বিবিধ প্রসঙ্গ

এপ্রিল ১৫, ২০১৬
যাঁদের আমি ছাত্র
ভাস্কর বসু
‘বাহিরে’ শিক্ষা - সুমিতবাবু
---১৫---
রবীন্দ্রসঙ্গীত তো ছোটবেলা থেকেই শুনছি। ভালো ও লাগে। আমাদের বাড়ীতে ঐ গানেরই চল ছিল বেশী। ষাটের দশকে আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন সদ্য সদ্য রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীর কল্যাণে আবার রবীন্দ্রনাথের পুনরুত্থান হয়েছে। আমাদের সময় বাড়িতে হিন্দি গান একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। শুধুই বাংলা গান। রেকর্ড ও ছিল বাংলা গানেরই, বেশীর ভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীতের।
পরবর্তী কালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধুর্য আরো বুঝতে পেরেছি, আরো গভীরে গিয়ে চেষ্টা করেছি একটু অনুসন্ধান করতে। আসলে আমাদের প্রবাসী ক্লাবের বিভিন্ন সাঙ্গীতিক অনুষ্ঠানে ভাষ্য রচনার দায়িত্ব থাকত আমার ওপর। সেই কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে আরো একটু পঠন পাঠনের প্রয়োজন পড়ত।
এরকমই এক সময়, একটি গানে দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যদের গানের বাণীর তফাৎ চোখে পড়ল। দেবব্রত গাইছেন “সকল স্বপন” আর অন্যরা গাইছেন, “সফল স্বপন”। নিজেও একটু ভেবে দেখলাম। কিন্তু রবীন্দ্র রচনাবলীতে ও পেলাম “সফল” কথাটি। ইতিমধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলীর একটি ইন্টারনেট সংস্করণ ও বার হয়েছে - http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/। তাতেও ঐ “সফল” আছে। কিন্তু সেখানে লেখা ছিল যে ভুল দেখলে সংশোধনের জন্য লেখা যেতে পারে। আমিও তাই একটি ইমেইল ছেড়ে দিলাম, আমার মত জানিয়ে –
“যদিও গীতবিতানে আছে, "মম দু:খবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম\" - কিন্তু সম্ভবত: \"সফল\" এর জায়গায় \"সকল" হওয়া উচিত! রবীন্দ্র গবেষকদের মতামত নেওয়া যেতে পারে!”
সঙ্গে রেফারেন্স হিসেবে পাঠিয়েছিলাম আমার ভাবনা চিন্তা আর দেবব্রতর যাবতীয় যুক্তি (ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত)। আমার বক্তব্য শুনে ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক শ্রী অনুপম বসু লিখলেন,
“ঠিক! আপনার এই reference এর পরে ভরসা পাচ্ছি রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যেতে”।
এরপরেতে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। তারপর জবাব এল সুমিত রায়, এক আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোকের কাছ থেকে। উনি জানিয়েছিলেন, “রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আপনার গভীর চিন্তার জন্য সাধুবাদ জানাই” – সেটা আমার খুব বড় প্রাপ্তি মনে হয়েছিল। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়। ২০১৩ সালের মে মাসের কবিপক্ষে উনি আমার সঙ্গে ওঁর আলোচনা ওয়েবসাইটে ও নথিভুক্ত করেন। এ ছিল আমার কাছে এক বড় প্রাপ্তি। আগ্রহী পাঠক সেই আলোচনা দেখতে পারেন- http://gitabitan.net/top.asp?songid=342
সেই শুরু। ধীরে ধীরে জানলাম, ওনার সৃষ্ট বিশাল ওয়েবসাইটটি সম্পর্কে – www.gitabitan.net ! জানতে পারলাম বহু অজানা তথ্য ও আরো বহু বইয়ের নাম।
এরপর আবার একটি গানে সংশয় জাগে – “বাহিরে ভুল ভাঙবে” না – “বাহিরে ভুল হানবে”!! আবার সুমিতবাবুকে পত্রাঘাত, উনি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করলেন – বিস্তারিত গানের আলোচনা করে মূল যা বলেছিলেন তা হল-
---- "সুপ্রযুক্তি"র ব্যাপারে দুটি দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। "অরূপরতন"-এ সুরঙ্গমা একা গাইছে ("হানবে"), সেখানে "তুমি" হচ্ছেন রাজা আর "সে" হচ্ছেন অনুপস্থিত সুদর্শনা, যিনি এখুনি এসে জুয়াড়ি সুবর্ণকে রাজা বলার ভুল করবেন এবং সে ভুলের অশুভ আঘাত হবে দূরপ্রসারী। সুরঙ্গমার প্রশ্ন এই যে বাইরের জগত্ থেকে এই ভুল যখন সুদর্শনাকে আঘাত "হানবে" তখন কি তার অন্তরের ভুল (রাজাকে সুন্দর দেখতে চাওয়া ইত্যাদি) ভেঙে যাবে।
পরিমার্জিত "শাপমোচন"-এ গানটি রাজা স্বয়ং গাইছেন মহিষীকে শুনিয়ে। মহিষীর জেদে রাজাকে স্বরূপ প্রকাশ করতে হবে, এবং মহিষী এতক্ষণ কুশ্রী নর্তকের ওপর চটে যাবার যে ভুলটি করছিলেন সেটি ভাঙবে, কারণ সেই নর্তকই রাজা। রাজা প্রশ্ন করছেন যে সে ভুল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে বহিরঙ্গের সৌন্দর্যে ভুলে থাকার যে ভুলটি বাসা বেঁধে আছে মহিষীর মনে, সে ভুলটিও কি ভাঙবে? অবশ্যই না, এবং "অরূপরতন"-এর রূপক প্রশ্নের থেকে এই সরাসরি প্রশ্নটি আরো মর্মন্তুদ । শাপমোচন পরিমার্জনের সময় রবীন্দ্রনাথ এই পার্থক্যটি লক্ষ্য করেন ও গানটিকে বদলান। একটু খেয়াল করলে গানটির দুটি রূপে আরো কিছু প্রভেদ দেখতে পাবেন।
আরো লিখেছিলেন,-
“শুধু সংখ্যা গুণে, কিন্তু বিশেষ করে ওপরের ৫নং তথ্যের সাক্ষ্য দেখে আমার মতে গান হিসেবে দেখলে "হানবে"-টাকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। নাটকের প্রয়োজনে "শাপমোচন" নাটকে কবি সেটির পরিবর্তন করেছিলেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সামান্য একটি কথার পরিবর্তন করে অন্তর্নিহিত ভাবটিতে কি বিরাট পরিবর্তন কবি অনায়াসে এনে দিলেন তা দেখেই আমরা মুগ্ধ!” http://gitabitan.net/top.asp?songid=229)
এ যাবৎ আমি কোন গানের এত গভীর ও বিস্তারিত আলোচনা পাইনি। বিষটি আমার খুবই প্রিয়, কাজেই এই ব্যাপারে একজন এইরকম শিক্ষক পাওয়ার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছিলাম।
উনি আমার লেখা সংক্রান্ত ব্যাপারে জানতে চাইলে খুব সঙ্কোচের সঙ্গেই আমার দু তিনটি লেখা পাঠালাম। আসলে এই লেখাগুলি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে লেখা, তার পিছনে কিছু ভাবনা চিন্তা থাকলেও সেরকম গভীর পড়াশুনো ছিলনা। লেখাগুলি ছিল রবিঠাকুরের গান, সলিল চৌধুরী ও সুধীন দাশগুপ্তের গানের ওপর। লেখাগুলি আমাদের স্থানীয় পুজোর স্যুভেনিরে প্রকাশ হয়েছিল কিন্তু ব্যস ঐ পর্যন্তই।
গীতিকার সুধীন দাশগুপ্তের ওপর “সুরে ঢাকা কথা” লেখা পড়ে উনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটি (গীতিকার সুধীন) ওনারও সেরকম ভাবে নজরে আসেনি।
সুমিত বাবুর সূত্রেই পরিচয় হল সুজন দাশগুপ্ত ও তাঁর “অবসর” পত্রিকার সঙ্গে। খুলে গেল আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায়। প্রসঙ্গত অনেকদিন অবধি আমি জানতাম না যে উনি বিকাশ রায়ের ছেলে, সুজনদার কাছেই পরে জেনেছি।
আমার কাকা বিকাশ বসু ছিলেন অতীব রবীন্দ্র মনোভাবাপন্ন মানুষ। আগেই লিখেছি তাঁর কথা। ওঁর সম্পর্কে এসে আমিও বিভিন্নভাবে আবিষ্কার করেছি রবিঠাকুরকে। তাই আমার বিভিন্ন লেখাতে কিছু না কিছু ভাবে “ঠাকুরমশাই” টুক করে ঢুকে পড়েন। আমার লেখাগুলি পড়ে সুমিতবাবুর খুশী হওয়ার আরো কারণ ছিল যে উনি ধরেছিলেন যে ওঁর মত আমিও “টেগোরাইটিস” এ রীতিমত আক্রান্ত।
সুজনদার অনুপ্রেরণাতে প্রথম সম্পাদনা করলাম অবসর এর একটি বিশেষ রবীন্দ্র সংখ্যা। যথারীতি সুমিতবাবু কে অনুরোধ করে একটি লেখা যোগাড় করলাম। নামের শীর্ষক সম্পর্কে আমার মতামত উনি সানন্দে মেনে নিলেন। এটা আমাকে খুব বড় আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল।
এখন কোনরকম রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে প্রশ্ন এলে – সেই বিখ্যাত বাংলা প্রবাদবাক্যটি মনে পড়ে – “হাতে পাঁজি, মঙ্গলবার?” কাজেই পরবর্তী সময়েও যখন কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, নির্দ্বিধায় ওনার দুয়ারে পৌঁছে গেছি এবং কাঙ্ক্ষিত উত্তরও পেয়ে গেছি।
এছাড়াও “অবসর” এ ওঁর বিভিন্ন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। ‘পরশুরাম’ সংক্রান্ত লেখাটি তো রীতিমতো গবেষণামূলক। ওনেক কিছু ভাবার জায়গা আছে। আমাদের অতিথি সম্পাদনায় প্রকাশিত দুটি বিশেষ সংখ্যাতে উনি ‘শরদিন্দু’ এবং ‘রেডিও’র ওপর দুটি চমৎকার লেখা দিয়ে ছিলেন। শরদিন্দুর ওপর লেখাটি পড়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শেখর বসু মন্তব্য করেছেন,
“যাঁরা খুঁটিতে শরদিন্দু পড়তে চান, তাঁরা সহায়ক-নিবন্ধ হিসাবে সুমিত রায়ের এই অনবদ্য লেখাটিক পাশে রেখে দিতে পারেন।”
চলতে থাকছি আরো অনেক পাওয়ার প্রত্যাশায়!
‘বাহিরে’ শিক্ষা - শেখরবাবু
---১৬---
আমাদের সময় কিশোর সাহিত্যের রমরমা ছিল। সত্যজিৎ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, বিমল কর, শৈলেন ঘোষ, নবনীতা দেবসেন, সব্বাই এক্কেবারে জমিয়ে লিখছেন। এই সময় একটি আনন্দমেলাতে একটি অদ্ভুত ছোটদের গল্প পড়লাম – “ঘুমের ওষুধ”!!
গল্পটি ভারী মজার!! ছোট করে বলছি।
একটি বাচ্চা ছেলের আঙুল না চুষলে ঘুম আসে না। তার মা তাকে বারবার বদ অভ্যাসটি ছাড়ানোর চেষ্টা করেও অসফল। একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে ছেলেটি দেখে মা র ঘুম আসছে না!! মা খুব বিরক্ত। ছেলেটি তখন মাকে পরামর্শ দেয় আঙুল চুষে ঘুম আনানোর চেষ্টা করতে। মা তো রেগে আগুন! কিন্তু ছেলের পীড়াপীড়িতে চেষ্টা করতেই, আশ্চর্য ফল!! সঙ্গে সঙ্গে মার দুচোখে ঘুম নেমে এল। পরদিন রাত্রে ছেলেটি ঘুম ভেঙে এক দৃশ্য দেখে হতবাক –বাবার ও ঘুম আসছে না, অথচ পরের দিন জরুরী কাজ। আর মা বাবাকে আঙুল চুষে ঘুম আনানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। তারপর শেষ অবধি বাবা মার কথাতে রাজী হলেন। ছেলে বেশ জোরে আঙুল চোষার শব্দ পেল এবং তারপরেই বাবার নাক ডাকার শব্দ। এবারে মার খুব লাজুক আঙুল চোষার শব্দ ও ঘুম। নিশ্চিন্ত মনে ছেলেটিও আস্তে আস্তে আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়ল।
লেখকের নাম – শ্রী শেখর বসু। এরপরেও ওঁর বেশ কিছু গল্প পড়েছি, পড়ে ফেলেছি একটি টানটান থ্রিলার, “সোনার বিস্কুট” – আনন্দমেলাতেই।
পরের দিকে, দেশ পত্রিকা, তা পাক্ষিক ই হোক বা শারদীয়াই হোক, তাতে ছোটো গল্প পড়তে যে তিন জনের লেখা পড়তে বরাবর ভালো লাগতো, বা সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম, তাঁরা হলেন, ইন্দ্র মিত্র, রমানাথ রায়, শেখর বসু।
শেখর বসুর অনেক গল্পই ভালো লাগে, একটি গল্প খুব মন কেড়েছিল – “শুধুই টিভি”!! সেই নব্বইয়ের দশকে টিভি বাড়ীতে ঢোকার ফলে লোক-লৌকিকতা প্রায় উঠে গেল। লোকে কারুর বাড়ী যেতে ভয় পায়, কারণ টিভি দেখার সমস্যা হতে পারে। তখন এক দম্পতি ঠিক করল তাদের ছেলে মেয়ে কে নিয়ে শনিবার করে এক এক আত্মীয়র বাড়ি যাবে। যাওয়া শুরু করে দিল,- কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, শনিবার সেই সময় সব আত্মীয়রাও সিরিয়াল দেখছে। সিরিয়ালটি আবার রহস্য কাহিনী নির্ভর। তখনকার প্রচলিত ছিল ১৩টি পর্ব, - সেই যে ‘তেরো পার্বণ’ এর মত। একে একে তাদের ১৩জন আত্মীয়র বাড়ীতে যাওয়া হয়ে গেল। আর ধীরে ধীরে সেই দম্পতি ও ছেলেমেয়েরা আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়েও শেষমেশ অতিথি আর গৃহকর্তারা সিরিয়ালই দেখল। যুগ পরিবর্তনের এক অদ্ভুত সুন্দর, মনকাড়া ছবি ফুটে উঠেছিল গল্পটিতে।
আমার এক স্বভাব, ইন্টারনেটে বাংলা সাহিত্যিকদের খোঁজ করা। সেভাবে হঠাৎ করেই শেখর বসুর খোঁজ পেলাম, পেলাম ফেসবুক প্রোফাইল। অনুরোধ পাঠালাম, গৃহীত ও হল। এই সময় হঠাৎ করে মারা যান ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঋতুপর্ণর ছায়াসঙ্গী দিলীপের কিছু ঘটনার উল্লেখ থেকে আমার ওঁর লেখা একটি গল্পের কথা মনে পড়েছিল। - “সময়ের আগে”!! সেটা ওঁকে জানাতে খুব খুশী হয়ে বলেছিলেন – “বাঃ, আপনি তো বেশ মনোযোগী পাঠক!” এবার সাহস করে ফোন করে ফেললাম। কথা বলে খুব ভালো লাগলো।
গত আড়াই বছরে সেই আলাপ আরো জমে উঠেছে। ওনার সাহিত্য জ্ঞানে আমি ই বেশী লাভবান হয়েছি। আমার অনুরোধে “অবসর” এর বিশেষ সংখ্যাতে ও উনি বেশ কটি বিশেষ লেখা করে দিয়েছেন, তাও আবার একেবারে ইউনিকোডেই। বিশেষ পুজো সংখ্যাটি বার করার আগে ওঁকে অনুরোধ করেছিলাম, নিজের প্রথম শারদীয়াতে লেখার কিছু অভিজ্ঞতা যদি লেখেন। উনি দিয়েছিলেন একটি সুন্দর লেখা! এই লেখা পাঠানোর সময় উনি লিখেছিলেন,
“প্রিয়বরেষু, আপনি স্মৃতির চাকে ঢিল মেরেছেন। ভেবেছিলাম দু-কথায় সারব, কিন্তু একটু বোধহয় বড়ই হয়ে গেল। প্রাসঙ্গিক বলে প্রথম উপন্যাসের প্রচ্ছদচিত্রটিও পাঠালাম। প্রয়োজন বুঝলে ব্যবহার করতে পারেন।”
খুব আনন্দ হয়েছিল। সে বছরই আমার কাকা বিকাশ বসু চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। আমার খুব বেশীমাত্রায় সাহ্যিত্যের একজন পথপ্রদর্শক এর দরকার ছিল। সেটা পূর্ণ হল। কিছু পরামর্শের দরকার হলেই ফোন এবং বিস্তারিত আলোচনা। উনি কিছুমাত্র বিরক্ত না হয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দেন।
অনেক দিন থেকে ইচ্ছে ছিল মুখোমুখি বসে কথা বলার। ২০১৫তে ব্যাঙ্গালোর থেকে ছদিনের ঝটিকা সফরে তা হয়েই গেল। বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা হল, যেমন টেলিফোনে মাঝে মাঝে হয়। তবে এবারের আলোচনাতে আমার খুব প্রিয় দুই বাঙালী পরিচালকের সম্পর্কে দুটি ঘটনা জানতে পেরে মন ভরে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে একটু সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই-
শেখরবাবু তখন আনন্দমেলাতে কর্মরত। এবার ওনার ভাষাতেই বলি:
“তখন আমি ‘আনন্দমেলা’য় কাজ করি , সম্পাদক ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সেই সময় আনন্দমেলায় একটি রেওয়াজ ছিল—লেখা যত প্রতিষ্ঠিত লেখকেরই হোক না কেন, সেই লেখা আদ্যোপান্ত পড়ার পরেই প্রেসে পাঠানো হবে। লেখকের অনবধানে কোথাও কোনও ছাড় বা মৃদু অসঙ্গতি থাকলে সংশ্লিষ্ট লেখকের সঙ্গে কথা বলে তা ঠিক করে নেওয়া হত। শারদীয় আনন্দমেলায় সেরা আকর্ষণ ছিল সত্যজিৎ রায়ের উপন্যাস। সেবার ওঁর উপন্যাসটি হাতে আসামাত্র সম্পাদক আমাকে দিলেন। আমি পড়ে প্রেসে পাঠালাম। এর একদিন পরেই একটি কাজে আমাকে সত্যজিতের কাছে যেতে হয়েছিল। বিশপ লেফরয় রোডের সেই বিশাল ফ্ল্যাট। বইপত্তরে ঠাসা মস্ত ঘরে জীবন্ত কিংবদন্তির সামনে বসে কাজের কথা সেরে ফেলার পরে বলেছিলাম, ‘আপনার এবারের আনন্দমেলার উপন্যাসটি পড়ে ফেলেছি, অসাধারণ লেগেছে ।’
তাই শুনে জলদগম্ভীর কণ্ঠের অধিকারী কঠিন ব্যক্তিত্বের আবরণে মোড়া ওই মানুষটি বলে উঠেছিলেন, ‘অ্যাঁ! এর মধ্যেই পড়ে ফেলেছ!’
জার্মানির পটভূমিতে লেখা কয়েকটি জাঁদরেল চরিত্রের কাণ্ডকারখানার উল্লেখ করে বললাম, ‘ওই জায়গাগুলো দারুণ লেগেছে!’
বিশালদেহী মানুষটি ছেলেমানুষি খুশিতে বলে উঠেছিলেন, ‘এই ব্যাপারে কেউ আমাকে হারাতে পারবে না।’
পাঠকের কাছে একজন বড় লেখকও কতখানি খোলামেলা হতে পারেন—এই ঘটনাটি তার প্রমাণ। শুনেছি, উপন্যাস লেখা হয়ে গেলে সত্যজিৎ সেটি প্রথমে স্ত্রী ও ছেলের কাছে পড়ে শোনাতেন । সেবার ঘটনাচক্রে ওই উপন্যাসের তৃতীয় পাঠক হয়ে গিয়েছিলাম আমি।”
তখন শরদিন্দুর মরশুম। ব্যোমকেশ কাহিনীর চলচ্চিত্রায়ন নিয়ে বাজার সরগরম। শেখরবাবুকে বলছিলাম যে কিছুদিন আগে আমি ও পল্লব আলোচনা করছিলাম শরদিন্দু কাহিনীর চিত্রায়ন নিয়ে। ব্যোমকেশ সহ ওনার অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হলেও আমরা কিন্তু সবচেয়ে বেশী উচ্ছ্বসিত ছিলাম “দাদার কীর্তি” নিয়ে। আমি পল্লবকে বলছিলাম যে এটি একেবারে শরদিন্দু ঘরানার চলচ্চিত্রায়ন। তরুণ মজুমদার একদম ঠিকঠাক করেছেন। পল্লব আরো একধাপ এগিয়ে বলেছিলেন – “খুব ছোট বয়সের লেখা তো। আসলে শরদিন্দু যদি পরিণত বয়সে ‘দাদার কীর্তি’ টি চিত্রনাট্য আকারে লিখতেন তাহলে সেটি প্রায় তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য হয়ে যেত।” শেখরবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি আনন্দমেলাতে ধারাবাহিক ভাবে বেরোনো চিত্রকাহিনী ‘সদাশিব’ পড়েছি কিনা। আমি জানালাম যে আমি উদগ্রীব থাকতাম ঐটি পড়ার জন্য। উনি জানালেন ঐ কাহিনীর চিত্রনাট্যকার ছিলেন স্বয়ং তরুণ মজুমদার – ওঁর নিজের কথায়-
“শরদিন্দুর ‘সদাশিব’ কাহিনীর চিত্ররূপ তখন আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে বার হত । অসাধারণ সব ছবি আঁকতেন শিল্পী বিমল দাস । সুরসিক এই মানুষটি তখন আনন্দমেলার কর্মী ছিলেন। অত ভালো চিত্ররূপ আমি আর কোনও বাংলা কাহিনীর দেখিনি। কেন যে ওটি গ্রন্থাকারে বার হল না—আজও বিস্ময়! হলে বাংলা চিত্রকাহিনির একটি চিরকালীন সম্পদ হতে পারত। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখতেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদার। কি আঁটোসাঁটো চিত্রনাট্য! কাহিনি মুহূর্তের জন্যেও কোথাও ঝিমিয়ে পড়েনি চিত্রনাট্যের গুণে। তিনি প্রায়ই আসতেন আমাদের দফতরে। সম্পাদক ও চিত্রশিল্পীর সঙ্গে কথা বলতেন। সুবিধে-অসুবিধে জেনে নিতেন চিত্রনাট্য আরও নিখুঁত করার জন্যে। সেই সময়ে আমিও মাঝেমধ্যে উপস্থিত থাকতাম।”
আমার কাছে এই দুটি ঘটনাই খুব মূল্যবান তথ্য মনে হল। আমার প্রিয় দুই পরিচালকের মধ্যে ই যে এইরকম অদ্ভুত সুন্দর একটি কিশোর লুকিয়ে থাকত তা জেনে বুঝতে পারছি তাঁদের করা কিশোর ছবিগুলিও কেন আজও আমায় এত টানে!!
এই লেখাটি ফেসবুকে দেওয়ার পর উনি যে প্রশংসাবাক্যটি দিয়েছিলেন তা আমাকে উল্লসিত করেছিল, কিন্তু লজ্জাতেও ফেলেছিল – লিখেছিলেন,-
“ফ্লবের বলেছেন--যাঁর দেখার চোখ আছে, গল্পের জন্য তাঁর বাইরে ছুটোছুটি করার দরকার নেই। আর যাঁর শোনার কান আছে? তিনি বোধহয় গল্পগুজবের ভেতর থেকেও তথ্য খুঁজে পান...বেশ হয়েছে লেখাটি...”
ওঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এখনও শিখে চলেছি। আমাদের “অবসর” পত্রিকার উনি একজন বড় অনুপ্রেরণা। প্রতিটি সংখ্যা পড়েন এবং মন্তব্য করেন, - “অবসর” এর প্রতি ওঁর এই অকুণ্ঠ ভালবাসা আমাকে বিস্মিত এবং আপ্লুত করে।
চলার পথে আরো অনেকের কাছ থেকেই পেয়েছি অনেক কিছু। সবকথা ঠিক মতো লেখা গেল না। আরো শিখেই চলেছি। নতুন শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে আমার বন্ধু, সহকর্মী বা আত্মীয়। “যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি” – এই উপদেশটিকে মাথায় নিয়েই আপাতত এই খানেই দাঁড়ি টানলাম।
লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার
রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে
ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু
লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায়
এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।