প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ১, ২০১৬

 

যাঁদের আমি ছাত্র

ভাস্কর বসু

এক লাফে বিশ্ববিদ্যালয় – প্রথম পর্ব

---৯--

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮)

পাঠভবনের সুমধুর দুটি বছর হুড়মুড় করে কেটে গেল। উচ্চ-মাধ্যমিকের পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই আমরা ঢুকে গেলাম যাদবপুরে, ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। স্কুল পেরিয়ে কলেজ নয়, একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বড়দের তখনো অভ্যাস হয়নি, প্রায়শই শুনতে হত, - ‘আজ স্কুল ছুটি বুঝি?” – কি জ্বালা!
যাদবপুরে যে পড়ব তা সম্ভবত আমার ভবিতব্যে অনেক আগেই লেখা ছিল। বাবা যাদবপুরের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কাকা কেমিক্যাল, মেশোমশাই সিভিল। মামাবাড়ি দক্ষিণ কলকাতায় ল্যান্সডাউন রোডে থাকায় যাতায়াতের পথে পড়ত যাদবপুর। তখন থেকেই সঙ্গলোভী– প্রতীক্ষায় ছিলাম। কাকার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হই, কিন্তু আমার একদম বায়োলজি ভালো লাগত না আর রক্তপাত দেখলে ভির্মি খাওয়ার যোগাড় হত। কাজেই সেদিকে আর ধারবার মাড়াইনি।

১৯৭৯ সালে আগস্ট মাসে আমাদের ক্লাস শুরু হল। ডিপার্টমেন্টের প্রথাগত নাম Electronics and Tele-communication Engineering (ETCE)। মনে আছে একাধিক নবীন-বরণ উৎসব হয়েছিল, একটি গান্ধী-ভবনে সব্বাই মিলে – তাছাড়া ডিপার্টমেন্টেও আলাদা করে। যাদবপুরে র‍্যাগিং এর কোন সেরকম প্রচলন নেই। তার ওপরে আমরা ছিলাম ডে-স্কলার অর্থাৎ যারা হোস্টেলে না থেকে বাড়ী থেকে যাতায়াত করে পড়াশুনো করতাম। প্রথম বছরে কিন্তু আমরা আমাদের ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করিনি। আমাদের ক্লাস হয়েছিল ইন্টিগ্রেটেড বিল্ডিং বলে একটি জায়গাতে। সেখানে অন্য ডিপার্টমেন্টেরও ক্লাস হত। সব্বাই মিলে বেশ হুড়োহুড়ি হত মনে আছে।

প্রথম বছরে আমাদের একটা গ্রুপ হয়ে গিয়েছিল যাদের খুব ব্রিজ খেলার নেশা ছিল। সদ্য সদ্য সবাই শিখেছি, - কি মজা! যাদবপুরের বিখ্যাত মাঠে বসেও আমরা তাস খেলতাম, বেশ বন্ধু-বান্ধবও জুটত। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ছিল সোমনাথ, মৃত্যুঞ্জয়, কৌশিক, অজয় আর পার্থ (প্রামাণিক)। মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী খুব লম্বা আর রোগা, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। একটা কথা সে খুব বলতো, “আমি লম্বা আছি তো, তাই সুবিধে।” ব্যাস, এরপর সে কোন পরীক্ষায় ভাল করলেই লোকে বলতে শুরু করতো, “ও আলাদা, লম্বা আছে না!” সোমনাথ বেশ স্বাস্থ্যবান হলেও ছিল বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। সোমনাথ ছিল আমার ব্রিজ পার্টনার এবং পরীক্ষা-কাম-পড়াশুনো পার্টনার। অজয় বেশ অদ্ভুত করে কথা বলত, “বলারই বা কি কারণ থাকতে পারে” আর “না বলারই বা কি কারণ থাকতে পারে?” কৌশিকও লম্বা, ফর্সা ছিল, মাঝে মাঝেই একটু ভাবুক হয়ে পড়ত। মৃত্যুঞ্জয়, কৌশিক, সোমনাথ, এরা আসত উত্তরের দিক থেকে ট্রেনে আর আমি আসতাম সোনারপুরের দিক থেকে ট্রেনেই। ফেরার সময়ও যাদবপুর স্টেশনে বেশ আড্ডা হত, - একটা ট্রেন ছেড়ে পরের ট্রেন – আবার পরের ট্রেন।

এইসময় একদিন আমাদের ডীন অব স্টুডেন্টস শ্রী হিমেন্দু বিশ্বাস (গণ-সঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অনুজ) আমাদের ডেকে বারণ করলেন। বুঝিয়েই বললেন,-“আমাদের সমাজে তাস খেলার সেই সমাদর নেই যা বিদেশে আছে। তোমরা এভাবে প্রকাশ্য জায়গাতে না খেললেই ভাল।” তারপর থেকেই আমাদের খেলার জায়গা পাল্টে গেল। এ নিয়ে বেশ মজার ঘটনাও আছে, একবার এসেই শুনি সেদিন স্ট্রাইক। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে বসে গেলাম সবাই মিলে তাস খেলতে। দু-একজন সংগ্রামী ছেলের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল আমাদের মিছিলে ডেকে নিয়ে যাওয়ার। অনেক চেষ্টাতে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে যেতে আমাদের অভিশাপ দিয়েছিল- ‘হতচ্ছাড়া, তোরা যখন মরবি, আমরা ঐ তাসের প্যাকেট গুলোই দিয়ে দেব – আর তার থেকে চারখানা বিবি বার করে নেব!” উফফ!

প্রথম বছরে আমাদের পাঠ্য ছিল সবই বিজ্ঞানের বিষয়, কিন্তু ইংরেজিও ছিল। আমাদের পড়াতেন রণজয় কার্লেকার বলে এক সুদর্শন ও খুব সুন্দর স্বভাবের মানুষ। আমার খুব ভালো লাগত। আমাদের সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতেন। একদিনই শুধু আমরা না বলে কয়ে ‘মাসকাট’ করেছিলাম বলে খুব মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় যখন আমরা ফাইনাল ইয়ারে, সেই সময় মাত্র চল্লিশের আশেপাশে বয়সে একরাতে মাসিভ কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এখনকার মত তখন এত জানতাম না, অবাক হয়েছিলাম, খুব কষ্টও পেয়েছিলাম মনে আছে।

অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ডঃ এন সি দাস। তিনি চমৎকার ফিজিক্স পড়াতেন, - তিনি কিন্তু PhD নন, তিনি ছিলেন DSc। তখন সম্ভবত: যাদবপুরের একমাত্র ঐ খেতাবধারী। অঙ্ক করাতেন এক রসিক মানুষ অচিন্ত্য মিত্র। তিনি আবার গীটার বাজিয়েও বেশ নাম করেছিলেন। তিনি পড়াতেন Complex variables. প্রথম দিন ক্লাসে এসেই বলে দিয়েছিলেন, “Actually complex variables are very simple.” চমৎকার পড়ানোর গুণে তা হয়েওছিল। একদিন হঠাৎ বলেছিলেন শিবরামের এক গল্পের কথা – শিবরাম নাকি নাকি এক মেকানিকের হাতে একটি যন্ত্র দেখে জানতে চেয়েছিলেন ওটা কি। মেকানিক বলেছিল, “এটা হল প্লাস” ! শিবরাম বললেন, “তাহলে ওর ঐ দাঁড়া দুটো, ও দুটো নিশ্চয় মাইনাস!” হতভম্ব মেকানিককে বুঝিয়ে শিবরাম বললেন, “আরে অঙ্কের নিয়ম, Two minus make one Plus!” মেকানিকের কি অবস্থা হয়েছিল জানিনা, আমরা ছাত্ররা তো রীতিমতো Nonplussed! আমাদের সময়ে কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল যে উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্কের একটি প্রশ্নপত্র তিনিই করেছিলেন। সেখানে একটি অঙ্ক ছিল খুব বিতর্কমূলক, পর্ষৎ পরে সেই অঙ্কটি যারা চেষ্টা করেছিল তাদের সকলকেই নাম্বার দেন। এ নিয়ে উনি ক্লাসে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে অঙ্কটি আদৌ ভুল ছিল না।

তবে, প্রথম বছরে আমাদের হাড় জ্বালিয়েছিল ওয়ার্কশপ আর ড্রয়িং। কি যে সব সাংঘাতিক কাজ! আমরা একদিন গেলাম ফাউন্ড্রি শপে। সেই শপে যিনি ছিলেন কি তাড়াতাড়ি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে আমাদের মডেল করে দেখালেন, আমরাও ভাবলাম এ তো একেবারে বাঁ হাতের কাজ। সমস্যা হল নিজে হাতে করতে গিয়ে। ওমা, করতে গিয়ে দেখি ঝুরঝুর করে গুঁড়ো পড়ে যাচ্ছে। কি সর্বনাশ! কয়েকজন দেখি আবার বেশ ভালই করছে। যা হোক কোনক্রমে নাকের জলে চোখের জলে পার হওয়া গেল। ফিটিং, কাঠ এই ওয়ার্কশপগুলোতেও এক অবস্থা। তখন আমরা দিন গুনছি কেবল। কবে সেকেন্ড ইয়ার আসবে আর মুক্তি মিলবে! এর ওপর আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং। আমরা অবশ্য ততদিনে বার করে ফেলেছি ইলেকট্রনিক্সে পরে আর এগুলো খুব কাজে লাগবে না, কাজেই কোনক্রমে বৈতরণী পার হওয়া। অন্যথায় খুব মজার ছিল ফার্স্ট ইয়ার (সেই শুনে আসা – নো ফিয়ার) কিন্তু এই ওয়ার্কশপ আর ড্রয়িং এর অত্যাচার আমাদের বেশ জব্দ করেছিল। তুলনাতে খুব ভালো ছিল ল্যাবগুলো।
তবে ফার্স্ট ইয়ারে সবচেয়ে বড় ঘটনা - সেই বার সত্যজিৎ রায় এলেন সমাবর্তন উৎসবে। চোখের সামনে সেই মহাপুরুষকে দেখার সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। বক্তৃতাও দিলেন, বললেন ফিল্মের পড়াশোনার জন্য যদি কিছু করা যায়। পরবর্তী কালে যাদবপুরে কিন্তু ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনোর বন্দোবস্ত হয়েছে।

--১০--

এসে গেল প্রতীক্ষিত সেকেন্ড ইয়ার। প্রবেশাধিকার মিলল ডিপার্টমেন্টে। মুক্তি মিলল ওয়ার্কশপ / ড্রয়িং এর অত্যাচারের হাত থেকে। আঃ, এদ্দিনে বেশ ইলেকট্রনিক্স পড়ছি পড়ছি ভাব এলো! আমাদের বিল্ডিং নীচের দুতলা সিভিল, তারপর ইলেকট্রনিক্স আর ইন্সট্রুমেন্টেসন। তারপর ছিল আর্কিটেকচার। চারতলার ওপর একটা ছাদ ছিল, সেখানে ছিল একটা ছোট্ট ক্যান্টিন। চা, পাউরুটি বিস্কুট ইত্যাদি পাওয়া যেত। এই ছাদে আমরা টিফিনের সময়ে (১-৪০ থেকে ২-১০) এসে খেতে খেতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত নিতাম তা হল নবীনাতে ভালো কোন সিনেমা এসেছে কিনা আর টিফিনের পর ক্লাসগুলোর গুরুত্ব কিরকম। যখনই তুল্য-মূল্য বিচারে পাল্লা নবীনার দিকে ঝুঁকত – ব্যাস! অনেক ভালো সিনেমাই আমরা দেখেছি ওখানে। তবে ক্যাম্পাসের মধ্যেই সিনেমা নাটকের ভালই ব্যবস্থাও ছিল। এক সময় বিনা পয়সায় বা খুব অল্প পয়সাতে উচ্চমানের নাটক, গান, সিনেমা দেখার দারুণ এক সুযোগ এসে গেল। ব্যারিকেড, টিনের তলোয়ার, জগন্নাথ, মারীচ সংবাদ, সমাবর্তন, অমিতাক্ষর, হারানের নাতজামাই— কত যে ভাল নাটক দেখেছি! ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পরিচয় হয়েছিল বিশ্ববন্দিত পরিচালকদের সিনেমার সঙ্গে— কুরোসোওয়া, গোদার, ফেলিনি, ডিসিকা, বার্গম্যান, আইজেনস্টাইন। সেই সময়ই গিরিশ কাসারাভাল্লি ও আদুর গোপালকৃষ্ণণেরও নাম শুনলাম।

এই সময় আমাদের ইলেকট্রিক্যাল আর ইলেকট্রনিক্স ল্যাবগুলোও শুরু হয়ে গেল। দাদাদের সঙ্গে আলাপ হতে লাগলো করিডরে। শুনতে লাগলাম বিভিন্ন শিক্ষকের গল্প যাঁরা পরে আমাদের ক্লাস নেবেন।
ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট এর প্রথম যে শিক্ষকের কথা মনে পড়ে তাঁর নাম মনীষ মুখার্জী। সম্ভবত: তিনি ছিলেন যাদবপুরের ETCE র প্রথম ব্যাচের ছাত্র। সুদর্শন, স্মার্ট – একেবারে নায়কসুলভ বেশবাস আর চালচলন! পড়াতেন যে বিষয় তা হল একেবারে ইলেক্ট্রনিক্সের একেবারে গোড়ার বিষয় – ডিভাইসেস (Devices)! তাঁর পড়ানোর একটা আকর্ষণীয় বিষয় ছিল পড়াতে গিয়ে চেষ্টা করতেন ম্যাথেমেটিকাল ডিডাকসনের সঙ্গে ফিজিক্যাল এক্সপ্লেনেসান ও দেওয়ার। বলতেন – “এই ফিজিক্স, আর এই ম্যাথেমেটিক্স – দেখো কিরকম মিলে গেল”! আমাদের এই বিষয়ে আকৃষ্ট করতে তাঁর পড়ানোর এই কৌশল বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। আধুনিক ইলেকট্রনিক্স এর যে মূল আবিষ্কার, সেই ট্রানসিস্টরও পড়িয়েছিলেন তিনি- জানিয়েছিলেন TRANSferred + ReSISTOR = TRANSISTOR !! অর্থাৎ ট্রানসিস্টর আবিষ্কার করার পর বৈজ্ঞানিকেরা এমন এক নাম দিলেন যার মধ্যে ট্রানসিস্টরের কর্মপদ্ধতিরও সন্ধান রইল। পরে যখন আমার ভাষা নিয়ে কিছু কৌতূহল হয়, মিলিয়ে দেখেছিলাম এবং মিলেও গিয়েছিল। মনীষবাবু তার পরেই কিরলিয়ান ফটোগ্রাফির মাধ্যমে সাদা কাগজে ফটোকপির পদ্ধতিতে কাজ করে বেশ নাম করেছিলেন। কাগজে ছবিসহ তাঁর গবেষণার কথা বেরিয়েছিল। মনে রাখতে হবে এই ঘটনা একেবারে আশির দশকের গোড়ার দিক- তখন মিডিয়ার এত দাপাদাপি ছিল না। কাজেই নিজেদের পরিচিত শিক্ষকের ছবি ও কথা কাগজে পড়ে খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম।

আমাদের সময় কম্প্যুটার কিন্তু একেবারেই সুলভ ছিলনা। আমাদের জ্ঞান-গম্যিও ছিলনা সে ব্যাপারে। কম্প্যুটার এর ভাষা বলতে বিখ্যাত ছিল FORTRAN। আমাদের সেই ভাষা শেখানোর ভার পড়েছিল মোহিত রায় বলে একজন শিক্ষকের ওপর। এই মানুষটি ছিলেন একটু গোলগাল, অনেকটা আমাদের স্কুলে যেরকম শিক্ষকরা ছিলেন তাদের মতই। খুব যত্ন করে পড়িয়েছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর তো বটেই, এমনকি কম্প্যুটারের ওপরও তাঁর ছিল অপার স্নেহ। প্রায় আমাদের এবং কম্প্যুটারকেও বাবা-বাছা করে কথা বলতেন। এতে আমাদের খুব সুবিধে হয়েছিল। নতুন ভাষা শিখতে গিয়ে বারে বারেই হোঁচট খেতাম, তাঁর কাছে অজস্র প্রশ্নও করতাম। কোনদিন এতটুকু বিরক্তি দেখিনি। বরং কিরকম এক অদ্ভুত স্নেহশীল, আকর্ষণীয় মনোভাব ছিল। সত্যি কথা বলতে প্রথম প্রথম আমাদের বেশ বোরিং ই লাগতো ঐ ভাষা। উঃ, সেইসব ফিক্সড বা ফ্লোটিং পয়েন্ট, রিটার্ন, হাবিজাবি সিম্বল (*, **, Exp, Go To, IF ইত্যাদি) – মনে হত দূর, দূর – হাতে করে নিলে তো অনেক সহজ হয়। তখনই মোহিতবাবু খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন যে যখন অঙ্কগুলো আরো বড় হয়ে যাবে আর হাতে করা যাবে না, তখন আমাদের কম্প্যুটার ছাড়া গতি নেই। কোন স্মার্ট ছাত্র জিজ্ঞেস করল, “স্যর, কত বড় অঙ্ক, যত বড় ইচ্ছে ---“!! মোহিতবাবু বললেন, “মোটামুটি যা আমাদের কাজে লাগে আর কি! তবে একটা সময়ে এসে ও (কম্প্যুটারও) হয়তো বলবে –‘না আর পারা যাচ্ছে না’!! আমরা খুব হেসেছিলাম যে ওঁর কম্প্যুটারের প্রতি ভালোবাসা আমাদের প্রতি ভালোবাসার থেকে একতিল কম নয়।

ল্যাব গুলিও বেশ মজার লাগতে শুরু করেছিল। আর ছিল ল্যাব রিপোর্ট। তখনই প্রথম শুনলাম, ‘মাদার’ নামের আর এক অর্থ হল পুরনো, বেশ নামকরা ল্যাব রিপোর্ট। তখন ডিপার্টমেন্টে এসেই আগের বছরের দাদাদের কাছ থেকে ভালো নম্বর-ওলা ‘মাদার’ যোগাড় করার জন্য বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে যেত।

সব্বাই খুব সুন্দর করে ল্যাব রিপোর্ট বানাত। আমাদের ফার্স্ট বয় বিশ্বজিৎ এর ল্যাব রিপোর্ট ছিল ঝকঝকে, তকতকে। কারুকে রিপোর্ট দিলেও সে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকত, পাছে নোংরা লাগে, সকলেই তো আর তার মতন সচেতন নয়! সোমনাথ একবার বেশ সুন্দর এক পন্থা আবিষ্কার করলো ডায়াগ্রাম কপি করার। ক্লিপ দিয়ে পুরনো ডায়াগ্রাম নতুন খাতার তলায় রেখে কাঁচের টেবিলের নীচে থেকে টেবিল-ল্যাম্পের আলো দিয়ে ফোকাস করলে তা একেবারে সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠে। তখন শুধু বুলিয়ে গেলেই হল। আমরা সব্বাই যখন সোমনাথকে এই আবিষ্কারের জন্য সাধুবাদ দিচ্ছি, বিশ্বজিৎ একটু কাঁচুমাচু হয়ে এসে বললো, “আচ্ছা, সোমনাথ, যে জায়গাতে ক্লিপগুলো লাগানো হবে, সেই জায়গাগুলো কি বেশ কুঁচকে যাবেনা?” আমরা প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম আর কি!
ইলেকট্রিক্যাল ল্যাবের সামনেই ছিল সত্যেনদার বিখ্যাত ক্যান্টিন। তখন আমাদের তাসের নেশা একেবারে তুঙ্গে। আমাদের ল্যাবের যা নির্ধারিত সময় তার আগেই শেষ করে ক্যান্টিনে গিয়ে তাস খেলার মতলব থাকত। আমাদের প্রতি গ্রুপে চার পাঁচজন করে থাকত। আমাদের গ্রুপে একটি খুব সিরিয়াস ছেলে ছিল যে ল্যাবের শেষে কি এক্সপেরিমেন্ট হল তাই নিয়ে আমার সঙ্গে গভীর আলোচনা করতে চাইত। সে কি সর্বনেশে কাণ্ড! সব্বাই ল্যাব শেষ করে সত্যেনদাতে হাজির, তাস পাতা শুরু হয়ে গেছে, দেরী করলেই জায়গা হাতছাড়া হবে, জানলা দিয়ে কেউ আবার তাস তুলে দেখাচ্ছে! আর আমি- সিরিয়াস মুখে আমাকে কারেন্টের গতি-প্রকৃতি বোঝাতে হচ্ছে। যথাসম্ভব সংক্ষেপে সেরেই দৌড়, জায়গা পেয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস!

যাদবপুরের ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এর সুনাম ছিল খুব। এমনকি যে সমস্ত শিক্ষকরা ল্যাব আর ল্যাবের মৌখিক পরীক্ষা নিতেন তাঁরাও ছিলেন রীতিমতো গুণী মানুষ। এমনি শিক্ষক ছিলেন কে কে দাস, এস কে পাল বা টি কে ঘোষালরা। ল্যাব চলাকালীনও খুব কড়া নজর রাখতেন। ল্যাবের পরও মাঝে মাঝে মাঝে সেই ল্যাব সংক্রান্ত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন। আর ভাইভাও হত বেশ শক্ত। সেই সময় আমাদের ইলেকট্রনিক্স ল্যাব তুলনাতে বেশ সহজই লাগত।

আমাদের সেমিস্টার পদ্ধতি ছিল, ফার্স্ট সেমিস্টার ছিল জুলাই থেকে ডিসেম্বর, সেকেন্ড সেমিস্টার জানুয়ারি থেকে মে-জুন। এটা বেশ সুবিধেজনক, কারণ শুধু ছ-মাসের পড়ার ভিত্তিতেই পরীক্ষা হত। সেকেন্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার এর পর থেকেই আমরা ভাবতে শুরু করলাম, এবারে সিরিয়াস হতে হবে। থার্ড ইয়ার এ বেশ পড়ার চাপ থাকবে।

ফার্স্ট-সেকেন্ড ইয়ার চলাকালীনই আমরা যাদবপুরের বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি, - ফিল্ম ক্লাব, সায়েন্স ক্লাব, মাউন্টেনীয়ারিং ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, গীতি সংসদ ---! সেকেন্ড ইয়ারের শেষে বন্ধুরা যখন থার্ড ইয়ারে কিভাবে শুরু হবে তাই নিয়ে আলোচনা করছি, সোমনাথ গম্ভীর ভাবে বলল “বুঝলি, এখানে ক্লাব না থাকলে কিছু হয় না। এবার আমাদের পড়াশোনার কোন ক্লাব আছে কিনা খুঁজতে হবে!” !!

 


লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।