর্ণ অভাব। এখন কলের পুতুলের মত যাচ্ছি। এ কথাটা মনে হলে আমার প্রাণের ভিতর কেমন একটা ঘোর অবসাদের ভাব এসে উপস্থিত হতো; আমার উদাস প্রাণকে আরও উদাস করে ফেলতো; আমি মোটেই মনটাকে স্থির করে নিতে পারতাম না; কাজেই সে সময়ে কোন কাজই ভাল লাগতো না, আর সেই জন্যই প্রত্যাবর্তনের ডাইরী শুধু যে ভাল করে রাখা হয় নি তা নয় , অসম্পূর্ণ পড়ে রয়েছে। যতই নীচে নেমেছি ততই জড়তা, বিষাদ, দঃুখ কষ্টের ছবি সব আমার প্রাণের ভিতর বেশি করে ফুটে উঠেছে, আর ততই আমি অন্যমনস্ক হয়েছি।

সেই অজ্ঞাতনামা চটিতে দুই প্রহর বিশ্রাম করে অপরাহ্নে আবার পথে নামলাম। আজ সন্ধ্যার সময়ে আমরা শিবানন্দ চটিতে এসে রইলাম। এই চটিতে আমাদের একাকী ফেলে অচ্যুত বাবাজি চলে যান। আমরা শিবানন্দীর সেই ঠাকুরবাড়িতে পূর্ব বারের মত বাসা করে রইলাম। রাত্রিটা বেশ কেটে গেল।

৭ জুন। - শিবানন্দী হতে রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত পথ অতি কদর্য, এমন ভয়ানক রাস্তা যে পা ঠিক রাখা যায় না। আর এই পথের মধ্যে পাহাড়গুলো আবার এমন নরম যে একটু জল হলেই অনেক ধস্ নামে। গভর্নমেন্ট এই রাস্তাটিকে ঠিক রাখতে না পেরে শিবানন্দীর ৪ মাইল উপরে পিপলচটিতে একটা লোহার সেতু নির্মান করে রাস্তাটিকে নদীর অপর পার দিয়ে চালিয়েছেন এবং সেই রাস্তা রুদ্রপ্রয়াগে এসে আবার আর একটা লৌহসেতুর সাহায্যে পূর্ব রাস্তায় এসে মিশেছে। আমরা এ সংবাদ জানতাম, কিন্তু আমাদের এও জানা ছিল, এই নূতন রাস্তায় আশ্রয় স্থান নেই। তাই আমরা নারায়ণে যাবার সময়েও সে রাস্তায় যাই নি, এখন ফিরবার সময়েও সে রাস্তায় গেলাম না। পিপল চটিতে অপেক্ষা না করে আমরা একেবারে শিবানন্দীতে এসে উঠেছিলাম। আজ শিবানন্দী হতে বাহির হয়ে একটু বোধ হয় মাইল দেড় কি দুই মাইল হবে, অগ্রসর হয়েই দেখি রাস্তার চিহ্নমাত্র নেই। গতকল্য যে ঝড় জল হয়েছিল, তাতে রাস্তা একেবারে ধুয়ে নেমে গিয়েছে। এখন কি করা যায়। স্বামিজী বললেন, আর কি করা; ফিরে পিপলচটিতে আজ রাত্রিবাস করে, কাল খুব ভোরে উঠে নদী পার হয়ে নূতন রাস্তা ধরে যেমন করে হোক, না খেয়ে সন্ধ্যা নাগাদ কি চার দণ্ড রাত্রের মধ্যে রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছুতে হবে; তা ছাড়া আর উপায় নেই। ফিরে যেতেও আমাদের আপত্তি ছিল না। তার পরের দিন অনাহারে সারাদিন চলতেও যে বড় একটা ভারি কষ্ট হবে তাও মনে হয় নি; কিন্তু আজকের সারাদিন রাত্রি পিপলচটিতে বাস করা অপেক্ষা গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়া ভাল; অচ্যুত ভায়ারও সেই মত। যে পিপলচটির লক্ষ লক্ষ মাছির দৌরাত্ম্যের কথা আজও আমার মনে আছে, সেখানে কিছুতেই রাত্রিবাস করা হবে না; অচ্যুত ভায়া বললেন, "আপনারা এইখানে অপেক্ষা করুন, আমি একটু উপরে উঠে গাছ ধরে ধরে এগিয়ে দেখি এই সুমুখের পাহাড়ের ও-পাশে রাস্তা আছে কি না।" যে কথা সেই কাজ; তিনি তাঁর বেদান্তদর্শনের বোঝা ও কম্বলখানি নামিয়ে রেখে বিপুল বিক্রমে গাছপালা ধরে ধরে উপরে উঠতে লাগলেন; এবং কখন গাছের পাতা সরিয়ে, কখন শিকড় ধরে বেশ যেতে লাগলেন; এবং মধ্যে মধ্যে আমাদের দিকে সগর্বে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরেই চীত্কার করে বললেন, "ভয় নেই এদিকের রাস্তা তেমন ভাঙেনি।" তারপর আবার যেমন করে গিয়েছিলেন তেমনি করে ফিরে এলেন। আমি তাঁর গমনাগমন দেখে বেশ যেতে পারব বলে মনে ভরসা বাঁধলাম, কিন্তু স্বামিজী তেমন সাহস পান নাই। অবশেষে কি করেন, আর ত কোনো উপায় নাই; কাজেই তাঁর দণ্ডকমণ্ডুল অচ্যুত ভায়ার জিম্মা করে দিয়ে তিনি আগেই রওনা হলেন; বৈদান্তিক তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যেতে লাগলেন; সে সময়ে বৈদান্তিকের দৃষ্টি এমন সতর্ক যে, তা লিখে বোঝাতে পারি না। তিনি শুধু স্বামিজীর গতিবিধির উপর নজর রেখে অগ্রসর হচ্ছেন, আর মধ্যে মধ্যে খবরদারি করছেন। বোধ হয় আমি তাঁর প্রদর্শিত পথে অনায়াসে যেতে পারব ভেবে তিনি আর আমার দিকে লক্ষ্য রাখলেন না, শুধু সাবধান করে দিতে লাগলেন। কখন গাছের ডাল ধরে, কখন লাফিয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন। শেষে অনেক কষ্টে নিরাপদে একটা রাস্তায় ওঠা গেল। এই আমাদের কষ্টের শেষ নয়। রাস্তায় পাঁচ সাত জায়গায় ভেঙে গিয়েছে; তবে এই ভাঙনটা যেমন অনেকটা স্থান জুড়ে, অন্যগুলি তেমন নয়। সেগুলি পার হতেও লাফালাফি করতে হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে তেমন বেশি কষ্ট হয় নি। যাই হোক, দুই ঘণ্টার পথ পাঁচ ঘন্টায় চলে বেলা প্রায় এগারোটার সময় আমরা রুদ্রপ্রয়াগে এসে উপস্থিত। নারায়ণে যাবার সময়ে আমরা রুদ্রপ্রয়াগের গভর্নমেন্টের ধর্মশালায় ছিলাম এবং সেখানে পীড়িত হয়ে আমাদের তিন দিন থাকতে হয়; এবারে সেজন্য আর ধর্মশালায় গেলাম না; বাজারে একটা দোকানে আশ্রয় গ্রহণ করা গেল।

আমরা আহারাদি শেষ করে বিশ্রামের আয়োজন করছি, বেলা তখন দুইটা বেজে গিয়েছে বলে বোধ হল। সে সময়ে দেখি একজন বাঙালি সন্ন্যাসী বাংলা ভাষায় যাচ্ছে তাই বলে দোকানদারগণকে গালাগাল দিতে দিতে আমাদের সম্মুখ দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা যে দোকানখানিতে ছিলাম, সেখানি বাজারের একপ্রান্তে অবস্থিত। লোকটির গৈরিক বসন দেখে তাকে সন্ন্যাসী বলেছি। তার পর গৈরিক রং করা ক্যামবিসের একজোড়া জুতা, পরিধানে গৈরিক বস্ত্র, গায়ে গৈরিক পিরান, কাঁধে ১ খানি কম্বল তাকেও রং করে পোষাকের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে; হাতে একটা সেতার; তারও পরিত্রাণ নাই, তাকেও গৈরিক খোলে মোড়া হয়েছে। লোকটাকে বড়ই রাগান্বিত দেখে আমি তাকে ডাকতে লাগলাম, বাংলা ভাষায় তাকে ডাকছি, তবু সে রাগের ভরে চলে যায় দেখে আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালাম এবং কেন সে এত চটে গিয়েছে জিজ্ঞাসা করায়, সে দোকানদারের পিতৃমাতৃ উচ্চারণ করে গালি দিতে লাগলো এবং রাগে গরগর করে কতকগুলি কথা বলে ফেললে; তার সার এই যে আজ ভোরে রওনা হয়ে সাত আট ক্রোশ রাস্তা সে হেঁটে এসেছে, সঙ্গে একটি পয়সা নেই। এখানে এসে যে দোকানে যায় সেই দোকানদারই বিনা পয়সায় তার আহার যোগাতে অসম্মত হয়। বেলা আড়াই প্রহরের সময় বেচারার উপর এ প্রকার অত্যাচার করায় সে কি করে তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারে; আপনারাই তার বিচার করুন। অনেক বুঝিয়ে তাকে এনে আমাদের দোকানে বসালাম এবং দোকানদারের ঘরে জলখাবার যা ছিল তা দিয়ে তার উদরকে শান্ত করা গেল। সে যখন প্রকৃতিস্থ হল তখন তাকে আমি বুঝিয়ে দিলাম যে, সে যে প্রকার চটা মেজাজের লোক তাতে বিনা সম্বলে এ পথে চলতে পারবে না; তার চাইতে তার পক্ষে ফিরে যাওয়া ভাল, এবং সে যদি সম্মত হয়, তা হলে তাকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজি আছি। সে তাতে সম্মত হল না; যে করেই হোক সে নারায়ণ দর্শন করতে যাবেই। তার সদুদ্দেশ্যে বাধা দেওয়া অকর্তব্য মনে করে আমি যথাসাধ্য তাকে সাহায্য করলাম, শেষে একসঙ্গেই সকলে বাহির হওয়া গেল। দুর্বাসার ছোট সংস্করণ সাধু নারায়ণের পথে গেলেন, আমরাও শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হলাম। এই স্থানে একটি কথা না বলা ভাল হয় না। নারায়ণে যাবার সময়ে এই রুদ্রপ্রয়াগে একজন জুতাওয়ালার পরমাসুন্দরী মেয়েকে দেখেছিলাম; তার কথা আমার মনেই ছিল, এবং এখানে এসেই তার দোকানের দিকে গেলাম; কিন্তু গতকল্য যে ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে তাদের সে ক্ষুদ্র দোকান ঘরখানি নদীতে নেমে গিয়েছে, তারা কোথায় গিয়েছে কে তার উদ্দেশ্য বলে দেবে আর কাকেই বা সে কথা জিজ্ঞাসা করব।
আজ অপরাহ্নে আমরা ভজনী চটিতে রাত্রিবাস করি। এ চটির কথা আমার খাতায় বেশি কিছুই লেখা নাই।

৮ জুন - আজ আমরা এই দীর্ঘ প্রবাসের সঙ্গী অচ্যুতানন্দ ব্রহ্মচারীকে হারিয়েছি। তিনি পথে আসতে আসতে কয়েকজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হলে তাদের দলে মিশে ফিরে গিয়েছে। আমি আগে এসেছিলাম, স্বামিজী পরে, সর্বশেষে বৈদান্তিকের আসবার কথা। আমরা দুজনে এসে একটা চটিতে বসে বৈদান্তিকের জন্য অপেক্ষা করছি; তিনি আর এসে পৌঁছেন না। কতকক্ষণ পরে সেই পথে একজন সন্ন্যাসী এলেন; তিনি এসে আমাদের সংবাদ দিলেন যে, আমাদের সঙ্গী তাঁর মুখে বলে পাঠিয়েছেন যে, তিনি একজন সাধুর সঙ্গে মানসসরোবরের দিকে গেলেন; আমাদের মনে বড়ই কষ্ট হল। লোকটা এতদিন সঙ্গে ছিল; যাবার সময় একটি কথাও বলে গেল না, বা বিদায় নিয়ে গেল না। হঠাত্ রাস্তার ভিতর থেকে ফিরে চলে গেল। তার কি একবারও মনে হল না যে, আমরা দুইটি মানুষ তার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকব; এবং শেষে যখন শুনবো যে, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তখন আমাদের মনে যে একটা ভয়ানক কষ্ট হবে, সে ভাবনাটাও কি মায়াবাদী বৈদান্তিকের মনে ক্ষণকালের জন্যও ওঠেনি। আর যাকে সে সংবাদ দিতে বলেছিল, সে যদি সংবাদ না দিত, তার যদি সে কথাটা মনে না থাকতো, তা হলে ত আমরা দুইটি মানুষ সে দিন কেন দুই তিন দিন ধরে তাকে সেই বনপ্রদেশের পর্বতগাত্রে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যেতাম ! এ সব কথা তার মনে হলে সে অমন করে নিতান্ত অপরিচিতের মত আমাদের পরিত্যাগ করে যেতে পারত না। কে জানে ভগবান তাকে কোথায় নিয়ে গেলেন; এ জীবনে তার সঙ্গে আর দেখা হবে বলে মনে হল না। এতদিন একত্র ছিলাম, পথশ্রমে কাতর হলে তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়ে বেশ সময় কাটানো গিয়েছিল, বিপদে আপদে সে তার বিশাল বক্ষঃস্থল পেতে দিয়ে কতদিন আমাকে রক্ষা করেছে; - গতকল্যই আমার প্রতি স্নেহ প্রকাশ করেছে, আজ কি না সে অনায়াসে চলে গেল। পথে ছেড়ে যেতে কি তার প্রাণে একটি কথাও উঠেনি; দুইজন স্বদেশবাসী সঙ্গীকে সে অনায়াসে ফেলে চলে গেল। স্বামিজী বড়ই দুঃখ করতে লাগলেন এবং বললেন যে, তার অদৃষ্টে অনেক কষ্ট আছে। তাঁর সে কথা সত্যসত্যই ফলে গিয়েছিল। অনেকদিন পরে, বোধ হয় চার পাঁচ মাস হবে, একদিন রুগ্ন জীর্ণশীর্ণ দেহে অচ্যুতানন্দ স্বামী আমার দেরাদুনের বাসায় এসে পৌঁছেছিলেন এবং তাঁর সেই পঞ্চমাসব্যাপী কষ্ট যন্ত্রণার কাহিনী যা আমাকে বলেছিলেন তা শুনলে পাষাণও বিগলিত হয়। তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি তাঁকে কয়েকদিন বাসায় রাখি, তারপর তিনি আলমোড়ায় যাবেন বলে আমার নিকট হতে বিদায় নিয়ে যান। সেই হতে তাঁর আর কোনো সংবাদ পাইনি, কিন্তু এখনও তাঁর কথা মনে পড়ে; এখনও আমার এই দরিদ্র গৃহস্থালীর মধ্যে অচ্যুতানন্দকে পেলে আমি কত সুখী হই এবং তার সঙ্গে হিমালয়ের প্রবাস-কাহিনী বলে অতুল আনন্দ পেতে পারি।

এইদিন থেকে আমি আর ডাইরী রাখিনি। কোন দিন আমার ভ্রমণ কাহিনী মানুষের নিকটে বলতে হবে, সে কথা ত আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আর যে দেশে ফিরে আসবো, সে চিন্তা একদিনের জন্যেও আমার মনে হয় নি। ডাইরী লিখবার অভিপ্রায়ও আমার ছিল না। আমার সঙ্গে একখানি গানের বই ছিল, সেই বইখানি যখন ভাল করে বাঁধানো হয়, সেই সময়ে তাতে অনেকগুলি সাদা কাগজ জুড়ে রাখি, উদ্দেশ্য নূতন নূতন গান পেলে সেখানে লিখব। যখন নারায়ণের পথে যাই, সে সময়ে সেই খাতায় সাদা কাগজ দেখে স্বামিজী আমাকে কিছু লিখে রাখতে বলেন এবং তারই আদেশে যে দিন যেখানে যা দেখেছিলাম, তা লিখে রাখি। কিন্তু প্রত্যাবর্তেনের পথে শ্রীনগর অবধি এসে আর আমার লেখবার তেমন ইচ্ছা হল না। আসল কথা এই যে, যতই আমি লোকালয়ের দিকে নেমে আসছিলাম, ততই যেন কেমন করে আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল, আমার মনের অবস্থা ততই কেমন খারাপ হচ্ছিল। এ অবস্থায় কি আর রোজনামচা লিখে রাখবার ইচ্ছা হয়। বিশেষ যে পথে গিয়েছিলাম, সেই পথেই প্রত্যাবর্তন; নূতন ব্যাপার, নূতন দৃশ্য কিছুই আমার সম্মুখে পড়েনি; ডাইরী না লিখবার ইহাও একটি কারণ।

শ্রীনগর হিমালয়ের মধ্যে হলেও একটা লোকালয়। আমরা লোকালয়ে পৌঁছেছি। শ্রীনগরে আমার অনেক বন্ধু, অনেক ছাত্র আছেন, তাঁদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে আমি ফিরে আসি।

এখন আমার বিদায় গ্রহণের সময়। হিমালয়ের পরম পবিত্র মহিমা আমি কীর্তন করতে পারিনি। যেটি যেমন করে বললে ভাল হত, আমার দুর্বল লেখনী তা বলতে পারেনি। যে দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সর্বপ্রধান শিল্পী নিজের দুর্বল হস্তের অযোগ্যতায় কাতর হয়ে তুলিকা দূরে নিক্ষেপ করে সেই মহান দৃশ্যের সম্মুখে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেই কৃতার্থ হন, আমি সেই হিমালয়ের মহিমা বলতে গিয়েছিলাম - আমার স্পর্ধা কম নয় ! আর যে রকম করে দেখলে ঠিক দেখা হত, আমার তা মোটেই হয় নি। আমি শ্মশানের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা বুকে নিয়ে হিমালয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম; আমি শুধু দুই হাতে হিমালয়ের শীতল বাতাস, হিমালয়ের কঠিন বরফ বুকে চেপে ধরেছি; চারিদিকে যে স্বর্গের দৃশ্য জগত্পিতার অনন্তমহিমা অনুক্ষণ কীর্তন করত , আমার কি সে সব দেখবার শুনবার সময় ছিল, না তেমন আমার মন ছিল ? আমি তখন মাথা উঁচু করে কি আকাশের দিকে, স্বর্গের দিকে চাইতে পারতাম; সে ভাবই তখন আমার ছিল না। আমার হৃদয়ের মধ্যে যে কবিত্ব থাকলে মানুষ গাছের ফল, নদীর জল, ফুলের সৌন্দর্য, নির্ঝরিণীর কলতান, বিহঙ্গের হৃদয়মনোমোহন কূজন বর্ণনা করতে পারে, আমার সে কবিত্ব কোনোদিনই ছিল না। আমার কবিত্বানুভবের অবকাশ বা সুবিধা কোন দিনই হয় নাই, সুতরাং কিছুই বলা হয় নাই। আমার এই অতি সামান্য ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়ে যদি কারো প্রাণে হিমালয় দর্শনের ইচ্ছা প্রবল হয়, তাহা হলেই আমার এ সব লেখা সার্থক হবে, এবং সেই হিমালয়ের দেবতা ভগবানের চরণে যদি কেহ অগ্রসর হতে পারেন, তা হলে আমার জীবন সার্থক হবে।


সমাপ্ত

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.