প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমালয় (২৬)

এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।

[জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জলধর সেনের 'হিমালয়' লেখাটি ভারতী-তে এক সময়ে প্রকাশিত হয়। লেখাটি সেকালে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রচুর বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল - যা নিয়ে অবসর-এ আগে লেখা হয়েছে (পড়ুন জলধর সেন)। লেখাটি এযুগের পাঠকদেরও ভালো লাগবে এই বিশ্বাসে এটি অবসর-এ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি হরফ-ফণ্টে করে পাঠিয়েছেন দীপক সেনগুপ্ত।]

---------------

হিমালয়
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২) (১৩) (১৪) (১৫) (১৬) (১৭) (১৮) (১৯) (২০) (২১) (২২) (২৩)
(২৪) (২৫) (২৬) (২৭) (২৮)

রায় বাহাদুর শ্রী জলধর সেন

প্রত্যাবর্তন

২৯ মে, শুক্রবার। - অপরাহ্ণে বদরিকাশ্রমে উপস্থিত হই। শনি, রবিবারে সেই পবিত্র তীর্থেই কাটানো গেল। আমাদের হিন্দুদিগের মধ্যে একটা নিয়ম আছে, প্রত্যেক তীর্থস্থানেই তে-রাত্রি বাস করতে হয়। আমরাও হিন্দুধর্মের সকল নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলেও তীর্থ স্থানে তে-রাত্রিবাসের পুণ্য অর্জন করা গেল।

তিনদিন কাটানো গেল, তবু এখান হতে ফিরতে ইচ্ছা হয় না, এমন সুন্দর স্থান ! ভারতে সুন্দর অনেক স্থানই দেখা গিয়াছে, কিন্তু এমন শান্তিলাভ আর কোথাও হয় নি। অনন্ত সুন্দরের পরিপূর্ণ সত্তায় আত্মাকে বিসর্জন দিয়ে যে তৃপ্তি, তা এখানেই পাওয়া যায়। তৃষিত পান্থের জীবন ব্যাপী পিপাসা নিবৃত্তি হয়। কিন্তু হায়, তথাপি চপল চঞ্চল চিত্ত অধীর হয়ে উঠে এবং সূর্যের উজ্জ্বল আলো, চন্দ্রের সুবিমল স্নিগ্ধ হাসি, নীল আকাশ ও আমাদের মাতৃস্বরূপিণী, ফলপুষ্প শোভিনী বসুন্ধরা সমস্ত অন্ধকার বলে প্রতীয়মান হয়।

তাই এই নিভৃত পার্বত্য-কুঞ্জে শান্তির আলয়ে এসেও মধ্যে মধ্যে প্রাণটা দূরদেশে ছুটে যেতে চায়। যখন পথভ্রমণে পা দুটি অসাড় হয়ে এসেছে এবং মন আর কোথাও যেতে রাজি হচ্ছে না, তখন একটা বদখেয়াল দুরন্ত স্কুল মাস্টারের মত কানটা ধরে নাড়া দিচ্ছে, আর বলছে, "আর কাজ কি এখানে, কম্বল ঘাড়ে করে বেড়িয়ে পড়া যাক। " ইচ্ছা না থাকলেও মন এ কথার বিরুদ্ধে কাজ করতে সমর্থ নয়। সুতরাং দেশের দিকেই ফিরতে হচ্ছে।

কিন্তু আর এক মুশকিল। আমি একা নই; আমার ন্যায় বাধাহীন, বন্ধন-শূন্য, উদ্দাম, অসংযত প্রাণীর কণ্ঠরজ্জু আর দুইজন পথিকের করলগ্ন, তাঁরা হচ্ছেন বৈদান্তিক ভায়া ও স্বামিজী। এমন সাদৃশ্যহীন তিনটি মনুষ্য একসূত্রে গাঁথা কতকটা বিস্ময়কর বটে। কিন্তু আর বুঝি শেষরক্ষা হয় না। বৈদান্তিক এখানে আহার করছেন, আর মহাস্ফূর্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বহুদিন পরে ইচ্ছেমত সময়ে আহার এবং উপযুক্ত কালে নিদ্রা লাভ করতে পেরে ভায়া আপন খেয়ালেই ঘুরে বেড়ান কাকেও গ্রাহ্য করেন না। দেশে ফিরবার কথা বললেই গম্ভীরভাবে বলেন, "গৃহধর্মে বিরক্ত সন্ন্যাসীর এ উপযুক্ত কথা বটে !" কথাটা ঠিক কি ভাবে আমার কানে প্রবেশ করল, তা জান ? আমার বোধ হলো নিশীথ রাত্রে কারারুদ্ধ জগৎসিংহের কাছে আয়েশাকে দেখে শ্লেষরুদ্ধ কণ্ঠে ওসমান যখন বলেছেন, "নবাবপুত্রীর পক্ষে এ উপযুক্ত বটে !" কি বলবো, হৃদয়ে আয়েশার মত আবেগ ছিল না, থাকলে বৈদান্তিককে বলতাম, - কি বলতাম এখন সে কথা বলা ভারি শক্ত; তবে তাকে কখনই পল্লীমাতার অজস্র স্নেহ-রস-পুষ্ট মা-হারা আর্ত সন্তান বলে অভিহিত করতাম না।

বৈদান্তিকের কথায় নিরুৎসাহ হয়ে স্বামিজীর কাছে বদরিকাশ্রম ত্যাগের প্রস্তাব করলাম। তিনি বললেন, "আরও দিন কতক থাকা যাক। চিরদিনই ত ঘুরছি, এখন দিনকতক বিশ্রাম করা মন্দ কি ?" আমি মনে করলাম বৃদ্ধ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর অপরাধ কি ? তাঁর জীবনে পথশ্রম অল্প হয় নি। আমি জীবনের মধ্যাহ্ণকালে তাঁকে সংসারযুদ্ধে পরাভূত, অক্ষম, বৃদ্ধ মনে করেছিলাম; কিন্তু এরূপ মনে করার আমার কোন অধিকার নাই। যে বয়সে লোকে পৌত্রপৌত্রী-পরিবেষ্টিত হয়ে আরাম উপভোগ করে, সে বয়সে তিনি অসুরের মত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ! এরূপ অবস্থায় দুদিন বিশ্রামের জন্য তাঁর হৃদয় ব্যগ্র হবে, তার আর আশ্চর্য কি ? আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিনি আজ হঠাৎ আমাকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করলেন। শুষ্ক কঠোর উপদেশের উপর আমার বড় শ্রদ্ধা নেই, তাও তিনি জানতেন; তবুও স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁর এ কষ্ট স্বীকারের আবশ্যকতা বুঝলাম না। শুধু মাথার উপর অবিরল ধারে উপদেশস্রোত বর্ষণ হতে লাগল। ক্রমে তাঁর আসাম-ভ্রমণের কথা; 'কুলি কাহিনী' হতে আরম্ভ করে - কবীর, নানক ও তুলসীদাসের দোঁহা পর্যন্ত কিছুই বাদ গেলনা। স্বামিজী যখন দেখলেন যে তাঁর উপদেশে কোনই ফল হবার সম্ভাবনা নেই, আমার সংকল্প আমি ছাড়ছিনে, এবং এই রকমে চিরজীবনটা দেশে দেশে ঘুরে কাটানোই আমার অভিপ্রেত - তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, "তবে কালই বেড়িয়ে পড়া যাক !" সুতরাং বৈদান্তিককে হাত করা আর কঠিন হলো না। তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করা গেল - কালই প্রাতঃকালে বদরিনাথ পরিত্যাগ করতে হবে।


অপরাহ্ণে পাণ্ডা লছমীনারায়ণ আমাদের আড্ডায় আহারের কোনো রকম আয়োজন করতে নিষেধ করলেন। বুঝলাম তার বাড়িতে আয়োজন হচ্ছে। সন্ধ্যাকালে আর কোনো কাজ নেই, শেষবারের জন্য বদরিনাথ প্রদক্ষিণ করতে বের হলাম।

বাজারের মধ্যে উপস্থিত হয়ে দেখলাম কাশীনাথ জ্যোতিষী মহাশয় অনেকগুলি পাণ্ডা সন্ন্যাসী পরিবৃত হয়ে একটা ঘরে বসে আছেন। আমাকে নিকটে ডাকলেন। এ সময় আমার মনটা বড়ো ভাল ছিল না, কিন্তু তাঁর কথা অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। তাঁর নিকটে উপস্থিত হ'লে তাঁর ইংরেজি সার্টিফিকেট আমাকে দিয়ে তর্জমা করিয়ে নিলেন; তার পর আমার প্রশংসা আরম্ভ হলো; ভবিষ্যতে আমার যে মঙ্গল হবে সে দৈববাণীও করলেন এবং আমরা শীঘ্রই বদরিনাথ ছাড়ছি শুনে আমাকে পথ খরচের সাহায্য করতে চাইলেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে এবং তাঁর এই অযাচিত অনুগ্রহ প্রকাশের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেখান হতে বিদায় হলাম। বিদায়কালে তিনি আমাকে বিশেষ অনুরোধ করলেন, যেন কলিকাতাতে আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমার দুর্ভাগ্য, বঙ্গদেশে ফিরে আর তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় নি।

এখানকার পোস্ট অফিসে গেলাম। পোস্টমাস্টারের সঙ্গে খানিক আলাপ করে নারায়ণের মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলাম, পথের মধ্যে শুনলাম মন্দির দ্বার বন্ধ হয়ে গেছে সুতরাং আর নারায়ণ দর্শন হলো না। যখন বাসায় ফিরলাম তখন ঘণ্টাখানেক রাত্রি হয়েছিল।

কিয়ৎক্ষণ পরেই পাণ্ডা লছমীনারায়ণ আর তার কর্মচারী পাণ্ডা বেণীপ্রসাদ এক হাঁড়ি উৎকৃষ্ট খিচুড়ি ও একটা থালে খানিক তরকারি, তিন চারি রকমের চাটনি, আর কতকগুলো পেঁড়া নিয়ে উপস্থিত হলো। রসনেন্দ্রিয় এ সকলের আস্বাদন সুখ বহুকাল অনুভব করে নি। আমি যথেষ্ট আশ্বস্ত হলাম। স্বামিজী একবার বৈদান্তিকের দিকে চেয়ে দেখলেন এই আশাতিরিক্ত ভোজন দ্রব্য দেখে ভায়ার কি আনন্দ ! তাঁর সেই লুব্ধ ব্যগ্র দৃষ্টির কথা অনেক কাল মনে থাকবে ! আহার বিষয়ে আমিও পশ্চাদপদ নহি, এখন পর্বতের মধ্যে কঠোর সন্ন্যাসে আমার আহার প্রবৃত্তিটা কিছু খর্ব হয়ে পড়েছিল। আজ পূর্ণ উৎসাহে লছমীনারায়ণের আনীত দ্রব্যগুলির সদ্‌ব্যবহার করা গেল। স্বামিজী বললেন, "অচ্যুত, এবার আমাদের যাত্রা ভাল, রাস্তায় আহারের কষ্ট হবে না। " স্বামিজীর এই ভবিষ্যৎ-বাণী পূর্ণ হয়েছিল - কিন্তু অচ্যুত ভায়ার অদৃষ্টে সে সৌভাগ্য ঘটেনি - কয়েকদিন পরেই তিনি আমাদের সঙ্গ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আহারান্তে পাণ্ডাদের কিছু দান করা গেল - পরিমাণে অধিক নয়। ভবিষ্যতে আরও কিছু দান করবার আশা দেওয়া গিয়েছিল; কিন্তু তা আর পূর্ণ হবার কোন সম্ভাবনা নেই। রাত্রেই পাণ্ডাদের কাছে বিদায় নিলাম। সে সময়ে লছমীনারায়ণ আমাকে একটা অনুরোধ করেছিলেন, - তা এই যে আমরা বদরিকাশ্রমে এসে যতদিন এখানে ছিলাম, - ততদিন আমাদের কোন অসুবিধা ভোগ করতে হয় নি, পাণ্ডা লছমীনারায়ণ ভারি 'জবর' পাণ্ডা, সে আমাদের খুব যত্ন করে রেখেছিল; এই কথা কটা খবরের কাগজে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করতে হবে। তার বিশ্বাস আমাদের মত বড় বড় (?) লোকে যদি ছাপার অক্ষরে তার জন্যে দু'কথা লেখে, তা হলে তা অব্যর্থ; তার পসার অনতিবিলম্বে ভারি জাঁকিয়ে উঠবে । আমি সেই সরল-প্রকৃতি, উপকারী পাণ্ডার অনুরোধ রক্ষা করেছিলাম। আমার জনৈক বন্ধুর দ্বারা পশ্চিমদেশের দুই একখানি হিন্দি সংবাদপত্রে লছমীনারায়ণের গুণের কথা, বিশেষতঃ সে দেবপ্রয়াগে যে রকম কষ্ট স্বীকার করে দক্ষতার সঙ্গে আমাদের হৃতসর্বস্ব উদ্ধার করেছিল, তা সেই পত্রের মধ্যে বিশেষরূপে উল্লেখ করা গিয়েছিল। এই প্রশংসাপত্র প্রকাশ করাতে লছমীনারায়ণের কোন উপকার হয়েছে কি না এবং তার পসার কিরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা জানতে পারি নি, তবে এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারা গিয়েছিল যে, সর্বত্রই মানব হৃদয়ের প্রবৃত্তি একই রকম। খবরের কাগজে নাম প্রকাশের জন্য আমরা সুসভ্য মানব-সন্তানগুলি কি নিদারুণ আয়াস স্বীকারই না করি ? পর্বতবাসী শিক্ষিত পাণ্ডাপুত্রের নিকটও এ প্রলোভন সামান্য নয়। নারায়ণক্ষেত্রে রাত্রি কেটে গেল।


১ জুন, সোমবার। - অতি ভোরে যাত্রা করা গেল। আজ আমাদের নূতন রকমের 'প্রোগ্রাম'। আমি প্রস্তাবকারী, আর স্বামিজী সমর্থনকারী, কাজেই অচ্যুতানন্দ আমাদের মতেই বাধ্য হলেন। আমরা স্থির করলাম - গত রাত্রের মত হনুমান চটিতে অল্পকাল বিশ্রাম করে এবং সম্ভব হলে সেখান থেকে জলযোগ শেষ করে রওনা হব। পাণ্ডুকেশ্বরে সেবার শীরঃপীড়ায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলাম, - জীবনের আশা বেশি ছিল না; সেই কথা মনে হওয়াতে পাণ্ডুকেশ্বরের প্রতি সহানুভূতি নিতান্ত হ্রাস হয়েছিল। জানি যে তাতে পাণ্ডুকেশ্বরের কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, তথাপি স্থির করলাম - সেখানে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করা হবে না। পাণ্ডুকেশ্বরে যদি সে দিন না থাকি - তা হলে আমাদের একেবারে বিষ্ণুপ্রয়াগে আড্ডা নিতে হবে। নারায়ণ হতে বিষ্ণুপ্রয়াগ আঠারো মাইল; সমতলক্ষেত্রে আঠারো মাইল পথ পদব্রজে চলা তেমন কিছু কঠিন কাজ নয় - অনেকেই চলেছেন। কিন্তু এই পার্বত্য পথে আঠারো মাইলের মধ্যে যে চরাই ও উৎরাই, এ রকম অতি কমই দেখা যায়। ইহা একদিনে হেঁটে শেষ করা প্রচুর সামর্থ্যের কাজ। স্বামিজী বৃদ্ধ বয়সেও এই দুর্গম পথ অনায়াসে অতিক্রম করতে প্রস্তুত, শুনে আমার মনে অত্যন্ত আনন্দ হলো।

নির্জন, সংকীর্ণ, পার্বত্য-পথ দিয়ে তিনজনে চলছি। কারো মুখে কথা নেই, সকলেই নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত। মনটা ভারি উৎক্ষিপ্ত - চিরদিনের জন্য বদরিকাশ্রম ছাড়বার পূর্বে সুন্দর পথ, ঘাট, পরিচিত অপরিচিত প্রত্যেক লোকের বাড়ি - তুষারাচ্ছন্ন বঙ্কিম গিরি-নদী-ঊর্দ্ধে অগণ্য তুঙ্গশৃঙ্গ এবং পর্বতের মধ্যদেশে সমুন্নত সুন্দর বৃক্ষরাজি দেখতে দেখতে অগ্রসর হলাম। অনেকখানি বেলা হলো, আমরা হনুমানচ্টিতে উপস্থিত হয়ে জলযোগের জোগাড়ে মনোনিবেশ করলাম। অধিক বিলম্ব হলো না - প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে আবার চলতে আরম্ভ করা গেল। প্রায় আধ মাইল যাবার পর মধ্যপথে দেখি - একজন বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের দিকে আসছেন। পোশাক আধাসন্ন্যাসী আধা-গৃহস্থ রকমের, গৈরিক বসন, অথচ পায়ে জুতো, মাথায় ছাতা আছে; বর্ণ গৌর; চেহারা দেখে মনে হলো ভদ্রলোকটি সম্ভ্রান্তবংশোদ্ভব; বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ বৎসর হবে। আমি ও স্বামিজী একত্রেই চলছিলাম। পথিক স্বামিজীকে দেখে "নমস্কার মশায়" বলে অভিবাদন করলেন। স্বামিজী কিন্তু তাঁকে চিনতে না পারায় তিনি বললেন, "মশায় আমাকে চিনতে পারছেন না, আপনার সঙ্গে সেই আমার বম্বে কংগ্রেসে দেখা ?" স্বামিজী তথাপি তাকে চিনতে না পারায় তিনি কিছু বেশি সংকুচিত হয়ে পড়লেন। পথিক বদরিকাশ্রম সম্বন্ধে দুই চারিটা জ্ঞাতব্য কথা জিজ্ঞাসা করে চলে গেলেন, নিজের কোনো পরিচয়ই দিলেন না। তাঁর পরিচয় জানবার জন্য আমার ভারি কৌতূহল হয়েছিল, কিন্তু স্বামিজীকে নীরব দেখে আমার কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে সাহস হলো না; কারণ এ পর্যন্ত তাঁর যা কিছু আলাপ তা স্বামিজীর সঙ্গেই হচ্ছিল, আমি মধ্যে থেকে দু'এক কথা জিজ্ঞাসা করে কেন নিজের বর্বরতার পরিচয় দিই।

লোকটি বদরিকাশ্রমের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। আমরাও গন্তব্য পথে চললাম। স্বামিজী বারবার বলতে লাগলেন, আমি যেন পাণ্ডুকেশ্বর হতে বিষ্ণুপ্রয়াগ পর্যন্ত ভয়ানক রাস্তাটা খুব আস্তে আস্তে চলি। এদিকে প্রত্যেক কাজে তাঁর উপদেশের বিরুদ্ধাচারণ করা অভ্যাস হয়ে গেলেও আমি অতি সাবধানে এবং আস্তে আস্তে চলতে কৃতসঙ্কল্প হলাম। কিন্তু তবু চলতে চলতে সহসা গতি বৃদ্ধি হয়ে যায় - স্বামিজী অনেক পেছনে পড়েন, - আবার তাঁর জন্য খানিক অপেক্ষা করি।

ক্রমে পাণ্ডুকেশ্বরের বাজারের মধ্যে উপস্থিত হলাম। বেলা তখন প্রায় দুটো; সূর্য পশ্চিম আকাশে একটু ঢলে পড়েছেন; রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে; ভয়ানক রৌদ্র, পাহাড়গুলো অগ্নিময় - জলহীন, ধূসর, উলঙ্গ। বাজারের মধ্যে কদাচিৎ এক আধজন লোক দেখা যাচ্ছে। একখানা দোকান খোলা। দোকানদার সেখানে নেই; আর একখানা দোকান - যে দোকানে আমি গতবারে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছিলাম, সেখানা বন্ধ; বোধ করি দোকানি গ্রামান্তরে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহের চেষ্টায় গিয়েছে। আমি একবার ঘৃণাভরে সে দিকে অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করলাম। বড় ক্লান্তি বোধ হয়েছিল, - এক একবার ইচ্ছা হচ্ছিল, একটু বিশ্রাম করা যাক। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলাম না। যেমন সবেগে আসছিলাম, তেমনই চলতে লাগলাম। দূর পাহাড়ের গায়ে বহুদূর বিস্তৃত বৃক্ষশ্রেণী, তার নীচ দিয়ে যদি আমাদের গন্তব্য পথ হতো, তবে সেই স্নিগ্ধ ছায়াযুক্ত অরণ্য উপত্যকার শ্যামল শোভা দেখতে দেখতে বেশ আরামের সঙ্গে পথ অতিক্রম করা যেত।

আরাম ভোগের কল্পনা করছি, দেবতার বুঝি তা সহ্য হলো না। চেয়ে দেখি সম্মুখে এক প্রকাণ্ড চড়াই। এতক্ষণে চড়াই উতরাই-এর আরম্ভ হলো; সুতরাং বিনা প্রতিবাদে অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে চলতে আরম্ভ করলাম। পদদ্বয় অবসন্ন হয়ে এল, কিন্তু বিরাম নাই। বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, বিষ্ণুপ্রয়াগ ভিন্ন এ পথে আর কোথাও 'আড্ডা' পাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ স্বামিজীকেও গতিবৃদ্ধি করতে হলো।

বেলা ঘণ্টাখানেক থাকতে আমরা বিষ্ণুপ্রয়াগে এসে উপস্থিত হলাম। পূর্বের সেই মন্দিরে এবারও বাসা করা গেল। যে দোকানদারের জিম্মায় মন্দির ছিল, সে আমাদের দেখে বিশেষ উল্লাস প্রকাশ করলে। আমরা কেমন ছিলাম, পথে কোনও কষ্ট হয় নাই ত ইত্যাদি অনেক কথা জিজ্ঞাসা করল। আমি একা দোকানে বসে। যেদিন এখান থেকে বদরিনাথ যাই, সেই দিনের সঙ্গে আজকার প্রভেদ অনুভব করতে লাগলাম। সে দিন কতখানি উদ্যম, উৎসাহ, একটা সুগভীর আকাঙ্ক্ষা এবং একাগ্রতা হৃদয়ের সমস্ত অভাব ও কষ্ট দূর করেছিল। আমরা একটা উদ্দেশ্য একটা ব্রত ধারণ করে চলেছিলাম। সে ব্রত শেষ হয়েছে, এখন হৃদয় শূন্য ! এই কথা ভাবছি, এমন সময়ে স্বামিজী এবং পশ্চাতে বৈদান্তিক ভায়া পরম স্মিতমুখে দর্শন দিলেন। বৈদান্তিককে সহসা ওষ্ঠমূলে হাস্যরসের অবতারণার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি উত্তর দিলেন, "আজ খুব প্রতিজ্ঞা-পালন করা গেছে। একদমে আঠারো মাইল, এই পাহাড়ে রাস্তা। এর চেয়ে জঙ্গলে বসে অনাহারে চক্ষু মুদে তপস্যা করা সহজ। " দোকানদারের পুত্র তার ক্ষুদ্র দেবতাটিকে মন্দিরের মধ্যে জাঁকিয়ে বসাল। আমরা সে রাত্রে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অপ্রচুর আহার্য সংগ্রহ্পূর্বক কোন রকমে উদর-দেবতাকে পরিতৃপ্ত করালাম। অনুষ্ঠানের যেটুকু ত্রুটি হলো, তা নিদ্রাতেই পুষিয়ে গেল। বহুকাল এমন নিদ্রাসুখ অনুভব করা যায়নি।

২ জুন, মঙ্গলবার। - এবার ফেরত পথ; কাজেই কবে কতদূর গিয়ে কোথায় আড্ডা নিতে হবে, তা পূর্বেই স্থির করতে পারতাম। বিষ্ণুপ্রয়াগ হতে স্থির করা গেল, সকালে নয় মাইল চলে দ্বিপ্রহরে কুমারচটিতে থাকা যাবে। পূর্বদিন আঠারো মাইল চলে আমাদের শরীর কিছু বেশি শ্রান্ত হয়ে পড়েছে; কাজেই গতি কিছু মন্থর। তার উপর আর এক বিপদ; শেষরাত্রি থেকে ভারি মেঘ হয়েছিল। আমরা যখন রওনা হই তখন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিল, কিন্তু অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে পড়া গেল। খানিক পথ অতিক্রম করতে না করতেই বৃষ্টি ভয়ানক চেপে এল। সর্বশরীর ভিজে গেল, তার উপর কম্বল ভিজে গিয়ে এমন ভারি হয়ে পড়লো যে তা আর সঙ্গে নেওয়া যায় না। নিকটে তেমন কোনও আড্ডা নেই যে বিশ্রাম করি। অগত্যা ভিজতে ভিজতেই চলতে হলো। যদি একবার ঝুপঝাপ করে বৃষ্টি হয়ে থেমে যায়, তাকে পারা যায়; কিন্তু এ পার্বত্য বৃষ্টি, সে রকম নয় ত ! খানিকক্ষণ বৃষ্টি হয়ে গেল - চারিদিক বেশ ফর্সা হলো, একটু একটু রোদও উঠলো। কোথা থেকে হঠাৎ একখানা ঘোলা মেঘ এসে আবার খানিক বর্ষণ করে গেল। যেন সোহাগের অশ্রু ! সে বেশ হাসছে; হঠাৎ কি একটা কারণ ঘটলো কি ঘটলো না - অমনি প্রবল অশ্রুবর্ষণ আরম্ভ হলো, সকলেই ব্যতিব্যস্ত। সকালে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আমরা আট দশবার ভিজলাম; ভারি বিরক্ত বোধ হতে লাগল; দুই তিনটি চড়াই উতরাই পার হবার সময় পা পিছলে দুই একবার পদস্খলনের সম্ভাবনাও বড় প্রবল হয়ে উঠেছিল ! সুখের বিষয় খুব সামলানো গেছে !

আজ সকাল হতে আমাদের নূতন পথ। কুমারচটি থেকে বের হয়ে যারা যোশীমঠে যায়, তারা খানিকদূর অগ্রসর হয়ে উপরের পথে যোশীমঠে প্রবেশ করে; আর যারা বরাবর বিষ্ণুপ্রয়াগে আসে তাদের পথ নীচের দিক দিয়ে। আমরা বদরিনাথ দর্শনে আসবার সময় উপরের পথে যোশীমঠে গিয়েছিলাম এবং সেখান হতে একটা প্রকাণ্ড উতরাই দিয়ে বিষ্ণুপ্রয়াগে নেমেছিলাম। এবারে বিষ্ণুপ্রয়াগে টানা সাঁকো পার হয়ে আর চড়াইয়ে উঠলাম না; নীচের পথে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম। এ পথটা মন্দ নয়। খানিকদূর পর্যন্ত অলকানন্দার খুব নিকট দিয়ে গিয়েছে; তারপর যোশীমঠের পথের সঙ্গে মিশবার জন্যে আস্তে আস্তে উপরে উঠেছে।
এ পথে একটা অতি সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। বেলা প্রায় এগারোটা; মেঘ কেটে গিয়েছে এবং সূর্য পাহাড়ের অন্তরাল ছেড়ে ঊর্দ্ধে অনেক দূর উঠেছে; কিন্তু তখনও সমস্ত প্রকৃতি সিক্ত; তাতেই বোধ হচ্ছে, এখনও বেলা বেশি হয় নি। আমরা ধীরে ধীরে গ্রাম্য পথে প্রবেশ করে দেখলাম, একটি গৃহস্থের মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে; বিবাহের পর এই তার প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাত্রা। তখন আমোদে উৎসাহের মধ্যে গিয়ে শ্বশুরালয়ে দুই একদিন ছিল, আর আজ কতদিনের জন্য ঘরকন্না করতে যাচ্ছে। তাই তার মা, মাসি, বোন এবং নিতান্ত আপনার জনের ন্যায় পাড়াপড়শিরা এসে রাস্তার ধারে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বিদায় দিচ্ছে। মেয়েদের কারো চোখ দিয়ে জল পড়ছে, কেউ তার হাতখানি ধরে কত স্নেহের কথা বলছে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার সবচেয়ে মধুর বোধ হলো। যে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, তার কোলে একটি বছর দুইয়ের ছোট ছেলে; অনুমান করলাম সে তার ছোট ভাই। ভাইটি কিছুতেই তার শ্বশুরবাড়ি গমনোন্মুখ দিদির কোল ছাড়বে না। যতই সকলে তাকে সাগ্রহে ডাকছে, ততই সে তার দিদির ঘাড়টি দু'হাতে ধরে বারে বারে মুখ ফিরচ্ছে, বুঝি সে কত কালের মত তার দিদির স্নেহময় ক্রোড় হতে নির্বাসিত হতে বসেছে, তা বুঝতে পেরেই শিশু তার আজন্মের স্নেহাধিকার ত্যাগ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে এবং অন্যান্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একটা আসন্ন বিপদের কল্পনা করে ডাগর চক্ষু মেলে চেয়ে রয়েছে।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এই পর্বতের উপরে পাহাড়ে মেয়ের বিদায় দৃশ্য; কিন্তু এই দৃশ্য আমাদের প্রীতিরসসিক্ত মাতৃভূমি, বহুদূরবর্তী বঙ্গের একটা মৃদুস্মৃতি মনের মধ্যে জাগিয়ে দিলে। সে যে বাংলা, আর এ যে পশ্চিমদেশ, তা আমি ভুলে গেলাম; শুধু মনে হলো সেখানেও যেমন মা, ভাই এখানেও তেমনি। দুই দেশের মধ্যে প্রভেদ বিস্তর, কিন্তু হৃদয় ও স্নেহের মধ্যে সর্বত্রই অমর সম্বন্ধ সংস্থাপিত। বৈদান্তিক ভায়া বোধ করি, এ সমস্ত বিষয়ে এমন গভীরভাবে চিন্তা করেন না, সুতরাং মুগ্ধ হৃদয়ে এমন বিদায় দৃশ্য দেখছি দেখে তিনি বিদ্রূপ করে বললেন ঒ আবার ভাব লাগলো বুঝি। পথে ঘাটে এ রকম ক঑রে ভাব লাগলে চলা যায় না। ও আমি তাঁর কথার কোন উত্তর দিলাম না - শুধু কঠোর দৃষ্টিতে একবার তাঁর দিকে চেয়ে চলতে লাগলাম।

আমার সঙ্গে জামাইটিও অগ্রসর হলো, সেই মেয়েটি আমার আগে আগে চলতে লাগলো। যুবক স্ত্রী নিয়ে ঘরে যাচ্ছে; তার চিন্তা, তার কল্পনা ও সুখ প্রেমস্বর্গচ্যুত সন্ন্যাসীর আয়ত্তাধীন নয়। সংসারের এই মোহবন্ধনই সোনার বাঁধন।

কুমরচটির কাছেই যুবকের বাড়ি। সে সস্ত্রীক বাড়ির দিকে গেল, আমরা চটিতে প্রবেশ করলাম। এখনও অনেক বেলা আছে, কিন্তু আজ শরীর বড় অবসন্ন; তার উপর আবার দুর্যোগ আরম্ভ হলো। কতক্ষণ আকাশ বেশ পরিষ্কার ছিল, ভয়ানক মেঘ ক'রে পুনর্বার বৃষ্টি আরম্ভ হলো। পর্বত-প্রান্তে এক অন্ধকার কোণে একা পড়ে কত কথাই মনে পড়তে লাগলো; শুধুই বোধ হতে লাগলো, -
"সংসার স্রোত জাহ্নবী-সম বহু দূরে গেছে সরিয়া,
এ শুধু ঊষর বালুকা ধূসর মরুরূপে আছে মরিয়া !
নাহি কোনো গতি, নাহি কোনো গান, নাহি কোনো কাজ, নাহি কোনো প্রাণ, ব'সে আছে এক
মহানির্বাণ আঁধার-মুকুট পরিয়া। "

২ জুন, মঙ্গলবার। - অনেক বেলা থাকতে কুমারচটিতে পৌঁছান গিয়াছিল। চারিদিকে মেঘ খুব আঁধার করে এসেছিল বলে বোধ হচ্ছিল বুঝি আর বেলা নাই। খানিকক্ষণ ঝুপঝাপ বৃষ্ট-বর্ষণের পরই মেঘ কেটে গেল, আকাশ পরিষ্কার হলো, রোদ উঠলো। তখন মনে হলো এখনও অনেক বেলা আছে। যদি বেড়িয়ে পড়া যায় ত অনেক পথ এগিয়ে থাকা যাবে। স্বামিজীর কাছে এই প্রস্তাব করলাম, তাতে তিনি রাজি হলেন। আর দেরি কি ? অমনি লাঠি হাতে, ভিজে কম্বল ঘাড়ে নিয়ে চটি হতে রওনা হওয়া গেল; কিন্তু সে পাহাড়ে রাস্তায় বেশি দূর যাওয়া হলো না। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লো; পাহাড়ের অন্তরাল হতে অস্তমিত তপনের আলোতে যতক্ষণ বেশ পথ দেখা গেল, আমরা চলতে লাগলাম। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে খুব মেঘ করে এল। আমরাও একটা ক্ষুদ্র চটিতে রাত্রের মত আশ্রয় নিলাম। চটির নাম "পাতালগঙ্গা"। বদরিনাথে যাবার সময় আমরা এ চটিতে ছিলাম না, এমন কি এটা তখন আমাদের নজরেই পড়ে নি; হয় ত তখন এ চটির জন্ম হয় নি ! চটির নীচে দিয়ে যে ক্ষুদ্রকায়া ঝরনাটি বয়ে যাচ্ছিল, তারই নাম অনুসারে এর নাম পাতালগঙ্গা হয়েছে। পাতালগঙ্গা সত্য সত্যই পাতালগঙ্গা; রাস্তা থেকে অনেক নীচে নেমে তবে নদীর কাছে আসা যায়। কিন্তু চটিওয়ালাদের জলের সন্ধানে নদীতীর পর্যন্ত যেতে হয় না; চটির গায়েই একটা ঝরনা আছে, তাতেই জল-কষ্ট নিবারণ হয়। এ দেশের চটি সকল দূরত্ব হিসাবে নির্মিত হয় না। যেখানে ঘর বাঁধিবার সুবিধা, ঝরনা খুব নিকটে এবং জায়গাটা চটিওয়ালার বাড়ির যথাসম্ভব কাছে, সেইখানেই একটা চটি খোলা হয়। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, কোন জায়গায় সাত আট মাইল তফাতে একটা চটি, আবার কোথাও মাইলে মাইলে চটি। আর সে সকল চটিরই বা কি শোভা। তা নির্মান করবার জন্য চটিওয়ালাকে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না, খরচপত্রও কিছু নেই বললেই হয়। গিরিরাজ হিমালয়ের কোলের মধ্যে হাজার হাজার গাছ রয়েছে, তার তলে প্রচুর লম্বা লম্বা ঘাস। গোটাকতক গাছের ডাল, আর বোঝা কতক ঘাস কেটে আনলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে একটা চটির ঘর তৈয়েরি হয়ে যায়। আর সেই পর্ণকুটিরে আশ্রয় নেবার জন্য কত ঝড়বৃষ্টিময়ী অন্ধকার রাত্রিতে আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠেছি; তাও সব দিন অদৃষ্টে জুটে ওঠে নি। সেই পর্ণকুটিরে এসে অমরা যে রকম অকাতরে নিদ্রা যেতাম, তা মনে হলে এখনও কাতর হয়ে পড়ি। তখন কোনও ভাবনা-চিন্তা ছিল না; কেমন করে যে দিনপাত হবে সে কথাও মনে আসতো না; ভগবানের নাম নিয়ে সমস্ত দিন ঘুরে দারুণ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে চটিতে এসে পড়তাম, খাওয়া দাওয়া হোক না হোক, কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়া যেত, আর কোথা থেকে হাটের ঘুম, মাঠের ঘুম, জঙ্গলের ঘুম এসে চোখের পাতা আচ্ছন্ন করে ফেলতো। ক্বচিৎ সেই সুখসুপ্তির মধ্যে বাল্যের নিশ্চিত জীবনের যৌবনের আবেশপূর্ণ সুখ-স্বপ্নের কথা মনে পড়তো। কখন মনে হতো, পাঠ্যাবস্থায় কলিকাতার সেই ক্ষুদ্র বাসাটিতে একখানি শতরঞ্চ বিছনো তক্তাপোষের উপর শুয়ে নবীন পণ্ডিত মহাশয়ের প্রকাণ্ডাকার সটিক রঘুবংশখানাতে, না হয় চামড়া বাঁধানো বিরাট দেহ দু'ভল্যুম ওয়েবস্টারের ডিক্সনারিতে মাথা রেখে নিদ্রা যাচ্ছি। ও হরি! জেগে দেখলাম হিমালয়ের মধ্যে একটা ভাঙা চটিতে ছেঁড়া কম্বল জড়িয়ে দিব্বি আরামে শুয়ে আছি, মাথার নীচে একটা ঘাসের আঁটি। বৈসাদৃশ্যটা বড় কম নয় ভেবে মনে মনে ভারি হাসি আসতো।

পাতালগঙ্গা চটিতে ঘর বেশি নেই, যাত্রীর সংখ্যাও নিতান্ত অল্প। যাত্রীর মধ্যে আপাতত আমরা তিনটি প্রাণী এবং একটা বিপুলকায় পাহাড়ী। আমরা যে ঘরে বাসা নিলাম, সেই ঘরের মধ্যে এক কোণে একটা লোক একটা কম্বলে মাথা হতে পা পর্যন্ত সর্বশরীর ঢেকে পড়ে রয়েছে দেখলাম। মনে হলো হয় ত কোনো পথশ্রান্ত সন্ন্যাসী এই নির্জন কুটিরে সাধন-ভজনের পরিবর্তে নিদ্রাদেবীর উপাসনা করছেন; আমরা ঘরের মধ্যে শোরগোল করলেই বিরক্ত হয়ে তিনি হুহুঙ্কারে উঠে বসবেন। বাস্তবিক আমাদের কথাবার্তায় লোকটা উঠে বসলো; কিন্তু সে সন্ন্যাসী নয, ষোলো সতেরো বৎসর বয়সের একটি বালক। ষোলো সতেরো বৎসর বয়স হলে অনেকে দেখতে যুবকের মত হয়, কিন্তু ছেলেটিকে অনেক ছোট বলে বোধ হলো; শরীর ভারি রোগা। বোধ হলো, এখনও সে রোগ ভোগ করছে। আমরা তার সঙ্গে আলাপ করতে লাগলাম, স্বামিজী তার কাছে বসে গেলেন; আমাদের সঙ্গী পাহাড়ী আহারের জোগাড় করতে গেল।

আলাপ করে দেখলাম, ছেলেটি অল্প-বিস্তর বাংলা কথাও জানে, তবে বেশি বাংলা বলে না; কিন্তু সে যেটুকু বাংলা বলে তা বাঙালির উচ্চারিত বাংলার মত, খোট্টাই ধরণের নহে। তার উচ্চারণ আমাদের মতই সহজ এবং সরল, কণ্ঠস্বর বিষাদাপ্লুত। আমার মনে ঘোর সন্দেহ হলো, এ হয় ত বাঙালি; হয় ত কোনো কারণে মা বাপের উপর রাগ করে, কি মা বাপ নেই পরের কাছে উপেক্ষা বা অনাদর পেয়ে অভিমান করে কোনো যাত্রীর দলের সঙ্গে এ অঞ্চলে এসে পড়েছে। তার পর অনাহারে, পথশ্রমে এবং রোগে ক্লান্ত ও জর্জরিত হয়ে এই নির্জন পর্বতের নির্জনতর প্রান্তে জীবনমধ্যাহ্ণের পূর্বেই অতর্কিত সন্ধ্যায় জীবন বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। একবার আমার জীবনের সঙ্গে তার জীবনের তুলনা করে দেখলাম। সংসারে আমি সকল বন্ধনশূন্য, এও কি তাই ? চলতে চলতে পথিপ্রান্তে মৃত্যুকেই কি সে জীবনের শেষ ব্রত মনে করেছে ? আমার ন্যায় জীবনের সমস্ত বাসনা, সমস্ত আশা ও আকাঙ্ক্ষাগুলিকে হৃদয় থেকে একে একে খুলে নিয়ে নদীস্রোতে ভাসিয়ে দিতে ত শূন্যমনে তাকে সংসার ত্যাগ করতে হয় নি ? তার পথ ও আমার পথ কখনও এক হতে পারে না; তার এই নবীন জীবনের নূতন উৎসাহ, অভিনব আশা, জাগ্রত আকাঙ্ক্ষা এবং প্রাণব্যাপী উচ্চাভিলাষ, সমস্ত পরিত্যাগ করে সে জীর্ণ চীর গ্রহণপূর্বক এক অনির্দিষ্ট জীবনপথে অন্ধের ন্যায় চলতে আরম্ভ করেছে ? এমন কদাচ দেখতে পাওয়া যায়। আর যদি তার মা বাপ থাকে, তবে তাঁদের আজ কি কষ্ট ! অভিমানী বালক হয় ত আজ এই রোগশয্যায় গভীর যাতনার মধ্যে বুঝতে পাচ্ছে, এ পৃথিবীতে যাদের কেউ নাই, তাদের কি দুর্ভাগ্য ! জ্বর ও উদরাময়ে কষ্ট পাচ্ছে, এমন সময় যদি স্নেহময়ী মা এসে একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন, কোমলহৃদয়া ছোট ভগিনীটি এসে যদি তার পাণ্ডুর শীর্ণ মুখখানির উপর দুটি করুণ চক্ষুর কোমল দৃষ্টি স্থাপন করে বলতো "দাদা, এখন কেমন আছ" তা হ'লে হয় ত তার রোগযন্ত্রণা অর্ধেক কমে যেত। কিন্তু তার দিকে ফিরে চেয়ে যে একবার আহা বলে, এমন লোকটি নাই। পৃথিবীর এমন আলো তার কাছে অন্ধকার এবং জীবজগতের হর্ষকাকলি বোধ করি তার কাছে একটা বিকট আর্তনাদের মত বোধ হচ্ছে। বালকের কথা ভেবে আমার প্রাণ বড় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। তন্ন তন্ন করে তার সম্বন্ধে কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। সব কথার ঠিক উত্তর পেলাম না। তবে জানতে পারলাম, আজ দু দিন হতে এখানে সে পড়ে আছে; কত লোক যাচ্ছে আসছে, কিন্তু তাকে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করে না; সঙ্গে দু তিনটি টাকা ও আনা কয়েক পয়সা আছে; যখন একটু ভাল থাকে, দু পয়সার বুট ভাজা না হয় বহুকালের প্রস্তুত ধূলিপূর্ণ দুর্গন্ধময় পচা প্যাড়া কিনে ক্ষুধাশান্তি করে। উদরাময় ও জ্বরের চমৎকার পথ্য ! অন্য সম্বলের মধ্যে একখানি ছেঁড়া কম্বল, একটা কমণ্ডুল, আর একটা ছোট ঝুলি; তার মধ্যে হয় ত দু চারখানি ছেঁড়া কাপড় থাকতে পারে। সেটা আর অনুসন্ধান করা দরকার মনে হলো না। ছেলেটি ইংরেজিও জানে; শুনলাম সে আম্বালা স্কুলে এনট্রান্স পর্যন্ত পড়েছিল, পরীক্ষাও দিয়েছিল, কিন্তু পাশ করতে পারে নি। আমি একবার সন্দেহাকুল চক্ষে তার দিকে চেয়ে দেখলাম। এনট্রান্স ফেল করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে নি ত ? আমি তাকে এনট্রান্সের পাঠ্যপুস্তক সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম; তাতে সে যে সকল বইএর নাম করলে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের তা পাঠ্য কি না তা আমি তখন ঠিক জানতাম না; তবে সে সকল বই আমাদের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যশ্রেণীভুক্ত বটে। The Book of Worthies কখনো পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রান্সের পাঠ্য ছিল বলে আমার মনে হয় না; তবে ১৮৮৮ সালে ঐ বই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রান্সের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল; সুতরাং বালকটি বাঙালি বলে আমার সন্দেহ দৃঢ়তর হলো ! এমন সময় সে কি কাজের জন্য কুটিরের বাহিরে গেল। আমি স্বামিজীকে আমার সন্দেহের কথা জ্ঞাপন করলাম। তিনি কিঞ্চিৎ আবেগের সঙ্গে উত্তর করলেন, "ঠিক ও বাঙালি, তাতে আর সন্দেহ নেই। আমাদের কাছে নিশ্চয়ই সমস্ত কথা গোপন করছে। " ছেলেটি আবার বাহির থেকে ভিতরে এসে বসলো। স্বামিজী তার নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন, তখনও খুব জ্বর আছে, উত্তাপ ১০৩ ডিগ্রির কম নয়। স্বামিজী বালকের মুখের উপর তীব্র দৃষ্টি রেখে তাকে আমার সন্দেহের কথা বললেন। কিন্তু সে যে বাঙালি, তা কিছুতেই স্বীকার করলে না। সে বললে আম্বালাতেই তার বাড়ি; মা বাপ কলেরায় মারা গেছে, একটি মাত্র ভগিনী আছে, সেও শ্বশুরগৃহে। মনের দুঃখে সে গৃহত্যাগ করেছে। তার বাড়িতে যখন কেউ নেই, তখন পাহাড় পর্বতই তার বাড়ি; তার কাছে ঘর বাড়ি, জঙ্গল সব সমান। সে বাঙালি নয় এ কথা প্রমাণের জন্য সে বিস্তর চেষ্টা করলে, এবং তার সেই চেষ্টা দেখে আমাদের আরও মনে হলো, সে নিশ্চয়ই বাঙালি, কোনো বিশেষ কারণে আত্মগোপন করেছে। আমি শেষে তাকে বললাম সে যদি বাড়ি থেকে রাগ করে এসে থাকে, তবে আমরা তাকে আবার বাড়ি পৌঁছিয়ে দিতে প্রস্তুত আছি; আর যদি সে একান্তই বাড়ি ফিরে যেতে না চায় তা হলে সে আমাদের সঙ্গে যেতে পারে। দেরাদুনে গিয়ে তার জন্যে যা হয় করা যাবে। সে আমার এ কথার কোনো স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে বললে, "আপনারা কেন আমাকে বাঙালি মনে করছেন। আম্বালায় যে সকল বাঙালি বাবু আছেন, তাঁদের কাছে আমি বাংলা শিখেছি !" তার এ কথার উত্তর দেওয়া আবশ্যক মনে করলাম না। আমাদের পাহাড়ি সঙ্গী এমন সময়ে এসে খবর দিলে যে, আমাদের খাবার প্রস্তুত। বালকটিকে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, তার অত্যন্ত ক্ষুধা হয়েছে, কাজেই আমাদের জন্যে প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্যের অংশ তাকে দেওয়া গেল। সে খাদ্যটা কি শুনবেন ? মোটা মোটা আধপোড়া রুটি, আর খোসাওয়ালা কলায়ের ডাল। ১০৩ ডিগ্রি জ্বর আর উদরাময়গ্রস্ত রোগীকে যদি এ দেশে এ রকম পথ্য দেওয়া হতো, তা হলে আমরা Culpable homicide not amounting to murder এই অভিযোগে শেষে দায়রা সোপর্দ হতাম; কিন্তু এ পর্বতের মধ্যে এ ছাড়া অন্য পথ্য কোথায় মিলবে ? রাত্রে বালকটি দু তিনবার উঠে বাইরে গেল, আমাদের ভয় হলো বুঝি সে আজই পেটের ব্যারামে মারা যায় ! যে পথ্যের ব্যবস্থা, তাতে ভয় হবারই কথা; কিন্তু ছেলেটি বললে, তার অবস্থা অনেক ভাল, এমন পরিপক্ক ডাল রুটি বহুদিন তার অদৃষ্টে জোটে নি। নিজে কষ্টে-সৃষ্টে যা পারতো তাই বানিয়ে নিতো। আমরা বুঝলাম, এ 'বিষস্য বিষমৌষধম' অর্থাৎ ইংরজি কথায় হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা হয়েছে। ভরসা করি আমার ডাক্তার বন্ধুরা এ ঔষধের সমর্থন করবেন। নিদ্রায় অনিদ্রায় কোনো রকমে রাত্রি কেটে গেল।


৩ জুন, বুধবার। - খুব ভোরে পাতালগঙ্গা চটি ত্যাগ করলাম। ছেলেটি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলো। তাকে নিয়ে আমাদের কিছু অসুবিধা হলো; কিন্তু সে দিকে দৃকপাত না করে তার সঙ্গে অতি আস্তে আস্তে চলতে লাগলাম। তার শরীর মোটেই চলবার মত নয়; এদিকে তার জন্য পাতালগঙ্গায় দু-তিন দিন বসে থাকাও অসম্ভব, সুতরাং ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়াই সঙ্গত বলে বোধ হলো। চটি ত্যাগ করবার আগে স্থির করা গেল, যে, আজ যে রকমেই হোক দুপুরের সময় পিপুলকুঠিতে পৌঁছে আহারাদি করতে হবে।

দুপুরের সময় পিপুলকুঠিতে পৌঁছান গেল। ছেলেটি সঙ্গে না থাকলে আমরা বেলা দশটার মধ্যেই এখানে এসে উপস্থিত হতে পারতাম; কিন্তু তা আর ঘটে ওঠেনি। আধ মাইল চলি, আর একটা গাছের ছায়ায় , কি ঝরনার কাছে এসে বসি; ঝরনা দেখলেই ছেলেটি বসতে চায়, অঞ্জলি পুরে জলপান করে; একটু বিশ্রাম করবার পর উঠে ধীরে ধীরে চলতে আরম্ভ করে।

পিপুলকুঠিতে আমাদের সেই পূর্বেকার চটিতে বাসা করা গেল। কিন্তু আজ পিপুলকুঠির ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত দেখলাম। গতরাত্রে এখানকার এক বেনিয়ার দোকানে চুরি হয়ে গিয়েছে। নগদ টাকা এবং সোনা-রূপার গহনা প্রভৃতিতে অনেক টাকা গিয়েছে। চোর মশায় কি উপায়ে গৃহপ্রবেশ করে এই সাধু অনুষ্ঠানে কৃতকার্য হয়েছেন, তা কেউ ঠিক করতে পারে নি, কিন্তু তিনি যে বমাল সমেত দরজা খুলে বেড়িয়ে গেছেন, তা স্পষ্ট বুঝতে পারা গেল। লালসাঙার থানায় খবর পাঠানো হয়েছে; দু এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের লোক এসে উপস্থিত হবে; সুতরাং বাজারের লোক কিছু ভীত ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা পূর্ববারে যে দোকানঘরে আড্ডা নিয়েছিলাম, তার সম্মুখেই এই বেনিয়ার দোকান। কারো প্রতি সন্দেহ হয় কি না জিজ্ঞাসা করায় সে বললে কাকে সে সন্দেহ করবে ? তার ত কোনো 'দুশমন' নেই; কারো সে কখনও অনিষ্ট করে নাই; কেন যে তার সর্বনাশ হলো, বিধাতাই জানেন, এই বলে বেচারি কাঁদতে লাগলো। দোকানে কোনো চাকর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলাম, দুই জন চাকর দোকানের মধ্যেই থাকে; বেনিয়া নিজে থাকে না, সপরিবারে দোকানের উপরতলায় থাকে। বেনিয়ার আর কোনো ভাই নেই, ছেলেপুলেগুলি সকলেই ছোট।

বেলা প্রায় একটার সময় দুই তিন জন লালপাগড়ি কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে পুলিশের জমাদার সাহেব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। আমরা আমাদের চটির মধ্যে বসে জানালা দিয়ে জমাদার সাহেবের কাণ্ড-কারখানা দেখতে লাগলাম। মনে করেছিলাম, জমাদার এসেই চুরির তদারক আরম্ভ করবেন; কিন্তু তার সে রকম ভাব কিছুই দেখা গেল না। ঘোড়া হতে নেমেই জিজ্ঞাসা করা হলো, কোথায় তাঁর বাসা দেওয়া হয়েছে এবং তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কি না। কথার ভাবে বোধ হলো, মেজাজটা বড় গরম। জমাদার সাহেব একে সরকারি লোক, তার উপর সরকারি কাজে এসেছেন সুতরাং তাঁর ক্যারদানিতে ক্ষুদ্র পার্বত্য বাজার সশঙ্কিত হয়ে উঠলো; কখন কার মাথা যায় তার ঠিক নেই।

যে বাসাটা জমাদার সাহেবের জন্য ঠিক করা হয়েছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তা তাঁর পছন্দ হলো না। তিনি গম্ভীর মুখে এবং ভারি রাগ করে আমাদের চটির পাশে আর একটা বাড়ির বারান্দার একটা চারপায়ার উপর বসে পড়লেন। বেনিয়া তার সকল কষ্ট ভুলে হাস্যমুখে প্রচুর উপহারের সঙ্গে জমাদার সাহেবের অভ্যর্থনা করতে পারে নি, এই তার অপরাধ, এবং এই অপরাধের জন্য তিনি কনস্টেবল বেষ্টিত হয়ে তর্জন গর্জন পূর্বক বলতে লাগলেন, যে চুরির কথা সমস্ত মিথ্যা, এই শঠ বেনিয়া অনর্থক সরকারকে হয়রান করবার জন্য চুরির এজাহার দিয়েছে, বাজারের লোকের এতে যোগ আছে। শুনে বাজারের লোক আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। জমাদারকে শান্ত করবার জন্য অবিলম্বে তাঁর সম্মুখে স্তূপাকার খাদ্যদ্রব্যের অর্ঘ্য এনে হাজির করা হলো। নানা রকমের জিনিস। সে সকল এতই বেশি যে, জমাদার সাহেব সগোষ্ঠী মিলে তিন দিনেও তা উদরস্থ করতে পারবেন না। এই উপহারস্তূপ দেখে হাকিম সাহেবের মেজাজটা একটু নরম হলো; তিনি আয়াস স্বীকার করে তখন ধূমপানে মনোনিবেশ করলেন। ধূমপান শেষ হলে বোধ করি চুরির কথাটা তাঁর মনে পড়লো। তিনি নিকটস্থ লোকগুলির দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন "কোন দোকানে চুরি হয়েছে ?" - দশ বারোজন লোক এক সঙ্গে তাঁর কথার জবাব দিল। বেনিয়া কাঁদতে কাঁদতে এসে তার সর্বনাশ হয়েছে এই কথা 'আরজ' করতে যাচ্ছিল, এমন সময় জমাদার সাহেব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন "ব্যস, চুপ। " - হতভাগ্য বেনিয়া সঙ্গে সঙ্গে সাত আট জন দোকানি এই হুঙ্কার শব্দে বিচলিত হয়ে দশ হাত তফাতে সরে দাঁড়ালো। হায় ! এই দূর পার্বত্যপ্রদেশে এখানেও সেই বঙ্গীয় পুলিশের অভিন্ন মূর্তি; তেমনই কর্কশ এবং কঠোর। ইহারাই আবার দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন কর্তা। বুঝি পুলিশ সর্বত্রই সমান।

হঠাৎ একটা কঠিন হুকুম জারি হলো। জমাদার সাহেব হুকুম দিলেন যে, আজ বাজারের দোকানদার কি 'মুসাফির' লোক যত আছে, চুরি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেহই স্থানান্তরে যেতে পারবে না। আমাদের চটিওয়ালা মনে করেছিল আমরা বুঝি জমাদার সাহেবের এই কঠিন আদেশ শুনতে পাইনি , তাই সে আমাদের কাছে এসে সংবাদ দিলে আজ আমাদের পিপুলকুঠিতে থাকতে হবে; চুরি তদন্ত শেষ না হলে আমরা স্থানান্তরে যেতে পারছিনে। স্বামিজী বললেন, "সুসংবাদ বটে ! একেই বলে উদোর ঘাড়ে বুদোর বোঝা। " যে ভাবে জমাদার সাহেব তদন্ত আরম্ভ করেছেন, তাতে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি এখানে অপেক্ষা করতে হয়, ত ইংরেজি মাসের এ কটা দিন এখানেই কাটিয়ে যেতে হবে। যা হোক, যা হয় করা যাবে ভেবে আমরা আহারাদিতে মনঃসংযোগ করলাম। এদিকে জমাদার সাহেব ষোড়শ উপাচারে আহার সম্পন্ন করে নিদ্রাদেবীর উপাসনায় প্রবৃত্ত হলেন। বেলা তিনটের পর আমরা চটি ত্যাগ করা মনস্থ করলাম; কিন্তু জমাদার সাহেবের কঠোর হুকুম লঙ্ঘন করলে পাছে বিপদে পড়তে হয়, এই ভেবে একটা উপায় স্থির করা আবশ্যক বলে বোধ হলো।

জমাদার সাহেব তখন নিশ্চিন্তমনে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত; দোকানদারেরা কেহ কেহ দ্বারপ্রান্তে বসে হুজুরের নিদ্রাভঙ্গের প্রতীক্ষা করছে। আমরা কি করি, তাই ভাবতে লাগলাম। স্বামিজী বললেন, জমাদার সাহেবকে বলে চলে যাওয়াই ভাল। কিন্তু সে ভারটা কে গ্রহণ করবে ? একটু গুছিয়ে কথা বলা চাই, এবং আবশ্যক হলে ভয় দেখানও কর্তব্য হবে। এই রকম অভিনয়ে আমা অপেক্ষা স্বামিজী পটু নহেন, সুতরাং আমি এই কার্যভার গ্রহণে সম্মত হলাম।

জমাদার সাহেবের আড্ডায় হাজির হয়ে দেখলাম, সাহেব ঘোরতর নাসিকা গর্জন করে নিদ্রা যাচ্ছেন, কনস্টেবলরা নিকটেই বসে আছে। আমি একজন কনস্টেবলকে বললাম যে, প্রভুকে একবার জাগানো দরকার - বিশেষ কাজ আছে। কনস্টেবলের কানে বোধ করি এ রকম অদ্ভুত কথা আর কখনও প্রবেশ করে নি; ঘুমন্ত জমাদারকে জাগানো, আর ঘুমন্ত বাঘের গায়ে খোঁচা মারা, এ তারা একই রকম দুঃসাহসের কাজ বলে মনে করে; সুতরাং অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নাছোড়বান্দা; পুনর্বার তাকে এ কথা বলা হলো। এবার কনস্টেবল সাহেব ভ্রুকুটিভঙ্গে আমার দিকে চাইলেন, পাছে হুজুরের নিদ্রাভঙ্গ হয়, এই ভয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠতে পারলেন না। আমি দেখলাম এ এক বিষম সমস্যা। শেষে খুব চেঁচিয়ে কথা কইতে লাগলাম, অভিপ্রায় আমার গলার আওয়াজে জমাদার সাহেবের নিদ্রাভঙ্গ হোক। ফলেও তাই হলো। আমার কণ্ঠস্বরে প্রভুর নিদ্রাভঙ্গ হলো; তিনি চক্ষু রক্তবর্ণ করে বললেন "কোন্‌ চিল্লাতা হ্যায় ?" সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলেন। সম্মুখেই আমাকে দেখে ভারি গরম হয়ে কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন "ক্যা মাঙ্‌তা" ? অনেকদিন এদেশে থেকে পুলিশের লোকের চরিত্র সম্বন্ধে আমার অনেকখানি অভিজ্ঞতা জন্মেছে। এরা প্রবলের কাছে মেষশাবক, কিন্তু দুর্বলের বাঘ ! সুতরাং জমাদার সাহেব "ক্যা মাঙ্গতা" বলবামাত্র আমিও তেমনি সুরে আমার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করলাম। আমরা যে তখনই চলে যেতে চাই, কোথা হতে এসেছি, কোথা যাব, আমরা কজন আছি, সমস্ত তাঁকে খুলে বলা হলো। তিনি "আবি নেহি হোগা" বলে ফরসির নলে মুখ লাগালেন ! আমি দেখলাম, সহজে কার্যসিদ্ধির সম্ভাবনা নেই; তখন আর একটু চড়া মেজাজে ইংরেজি ও হিন্দুস্থানিতে মিশিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলাম। তাকে সোজাসুজি জানিয়ে দিলাম যে, সে যদি আর একদণ্ডও আমাদের আটকে রাখে, তবে তার মস্তক ভক্ষণের সুব্যবস্থা করবো। রাস্তায় কোথাও কোনো পুলিশের লোক কোনোরকম কুব্যাবহার করলে তখনই ইনস্পেক্টারকে জানাবার ভার আমার উপর আছে। ইনস্পেক্টারের সঙ্গে যে আমার বন্ধুত্ব আছে, সে কথাও তাকে জানিয়ে দিলাম এবং আজ কয়দিন হলো কর্ণপ্রয়াগে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাও বললাম। জমাদার যে ভাবে চুরি তদন্ত করছেন, আমি তা দেখে যাচ্ছি; এ কথা গোপন থাকবে না।

আমার কথা শুনে লোকটা একদম নরম হয়ে গেল। কাপুরুষদের বিশেষত্ব এই যে, তারা প্রথমে মুখে যতই তর্জন করুক না কেন, ভয়ের কোন কারণ উপস্থিত হলেই একেবারে পৃষ্ঠভঙ্গ দেয়। এ ক্ষেত্রেও তা হলো। জমাদার সাহেব ফরসি ছেড়ে আমার সঙ্গে ভদ্রালাপ আরম্ভ করলেন এবং আমাদের প্রতি আদেশ দিলেন যে, আমরা যখন ইনস্পেক্টারের জানিত লোক এবং ইনস্পেক্টারের সঙ্গে বন্ধুতাও আছে, তখন আমরা 'চোট্টা কি ডাকু' হতেই পারি নে; অমরা যখন ইচ্ছা চটি ত্যাগ করতে পারি; অনেকেই সন্ন্যাসীর সাজ নিয়ে চুরি ডাকাতি করে বেড়ায় বলে, সকলের প্রতি তাঁকে পুলিশোচিত সন্দিগ্ধভাব প্রকাশ করতে হয় এবং ইহা তাহাদের দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার ফল। আমরা যদি খানিক আগে আত্মপ্রকাশ করতাম, তা হলে তাঁকে বাধ্য হয়ে এ রকম রূঢ়তা প্রকাশ করতে হতো না। তিনি আরও প্রকাশ করলেন যে, চুরির তদন্ত তিনি অনেক আগেই আরম্ভ করতেন, কিন্তু আজ তাঁর "তবিয়ত আচ্ছা নেই" তাই কিঞ্চিৎ বিশ্রামের পর তদন্ত আরম্ভ করা মনস্থ করেছেন; এতে সরকারি কাজের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। আর আমি এ সকল কথা যেন ইনস্পেক্টারের গোচর না করি। হাস্যমুখে তাকে অভয়দান করে চটি ত্যাগ করবার উদ্যোগ করতে লগলাম।

সেই এক বাজার পাহাড়ি লোকের মধ্যে দারোগা সাহেবকে খুব খানিকটে অপদস্থ করে আমরা চটি ত্যাগ করলাম। বলা বাহুল্য তখন মনে মনে প্রচুর আত্মপ্রসাদ লাভ করা গিয়েছিল; এবং দারোগার দর্প চূর্ণ করবার দরুন তার পরেও কিছু ক্ষোভের কারণ জন্মায় নি, তবে মনটা বিশেষ প্রসন্ন ছিল না। থানার দারোগা মফঃস্বলের সর্বত্রই যমের এক একটি আধুনিক সংস্করণ; কনস্টেবলগুলি যমদূত; কিন্তু সেকালের যম ও যমদূতের সঙ্গে একালের দারোগা এবং কনস্টেবলদের অনেক বিষয়ে পার্থক্য দেখা যায়। দারোগা সাহেবদের হাতে যমদূতের ন্যায় কোনো রকম দণ্ড না থাকলেও তাঁদের দোর্দণ্ডপ্রতাপে মফঃস্বলবাসীদিগের সন্ত্রস্ত থাকতে হয়, এবং যদিও যমদূতদিগের শেল, শূল, মুষল, মুদ্গর ও পাশ একালে লৌহনির্মিত হাতকড়া ও রুল নামক অনতিদীর্ঘ কাষ্ঠদণ্ডে পরিণত হয়েছে, তথাপি সাহসপূর্বক বলা যায় যে, যম ও যমদূতের হাতে অন্তত সাধুদিগের কোন আশঙ্কা ছিল না, কিন্তু পুলিশের হাতে সাধু অসাধু কারও রক্ষা নেই। অতএব এ রকম ক্ষমতাশালী দারোগা সাহেব তাঁর হাতের মধ্যে একজন নগ্নপদ রুক্ষকেশ, কম্বলধারী মুসাফির সন্ন্যাসীর কাছে এরূপভাবে অপদস্থ হয়ে তাঁর অমোঘ হুকুম ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে সাধারণের সম্মুখে যে গৌরব হতে বঞ্চিত হলেন, তাঁর সেই হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে তাঁকে অনেক হয়রান হতে হবে এবং আমাদের দোষে হয় ত অনেক নির্দোষী বেচারা তাঁর হাতে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করবে। অনেক অসাধু লোকের এ রকম স্বভাব যে, যদি তারা নিজের কুকর্মের জন্যে কারও কাছে নিগ্রহ ভোগ করে, তা হলে আর পাঁচটা নিরীহ লোককে নিগৃহীত করতে না পারলে তারা কিছুতেই শান্তি পায় না; যতক্ষণ সে রকম কোনো সুবিধা না পায় ততক্ষণ মনে করে তার অপমানটা সুদ সমেত অনাদায় থেকে গেল।

এই সকল কথা ভাবতে ভাবতে এবং তৎসম্বন্ধে বৈদান্তিক ভায়া ও স্বামিজীর সঙ্গে রহস্যালাপ করতে করতে আমরা অপরাহ্ণে পর্বতগাত্রস্থ সঙ্কীর্ণ পথ ধরে চলতে লাগলাম। তখনও সূর্য অস্ত যায় নি। সূর্য ধূসর পাহাড়ের অন্তরালে খানিকটে ঢলে পড়েছিল, এবং তার লাল আভা পার্বত্য গাছপালার উপর দিয়ে আকাশের অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। অল্পক্ষণ পরে পাহাড়ের পশ্চিম দিগন্তে একটু মেঘ দেখতে পেলাম; সূর্যাস্তের পূর্বে নীল আকাশের লোহিতাভ প্রদেশের অতি ঊর্ধ্বে দুই একটা কাল পাখি যেমন ছোট দেখায় তেমনি ক্ষুদ্র একখণ্ড মেঘ; - ক্রমে মেঘখানি বড় হতে লাগলো; শেষে মোড় ঘুরে দেখি সম্মুখে পাহাড়ের উপর মেঘের দল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে; বোধ হলো যেন তারা পরামর্শবদ্ধ হয়ে কোন আগন্তুক শত্রুর প্রতীক্ষা করছে। আমরা বৃষ্টির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুর্গম দীর্ঘ পথের উপর সহসা এরকম ঘনঘটা দেখে মনটা বড় অপ্রসন্ন হয়ে উঠলো; ভাবলাম আর যাই হোক, দারোগার শাপটা হাতে হাতে ফলে গেল। দেখছি কলিযুগেরও কিছু মাহাত্ম্য আছে; সত্যযুগে শুনেছি ব্রাহ্মণ যোগী-ঋষির শাপে অগ্নিবর্ষণ হতো, ব্রহ্মতেজে অভিশপ্ত ব্যক্তি দগ্ধ হয়ে যেত, আর কলির এই শেষে মুসলমান দারোগার শাপে বুঝি অজস্র বৃষ্টি ধারায় আমরা ভেসে যাই। এখন কোথায় আশ্রয় নেওয়া যায়, এই চিন্তায় মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো।

কিন্তু এখানে আশ্রয় জুটানোও বড় সহজ কথা নয়। এ শহর অঞ্চলের পথ নয় যে, ঝড়বৃষ্টির উপক্রম দেখলে কোনো বাড়ির দুয়ারে আশ্রয় নেব। একবার পথে বেরুলে সহজে গ্রাম চোখে পড়ে না; যদিও দুই বা চারি ক্রোশ অন্তর এক আধখানা গ্রাম দেখা যায়, সে গ্রাম আর কিছুই নয়, পাঁচ সাত কি বড় জোর দশখানি কুটির সমষ্টি মাত্র। গোটাকতক মহিষ, ছাগল আর জনকতক স্ত্রী পুরুষ এবং তাহাদের ছেলেমেয়ে এই গ্রামের অধিবাসী। যে কয়খানা কুটির, তা হয় ত তাদের নিজের ব্যবহারের জন্যই যথেষ্ট নয়। এই পথে চলতে চলতে অনেক সময় বিপদে পড়ে এ রকম গ্রামে গৃহস্থের ঘরে আশ্রয় নিতে হয়েছে, কিন্তু ঘরে আশ্রয় নিয়ে সমস্ত রাত্রি বাহিরেই কাটিয়েছি। আমাদের দেশে একটা কথা আছে; একবার একটা লোককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সে এতটা পথ কি রকম করে এল, তাতে সে লোকটা উত্তর করেছিল যে, "নৌকাতেই এসেছি, তবে সমস্ত রাস্তাটা গুন-টেনে। " আমাদের এই পার্বত্য আশ্রয়ও ঠিক সেই রকমের; গৃহস্থের ঘরে আশ্রয় পাওয়া গিয়েছিল বটে কিন্তু সমস্ত রাত্রি অনাবৃত আকাশতলেই কাটাতে হয়েছে। কেউ মনে করবেন না যে, আমি গ্রামবাসীদের আতিথেয়তার দোষ দিচ্ছি; তারা বাস্তবিক অত্যন্ত আতিথেয়। পার্বত্য গৃহস্থ দুর্গম হিমালয়ের নিভৃত বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায়, তাই অনেক যাত্রীর প্রাণরক্ষা হয়। বাস্তবিক যদিও তারা গরীব এবং কায়ক্লেশে পর্বত বিদীর্ণ করে যে মুষ্টিমেয় গম বা ভুট্টা সংগ্রহ করে, তারই তিনখানা রুটির একখানা ক্ষুধিত অতিথিকে দিতে কিছুমাত্র কাতর হয় না; এবং অতিথির প্রতি তাদের যে যত্ন, আগ্রহ, তা অপার্থিব। কিন্তু পরের জন্য নূতন করে ঘর বেঁধে রাখতে পারে না। পাহাড়ের গায়ে বৈঠকখানা তৈয়েরি করবার মত জমিও মেলে না। অনেক খুঁজে পাহাড়ের যেখানে সামান্য একটু চাষের উপযুক্ত জায়গা পায়, তারই এক কোণে দুই পাঁচ ঘর গৃহস্থ ছোট ছোট কুটির তৈয়েরি করে, বাকি জমিটা চাষ করে। কাজেই অতিথির মাথা রাখবার মত স্থান কখন মেলে, কখন মেলে না।

যা হোক আমাদের সম্মুখে ত আপাততঃ বৃষ্টি উপস্থিত, ঝড় হওয়াও আশ্চর্য নয়। তিনটি প্রাণী ঘোর তুফান মাথায় করে চলেছি, এক একবার আকাশের দিকে চাচ্ছি, আর অগ্রসর হচ্ছি। কিছু লক্ষ্য নেই তবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে চলেছি, - কথাটা আশ্চর্য বটে, কিন্তু আমরা কেউ নির্বাক হয়ে চলছি নে। দারোগার সঙ্গে আমার যে কথান্তর হয়েছিল, তা লক্ষ্য করে বৈদান্তিক ভায়া উল্লেখ করলেন যে, লোকের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করা সাধু সন্ন্যাসী মানুষের উচিত নয়, তাতে প্রত্যবায় আছে। তাঁর মত নৈয়ায়িক প্রবর যে, এই শব্দবিন্যাসের মধ্য হইতে 'অকারণ' কথাটা অনায়াসে বাদ দিলেন, সে জন্যে তাঁর সঙ্গে তর্ক করবার প্রলোভনটা সংবরণ করা দায় হলো। আমি সবে গৌরচন্দ্রিকা ফেঁদে বিষম একটা তর্কজাল বিস্তার করবো এবং সেই অবসরে অনেকদূর নির্ভাবনায় যাওয়া যাবে ঠিক করেছি, এমন সময় স্বামিজী আমাদের ডেকে বললেন সম্মুখে একটা ভয়ানক ঝড় উঠেছে ; সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া দরকার, আর তর্ক করবার সময় নাই। স্বামিজী আমাদের আগে আগে যাচ্ছিলেন। এক মিনিটের মধ্যে ঝড় আমাদের উপর এসে পড়লো। স্বামিজী তৎক্ষণাৎ পাহাড়ে ঠেস দিয়ে বসে পড়লেন। প্রবল বাতাসে কতকগুলো পাতা উড়ে স্বামিজীকে ছেয়ে ফেললে, তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন, কিন্তু দেখলাম বৈদান্তিক ভায়া তর্ক করতে বিশেষ মজবুদ হলেও তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিটা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি অন্য উপায় না দেখে এবং বেশি কিছু বিবেচনা না করে আমাকে কোলের মধ্যে চেপে ধরে রাস্তার পাশে উবু হয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি তাঁর শরীরের নীচে পড়ে রইলাম; তিনি তাঁর বিপুল শরীর দিয়ে আমাকে ঢেকে রাখলেন। বাতাসটা আমাদের উপর দিয়ে এত জোরে বয়ে গেল, এবং আমাদের এত নাড়া দিল যে, বোধ হলো যেন সেই দণ্ডেই আমাদের দু'জনকে উড়িয়ে নিযে রাস্তার পাশে গভীর খাদের মধ্যে ফেলে দেবে; কিন্তু দেখলাম বৈদান্তিকের শরীরে অসাধারণ বল। সেই প্রবল ঝঞ্ঝাবাতটা তিনি অকাতরে সহ্য করলেন। আমাদের নাক মুখের ভিতরে যে কত ছাইভস্ম প্রবেশ করলো তার শেষ নাই। বাতাস চলে গেলে আমরা চেয়ে দেখলাম, গাছের পাতা ধুলো কাঁকর আর রাস্তার ছোট ছোট পাথরের মধ্যে আমরা সমাহিত হয়েছি; দু'জনেই গা-ঝেড়ে উঠলাম; উঠে দেখি বৈদান্তিক ভায়ার পিঠ জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে, এবং সেখান হতে অল্প অল্প রক্ত পড়ছে; পাঁচ সাত জায়গায় ছড়ে গিয়েছে। বড় বড় কাঁকর খুব জোরে এসে পিঠে লাগাতেই এ রকম হয়েছে। আমার কোনো ক্ষতি হয় নি, শুধু একবার দম আটকে গিয়েছিল। ঝড় বৃষ্টির সময় পক্ষীমাতা যেমন তার ক্ষুদ্র অসহায় শিশুটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে তার হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ ও যত্ন এবং সুকোমল প্রসারিত পক্ষপুট দিয়ে ব্যাকুল আবেগের সঙ্গে ঢেকে রাখে, আজ এই ঘোর ঝঞ্ঝাবাতের মধ্যে বৈদান্তিক তেমনি নিজের শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে শরীর দিয়ে আমাকে রক্ষা করেছেন; নিজের যে কষ্ট হয়েছে, সে দিকে একটুও লক্ষ্য নেই। আমার শরীরে যে আঘাত লাগে নি এতেই তাঁর মহা আনন্দ। বৈদান্তিকের সহৃদয়তা, মহত্ত্ব এবং আমার প্রতি করুণ স্নেহ দেখে স্ব্তঃই আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতা-রসে ভিজে গেল। বিপদের সময় ভিন্ন যে মানুষ চেনা যায় না, বিপদই মানুষের কষ্টিপাথর, তা তখন বুঝতে পারলাম। এই সংসারবিরাগী, শুষ্কহৃদয়, তর্কপ্রিয়, পরুষভাষী বৈদান্তিকের সঙ্গে অনেক দিন হতেই একত্র ঘুরে বেড়াচ্ছি। শরীর শক্ত, মানুষ প্রকাণ্ড উঁচু, চুলগুলো আবড়া-খাবড়া, ঠিক খেজুর গাছের মত; মনে হতো এর মধ্যে শুধু তর্কেরই ইন্ধন সঞ্চিত আছে; এতে আর কিছু পদার্থ নেই; কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম, এই কঠিন দেহের মধ্যে একখানি অতি সুকোমল স্নেহার্দ্র হৃদয় আছে, এবং তার ঐ অতি বিশাল বক্ষ আর্তের স্নেহনীড়। কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাসে আমার চক্ষে জল এলো। আমরা উঠে দাঁড়ালে স্বামিজী তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে ছুটে এলেন; আমরা কেমন করে রক্ষা পেয়েছি শুনে তিনি বৈদান্তিকের গায়ে তাঁর স্নেহাশীর্বাদপূর্ণ হাতখানি বুলিয়ে দিলেন। স্বামিজীর ভাবে বোধ হলো, আমাকে এমন করে রক্ষা করেছেন বলে বৈদান্তিককে তিনি তাঁর প্রাণের মধ্য হতে নীরব আশীর্বাদ প্রেরণ করেছিলেন। দুই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর এ কি ব্যবহার ? বৈদান্তিক বিপদের সময় আমার কাছে ছিলেন, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তিনি না হয় নিজের প্রাণ দিয়ে পরের প্রাণ রক্ষা করেছেন; কিন্তু স্বামিজী সংসারের উপর বীতস্পৃহ হয়ে লোটা কম্বল মাত্র সার করে বেরিয়ে পড়েছেন; তাঁর এ আসক্তি, মায়াবন্ধন, এ বিড়ম্বনা কেন ? কোথায় ভগবানের নামে বিভোর হয়ে তিনি সময় কাটাবেন, না শুধু আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি ব্যস্ত। এই পর্বতের মধ্যে শত কার্যে আমার প্রতি তাঁর স্নেহের পরিচয় পেয়েছি। আজ দেখলাম আমার জন্য তাঁর আগ্রহ, উৎকণ্ঠা - স্নেহবন্ধনে বদ্ধ গৃহীর আগ্রহ, উৎকণ্ঠা অপেক্ষা অল্প আসক্তি বর্জিত নয়। তাই একবার আমার ইচ্ছা হলো তাঁকে চেঁচিয়ে বলি, সাধু সন্ন্যাসী, এই কি তোমার সংসার ত্যাগ, ইহারই নাম কি মায়ার বন্ধন ছেদন ? সমস্ত ছেড়ে হিমালয়ের মধ্যে এসেও তোমার আসক্তি বিদূরিত হলো না। শেষে কি বলবে যে, "এই লেড়কা হামকো বিগাড় দিয়া" - কিন্তু এত কথা মুখ দিয়ে বাহির হলো না; শুধু বললাম "আমার প্রতি আপনার মায়া ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা কিন্তু ভাল নয়। " তিনি এবার জবাবে আমাকে যা বলেছিলেন, তেমন দেববাণী আমি আর কখনও শুনি নি; তিনি বললেন "আমি সংসার ছেড়ে এসেছি, সংসারে আমার কেউ নাই, তোমার সঙ্গেও আমার কোনো সম্বন্ধ নেই। তোমার উপর আমার হৃদয়ের নিঃস্বার্থ স্নেহবর্ষণ করে আমি প্রেমময়ের প্রেম-মন্দিরে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করছি। তুমি আমার কে ?"

আমি নিরুত্তর রইলাম। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ হলো, তাতে পথ আরও পিচ্ছিল; ও দুরারোহ হয়ে উঠলো। আমরা তিনটি প্রাণী নীরবেই চলছি, কিন্তু মন বোধ করি চিন্তাশূন্য নয় ! চারিদিকে ঘোর মেঘ, দূরে পাহাড়ের কোলে বড় বড় গাছগুলোতে বাতাস বেধে একটা অস্পষ্ট বিকট শব্দ উঠছে, যেন বহুদূরে উন্মত্ত দৈত্যদল দুর্ভেদ্য পর্বতদুর্গ বিদীর্ণ করবার জন্যে প্রবল আস্ফালন করছে। আমরা কখন অতিধীরে, কখন দ্রুতপদে চলে অনেক বিলম্বে নারায়ণচটি নামক একটা খুব ছোট চটিতে উপস্থিত হলাম। শুনলাম এ জায়গাটা পিপুলকুঠি হতে সবে দু মাইল। শুনে আমার বিশ্বাস হলো না, আমাদের দেশে দু মাইল তফাত বললে এ-পাড়া ও-পাড়া বুঝায়; বৌবাজার হতে শ্যামবাজার দু মাইলের বেশি নয়; কিন্তু এ কি রকম গজের দু মাইল তা বুঝতে পারলাম না; এ যদি দু মাইল রাস্তা হয়, তা হলে স্বীকার করতে হবে, এর সঙ্গে আরো পাঁচ সাত মাইল 'ফাউ' যোগ করা ছিল।

আমি ইতঃপূর্বে আমাদের সঙ্গেকার যে রোগা ছেলেটির কথা বলেছি , আমরা তাকে কাতর দেখে আহারান্তেই রওনা হয়েছিলাম, কারণ সে যে রকম রোগা, তাতে সে আমাদের সঙ্গে চলতে পারবে, সে ভরসা ছিল না; তার উপর যদি তাকে আগে রওনা না করা যেতো তা হলে দেখছি, পথে এই দৈবদুর্যোগের মধ্যে সে নিশ্চয়ই মারা পড়তো। যাহোক দারোগা সাহেব আমাদের চটি ত্যাগ করবার নিষেধবার্তা জারি করবার পূর্বেই সে বেরিয়ে পড়েছিল। কথা ছিল, সে সম্মুখের চটিতে এস আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে; আমরা নারায়ণচটিতে পৌঁছে দেখলাম, সে আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে। পথে জল ঝড়ে আমাদের কি দুরবস্থা হচ্ছে ভেবে বেচারি বড়ই চিন্তিত ও বিমর্ষ হয়ে বসেছিল। আমরা ভিজতে ভিজতে নারায়ণচটিতে উপস্থিত হলাম; আমাদের দেখতে পেয়ে তার রোগক্লিষ্ট শুষ্কমুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো, আমারাও তাকে সুস্থদেহে সেখানে উপস্থিত দেখে খুব আনন্দিত হলাম।


(চলবে)

 

 

Copyright © 2011 Abasar.net. All rights reserved.