প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ৩০, ২০১৬

 

যাঁদের আমি ছাত্র

ভাস্কর বসু

ঘরের শিক্ষা - রাঙাকাকা
---১৩--

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮)

আমাদের বসু বংশের সাহিত্য অনুরাগ বরাবরের।  এই বংশের বিগত প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে কারুর কারুর সাহিত্য রচনার ও অভ্যাস ছিল। প্রথাগত ভাবে তারা যদিও বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ছাত্রও হয়, তা ও তাদের এই অনুরাগ কখনোই কমেনি। সাহিত্যচর্চার এই ধারাটি হয়তো ছিল অপেশাদার, কিন্তু তা নিরন্তর। কিন্তু যাঁর হাতে এসে শেষ অবধি এই সাহিত্যানুরাগ অবশেষে সত্যিকারের চিরস্থায়ী সাহিত্য রচনার আকার নিলো তিনি আমাদের রাঙাকাকা - শ্রদ্ধেয় শ্রী বিকাশ বসু।

ছোটবেলাতেই রাঙাকাকার লেখার সঙ্গে পরিচয় যুগান্তরে ‘ছোটদের পাততাড়ি’র মাধ্যমে। এখনো বেশ মনে আছে একটি কিশোর চরিত্রের নাম দিয়েছিলেন “টুকাই” - খবরের কাগজে ছাপার অক্ষরে নিজের কাকার লেখাতে নিজ নামের একটি চরিত্রকে দেখে বেশ শিহরিত হয়েছিলাম। এরপর যতই বড়ো হয়েছি রাঙাকাকার লেখা সম্পর্কে সেই শিহরণ বেড়েছে বই কমেনি! আমার তিন-চারজন সাহিত্যমনস্ক বন্ধুরাও রাঙাকাকার লেখার উৎসাহী পাঠকে পরিণত হয়েছে। অনেক সময় এমন ও হয়েছে কেউ ফোন করে বা কাগজ নিয়ে এসে রাঙাকাকার কোন লেখা দেখিয়ে আমাকে জানিয়েছে তাদের মুগ্ধতার কথা। এতে আমার গর্ব ও আনন্দ দুই ই বেড়েছে। দুর্ভাগ্যবশত: অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরণের গভীর ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখার পাঠক সংখ্যা কম হয়েই থাকে, ফলে লেখকের সেইরকম আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা কম। এই নিয়ে লেখকের মনে আক্ষেপ থাকারই কথা, রাঙাকাকার ও ছিল!

আনন্দবাজার রবিবাসরীয় ও অন্যান্য পত্রিকাতে প্রকাশিত রাঙাকাকার বিখ্যাত লেখাগুলির সংকলন “শব্দ নিয়ে” ও “সাহিত্য নিয়ে” বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কিশোর থেকে পরিণত পাঠক - সকলেরই মনে সাহিত্যের আকর্ষণ জাগিয়ে তোলার পক্ষে এই বই দুটি খুবই সহায়ক। সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় গুলিতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল এরকমই আরো কিছু লেখা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনস্ক পাঠকের পক্ষে এই লেখাগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশক হয়ে উঠবে। সম্প্রতি রাঙাকাকার গদ্য সংকলন বেরিয়েছে, আমার কাছে খুব মূল্যবান বই।

আমার জীবনে রাঙাকাকার উপদেশ ও পরামর্শ বারেবারে আমাকে অভ্রান্ত পথনির্দেশ করেছে। একথা বললে কোনরকম অত্যুক্তি ও করা হবেনা যে সামান্য যে কিছু লেখা আমার দ্বারা সম্ভব হয়েছে রাঙাকাকার সময়োপযোগী অভিভাবকত্ব না থাকলে তার কিছুই হয়তো সম্ভব হতনা। শব্দের (বাংলা ও ইংরেজি) উৎপত্তি সম্পর্কে আমার যা কিছু অনুরাগ এবং চর্চা তা সবকিছুই রাঙাকাকার অনুপ্রেরণায়। ছোটদের জন্য শব্দ সংক্রান্ত একটি লেখা তৈরি করতে গিয়ে  মুখ্য চরিত্রটির নাম  যে রাঙাদাদু হয়ে গিয়েছিল তার কারণ খুবই সহজবোধ্য। শুধু সাহিত্য নয় - সিনেমা, নাটক, জাতির চরিত্র, রাজনীতি, ইতিহাস, দেশ-বিদেশ এবং সাহিত্যের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক - বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হত আমাদের। রাঙাকাকা বলতেন - “তোর সঙ্গে ফোনে কথা বলে আনন্দ ও হয়, আবার খুব উত্তেজিতও হয়ে পড়ি। আসলে এখন এসব ব্যাপারে কথা বলার লোক এত কমে গেছে !”

সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছি যে আলোচনাগুলোতে তা হল শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। ইন্দো-ইউরোপীয় বলে যে একটা তত্ত্ব আছে তা রাঙাকাকার কাছেই প্রথম শুনি। একবার গল্পচ্ছলে রাঙাকাকা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি “Genuflect” শব্দটির মানে জানি কিনা। কপালগুণে আমি জানতাম, বললাম,
-      এটা হল সারেন্ডার বা আত্মসমর্পণ।
-       দেখ, আত্মসমর্পণ করে কিভাবে, - নত ‘জানু’ হয়ে, হাঁটু মুড়ে। এখানে “Genu” কথাটা কিন্তু একেবারে বাংলা বা সংস্কৃত জানু! “Flect” মানে তো জানিস, - ঘোরানো বা মুড়ে ফেলা – Reflect, Deflect, Flexible – সব শব্দগুলোই তো তার থেকে উদ্ভূত।

এর আগে আমি কিছু কিছু ইংরেজি ভোক্যাবুলারির বই পড়েছিলাম। তার ওপর এই অদ্ভুত পথনির্দেশ আরো একমাত্রা যোগ করল।

এরপরেতে রাঙাকাকা আমাকে আর একটা দারুণ ব্যাপার শিখিয়ে দিলেন। বাংলা ভাষায় যে বর্গপ্রথা (ক, চ, ত, ট, প) আছে তার কিরকম ভাবে প্রভাব পড়েছে ইংরেজি শব্দের ওপর। বলেছিলেন –
-      আচ্ছা, তুই ‘Pyre’ নিশ্চয় জানিস?
-       হ্যাঁ, ‘Funeral Pyre’ মানে শবদেহে আগুন দেওয়া – আর আমাদের তো “Pyrometer” বলে একটা যন্ত্র আছে,  “a type of remote-sensing thermometer used to measure the temperature of a surface”  !!
-       আচ্ছা, এত জানিস কিন্তু –তোর মনে হয়নি – ইংরেজি “Fire” এর খুব কাছে ‘Pyre’ কথাটা!

আমি এক্কেবারে চমকে উঠেছিলাম,
-      আরে তাই তো, বুঝিয়ে বল।
-       দেখ, ‘প’ আর ‘’ফ’ একই বর্গের পাশাপাশি দুটি বর্ণ, কাজেই ল্যাটিন থেকে ইংরেজিতে আসার  সময় “পায়ার” হয়ে গেল “ফায়ার” !!
-       দারুণ তো !! এরকম আরো আছে নাকি?
-       নিশ্চয় – “Pisces” – “Fishes”   “Podo” – “Feet” – এখানে দেখবি আবার “ড” থেকে “ট” হয়ে গেল।

এই শিক্ষা আমার দারুণ কাজে লেগেছিল। আমাকে রাঙাকাকা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “উপসর্গের অর্থবিচার” বলে একটা দারুণ বইয়ের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আমার জীবনে এই লেখাগুলি খুব বড় অবদান রেখে গেছে।      

সত্যজিৎ রায়ের খুব ভক্ত হলেও “গণশত্রু” রাঙাকাকার ভালো লাগেনি, কারণ শেষে জনতার যোগদান রাঙাকাকার মনে হয়েছিল এটি ইবসেনের মূল কাহিনীতে যে ‘একলা চলো রে’ মন্ত্র, তার পরিপন্থী। এটাও জানিয়েছিলেন যে শম্ভু মিত্র যখন একই কাহিনী অবলম্বনে “দশচক্র” নাটক করেন তিনি কিন্তু এই বিচ্যুতি করেননি। একটি প্রবন্ধও লিখে ফেলেছিলেন, পড়ে রীতিমত ঋদ্ধ হয়েছিলাম। এই সুবাদে ইবসেন এর সম্পর্কেও আমার বেশ জ্ঞানলাভ হয়েছিল। জানতে পেরেছিলাম “ডলস হাউস” লিখে কি বিপত্তিতে পড়েছিলেন ইবসেন, এমনকি চাপে পড়ে, বাধ্য হয়ে তাঁকে অন্য একটি যবনিকাও লিখতে হয়, যেখানে নোরা স্বামীগৃহে ফিরে আসবে।

রাঙাকাকার জীবনে প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ। এই জায়গাতে এক্কেবারে কোনরকম সমালোচনা চলবে না! সেটা নিয়েই আমার সঙ্গে বেশ কিছু তর্ক হত। পরবর্তীকালে একটি কথা শুনেছিলাম, “টেগোরাইটিস” এ আক্রান্ত মানুষ। রাঙাকাকা ছিলেন তার এক অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ।  বলতেন রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর কাছে খুব হেয় হয়েছিলেন, রাণী চন্দের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন,-  ‘লিখেছিলাম ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে” – ভুল করেছিলাম! মরার আগে কেটে দিয়ে যাবো’। আমি মেনে নিতে পারিনি – বলেছিলাম সেটা ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথের অন্য যাঁরা অনুগামী, তাঁদের কাছে তো এরকম কিছু শোনা যায় না। আর রবীন্দ্রনাথকে তেমনি তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের লেখকেরা খুব সম্মান দিয়েছেন। শরৎবাবুর বিখ্যাত উক্তি – ‘রবীন্দ্রনাথ লেখেন আমাদের জন্য’ তো খুব পরিচিত।  বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রও তো সেরকম স্বীকৃতি পাননি, পরাধীন দেশে জন্মেছিলেন বলে। এই নিয়ে আমাদের প্রচুর তর্ক বিতর্ক হত। সেই সময় এক লেখক রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীকে নিয়ে বেশ কিছু কেচ্ছা কাহিনী লিখে বাজার মাত করছিলেন। রাঙাকাকার রাগ আরো বেড়ে গিয়েছিল দেশবাসীর ওপর, যারা এগুলো কিনছে আর পড়ছে, কোন প্রতিবাদ করছে না।

শেষবার যখন কথা বললাম - শরীর অসুস্থ থাকার জন্য বেশী কথা হয়নি। প্রত্যেকবার শীতের প্রকোপ রাঙাকাকাকে খুবই কাবু করে ফেলত - আমাকে বলেই বসতেন - “বুঝতে পারছি না রে, এই শীত টা আর কাটিয়ে উঠতে পারবো কিনা”।

আমি খুব ধমক দিয়ে বলতাম  - “তোমাকে আমার এখনো অনেক দরকার আছে, ওসব কথা ভুলে যাও”।

আমার ছেলের দু-তিনটি লেখা পড়েও রাঙাকাকা খুব সুচিন্তিত মতামত দিয়েছিল, এমনকি প্রকাশনার জন্য উপযুক্ত জায়গার সন্ধান সমেত। সেই সঙ্গে অবশ্য সরস মন্তব্যও ছিল -“হ্যাঁ রে, তোর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাহলে তো অনেকদিন বেঁচে আছি”।

কত কথা যে বলার, কিন্তু এবার দাঁড়ি টানার পালা। আমার ও রাঙাকাকার বিভিন্ন আলোচনার সিংহ ভাগ জুড়ে ছিলেন যিনি সেই রবীন্দ্রনাথের কথা তো একটু আসবেই। তাঁর সাহায্য নিয়েই বলি – রাঙাকাকা, পরবর্তী  প্রজন্মের কাছে তোমার লেখা রয়ে গেল -

“কিন্তু যারা পেয়েছিল প্রত্যক্ষ তোমায়
অনুক্ষণ তারা যা হারাল তার সন্ধান কোথায়, কোথায় সান্ত্বনা?”


ঘরের শিক্ষা - সেজমামা

---১৪---

শৈশব খুব আনন্দেই কেটেছিল। যৌথ পরিবার হওয়ার সূত্রে মামা-মাসীদের সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। আমরা জানতাম আমাদের এক মামা বোম্বেতে ফিল্মের কাজে যুক্ত। মাঝে মাঝে তিনি কলকাতায় এলে আমাদের রাজপুরের বাড়ীতে আসতেন। প্রথম উজ্জ্বল স্মৃতি যেটি সেটি হল, গুড্ডি সিনেমা দেখতে গিয়ে, একটি খুবই ছোট দৃশ্যে তাঁকে দেখে। আমাদের একজন পরিচিত মানুষ, তিনি কিনা সিনেমার পর্দায়!! সে এক অদ্ভুত শিহরণ।

তারপর মাঝে মাঝে  সেজমামা আসতেন। আমরা সেজমামার গলায় রেডিওতে বিজ্ঞাপনের গানও শুনেছিলাম – সম্ভবত: ‘গ্লাইকোডিন’! মাঝে মাঝে এলে একটু আধটু আলোচনা ও হত সিনেমা নিয়ে। সেজমামার বাংলা দুটি ছবি,  দেবিকা বা আর একটি সম্পর্কে অবশ্য বিশেষ কথা হয়নি। ‘কবিতা, ছবিটি সম্পর্কে সেজমামা জানিয়েছিলেন ঐ ছবির পরিচালনাতে ওনার ভূমিকা ছিল।

সত্তরের শেষ বা আশির দশকের গোড়ার কথা। যাদবপুরে পড়ছি আর ততদিনে আমরা সলিল চৌধুরীর গানের বেশ ভক্ত হয়ে গেছি। হেমন্ত, শ্যামল বা মান্নার কণ্ঠে অনেক গান শুনে ফেলেছি। পুজোতে রিলিজ হওয়া  লতা মঙ্গেশকরের অজস্র গান আমাদের মন-প্রাণ জুড়ে আছে। এই সময় হঠাৎ ই মুক্তি পেল সলিল চৌধুরীর স্বকন্ঠে গীত একটি সম্পূর্ণ অন্যধারার গান – “এই ... রোকো! পৃথিবীর গাড়ীটা থামাও”!!

মনে রাখতে হবে, এই সময় কিন্তু বাংলা গানের সেইরকম কোন বিবর্তন হয়নি। কাজেই বেশ বিক্ষুব্ধই ছিলাম। এই সময় একদিন সেজমামা আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, -‘আচ্ছা, তোমার এই গানটা অদ্ভুত লাগেনি! এর কি মানে- “আমার স্বপ্নভরা, এই কুলি, লাগেজ নামাও”!! আবার তার ওপর কি দরকার ছিল নিজের গলাতে গান গাওয়ার!’

সেজমামা বললেন –‘আচ্ছা, চট করে বলতো ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে’ এর মানে কি?”

তখন এত পড়াশুনা ছিল না। কাজেই সেইভাবে জবাব দিতে পারিনি।

সেজমামা দুটো কথা বলেছিলেন – ‘এই গানটা সম্পর্কে পুলকের (বন্দ্যোপাধ্যায়) লেখা চিঠি আমি সলিলদার কাছে দেখে এসেছি, - লিখেছেন –‘সলিলদা, কি অপূর্ব লিখেছেন, আমি আসছি আপনার পায়ের ধুলো নিতে।’ পরে বুঝতে পারবে এই গানের তাৎপর্য। আর  নিজের গলায়, -এই গানের জন্য যে গায়নরীতির প্রয়োজন তা সলিলদা ছাড়া একজনেরই আছে, সেও ঠিক গায়ক নয়, ‘পঞ্চম’!! সলিলদা ঠিকই করেছেন নিজের গলায় গেয়ে”!!  

পরবর্তী কালে এই গান নিয়ে বহু আলোচনা শুনেছি এবং ধারাবাহিক ভাবে সেজমামার সেই বক্তব্যের সঙ্গে বিভিন্ন গুণীজনের বক্তব্য  অদ্ভুত ভাবে মিলে গেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিক ভাবে স্মৃতিকথা লিখছিলেন – “কথায় কথায় রাত কেটে যায়”!! এইখানে দেখেছিলাম, পুলক ঐ গানটি সম্পর্কে চিঠি লিখে সলিলকে তাঁর মুগ্ধতার কথা জানানোর উল্লেখ করেছেন। কাজেই যখন উপরোক্ত চিঠির ঘটনাটি আনন্দলোকে পড়ি, বেশ কলার নেড়ে স্ত্রীকে বলেছিলাম, -‘এটা আমি আগেই সেজমামার কাছে শুনেছিলাম।’

              মাঝে আবার অনেকদিনের বিরতি। ব্যাঙ্গালোর চলে আসার পর আমি যখন বিভিন্ন ছুটি ছাটায় কলকাতায় যেতাম, তখন সেভাবে দেখা সাক্ষাৎ এর সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি সেজমামা জয়নগরে স্থায়ীভাবে থাকার পর ফোনে খুব আবার যোগাযোগ হত। বিগত দু বছরে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, সলিল তো ছিলেনই, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল, তপন, এই চিত্র পরিচালকরা ছাড়া হেমাঙ্গ, নির্মলেন্দু, হেমন্ত, শ্যামল, দ্বিজেন – গণনাট্যের সব উজ্জ্বল তারকারাই সেই আলোচনাতে এসে গিয়েছিলেন। নৈহাটিতে গণনাট্য শাখার প্রতিষ্ঠা সদস্যের নাম শ্যামল মিত্র, এই তথ্য সেজমামার কাছেই জানা।  সেজমামারই উদ্যোগে আমার দুটি লেখা ‘আলোর পথযাত্রী’ ‘গণনাট্য’ পত্রিকাতে ও ‘রবিকরে জ্বালাতন’ ‘মিলেমিশে’ পত্রিকাতে বার হয়।

              অনেক গল্পই হয়েছিল সলিল চৌধুরীকে নিয়ে – আমি মজা করে বলতাম – ‘তুমি যতই সলিলদা বল একটা ব্যাপারে আমি তোমার চাইতে এগিয়ে, সলিল চৌধুরী আর আমি এক স্কুল থেকে ম্যাট্রিক আর মাধ্যমিক দিয়েছি।’

সেজমামা হেসে বলতেন, -‘এটা ভালো বলেছিস, সত্যিই তো!!’

একদিন কথা হচ্ছিল-‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’ গানটি নিয়ে। আমি বলেছিলাম – দেখ ‘মোহিনী চৌধুরীর ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখোনা বেঁধে আমায়’ গানের যেন প্রত্যুত্তর – ‘ওগো প্রিয় মোর, খোল বাহুডোর, পৃথিবী আমারে যে চায়’।

সেজমামা বলছিলেন – ‘হ্যাঁ, দুজনেই তো কাছাকাছির মানুষ। মোহিনী চৌধুরী একবার আমাকে বলেছিলেন –‘এই সলিল ছেলেটি বড় ভাল লেখে, একবার নিয়ে এস আমার কাছে, সেটা আর সম্ভবত: হয়ে ওঠেনি’।

আর একদিন আমি বলছিলাম- আচ্ছা, ‘আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে’ – এই গানটার শুরুটা ধরলে মনে হয় না যেন অন্য গানের চেয়ে একটু অন্যরকম! কিরকম হাল্কা ভাবে শুরু হয়ে অদ্ভুত গভীরতায় পৌঁছে যাচ্ছে –  “শরতের কোন এক নাম না জানা গাঁয়, শিউলি ফুল যেথায় ঝরে ঝরে যায়। কিশোরী মনের মত দু'টি চোখে অবনত” - 

সেজমামা বলছিলেন, -“ ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ সিনেমাতে এ একজন ‘Usher’ ছিল, মনে আছে – যে যাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। এখানেও সলিলদার ভূমিকাটা সেইরকম, আস্তে করে হাত ধরে পৌঁছে দিচ্ছেন একেবারে অন্য উচ্চতায়।” অনবদ্য গান, অসাধারণ ভাষ্য!!

অসম্ভব ভক্ত ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের। এমনকি ‘গণশত্রু’ দেখে রাঙাকাকা অসম্ভব হতাশ হয়েছিলেন, কারণ শেষে সত্যজিৎ ইবসেন এর থেকে সরে গিয়ে ডাক্তার এর পাশে জনগণকে দাঁড় করিয়েছিলেন। আগেই লিখেছি সে কথা। কিন্তু সেজমামা বলেছিলেন, ওনার মনে হয়েছে, না ওটাই ঠিক!! কারণ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই আরো বেশী সংখ্যক মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। আগে আমার ধারণা ছিল, সত্যজিৎ রায়ের চেয়ে সেজমামা নিশ্চয়ই ঋত্বিক ঘটকের বেশী ভক্ত হবেন, কিন্তু দেখলাম ঠিক উল্টো। 

গুলজার সম্পর্কেও বেশ কথা হয়েছিল। আমি গুলজারের অনুরাগী পবন ঝা কে মেল করে সেজমামার মোবাইল নাম্বার দিয়ে জানিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ একদিন সেজমামার উত্তেজিত ফোন – ‘তুই কি গুলজারকে আমার কথা জানিয়েছিলি? আমি ‘হ্যাঁ’ বলাতে খুব খুশী হয়ে বললেন, আমাকে ফোন করে প্রায় আধঘণ্টা কথা বলেছেন।’ মনে পড়ে, একবার অনেক বছর আগে সেজমামার কাছেই জেনেছিলাম যে আনন্দের বিখ্যাত গান “ম্যয়নে তেরে লিয়ে” এর এক বাংলা পূর্বসূরি ছিল – ‘শুধু তোমার জন্য সুর তাল আর গান বেঁধেছি, এর আর কোন নেই প্রয়োজন”! গুলজার খুব সুন্দর করে ভাবানুবাদ করে দিয়েছিলেন।

তবে সেজমামা জানিয়েছিলেন হিন্দি যে গীতিকার একেবারে সলিল চৌধুরীর কাছের মানুষ ছিলেন, তিনি হলেন যোগেশ। সলিল চৌধুরীর আনন্দের সেই বিখ্যাত গান ‘কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’ এর কথাও জানিয়েছিলেন যে গান দিয়ে যোগেশের খ্যাতির শুরু।

সেজমামা আর একটি ভাল কাজ করে গেছেন, ‘কাদম্বরী’ কে নিয়ে লিখে, ‘মিলেমিশে’ থেকে প্রকাশিত। লেখাটি আমি খসড়া পড়লেও বইটা সংগ্রহ করতে পারিনি। কারুকে দিয়ে আনিয়ে নেব। বাজারী বইয়ের চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। এখন যে ভাবে চলছে তাতে এইরকম বইয়ের খুবই দরকার।

একটা বড় দুঃখ রয়ে গেল। ‘অবসর’ এর জন্য সেজমামাকে একটা ধারাবাহিক স্মৃতিচারণা লেখার কথা পরিকল্পনা করেছিলাম, সেজমামা কথাও দিয়েছিলেন, বিষয়ও মোটামুটি ভেবে রেখেছিলাম। বোম্বের ফিল্ম- জগতে যে সব উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁদের সম্পর্কে কথাবার্তা আর স্মৃতিচারণ। এদের মধ্যে থাকবেন, বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখার্জী, সলিল চৌধুরী, গুলজার, রাজেশ খান্না, বাসু চ্যাটার্জী, আর ডি, এস ডি বর্মন প্রমুখ। ভেবেছিলাম মধুমতীর চিত্রনাট্য যখন ঋত্বিক ঘটক লিখছিলেন সেই ঘটনার কিছু স্মৃতিও আসবে। ‘পঞ্চাশোর্ধে’ তে ‘হৃষীকেশ মুখার্জী অধ্যায়ে নারায়ণ সান্যাল সেজমামার কথা লিখেছিলেন। সেই প্রসঙ্গও নিয়ে আসবো। কিন্তু সেটা আর হল না। আর বছর-খানেক সময় পেলে হয়ে যেত। সেজমামা যদিও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, আমার আশা ছিল। আমাদের প্রধান সম্পাদক সুজন দাশগুপ্তর সঙ্গে কথাও বলে রেখেছিলাম। মা কে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম ২০১৫ তে। ফেব্রুয়ারি মাসে মা চলে গেলেন, তার কিছুদিন পরেই সেজমামাও। ধারাবাহিক প্রকাশের আর ‘অবসর’ পাওয়া হল না।


লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।