প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২৪)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩)
(২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

ব্যাসগুহা

৩০ মে, শনিবার। - মন্দির মেরামতের জন্য পাঁচটাকা দান করে এবং সেই দানের কথা ইংরেজি অক্ষরে নাম সহি দ্বারা খাতাভুক্ত করে বদরিনাথের প্রধান পাণ্ডা - মহাত্মা শঙ্করাচার্যের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধির নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করলাম। সে সময়ে মনে একটা বড় আক্ষেপ জেগে উঠেছিল। কোথায় সেই জ্ঞান এবং ধর্মের অবতার মহাপণ্ডিত, নরদেবতা শঙ্করাচার্য - আর কোথায ঘোর সংসারী বিষয়াসক্ত, পাণ্ডিত্যহীন, ব্যসননিরত এই সর্দার-পাণ্ডা। মহান হিমালয়ের অভ্রভেদী উচ্চতা হতেও সমুচ্চ মহত্ব ও জ্ঞান একদিকে, আর ক্ষুদ্র ধূলিকণা হতেও ক্ষুদ্রতর এই পাণ্ডাপুত্রটির আত্মাভিমান এবং ক্ষমতা-দর্প আর একদিকে; এ দুইয়ের মধ্যে তুলনা হয় না, কিন্তু তবু উভয়ের অবস্থান তুলনার উপযোগী। বাস্তবিক যাঁর উৎসাহের তেজে পৃথিবীপ্লাবিত বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ হতে নির্বাসিত হয়েছিল, হিন্দুধর্মের সংস্কারে বদ্ধপরিকর হয়ে যিনি সমস্ত হিন্দুজাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে গেছেন, এবং সকলের অশান্ত আকুল হৃদয় গভীর আশাভরে যাঁর উপর নির্ভর করে শান্তিলাভ করেছিল, সেই শঙ্কর ও তাঁর এই পাণ্ডা, এ উভয়ে এক জাতীয় জীব তা বিশ্বাসই হয় না। শঙ্করাচার্যের দুর্ভাগ্য - এরা সকলে আসন কলঙ্কিত করছে। এই স্থানের সম্বন্ধে পরে যে সকল কথা শুনেছি, তা আর কাগজে কলমে লেখা যায় না, এমনই অপবিত্র কথা ! তীর্থস্থানের অধিনায়কগণের কথা অনেকেই শুনেছেন; দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত অর্থ কিরূপে অযথা ব্যয়িত হয়, তার নূতন দৃষ্টান্ত প্রয়োগ নিষ্প্রয়োজন। চক্ষের সম্মুখে আজও কলিকাতার প্রধান বিচারালয়ে অকারণে রাশি রাশি অর্থ জলস্রোতের মত ভেসে যাচ্ছে। দুখ-তাপ-পাপক্লিষ্ট শত শত নরনারী তাহাদের বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থের দুই একটি পয়সা বাঁচিয়ে তাই নিয়ে তীর্থদর্শন করতে যায়, দেবচরণে সেই কষ্টোপার্জিত অর্থ দিয়ে আপনাকে কৃতার্থ বোধ করে; আর মঠের অধিকারী মহাশয়েরা বিলাস-লালসা তৃপ্তির জন্য সে অর্থ যা খুশি তাতে ব্যয় করেন।

বাইরে এসে দেখি স্বামিজী ও অচ্যুত বাবাজি আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। এইবার আমাদের মধ্যে প্রথম কথা উঠলো, এখন কোথায় যাওয়া যায় ? বাস্তবিকই এবার আমাদের নিরুদ্দেশ যাত্রা। যেখানে ও যে পথে লোক যায়, এত দিনে আমরা তা শেষ করলাম; এইবার হতে এক নূতন পথে যেতে হবে। সে পথে কখনও লোক চলে না, এবং যাত্রী দলও সে পথে যেতে আগ্রহ করে না। এই নূতন পথ দিয়ে আমাদের ব্যাসগুহা দেখতে যেতে হবে। নূতন পথে চলতে একজন পাণ্ডার সাহায্য লওয়া ভাল, স্থির করে একবার লছমীনারায়ণ পাণ্ডার খোঁজ করা গেল। সে পূর্বদিন রাত্রেই বদরিকাশ্রমে এসে সশরীরে হাজির হয়েছে। লছমীনারায়ণ দেবপ্রয়াগে আমাদের ভরসা দিয়েছিল যে শীঘ্রই সে নারায়ণ মন্দিরে এসে পৌঁছবে; কিন্তু, এত শীঘ্র আসবে তা একদিনও আমাদের মনে হয় নি ! তার এত তাড়াতাড়ি আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, নারায়ণ দর্শন জন্য যে ব্যাকুল হয়ে সে এসেছে তা নয়, কাশীনাথ জ্যোতিষী মহাশয় তার একজন সম্ভ্রান্ত যজমান; তাঁর কাছে বিলক্ষণ দশটাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা, কিন্তু "রামনাথ কি চাচীর" দ্বারা সে কাজটা যথা-বিহিত সম্পন্ন হবে, লছমীনারায়ণের সে আশা ছিল না; তাই সে প্রাণপণে হেঁটে এসেছে। জ্যোতিষী মহাশয় সেই রাত্রেই বদরিনাথ পৌঁছেছেন। আমরা তাঁকে পাণ্ডুকেশ্বরে রেখে এসেছিলাম; তারপর আমরা ঘুরতে ঘুরতে আসছি, তিনি বাহকস্কন্ধে নির্ভাবনায় আসছিলেন; সুতরাং আমাদের আগেই তাঁর এখানে পৌঁছিবার সম্ভাবনা বেশি ছিল।

আমাদের সঙ্গে ব্যাসগুহা পর্যন্ত যাবার জন্য লছমীনারায়ণকে বলা গেল; কিন্তু এ প্রস্তাব সে অস্বীকার করল; বলল, তার অনেক যাত্রী রাত্রে এসেছে, পরদিন সকালেও অনেকে এসে পৌঁছবে। এ রকম অবস্থায় তাদের নারায়ণ দর্শনের ব্যবস্থা না করে সে আমাদের সঙ্গে কি রকম করে অতদূর যায়। এ ছাড়া ব্যাসগুহা তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত; এবং এ পর্যন্ত কোন যাত্রী সে পথে অগ্রসর হয় নি। বিশেষ ব্যাসগুহা একটা তীর্থ বলেই গণ্য নয়। তার কথায় মন কেমন দমে গেল। কিন্তু এখান থেকে ফিরে যাওয়া হচ্ছে না; আর খানিকটা যেতেই হবে, সুতরাং এ পথে যাওয়াই ভাল। স্বামিজী ও আমি এ রকম সিদ্ধান্ত করে ফেললাম। বৈদান্তিক ভায়ার সাংসারিক আকর্ষণ কিছু ছিল বলে বোধ হয় না; কিন্তু এ পথে অগ্রসর হতে তিনি বিষম নারাজ; আমার ও স্বামিজীর মতলব শুনে তিনি ভীষণ চটে উঠলেন; বললেন, পাণ্ডারা যে পথ চেনে না তীর্থযাত্রীরা সে স্থানকে তীর্থের হিসাবে নগণ্য মনে করে, সেখানে এত কষ্ট করে যাবার কি দরকার ? শরীরকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়াই যদি অভিপ্রেত হয়, তবে তার অনেক উপায় আছে। আমি ভায়ার উপর রাগ করে বললুম, "তুমি বৃথা তীর্থভ্রমণের উদ্দেশ্যে এতকাল অতিবাহিত করলে। শুধু যাত্রীনির্দিষ্ট তীর্থে ঘুরে মন্দির এবং ঠাকুর দেখেই কি তুমি তোমার জীবনকে ধন্য ও হৃদয়কে পরিতৃপ্ত বোধ কর ? এই হিমালয়ের মহান গম্ভীর শান্তিপূর্ণ ক্রোড়ের মধ্যে কি এমন কোন তীর্থ নেই, যাকে যাত্রীদের দেবতা এবং দেবমন্দিরে পবিত্র ও বিখ্যাত না করলেও প্রকৃতির বিচিত্র শোভা এবং শান্তির কোমল উৎসে তা সমলঙ্কৃত ?" বক্তৃতার দ্বারা ভায়াকে বিলক্ষণ বাধ্য করা গেল সুতরাং অবিলম্বেই তিনি আপত্তি ত্যাগ করলেন।

আমাদের যখন এই রকম তর্কবিতর্ক চলছিলো, সেই সময় সেখানে দু'-চারজন প্রৌঢ় পাণ্ডা উপস্থিত ছিলেন। আমরা ব্যাসগুহা দেখবার জন্য উৎসুক হয়েছি শুনে তাঁরা সকলেই ভারি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, সেখানে যাবার কোনও রকম বন্দোবস্ত নেই; অলকানন্দা পার হতে হবে, কিন্তু কোথাও সাঁকো নেই; নদী জমে শক্ত হয়ে গিয়েছে; তারই উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে কোনও রকমে পার হতে হবে। হঠাৎ একটা চাপ বসে গিয়ে সবশুদ্ধ ডুবে যাবার কিছুমাত্র আটক নেই ! একজন পাণ্ডা বললেন, কিছুদিন আগে একজন অলকানন্দা পার হতে গিয়ে বরফ ভেঙে ডুবে গিয়েছিল। অতএব সেখানে যখন দেখবার যোগ্য কিছু নেই, তখন এত কষ্ট করে যাবার কি আবশ্যক ? আমরা কিন্তু এ যুক্তিতে কর্ণপাত করলাম না, এবং বলা বাহুল্য এ রকম যুক্তি অনুসারে চললে, আর এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হবার সম্ভাবনাই থাকতো না।

বরাবর এই একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখে আসা যাচ্ছে যে, যে সমস্ত যাত্রী তীর্থভ্রমণ করতে আসে, তারা শুধু দেবমন্দির ও দেবতা ছাড়া আর কিছুতেই মনোনিবেশ করে না। হয় তো তারা সেটা বাহুল্য জ্ঞান করে ; না হয়, একমনে, একপ্রাণে অভীষ্ট দেবতার চিন্তাতেই তারা তন্ময় হয়ে থাকে, এবং তাতেই তারা এমন নিবিষ্টচিত্তে পথ চলে যে, চতুর্দিকে আর যা কিছু দেখবার আছে, তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের অবসর পায় না। এ পর্যন্ত কত তীর্থযাত্রীর সাথে দেখা হল; তারা বাহ্যপ্রকৃতির সৌন্দর্য, চতুর্দিকের অভিনব দৃশ্যরাজির বৈচিত্র্যসম্বন্ধে কোন কথাই বলে না।

যাহা হউক, আপাতত ব্যাসগুহার উদ্দেশ্যেই রওনা হওয়া গেল। বদ্রিকাশ্রম ত্যাগ করে চলতে আরম্ভ করলাম। তিনটি প্রাণী পূর্ববৎ চলছি বটে, কিন্তু পথ অনির্দিষ্ট, অধিকতর দুর্গম এবং একান্ত নির্জন। চলতে চলতে ক্বচিৎ যদি কোন লোকের সঙ্গে দেখা হয় তো পথের কথা জিজ্ঞাসা করলে সে একটু অবাক হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকে; তার পর বলে, "ইস্‌ তরফ কৈ জায়গা পর হোগা, মালুম নেহি," সুতরাং অন্য লোকের কাছে পথের সন্ধান জানার আশায় নিরাশ হয়ে আমরা নির্বাক ভাবে এবং কতকটা সন্দিগ্ধচিত্তে অলকানন্দার ধারে ধারে চলতে লাগলাম। আগে পাছে সেই উন্নত পর্বতশ্রেণী তুষারাচ্ছন্ন, বন্ধুর, তরুতৃণহীন; পর্বতের অন্ত নেই; মধ্যে শুধু সঙ্কীর্ণ বঙ্কিম অধিত্যকা ভেদ করে অলকানন্দা অস্ফুটশব্দে ছুটে চলেছে এবং তার কম্পিত জলপ্রবাহ কঠিন প্রস্তরভিত্তিতে এসে ধীরে ধীরে আঘাত করছে। ক্রমে বরফের স্তূপ আবার দৃশ্যমান হয়ে পড়লো। অলকানন্দার জলধারা অদৃশ্য হয়ে এলো; অবশেষে বরফের নদী ভিন্ন আর কিছুই দেখা গেল না। কঠিন বরফরাশিতে নদীগর্ভ সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন।

অনেকক্ষণ চলার পর আমরা তুষারাচ্ছন্ন নদীতীরে এসে দাঁড়ালুম। চারিদিকে শুধু ধু ধু করছে। নিম্নে ঊর্ধ্বে যে দিকে চাই শুধু বরফ; পথের চিহ্ন নেই, নদীর চিহ্ন নেই, গন্তব্যস্থল কোন দিকে ঠিক নেই, দিঙ্‌নির্ণয়ের পর্যন্ত উপায় নেই। আমরা তিন জনেই দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে বরফ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। যে দিক থেকে আমরা এসেছি, সে দিক ঠিক আছে - এখনও ফিরে যেতে পারি। অনির্দিষ্ট বিপদের মুখে প্রবেশ করবার পূর্বে আর একবার ভেবে দেখলাম; তার পর ভগবানের নাম স্মরণ করে নদী পার হওয়াই স্থির করলাম।

ব্যাসগুহা যে কোথায়, তা এখনও পর্যন্ত স্থির হয়নি। স্বামিজীর বিশ্বাস, আমাদের সম্মুখের পর্বতের গায়েই নিশ্চয়ই ব্যাসগুহা দেখতে পাওয়া যাবে। স্বামিজীর অনুমানের উপর নির্ভর করেই নদী পার হতে প্রবৃত্ত হলাম। এখানে নদী পার হওয়া বড়ই দুঃসাহসের কাজ। আগেই বলেছি, নদীর উপর কোনও সাঁকো নেই, তার উপর কোন স্থানে বরফ কি অবস্থায় আছে তা নির্ণয় করা দুরূহ। আমরা যে বরফরাশির উপর দাঁড়িয়ে আছি, তার নীচেই যে নদী নেই তারই বা ঠিক কি ? অতএব আর বেশি চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি চলতে লাগলাম। বৈদান্তিক তার দীর্ঘ পার্বত্য-যষ্টি হস্তে পথিপ্রদর্শক হলেন। এক পা এক পা অগ্রসর হন, আর যষ্টিগাছাটি বরফে বসিয়ে দিয়ে জমাট বরফের গভীরতা পরীক্ষা করেন। আমিও বৈদান্তিকের সঙ্গে সঙ্গে চলতে প্রস্তুত হলাম, কিন্তু স্বামিজী আমাকে ভারি ধমক দিয়ে হটিয়ে দিলেন, এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে অনুমতি করলেন; আরও বললেন, যদি আমি তাঁর কথার অবাধ্য হই, তবে তিনি তখনই সেখান থেকে ফিরে যাবেন; আমার মত উচ্ছৃঙ্খলমতি বালকের সঙ্গে তাঁর চলা পুষিয়ে উঠবে না। আমি হাস্যমুখে তাঁকে নির্ভয় হতে বললাম। কিন্তু তিনি পুনশ্চ ভয় দেখিয়ে বললেন, হঠাৎ আমার পা দুটো আমর অজ্ঞাতসারে বরফের মধ্যে বসে যেতে পারে, তখন পা টেনে তোলা তাঁদের দুজনের সাধ্যায়াত্ত হবে না। অগত্যা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলাম, বুঝলাম স্বাধীনতা না থাকলে স্বর্গেও সুখ নেই, কিন্তু স্বামিজীর স্নেহ-কোমল ভর্ৎসনায় মনে অধীনতার সন্তাপ স্থান পায় না। আসল কথাটা এই, আমরা যে নদীর উপর দিয়ে চলে যাচ্ছি, সেই নদী যে কোনও মুহূর্তে আমাদিগকে তার হৃদয়ে চিরদিনের জন্য আশ্রয় দিতে পারে। আমি আগে গেলে আমিই আগে মারা যাবো, এই ভয়ে স্বামিজী আগে গেলেন, - নিজের জীবন সংকটাপন্ন করে তিনি আমাকে বাঁচাবেন বলেই তাঁর ভর্ৎসনা ! হায় সন্ন্যাসী ! কি মায়ার বাঁধনেই তুমি আটকে পড়েছ।

সেই তুষারাচ্ছন্ন নদীর পরিসর কতখানি তা জানা নেই, সুতরাং আমাদের সকলকে অতি সন্তর্পণে পদক্ষেপ করতে হল। অনেকক্ষণ হতে চলছি, কিন্তু তবু সতর্ক হয়ে যেতে হচ্ছে। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম বৈদান্তিক ও স্বামিজী দুজনেই বেশ স্বচ্ছন্দভাবে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের আকার প্রকারে এবং গতিতে ভয়ের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না; কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার মনে বিলক্ষণ ভয়ের সঞ্চার হচ্ছিল। সংসারের বন্ধন কাটিয়েছি, সন্ন্যাস অবলম্বন করা গেছে, পৃথিবীতে সুখ নেই, এবং বেঁচে থাকবার যে কিছু প্রলোভন তাও দূর হয়েছে, কিন্তু তবুও জীবনের মায়া বিসর্জন দিতে পারি নি। যার কোনও কাজ নেই, সেও জীবনটাকে মূল্যবান মনে করে। জীবন বিসর্জন দেওয়া সহজ বলে মুখে যতই আস্ফালন করি না কেন, যখন বিপদের মেঘ চারিদিকে ঘন হয়ে আসে এবং সংসারের উন্মত্ত তরঙ্গ ফেনিল হয়ে ওঠে, তখন আমরা নিরাশ্রয় হাত দুখানি কৃতাঞ্জলিবদ্ধ করে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি; তখন আমরা বুঝতে পারি, আমরা শুধু কাপুরুষ নই, ভগবানের চিরমঙ্গল ইচ্ছার উপর নির্ভর করতেও আমরা অশক্ত; আমরা দুর্বল এবং বিশ্বাসহীন।

অনেকক্ষণ পরে একটা চড়াইয়ের উপর উঠা গেল, তখন নির্ভয় হলাম, কারণ সেটা আর নদীগর্ভ হতে পারে না। পাহাড়ের উপরে উঠে অনেক অনুসন্ধানেও ব্যাসগুহার কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। চারিদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও গুহার নামও নেই। ছোট ছোট দু'একখানি গুহা থাকলেও তা বরফে ঢাকা। পাহাড়ের অনেকখানি ঘুরে বহুকষ্টে সেই উঁচু জায়গাটাতে উঠলাম। স্বামিজী শুনেছিলেন, বরফাচ্ছন্ন পর্বতের মধ্যে ব্যাসগুহার সম্মুখে কিছুমাত্র বরফ নেই, সে জায়গাটা শৈবালদলে সমাচ্ছন্ন। এইস্থানে উপনীত হবামাত্র সেই দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে গেল, সুতরাং আমরা সহজেই বুঝতে পারলাম, এ জায়গাটাই ব্যাসগুহার সম্মুখভাগ। এত ভয়, উদ্বেগ এবং পরিশ্রমের পর আমাদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু আবিষ্কৃত হল দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দ বোধ করলাম। বাঙালির ছেলে লিভিংস্টোন, স্ট্যানলের মত বিপদসংকুল অনাবিষ্কৃত দেশ আবিষ্কার করিনি এবং জীবনে সে আশাও নেই, কিন্তু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অন্ধভাবে রাস্তা হাতড়ে ব্যাসগুহায় উপস্থিত হওয়াতে আমার মনে ভারি অহংকারের সঞ্চার হল। মনে করতে লাগলাম, দায়ে পড়লে আমরাও লিভিংস্টোন, স্ট্যানলের মত একা একটা বৃহৎ কাজ করে ফেলতে পারি। সমস্ত বিশ্ব-সংসারের লোক তখন বিস্ময়-বিহ্বল নেত্রে এই বঙ্গবীরের দিকে চেয়ে কি ভাববে, তা কল্পনা করে বেশ আরাম বোধ হল এবং অনেকখানি আত্ম-প্রসাদও ভোগ করা গেল।

ব্যাসগুহার সম্মুখের প্রাঙ্গণটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, একটা ছোট অনাবৃত উঠানের মত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখানে বিন্দুমাত্র বরফ নেই, অথচ আশেপাশে স্তূপাকার বরফ। সেই ঋষিশ্রেষ্ঠের কোন মায়ামন্ত্র বলে চিরদিনের জন্য এখান থেকে বরফরাশি তিরোহিত হয়েছে, তা আমাদের মত ক্ষুদ্র মানব-বুদ্ধির অগম্য। আমরা অবাক হয়ে তার কারণ খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোনও কারণই নির্দেশ করতে পারলাম না। এই বরফহীন গুহাপ্রাঙ্গণটি যে নীরস কালো পাথরমাত্র, তাও নয়; পাথরের উপর ক্রমাগত জল পড়লে যেমন একরকম সবুজ পাতলা শেওলা জন্মে, এখানে তেমনি জন্মিয়ে আছে। আর শৈবালদল পাতলা নয়, গালিচার আসনের মত পুরু; তার রং বড় চক্ষুতৃপ্তিকর, বিশেষত তার মধ্যে আবার ছোট ছোট লাল ও সাদা ফুল ফুটে প্রকৃতির হস্তনির্মিত সেই আসনখানিকে আরও সুন্দর এবং প্রীতিকর করে তুলেছে।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেই মনোহর আসনখানির দিকে চেয়ে রইলাম। সেই পুরু শৈবালরাশির উপরে খুব ছোট ছোট লাল ও সাদা ফুল ফুটে রয়েছে, তাতে আসনখানিকে মণিমুক্তাখচিত বলে বোধ হচ্ছে। এমন আশ্চর্য দৃশ্য আর কখনো দেখেছি বলে মনে হল না। এ রকম জিনিস আমার কাছে এই নূতন। আমার সঙ্গে কোন বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত থাকলে হয় তো এই বরফ রাজ্যে এ রকম প্রাকৃতিক-বৈচিত্র্যের কারণ অবগত হবার জন্য চেষ্টা করতেন এবং হয় তো কৃতকার্যও হতে পারতেন; কিন্তু আমরা কেহই বৈজ্ঞানিক নই; কোন একটা সুন্দর জিনিস দেখলে তাকে বিশ্লেষণ না করে তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করেই কেবল আমরা আনন্দিত হই। জ্যোৎস্না-পুলকিত শুভ্র শারদ যামিনীতে পূর্ণচন্দ্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষুদ্র শিশু হতে প্রেমিক কবি পর্যন্ত সকলেই সুখ এবং তৃপ্তি অনুভব করে। চন্দ্র কি বস্তু, দূরবীক্ষণ যন্ত্রে তাকে পর্যবেক্ষণ করলে তার মধ্যে কতকগুলি পর্বত, সাগর এবং মরুভূমি আবিষ্কার করা যায়, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়, কিন্তু তাঁর এই গবেষণাজনিত আনন্দ, শিশু ও কবির আনন্দ অপেক্ষা অধিক কি না তা কে বলবে ? ইদানীং বৈজ্ঞানিকেরা প্রমাণ করবার চেষ্টা করছেন যে, মঙ্গলগ্রহে মনুষ্য অপেক্ষা উচ্চশ্রেণীর জীবের বাস আছে। সেই সকল অপার্থিব প্রাণী ক্রমাগত লাল আলো দেখিয়ে আমাদের পৃথিবীর মনুষ্যের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করবার চেষ্টা করছে আর একজন কবি হয় তো সেই মঙ্গল গ্রহকে অনন্ত গগনোদ্যানের একটি লোহিত কুসুম বলে বিশ্বাস করেই সন্তুষ্ট। হয় তো এ ভ্রম; কিন্তু কত সময় আমরা ভ্রান্তিতেই সন্তুষ্ট থাকি। আমাদের মত উদ্দেশ্যহীন জীবনের সুদীর্ঘ যাত্রাটাই কি ভ্রম নয় ? কিন্তু এ ভ্রম দূর হয়ে যায়, আমরা স্বপ্ন হতে হঠাৎ জেগে উঠি এবং কঠোর সত্যের অতিপরিস্ফুট কঠিন শিলাতলে নিক্ষিপ্ত হই, তখন শান্তির আশায় আর একটা অভিনব ভ্রমের কুহক রচনার জন্য আমাদের প্রাণ আকুল হয়ে উঠে।

যা হোক, এ দার্শনিক তত্ত্ব এখানে থাক। ব্যাসদেবের আসন দেখতে দেখতে মাথার মধ্যে এতখানি দার্শনিক ভাব জাগিয়ে তোলা অনেকেরই বাহুল্য বোধ হবে। আসন-দর্শন ত্যাগ করে আমরা তিন জনেই গুহার মধ্যে প্রবেশ করলাম। ব্যাসগুহার নাম শুনে ভেবেছিলাম, এ বুঝি একটা ছোট গুহা; তার মধ্যে ব্যাসদেব এবং বড় জোর তাঁর লোটা কম্বল ধরতে পারে; কিন্তু গুহায় প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, সে এক প্রকাণ্ড গহ্বর, তার মধ্যে এক-শো দেড়-শো লোক অনায়াসে বসতে পারে; তার মধ্যে বিস্তীর্ণ দেওয়াল, তাতে যুগান্তের কালি ও ধোঁয়ার দাগ লেগে আছে। ব্যাসদেবের গুহা, কাজেই এখানে যাগযজ্ঞের অভাব ছিল না, এ হয় তো তারই ধোঁয়ার চিহ্ন ! আমি কল্পনাচক্ষে মহাভারতীয় যুগের হোম যজ্ঞ সমাকীর্ণ এই সুবিস্তীর্ণ আশ্রমে একটি শান্তিপূর্ণ পবিত্র তপোবনের চিহ্ন দেখতে পেলাম। শুনেছি থিওজফীষ্ট মহাশয়েরা বলেন, এক একটা জায়গায় বৈদ্যুতিক হাওয়া খুব ভাল; সেই সেই জায়গা হিন্দুদিগের তীর্থস্থান। এ কথাটা কতদূর সত্য তা জানি নে। এ জায়গাটা যদিও তীর্থের লিস্ট হতে নিজের নাম খারিজ করেছে, তবু যে শান্তি পবিত্রতা ও স্বর্গীয়ভাব এই গিরি-অন্তরালে সংগুপ্ত আছে, অনেক তীর্থে তা একান্তই দুর্লভ। আমরা গুহার মধ্যে অনেকক্ষণ বসে রইলাম, পৌরাণিক স্মৃতির তরঙ্গ আমাদের প্লাবিত করতে লাগলো ! এমন স্থানে এসে কি গান না করে থাকা যায় ? স্বামিজী আমাকে গান করতে অনুরোধ করলেন, এবং নিজেই আরম্ভ করলেন --
"মিটিল সব ক্ষুধা, তাঁর প্রেমসুধা,
চলো রে ঘরে লয়ে যাই। "
পথশ্রমে এই দারুণ ক্লান্তির পর ভাঙা গলাতে গুহা প্রতিধ্বনিত করে এই গানটি বার বার গাওয়া গেল; এমন মিষ্টি লাগলো যে, নিজেরাই মোহিত হয়ে পড়লাম। যাঁরা ভাল গায়ক তাঁরা এখানে গান আরম্ভ করলে বুঝি পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যায় ! আমি দুই এক পালটা গেয়ে ছেড়ে দিতে চাই, স্বামিজী আবার আর একটি গান আরম্ভ করেন। আমাকে আবার গাইতে হয়, তাঁর ক্ষুধা যেন আর মেটে না; শেষটা তাঁকে দেখে বোধ হল, তাঁর যেন কিছুতেই তৃষ্ণা মিটল না।

আমরা এইভাবে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলাম। বেলা একটা বেজে গেল; আর বেশি দেরি করলে পথে কোনও বিপদে পড়তে পারি মনে করে আবার উঠে পড়লাম ! তবু কি সেখান থেকে উঠতে ইচ্ছা করে ? আর সেখানে আসবো সে আশা নেই ভেবে, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে স্থান থেকে বিদায় নিলাম। এমন কত স্থান হতে বিদায় নিয়েছি, ভবিষ্যতে আরও কিছু সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাব, এই আশাতেই এমন সকল স্থানের প্রলোভন ছাড়তে পেরেছি, নতুবা হয় তো চিরজীবন এই সকল পুণ্যদৃশ্যে কাছে পড়ে থাকতাম।

গুহা ত্যাগ করে তিন জনে নদীতীরে এলাম। যে রাস্তা দিয়ে নদী পার হয়েছিলাম, তার চিহ্ন মাত্র দেখা গেল না, সুতরাং আবার পূর্ববৎ সন্তর্পণে নদী পার হতে হল, কিন্তু নদী পার হয়ে দেখি আমাদের পথ ভুল হয়ে গেছে। তখন ব্যাকুল হয়ে পথ খুঁজতে লাগলাম এবং তিন মাইলের জায়গায় সাত মাইল ঘুরে অপরাহ্ণ পাঁচটার পর বদরিকাশ্রমে পুনঃপ্রবেশ করলাম। আমাদের বিলম্ব দেখে পাণ্ডা বাবাজিরা আমাদের নামে খরচ লিখে বসেছিল; আমাদের সশরীরে এবং সুস্থভাবে ফিরতে দেখে তারা খুব খুশি হল এবং আমরা কি দেখলাম তা বলবার জন্য আমাদের অনুরোধ করল। লোকগুলি বুদ্ধিমান সন্দেহ নাই: আমাদের এত কষ্টের অভিজ্ঞতা দুটি বাহবা দিয়েই আয়ত্ত করে নিতে চায়।

(চলবে)

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.