প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ১৫, ২০১৬

 

যাঁদের আমি ছাত্র

ভাস্কর বসু

এক লাফে বিশ্ববিদ্যালয় – দ্বিতীয় পর্ব

---১১--

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮)

আশির দশকে আমরা এসে গেলাম। আস্তে আস্তে এসে গেল থার্ড ইয়ার। এইবারে বেশ সিরিয়াস হওয়ার পালা। শোনা গেছে, ইন্টারভিউ আর চাকরীর পরীক্ষাতে যা সব প্রশ্ন আসে তা মূলত থার্ড আর ফোর্থ ইয়ারের থেকে। বড় দাদা – দিদি রাও বলতে লাগলো, “এবার একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে”!

 আস্তে আস্তে অবশ্য আমরা ডিপার্টমেন্টটাকে ভালবাসতে পারছিলাম। বিল্ডিং এর করিডর, লিফট, সিঁড়ি, ল্যাব, লাইব্রেরী, ছাদের ওপর আমাদের ছোট্ট ক্যান্টিন – এগুলো যেন আস্তে আস্তে আমাদের একেবারে নিজস্ব জায়গা হয়ে উঠছিল। যদিও সত্যেনদার বিখ্যাত ক্যান্টিন বা এমিনিটি সেন্টার ছিল, আমরা কিন্তু সবচেয়ে বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম আমদের ঐ চারতলার ছোট্ট ক্যান্টিনেই। সেখান থেকে চারিদিক দেখা যেত, খোলা হাওয়া, কিরকম এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি থাকত যা অন্য ক্যান্টিনগুলোতে পাওয়া যেত না। আমদের বন্ধুদের একটা গ্রুপ ও হয়ে গিয়েছিল, আড্ডা ও সিনেমার, - আমি, সোমনাথ, কৌশিক, ইন্দ্রনীল, মৃত্যুঞ্জয়, পার্থ, সাহানা আর সুকন্যা। খুব সুখের বিষয় আজও এই বন্ধুদের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ আছে। ভারত ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও বর্তমান প্রযুক্তি আমাদের এই সুবিধেটুকু দিয়েছে।

আমি, সাহানা আর সুকন্যা একসঙ্গেই পাঠভবন থেকে এসেছিলাম। প্রায় একই সঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম। তাই আমাদের রোল নম্বরও কাছাকাছি ছিল, সব ল্যাবেই আমরা এক গ্রুপে থাকতাম। সাহানা আর সুকন্যার বন্ধুত্ব প্রায় প্রবাদ-প্রতীম, প্রায় একসঙ্গেই ওরা থাকত। পরীক্ষাতেও প্রায় পাশাপাশি বসত। আমাদের যাদবপুরে ক্লাস-টেস্ট এর সময় একটু বোঝাপড়া থাকত, আমি আর সোমনাথ পাশাপাশি বসতাম, তেমনি ওরাও। আর কিছু না হোক একটু আত্মপ্রত্যয় বাড়ত। তবে পরীক্ষা চলাকালীন স্বাভাবিক কারণেই দুই পরীক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব কমে যেত। একবার সাহানা আর সুকন্যারও সেরকম হচ্ছিল। আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন অলক দাস বলে একজন শিক্ষক। তিনি বলছিলেন, “তোমরা সরে বস”,-  সরে বসার পর ও খুশী নন। “আরো সরে বস” – সুকন্যা বেশ রেগেমেগে বলল, “স্যার, আরো সরলে তো বেঞ্চ থেকে পড়ে যাব!” নির্লিপ্ত কণ্ঠে অলকবাবুর জবাব, “তাতে কি? আবার উঠে বসে পড়বে!” ভাবা যায়!! কি নিরপেক্ষ শিক্ষক, ছাত্রী বলেও ছাড় নেই!! সুকন্যা অবশ্য পরে গজগজ করলেও তখন আর বেশী সরার সাহস করেনি! একঘর ছাত্রর সামনে বেঞ্চ থেকে পড়ে গেলে তা তো বিরাট মুখরোচক খবর হবে!!

যে কোন পরীক্ষার আগের সন্ধ্যে থেকে পরের দিন সকাল অবধি আমাদের বেশ লসাগু, গসাগুর খেলা চলত। তখন সুকন্যা, সাহানা, সোমনাথ, আমার,– চারজনের বাড়ীই ফোন ছিল। সাহানা আর সুকন্যা একসঙ্গেই প্রায় পড়াশুনো করত। হয়তো কোন একটা কিছু আটকে গেছে, সেটা বাদ দেওয়া কতটা ঝুঁকি নেওয়া হবে – বা কিভাবে শর্টে কিছু সারা যায় কিনা সেটা জানা যেত। এরপর আবার সোমনাথের বাড়ী ফোন করে আরো কিছু স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হত। তারপরেতে আবার পরীক্ষা হলে গিয়ে আলোচনা,- তবে সবসময় ভাবতাম সামনের পরীক্ষাতে পুরো অন্যরকম,- কিচ্ছু বাদ নয়! কিন্তু ---!! তবে একবার আমাদের খুব ভালো ছাত্র ইন্দ্রনীলকে পরীক্ষার আগে ফোন করে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। একটা ছোট্ট প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই এখন কোনটা পড়ছিস?” বলে –“চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী”!! শুনে নার্ভাস হয়ে আমার হাত কাঁপছিল – বলল - ও নাকি পরীক্ষার দিন সকালে পড়ে না! ব্যস, আর কোনদিন পরীক্ষা চলাকালীন ফোন করিনি!

তৃতীয় বর্ষে এসে দুর্দান্ত সব টিচারের দেখা পেলাম। সবার কথা লেখা সম্ভব নয়। দু-তিনজনের কথা লিখব। এইবার আমাদের যে সব কঠিন বিষয় পড়তে হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল Electro-Magnetic (EM) Theory. একেই কঠিন বিষয়, তায় সেরকম কোন ল্যাব নেই। দাদা-দিদিরা বললেন – “আমরাও বুঝিনি রে, ঝেড়ে মুখস্থ! আর চাকরির ইন্টারভিউতে কেউ জিজ্ঞেস করবে না, কারণ ওরাও ভাল জানে না।”

যা হোক, আমাদের EM Theory পড়াতে এলেন আমাদের তখনকার বিভাগীয় প্রধান শ্রী জ্ঞান-শরণ চ্যাটার্জী। ইনি এক প্রখ্যাত মানুষ। ইনিই ছিলেন যাদবপুরে ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, এন্টেনার ওপর একজন পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ। যাদবপুরে থাকাকালীনই  উনি NASA তে গিয়ে গবেষণা করে খুব খ্যাতি অর্জন করেন। বেশ কিছু বই ও রিসার্চ পেপার আছে তাঁর নামে। আমরা প্রায় ভয়ে কাঁটা! এমন মানুষের ক্লাসে কি প্রশ্ন করা যায়! প্রথম দিন এসেই এমনই এক কথা বলেছিলেন যার সারমর্ম সদ্য-সমাপ্ত এশিয়া কাপ ফাইন্যালেও উপলব্ধি করেছি। ভারত অধিনায়ক বলেছেন না সাংবাদিকদের উদ্দেশে, একটু ব্যঙ্গ করেই -  আমরা জিতলে কি আর খবর হয়, খবর হত বাংলাদেশ জিতলে। এক্কেবারে এই কথাই তিনি বলেছিলেন, - আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন – “What is information?” যশস্বীর সামনে আমরা নিরুত্তর!! তখন নিজেই জানিয়েছিলেন, “যে ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যত কম তার Information Content তত বেশী। সুতরাং, Information is the change of probability” !! পরবর্তীকালে Information Theory পড়ার সময়ও তাই দেখেছি।

আমাদের সবচেয়ে মন জয় করেছিলেন যিনি তিনি শ্রী প্রদীপ কুমার দাস, PKD. একটু পরে বিস্তৃত ভাবে লিখবো তাঁর কথা।

আমাদের  Network Analysis বলে একটি বিষয় পড়াতেন অনুপবাবু।  তিনি ছিলেন একটি বিশাল গোঁফের অধিকারী, ভারি ভালোমানুষ গোছের, আপনজনের মত। বিষয়টি যা পড়াতেন, বেশ শক্ত। ক্লাসে পড়ানোর সময় তিনি ভীষণ আন্তরিক ছিলেন। বারবার করে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। কোন একটি কিম্ভূতকিমাকার সমীকরণ বুঝতে না পারলে আমরা যদি জিজ্ঞেস করতাম, সঙ্গে সঙ্গে বলতেন,-
“কোনটে? (পিছনে বোর্ডে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে) এইটে – OK. I repeat”!!

এটা ছিল ওনার বিখ্যাত উক্তি। আমরা পড়া না তুললেও এই ভঙ্গিমা খুব সহজেই তুলে নিয়েছিলাম। সেই যে কবে ঠাকুর মশায় বলেছেন, - “ইহা বেশ দেখিয়াছি, শিক্ষকের প্রদত্ত বিদ্যাটুকু শিখিতে শিশুরা অনেক বিলম্ব করে, কিন্তু শিক্ষকের ভাবখানা শিখিয়া লইতে তাহাদিগকে কোনো দুঃখ পাইতে হয় না।” আমাদের শিশুকাল তখনো কাটেনি আর কি! সেই পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (λ) খুব যোগাযোগ। অনুপবাবুর হাঁটার এক বিশেষ ভঙ্গিমা ছিল, একজন সিনিয়র খুব গম্ভীরভাবে আমাদের জানাল উনি নাকি λ/4 মেপে মেপে রাস্তা হাঁটেন!

আমাদের কম্যুনিকেশন পড়াতেন অচিন্ত্যবাবু। উফফ, উনি একেবারে বোর্ডটিকে নিয়ে এধার ওধার করে ফেলতেন। একেই জটিল ব্যাপার, শক্ত শক্ত সব অঙ্ক, তার ওপর বোর্ডের বাঁদিক থেকে শুরু করে উনি ছুটে চলতেন। আমরা প্রায়শই খেই হারিয়ে ফেলতাম। অচিন্ত্যবাবু ছিলেন এক্কেবারে পাক্কা নর্থ কলকাতার লোক। ঘোর মোহনবাগান  সাপোর্টার এবং অনিবার্যভাবে কথায় বেশ শ্যামবাজারীয় টান। আমরা প্র্যাকটিকাল ক্লাসে ফাঁকি মারলে হুমকি দিতেন, “Saয়েব, ঝাল মারতে শেখ, নইলে কিন্তু চাকরি পাওয়া মুশকিল!”

আসলে ঝাল মারা হল Soldering যা ছিল আশির দশকের ইলেক্ট্রনিক্সের একেবারে মূল কর্মকাণ্ড! অচিন্ত্যবাবু আবার আমাদের রামকৃষ্ণ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন,  সেই তোতাপুরি আর রামকৃষ্ণর বিখ্যাত সংলাপ। কাঁসার পাত্র আর সোনার পাত্র! বলতেন,- ‘সোনার পাত্র হওয়ার চেষ্টা কর। একবার পড়বে মনে রেখে দেবে, বারবার মাজতে হবেনা।’

তবে মোহনবাগানের খেলা দেখে এলে অচিন্ত্যবাবুর মুড দেখে কে! – “৬২ মিনিটের সময় শিশির বিশ্বাস একটা বল পেল- সেটা যদি ঠিকমত--” বা “৩৭ মিনিটের মাথায় প্রশান্ত ব্যানার্জী একটা থ্রু দিয়েছিল, কেউ ছিল না-” !!  খুব উপভোগ করতাম। একবার পরীক্ষার পর যাদবপুর স্টেশনে ধরে বকে দিলেন, একটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক লিখিনি। আমি মিনমিন করে বললাম,- “স্যার, খাতায় নাম তো থাকে না, কি করে বুঝলেন”!

গম্ভীরভাবে আপাদমস্তক দেখে বললেন –“তাতে কি, সবকটার হাতের লেখা চিনি যে!”  বাপ রে!!

তবে আমাদের সকলের প্রিয় শিক্ষকরা ছিলেন ডিজিট্যাল ইলেক্ট্রনিক্সের লোক। বিষয়টি ছিল বেশ বোধগম্য আর তাঁরা পড়াতেনও খুব যত্ন করে। দুজনের নাম সর্বাগ্রে মনে পড়ে, সুকুমার ঘোষ (এসজি) আর প্রদীপ কুমার দাস (পিকেডি)। এঁদের কথা একটু ভালোভাবে লিখতেই হবে।


--- ১২ ---

সুকুমার ঘোষ ছিলেন, ভীষণ এক শান্ত সৌম্য প্রকৃতির মানুষ। তাঁর চলা ফেরা, পড়ানো সব কিছুর মধ্যেই যেন পুরো মাত্রায় ‘যতির আয়েস’। তিনি কথা বলতেন খুব আস্তে, সিগারেট খেতেন ও আরাম করে। যেন শুধু পড়ানো নয়, সব কিছুই খুব উপভোগ করতেন, সব কিছুরই যেন উত্তর ছিল তাঁর কাছে। সেই সময় আমাদের ক্লাসে পড়াতে এলে বেশ তৈরী হয়েই আসতে হত। একদিন উনি ক্লাসে এলে আমরা যা পড়ানোর কথা সেটা না পড়িয়ে অন্য একটি বিষয় পড়ানোর অনুরোধ করি। তার কারণ ছিল চাকরির ইন্টারভিউতে নাকি সবাই সেই বিষয়ের ওপর প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। উনি একটু ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু আমরা প্রায় খুব চাপাচাপি করাতে পড়াতে শুরু করলেন। এবং আস্তে আস্তে ছোট থেকে ধারণাটাকে বড় করে একটা সুন্দর রূপ দিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতে আমরা অতিমাত্রায় সন্তুষ্ট হলেও উনি যেন একটু ক্ষুণ্ণ ছিলেন, “আরে ঠিক ভাল করে তৈরী হয়ে আসিনি তো!”
              তবে পূর্ণমাত্রায় তৈরী হয়ে এসে আমাদের ক্লাস নিতেন তিনি পিকেডি। তিনি কেন জানিনা আমাদের সবসময় সুনীল গাভাসকারের কথা মনে পড়াতেন। ঠিক সেই রকমই হাইট, সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামা, সেই রকম অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ, - ছাত্রদের ওপর, ক্লাসের ওপর, এমনকি নিজের ওপর। যা পড়াবেন একেবারে সুন্দর করে নোট করে নিয়ে আসতেন। বোর্ডে ঠিক জায়গা পরিমাপ করে ডায়াগ্রাম আঁকতেন, যাতে অন্যান্য জিনিষগুলো সব সেই ডায়াগ্রামের চারিপাশে  ঠিকঠাক জায়গাতে থাকতে পারে। হাতের লেখা ছিল একেবারে মুক্তোর মত! ঐ ক্লাসে শুধু নোট নিলেই আর বই পড়বার সেরকম দরকার হত না। আসলে উনি বোর্ডটাকে এত যত্ন করে সাজাতেন, আমাদের ও ইচ্ছে করত ঠিক সেভাবেই খাতাটাকে পরিষ্কার রাখতে। আর পরীক্ষার সময়ে ক্লাসের খাতা একেবারে বইয়ের মতই থাকত। আমার শিবপুরের বন্ধুদের কাছে শুনেছি প্রখ্যাত শিক্ষক শ্রী শঙ্কর সেন এর ও নাকি একই সুন্দর অভ্যাস ছিল।

পিকেডির পড়ানোর কায়দাটা ছিল অসম্ভব সুন্দর। আমাদের ডিজিট্যাল পড়ানোর আগে একটু পুরনো ট্রানসিস্টর পড়া ঝালিয়ে নিতে গিয়েই আমরা রীতিমতো মুগ্ধ হচ্ছিলাম। তারপরেতে তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আমরা বলে উঠলাম, - স্যর, এটা আরো কিছুক্ষণ চলুক, আমাদের বেশ জ্ঞান লাভ হচ্ছে। উনি বেশ অবাক হয়ে বললেন, - আরে এ তো তোমাদের আগেই পড়া হয়ে যাওয়ার কথা! আমরাও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম – তা ঠিক কিন্তু মানে ঐ আর কি, আর একবার ভালো করে বুঝলে – মানে এটা তো একেবারে গোড়ার কথা - !! যা হোক উনি সম্ভবত বুঝেছিলেন আমাদের বেশ “গোড়ায় গলদ” আছে আর “শেষরক্ষা”র ভার ওনাকেই নিতে হবে। নিয়ে ও ছিলেন – সত্যি পরবর্তী কালে চাকরি করতে এসেও ওনার পড়ানো বিষয়গুলি আমাকে প্রভূত সাহায্য করেছে। উনি বেশ সরস ভঙ্গিমাতে কথা বলতেনও, যেমন “The best way to write a big program is to never write a big program but to divide it into many small programs!” চমৎকার না!! তখন আমাদের পড়ানোর মধ্যে “Steady-state” আর “Transient State” এর খুব কথা হত। একবার ক্লাস-টেস্ট ছিল, আমাদের কারুরই ভালো তৈরী হয়নি, পিকেডির ও ভাল তৈরী হয়নি বোধহয়। উনি এসে বললেন,- ‘ক্লাস-টেস্ট পরে হবে’। বলতেই ক্লাস জুড়ে কল-কল্লোল! পিকেডি আবার পড়ানো শুরু করতে গেলেই কেউ একজন বলল, “স্যর, একটু সময় দিন। আনন্দটা একটু Transient State থেকে Steady-state আসুক!” উনি বেশ অবাক হয়ে –“আনন্দ in steady state” বলে ধপ করে বসে পড়েছিলেন।

ফাইন্যাল ইয়ারে আমার আর সোমনাথের দুজনের খুব ইচ্ছে ছিল পিকেডির কাছে প্রোজেক্ট করব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: সোমনাথের হলেও কোন কারণে আমার হয়নি। সোমনাথ খুব ভালোই কাজ করছিল কিন্তু একবার কোন বিয়ে উপলক্ষে সপ্তাহ-খানেক আসেনি, তাও আবার না বলে। পিকেডি বলেছিলেন –‘তুমি আত্মীয়র বিয়েতে এক-সপ্তাহ ছুটি নিলে, মানে নিজের বিয়েতে তো বছর খানেক ছুটি নেবে?” পিকেডির আশঙ্কা দেখে সোমনাথ আশ্বস্ত করেছিল, “না স্যর, ভাববেন না, এখন বিয়ে করছি না!” পরে শুনেছি এক মজার ঘটনা। জানিনা সেটা কতটা সত্যি আর কতটা আমাদের সিনিয়রদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। পিকেডির কাছে একজন বয়স্ক পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্র কাজ করত। সে বর্ধমানে বিয়ে করতে গেল, কিন্তু বেশী দিন ছুটি পায়নি। বিয়েই হল কিন্তু মধু চন্দ্রিমা আর হয়নি। সে নাকি ফিরে এসে দুঃখ ভোলার জন্য সন্ধেবেলা রোজ যাদবপুরের ল্যাব থেকে চাঁদ দেখত,- জনশ্রুতি পিকেডি নাকি বুঝিয়েছিলেন যে সে এখান থেকে চাঁদ দেখছে আর তার স্ত্রী বর্ধমান থেকে। হাজার হোক একই চাঁদ – এও তো একপ্রকার মধুচন্দ্রিমাই!!

তবে আস্তে আস্তে যাদবপুরের চার বছরের স্বর্গবাস শেষ হতে চলল। কেউ কেউ ক্যাম্পাসে চাকরি পেল, কেউ কেউ বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে। কেউ কেউ পিজি করতে বাইরের ইন্সটিটিউট গুলিতে যেতে থাকল। আমরা কজন যারা চাকরি করব ভেবেছিলাম তারা জেনে গেলাম, আপাতত এই পর্যন্তই আমাদের ছাত্রজীবনের দৌড়। এইবার আমাদের আসল ভাগ্যান্বেষণের শুরু।

তবে আসল শিক্ষার তো শেষ নেই। পরের পর্বে লিখব এমন কটি মানুষের কথা যাদের কাছে পেয়েছি সাহিত্যের বা শিল্পের শিক্ষা। সেই শিক্ষা কিন্তু প্রথাগত শিক্ষার থেকে একদম আলাদা।


লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।