প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

নভেম্বর ১৫, ২০১৫

 

যাঁদের আমি ছাত্র

ভাস্কর বসু

ভূমিকা

--১--


অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮)

খুব ছোটবেলাতেই আমরা পড়ে ফেলেছিলাম সেই বিখ্যাত পংক্তিগুলি –

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।

জীবনভোর শেখা আর সেই শেখার জন্য চাই নিজের অদম্য আগ্রহ। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে এই শিক্ষার পেছনে আমাদের নিজের কৌতূহল, মনন ও পরিশ্রম ছাড়াও থাকে আরো কিছু, - তা হল আমাদের সুযোগ্য শিক্ষকদের পথপ্রদর্শন। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তাঁরা আমাদের পথ চলা শেখান, প্রয়োজনে কঠোর হতেও দ্বিধা করেন না আবার আমাদের দুর্বলতাগুলিকে সযত্নে মুছিয়ে দিতেও তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। আমাদের জীবনে আমরা বহু শিক্ষকের সংস্পর্শে আসি, তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার থাকে অনেক কিছু,- বিষয় সম্পর্কে তাঁদের গভীর জ্ঞান তো বটেই, এছাড়াও তাঁদের বাচনভঙ্গী, শিক্ষণ পদ্ধতি, বহির্জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল, সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান, জীবনযাত্রা আর অবশ্যই রসবোধ। ছাত্রদের কাছে শিক্ষা অনেক সময়েই চিত্তাকর্ষক নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষকদের দায়িত্ব থাকে তাদের কাছে বিষয়টিকে সরস পরিবেশনার।

আমার জীবনের এগারোজন বিশেষ শিক্ষককে নিয়ে আমি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্ব পরিকল্পনা করেছি। একেবারে স্কুল জীবন থেকে শুরু করে চলমান জীবনগুলিতেও যাঁরা আমাকে আলো দিয়েছেন তাঁদের কথা মনে করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

মাষ্টারমশাই

--২--

‘প্রথম স্কুলে যাবার দিন, প্রথম বার ফেল
প্রথম ছুটি হাওড়া থেকে ছেলেবেলার রেল’

প্রথম বাড়ীতে মাষ্টারমশাই পড়াতে আসার উত্তেজনা আমাদেরও কিছু মাত্রায় তার থেকে কম ছিল না।

আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন যতীনবাবু আমাদের পড়াতে আসেন। আমরা ভাইবোনেরা ছিলাম এরকম – একজন ২য় শ্রেণী, ২জন চতুর্থ শ্রেণী আর একজন ষষ্ঠ শ্রেণী। প্রত্যেকের বিভিন্ন রকম স্তর আর এটা ঠিক ছিল উনি পড়াবেন বেশ কটি বিষয় – অংক, বাংলা, ইংরেজী, সংস্কৃত, ভূগোল, ইতিহাস, জীবন বিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞান -!!! হলফ করে বলতে পারি, আজকের দিনে শুধু এই রকম পড়ানোর কথা উচ্চারণ করলেই কোন শিক্ষক তীরবেগে সেই স্থান পরিত্যাগ করবেন - কিন্তু সেই সত্তরের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। আমাদের মাষ্টার মশাই যতীনবাবুর আরো এক নাম ছিল – পণ্ডিতমশাই। কারণের সঙ্গে আমরা ধীরে ধীরে পরিচিতি হচ্ছিলাম।

আমরা ছিলাম একেবারে “কাঠ-ঘটি” আর মাষ্টারমশাই “কাঠ-বাঙাল”!! স্বাধীনতার পরে তিনি সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে আসেন এবং স্কুলে চাকরী নেন। মজার মজার গল্প বলতেন বাংলাদেশের – ‘ঢাকা, খুলনা, পাবনা’ – অর্থাৎ ‘ঢাকা খুলোনা – পাবোনা- এ ভাবে যে মজা করা যেতে পারে তা শিখিয়েছিলেন। প্রথমদিনেই – ‘সাইট’ শুনে কিছুই বুঝতে পারছি না – তারপর ‘উনসাইট’ (৫৯) আর ‘সাইট’ শুনে কিছু বোধগম্য হল। কিন্তু পড়ার মধ্যে যে একটা মজা আছে তা ছোটবেলাতেই আমাদের শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ওনার হাত ধরে – “দশ দিয়ে গুণ আর ভাগ হল দশমিককে কান ধরে ডান আর বাঁদিক করানো” ত। একবার কোন লেখাতে উনি খুশী হননি, আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম – সবই তো লেখা আছে, ভুলটা কোথায়। উনি ক্রুদ্ধ না হয়ে খুব মজা করে বুঝিয়েছিলেন কালিদাস আর ভবভূতির গল্প – সেই “শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে” আর “নীরস তরুবর পুরতঃ ভাতি” র পার্থক্য। খুব তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার এই সময়ে আমরা হয়তো ষষ্ঠ / সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তিনি সহজেই উপেক্ষা করে বলতে পারতেন – “কথা শোন বাছা”! কিন্তু তা না করে এমন সুন্দর বুঝিয়েছিলেন যে তা সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল। আমার দিদি বা বোন ওনার কোন যুক্তি মেনে না নিতে পারলে বলত – “না, মাষ্টারমশাই, আমাদের দিদিমনিরা অন্যরকম বলেছেন”!! উনি না চটে বলতেন – “আহা, আমরা দাদামনিরাও তো কিছু জানি, শুনে দেখ না।” যদিও ওনার বিষয় ছিল ইতিহাস কিন্তু সংস্কৃতে ছিল অদ্ভুত ব্যুৎপত্তি। বাংলা আর ইংরেজী ব্যাকরণে ছিলেন সিদ্ধহস্ত – যেমন জ্ঞান, তেমনি পরিবেশন । ছোট্ট একটা উদাহরণ – “টি, টা, খানা, খানি” পড়াতে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন –
ওদের বাড়ীর ছেলে-টা / খায় এত-টা / নাচে যেন বাঁদর-টা -
আর
মোদের বাড়ীর ছেলে-টি / খায় এত-টি / নাচে যেন ঠাকুর-টি!!

এরপর আর প্রয়োগে কোনদিন ভুল হয়নি। আর ইংরেজী গ্রামারে এতটাই পোক্ত করে দিয়েছিলেন যে আমার সারাজীবন ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়া ছেলের সঙ্গেও যতীনবাবুর নাম নিয়ে লড়ে যেতাম। ভূগোলে চোখ বন্ধ করে ম্যাপ পয়েন্টিং শিখিয়েছিলেন – ভূগোল ও ইতিহাসের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও ওনার ছিল খুব জোরের জায়গা যেমন ছিল সংস্কৃত ও বাংলার মিল-অমিলের ক্ষেত্রে।

মাষ্টারমশাইয়ের অনুপস্থিতি প্রায় ছিল না বললেই চলে। একবার খুব সাইক্লোনিক আবহাওয়া, ঝড়ে গাড়ী চলাচল বন্ধ কারণ রাস্তাঘাটে অনেক জায়গায় গাছ পড়েছে। আমাদের বাড়ীতেও ফুলের গাছ পড়ে গেট আটকে বাড়ীর রাস্তা বন্ধ। বাবা অফিসে যেতে পারেনি আর আমরা গল্প শুনছি। এর মধ্যে গেটে আওয়াজ। দেখি একহাতে ছাতা নিয়ে আর একহাত দিয়ে ফুলগাছ কাটিয়ে কাটিয়ে তিনি আসছেন!! রাগে আমাদের ভাই-বোনেদের গা জ্বলে গেল, কিছুতেই পড়ব না!! বাবা-মা বোঝালেন যে এই নিষ্ঠার অবমাননা করার চেয়ে বড় খারাপ কাজ আর হতে পারেনা। অগত্যা -!! তিনি সম্ভবতঃ আমাদের মনোভাব আগেই বুঝেছিলেন, সেদিন হাল্কা কিছু গল্পচ্ছলে পড়িয়েই ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ‘জীবনস্মৃতি’ তে রবীন্দ্রনাথের ও একইরকম অভিজ্ঞতার কথা পড়ে মনে মনে হেসেছিলাম – সেই যে –

“দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে। হইতে পারে আর কেহ। না, হইতেই পারে না। ভবভূতির সমানধর্মা বিপুল পৃথিবীতে মিলিতেও পারে কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদেরই গলিতে মাস্টারমহাশয়ের সমানধর্মা দ্বিতীয় আর কাহারও অভ্যুদয় একেবারেই অসম্ভব”

মাষ্টারমশায় নিজে ঘোর নাস্তিক ছিলেন, কিন্তু বাড়ীতে কোজাগরী লক্ষীপুজো হত। সেই সময় ওনাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণে ভোগের খিচুড়ির আকর্ষণ দারুণ ছিল। তবে ওনার কাছে পড়াশোনার বাইরে আরো যা শিখেছিলাম তা হল – দাবা খেলা।

১৯৭৩ সাল! বরিস স্প্যাশকি ও ববি ফিশারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেলা নিয়ে সারা বিশ্ব মাতোয়ারা। মাষ্টারমশাই ও রোজ কাগজে খেলার রিপোর্ট পড়তেন – আমাদের উৎসাহ দেখে আমাদের খেলা শেখালেন। ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম – যেখানে রাজার আড়াই চাল নেই কিন্তু Castling নামক এক রক্ষণাত্মক প্রথা আছে। ববি ফিশারের প্রথম চাল নাকি – PK4, অর্থাৎ রাজার সামনে বোড়ে টাকে আরো দুইঘর এগিয়ে দেওয়া। যাই হোক প্রথম প্রথম খেলা শিখে আমরা ওনার কাছে গোহারান হারতাম। তারপর আমরাও একটু খেলতে শিখলাম। আমরা লক্ষ করেছিলাম বার্ধক্যের কারণে অনেক সময়ে বা লোডশেডিং হলে হারিকেনের আলোতে, ওনার একটু দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়ায় দেখতে বা মনঃসংযোগের সমস্যা হয়। সেই সুযোগে আমরা ওনার মন্ত্রীটিকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতাম। দু-একবার এমনও হয়েছিল, মাষ্টারমশাই আমাদের মনক্ষুণ্ণ করে, ‘সরি, সরি,’ বলে চাল ফেরত নিয়ে মন্ত্রী বাঁচিয়েছেন। এরকম একদিন পড়াশোনার পর আবার খেলা হচ্ছে, লোডশেডিং এর মধ্যে। অন্ধকারে মাষ্টারমশাই আবার আবার ফাঁদে পা দিলেন, ক্ষীণ আলোতে একটি বোড়েকে সরাতেই অনেক দূর থেকে গজ এসে তাঁর মন্ত্রীটিকে ধরাশায়ী করল। মাষ্টারমশাই কিছু বলার আগেই মন্ত্রীকে ঘুটির বাক্সে ভরা হল – কিছুতেই ফিরৎ দেওয়া হবে না। তখন যাকে বলে আমাদের জীবনের এক সন্ধিক্ষণ। যা হোক, হেরে এবার মাষ্টারমশাই ভালো করে খেলতে বসলেন। খুব সন্তর্পণে, ক্ষীণ আলো, ভারী চশমা, কোন অজুহাতই চলবে না। আমরাও তাই, সবাই ভেবে ভেবে চাল দিচ্ছি। এদিকে রাত বাড়ছে, মা, কাকিমারা মাষ্টারমশাইকেও কিছু বলতে পারছেন না। আমাদের তো মহাফূর্তি – সাবালক হয়ে গেছি!! এর মধ্যে হঠাৎই একটি উৎকন্ঠ, কচি গলা শোনা গেল – “বাবা, বাবা”!! মাষ্টারমশায়ের ছেলে খুঁজতে বেরিয়েছে, রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। স্কুল থেকে এখনও বাড়ী ফেরেননি, তাই বাড়ীর সবাই চিন্তা করছে।

আজকের যুগে এটা সম্ভবতঃ রূপকথা বলে মনে হবে।

 


লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।