আকাশ-সমুদ্রে জাহাজের মতো

আকাশ-সমুদ্রে জাহাজের মতো

বিংশ শতকের শুরুর দিকে বাঙালি জীবনে যখন “সন্ধ্যাবেলা” নেমেছে, যখন “বড়বাজারের মাড়োয়াড়ী এক-একটা মহাজন” “মোটা গের্দা ঠেস দিয়ে একরাশ মোহর গুনে-গুনে চটের থলিতে ভরে-ভরে রাখছেন”, তখন মেওয়াড়ের রাজা-রানিদের গল্প আঁকতে শুরু করলেন বাঙালি শিল্পী। সেসব গল্প মুগ্ধচিত্তে পড়ল কত প্রজন্মের বাঙালি বালক-বালিকা। সে-বয়সে আবহাওয়া মেঘলা কমই থাকত, চোখ সর্বদা থাকত দূরবিনে এবং “আকাশ পরিষ্কার থাকলে”ই বাংলার সমতল “থেকে পাহাড়ের উপর চিতোরের কেল্লা ঠিক যেন একখানি জাহাজের মতো আকাশ-সমুদ্রে ভেসে রয়েছে দেখা যেত।” বইটার সাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা ছিল জল-রং ছবি। গ-ল’য়ে-প খেয়াল করার আগেই গল্প পড়া শেষ। সে এক ভিন্নধর্মী মুগ্ধ-বোধ। রাজা-রানিরা যেমন, তেমনই তাদের ভিল প্রজারা, সকলেই সে-বইয়ে বাংলায় কথা বলত। তাদের বাঙালিই মনে হত। ক’টা রাজপুতই বা দেখেছে ছাপোষা বাঙালি ঘরের শিশু! কিন্তু, বইটা পড়তে তাকে বাংলা ভাষা জানতে হত। সে-ভাষার বানান ব্যাকরণও শিখতে হত। অদ্ভুত শোনাচ্ছে!

সত্যজিৎ রায় কৃত 'রাজকাহিনী'র প্রচ্ছদ

 

বাঙালির সন্তান, বাংলা ভাষা জানবে সে এমন কী হাতি-ঘোড়া ব্যাপার! পরে, বোধের আপেল না পেয়ারায় আরও কয়েক কামড় বসানোর পর, জানা গেছে, বইয়ের সেই বাংলা যে-সে বাংলা নয়, অনেক কাল ধরে অনেকের উদ্যোগে সংস্কৃত সাধুত্বের ধড়াচূড়া আলগা করা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ পৃষ্ঠপোষিত চলিত বাংলা। চলিত, কিন্তু প্রমিত চলনে মান্য। সে-ভাষা সবাই জানত না কারণ, কলকাতা আর তার আশপাশের এলাকা ছাড়া কোথাও কেউ ওই ভাষায় কথা বলত না। ওটা ছিল না কি ঘটিদের ভাষা। ঘটিদের ভাষা? না কি, বইয়ের ভাষা! এই দেখো, ‘ঘটি’ বললে ‘বাঙাল’ উচ্চারণ এসে পড়বেই! একদিকে বাঙাল না থাকলে, অন্যদিকে ঘটি কেউ থাকে না। দুনিয়ায় আগে কে এসেছে? বাঙাল না ঘটি?

যে-ই এসে থাক, একজন জন্ম দিয়েছে আর একজনের। নদীর এদিকে উত্তরে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে যেখানেই যান-না কেন এবং নদীর ওদিকে পূর্বে সর্বত্র রবীন্দ্র-অবনীন্দ্রের ভাষা ইস্কুলে শিখতে হত, এখনও হয়। ওদিকে বরিশাল, কুমিল্লা কিংবা, চাটগাঁর ওরা যেমন ঘটি নয়, এদিকে বাঁকুড়া, বীরভূম কিংবা, পুরুলিয়ার এদের মধ্যেও ঘটিত্ব কিছুমাত্র নেই। তবে, নদীর ওদিকে ওরা আগেও না কি ছিল বাঙাল, কলকাতার ঘটিরা বলত।

পূর্ববঙ্গের জমিদারেরা, যাদের প্রজাদের মধ্যে সংখ্যাগুরু ছিল মুসলমান চাষা, আসতেন ভারতের রাজধানী কলকাতায় কেউ কারবার, কেউ ফুর্তি করতে।  অনেকেই থেকে যেতেন। বাঙালত্ব ঘুচিয়ে ঘটি হতেন সম্ভবত, যদিও ঘটি শব্দের উদ্ভব অত পুরনো নয় মনে হয়।

 নদীর এদিকে কলকাতার বাইরের মানুষদের বিষয়ে কারও মাথাব্যথা কোনও কালেই ছিল না, এদের নামকরণও তাই হয়নি। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা আধুনিক অভিজাত সংস্কৃতির গর্বে ধরা কে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে থাকতেও পারে। ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া কিছু তো থাকেই। একসময়, বিশেষ করে, দেশভাগের পর এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পরে তো বটেই, আসা-যাওয়া ও বলা-কওয়ার কাঁটাতার পেরিয়েই সম্ভবত, দেখা গেল বাঙাল পতাকা উড়ছে পতপতিয়ে কলকাতায়। বাঙাল প্রতিস্পর্ধার সামনে কলকাতার ঘটিরা দেখা গেল নেহাতই দুর্বল সংখ্যালঘু। কলকাতা দেশের রাজধানীও আর রইল না। তারপর যখন রাজা-গজা আর নেই তখন, মন্ত্রী-সান্ত্রিরা প্রায় সকলেই দেখা গেল বাঙাল। হাজার হোক, নদীর এ-পারে ঘটিদের অনেকেরই শিকড়ও যে ছিল ও-পারেই। তারা বস্তুত স্মৃতিভ্রংশ বাঙাল-টার্ন্‌ড-ঘটি। ফলত, দলভারী করার চেষ্টা কলকাতার কোণঠাসা ঘটিদের তরফে কিছু হয়ে থাকতে পারে। পাশাপাশি, দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভ করে আমোদ নেই। নেই সেই পরাক্রমের দামামা বাজানোর ফুর্তি। ফলত, হতমান ঘটি সম্ভ্রম ও আগ্রাসী বাঙাল বীরত্ব একযোগে বিভক্ত বঙ্গে ঘটি সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করার যজ্ঞ শুরু করল।

নদীর পশ্চিমে পুরুষানুক্রমে বাস করা সবার পশ্চাদ্দেশে “টেস্টেড অ্যান্ড সার্টিফায়েড” মার্কা বসে গেল। কারণ, তাদের ভাষা হয় ছিল না, আর থাকলেও, কেউ সে-ভাষা জানতে চায়নি। কর্তৃপক্ষের অনপনেয় গালা সীল মোতাবেক, পশ্চিমবঙ্গীয়রা সকলেই ঘটি। গুড! বাঙালের ভাষা কী? কেন, যে-ভাষায় বিক্রমপুরের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ফিল্মে বুকনি ঝাড়তেন। বেশ, বাঙালের তাহলে ওই একটাই ভাষা! ঘটি ভাষা কী? কেন, আলালী জামিয়ার ছেড়ে, হুতোমি নকশাদার আলোয়ান খুলে, ভানুসিংহ চোগা-চাপকান গায়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যে-ভাষায় লিখে গেছেন। তা ভাল, বাঁকুড়ার ভানু কোন ভাষায় কোন ফিল্মে কথা বলে গেছে, বই লিখেছে? ইয়ে, গেছেন, লিখেছেন? এর জবাব হয় না। বরং, প্রশ্ন আসে মনে, বাঁকুড়ার ভানুটা কে? কোন হনু? কলকাতার বাইরে সে কোন বাংলার বাঙালি? তবু, “মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলে খেলা হয়েছে, দু’দলের একদল নয় …”। দলাদলি শুরু করল কারা? দল গড়ে দ্বন্দ্বের সূচনা কাদের চেতনায়! গ্যালারির লোক জানে কি না বলা মুশকিল। মাঠের মধ্যে যার মাথায় মাথাল, হাতে পাচনবাড়ি, সে জানে না নিশ্চিত। কলকাতার ঝরঝরে কিন্তু পরিশীলিত বাংলায় অবনীন্দ্রনাথ কার জন্য ‘রাজকাহিনী’ লিখলেন! সে-কাহিনি পড়ল কারা? ঘটি না বাঙাল? যে-ই পড়ে থাক, পিলচু হাড়াম, পিলচু বুড়ির গল্প এরা কেউ জানল না। জানল না, কুশমেটিয়া আদরে মানুষ রাজা রঘুনাথ সিংহের বংশ বিষ্ণুপুরে চৈতন্যভক্ত হয়ে গেল কেমনে। ভাষা-বিতর্ক কলকাতার বাইরে বেরতে পারল না। চিনতে পারল না বাঙালির ভাষার বৈচিত্র্য। ঘটি-বাঙাল মন্থনে ভাষা-বৈচিত্র্য হারিয়ে তৈরি হল বাংলা লেখ্য ভাষা। সে-ভাষায় বাঙালির কাহিনি শিল্পীর কলমে রূপ পেল না। ইতিমধ্যে, বঙ্গের রাঢ় ও সীমান্তরাঢ়ের জমিদাররা, যাদের প্রজা ছিল আদিবাসীরা, রাজা উপাধি নিয়ে ব্রাহ্মণ বহাল করে মান্য তৎসম শব্দে চোদ্দ পুরুষের রাজ-কাহিনি লিখিয়ে নিল। সবাই রাজপুত, সবাই এসেছে রাজপুতানা থেকে, সবই রাজা মান সিংহের সঙ্গে। রাজা মানেই তাহলে রাজপুত। সেই বিশ্বাসেই কি রচিত চলিত ‘রাজকাহিনী’! নইলে, প্রবল পরাক্রমী সম্রাটরাও যে দামোদরের দক্ষিণে মৌরসি পাট্টা গাড়তে পারেননি সেই গল্পও কিছু থাকত। দেখতে দেখতে অনেকেই পড়ল শিল্পীর ভাষায় আঁকা রাজপুত-রাজপুতানির গল্প। গল্প কিছু ভিল-ভিলনীরও। তারা কমই প্রতিবাদী, বেশিটাই পোষ্য। শিল্পীর আঁকা সেসব ছবির পাঠ সকলের চোখে এক রকম হয় না। সবাই কলকাতার ময়দানে খেলা দেখতে যায় না। অনেকে, বস্তুত, পাত্তাই দেয় না। আমার মতো অনেকেই ‘রাজকাহিনী’ পড়েছে বেশ বেশি বয়সে, তাও সে-বই পাঠ্য কেতাবের অবতারে আবির্ভূত বলে। মোহনবাগান আমার ক্লাব নয়, ইস্টবেঙ্গলের হয়েও এক পয়সার বাজি ধরি না। অপরূপ শিল্পিত রচনা ‘রাজকাহিনী’ সব বাঙালি শিশুর মনের কাহিনী নয়। এ-কথাটা প্রথমেই বলে রাখা যাক। তাতে খেপে গিয়ে বাঙাল আর ঘটি দেশি-বিদেশি খেলোয়াড় ভাড়া করে যে-যাকে যত গোলই দিক। বাঙালির ভাষা একটা নয়।

জানি না আমার নিজের ভাষাটা ঠিক কোন বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার যে গ্রামে আমার পিতৃপুরুষের বাস, যেখানে আমার জন্ম, সেখান থেকে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার মলুটি গ্রাম, যে-গ্রামে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের এক তরফের বাস, দূরত্ব চোদ্দ কিলোমিটার। এই নৈকট্যেও ভাষা বদলে যায়। মুখে মুখে চলে আসা গল্প শোনা যায় সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এবং রাজা বাজ বসন্ত রায়ের। রাজা আরও ছিল এ-অঞ্চলে। রাজনগরে সেকালের আফগান রাজাদের মাঠে একালেও হাট বসে। অনেক রকমের বিকিকিনি। সেকালের রাজাদের নাম আসাদুল্লা খান, জুনেইদ খান, এই রকম। নবাব-বাদশা-সুলতান কেউ বলে না। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে আমার বহুমূল্য স্কুলশিক্ষা জুটেছে পশ্চিমবঙ্গেরই পাঁচ জায়গার ছ’টি প্রতিষ্ঠানে। বাল্যে পায়ের তলায় এমন সর্ষে জুটলে, অনেক ভাষা চিনতে চিনতেও, বইয়ের ভাষাটাই বেশি চেনা হয়, সেসব বই যারাই লিখে থাকুন না কেন। বয়স তখন দশ কি এগারো, ঘটনাচক্রে বাবা তখন বীরভূম জেলারই এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত। আমিও তাই সেই গ্রামের স্কুলের ছাত্র। নতুন ক্লাসের পুস্তক তালিকায় ছিল ‘রাজকাহিনী’ – বেঙ্গলি র‍্যাপিড রিডার! বাবা যেদিন বইটা কিনে দিল, সেদিনই খুবই র‍্যাপিডলি পড়া হয়ে গেল। আজ আর ঠিক মনে পড়ে না, দ্রুতপাঠ ব্যাপারটা জীবন থেকে ঠিক কবে হারিয়ে গেল! তাতে ভাল না খারাপ হয়েছে বুঝি না সেও। সে-বইয়ের গল্পগুলো ছিল রূপকথাই বটে, কেমন একটু অন্যরকম। রাজা, রানি, রাজপুত্র, রাজকন্যা সবই আছে, কিন্তু রাক্ষস-খোক্কস, দত্যি-দানো নেই। মুসলমানরা আছে। রাজা আর রাজপুত্ররা তাদের সঙ্গেই বেশি লড়াই করে। ঘোড়াও আছে, তবে তারা ডানাওলা পক্ষীরাজ নয়। আর আছে কাঠকুড়ুনি দুঃখিনী দুয়োরানি, সব গল্পেই থাকে। আমার দিদিমা এক পাতনা-হটমটি পেতনির গল্প বলত। তেমন গল্প নেই দেখলাম। পাতনা গোছের প্রান্তিক শব্দও নেই কোনও গল্পে।

আমাদের ক্লাসে অঙ্কে একশোয়-একশো পাওয়া অবিসংবাদী ফার্স্ট বয় মতিউর রহমান। ঘটি যে নয় সে ওর ভাষাতেই মালুম। ডাক নাম বুড়ো, বোধহয় পাকা ছেলে বলে, সবাই ডাকে বুড়্যা। তার দাদা তেমনই বুজু থেকে বুজ্যা, ভাল নাম হাবিবুর রহমান, বিভিন্ন ক্লাসে বার কয় ফেল করে ভাইয়ের ক্লাসমেট হয়েছে। আমার ডাক নাম সুকু, বন্ধুরা ডাকে সুক্যা। রামপুরহাটেও বুড়ো ছিল, লোকে ডাকত বুড়্যো। বুজুকে বুজ্যো। আর, আমাকে সুক্যো। মাত্র ষোল-সতেরো কিলোমিটার যেতে-না-যেতে আকার বদলে ও-কার হয়ে যায়। বাবার কোয়ার্টার, আমাদের বাসস্থান, ছিল বড় রাস্তার ধারে। সেদিন রবিবার। দুপুরে বাড়ির সামনে দঙ্গল পাকিয়ে মার্বেল খেলছি। দেখি, বুড়্যা নলহাটির দিক থেকে গরুগাড়ি ডাকিয়ে ফিরছে, সঙ্গে দাদা বুজ্যাও আছে। দেখে ছুটে গেলাম। বুড়্যা গাড়ি দাঁড় করাল। লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে। আমার হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে গেল, পরে বুঝলাম দাদা বুজ্যা যাতে আমাদের কথা শুনতে না পায়। বলল, “সিদিন ইস্কুল থিক্যা বুকলিস্টি দিলে। বাপকে যেঞে বুলল্যাম। বাপ চোখ ফেড়ে লিস্টি দেখল্যে না পয্‌যুন্ত। কেদ্যা-হাতে ধানের পাঁজা আর খড়ের পালুই দ্যাখিঞে বুইল্‌ল্যে, দাঁতফ্যাড়ার বেটা, মাহাজুনের কাছকে বেচি আয় তবে জানব তুর লিস্টিফিস্টি! খ্যাল কর, সুক্যা, আমু যেতি দাঁতফ্যাড়ার বেটা বটে, মুর বাপ থাল্যে দাঁতফ্যাড়া হয় কি না হয়! বুলব্যে কে! বুলল্যেই পিঠে কিল মেরি হুঁক লাগিঞ দিবে। তো, আইজ ঘরের পড়া ফেলাঞে গরু ডাকিঞে গাড়ি লিঞে যেল্যাম শালো মাহাজুনের আড়ত-কে ধান বিচতে …”
“কেন”, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, “তুই কেন? কাল অঙ্কের স্যার সারা সপ্তাহের পড়া ধরবেন ক্লাসে! বুজ্যা একা গেলেই তো হত। ও ধাড়ি ছেলে, পড়াতেও মন নাই।”
“না”, বুড়্যা ঘাড় নাড়ে, “উ শালো …”
উ শালো! আজ এতদিন পরে ভেবে ভিরমি যাই আর-কী! বুল্যা তার সহোদর ভাই বুজ্যাকে বলছে শালা! অবনীন্দ্রনাথের গল্পে এমন অনাচার কোথাও নেই, গল্প হলেও। অথচ, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমার চেনা সকলেই এমন কদাচারে ছিল অভ্যস্ত। কেন! আমি নিজেই তো মামাতো ভাইকে উঠতে-বসতে শালা বলতাম!
বুড়্যা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, “উ শালো বুজ্যা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ পারে না খো। অখে একা পেঞে মাহাজুনে ঠকিঞ লিবে। তাই আমু সাথ-কে যেল্যাম। গাড়ি-ভরা ধানে বাপের হিস্যাবটো ছেল দু’শো। আমু দরাদরি করে বেচল্যাম দু’শো দশে। ঘর-কে যেঞে বাপকে সি ট্যাকাগোলা সবটো ধরি দিলে মুর খানিক-আধেক ইজ্জত হয়। কিন্তু, দুব না খো।”
“সে কী রে!” চোখ কপালে তুলে বলি, “দশ টাকা মেরে দিবি! করবি কী?”
বুড়্যা হাসে, “করব্য! করি ফেলাইলছি।”
“কী করে ফেলেছিস?”
“একটো কলম কিনল্যাম”, বুড়্যা জাদুকরের হাত থেকে বাগিয়ে আনা জাদুদণ্ডের মতো নাচায় ঝরনা কলম, “দ্যাখ-সে! আর এক দোয়াত কালি। তাথেই খসি যেল সাত-সাতটো ট্যাকা। থাকে মোটে তিন। অই দিঞে দিস্তা খাতাও কিনতে লাগে। দুকানে রাজকাহিনীর দাম বুলল্যে বারো ট্যাকা। এবেটি আমু কী করি!”
“তাই তো! কী করবি?”
“ভাবছি”, বুড়্যা ভাবুক মুখে বলে, “র‍্যাপিড রিডার বটে, আর তো কিছু লয়, উই বইটো নাই কিনল্যাম।”
“কিন্তু, পড়তে তো হবে”, আমি চিন্তিত সুরে বলি, “পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। না পড়ে লিখবি কী করে?”
“তু ক’দিনের লেগ্যে দে ক্যানে। পড়ি লিঞে ফিরত দুব, জাহান শা’র কির‍্যা।” জাহান শাহ্‌ অঞ্চলের জাগ্রত পির। কবেকার লোক কেউ জানে না। তাঁর মাজারে নিয়মিত চাদর চড়ে।
বললাম, “তা না হয় দিলাম। কিন্তু, বই পড়বি আজ, পরীক্ষা একটা ছ’মাস, আর একটা এক বছর পরে। পড়া মনে থাকবে?”
বুড়্যা একগাল হাসে। বলে, “থাইকব্যে।”
“আচ্ছা, দেব। কিন্তু, শালা, ফেরত দিবি মনে করে।”
“দুব রে, শালো!” বুড়্যা আমাদের কে-জানে-কোন সম্পর্কের বৈধতা দিয়ে হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠল। দাদা বুজ্যাকে পাশে নিয়ে গাড়ি ডাকিয়ে চলে গেল।
পরদিন স্কুলে গিয়ে ওকে বইটা দিলাম। তারপর সপ্তাহ ঘুরে গেল। বুড়্যা আর বই ফেরত দেয় না। রোজই বলি, সেও বলে, “দুব, দুব।” কী ব্যাপার! বইটা তো আমি একদিনে পড়ে ফেলেছি। বুড়্যা আমার চেয়ে বুদ্ধিমান, ওর এত দেরি লাগছে কেন!

দিন দশ-বারো পরে বুড়্যা বই ফেরত দিল। জিজ্ঞেস করলাম, “গোটা বইটা মুখস্থ করে নিলি না কি রে?”
“ব্যাপার খানিক তেমুনই বটে।” বুড়্যা ব্যাগ থেকে খাতা বের করে। দিস্তা কাগজ সুতো দিয়ে সেলাই করে, ইয়া মোটা খাতা বানিয়েছে। সাদা মলাটে বড় বড় করে রয়্যাল ব্লু কালিতে লিখেছে ‘রাজকাহিনী’, ‘শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। খাতা হাতে নিয়ে পাতা উলটে দেখি বইয়ের গল্পগুলো পরপর তাতে লেখা। অবাক হয়ে বলি, “গোটা বইটা কপি করলি!”
“হিঁ”, বুড়্যা ঘাড় নাড়ে, “করি ফেলাইল্যাম। গল্পগোলা মুখস্থ হঞে যেলছ্যে।”
“কেমন লাগল? দারুণ, না?” খাতা ফেরত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“খারাব লয় খো। তবে যেঞে”, বুড়্যা মুখ তুলে আমাকে দেখতে দেখতে বলে, “বইখ্যান সবকার লেগ্যে ল্যাখেনি খো।”
মানে! অবাক হলাম। অনেকদিন পরে একদিন, বইটা আবার পড়তে গিয়ে মনে হল বুঝলাম। বাঙালি হয়েও আমি যে রাজপুত রানা সঙ্গ কিংবা, বীর হাম্বিরের সঙ্গেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম মনে মনে, সে কোন কারণে! আর, আমাদের বুড়্যা! আমারই মতো ভেতো হলেও, ওর নাম মতিউর রহমান। আমি যদি রানা চণ্ড কি মহারানা পৃথ্বীরাজকে নিজের লোক মনে করতে পারি, কে বলবে ও আলাউদ্দিন খিলজি বা বহলোল লোদির কেউ হয় কি না!
পরীক্ষায় সব বিষয়ের মতোই, রাজকাহিনীর প্রশ্নের উত্তর লিখেও হায়েস্ট মার্ক পেল বুড়্যা। ওর দাদা বুজ্যা আবার ফেল করল, বলল আর পড়বে না। ওদের বাবা বলদের লেজ মুচড়ে জমিতে হাল চালায়। ঘোড়ায় চড়তে পারে না। আমার বাবাও পারে না, অফিসে কলম পেষে।

রাজপুতানার ইতিহাস আর বাংলার ইতিহাসে তফাত আছে। বাঙালি এককালে যুদ্ধ করেছে আগ্রাসী রাজপুতদের বিরুদ্ধে। অবনীন্দ্রনাথ বাংলার কাহিনি আঁকলে, বুড়্যা আর আমি হয়তো একসঙ্গে কখনও দেবপালের হাতিতে, কখনও আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ঘোড়ায় চড়ে স্বপ্নসফর করতে পারতাম। বসন্ত রায়ের মতো দৌড়তে পারতাম বাজের পিছনে। তখন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে, এখান থেকে দেখতে পাওয়া যেত চিতোরের অনেকটা আগে গঙ্গার পারে গৌড়, আর একটু পশ্চিমে পাটলিপুত্র আর, চিতোর থেকে অনেকটা দূরে আমু দরিয়ার তীরে তেরমিজ নগরী। বাপ্পাদিত্যের গল্পে পূর্বের “হিন্দুস্থান” আর পশ্চিমের “ইরানীস্থান”-এর মাঝখানে এক নোম্যান্‌স ল্যান্ডের গল্প খানিকটা এমনই তো লিখেছেন অবনীন্দ্রনাথ – “হিন্দুরা তাদের মহারাজকে চিতায় তুলে দিতে চাইলে, আর নৌসেরা পাঠানের দল তাঁকে মুসলমানের কবর দিতে ব্যস্ত হল। শেষে যখন একপিঠে সূর্যের স্তব আর একপিঠে আল্লার দোয়া-লেখা প্রকাণ্ড কিংখাবের চাদর বাপ্পার ওপর থেকে খুলে নেওয়া হল, তখন সেখানে আর কিছুই দেখা গেল না –”
অবনীন্দ্রনাথ কি ভেবেছিলেন তাঁর আঁকা কাহিনিগুলি মুসলমান ছেলেমেয়েরা পড়বে না! বিংশ শতকের গোড়ায় শিক্ষিতের হার কোথায় কত, পণ্ডিতেরা সে জানতেন হয়তো। আর, পড়লেও, স্বপ্নের গল্পে শিল্পী বেখেয়ালে রূপকথায় কারও জন্য কোথাও বিষাদ বরাদ্দ করে বসলেও, শিল্পের মহিমায় সে সোনামুখে কান্না গিলে নেবে না কি!

মতিউর রহমান এখন কোথায় থাকে, কী করে, জানি না। বাপের সঙ্গে পাঁচ জায়গা ঘুরতে ঘুরতে বুড়্যাকে কবেই ভুলে গেছি। ও-ও কি মেয়ের বাপ হয়েছে! মেয়ের বাপের চোখের পর্দা থেকে থেকেই খুলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বছর চোদ্দ আগের কথা। মেয়ে তখন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ওর মা ওকে কিনে দিয়েছিল ‘রাজকাহিনী’। ল্যাপটপে ম্যানেজারিয়াল ইকোনমিক্সের ক্লাসনোট রেডি করছিলাম না ফরমায়েশি গল্প লিখছিলাম মনে নেই। মেয়ের ঘর থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে গেলাম। সে তার খাটে বসে আছে দু’হাতে মুখ ঢেকে, কোলে ‘রাজকাহিনী’। খাটে বসে কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে, মা! কী হল?”
মেয়ে আমাকে এক মুহূর্ত দেখল। পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে বলল, “বাবা, গায়েবীর কী কষ্ট!” বলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল।
গায়েবী! ওর কোল থেকে বিছানায় গড়িয়ে পড়া ‘রাজকাহিনী’ তুলে নিয়ে দেখলাম। গল্পের নাম ‘শিলাদিত্য’।

শিলাদিত্য গল্পের ছবি

মনে পড়ল গায়েব আর গায়েবীর কথা। ওর বয়সে যখন নিজে পড়েছিলাম, গায়েবীর কষ্টটা তত বুঝিনি। গায়েবী পাতালে প্রবেশ করল। দুঃখের কথা ঠিকই, গায়েবীকে পাতালে না পাঠালেই বোধহয় ভাল হত। কিন্তু, গায়েব শিলাদিত্য হয়ে ফিরে এলেন। স্বপ্নে শুনলেন কে ডাকছে, “ভাইরে!” শিলাদিত্য এলেন, মন্দির মুড়ে দিলেন সোনায়। গায়েবীর স্মৃতি তাতেই চাপা পড়ে গেল। সোনার উপরে কথা কী আছে! যেমন শিলাদিত্য, তেমনই শাহজাহান। সোনায় মোড়া এঁর বোনের সমাধি। শ্বেতপাথরে ওঁর বেগমের কবর। তাজমহল দেখতে গিয়ে কে মনে করে আর্জুমন্দ বানু বেগমের কথা! মারা গিয়েছিলেন চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে। আহ্‌! মমতাজ মহল! মম তাজমহল! আহা!

সেদিন মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর আবার পড়লাম ‘রাজকাহিনী।’ প্রথম মনে প্রশ্ন জাগল, গায়েবীকে গল্পে আনার কী প্রয়োজন ছিল! জন্মের পর পাতালে প্রবেশ করা ছাড়া বাঁচার আর কোনও লক্ষ্যই তার জন্য কেউ নির্ধারণ করেনি। আত্মনির্ধারণের অধিকারও দেয়নি। তবে কেন! আস্তে আস্তে বুঝলাম, দস্যি বালক গায়েবের জন্ম দিতে অভাগা মা সুভাগার প্রয়োজন ছিল নিতান্তই জৈব-সামাজিক কার্যকারণে। ভাবী রাজার জন্মের মাহাত্ম্য প্রতিপাদনে জরুরি ছিল মায়ের সতীত্বের প্রমাণ। সুভাগার পুড়ে মরা ছিল ভবিতব্য। আর, গায়েবী! ক্ষমতার নিষ্ঠুর যান্ত্রিক বুননে দিগ্বিজয়ী রাজারও শাসনের প্রয়োজনে প্রজার মনে গাঁথতে হয় নিঃস্বার্থ ভালবাসা, নিঃশর্ত সমর্পণ এবং প্রতিবাদহীন নির্বাসনের বোধ। মানবী গায়েবীর সঙ্গে সম্পর্কিত না হলে, রাজা শিলাদিত্য রাক্ষস ছাড়া কিছু নয়।
বইয়ের মলাট মুড়ে ভাবলাম, এ আর ওর পড়ে কাজ নেই, নিয়ে যাই, লুকিয়ে রাখি কোথাও। কেন জানি না, বই ওর ঘরে যেমন ছিল তেমনই রেখে চলে এলাম। মেয়ে পড়ে শেষ করল। কাঁদতে শুনিনি আর। মেয়েজীবনের মূলকথাটা ওই বয়সেই বুঝে নিয়েছে বুঝি।
বছর চার পরে ক্লাস সিক্সে ওদের বাংলা দ্রুতপাঠের তালিকায় দেখা গেল আছে ‘রাজকাহিনী’। চার বছর পরে আবারও সে পড়ল কান্না পাওয়ানো কাহিনিগুলি। পড়ে-লিখে নতুন ক্লাসে উঠল। লায়েকই হল-বা! পুরনো বইও চলে গেল কোথায় কে জানে। মেয়ের কান্না ততদিনে বাপের বুকে ঝরনার মতো লুকিয়েছে শুকনো ঘায়ের নীচে কাঁচা ক্ষতের মধ্যে। বেশি অনুভব করতে গেলে ব্যথা লাগে।
সম্পাদককে শুনিয়েছিলাম সে-কথা কথায় কথায়। উনি বললেন, তুমি লেখো। অতএব …

অতএব, সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, “বইটা কোথায় রে?” ও গায়েবীর পাতালপ্রবেশ আবিষ্কার করার চোদ্দ বছর পরে।
বলল, “দেখো না, ওদিকে কোথাও থাকবে।”
দেখলাম। ওর তাক থেকে বইটা খুঁজে এনে রাখলাম নিজের টেবিলে। এ-মলাট থেকে ও-মলাট পড়লাম। জাদু তো আছেই। কিন্তু, কয়েকটি জায়গায় ছাড়া বছর পঁয়তাল্লিশ আগের মতো সম্মোহিত হলাম না। মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম ওর মতামত। বলল, “বাবা, প্রথম যখন পড়েছিলাম, ছবির মতো দেখেছিলাম, অনেককিছুই বুঝতে পারিনি, অনেক জায়গায় ভয় পেয়েছিলাম। পরে যখন ক্লাস সিক্সের সিলেবাসে পড়লাম, ভয় তত লাগেনি, দুঃখও কমই, ছবি তখনও দেখলাম, বুঝলাম অনেকগুলোই বানানো ইমেজারি …”
“চিত্রকল্প!”
“ঠিক”, মেয়ে হাসে, “চিত্রকল্প। শিল্পী এঁকেছেন, আকর্ষণ তার তো থাকেই। কিন্তু, ইমেজারির পিছনে ইমেজটা আজ চোখে পড়ে যায়।”
“চিত্রকল্পের পিছনের চিত্রপট?”
“বলতে পারো।”
“আর একবার পড়ে দেখবি, আজ কেমন লাগে?”
“না।”
“কেন রে!”
“বাবা, ওটা ভাল বই, কিন্তু পুরনো। নতুন আরও অনেককিছু আছে পড়ার। নতুন চিত্রকল্প। তার চেয়েও বেশি, নতুন চিত্রপট। আর”, মেয়ে স্পষ্ট বলে, “ওটা ছেলেদের যত ভাল লাগে, মেয়েদের তত লাগে না।”
আমি আর কথা বাড়াইনি। ভুল তো বলেনি মেয়ে। গায়েবী পাতালগমন করল, সতীত্ব রাখতে রানি পদ্মিনী পালন করলেন জহরব্রত, ছেলের কাছে সতীত্ব প্রতিপাদনার্থ সুভাগা চিতায় আরোহণ করলেন। বাকি নারীরা রাজকাহিনীতে একটিই কাজ করেছেন, মায়ের মতো মা হয়ে ছেলে মানুষ করেছেন, রাজপুত্রকে করে তুলেছেন রাজসিংহাসনের উপযুক্ত। তারপর “লছমীরানী হাম্বিরকে সিংহাসনে বসিয়ে উজলাগ্রামে তাঁর বাপের বাড়ি চলে গেলেন তাঁর সেই ছেলেবেলার ঘরে নদীর পারে খেতের ধারে।”
অসম্ভব লিরিক্যাল। অসাধারণ চিত্রকল্প। মুগ্ধ মনে প্রশ্ন জাগতেই পায় না। বহু পাঠের পর কখনও ক্লান্তির ঘোরে হয়তো জানতে ইচ্ছে করে – লছমীরানিকে নদীর পারে খেতের ধারে তাঁর সেই ছেলেবেলার ঘরে জায়গা দিতে অপেক্ষায় আছে কে? মা-বাপ তো বেঁচে নেই আর। লছমীরানি নিজেও আর নন ছেলেমানুষ। জনারের শিষে বুনো শুয়োর গেঁথে ফেলার ক্ষমতা কি তখন আর তাঁর আছে!

 ‘রাজকাহিনী’ অনেককিছু। অনেক ছবি। বিংশ শতকের গোড়ার হিন্দু বাঙালি মনের ছবিও আঁকা হয়ে গিয়েছে ত্রয়োদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতকের রাজপুতানার বীর রাজাদের গল্পে। ছবির শেষে অনেক প্রশ্ন। আজকের সময় একশো বছর আগের সময়কে প্রশ্ন করতে পারে কি না নিশ্চিত নই। নিঃসন্দেহে, অতীতকে কাঠগড়ায় তুলে সওয়াল করে লাভ নেই। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা ভাল আগামীর দিকে তাকিয়ে। রাজকাহিনী আজ লিখিত হলে, শৈলী অক্ষুণ্ণ রেখেও, তার পাঠ কিছু ভিন্ন হত।

বিংশ শতকের শুরু থেকে, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ প্রমুখের কলমে বাংলা সাহিত্যে যে ধারাটা ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যে ধারার লেখা বাঙালি পাঠক আজও পছন্দ করে, সে ধারায় লেখার প্রবণতা আজও সম্ভবত বেহদ্দ আত্যন্তিক। এতেই প্রমাণ এই লেখকদের অবদান, তাঁদের তৈরি ঘরানার দীর্ঘস্থায়ী প্রতাপ। এই ঘরানার সাহিত্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি বিষয় হয়তো লেখার লিরিক্যাল চরিত্র এবং তাতে চিত্রকল্পের যুগপৎ নিবিড় ও বিস্তৃত ব্যবহার। বাঁশিওয়ালার পিছনে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে একদিন পাঠক ক্লান্ত হবে আশা করা যায়। চৌমাথায় পথ খুঁজে লেখকেরা তখন এই চৌহদ্দি ছেড়ে বেরবেন হয়তো। গান গাওয়া কলমে রচিত দুঃখী জীবনের সন্ধ্যারাগের রেশ দরবারি আসরের শেষে রাতের রোমান্টিক দীর্ঘশ্বাসে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না আর। লেখা ভারী হয়ে চেপে থাকবে চেতনায়।

জয়তু অবনীন্দ্রনাথ! একশো বছর কম নয়। ‘রাজকাহিনী’ আজও মান্য ভাষায় আঁকা অবশ্যপাঠ্য ছবির বই। হলেও, ভাষা স্থবির নয়। বাঙালির ভাষার বহুত্ব স্বীকৃতি পাবে অদেখা মাইল-ফলকে, কখনও। কাহিনী নতুন চেতনা পাবে, চৈতন্যও। সবটা তার রাজকীয় নাই-বা হল। নাম ‘রাজকাহিনী’ হলেও, সে তো আসলে সাধারণ মানুষেরই ছবি, মাটি-ঘাস-পুষ্পপত্রে রাঙানো। তাতে দুই বুড়ো চাচা আর মৈরকে বালিকা প্রশ্ন করেছিল, “আমাকে একদিন তোমাদের মাকে দেখাবে?” চাচা আর মৈর রাজি হয়েছিল। বলেছিল, “নিরালা ঘরে একটি পিদিম জ্বালিয়ে মা যেখানটিতে একলা বসে আছেন সেখানে আমরা সবাই মিলে চুপি চুপি চলে যাব।” বালিকা ঘুমের ঘোরে জিজ্ঞেস করেছিল, “হিঙ্গুলিয়া?” জবাব এসেছিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাকেও সঙ্গে নিতে হবে।”
সুতরাং, এই প্রবন্ধে আগের অনুচ্ছেদগুলিতে যা বলা হল তার সবটাই অর্থহীন করে দিল দুই বুড়ো আর এক বালিকা আর, চতুষ্পদ হিঙ্গুলিয়া। শিল্পীর খেয়াল যুক্তি দিয়ে ধরব বললেই কি ধরা যায়! ছবি দেখে স্তব্ধ হওয়া যায় শুধু।

লব্ধ প্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক। ওঁর গোয়েন্দা কাহিনী "গজপতি নিবাস রহস্য ধারাবাহিক ভাবে "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । "অন্য কোনোখানে" দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর আরেকটি ধারাবাহিক কাহিনী। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বৈবস্বত, জিয়ন নদী, অনিকেত, জন হাওয়ার্ড পেনের ডায়রি ইত্যাদি। প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থ - On the Trail of a Woman

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *