প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২৭)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩)
(২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

নারায়ণচটিতে যখন পৌঁছানো গেল, তখনও দেখলাম বেলা আছে। পাতলা মেঘের দল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে, চারিদিকে উড়ে যাচ্ছে; রোদ একটুও নেই; গাছের ডালে নানারকম পাখি বসে তাদের সিক্ত পাখা ঝাড়ছে, আর কলরব করছে। এখানে দু পাঁচজন মানুষের মুখ দেখে আমরা অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। এ চটিও পাহাড়ের এক অতি নির্জন নেপথ্যে; লোকালয় নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না; তবু এখানে এসে মনে হলো, আমরা জনমানবশূন্য নির্জন প্রান্তর ছেড়ে যেন একটা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করছি। পুরুষেরা নিশ্চিন্ত মনে গল্প বলছে; মেয়েরা দু তিনজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসছে, কথাবার্তা বলছে, অপরিচিত কয়েকজন সন্ন্যাসীকে দেখে কৌতুক-বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে চেয়ে জনান্তিকে কি বলা-কহা করছে; আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এদিকে ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে; পথের উপর ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত রাশীকৃত ভিজে কাঁকর জড় করছে, কিম্বা অদূরবর্তী গাছের তলা হতে রাশি রাশি শুকনো পাতা কুড়িয়ে আনছে। চারিদিকে বেশ একটা জীবনের হিল্লোল; এবং সজীবতার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে।

এই চটিতে দুখানা ঘর। ঘর দুখানা নিতান্ত চটির মতন নয়, একটু বড় বড়। আমরা বদরিনারায়ণে যাবার সময় এ চটিটা দেখতে পাইনি। এই রাস্তা দিয়েই গিয়েছি,তাতে আর সন্দেহ নাই, কিন্তু তখনও বোধ হয় এ চটি খোলা হয় নি, কিম্বা হয় ত কোনো গৃহস্থের বাড়ি ভেবে এদিকে না তাকিয়েই চলে গিয়েছি। সম্ভবত তখন বিশেষ দরকার হয় নি বলেই এ বিষয়ে উপেক্ষা করেছিলাম, এখন ফিরবার সময় এই চটির সম্ভাবনার কথা একবারও আমাদের মনে হয় নি বলেই আমরা মেঘ দেখে ভারি ভয় পেয়েছিলাম; কারণ আমাদের মনে হয়েছিল, এত নিকটে বুঝি আর চটি পাওয়া যাবে না। যা হোক, এই চটিতে আমরা আজ কয়জন মাত্র যাত্রী। অন্য কোনো যাত্রী নেই দেখে আমাদের মনে বড়ই ভরসা হলো, কারণ যদি আমাদের আগে কোন যাত্রীর দল আসতো, তা হলে চটিতে যে সামান্য খাদ্য সামগ্রী পাবার সম্ভাবনা, তা তারা পঙ্গপালের মত সমস্ত নিঃশেষ করে চটির দোকানখানিকে গজভুক্ত কপিত্থবৎ নিতান্ত অসার করে রাখত; আমরা দারুণ পথশ্রমে, এবং তা অপেক্ষাও নিদারুণ ক্ষুধা নিয়ে অনাহারেই পড়ে থাকতাম। যৎকিঞ্চিৎ পানাহার হতে বঞ্চিত হতে হবে না ভেবে, আমরা অনেক পরিমাণে আশ্বস্ত ও আনন্দিত হলাম। বৈদান্তিক ভায়া পেটের চিন্তাতে এতই বিভোর হয়ে পড়েছেন যে, তাঁহার পিঠের বেদনার দিকে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নাই। চটিতে যাত্রীর ভিড় নেই দেখে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর সেই দীর্ঘ নিঃশ্বাসকে ভাষায় তর্জমা করতে হলে এই ভাবখানা দাঁড়ায় যে "রাম, বাঁচা গেল, একটা বাজে লোকও এখানে আসে নি দেখছি, তা হলে এখানে দুটো খাবার এবং একটু মাথা রেখে আরাম করবার অসুবিধা হবে না"।

চটিতেই দোকানদারকে দেখতে পেলাম। তার বাড়িও এই চটির নিতান্ত কাছে, একেবারে লাগাও বললেই হয়। রাস্তার বাঁ-ধারে পাহাড়ের ঢালুর দিকে দু খানা দোকানঘর, আর ডান পাশে একটু উঁচু জমিতে তার বসত বাড়ি। দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটু উপর দিকে নজর করলেই তার বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। আজ এতদিন পরে তার সেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোট চটিখানার কথা লিখছি, এখনও যেন সেই ঘর, দ্বার, বাড়ি আমার চক্ষুর সম্মুখে চিত্রের মত ভাসছে। তার বাড়িখানিও বেশ সুন্দর। আমাদের বঙ্গদেশের সমভূমিতে পল্লীগ্রামের সাধারণ গৃহস্থ বাড়ি যে রকমের, ঠিক সেই রকম নয় বটে, কিন্তু তার সেই পার্বত্য পল্লীর সামান্য বাড়িটাতে আমাদের পল্লীগ্রামের অনেকটা ভাব পরিস্ফুট দেখা গেল, তেমনই জাঁকজমকহীন, পরিষ্কার সরল মাধুর্যমণ্ডিত, রাঙামাটির দেওয়ালের উপর নানা রকমের ফল ফুল লতা পাতা কাটা, পল্লীগ্রামের অজ্ঞাতনামা রবিবর্মার হাতে তৈয়েরি অদ্ভুত রকমের পাখির ছবি; ছবিগুলিতে যে পরিমাণেই শিল্পচাতুর্যের অভাব থাকুক, কিন্তু সেই অশিক্ষিত হস্তের অঙ্কনভঙ্গির মধ্যে একটা আগ্রহের ভাব ফুটে উঠেছিল। সুন্দর করে আঁকবার জন্যে একটা ব্যাকুলতা, আর তাতে স্থায়িত্ব স্থাপনের আকাঙ্খা তার প্রত্যেক রেখার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল, আর সেইটিই সকলের চেয়ে আমার কাছে সজীব এবং সুন্দর বলে বোধ হচ্ছিল। পৃথিবীতে সকলে সকল বিষয়ে সিদ্ধিলাভ করে না, কিন্তু যারা সিদ্ধিলাভের জন্যে চেষ্টা করে, অসিদ্ধ হলেও তাদের প্রাণপণ চেষ্টাটা উপেক্ষার বস্তু নয়।

দোকানদারের বাড়িতে দুখানা ঘর; একখানা বেশ বড়, তাতেই সে সপরিবারে বাস করে, আর একখানা ছোট কুঁড়ে - বোধ হলো গোয়াল ঘর, তখন সে ঘরের মধ্যে গোরু ছিল না। একটা মাঝারি গোছের বেলগাছতলাতে দু তিনটে গোরু বাঁধা ছিল, এবং একটা ছোট বাছুর পাহাড়ের একধারে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল। বাছুরটা এক-একবার তার মায়ের দৃষ্টির বাহিরে গেলেই তার পয়স্বিনী মাতা মাথা উঁচু করে প্রসারিত চক্ষে ঘন ঘন সে দিকে তাকিয়ে দেখছে, যেন সেই রজ্জু-বদ্ধ গাভিটির সকরুণ মাতৃস্নেহ অক্ষয় কবচ হয়ে তার চঞ্চল বৎসটিকে কোন অনিশ্চিত বিপদ হতে রক্ষা করতে চায়। এই বেলগাছের অদূরে আরও একটা বেলগাছ এবং দুটো পেয়ারা গাছ। এখন বর্ষার পূর্বাভাস মাত্র ফুল এবং ছোট ছোট ফলে পেয়ারা গাছ দুটি ভরে গিয়েছে। গোয়ালের পাশে এক ঝাড় কলাগাছ, তেমন সবল নয় এবং পাতাগুলো ছোট ছোট, যেন পাহাড়ের শুষ্ক নীরস জমি হতে তারা যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যরস সংগ্রহ করতে পারছে না। দোকানদারের বাড়ির ঠিক নীচে দিয়ে একটা ঝরনা বয়ে যাচ্ছে; জল গভীর নয়, কিন্তু অতি নির্মল, এবং এই ক্ষুদ্র গ্রামখানির প্রাণস্বরূপিণী। দোকানদারের বাড়ির সম্মুখে একটুখানি সমতল জমি আছে, মাঝখানে একটা মধ্য-আকৃতির বটগাছ; গোড়াটা পাথর দিয়ে বাঁধানো; আমাদের দেশে কোনো কোনো গাছের তলা যেমন ইট পাথর দিয়ে বাঁধানো হয়; সে রকম নয়; কতকগুলো বড় বড় পাথর গোল করে গাছের গোড়ায় দেওয়া। পাথরগুলি সমস্তই আল্‌গা, তবে তার উপর বসলে ধসে পড়বার কোনো সম্ভাবনা নেই। সকালে সন্ধ্যায় অনেকেই এই গাছের তলায় বসে গল্প গুজবে দুদণ্ড কাটিয়ে দেয়; ধরতে গেলে এই গাছতলাটাই দোকানদারটির বৈঠকখানা। আমরা এই দোকানদারের দোকানে রাত্রির মত আশ্রয় নিলাম।

আমরা যে দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই দোকানদারের বাড়ি ও দোকান খুব কাছাকাছি বলে সে দোকান এবং ঘরের দু-জায়গার কাজই চালাতে পরে। তার কটি ছেলেমেয়ে তা জানি নে, তবে একটি একটু বড় মেয়ে দোকানে এসে আমাদের জিনিসপত্র এনে দিয়েছিল।

আমরা আজ সত্যসত্যই একটা প্রকাণ্ড ভোজের আয়োজন করে ফেললাম। দোকানে চাউল মিললো না, এ পাহাড়ে রাস্তায় অতি কম জায়গাতেই চাউল পাওয়া যায়, অনেকদিন পরে পিপুলকুঠিতে একদিন পাওয়া গিয়েছিল। চাল না পাবার কারণ এই যে ভাতভক্ত বাঙালি এদিকে প্রায়ই তীর্থ করতে আসে না; যে দু-পাঁচজন আসে, তারা অল্প দিনের মধ্যে অগত্যা ডাল রুটিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। দোকানদারের মেয়ে আমাদের জন্যে আটা নিয়ে এল। আটার চেহারার বর্ণনাটা এখানে দিতে পারলাম না; সেটা আমার দোষ নয়, বাঙলা ভাষায় তার উপযুক্ত দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করার চেষ্টায় একেবারে হয়রাণ হয়ে গিয়েছি; তবে কাব্যরসবঞ্চিত বৈদান্তিকের মুখে একটা উপমার কথা শুনা গিয়েছিল। তিনি আটার রং দেখে বলেছিলেন "এ কি আটা ? তবু ভাল; আমি ভাবছি বুঝি খোল পিষে এনে দিয়েছে। " - কথাটা শুনে আমার মনে একটু তত্ত্বকথার উদয় হলো; আমি বললাম, "আমাদের মনরূপ গাড়োয়ান এই দেহরূপ গোরুগুলোর নাকে দড়ি দিয়ে ক্রমাগত ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে; কাঁধের জোয়ালও নামছেনা, যাত্রার অবসান নেই। শুধু মহাপ্রাণীটাকে কোন রকমে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে সন্ধ্যাবেলা এই রকম চারটে খোল বিছলির বন্দোবস্ত হচ্ছে। স্বামিজী সকল অবস্থাতেই অটল; তিনি বললেন, "অচ্যুত, আজ তুমি যেমন পিঠে খেয়েছ, তেমনি এই আটা দিয়ে লুচি তৈয়েরি করে তোমাকে পিঠে খাওয়াতে পারতাম ত বড় আনন্দ হতো। " -"সে ত আর কঠিন কথা নয়" বলে আমি দোকানদারের দোকানে প্রবেশ করলাম এবং তার ঘিয়ের ভাঁড়টা দিয়ে সমস্ত ঘিটুকু নিয়ে এলাম। দোকানদার আমাদের এই ভোজন ব্যাপারে স্বয়ং পরিশ্রম দ্বারা সাহায্য করতে অঙ্গীকার করলে। সে তার বাড়ি হতে জিনিসপত্র এনে আমাদের জোগাড় করে দিলে, তার মেয়েটি আমাদের কাছেই বসে রইল। উনুন জ্বলছে, আটা মাখা হচ্ছে, একটি ছোট প্রদীপে ছোট ঘরখানি আলোকিত হয়েছে, আর মেয়েটি যুক্তাসনে বসে তিনটি অপরিচিত অতিথির কাণ্ডকারখানা দেখছে; একবার বা আমাদের দিকে চাইতেই আমাদের সঙ্গে যেমন চোখাচোখি হচ্ছে, অমনি চোখ নামিয়ে দু'হাতের দশটা অঙ্গুলি নিয়ে খেলা করছে। আমি বারে বারে তার মুখের দিকে চেয়ে দেখছিলাম; মুখখানি যে খুব সুন্দর তা নয়, তবে ভারি সরলতাপূর্ণ। চোখের উপর কাল ভ্রূ; সমস্ত মুখখানি ও রুক্ষ অপরিচ্ছন্ন চুলের উপর প্রদীপের আলো পড়ে তাকে একটি পবিত্র আরণ্য-ফুলের মত দেখাচ্ছিল; সুন্দর না হোক কিন্তু তার সুবাস ঢাকা থাকে না। এই মেয়েটি তার ক্ষুদ্র জীবনের কয়েক বৎসর মধ্যে আমাদের মত কত অপরিচিত পথিক দেখেছে, কতদিন কত লোকের সুখ দুঃখের সঙ্গে তার জীবনের একদিনের সুখ দুঃখ আনন্দ মিশিয়ে দিয়েছে। সংসারে সকল বন্ধন কেটে যারা সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়েছে, পুত্র কন্যার স্নেহের টান এই দূর হিমালয় শৃঙ্গেও যাদের হৃদয়কে সবলে আকর্ষণ করেছে - এমন কত লোক এমনি সন্ধ্যাবেলা এই কুটিরে প্রদীপের আলোতে এই মেয়েটির কচি মুখখানি দেখে চিরবিদায় ক্লিষ্ট হৃদয়ে আপনার একটি সুন্দর ছোট মেয়ের করুণ আহ্বান অনুভব করেছে, হঠাৎ একটা অব্যক্ত মধুর ব্যথায় তাদের বুকের শিরাগুলো টনটন করে উঠেছে এই সকল কথা ভাবতে ভাবতে আমি কুটিরের এক কোণে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বৃষ্টি ও ঝড়ে আমার শরীরটেও বড় কাতর হয়েছিল, কাজেই আমাকে ঘুমাতে দেখে কেউ জাগিয়ে দেন নি। শেষে কতক্ষণ পরে জানি নে, স্বামিজীর ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল, দেখি তখনও মিটমিট করে আলো জ্বলছে, উনুনের আগুন নিবে গিয়েছে, মেয়েটিও চলে গিয়েছে, তার বদলে থালের উপর অনেকগুলি গরম লুচি, খোসাওয়ালা 'রহড়কা ডাল' আর ছোট একতাল গুড়, তাতে বালি কাঁকর প্রভৃতি এমন অনেক জিনিস প্রচুর পরিমাণে মিশানো, যা কোনো কালে খাদ্যশ্রেণীর মধ্যে ধর্তব্য হতে পারে না। কিন্তু তাই পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে গ্রহণ করা গেল। আমার অনুরোধক্রমে দোকানদার তার মেয়েটিকে নিয়ে এল, বোধ হয় সে ঘুমিয়েছিল। প্রথমে কিছুতেই সে খাবার নিতে চায় না, শেষকালে তার বাপের উপদেশে কিছু কিছু নিলে ! দোকানদার তার নিজের বা গৃহিণীর হাতের রান্না ভিন্ন খায় না, ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ বলে নিজের পরিচয় দিল, সুতরাং আমাদের এই আনন্দভোজন থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হলো। আমরা খুব পরিতোষের সঙ্গেই আহার করলাম, পথের সমস্ত কষ্ট এবং ক্ষুধা এই গরম পুরি ও 'রহড়কা ডালের' সঙ্গে পরিপাক হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গী রোগা ছেলেটির প্রতিও এই পথ্যের ব্যবস্থা হলো; কিন্তু এই ব্যবস্থা সমালোচনা করবার উপযুক্ত লোক সেখানে ছিলেন না; এক স্বামিজী নাড়ি টিপতে জানতেন, কিন্তু তিনিই রোগা ছেলেটিকে স্বহস্তে 'ডাল ও পুরি' দিলেন।

আহারান্তে আবার নিদ্রা - অতি চমৎকার নিদ্রা। এই দেশভ্রমণে প্রবৃত্ত হয়ে আমাদের সকল জিনিসেরই অভাব ছিল, অভাব ছিল না কেবল একটি জিনিসের, সেটি হচ্ছে - সুনিদ্রা। বাস্তবিকই এই অতি দুর্গম দীর্ঘ পথে নিদ্রা আমাদের সন্তাপহারিণী মায়ের মত হয়েছিল। এই নিদ্রার অভাব হলে বোধ করি আমরা এতটা কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। বিছানা ত কোনদিন জোটেই নি, কোনদিন কদাচিৎ পর্ণকুটিরে মাথা রাখবার জায়গা পেয়েছি; অধিকাংশ সময়েই হয় অনাবৃত পর্বতবক্ষে, না হয় গাছের তলায় রাত্রি কাটাতে হয়েছে; কিন্তু তখন সেই পর্বত গহ্বরে ভূমিশয্যায় কম্বল মুড়ি দিয়ে যেমন ঘুম হতো, সেরূপ নিদ্রা লাভ করার জন্যে এখন কতদিন সুকোমল শয্যার উপর শয্যাকণ্টক ভোগ করতে হয়েছে। সন্ধ্যার সময় শুয়েছি, আর এক ঘুমেই রাত্রি ভোর হয়েছে; সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জড়তা, পায়ের বেদনা, মনের অবসন্ন ভাব দূর হয়ে গিয়েছে; সম্মুখের বড় বড় চরাই উৎরাইগুলো ভাঙতে কিছুই কষ্ট বোধ হয় নি। আজ এই বাঙলাদেশে সে সব কথা স্বপ্ন বলে মনে হয় , আরও দিনকতক পরে হয় ত মনেই করতে পারবো না যে, আমার দ্বারা এমন একটা গুরুতর কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।

৪ জুন, বৃহস্পতিবার। ... আজ সকালে যাত্রা আরম্ভের উদ্যোগ করলাম। স্থির করা গেল লালসাঙা গিয়ে দুপুরবেলা বিশ্রাম করতে হবে। লালসাঙার কথাটা আমার এখনও বেশ মনে আছে। এই পথ দিয়ে নারায়ণে যাবার সময় এইখানেই সেই জুতোচোর সাধুর বিড়ম্বনা দেখেছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্যবশত আজও কিছু লজ্জাজনক ব্যাপার দেখতে হলো। নারায়ণচটি হতে লালাসাঙা ছয় মাইল, পথের বর্ণনার আর দরকার নেই। আজ এই এক মাসের উপর হতে শুধু চরাই ও উৎরাই, নামা আর উঠা, পর্বত নির্ঝর এবং নির্ঝর পর্বত এই নিয়েই আছি। এসব কথা ভাল লাগবে না, কিন্তু এখন নেমে যাচ্ছি, আর কখন এ সব জায়গাতে ফিরে আসতে পারব না - তাই ভেবে মনে বড় কষ্ট হচ্ছে। একরাত্রিও যে দোকানে বাস করেছি, সেটা ছাড়তে মনে হচ্ছে যেন চিরকালের জন্যে একটা আশ্রয় ছেড়ে চললাম। নারায়ণে যাবার সময় মনে হয়েছিল যেন মহাপ্রস্থানের স্বর্গে চলেছি। এখন মনে হচ্ছে আবার সেই আকাঙ্খা-কাতর ধূলিময়, রৌদ্রদগ্ধ পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি। আমার চিরদিনের মাতৃভূমিতে যাচ্ছি এই যা কিছু সান্ত্বনা; কিন্তু সেখানেও দুঃখযন্ত্রণা, হাহাকারের বিরাম নেই।

এই সকল কথা ভাবতে ভাবতে চলতে লাগলাম; শেষে বিস্তর চরাই উৎরাই ভেঙে শ্রান্তদেহে বেলা প্রায় এগারটার সময় লালসাঙায় পৌঁছলাম। আজ আমাদের পথশ্রম বড়ই বেশি হয়েছিল। ধীরে ধীরে চলা আমার অভ্যাস নয়, সে কথা পূর্বেই বলেছি, চলতে চলতে মাঝরাস্তাতে বসে আমি কোনদিনই বিশ্রাম করতে পারি নি। যেদিন যতটুকু যাওয়া দরকার, এক দম চলে, তারপর হাত পা ছড়িয়ে সে দিনের মত ছুটি। এই রকম হিসাবে চলে আসা যাচ্ছিল, কিন্তু আজ আমাকে বাধ্য হয়ে এ অভ্যাস ছাড়তে হলো। আমাদের সঙ্গে সেই রোগা ছেলেটি আছে; সে নিতান্ত ভাল মানুষ, মুখে কথাটি নেই। তাকে সঙ্গে করে পথ চলা বড় কঠিন; পাছে দ্রুত চলতে তার কষ্ট হয়, এই ভেবে আমি বড় আস্তে আস্তে চলছিলাম। সে দশ পা যায়, আবার নিতান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে, তখন গাছে ছায়া, কি পাথরের পাশে বসে, তাকে অঞ্জলি পুরে ঝরনার জল খাওয়াই, ইংরেজি পুঁথির দু চারটি ভাল গল্প বলি, কখনও বা দু চারটি কবিতা বলে তার মনটা প্রফুল্ল করবার চেষ্টা করি। তারপর আবার তাকে নিয়ে উঠি - ধীরে ধীরে পায়ে পায়ে তাকে নানারকমের অদ্ভুত গল্প বলে - মা যেমন ছোট ছেলেটির মন গল্পে আকৃষ্ট করে তাঁর চঞ্চল শিশুটিকে ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যান, তেমনি আমিও তার অজ্ঞাতসারে তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, অজ্ঞাতসারে তার গতিবৃদ্ধি হচ্ছে। এই রকম করে ছয় ঘণ্টায় প্রায় চায় মাইল পথ পার হয়ে লালসাঙায় হাজির হওয়া গেল।

নারায়ণে যাওয়ার সময় লালসাঙার বাজারটি পর্যন্ত ঘুরে দেখিনি। এবার লালসাঙায় এসে সেবারকার সেই দোকানের উপর ঘরেই বাসা নেওয়া গেল। আহারাদির বন্দোবস্তের ভার সঙ্গীদের উপর সমর্পণ করে বাজার দেখতে বেড়িয়ে পড়া গেল।

বাজারের ঘরগুলি বেশ বড় বড়, অধিকাংশ দোতলা। দোকানগুলিতে প্রচুর পরিমাণে জিনিসপত্র আছে। চারিদিক দেখতে দেখতে আমি বাজারের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হলাম। সেখানে একটা ছোট অথচ বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কুটিরের সম্মুখে একটু জনতা দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখি চার পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কি জানবার জন্যে একটু অগ্রসর হয়ে দেখি, দুজন স্ত্রীলোক হিন্দি ও বাংলায় কথা মিশিয়ে ঝগড়া করছে। এই দূরদেশে বাংলা কথা, তা আবার স্ত্রীলোকের মুখে ! আমি আরও খানিকটে অগ্রসর হলাম। সে সময়ে আমার চেহারা এমন হয়েছিল যে, আমার অতি নিকট বন্ধুও আমাকে বাঙালি বলে সন্দেহ করতো না, সুতরাং সেখানে যে সমস্ত পাহাড়ী দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছিল, আমিও তাদের মধ্যে একজন হয়ে পড়লাম। কিন্তু গিয়ে দেখি সেখানে না গেলেই ভাল হতো। সে দৃশ্য দেখে আমার যেমন কষ্ট তেমনি রাগ হলো। অনেক দিন হতেই সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে চলা-ফেরা, আহার উপবেশন করছি সাধারণের কাছে আমিও একজন সন্ন্যাসী বলে পরিচিত, কিন্তু সাধুসন্ন্যাসীর মধ্যে থেকেও সন্ন্যাসীর জাতের উপর শ্রদ্ধা অপেক্ষা আমার অশ্রদ্ধাই বেশি হয়েছে। সন্ন্যাসীদের দূর হতে দেখতে বেশ; কোনো আসক্তি নেই, বিলাস-লালসা, সংসার চিন্তার নাম মাত্র নেই; মুক্ত, স্বাধীন, বন্ধনহীন; কিন্তু শরীরের উপরের মত তাদের অধিকাংশেরই মনের ভিতর এত ময়লা-মাটি যে, এদের ঘৃণা করাই স্বাভাবিক বলে বোধ হয়। শ্রেষ্ঠতীর্থ কাশীধামের পবিত্রতার আবরণতলে যে বিভৎস কাণ্ডের অভিনয় হয় পবিত্র সন্ন্যাসী নাম গ্রহণ করে কত সমাজ-তাড়িত লোক যে সন্ন্যাসধর্মের উপর কলঙ্ক ঢেলে দিচ্ছে, তার আর অবধি নেই। অধিকাংশ সন্ন্যাসীই শুধু গেজাখোর, ভিক্ষুক, কোপন-স্বভাব, সকল দোষের ঝুলি নিয়ে তীর্থে তীর্থে পাপের বীজ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে তবে বাঙালি সন্ন্যাসীর সংখ্যা নিতান্ত কম, তাই তাদের কুকীর্তি বলার কোনো সুযোগ হয় না, কিন্তু খুঁজে দেখলে বাঙালি সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর মধ্যেও অনেক ভণ্ড নজরে পড়ে।

আজ যে স্ত্রীলোক দুটিকে প্রকাশ্য বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে অশ্লীল ভাষায় ঝগড়া করতে দেখলাম, তারা বাঙালি সন্ন্যাসিনী, ভৈরবী বেশ, পরিধানে গৈরিক বস্ত্র, সিঁথিতে রক্তচন্দনের কি সিঁদুরের ফোঁটা, রুক্ষকেশপাশ আলুলায়িত, হস্তে ত্রিশূল ও কমণ্ডুল, গলে রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধের ঝুলি বোধ হয় কুটিরের মধ্যে আছে; অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই, যাত্রার দলে নির্লজ্জ ছোকরারা যেমন গোঁফ কামিয়ে সন্ন্যাসিনীর পোষাকে দর্শকদিগের সম্মুখে দর্শন দেয়, কিছুমাত্র সংকোচ কিংবা শ্লীলতা নেই, এদের দুজনেরও ঠিক সেই ভাব দেখা গেল। অনুষ্ঠানের কোনো ত্রুটি না থাকলেও এদের আর কিছু নেই; ধর্ম নেই, কর্ম নেই, সতীত্বের সৌকুমার্য নেই। স্ত্রীলোক দু জন মধ্যবয়সী, একটি প্রৌঢ়াবয়স্কা বললেও অত্যুক্তি হয় না। যার বয়স কিছু বেশি, সে এইমাত্র লালসাঙায় এসেছে; দেখে বোধ হলো সে এখনও বাসা নেয় নি; সর্বশরীর ধূলিধূসরিত, শ্রান্ত ক্লান্ত। এদের বিবাদের কারণ শুনে আমার মনে যুগপৎ লজ্জা ও দুঃখ হলো। এরা দুজনেই কেদারনাথ দর্শন করতে গিয়েছিল। বড় ভৈরবীর সঙ্গে একটি সাধুপুরুষ ছিল, কনিষ্ঠা ভৈরবী পূর্বদিন অপরাহ্ণে সেই সাধুটিকে ভুলিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। জ্যেষ্ঠা সন্ন্যাসিনী বহু পরিশ্রমে এখানে এসে তার হারানিধিকে আবিষ্কার করেছে, এবং সেই সাধুপুরুষের উপর অধিকার নিয়ে দুজনে বিষম ঝগড়া আরম্ভ করেছে। এ বিবাদের কথাবার্তা সমস্ত হিন্দুস্থানিতে পুষিয়ে ওঠে নি, কাজেই হিন্দুস্থানি ছেড়ে এখন বাংলায় কথা চলেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই হাত মুখের অতি কুৎসিত ভঙ্গি করছে। আমি সেখানে লজ্জায় দাঁড়াতে পারলাম না। যে সকল দর্শক সেখানে উপস্থিত ছিল, তারা বাংলা জানে না, কাজেই তারা পরম তৃপ্ত মনে এই বীরত্ব গাথা শুনে যাচ্ছিল। আমি সেখান হতে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলাম। কথায় কথায় অচ্যুত ভায়া এই কলঙ্ক কাহিনী শুনতে পেলেন; আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন "তারা সত্যিসত্যিই বাঙালি নাকি ? এতক্ষণ বল নি !"- এই বলে তিনি তাঁর সুবৃহৎ পার্বত্য-যষ্টি নিয়ে ভৈরবীদ্বয়ের দর্শনাকাঙ্খায় চটি ত্যাগ করলেন। আমি ও স্বামিজী মিলে কি তাঁকে ঠাণ্ডা করতে পারি ? শেষে অনেক নীতিকথা ব্যয় করে তাঁকে ফিরাই। ভৈরবীদ্বয় আপাতত রক্ষা পেলে, কিন্তু ভায়া তর্জন করতে করতে বললেন যে একবার তাদের সঙ্গে দেখা হলে এক লাঠির বাড়িতে তাদের ভণ্ডামি ভেঙে দেবেন।

নারায়ণে যাবার সময়ে লালসাঙায় এক বিনামা চোর সাধুর কীর্তিকাহিনী বলেছিলাম, এখন ফিরবার সময়ে দুইটি বাঙালি ভৈরবীর পাশব দৃশ্য দেখা গেল। স্বামিজীর ইচ্ছা ছিল যে, আজকার দিনটা লালসাঙায় থাকা যাক, বৈদান্তিক ভায়ারও তাতে বড় একটা আপত্তি ছিল না; কিন্তু যা হোক বসে থাকা আমার ভাল লাগলো না; কাজেই আমরা সেই অপরাহ্ণেই বেরিয়ে পড়লাম। শীঘ্র শীঘ্র নন্দপ্রয়াগে আসবার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল; আমাদের সঙ্গে এক অজ্ঞাতকুলশীল বালক সন্ন্যাসী জুটেছিল তার শরীরের অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। আজ অনেক কষ্টে তাকে লালসাঙা অবধি নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা যদি এখানে বাস করি, তা হলে এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় যে, সে একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়বে, তার শরীর এমন ভেঙে পড়বে যে, আর তার চলবার শক্তি থাকবে না। যদিও লালসাঙাতে চিকিৎসালয় আছে, কিন্তু যাকে আজ কয়দিন থেকে সঙ্গ করে ফিরছি, তাকে এই অপরিচিত স্থানে দাতব্য চিকিৎসালয়ে ফেলে যাব, এ কথাটা যেন মনে কেমন ঠেকতে লাগলো। তাকে হয় ত দুদিন পরে ডাক্তারখানা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। অথবা সাধারণত দাতব্য চিকিৎসালয়ের রোগীদের প্রতি যে প্রকাণ্ড যত্ন লওয়া হয়, তাতে এই দুর্বল রুগ্ন অসহায় বালকটি দুদিন আগেই জীবনলীলা শেষ করে বসবে। কোন রকমে তাকে নন্দপ্রয়াগে নিয়ে যেতে পারলে আমার আর সে ভয় থাকবে না। যখন নারায়ণ দর্শনে যাই, সেই সময়ে নন্দপ্রয়াগের দাতব্য-চিকিৎসালয়ের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় হয়েছিল, তাঁকে একজন দয়ালু ভাল ভদ্রলোক বলে আমার বেশ বিশ্বাস হয়েছিল। এই রোগীটিকে তাঁর হাতে দিয়ে যেতে পারলে তার যে অযত্ন হবে না এবং সেই ডাক্তারের যতটুকু বিদ্যা তাতে যদি বালকের রোগমুক্তির সম্ভাবনা থাকে তা হলে চাই কি, সে আবার সুস্থ হয়ে নিজ গন্তব্য স্থানে চলে যেতে পারবে। এই জন্যেই সেই অপরাহ্ণে তাড়াতাড়ি নন্দপ্রয়াগে আসবার জন্য বেড়িয়ে পড়া গিয়েছিল।

প্রাতে ছয় মাইল রাস্তা হেঁটেই বালকটি কাতর হয়েছিল; এবেলা আমাদের বাহির হবার আয়োজন দেখে সে যে অতি অনিচ্ছায় তার ঝুলিটি কাঁধে ফেলে বাহির হলো তা তার আকার-প্রকারেই বেশ বুঝতে পারা গিয়েছিল। কিন্তু কি করা যায় ! তার মঙ্গলের জন্যই তাকে আজ এই অপরাহ্ণে আবার ছয় মাইল পথ যেতে হলো। অপরাহ্ণ বলে আজ আর আমরা কেহই একাকী চললাম না; আমরা চারজন মানুষ একসঙ্গে চলতে লাগলাম। বালকটিকে ধীরে ধীরে চলবার জন্য স্বামিজী তার সঙ্গে নানাপ্রকার গল্প জুড়ে দিলেন। সে এমনই ধীর অথবা তার স্বাভাবিকতা গোপন করবার তার এতটাই দরকার যে, সে 'হুঁ' 'না' এই প্রকার দুই একটি কথা ভিন্ন বেশি বাক্যব্যয় মোটেই করলে না। তার এই প্রকার সংকোচের ভাব দেখে সে যে নিশ্চয়ই বাঙালী এ বিশ্বাস আমার ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছিল। সে যদি বালক না হতো তা হলে তার পরিচয়ের জন্য এত আগ্রহ হতো না; কারণ বাঙালীই হোক আর হিন্দুস্থানীই হোক সন্ন্যাসীদলের মধ্যে এ প্রকার লোকের সংখ্যা খুব বেশি, যাদের পূর্বজীবন না জানাই ভাল। আইনের হাত থেকে পালিয়ে জটাধারী হয়ে ভস্ম মেখে কতজন তাদের দুর্বহ জীবন যাপন করে, তার ঠিকানা কি ? কি কষ্টেরই জীবন তাদের ! হৃদয়ের মধ্যে সন্ন্যাসের বোঝা প্রকৃত সন্ন্যাসী অপেক্ষা তাদেরই বেশি করে বইতে হচ্ছে; তাদের ভান বেশি, কারণ তাদের আত্মগোপন বেশি দরকার। বালকটি অবশ্যই এমন কোনো অপরাধ করে নি, বা তার পক্ষে এমন কোনো কাজ করা সম্ভবপর নয়, যার জন্যে সে নবীন বয়সে সব ছেড়ে বনে বনে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পারিবারিক কোনো প্রকার অশান্তি, বা মনের কষ্টেই সে ঘর ছেড়ে ফকির হয়েছে; নতুবা ছেলেমানুষ, ইংরেজি Entrance অবধি পড়েছে, বয়সও অল্প এবং জাতিতে সম্ভবত বাঙালী, সে যে ধর্মের জন্য সব ছেড়েছে, এ কথা, এই কলি যুগের শেষভাগে পুনরায় প্রহ্লাদের ন্যায় ভক্তের আগমন সম্বন্ধে বিশ্বাসবান ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ সহজে, মোটেই বিশ্বাস করতে চাইবে না।

রাস্তায় এমন কোন ঘটনা উপস্থিত হয় নি, যার কথা বলা যেতে পারে, তবে রাস্তার বর্ণনা একটা দেওয়া যেতেই পারে; কিন্তু তার ভিতরে ত আর নূতন কথা কিছু নাই; সেই চরাই আর উৎরাই, সেই বন আর নির্ঝর; সেই হিমালয়, সেই পাখির কলতান, আর সেই জনশূন্য পথে আমাদের মধুর গমন। রাস্তার ধারে তেমনি অতুল শোভা বিকাশ করে ফুল ফুটে রয়েছে, অলকানন্দা তেমনি কুলকুলস্বরে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে; বনের মধ্যে পাখি সকল তেমনই গান করছে। এসব দেখতে আমরা একেবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

লালসাঙা থেকে নন্দপ্রয়াগ ছয় মাইল। আমাদের নন্দপ্রয়াগে পৌঁছিতে রাত হয়ে গেল; তাতে আমাদের বিশেষ কোন অসুবিধার ভয় ছিল না। এখন প্রত্যাবর্তনের পথ; কোথায় কি আছে সব আমরা জানি; যেখানে গিয়ে সুবিধামত থাকতে পারা যায়, তারও বন্দোবস্ত আমরা পূর্ব হতেই করতে পারি। নন্দপ্রয়াগে উপস্থিত হয়ে আমাদের সেই পূর্বাবাসেই অবস্থিতি হলো। রাত্রিকালে আর বালকটিকে দাতব্য-চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া হলো না। যতক্ষণ তাকে আমাদের কাছে রাখতে পারি, সেই ভাল। আমাদের পৌঁছানো সংবাদ পেয়েই থানার দারোগা মহাশয় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। নারায়ণে যাবার সময় এখানেই পুলিসের ইন্সপেক্টর বাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সেই সূত্রে নন্দপ্রয়াগ থানার দারোগা বাবুও আমাকে একটা বড় লোক ঠাউরে রেখেছিলেন। রাস্তায় কোন প্রকার অসুবিধা হয়েছে কি না, পুলিসের কোনো কর্মচারী যাত্রীর উপর কোনো প্রকার অত্যাচার করেছে কি না, ইন্স্পেক্টার সাহেবকে আমি কোনো পত্র লিখেছি কি না, এইসব কথা তিনি একটি একটি করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তাঁর কথাগুলির জবাব দিয়ে আমি সঙ্গী বালকের কথা পাড়লাম; তাকে যে দাতব্য চিকিৎসালয়ে রেখে যাব সে কথা জানিয়ে দিলাম, এবং তাঁদের ভরসায় যে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বালকটিকে ফেলে যাচ্ছি, সে কথাও বলতে ত্রুটি করা গেল না। দারোগা সাহেব প্রাণপণে এ কাজ করবেন বলে প্র্তিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। একে সে রোগী, তার তত্ত্বাবধান করা ত কর্তব্য কর্ম; তারপর আমি যখন এত করে অনুরোধ করছি এবং ছেলেটির ভার তাঁর উপরে দিয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছি, তখন তিনি যে প্রকারে হউক, তাকে আরাম করে দেবেন; সেই রাত্রেই বালকটিকে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু রাত্রিটা আমরা একসঙ্গে বাস করবো এই অভিপ্রায় প্রকাশ করায় অতি 'সবেরে' এসে একত্রে ডাক্তারখানায় যাওয়া যাবে, এই বন্দোবস্ত স্থির করে 'বন্দেগি' জানিয়ে নন্দপ্রয়াগের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা মহাশয় প্রস্থান করলেন। তিনি চলে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর অনুচরগণ সে রাত্রি আমাদের ছেড়ে সহজে যায় নি। আমার কথা ত বলেই রেখেছি, কোনো রকমে একবার কম্বলখানি জড়িয়ে পরতে পেলেই হয়, তা হলে স্বয়ং কুম্ভকর্ণও পেরে উঠেন কি না সন্দেহ। পরদিন ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত্রিই কনস্টেবলগণ বাজারে পাহারা দিয়েছে এবং তাদের চীৎকারে মরা মানুষেরও নিদ্রাভঙ্গ হয়; বৈদান্তিক ভায়া না কি অনেক রাত্রে তাদের উপর চটে উঠেছিলেন, কিন্তু আজ তারা মনিবের হুকুম পেয়েছে, আজ বেশ ভাল করে পাহারা দিতে হবে। কেউ যেন মনে না করেন, আমাদের মত অজ্ঞাতকুলশীল মুসাফির লোক আজ বাজারে বাসা নিয়েছে, রাত্রে হয় ত কিছু চুরি করে নিয়ে আমরা পালিয়ে যেতে পারি, সেই জন্যই এত কড়াকড়ি পাহারা। ব্যাপার এই, নীচে নেমে যাচ্ছি খুব সম্ভবত নীচে কোনো জায়গায় ইনস্পেক্টর বাবুর সঙ্গে দেখা হলে নন্দপ্রয়াগের পুলিস বন্দোবস্ত সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে আমি খারাপ কিছু বলতে পারি; যাতে তা না বলি, তারই জন্যে আজ এ প্রকার পাহারা ! নতুবা দোকানদারদের কাছে শুনলাম অন্য কোনো রাত্রে পাহারাওয়ালাদের সাড়া শব্দও পাওয়া যায় না।

পরদিন প্রাতঃকালে ( ৫ ই জুন শুক্রবার ) আমরা প্রস্তুত হবার পূর্বেই দারোগা সাহেব ও দুইজন বরকন্দাজ ধড়াচূড়া পরে এসে হাজির। স্বামিজী, বৈদান্তিক ও আমি তিনজনেই বালকটির সঙ্গে সঙ্গে দাতব্য চিকিৎসালয়ে গেলাম। ডাক্তারবাবু খুব খাতির যত্ন করলেন। পথে কোনপ্রকার অসুখ হয়েছিল কি না তার তত্ত্ব নিলেন; স্বামিজীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ডাক্তার অতি ভক্তিভরে তাঁর চরণ-বন্দনা করলেন। শেষে বালকটির কথা বলায় অতি আগ্রহে তাকে হাসপাতালে একটি ছোট ঘরে একাকী থাকবার বন্দোবস্ত করবার আদেশ দিলেন। বালকটিকে বিশেষ রকম তত্ত্ব লওয়ার জন্যে এবং তাকে ভাল করে শুশ্রূষা করতে যদি কিছু ব্যয় হয়, আমি তা দিয়ে যেতে প্রস্তুত হওয়ায় ডাক্তার বাবু বড়ই দুঃখিত হলেন। চিকিৎসালয়ের নিয়মানুসারে সরকার হতেই সব দেওয়া হয়ে থাকে; তা ছাড়াও যদি বিশেষ কিছু দরকার হয়. তাহলে সে দেওয়ার ক্ষমতা ভগবান তাঁহাকে দিয়েছেন, এ কথা তিনি অতি বিনীতভাবে বললেন। - আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।

বালকটির জন্যে বিছানা প্রস্তুত হলে তাকে সেই ঘরে নিয়ে যাওয়া হল, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। এখন বিদায় গ্রহণের সময় উপস্থিত হল। আজ তিনদিন যদিও বালকটিকে পেয়েছি, তবুও তাকে আমাদের একজন নিতান্ত আপনার জন বলে মনে হতে লাগলো। এই অসহায় রুগ্ন অবস্থায় তাকে এই পর্বতের মধ্যে ফেলে যাচ্ছি; এ জীবনে হয় ত আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। এই দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে সে যে আর বাহির হতে পারবে, তারই বা নিশ্চয়তা কি, এই সব কথা ভেবে প্রাণের মধ্যে কেমন করতে লাগলো। তারপর যখনই তার সেই রোগক্লিষ্ট মলিন মুখের দিকে দৃষ্ট পড়তে লাগলো, তখনই একটা অব্যক্ত শোকের ছায়া এসে আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন করতে লাগলো। তবুও আমি ধীর নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম; বৈদান্তিক ভায়ার দুইটি চক্ষু বিস্ফারিত দেখে বেশ বুঝতে পারলাম, মায়াবাদী অনেক কষ্টে মনের কোমল ভাব গোপন করছেন। স্বামিজী কিন্তু কেঁদে ফেললেন। তিনি আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না; বালকটির হাত ধরে তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। হায় সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী তুমিই ধন্য ! নিজের সব ত্যাগ করে এসে এখন পথে ঘাটে যাকে কাতর দেখ, যাকে দুঃখী দেখ, তারই জন্যে কেঁদে আকুল। আমারা সর্বত্য্যগী সন্ন্যাসীর এই অশ্রুত্যাগ দেখতে লাগলাম। পরের জন্যে যে এমন করে চোখের জল ফেলতে পারে, সে দেবতা নয় ত কি !

বেলা হয়ে যায় দেখে, আমরা অতিকষ্টে বালকের নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করলাম। ডাক্তারবাবু ও দারোগা মহাশয়কে বিশেষ করে অনুরোধ করা গেল। শেষে তাঁদের নিকট হতে বিদায় নিয়ে আমরা নন্দপ্রয়াগ ত্যাগ করে চলে এলাম। আর হয় ত জীবনে নন্দপ্রায়াগ দেখা হবে না। যে সব স্থান ছেড়ে যাচ্ছি, কতদিনের সাধনবলে তবে এমন সব পবিত্র স্থান দেখা হয়েছিল; আবার কি এ পুণ্যভূমিতে আসা হবে ? কে জানে ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে ? কে জানে অদৃষ্টদেবী অন্তরাল থেকে আমাদিগকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু বালকটির কথাই মনে হতে লাগলো। সে যদি আমাদের পরিচয় দিত, তা হলে তার জন্যে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারতাম। সে ত নিজের পরিচয় দিলে না। কি এক মনের আবেগে, কি এক হৃদয়ভেদী কষ্টে, যন্ত্রণায় সে লোকালয় ছেড়ে এই ভয়ানক পর্বতপ্রদেশে মাথা দিয়েছে, তা না জানতে পেরে তার উপরে আমাদের স্নেহ আরও বৃদ্ধি হয়েছিল। এমনি করে কত পথিকের সঙ্গে কতদিন কত পথে দেখা হয়েছিল। আজ হয় ত তাদের চেহারা পর্যন্তও মনে নাই।

(চলবে)

 

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.