প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২৩)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩)
(২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

বদরিকাশ্রমে নারায়ণ দর্শন

বৈদান্তিকের কথার পর আমার কিঞ্চিৎ নিদ্রাকর্ষণ হলেও অতি সকালেই জেগে উঠেছিলাম। কোনো স্থানে উপস্থিত হলে অনেক সময় রাত্রে ঘুম তত গভীর হয় না এবং সকালে সহজে নিদ্রাভঙ্গ হলে প্রাণের মধ্যে যেন একটা অভাব অনুভূত হয়। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় যে দিন বিদেশে যাই, তার পরদিন নিদ্রাহীন প্রভাত কেমন অপ্রসন্ন এবং স্নিগ্ধতাবাহী বলে বোধ হয়েছিল। তারপর আর কত বিদেশে বেড়ালাম, এই শেষে কয় বৎসর তো নিত্য নূতন বিদেশে; তবে আজ প্রভাতে উঠেই প্রাণের মধ্যে একটা অভাব অনুভূত হলো কেন ? এ কি মায়া ? মায়াবাদের ঊর্ধে যাঁহার অবস্থান, তাঁহার পুণ্যমন্দিরের দ্বারেও মায়ার প্রভাব।

যা হোক, সে জন্য দেবতার প্রতি আমার অভক্তি হয় নি। শঙ্করাচার্যের সমুজ্জ্বল প্রতিভা মানব মস্তিষ্ককে বিস্মিত করেই ক্ষান্ত হয় নি; তাঁর ধর্মানুরাগ, অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে শৃঙ্খলাসাধনের জন্য যত্ন, মানবজাতির প্রতি অপক্ষপাত সহানুভূতির পরিচয়, এই মন্দির সগর্বে বহন করছে। এখানে এসে সর্বপ্রথমেই আমাদের হৃদয়ে যে সুপবিত্র মহৎ গীতটি ধ্বণিত হলো, অনেক দিন আগে কলিকাতার আদি ব্রাহ্ম সমাজের এক বার্ষিক অধিবেশনে কোন শ্রদ্ধেয় গায়কের কণ্ঠে তা গীত হতে শুনেছিলাম। সে দিন এগারোই মাঘের প্রভাত, বাহিরে সমুজ্জ্বল সূর্যকিরণ এবং প্রভাতের তুষার শীতল বায়ু প্রবাহ, কিন্তু মণ্ডপের মধ্যে শত শত সহৃদয় ভক্তের সমাগম হয়েছিল। তাঁরা সংযত-হৃদয়ে সচ্চিদানন্দের উপাসনায় মগ্ন, অন্যদিকে উচ্ছ্বাসময়ী ভাষায় ধ্বণিত হচ্ছিল -

"গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।
ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে,
সকল বনরাজি ফুটন্ত জ্যোতিঃ রে।
কেমন আরতি হে ভবখণ্ডন তব আরতি,
অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে। "

দেবমন্দিরের চারিপার্শ্বে যে পূণ্য ও পবিত্রতা বিস্তৃত আছে, তাই আমাদের অনেক ঊর্ধে নিয়ে যেতে পারে; কিন্তু তীর্থস্থানের দূরদৃষ্ট, বদরিকাশ্রম ভিন্ন আর কোথাও এই সুখ শান্তি স্নিগ্ধভাবে আছে কি না জানি না। আমি ত অনেক দিনই অনেক স্থান হতে অপূর্ণ-হৃদয়ে সরে গিয়েছি। আমার হৃদয় শুষ্ক, ভক্তিহীন, হয় ত তার ঠিক ভাব গ্রহণ করতে পারি নি; তাই বুঝি আশা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু যে দৃশ্য দেবমন্দিরে সর্বদা দেখা যায়, তাতে শুধু আমি কেন অনেকেই ব্যর্থ মনোরথ হন। হয় ত কোথাও খর্পরাঘাতে ছাগ-শিশুর মস্তক রক্তসিক্ত হয়ে ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, কতকগুলি নির্দয় লোক রাক্ষসের ন্যায় নৃত্য করছে; আর কেহ কেহ ভক্তিভরে "মা, মা" চীৎকার করছে। এই সকল ভয়ানক দৃশ্যের মধ্যে ভক্তি যে কিরূপে অব্যাহত থাকে, তা বুঝে উঠা আমাদের সাধ্য নয়। আবার কোথাও বা যত রকম মন্দ লোক দল বেঁধে একটা মহা হট্টগোল আরম্ভ করেছে; সে সকল জায়গায় পিতৃ-পিতামহের শ্রাদ্ধ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী তিন লাখ তেষট্টি হাজার বংশধরকে স্বর্গে পাঠানর অতি সহজ ব্যবস্থা হচ্ছে; যে কোন রকমে সংসারের কাজ শেষ করে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারলেই মানবজন্ম সার্থক হলো। এখানে কিন্তু তার কিছু সূচনা দেখা গেল না, যেন এখানে অনুষ্ঠান আছে, তার উপদ্রব নেই; মাতৃস্নেহ আছে পুত্রের ভক্তিরও অভাব নেই; সরল ভাব বহুকালের উন্নত-কল্পনা এখানে যেন জমাট বেঁধে তার উপর একটা মহান দেবমহিমা প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। সেই মহিমা অনুভব করে আমরা পরিতৃপ্ত হয়ে যাই, জীবনকে ধন্য বলে মনে হয়। দেব-মন্দির ও দেবতা অপেক্ষাও তাঁদের পুণ্য-স্মৃতি অধিক সৌরভময়।

ক্রমে পূর্বদিক পরিষ্কার হলে আমার দেবদর্শনস্পৃহা বলবতী হয়ে উঠলো। প্রত্যুষে বোধ হলো, কে যেন স্নিগ্ধ রাগিণীতে সন্তোষ ও সম্ভ্রমময় আগ্রহ ঢেলে দিচ্ছে; সেই ললিত মধুর শব্দ পৃথিবীর বাদ্যযন্ত্র হতে ধ্বণিত হয় না; সেই মঙ্গলবাদ্য পৃথিবীর শোকসন্তপ্ত, দুঃখভারাবনত, পাপক্লিষ্ট পথিকের কর্ণে অভিনন্দন সংগীতরূপে প্রতীয়মান হয়।

৩০ মে, শনিবার। সূর্যোদয় হলো। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে নারায়ণ দর্শন করতে বের হয়ে পড়লাম; কিন্তু শুনলাম বেলা আটটার আগে মন্দিরের দ্বার খোলা হয় না; কাজেই কিয়ৎক্ষণ এদিক ওদিক করে বেড়াতে লাগলাম। মন্দিরের চকের বাহিরে একটা ক্ষুদ্র ঘরে ডাকঘর বসেছে। এটি সাময়িক পোস্ট অফিস; যাত্রীর যাতায়াত বন্ধ হলে এ পোস্ট অফিসও বন্ধ হবে। ডাকঘরে টিকিট খাম, পোস্টকার্ড প্রভৃতি দরকারি সকল জিনিসই পাওয়া যায়। পোস্টমাস্টারটি গাড়োয়ালী; দিব্যি গৌরবর্ণ গোলগাল চেহারা এবং মাথায় এক বিরাট পাগড়ি। লোকটা লেখাপড়া অতি সামান্য জানে; ইংরেজি নাম ও ঠিকানাগুলো কোন রকমে পড়তে পারে। আমি খানকতক পোস্টকার্ড কিনে দেশে চিঠি লিখতে প্রস্তুত হলাম। শীতে হিঁ হিঁ করে কাঁপছি, আর বহু কষ্টে অঙ্গুলির আগা বের করে কোনো রকমে কলম ধরে বাংলাদেশে এই পোস্টকার্ড কখানি লিখছি। এই কার্ডগুলি পাঁচ সাত দিন পরে হয় তো বঙ্গের একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে একটি সামান্য পরিবারে একজন প্রবাসীর সুস্থ সংবাদ ঘোষণার দ্বারা কিঞ্চিৎ সুস্থ শান্তি আনবে; কিন্তু কেহ কি একবারও ভাবছে কত অলিখিত প্রবাস কাহিনিতে ঐ পোস্টকার্ডের উভয় পৃষ্ঠা পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রবাসীর মনে এ কথা অনেক সময় উদয় হলেও বোধ হয় গৃহজীবী তাঁর সংসারচিন্তার মধ্যে ও কথা ভাববার অবসর পান না।

পত্র লিখে যখন বাইরে এলাম, তখন শুনা গেল মন্দিরদ্বার উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। স্বামী ও বৈদান্তিক আমার সঙ্গে আসেন নি; সুতরাং তাঁদের ডেকে এনে একসঙ্গে মন্দির-প্রবেশ করবো ইচ্ছা করলাম। কত দিন হলো এক অভীষ্ট লক্ষ্য করে আমরা কোন দূরবর্তী রাজ্য হতে যাত্রা করেছি, আমরা পরস্পরের জীবনের অবিচ্ছিন্ন অবলম্বন; জীবনের উপর দিয়ে কত বিপদ চলে গেছে, সে স্রোতের বেগে আমরা বিভিন্ন হইনি। আজ এই পরম আনন্দের দিনেও একত্র হয়ে যাই। কিন্তু অধিক দূর যেতে হলো না, মন্দিরে প্রবেশ করা গেল। আমার মনের মধ্যে কেমন একটা নূতন ভাবের সঞ্চার হলো।

চতুর্ভুজ নারায়ণমূর্তি দৃষ্টিগোচর হলো। মূর্তি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ পাথরের প্রস্তুত; বিগ্রহের গায়ে বহুমূল্য অলঙ্কার। অলঙ্কার নারায়ণের আপাদমস্তক ঢেকে ফেলেছে। সেই মণিমুক্তাহীরকাদিজড়িত হেমাভরণের মধ্য হতে একটা উজ্জ্বল স্নিগ্ধ শ্যামকান্তি বিকশিত হচ্ছিল, তা দেখলে মনে বাস্তবিকই আনন্দের সঞ্চার হয়। নারায়ণের শরীরস্থ মণিমুক্তাদির জ্যোতিতে গৃহ আলোকিত। পূর্বে গল্প শুনেছিলাম, ভাদ্র মাসে যে দিন মন্দির দ্বার বন্ধ হয়, সে দিন মন্দিরের মধ্যে যে প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়, বৈশাখ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ এই নয় মাস কাল অনবরত তা জ্বলতে থাকে; আর যে সমস্ত নৈবেদ্য করে দেওয়া হয় , এ দীর্ঘকালেও তা নষ্ট হয় না, যেমন তেমনই থাকে। এই শেষে কথাটি সত্য হতে পারে, কারণ ঠিক নয় মাস বদরিনারায়ণের মন্দির বরফের তলে থাকে; বরফের মধ্যে নিহিত থাকাতে কিছু নষ্ট হয় না; কিন্তু আগের কথাটির যথার্থতা সম্বন্ধে তেমন বৈজ্ঞানিক যুক্তি পাওয়া যায় না। যদি মনে করা যেত, সেই প্রদীপ এমন সুবৃহৎ যে তাতে নয় মাস দিনরাত্রি জ্বলবার উপযুক্ত তৈল দিয়ে রাখা হয়, তাই জ্বলবার পক্ষে আর কোন বাধা থাকে না, কিন্তু তাতেও বিজ্ঞান প্রতিবাদী। বরফের দ্বারা এইরূপ বদ্ধ স্থানে আলোক অচিরাৎ নির্বাণ হয়; দেবতা স্বয়ং চেষ্টা করেও অগ্নির এই দৌর্বল্যটুকু বোধ করি দূর করে দিতে পারেন না। যা হোক যখন সেই মন্দিরস্থিত ক্ষুদ্র প্রদীপটি দৃষ্টিগোচর হল, তখন সমস্ত বিবাদ খণ্ডন হয়ে গেল। এ যুক্তির দিনে আমাদের অগত্যা বিশ্বাস করতে হল মন্দিরে অভ্যন্তরস্থ মণিমুক্তা এবং হীরকস্তূপই মন্দিরের মধ্যভাগ দীপালোকের ন্যায় উজ্জ্বল রাখে। বিশেষ যে দিন নারায়ণের দ্বার বন্ধ হয়, সে দিন জ্যোতির্ময় অলঙ্কারগুলি নারায়ণের শরীরে পরাইয়া দেওয়া হয়; তাদের আলোতেই মন্দিরের মধ্যভাগ অধিক আলোকিত হয়। তারপর যে দিন প্রথম দ্বার খোলা হয়; সেদিন অনেক সন্ন্যাসী উপস্থিত থাকে। দ্বার খোলামাত্র তারা মন্দিরের মধ্যে এই অলঙ্কারের জ্যোতিঃ দেখতে পায়, সুতরাং মনে করে প্রদীপ জ্বালা আছে ! নারায়ণের দেহ পরশপাথরে নির্মিত বলে যে প্রবাদ আছে, বৈদান্তিকের মতে তার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা থাকলেও আমার বোধ হলো নির্জন দেবালয়ের দেবতা যে বরফরাশির মধ্যে আপনার নিভৃত সিংহাসন স্থাপন করেছেন, সেখানে এত হেমাভরণ, স্তূপাকার মণিমুক্তার উজ্জ্বল বিকাশ দেখে সাধারণে বিশ্বাস করে নিয়েছে, দেবতার দেহ পরশমণি-নির্মিত।

যা হোক বদরিনারায়ণের এই বহু মূল্যবান অলঙ্কারপ্রাচুর্য দেখে আশ্চর্য হবার কোন কারণ নেই। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম্য বিগ্রহদেরই কত লোক কত মূল্যবান উপহারাদি উপহার দেয়। বদরিকাশ্রম ভারতের শেষ্ঠ তীর্থ; বদরিকাশ্রমে নারায়ণের মহিমা নিখিল দেব-মহিমার উপরে, সুতরাং নানা দেশবিদেশের রাজগণ বদরিনাথকে কত মূল্যবান দ্রব্য উপহার দিয়েছেন, তার সংখ্যা নেই। তার উপর গাড়োয়াল যখন স্বাধীন ছিল, তখন গাড়োয়ালের রাজা প্রায়ই নারায়ণকে বহুমূল্য উপহারাদি দান করতেন।

মন্দিরমধ্যে দেখলুম, শুধু নারায়ণ একা নেই, আরও দুচারটি অতিথি অভ্যাগত অতিথি আছেন; কিন্তু তাঁরা নারায়ণের উজ্জ্বল প্রভায় কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের দিকে দৃষ্টিও সহসা আকৃষ্ট হয় না। আমাদের সঙ্গে আরও অনেক যাত্রী মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। আমার হৃদয়ে যত না ভক্তির উদ্রেক হোক, এই সকল সমাগত যাত্রীর ভক্তি ও নিষ্ঠা দেখে আমি মোহিত হয়ে গেলাম, আমার হৃদয়ে এক স্বর্গীয় ভাবের উদয় হল। আমার কাছেই একটি বৃদ্ধা দাঁড়িয়েছিল; সে বড় কষ্টে নারায়ণ দর্শন করতে এসেছে। পা একেবারে ফুলে গিয়েছে, দাঁড়াবার শক্তি নেই, তবুও প্রাণপণ শক্তিতে একবার দাঁড়িয়ে নারায়ণের শ্রীমুখ নিরীক্ষণ করছে। তার মুখে এমন উজ্জ্বল প্রফুল্ল ভাব, চক্ষে এমন নিস্পন্দ সতৃষ্ণ দৃষ্টির একাগ্রতা যে, বোধ হল শারীরিক যন্ত্রণার কথা একটুও তার মনে নেই। তার যেন মনের ভাব, তার সকল কষ্ট দুঃখ এবার সার্থক হয়েছে। বৃদ্ধার সঙ্গে একটি বড় পুত্র ও একটি বিধবা কন্যা। আমরা যেদিন বদরিকাশ্রমে পৌঁছি, এরাও সেদিন এখানে এসেছিল। বৃদ্ধা অনেকক্ষণ নারায়ণ দর্শন করে শেষে ভক্তিভরে প্রণাম করলে। তারপর পুত্রটির দিকে চেয়ে বললে, "বেটা জনম সফল কর্‌লিয়া। " সেই কথা কয়টির মধ্যে যে কত আনন্দ, তা বর্ণনাতীত। ছেলেটির মার কথায় ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে নতজানু হয়ে মায়ের পদধূলি গ্রহণ করলেন, মাও আস্তে আস্তে জীবনের অবলম্বন ছেলেটিকে বুকের মধ্যে টেনে নিলে। সে দৃশয় স্বর্গীয়; আমাদের সকলের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। পুত্র মায়ের প্রতি কর্তব্যের এক অংশ সম্পূর্ণ করে অতুল আনন্দ বোধ করলে এবং মায়ের স্নেহপূর্ণ বুকের মধুর প্রশান্তির মধ্যে স্থান পেয়ে হয়তো সে মনে করলে, তার অপার্থিব পুরষ্কার হয়ে গেল। হায় মাতৃহীন আমি - আমি মর্মে মর্মে মাতার অভাব অনুভব করলাম।

তারপর আমরা ধীরে ধীরে মন্দির হতে "তপ্তকুণ্ড" দেখতে চললাম। মন্দিরের বাহিরে একটু নীচেই একস্থলে পাথর দিয়ে বাঁধান জল রাখবার একটা অনতিবৃহৎ চৌবাচ্চা নির্মিত আছে, তার গভীরতা বেশি নয়। নারায়ণের মন্দিরের নীচে দিয়ে তার পাশে একটা বৃহৎ ঝরনা এসে পড়েছে। এ ঝরনার জল ভারি গরম; এত গরম যে তাতে স্নান চলে না। তাই পাণ্ডারা উক্ত চৌবাচ্চায় সেই ঝরনার জল এনে ফেলেছে আর এক দিক দিয়ে এক ঠাণ্ডা জলের ঝরনাও তার মধ্যে এসে মিশেছে, এবং এই দুই জল একত্র মিশে স্নানের উপযুক্ত ঈষদুষ্ণ জলে পরিণত হয়েছে। এই স্থানটির চারিপাশে পাথরের স্তম্ভ দিয়ে উপরে ছাদ তৈয়ারি করা হয়েছে। অনেকেই এখানে স্নান করছেন দেখলাম, আমারও স্নান করবার বড় ইচ্ছা হল। গায়ের কাপড় চোপড় খুলছি, স্বামিজী তাড়াতাড়ি আমাকে নিষেধ করলেন। আমি তাঁকে বললাম, এ গরম জলে স্নান করায় এমন কি আপত্তি হতে পারে ? তিনি বললেন, স্নান করায় ক্ষতি না হতে পারে, কিন্তু গায়ের কাপড় খুলে শরীর অনাবৃত করাতে বুকে হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতে পারে। তাঁর কঠোর শাসনে অগত্যা আমাকে স্নান বন্ধ করতে হল। কিন্তু বৈদান্তিক ভায়া নিরঙ্কুশ, তিনি গায়ের কাপড় চোপড় খুলে দিব্য স্নান করতে লাগলেন। তাঁর সেই সজোরে গাত্রমার্জন এবং মৃদু হাস্যের অর্থ আমি বুঝলাম যে, তোমরা কোন কাজের লোক নও। অতি সাবধান হয়ে সর্বত্র নিষেধ-বিধি মানলে জীবনের অনেক সুখভোগ হতে বঞ্চিত থাকতে হয়।

বৈদান্তিকের স্নান প্রায় শেষ হয়েছে এমন সময় মহান্ত মহারাজা আমাকে ডেকে পাঠালেন। ইনি সেই যোশীমঠের মহান্ত, নারায়ণের সেবার ভার এখন ইহার উপর ন্যস্ত আছে। একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। এই মন্দির বন্ধ হলে তার চাবি মহান্তের কাছে থাকে না: গাড়োয়ালের রাজার ( এখন তিহরির রাজা ) এ মন্দির; তাঁরই কর্মচারীগণ এসে মন্দিরের দ্বার খুলে জিনিসপত্র সব বুঝে পেড়ে দিয়ে যায়, আর বন্ধের পূর্বে এসে সমস্ত বুঝে নিয়ে চাবি বন্ধ করে চলে যায়; অবশ্য জিনিসপত্র যে তারা স্থানান্তরিত করে তা নয়, সমস্তই মন্দিরের মধ্যে থাকে, তবে তারা একবার পরীক্ষা করে দেখে মাত্র ! এতদ্‌ভিন্ন বৎসর বৎসর যে লাভ হয় তা মহান্তরই প্রাপ্য ! মহান্ত আমাকে কেন ডাকলেন, তা বুঝতে পারলাম না; স্বামিজীকে আমার সঙ্গে যাবার জন্যে অনুরোধ করলাম, কিন্তু তিনি কোথাও যাওয়া পছন্দ করেন না, সুতরাং আমি চললাম। একটা বড় ঘরের ভিতর, একটা উঁচু গদির উপর কতকগুলি তাকিয়ার মধ্যে স্থূলদেহ মধ্যবয়সি মহান্ত-মহারাজ বসে আছেন, চারিদিকে ফরাসের উপর অন্যান্য লোক আছে; কেহ বাক্স সম্মুখে নিয়ে বসে আছে, কারও কাছে কতকগুলি খাতাপত্র , কেহ নিস্পরোয়া হয়ে ধূমপান করছে; দুই চারজন লোক একপাশে বসে খোশগল্প আরম্ভ করে দিয়েছে। মনে করেছিলাম, বুঝি বিভূতিভূষিত-অঙ্গ, ব্যাঘ্রচর্মাসন, কমণ্ডুলধারী, রুদ্রাক্ষশোভিত যোগীবরকে অগ্নিকুণ্ডের সম্মুখে উপবিষ্ট দেখবো, চারিদ্কে পূজার্চনার দ্রব্য এবং সংযত ও ধর্মালোচনা তৎপর বিনীত শিষ্যমণ্ডলী দেখা যাবে। কিংবা ইনি নারায়ণের সেবাইত; বিভূতি ব্যাঘচর্ম রুদ্রাক্ষ পরিবেষ্টিত যোগী না দেখি, বৈষ্ণবের মত একটা মানুষ নিশ্চয়ই দেখতে পাবো; কিন্তু দঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সে আশায় ভারি নিরাশ হলাম। মহান্তর অফিসে উপস্থিত হয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, বড়বাজারের কুঠিয়াল কি মাড়োয়ারি মহাজনের গদির সঙ্গেই তার তুলনা হতে পারে। একটু সম্ভ্রম একটু বিনয় - কোনও ভাব এখানে নেই; যেন ধর্ম শুধু ভান মাত্র, ব্যবসা করাই এ সমস্ত অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। দেবতার দ্বারে হৃদয়ের দেবভাব অপেক্ষা অর্থের খ্যাতি, অর্থের সম্মান, প্রেম ভক্তি বিনয় প্রভৃতি অপেক্ষা অনেক অধিক। যেখানে অপার্থিব দেবমাহাত্ম্যের উপর তুচ্ছ সংসারের কোলাহল এবং হীনতা প্রতিষ্ঠিত, সেখানে দেবমর্যাদা বিড়ম্বিত।

আমি মহান্তের সম্মুখে উপস্থিত হবামাত্র "আইএ বাবু সাব" বলে মহান্ত অভিবাদন করলেন। সকলেই সরে' সরে' আমার জন্য একটা জায়গা করে দিলে। আমি মহান্তের অনুমতিক্রমে একপাশে উপবেশন করলাম; মহান্ত মহারাজ গল্প করতে লাগলেন। তাঁর গল্পে বাজে কথাই বেশি, ধর্ম প্রসঙ্গে তাঁর তেমন আগ্রহ দেখলাম না, বরং সে সম্বন্ধে কিছু বললে তিনি কৌশলক্রমে কথাটা উলটে দিতে চেষ্টা করলেন। সুতরাং অন্যান্য স্থানের মহান্তেরা যে শ্রেণীর লোক, ইনিও যে সে শ্রেণীর বেশি উপরে, তা মনে করবার বিশেষ কোন কারণ দেখলাম না ! যোশীমঠ সম্বন্ধে কথা হলে তিনি এই বললেন, উক্ত মঠ শঙ্করাচার্য স্বামীরই প্রতিষ্ঠিত। যোশীমঠে দুচারখানি পুস্তক আছে, তার কোন কোনখানি পাঠোপযুক্ত এবং তা হতে অনেক পুরাতন তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে; কিন্তু সে জন্য কষ্ট স্বীকার করে, এমন লোক প্রায়ই দেখা যায় না; সুতরাং পুস্তকগুলিতে যে সত্য সংগুপ্ত আছে তা শীগ্রই চিরবিলীন হয়ে যাবে। মহান্তের কাছে যে বিশেষ কিছু প্রত্যাশা নাই, তা তাঁর কথার ভাবেই বুঝতে পারলাম।

এই সমস্ত কথাবার্তা শেষ হলে তিনি আমাকে ডাকবার কারণ বললেন। তিনি বললেন যে, মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে গেছে; এখন হতে যদি জীর্ণ-সংস্কার না করা হয়, ত হিন্দুর একটি প্রধান কীর্তি লোপ হবে। তাই তিনি জীর্ণ সংস্কারের কাজ আরম্ভ করে দিয়েছেন। কিন্তু এই কাজে বহু অর্থের প্রয়োজন, বিশেষ এদিকে তেমন বড়লোক বেশি আসেন না, অন্য লোকের দৃষ্টি নেই, সুতরাং মহান্ত মহাশয়ের ইচ্ছা ছোট বড় সকলের কাছে চাঁদা সংগ্রহ করে হিন্দুর এই তীর্থকে বজায় রাখেন। এ সমস্ত কথা মহান্ত একা বললেন না, তাঁর মোসাহেবরাও অনেক কথা বললেন। সমস্ত কথা শেষ হলে মহান্ত মহাশয় একখানি চাঁদার খাতা বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি খাতাটি উলটেপালটে দেখে মহান্তের হাতে ফেরত দিলাম , এবং দীনতা জানিয়ে বললাম আমার অবস্থানুসারে যথাযোগ্য দিতে প্রস্তুত আছি; কিন্তু আমাদের কাছে যে টাকাকড়ি আছে তা অতি সামান্য, তা এই দীর্ঘ পাথেয় হিসাবে যথেষ্ট নয়, - সুতরাং তা হতে কিছু দান খয়রাত করা যায় না; তবে শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরের একখানা পাথর গাঁথবার খরচের যদি সাহায্য করতে পারি, তা হলেও আমার অর্থ সার্থ্ক। আমি পাঁচটি টাকা দিলুম। মহান্ত মহাশয় বললেন, "ফরাসি হরফমে মৎ লিখিয়ে, আংরিজেমে দস্তখত কর দেনা", তিনি মনে করেছিলেন, আমি যখন বাবু, তখন আমি ইংরেজি ফারসি উভয় বিদ্যাতেই পারদর্শী। কিন্তু আমি ত আর ফারসি জানিনে, আমি বললাম নাগরীতে দস্তখত করি; কিন্তু এ কথা শুনে মহান্ত ব্যস্ত্ভাবে বললেন, "নেহি নেহি বাবু, আংরেজী লিখ্‌নেসে দস্তখৎ কি কদর যাস্তি হোগা। " বুঝলাম ইংরেজি দস্তখতের মান বেশি। মহান্তের এই এক কথাতে আরও অনেক বিষয় বুঝতে পারলাম। ইংরেজিতেই নাম সহি করে সেখান থেকে বের হলাম।

(চলবে)

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.