আরব্যরজনীর তারকারা
আর.জি.করের ঘটনা শুনে মনে পড়ছে চন্দ্রবিন্দুর একটি গানঃ ‘অঙ্ক কি কঠিন!’
কিন্তু সত্যিই এটা বোঝা কি রকেট বিজ্ঞানের মত শক্ত বিষয়? বিষয়টি কঠিন, না চাপা দিতে বিষয়টিকে কঠিন করে ফেলা হচ্ছে? বিষয়টির সমাধান হলে আমরা সমবেত ভাবে ‘চাটনি ও আচার’ খেতাম। কিন্তু যদ্দিন সমাধান না মেলে কলকাতা তো বটেই, সারা বিশ্বের মেয়েরা ঠিক করেছেন তাঁরা এটি ভুলতে তো চাইবেনই না, বরঞ্চ বারংবার লেবু চটকে তেতোটিকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেবে। কারণ এটি মিষ্টিমুখ প্রত্যাখ্যানের সময়, যেমন মেয়েটির বাবা দশলক্ষ টাকার লোভ এবং সমাজ মেয়েটির নামে সেতু বা পথ নামকরণের ললিপপের লালসার হাত থেকে নিজেদের উত্তীর্ণ করতে পেরেছেন। বা যেমন জেলেনস্কিকে আমেরিকা বিমানে পালানোর প্রস্তাব দিলে তিনি বলেছেন, “আমি রাইড নয়, আর্মস চাই।” পেরেছে এই ‘ক্ষণজন্মা সময়’-টি বলেই, মেয়েরা আজ সকলে রাত অধিকার করে আরব্যরজনীর তারকা।
তাই চটকানো লেবু আবারও বলে, এই সমাজে একটা ঘৃণ্য খুন হয়েছে, তাই আমরা শুধু ‘বিচার’ চাই। নতুবা এই ঘটনার ‘অবিচার’ প্রতিটি ঘরে ঘরে বিকৃত মানসিকতার অত্যাচারীকে আস্কারা, উৎসাহ ও উস্কানির বার্তা দেবে— যা থামানোর দায় মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে প্রশাসনের প্রতি আস্থাহীন মানুষের ঢল।
এই সমাজে ধরে নেওয়া হয় শাসনব্যবস্থার নামে এক ‘সরকার’ গঠিত থাকবে যাঁরা শহরের-জনগণের ভালোমন্দ ভাববেন। আছে পুলিশ প্রশাসন যাঁরা নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার দিকটি খেয়াল রাখবেন। কলকাতা পুলিশবিভাগকে তো একসময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হত। সঙ্গে আছে বিচার ব্যবস্থা যাঁরা ‘বিচার পদ্ধতি’ দেখাশোনা করেন, কোন সমস্যা ঠিকপথে সুবিচার না পেলে তাদের দ্বারস্থ হয় মানুষ। এই প্রত্যাশাগুলো ‘ফ্রি ডেলিভারি’ নয়, এর বিনিময়ে আমরা আয়কর দিই, ভোট দিই, জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি।
আজ তাই কড়ায় গণ্ডায় হিসেব নিতে, সাধারণ মানুষের মুখে দুটি সহজ কথাঃ
১) বিচার চাই,
২) দুষ্কৃতকারীর শাস্তি চাই।
তাঁকে ফেরানো যাবে না, কিন্তু তাঁর মৃত্যুকে যেন ব্যর্থ হতে না দেয়া হয়। এই চাওয়া কি খুব বেশি চাওয়া? এ কি খুব দুর্বোধ্য বিষয়, যা সারা বিশ্বকে রাস্তায় নেমে চিৎকার করে বোঝাতে হবে?
নৃশংসতার একটা সীমা আছে। নিহত কর্তব্যরত ডাক্তারটি একজন মহিলা। তাঁকে বলাৎকার করা হয়েছে। তাঁর পেলভিক এবং কলার বোনে হাড় ভেঙে দেয়া হয়েছে, জননাঙ্গে ক্লেচার ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। পা-কে নব্বুই ডিগ্রী কোনে পাওয়া গিয়েছে। তাঁকে ফাঁস দেয়াতে চোখের মণি ফেটে রক্ত বেরোয়, সারা গায়ে ১০৮-টি কামড়। সেখানকার স্থানমাহাত্ম্য এত বেশি যে জ্যান্ত মেয়ে হাতের মুঠোয় না পেলে কিছু চিকিৎসাকর্মীরা মরদেহর মুখে ফিল্মি হিরোইনের ছবি বসিয়ে বলাৎকার করেন।
এই ঘটনা তাই অনেক কিছু শিখিয়ে গেল আমাদের। এই বর্বর ঘটনা ‘মুখোশ’ না খুলে দিলে আমরা ভুলেও ভাবতাম না যে আমাদের চারপাশে সভ্য পোশাকে ঘোরাঘুরি করা মানুষের আড়ালে এমন নৃশংস ক’জন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কে জানে!
আজ না চাইলেও মনে এসেই যায় যে টোপর পরা কারও বিয়েতে সাজা বরটি কি এদেরই একজন? পাড়াতুতো ভাই বলে যাকে রাখী পরাই ও ভাইফোঁটা দিয়ে এসেছি সে হয়তো ওদেরই একজন। নিজের দুধ খাইয়ে যে ছেলেকে বড় করেছি, রোজ ভাত বেড়ে দিই কলেজ যাবার আগে—তার মধ্যে কি এরা আছে? এটি ভাবতে না চাইলেও, ভাবনাটি স্বাস্থ্যকর না হলেও, একটা অবিশ্বাস-আশঙ্কা-ভীতি —যা সমস্ত নারীপুরুষের মধ্যে ‘করোনা’ ভাইরাসের মতই সৃষ্ট ‘দূরত্ব ও দূষণ’-এর মত এক ‘অনিশ্চয়তার মেঘচ্ছায়া’ হয়ে থাকবে বহুকাল। এই বিশ্বাস টলে যাওয়াতেই পা টলে গেছে বিশ্বের মেয়েদের তাই তারা নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে আজ রাস্তায়।
নবজাগরণ আসে নতুন এক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে। সংবাদ মাধ্যমগুলো আজ ‘মধ্যপন্থা’ থেকে বেরিয়ে ‘উচিত’ কথা বলছে। এই ‘সময়‘-টি ক্ষমতাপ্রভাবিত বুদ্ধিজীবী চিহ্নিত করছে স্পষ্টভাষায়। যাঁরা সমাজসংস্কারের কথা বলেছেন, প্রশাসনিক সংস্কারের কথা এড়িয়ে গিয়ে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা রাখতে ‘ঘরবন্দীত্ব’ নিশ্চয়তা করছেন রাত্রের অধিকার রুখে দিয়ে। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটি মনে পড়ে যায়, “নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।”
আবার অন্যদিকে এও দেখছি, মেয়েটির পক্ষে চিকিৎসক সহকর্মীরা চাকরীর মায়া-ভয় তুচ্ছ করে তাঁরা বলেছেন শেষ না দেখে তাঁরা থামবেন না, তাতে আর.জি.কর. সিল হয়ে যায় যাক। ‘বিপ্লব‘ শব্দটি সহসা ঘটিত আমূল পরিবর্তনকে বলে। এই তো সেই সময়। কিন্তু প্রতিবিপ্লবে আর.জি.কর. প্রমাণ-লোপাটে কোটি কোটি টাকার লোকসানে ভাঙচুর। তাই ন্যায়-অন্যায়ের ‘টাগ অব ওয়ার’ অব্যাহত আজ। ফলাফলে, ‘ম্যায় কাল হুঁ—“কী বলবে, সেটাই দেখার।
কামদুনি, হাঁসখালি, যাদবপুরের র্যাগিং —সব কেসগুলো ‘গুম’ হয়ে গেছে। এই কেসটিও প্রমাণসাপেক্ষের অভাবে এত জনজোয়ারের দাবী নস্যাৎ করে বাতাসে বিলীন হবে কিনা জানা নেই। তবে কয়েকটি খুব সাধারণ প্রশ্ন অভয়া ওরফে তিলোত্তমা রেখে গেল আমাদের সামনে।
একটি সন্তান ঠিক মত পড়াশুনো করেছে। ঠিক মত উচ্চশিক্ষিত হয়ে চিকিৎসক হয়েছে। আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের কথা ভেবে, যে জায়গায় দুর্নীতি রয়েছে দেখে, একা হবে জেনেও প্রতিবাদের আঙুল তুলেছে। কোথায় তাঁর ভুল? কী তার অন্যায়? কেন তাঁর এমন নির্মম শাস্তি? তবে কি আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে অন্যায় দেখে সব মুখ বুজে চোখ-কান বন্ধ করে রাখতে বা নিজের প্রাণ-মান বাঁচাতে বলাৎকারীদের সঙ্গে দলে ভিড়ে মিশে যাওয়াই শ্রেয়? বলা হয়ে থাকে ‘লাইফ ইজ এ চয়েস।’ প্রতিটি ‘মুহূর্ত চয়ন’-এর মাধ্যমেই আমাদের যুক্তি ও দায়িত্ব প্রতিফলিত হয়। যেমন এই চেয়ারটি পাখার কাছে, ঠাণ্ডা লাগায় আমি এখানে বসব না। এমন অজস্র মগজচয়নে আমাদের ‘মন,’ ‘দিন’ ও ‘জীবন’ গঠিত হয়।
যে ‘চয়ন’ সমাজ বদলের কথা ভাবে তার নিধন হবে, আর যে ‘চয়ন’ সুস্থ মানসিকতাকে দমিয়ে বিকারগ্রস্ততার জয় জাহির করবে, সে টিকে যাবে – সে হতে পারে না আর কিছুতেই তা হতে দেওয়া যায় না বলেই, সব আরব্যরজনীর তারকারা আজ রাস্তায়।
শুধু তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায় আকাশের এক অবাক ‘অভয়া তারা’-র নির্বাক ভাষা…. “এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম। অবাক পৃথিবী সেলাম, তোমারে সেলাম।”
—–
ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে।