প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২৫)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩) (২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

বিশ্রাম

৩১ মে, রবিবার। - আজ ইংরেজি মাসের শেষ দিনে খ্রিস্টানদিগের বিশ্রামবারে ভগবানের অনুগ্রহে অখ্রিস্টান আমরাও বিশ্রাম গ্রহণ করলাম। এ পথে বদরিকাশ্রমই শেষ তীর্থ। তীর্থের তালিকার মধ্যে ব্যাসগুহার নাম নেই, তবুও আমরা সন্ধানে সন্ধানে সেখানে ঘুরে এলাম। এখন নিকটে বা দূরে অন্য কোনও তীর্থের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই আমাদের হাতে আর কোনো কাজ নেই। এতদিন কাজের মধ্যে ছিলাম; ভাবনা চিন্তা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা কিছুতেই বড় ব্যাকুল করতে পারে নি। যখন সংকটাপন্ন বিপদরাশি পাষাণস্তূপের মত জীবনের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে, তখন সেই বিপদজাল হতে উদ্ধার হবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করা গিয়েছে। তারপর আর সে কথা মনে হয় নি । নূতন উৎসাহ নূতন বল এবং অপেক্ষাকৃত অধিকতর স্ফূর্তিতে নব নব পথে অগ্রসর হওয়া গেছে। ক্ষুধার সময় একমুষ্টি আহার জুটলে ভাল, না জুটলো পথ হতে দুটো ফলমূল সংগ্রহ করে আহার করা যেত, অথবা পরিপূর্ণ মাত্রায় উপবাস। নিদ্রার জন্যে কোনো দিন কিছু আয়োজন করতে হয় নি, কিন্তু বিনা আয়োজনে, কি গিরিগুহা, কি অনাবৃত নদীতীর, কোথাও তাঁর শুভাগমনের ব্যাঘাত জন্মেনি। আজ একমাসেরও অধিক পূর্বে যে ব্রত মাথায় নিয়ে বদরিনাথের এই তুষার শৈলমণ্ডিত সুপবিত্র পীঠতল দেখতে অগ্রসর হয়েছিলাম - আজ তার শেষ। তাই আজ শ্রান্তিভরে হৃদয় ভেঙে পড়েছে, এতদিন ঘুরে বেড়ালাম - যে আশায় এত দেশ্ভ্রমণ, তার কিছুই পূর্ণ হলো না। প্রকৃতির দৃশ্য বৈচিত্র্যে সাধকের একান্ত সাধনায় শত শত ভক্ত হৃদয়ের নিষ্ঠা ও ভক্তিতে যে মহান ভাব, যে পবিত্রতা, যে একটা অব্যক্ত মাধুর্যের পরিচয় পেয়েছি, তা প্রকৃতই শান্তিপ্রদ; কিন্তু সে শান্তি ক্ষণস্থায়ী; হৃদয়ের অসীম পিপাসা তাতে প্রশমিত হয় না; প্রাণের কঙ্কালসার জীর্ণ আবরণ ভেদ করে একটা দুর্দমনীয় অতৃপ্তি এখনও হাহাকার করছে। বিশ্বের সমস্ত সুন্দর জিনিস তাকে এনে দিচ্ছি, সে একবার আগ্রহের সঙ্গে হাতে করে নিচ্ছে, তার পর তুচ্ছ জিনিসের মত দূরে ফেলে দিচ্ছে। কতবার হয় তো পরশমণি এনে তার হাতে সমর্পণ করে দিয়েছি, কিন্তু কাচখণ্ডের মত সে তা দূরে ফেলে দিয়েছে। হায় যদি সে একবার চিন্তে পারতো তা হলে হয় তো তার এই তৃষিত ক্রন্দন, এই জীবনব্যাপী দীর্ঘনিঃশ্বাস থেমে যেত।

আজ আর কোনো কাজ নেই, আজ শুধু বিশ্রাম করবো ভেবে বদরিকাশ্রমের শুভ্র তুষারমণ্ডিত ক্ষুদ্র উপত্যকার একখানি ছোট ঘরে কম্বল জড়িয়ে বেশ গরম হয়ে বসা গেল। কিন্তু চিন্তার আর বিরাম নেই; আজ আবার পুরাতন সমস্ত কথা নূতন করে মনে হতে লাগলো। বোধ হলো, জীবনটা আগাগোড়া একটা নাটক; এক অংশের সঙ্গে আর এক অংশের কোনও সংশ্রব নেই; যবনিকা পড়ছে এবং যবনিকা উঠছে; আর আমি তারই মধ্যে কখন ছাত্র, কখন শিক্ষক, কখন সংসারী, কখন বৈরাগীর অভিনয় করে যাচ্ছি। কেউ করতালি দিচ্ছে, কারও বা বুকে বেদনা এবং চোখে অশ্রুর সঞ্চার হচ্ছে; জিজ্ঞাসা করছে আর কতদূর ? এ জীবন ট্রাজিডিতে আমিই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি, অন্যেরা ত দূরের কথা; এখন এ পর্বতের প্রান্ত হতে দেহের বৃন্তটুকু থেকে জীবন খসে পড়লেই বুঝি নাটকাভিনয়ের অবসান হবে। জানি না কোথায় এর শেষ অঙ্কের সমাপ্তি। যেখানেই হোক আমার কিন্তু বিশ্রাম নিতান্ত দরকার হয়ে পড়েছে।

শৈশবের কথা, যৌবনের কথা একবার সেই রাজ্যের সুখ-কুঞ্জ পল্লীগ্রাম, একবার যৌবনের কর্মবৈচিত্র্যে পূর্ণ কলিকাতা, ঘুরে ফিরে সেইগুলিই এই পাষাণ প্রাচীরবেষ্টিত হিমালয়ের উপত্যকার মধ্যে আমার কর্মশ্রান্ত ক্লান্ত হৃদয়কে আন্দোলিত করতে লাগলো। এই লোটা, কম্বল এই সন্ন্যাস শুধু বিড়ম্বনা। হৃদয়ের সুখ দুঃখ লোটা-কম্বলে নিয়ন্ত্রিত হবার কথা নয়, যা ফেলে এসেছি, তাদের আসক্তি ও আকর্ষণ এখনও চিরনবীন। বাল্যকালে কোনদিন গৃহপ্রান্তে একটা খেজুর গাছ পুতে এসেছিলাম সে আজ শাখাবাহু বিস্তার করে এখনও যেন আমাকে আহ্বান করছে; বাড়ির অদূরবর্তী গৌরী নদী - সকালে সূর্য উঠবার সময় তার চড়ার উপর বালিগুলি চিকচিক করতো; ছোট ছোট সঙ্গীদের সঙ্গে তারই উপর লাফালাফি করে বেড়াতাম, সে যেন সে দিন ! আবার বর্ষাকালে যখন সমস্ত চড়া ডুবে যেত, চড়ার উপরের বনঝাউ গুলিকে নত করে নদীর স্রোত চলত তখন আমরা কতবার সেখানে সাঁতার কেটেছি; পরিশ্রান্ত হলেই ঝাউগাছের আগা ধরে বিশ্রাম করতাম এবং কদাচিৎ দূর থেকে মার গলার সাড়া পেলেই বাবলা গাছের সারের ভিতর দিয়ে বানের জলে আকাণ্ড নিমজ্জিত কচুবনকে পদদলিত করে সরকারদের গোয়াল ঘরের ভিতর গিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। একদিন পায়ে একটা বাবলার কাঁটা বিঁধেছিল। এখনও মনে করতে চোখে জল আসে - মা আমার সেই কোমল পা'খানি কোলের উপর নিয়ে ছুঁচ দিয়ে কত যত্নে সেই কাটাটা তুলে দিয়েছিলেন। সামান্য একটা কাঁটা বের করবেন, তাতে কত যত্ন, কত ভয় সাবধানতা, - যেন তাঁর প্রাণের সমস্ত আগ্রহ সেই ক্ষুদ্র ছুঁচ-বৃন্তে ভর করেছিল। কথাটা সামান্য এবং সে দিন বহুকাল চলে গেছে, কিন্তু জীবনের এই মরুপ্রান্তে শৈশবসুখের সেই ইতিহাসটুকু এখনো ভুলিনি।

সমস্ত সকাল-বেলাটা সেই গৃহকোণে বসে সেই রকম চিন্তায় কেটে গেল। স্বামিজী কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন; বৈদান্তিক ভায়া বোধ করি, কোন জায়গায় তর্কের গন্ধ পেয়েছিলেন; তিনি অনেকক্ষণ হতে এ অঞ্চল ছাড়া। বেলা প্রায় দশটা সাড়ে-দশটার সময় স্বামিজী কুটিরে এসে উপস্থিত হলেন। আমাকে চিন্তামগ্ন দেখে তিনি কিছু শঙ্কিত হলেন, স্নেহ মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,"তোমার কি কিছু অসুখ হয়েছে ?" তাঁর সেই কোমল স্নেহের স্বরে আমি অনেকটা তৃপ্তি অনুভব করলাম, বললাম, "না আমার অসুখ হয় নি, আমি আজ বিশ্রাম করছি" - তিনি হাফ ছেড়ে বললেন, "তবু ভাল !" আমি যে তখন কি গুরুতর বিশ্রামে প্রবৃত্ত তা তিনি বোধ করি বুঝতে পারেন নি। যা হোক ক্রমাগত এই পথশ্রম দুশ্চিন্তা এবং ক্লান্তিতে আমি একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়েছি, তা তিনি কতটা অনুমান করতে পারলেন, - সুতরাং আমাকে একটু প্রফুল্ল করবার জন্য অনেক বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তত্ত্বের অবতারণা করলেন। সবই পুরানো কথা - সেই সংসার অসার, জীবন মায়াময়, আসক্তি সকল দুঃখের মূল, সুখ দুঃখ হতে হৃদয়কে অব্যাহত রাখাই প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভের মূল উপায়। পাঁজি পুঁথিতে এবং ধর্মপ্রচারকদিগের মুখে এই বাঁধি বোল বহুদিন হতে শুনে আসা যাচ্ছে, সুতরাং এ সকল কথা শুনতে আর তত আগ্রহ বোধ হল না। তখন তিনি তাঁর যৌবনকালের ভ্রমণ বৃত্তান্ত আমাকে বলতে আরম্ভ করলেন। আসামের পাহাড়ে পাহাড়ে কেমন তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন, ভগবৎকৃপায় কতবার তিনি আসন্ন বিপদের হাত থেকে কেমন করে রক্ষা পেয়েছেন, সেই কথা বলতে লাগলেন; কিন্তু আমার সে নিস্তেজ ভাব কিছুতেই দূর হল না।

দুপুরের সময় একাই বেড়াতে বেরুলাম। ভিড় অনেক কম, যাত্রীরা প্রায় সকলেই বাসায় গেছে - এখনও পথিপ্রান্তে তীর্থযাত্রার কতক কতক নিদর্শন আছে; রাস্তা জনহীন, মধ্যাহ্নের রৌদ্রে আরও নিরালা বলে বোধ হতে লাগলো; রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে; উপরে পর্বতশৃঙ্গে গলিত তুষার চিক চিক করছে; দূরে একটা গাছে পাতা নড়ছে এবং তুষারনির্মুক্ত ধূসর গাত্র উঁচু নীচু ফাটল সংযুক্ত, দেখতে মোটেই ভাল লাগছে না। রাস্তা দিয়ে যেতে মনে হল আমাদের সেই বঙ্গের সমতল ক্ষেত্রের খানিকটা শস্য-শ্যামল খোলা মাঠ, অবাধ বায়ুর মধুর হিল্লোল, নিকটে একটা ছোট খাল, জেলেরা তাতে বাসজাল ফেলে মাছ ধরছে, বটতলায় রাখালেরা মিলে জটলা করছে - আর শস্যক্ষেত্রের দিকে একটা গোরুকে ছুটতে দেখে দৌড়ে এসে তাকে ঠেঙাচ্ছে, বুঝি এই রকম প্রাচীন ও অভ্যস্ত দৃশ্যের মধ্যে গেলে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বাঙালির ছেলে ক্রমাগত এই রকম লোটা কম্বল ঘাড়ে করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে আর কিছুতেই ভাল লাগছে না। এ পাহাড় প্রকৃতির সঙ্গে আমার প্রকৃতির কোন রকম মিশ খাচ্ছে না। সুখ চেয়ে স্বস্তি ভাল - অতএব এখন মনে করছি একবার বাড়ি ফিরে যাব; এই সন্ন্যাস অথবা তার চেয়েও অতিরিক্ত কিছু আমার আর পুষিয়ে উঠছে না ভাবছি -
"এখন ঘরের ছেলে, বাঁচি ঘরে ফিরে গেলে,
দু'দণ্ড সময় পেলে নাবার খাবার। "
যারা আমার এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত একটু ঔৎসুক্যের সঙ্গে পড়ছিলেন, এবং প্রতি মুহূর্তে আমাকে একটা দিগ্‌গজ সাধুরূপে পরিণত হওয়া দেখবার আশায় ধৈর্যাবলম্বন করেছিলেন, তাঁরা হয় তো এতদিনের পরে আমার এই লোটা কম্বল এবং বক্তৃতার মধ্যে থেকে আমার স্বরূপ নিরীক্ষণ করে ভারি নিরুৎসাহ হয়ে পড়বেন, কারো কারো মুখ দিয়ে দু'চারিটি কটুবাক্যও বের হতে পারে। আমার তাতে আপত্তি নাই, এ ছদ্মবেশের চেয়ে সে বরং ভাল।

আমার মন ঢাউস ঘুড়ির মত অনন্ত বিস্তৃত কল্পনারাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমি বাজারের পথ ছাড়িনি। ঘুরতে ঘুরতে বাজারের মধ্যে এসে দেখলাম, একটা জায়গায় অনেকগুলি লোক জড় হয়েছে। প্রথমেই মনে হল হয় ত কোনো সাধুর কিঞ্চিৎ গাঁজার দরকার হয়েছে, তাই সে কোন রকম বুজরুকি দেখিয়ে গাঁজার অর্থ সংগ্রহের চেষ্টায় আছে। ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য আমিও ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলাম। দেখলাম সাধু সন্ন্যাসী আমার সেই পূর্বপরিচিত পণ্ডিত কাশীনাথ জ্যোতিষী। জ্যোতিষী মহাশয় সেই সমবেত ক্ষুৎকাতর পাহাড়ীদের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছেন। কাকেও পয়সা, কাকেও কাপড় দান করছেন, তাঁর মিঠে কথায় সকলেই সন্তুষ্ট হয়েছে। এই রকম ব্যবহারে তিনি অনেক জায়গায় লোকের উপর আধিপত্য স্থাপন করে নিয়েছেন। তাঁর হৃদয়টা স্বভাবতই দয়ালু, চিত্ত উদার বলে বোধ হয়; দোষের মধ্যে তিনি একটু প্রশংসাপ্রিয়। নির্দোষ কটা লোক ? সে জন্যে তাঁকে বড় নিন্দা করা যায় না। পূর্বেই বলেছি একবার তাঁহার অনুগ্রহের উৎপাতে আমি বিষম বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম, আজ তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই আগ্রহে তিনি কাছে ডাকলেন; আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, পথে আর কোন অসুখ হয়েছিল কি না, তারও খোঁজ নিলেন। তাঁর সমস্ত কথার উত্তর দিয়ে শান্ত অপরাধীর মত তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে বসতে বলে তাঁর ভৃত্যকে তিনি তাঁর বাক্সটা আনতে আদেশ দিলেন। আবার বাক্স ! সর্বনাশ ! এখনি হয় তো তিনি হরেক রকম ভাষায় লেখা একতাড়া সার্টিফিকেট খুলে বসবেন আর এই সব পাহাড়ীদের সম্মুখে আমাকে তার ব্যাখ্যা করতে হবে ? কি কুক্ষণেই আজ বাজারে পা দিয়েছিলাম ! মনে বিলক্ষণ অনুতাপের উদয় হল; কিন্তু সে জন্য জ্যোতিষী মহাশয়ের বাক্সের শুভাগমন বন্ধ রইল না।

যা হোক শীঘ্রই আমার ভয় দূর হল; দেখলাম এবার আর তিনি সার্টিফিকেটের তাড়ায় হাত দিলেন না, বাক্সের মধ্য হতে একখানা খাম বের করে হাস্যপূর্ণ-মুখে আমার দিকে চাইলেন এবং সেই খামখানি আমার হাতে দিলেন। খামখানি চতুষ্কোণ, সুন্দর মসৃণ এবং পুরু, ডাকহরকরাদের ময়লা হাতের সংস্পর্শে কিঞ্চিৎ শ্রীভ্রষ্ট। খামের সম্মুখে সুন্দর ইংরেজি অক্ষরে জ্যোতিষী মহাশয়ের নাম লেখা অপর দিকে স্বর্ণবর্ণে অঙ্কিত একটা মনোগ্রাম; মনোগ্রামটি দেখে লেখকের নাম ঠিক ধরতে পারলাম না। ডাকঘরের মোহর দেখে বুঝলাম, এ চিঠি কলিকাতা থেকে আসছে। চিঠিখানি হাতে করে কি কর্তব্য ভাবছি; তখন জ্যোতিষী মহাশয় চিঠিখানা পড়তে আমায় অনুমতি করলেন। পত্র খুলে দেখলাম, কলিকাতা হতে মহারাজ সার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাহাদুর জ্যোতিষী মহাশয়কে এই পত্রখানি লিখেছেন। হিন্দিভাষায় লেখা মহারাজের স্বাক্ষর ইংরেজিতে। জানিনে পত্রখানি রচনা কার, কিন্তু যারই রচনা হোক ভাষাটি অত্যন্ত সুন্দর, হিন্দি ভাল লিখতে না পারি, বহুদিন এ হিন্দিভাষার দেশে থেকে ভাষার ভালমন্দ বুঝবার একটু ক্ষমতা হয়েছিল। বহুদূরদেশ প্রবাসী একজন হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণের জন্য মহারাজ বাহাদুরের এরূপ যত্ন প্রশংসনীয়। জ্যোতিষী মহাশয়ের শরীর ভাল নয় তাই মহারাজ তাঁকে দেশভ্রমণ ত্যাগ করে শীঘ্রই দেশে অথবা কলিকাতায় প্রত্যাগমনের জন্য বারবার অনুরোধ করে পত্র লিখেছেন। জ্যোতিষী মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার সঙ্গে মহারাজের আলাপ আছে কি ন। মহারাজের অনেক মহৎ গুণের কথাও আমাকে বললেন, তিনি যে অনেক বড় রাজা ও মহারাজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ তাও দুচারটি উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করলেন। প্রশংসাভাজন লোকের প্রশংসা করাই কর্তব্য কিন্তু আমার সর্বাপেক্ষা অধিক আনন্দের বিষয় এই যে কতকগুলি বিদেশি লোক একত্র হয়ে এই দূরবর্তী হিমালয়ের অন্তরালে আমার একজন স্বদেশি ও এবং স্বজাতীয় এমন প্রশংসা করলেন। স্বজাতীর সমস্ত লোকের মধ্যে পরস্পর যে একটা হৃদয়ের গভীর টান আছে সেদিন তা আমি বেশ বুঝেছিলাম; বুঝি শতলক্ষ বাঙালির মধ্যে দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রশংসা শুনলে মনে এমন আনন্দের সঞ্চার হতো না; কিন্তু এখানে বাঙালি আমি একা - স্বদেশ আমার বহু পশ্চাতে; সেই প্রাতঃসূর্যের স্নিগ্ধ মধুর কিরণোজ্জ্বল আমার মাতৃভূমি সেই নদীমেখলা শস্য-শ্যামলা বঙ্গদেশ - আমার মা বাবা ভাই বোনের পবিত্র স্মৃতিভূষিত চিরবাঞ্ছিত ভূস্বর্গ আমার তৃষিত হৃদয়ের একমাত্র আকাঙ্খার ধন ! এখানে প্রত্যেক বাঙালির স্মৃতিই আমার কাছে পরম আদরের বস্তু, আমার বোধ হতে লাগলো, জ্যোতিষী মহাশয়ের নিকট আমার একজন প্রিয়তম পরমাত্মীয়ের গল্প শুনছি।

জ্যোতিষী মহাশয়ের একটা বাহাদুরি এই যে, তিনি গল্প করে কখনও ক্লান্ত হন না। ছেলেবেলায় বর্ষাকালে কতদিন সন্ধ্যাবেলা ঘরের মধ্যে মাদুর বিছিয়ে শুয়েছি, আর স্তিমিত প্রদীপের কাছে বসে পিসিমা তাঁর দৈত্যদানব রাক্ষস-রাক্ষসীর রূপকথা বলতেন। আষাঢ়ের সেই দীর্ঘ দিনের অবসানে খেলা-শ্রান্ত ক্লান্ত শিশু শরীরটি নিতান্ত আলস্য-বিজড়িত হয়ে উঠতো; তারপর মেঘখণ্ডিত রাত্রি, মেঘের ডাক, বৃষ্টির ঝম্‌ ঝম্‌ শব্দ, সেই শব্দে বিশ্বের সমস্ত নিদ্রা একত্র জড় হয়ে কোমল নয়ন-পল্লব ঢেকে ফেলতো। পিসিমার অসম্ভব আষাঢ়ে গল্পের অসম্ভব নায়কটি, তার প্রেয়সীর অনুরোধে যখন অতল মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে অঞ্জলি পুরে পদ্মরাগমণি তুলছে, ঠিক সেই সময়ে আমাদের "হুঁ" বলা বন্ধ হয়ে যেত; পিসিমাও তার শ্রোতাদিগকে নিদ্রা-কাতর দেখে দুঃখিত মনে হরিনামের মালায় অধিক করে মনঃসংযোগ করতেন ! কিন্তু জ্যোতিষী মশাই গল্প করবার সময় পিসিমার চেয়েও বাড়িয়ে তোলেন। কেউ তাঁর কথায় "হুঁ" বলুক আর না বলুক, শুনুক আর না শুনুক, তিনি অনর্গল বলে যান, এবং বোধ করি তাতে তাঁর তৃপ্তির অভাব হয় না। তবে সৌভাগ্যবশত তাঁর নিবিষ্টচিত্ত সহিষ্ণু শ্রোতা প্রায়ই দেখা যায়। আজ গল্পের অনুরোধে বেলা একটা পর্যন্ত জ্যোতিষী মহাশয়ের স্নানাহার হয় নি; আমি তাঁকে সে বেলার মত সভাভঙ্গ করতে অনুরোধ করলাম। তিনি উঠে গেলেন আমি সে স্থান পরিত্যাগ করলাম।

বাজারের দিক ছেড়ে যে দিক দিয়ে বদরিকাশ্রন যেতে হয়, সেই দিকে খানিকদূর গেলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি, একদল সাধু আসছে। পাঠকগণের হয় তো মনে আছে, আমরা যখন এই পথে আসি, তখন দ্বিতীয় দিনে একদল উদাসী সাধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল - এ সেই দল; কেদারনাথ দর্শন করে আজ এখানে এসেছে। সাধুদের কাহারও কাহারও সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় হয়েছিল। তাদের সঙ্গে যথারীতি অভিবাদন ও প্রত্যাভিবাদন শেষ হতে না হতেই আমার সেই পূর্ব পরিচিত বাঙালী সাধুটি এসে উপস্থিত হলেন, এবং আনন্দের সঙ্গে আমাকে আলিঙ্গন করলেন। পরিষ্কার বাংলায় বললেন, "ভাই, আর যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে এ আশা ছিল না" - সেই সকল সাধুকে পেয়ে আমার বড়ই আনন্দ হলো। আজ আমার মনের অবস্থা অতি খারাপ; এ অবস্থায় আমার সহধর্মী একজন স্বদেশি লাভ বিধাতার বিশেষ অনুগ্রহ বলে মনে হলো ! সাধুকে সঙ্গে নিয়ে আড্ডার দিকে চললাম। তাঁর সঙ্গে খান দুই পুঁথি, একটা কমণ্ডুল, একটা ছেঁড়া কম্বল। তাঁর তখনও আহারাদি হয় নি। আমি বাজার হতে তাঁকে খাদ্যসামগ্রী কিনে দিতে চাইলাম, কিন্তু তিনি তাতে নিষেধ করলেন, বললেন সঙ্গীদের কারও খাওয়া দাওয়া হয় নি, এ অবস্থায় তাঁর আহারাদি শেষ করা নিয়ম বহির্ভূত। কোনদিনই বেলা চারিটার আগে তাঁর আহার হয় না, কারণ দলে লোক অনেক, তার উপর গ্রন্থ সাহেবের পূজা আছে; পূজা ও ভোগের পর ইহারা আগে অতিথি অভ্যাগতদিগের আহার করায়, পরে নিজেদের ব্যবস্থা।

আমরা ঘুরতে ঘুরতে বেলা তিনটার সময় বাসায় ফিরে এলাম। স্বামিজী ও শ্রীমান অচ্যুতানন্দ বাসাতেই ছিলেন। আমরা চারিজন গল্প আরম্ভ করলাম। কিন্তু সংসারে অবিমিশ্র সুখ কোথায় ? গল্পের আরম্ভেই অচ্যুত ভায়া আগন্তুক সাধুর সঙ্গে তর্ক করবার এক বিপুল আয়োজন করে বসলেন। সাধুটির তখনও আহার হয় নাই এবং পথশ্রমে তিনি নিতান্ত ক্লান্ত, সুতরাং তিনি তর্কের সুবিধা সত্ত্বেও তাহাতে মনযোগ দিলেন না। বেলা প্রায় চারটে বাজে দেখে আগন্তুক সাধু উঠে গেলেন, বললেন শীঘ্রই আবার ফিরে আসবেন। আসন্ন তর্কের আশা বিলুপ্ত হওয়াতে বৈদান্তিক নিরুৎসাহ চিত্তে নিশ্চলদাসের বেদান্তদর্শন খুলে বসলেন। আমি দেখলাম, বেচারা নিতান্ত অসুবিধায় পড়েছে, অতএব প্রস্তাব করলাম, "এস এই তীর্থস্থানে বসে আমরা একটু শাস্ত্রালোচনা করি। " এই রকম শাস্ত্রালোচনা যে তর্কের ভূমিকা, তা স্বামিজীর বুঝতে বাকি রইল না। তিনি বললেন, "তোমরা বাপু শাস্ত্র চর্চা কর, আমি একটু বাহিরে যাই। " স্বামিজী রণে ভঙ্গ দিলেন, আমরা মায়াবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিবর্তনবাদ প্রভৃতি নিয়ে এক ঘোর দার্শনিক তর্ক জুড়ে দিলাম। আমার উদ্দেশ্য অচ্যুত ভায়াকে কিছু জব্দ করা, সুতরাং যত তর্ক করি না করি, ক্রমাগতই বলি, "আরে ভাই, তুমি এই সোজা কথাটা বুঝতে পারছ না; এটা যার মাথায় না আসে, তার পক্ষে তর্ক না করাই নিরাপদ। " বুদ্ধির উপর দোষারোপ করলে, অতি ভালমানুষরও রাগ হয়। বৈদান্তিক আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, এবং অধিক উৎসাহের সঙ্গে নানা রকমের শ্লোক আওড়াতে লাগলেন, আমি বলি, "হল না, - হল না, ও শ্লোক ঠিক এখানে খাটবে না। " "কেন খাটবে না" বলে তিনি আবার সেই শ্লোকের ব্যাখ্যা আরম্ভ করেন, কোন্‌ টিকাকার কি বলে গেছেন তা পর্যন্ত বাদ গেল না।

ক্রমে সন্ধ্যা উপস্থিত। স্বামিজীর সঙ্গে সাধু কুটিরে প্রবেশ করলেন; তখনও আমাদের তর্ক সমানভাবে চলছে। স্বামিজী বৈদান্তিককে ডেকে বললেন "রাত্রি হয়ে এল, শুধু তর্কতে ক্ষুধানিবৃত্তির কোন সম্ভাবনা নেই, এখন তর্ক ছেড়ে আহারের বন্দোবস্তে মন দিলে হয় না কি ?" প্রবল যুদ্ধের মধ্যে শান্তির শ্বেত নিশান দেখালে যেমন অর্ধপথে যুদ্ধনিবৃত্তি হয়, তেমনই স্বামিজীর এই কথায় তর্কযুদ্ধ হঠাৎ থেমে গেল ! পৃথিবীর অনেক তর্ক অন্নচিন্তায় নিষ্পত্তি হয়ে যায়; আমাদেরও তাই হলো। সেই সন্ধ্যাকালে দিবা ও রাত্রি, আলো ও অন্ধকারের মধুর মিলনক্ষণে স্বামিজী ও আগন্তুক সাধু সংযত হৃদয়ে পুরাণের শান্ত-গম্ভীর বিষয় আলোচনা করতে লাগলেন; তখন দূরে মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টা ধ্বনিত হচ্ছিল, দূরে সন্ন্যাসীর দল সমস্বরে ভজন আরম্ভ করেছিল; আমার প্রাণের মধ্য হতে একটা ব্যাকুল স্বর নিতান্ত কাতর ভাবে যেন গাহিতে লাগিল -
"কী করিলি মোহের ছলনে।
গৃহ তেয়াগিয়ে, প্রবাসে ভ্রমিলি,
পথ হারাইলি গহনে।
(ঐ) সময় চলে গেল, আঁধার হয়ে এল
মেঘ ছাইল গগনে।
শ্রান্ত দেহ আর চলিতে চাহে না,
বিঁধিছে কণ্টক চরণে । "
অনেক রাত্রি পর্যন্ত এই গানটি পুনঃ পুনঃ আমার মনে ধ্বনিত হতে লাগল। কেবলই মনে হতে লাগল, "শ্রান্ত দেহ আর চলিতে চাহে না, - বিঁধিছে কণ্টক চরণে !" নানকের কথা ও কবীরের দোঁহা আবৃত্তি করে অনেক রাত্রে আগন্তুক সাধু ও স্বামিজী শয়ন করলেন, আমিও কুটিরের একপ্রান্তে কম্বলশায়ী হলাম। এবারের মত আমাদের তীর্থযাত্রা শেষ হলো। সকালে আমরা দেশে ফিরব, - দেখি নূতন পথ নূতন দেশ দিয়ে ফিরে যেতে যদি কোন রত্নের সন্ধান পাই।

(চলবে)

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.