“ক্রিকেটের ভারতীয় ভগবান” কেমন অধিনায়ক ছিলেন?

“ক্রিকেটের ভারতীয় ভগবান” কেমন অধিনায়ক ছিলেন?

কাঁটার মুকুটধারী রাজা নাকি বিয়োগান্ত নাটকের নায়ক!

বাজার-চলতি কথায় অনেক সময় বলা হয়, “বার বার তিন বার,” অর্থাৎ তৃতীয় বারের প্রচেষ্টাতে নাকি ভাগ্য সহায় হয়ে থাকে! কিন্তু ক্রিকেট-দুনিয়ার আর জানা হয়নি যে ২০০৭ সালে চোট-আঘাতের ফলে শারীরিক সক্ষমতায় ক্রমবর্ধমান ঘাটতির কারণ দেখিয়ে তৎকালীন বিসিসিআই-সভাপতি শারদ পাওয়ার-এর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করলে শচীন তেন্ডুলকর ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে ‘সফল’ হ’তে পারতেন কিনা।

কেমন অধিনায়ক ছিলেন শচীন? এই প্রসঙ্গে বহু তাবড় তাবড় শচীন-ভক্ত হয় একটু ঢোঁক গেলেন, নাহয় ‘আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র’ নামক বস্তুটির ওপর যাবতীয় দায়ভার চাপিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে হ্যাঁ, ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে ওঁর গুণগান গাইতে ওঁর অতিবড় ভক্তকেও বিশেষ শুনেছি বলে মনে করতে পারিনা। সিকে নায়ডু (১৯৩২) থেকে রাহুল দ্রাবিড় (২০০৭) পঁচাত্তর বছরকার ভারতীয় অধিনায়কদের নিয়ে এক ভারতীয় ক্রিকেট-লেখকের এক বইতে ওঁর অধিনায়কত্বের অধ্যায়টার নামটাও বেশ ইঙ্গিতবাহী – “Uncomfortable in the Hot Seat,” তাই না!

 

সাম্প্রতিক বিজিটি-সিরিজে অ্যাডিলেড-টেস্টে পরাজয়ের পর আলগোছে চোখ বুলোচ্ছিলাম টেস্ট-ক্রিকেটে ভারতের জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যানে। রোহিত শর্মার নেতৃত্বে ২০২৪ সালে ভারতের চতুর্থ টেস্ট-পরাজয় একটা প্রায়শ-লুক্কায়িত তথ্য সামনে এনে দিল। সেদিকে একবার নজর দিই।

উপর্যুপরি পরাজয়ের কান্ডারী (নাকি ভান্ডারী!)

পরপর তিনের বেশি সংখ্যক টেস্ট-ম্যাচে পরাজিত ভারতীয় অধিনায়কদের তালিকা (সময়ের ক্রমানুসারে):

  • পতৌদির নবাব মনসুর আলি খান (৬) – ১৯৬৭ মরশুমে ইংল্যান্ডে হেডিংলি, লর্ডস, এজবাস্টন এবং ১৯৬৭-৬৮ মরশুমে অস্ট্রেলিয়াতে মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, সিডনি [অ্যাডিলেডে সিরিজের প্রথম টেস্ট-ম্যাচে উনি খেলেননি চোট-আঘাতের কারণে – চান্দু বোরদে অধিনায়ক ছিলেন।]
  •  শচীন তেন্ডুলকর (৫) – ১৯৯৯-২০০০ মরশুমে অস্ট্রেলিয়াতে অ্যাডিলেড, মেলবোর্ন, সিডনি এবং স্বদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর
  • মহেন্দ্র সিং ধোনি (৪) – ২০১১ মরশুমে ইংল্যান্ডে লর্ডস, ট্রেন্টব্রিজ, এজবাস্টন, ওভাল
  • মহেন্দ্র সিং ধোনি (৪) – ২০১৩ মরশুমে ইংল্যান্ডে রোজ বৌল, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ওভাল এবং ২০১৪-১৫ মরশুমে অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিসবেন [অ্যাডিলেডে সিরিজের প্রথম টেস্ট-ম্যাচে উনি খেলেননি চোট-আঘাতের কারণে – বিরাট কোহলি অধিনায়ক ছিলেন।
  • রোহিত শর্মা (৪) – ২০২৪-২৫ মরশুমে স্বদেশে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু, পুনে, মুম্বই, এবং অস্ট্রেলিয়াতে অ্যাডিলেড [ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথম টেস্ট-ম্যাচে উনি খেলেননি পারিবারিক কারণে – যশপ্রীত বুমরা অধিনায়ক ছিলেন। ।
পতৌদি
শচীন তেন্ডুলকর
এম এস ধোনি
রোহিত শর্মা

পতৌদি-কে তো এই শতকের বহু তরুণ ক্রিকেট-প্রেমীই বোধহয় ‘ছদ্ম-গৌরবান্বিত’ ও ‘সুবিধাভোগী’ অধিনায়ক হিসেবে দেখে থাকেন – ‘উদ্ধতমনা খামখেয়ালি হেরো ক্যাপ্টেন’ – যিনি ষাট-সত্তর দশকের ‘হেলাফেলা সারাবেলা’ টেস্ট-ক্রিকেটের জমানাতেও জিততে পারতেন না, বিশেষত বিদেশের মাঠে। তাই এই তালিকায় তিনি যে থাকবেন এতে আর আশ্চর্যের কী!

পতৌদি, ধোনি (তাঁর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে) ও রোহিত এঁদের এই ‘পরপর’ রেকর্ডে কিঞ্চিৎ ‘ভেজাল’ আছে, চোট-আঘাত বা পারিবারিক কারণে – সেটা উল্লেখ করেছি। এই ব্যাপারে ‘খাঁটি’ রেকর্ড কিন্তু ধোনি (প্রথম ক্ষেত্রে) ও শচীন এঁদের, আর সেখানে আবার এগিয়ে শচীন – তাঁর সংগ্রহে একটা বেশি হার এবং সেটা দেশ-বিদেশ মিলিয়ে, কারণ ধোনির দ্বৈত-কীর্তিই বিদেশে!

একবার তাহলে দেখি শচীনের দু’পর্বের অধিনায়কত্বের কিঞ্চিৎ খতিয়ান, টেস্ট-ক্রিকেট ও ওডিআই-ক্রিকেট দুইই। তারও আগে মনে করিয়ে দিই যে তাঁর মোট ২৫টা টেস্ট-অধিনায়কত্বের কালে তিনি মোট ২,০৫৪ রান করেছিলেন (সর্বোচ্চ ২১৭), গড় ৫১.৩৫, সাতটা শতরান ও চারটে অর্ধশতরান সমেত – তাঁর গোটা টেস্ট-জীবনের সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তবে সবিনয়ে মনে করিয়ে দিই যে অধিনায়কত্বের কালে শচীনের ব্যাটিংয়ের ছন্দ (form) বা প্রদর্শন (performances) নিয়ে বিশ্লেষণ এই রচনার উদ্দেশ্য একেবারেই নয়। কাজেই “অধিনায়কত্বের বাড়তি চাপ ওঁর ব্যাটিংয়ে কোনও প্রভাব ফেলেনি” এইজাতীয় ফরোয়ার্ড-ডিফেন্সিভ (বা আক্রমণাত্মক আপার-কাট) শট কেউ খেললেও বাড়তি বাহবা পাবেন না!

"এ ব্যথা কী যে ব্যথা, বোঝে কি আনজনে?"

শচীন বোধহয় কখনই ভারতীয় অধিনায়কের “হট সিট”-এ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তিনি ‘জন্মগত দলনেতা’ ছিলেন না। এটাও দেখা গেছে যে অধিনায়ক হিসেবে তিনি দুর্দান্ত কৌশলী ছিলেন না এবং ক্রিকেটের কৌশলগত দিক সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল গড়পড়তা।

তার ওপর নানা ধরণের বিভিন্ন বয়সের বিচিত্র মানসিকতার সহ-খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা, নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য এঁদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাঁর সহজাত মৃদু স্বভাব, যেটা সহজেই কম দৃঢ়তাপূর্ণ ব’লে মনে করবার সম্ভাবনা থেকে যায়, এবং ক্রিকেটীয় রাজনীতির প্রতি স্বভাবগত বিরাগ [যেমন আপাততুচ্ছ স্পর্শকাতর বিষয়, সাজঘরের রাজনৈতিক কূটকৌশল, অহেতুক প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি], এই সব মিলিয়ে অধিনায়ক হিসাবে তাঁর জীবনটাকে, দুর্বিষহ না হ’লেও, ক্রমশই অস্বস্তিকর করে তুলেছিল।

মাঝেমধ্যেই তাঁকে প্যাঁচালো দুনিয়ায় পথ-হারানো সাদাসিধে এক পথিকের মতন মনে হত। এক কথায় তিনি যেন ছিলেন একজন ‘অনিচ্ছুক অধিনায়ক।’ মহান খেলোয়াড়রা সবসময় মহান অধিনায়ক হন না, এই আপ্তবাক্যের আরেক উদাহরণ শচীন তেন্ডু্লকর – গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ব্রায়ান লারা, জো রুট এঁদেরই মতন। মনে হয় এঁরা খেলোয়াড় হিসেবে এতটাই প্রতিভাবান যে বাকি সহ-খেলোয়াড়দের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে কখনও কখনও কিছুটা যেন উদাসীন। অধিনায়ক হিসেবে, দলের একটু-পেছিয়ে-থাকা কয়েকজনকেও যে ‘ইহাদেরও পথে, নিতে হবে সাথে,’ এই মানসিকতা নিয়ে  চলতে হবে সে ব্যাপারে এই ‘কান্ডারী’-রা বোধহয় মাঝে মাঝে ‘হুঁশিয়ার’ থাকতে ভুলে যেতেন (অথবা অক্ষম ছিলেন)।

শচীন মাত্র ২৩ বছর বয়সে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় অধিনায়ক হয়েছিলেন – এই ব্যাপারে তাঁর থেকে এগিয়ে একমাত্র মনসুর আলি খান পতৌদি যিনি ২১ বছর বয়সে অধিনায়ক হন। এত কমবয়সে এমন গুরুদায়িত্ব যে শচীন-এর ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, সেটা এখানে বলে নিতে চাই।

ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব পাওয়ার আগেই তাঁর ছ’বছরেরও বেশি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে – ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবোয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা এইসব দেশে সফরসমেত। অধিনায়ক হওয়ার আগে ১৯৯৩ সাল থেকে প্রায় তিন বছর আজহার-এর সহ-অধিনায়কও ছিলেন।

এছাড়া ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটেও তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব মোটামুটি ভালমতই সামলেছিলেন – মোট ১৬ বার বোম্বাইয়ের অধিনায়কত্ব করে ১৪ বার জয়, ১৯৯৪-৯৫ মরশুমে অধিনায়ক হিসেবে ফাইনালে পাঞ্জাবকে হারিয়ে রঞ্জি-জয়। অতএব অধিনায়ক হওয়ার আগেই তাঁর যথেষ্ট ‘প্রস্তুতি’ (grooming) ছিলই – এই ব্যাপারে তিনি যাকে বলে কপিল-এর বিপ্রতীপে।

অপরদিকে, একটানা বছর-তিনেকের (মূলত ঘরের মাঠে) সফল অধিনায়ক আজহার-এর থেকে দেশবাসীর বিশাল প্রত্যাশা ছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়। সেই ‘বাড়া-ভাতে ছাই’ পড়ল ইডেন-মাঠের সেমি-ফাইনালে। টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে, ব্যাট-হাতে নিজে ব্যর্থ হয়ে ও ম্যাচটা হেরে ১৯৯৩-এর ‘ইডেন-হিরো’ দেশবাসীর চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন। তারপর ইংল্যান্ড-সফরে ওডিআই ও টেস্ট দুটো সিরিজেই হার, টেস্ট-সিরিজে পাঁচ ইনিংসে মোট ৪২ রান (১৩, ০, ১৬, ৫, ৮) এই ব্যর্থতার ওপর ‘উটের পিঠে শেষ খড়’ হয়ে দাঁড়াল সফরের মাঝখানে ‘অন্তর্দলীয় মনোমালিন্য’-সংক্রান্ত কারণে বরিষ্ঠ সদস্য সিধু-র ‘রহস্যময় দলত্যাগ।’ অতএব টলমলে সিংহাসন থেকে আজ্জু-র অপসারণ। দেশবাসী ও দেশের ক্রিকেট-কর্ণধাররাও তো এটাই চাইছিলেন। সর্বজনপ্রিয় ‘তরুণ রাজকুমার’ বসলেন সেই সিংহাসনে। সবাই ভাবলেন ভারতীয় ক্রিকেটে এবার ‘রামরাজ্য’ আসবে। কিন্তু …

দুর্ভাগ্যবশত, শচীন-র অনন্যসাধারণ ব্যাটিং-দক্ষতা বোধহয় অধিকাংশ ভারতীয়ের মধ্যে অধিনায়ক হিসেবে তাঁর কাছ থেকে খুব বেশি প্রত্যাশা তৈরি করেছিল – তাঁর ‘জাদুকরী’ ব্যাটিংয়েরই মতন। অথচ ক্রিকেটের তিনটি বিভাগেই তাঁর দলের কিছু অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ছিল, এটাও অনস্বীকার্য। এটা তো মানতেই হবে যে তিনি কখনোই তেমন শক্তিশালী দল পাননি, বিশেষত বোলিং-আক্রমণের প্রেক্ষিতে, এবং একজন অধিনায়ক ততটাই ভাল যতটা ভাল তাঁর দল। একবার চোখ বুলিয়ে নিই তাঁর অধিনায়কত্বের ‘করনামা’-র ওপর।

প্রথম ইনিংস – মধুচন্দ্রিমার দ্রুত অস্তাচলগমন

১৯৯৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, ১৯৯৬-এর ইংল্যান্ড-সফরের পর, অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম ‘ইনিংস’-এর শুরুটা তিনি বেশ ভালই করলেন – ঘরের মাঠে চারটে টেস্ট-ম্যাচে তিনটে জয়, অস্ট্রেলিয়া (প্রথম বিজিটি-টেস্ট, দিল্লিতে) এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এদের মতন শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২-১ ম্যাচে টেস্ট-সিরিজ জয় তো বেশ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক।

কিন্তু পরবর্তী ১৫ মাসে জয়ের অভাব – দক্ষিণ আফ্রিকায় ০-২ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে ০-১ ব্যবধানে টেস্ট-সিরিজে হার, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টানা পাঁচটা টেস্ট ড্র (দু’টো সে দেশে ও তিনটে ঘরের মাঠে) – অনেক সমালোচনার জন্ম দিতে শুরু করল, ‘আশাভঙ্গের আক্ষেপ।’ ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে বার্বাডোজ-টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে ১২০ রান তাড়া করতে গিয়ে ৮১ রানে সবাই আউট হয়ে যাওয়ার বেদনা কেবল অধিনায়ক শচীন নয়, তৎকালীন বহু ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীই আজও ভুলতে পারেননি। ঐ ম্যাচটা জিতলে হয়ত তাঁর অধিনায়ক-জীবনটা অন্যরকম হত।

গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠল দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা (ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ও এশিয়া কাপ), পাকিস্তান এবং ইউএই (আকাই-সিঙ্গার কাপ) সর্বত্রই ওডিআই-সিরিজ/প্রতিযোগিতায় একটানা হার। ফলে কানাডায় সাহারা কাপ-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাফল্যও চাপা পড়ে গেল, তার ‘ফুটেজ’-টা মূলত খেয়ে নিলেন শচীন-এর ‘গোপন (বোলিং) অস্ত্র’ তথা প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় সৌরভ। তবে এটাও তথ্যভিত্তিক সত্যি যে সৌরভ-কে বোলার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অধিনায়ক শচীন মোটামুটি ভালই সফল, বিশেষত ওডিআই-ক্রিকেটে।

১৯৯৭ সালে, তিনি যে ১২টা টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছিলেন তার একটাতেও জিততে পারেননি। তাঁর জমানার আগে, ১৯৯২-৯৩, ১৯৯৪-৯৫, ১৯৯৫-৯৬ মরশুমে আজহার-এর জমানায় ভারতের ঘরের মাঠে নিয়মিত টেস্ট-জয় তো ভারতীয় জনতার অভ্যেস হয়ে গেছিল। তা সে যতই আমরা “ঘরের মাঠে বাঘ, বিদেশে বেড়াল” এই ব’লে আওয়াজ দিই না কেন – অজিত-আজ্জু জুটির ছত্রছায়াতে টেস্ট-ম্যাচে জয়ের সংখ্যা যে বাড়ছিল সেটা তো সত্যি!

১৯৯৬-৯৭ মরশুমে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ভারত জিতে যাওয়ার কারণে একটা ঘটনা চাপা পড়ে গেছিল। কানপুর-টেস্টের পর আহমেদাবাদ-টেস্টের জন্য দলগঠনের সভায় শচীন বম্বে-দলের স্পিনার নীলেশ কুলকার্নি-র দলে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব তোলেন, যিনি ১৯৯৫-৯৬ ঘরোয়া-মরশুমে ২৬টা প্রথম-শ্রেণীর উইকেট নিয়েছিলেন। প্রধান-নির্বাচক কিষেণ রুংটা-র প্রশ্নের উত্তরে শচীন জানান যে যদিও তিনি নীলেশকে খেলতে নিজে দেখেননি, কিন্তু অতগুলো উইকেট যিনি নিয়েছেন তিনি ভাল বোলারই হবেন। শচীন থম মেরে যান যখন রুংটা তাঁকে বলেন, “Dear skipper, I might have given thought to your recommendation if you had seen him bowl. Now, let me tell you for your kind information that in the current season, Mumbai has played two Ranji matches and Kulkarni has not played a single. He was dropped from the team. Tell me, how can a player find a place in the national team when he is not found worthy of selection in the local team?”

তিনি বোঝেন যে অন্যের কথায় চোখ বুজে বিশ্বাস ক’রে তিনি নিজে বোকা বনে গেছেন। নীলেশ পরের শ্রীলঙ্কা-সফরে সুযোগ পেলেও বিশেষ দাগ কাটতে পারেননি।

শচীন-এর অধিনায়কত্বকে কিছুটা ‘নরমসরম’ এবং ‘চাপের মুখে দিশাহারা’ বলে মনে করা হতে লাগল। পরিস্থিতি অনুযায়ী রক্ষণমূলক নীতি নিয়ে বিপক্ষকে আটকে/চেপে দেওয়া – যেটা অধিনায়ক সানি অনেকবার করেছিলেন – এই ব্যাপারে তাঁর ঘাটতির বড় উদাহরণ হয়ে উঠল ১৯৯৭ সালের কলম্বো টেস্ট, যেখানে শ্রীলঙ্কা ৯৫২/৬ তুলে ইনিংস ছেড়ে দেয়। শচীনের আত্মজীবনীর ঐ অংশে (তৎকালীন) বিশ্বরেকর্ড-হওয়া ম্যাচটা যে কেন উল্লিখিতই নয়, সেটা আমি অবশ্য বুঝিনি!

ঘটনাচক্রে, ১৯৯৭ সালে সাহারা কাপ প্রতিযোগিতার জন্য টরন্টো-যাত্রার ঠিক আগে তাঁর এক সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ছে, যেখানে তাঁকে বেশ কিছুটা রক্ষণাত্মক ব’লে মনে হয়েছিল, এবং দল-নির্বাচন সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন, এবং দলের সাম্প্রতিক পরাজয় নিয়েও, “মিড-ডে” পত্রিকার ক্রিকেট-সাংবাদিক ক্লেটন মুরজেলো তো তেমনটাই লিখেছিলেন।

এই ‘ইনিংস’-এর শেষদিকে, ১৯৯৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মাঝেমধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি আবার অধিনায়কত্ব গ্রহণ করতে বেশ অনিচ্ছুক। অথচ তার বছর-দেড়েকের মধ্যেই “উপরোধে ঢেঁকি গেলা” ক’রে আবার অধিনায়ক হ’তে বিসিসিআই-এর সঙ্গে এক ‘অকথিত’ বোঝাপড়ার মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে রাজি হলেন যে দল নির্বাচনে তাঁর আরও ক্ষমতা, আরও স্বাধীনতা, আরও বক্তব্য-মতামত থাকবে। ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে প্রায় সাত দশকের অনেক ‘কহানি’-র মধ্যে সে আরেকটা – একবার দেখা যাক!

দ্বিতীয় ইনিংসের প্রস্তুতি – "চাইনা মা'গো রাজা হতে"

১৯৯৯ সালের জুন মাসে বিশ্বকাপে ভারতীয়-দলের সেমি-ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হওয়া, অধিনায়ক আজহার-এর ব্যাটিংয়ের ছন্দপতন এবং তাঁর কাঁধের এক অস্ত্রোপচার, এমন পটভূমিকায় জুলাই মাসে নির্বাচকমণ্ডলীর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে শচীন-এর প্রত্যাবর্তন ঘটল, জাতীয় ক্রিকেট-অধিনায়কের আসনে। প্রধান নির্বাচক অজিত ওয়াদেকর-এর কথায়, “It took us just two minutes to decide. We’re looking ahead with Sachin Tendulkar as captain. It was decided in one voice, no other name was considered.” বিশ্বকাপে ভারতের কোচ অংশুমান গায়কোয়াড়-ও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহমত ছিলেন।

তবে কিছু প্রশ্ন তো ছিলই – ‘অনিচ্ছুক’ শচীন-কে কোন কোন শর্তে ‘রাজি’ করানো হ’ল? নির্বাচকমণ্ডলীর ওপর বিসিসিআই-এর ওপরমহলের কোনও ‘চাপ’ ছিল কি? ওয়াদেকর-এর কথায়, “No (such)  ‘directive’ was issued.” একজন নির্বাচক বলেছিলেন, “Now, if Sachin actually has reservations, he should publicly decline the captaincy.” আরেকজন নির্বাচকের কথায়, “We have chosen somebody who will lead India into the 21st century. Sachin is a stayer and, if all goes well, he will be around (as captain) for years.”

মজার ব্যাপার হ’ল যে নির্বাচকমণ্ডলীর এই ঘোষণার পর প্রায় দশ-বারো ঘন্টা অবধি শচীন-এর থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এটা কি তাঁর ‘অনিচ্ছা’-র ইঙ্গিত ছিল? গণমাধ্যমের কাছে ‘দেশের স্বার্থের থেকে আমার পছন্দ-অপছন্দই বড়’ এমন কোনও আভাস তিনি কি দিতে চাননি? নাকি তিনি নিজে থেকে বাছতে চেয়েছিলেন তাঁর অধিনায়কত্বের দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ করবার শুভক্ষণ (হয়ত ১৯৯৯ সালের পরে)? নির্বাচকদের মতে, সেটা আবার ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠতে পারত যদি ‘অন্তর্বর্তী-কালীন’ অধিনায়ক অজয় জাদেজা ইতোমধ্যে ভাল সাফল্য পেয়ে যেতেন।

একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য দেওয়া যাক। নব্বইয়ের দশকে, ভারতীয়-দল বিদেশের মাঠে গোটা-দশেক বহুদলীয় (চতুর্দলীয়-বা-তার-বেশি) ওডিআই-প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল, জিতেছিল মাত্র দু’টোতে – ২০% দলীয়-সাফল্য। ঐ দশকেই বিদেশের মাঠে ১৪টা টেস্ট-সিরিজ খেলে মাত্র একটা জিতেছিল, শ্রীলঙ্কায় – সাত শতাংশ দলীয়-সাফল্য। পরিসংখ্যান তো মিথ্যে বলে না (কার্ডাস-সাহেব যাই বলুন)! এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তৎকালীন বিসিসিআই সভাপতি রাজ সিং-এর খেদোক্তিটা প্রণিধানযোগ্য: “It (lack of success) saddens me but doesn’t surprise me. We lack a high level of physical fitness, we lack consistency and we lack mental toughness.” এই পটভূমিকার আবহে শচীন তাঁর অধিনায়কত্বের দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামলেন।

দ্বিতীয় ইনিংস – সাংসারিক কলহের আধিক্য

১৯৯৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার পর, অধিনায়কত্বের ‘দ্বিতীয় ইনিংস’ তিনি শুরু করলেন পরাজয় দিয়ে –শ্রীলঙ্কায় (আইওয়া কাপ), সিঙ্গাপুরে (কোকা-কোলা কাপ), কেনিয়ায় (এলজি কাপ) যার উদাহরণ।

এবার নতুন কোচ কপিল-এর সঙ্গে জুটি বাঁধলেন। দেশবাসী অনেকেই আপ্লুত, ভারতের সেরা অলরাউন্ডার ও বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র অধিনায়ক এবং ভারত-সেরা ব্যাটার এই দুইয়ের ‘সাফল্যের যুগলবন্দী’-র অপেক্ষায়। আমরা হয়ত ভুলে গেলাম অধিনায়ক কপিল-এর কৌশলগত সীমাবদ্ধতার উদাহরণগুলো এবং শচীন-এর অধিনায়কত্বের প্রথম ইনিংসের ‘দুর্বলতা’ ও ১৯৯৭-এর বার্বাডোজ-টেস্টের পরাজয়-পরবর্তী ‘অসহিষ্ণুতা’। আমরা আবার আশায় বুক বাঁধলাম।

১৯৯৯-২০০০ মরশুমের কথা বলি। কিউয়িদের বিরুদ্ধে তিন-ম্যাচের টেস্ট-সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচটা জিতে ভারত তখন ১-০ এগিয়ে। আহমেদাবাদ-টেস্টে পৌনে-তিনশো রানে এগিয়ে থেকেও কিউয়িদের ফলো-অন না করানোর ‘কৌশলী কৌশল’ সত্ত্বেও ম্যাচটা ড্র হ’ল। ‘আক্রমণাত্মক ক্রিকেটার’ ব’লে সুপরিচিত শচীন-কপিল জুটি সমালোচনায় বিদ্ধ হলেন, ম্যাচ-গড়াপেটার অভিযোগও পরে উঠেছিল। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট-সিরিজে ১-০ এবং ওডিআই-সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে জয় হলেও খুঁতখুঁতুনি রয়েই গেল।

তৎকালীন বিসিসিআই সচিব জয়ন্ত লেলে পরবর্তীকালে জানান যে কোচ কপিল নাকি অধিনায়ক শচীন-কে প্রভাবিত করে আহমেদাবাদ-টেস্টে কিউয়িদের ফলো-অন করানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছিলেন। শচীন বিপক্ষ-অধিনায়ক স্টিফেন ফ্লেমিং-কে এবং আম্পায়ারদের বলেছিলেন যে ভারত ফলো-অন করাচ্ছে। এমনকি সাজঘরে ঢুকে দুই পেসার জাভাগল শ্রীনাথ ও ভেঙ্কটেশ প্রসাদ এঁদের দু’জনকে তিনি নির্দেশ দেন আম্পায়ারদের কাছ থেকে পছন্দমতন নতুন একটা বল বেছে নিতে। এমন সময় কপিল নাকি হাঁক পেড়ে শচীন-কে বলেন, “Captain, no follow-on! Our bowlers are tired. We will bat.” কপিল হেন খেলোয়াড়ের কোচ-নির্দেশ মেনে ‘অতি-সুভদ্র’ অধিনায়ক শচীন ফিরে গিয়ে ফ্লেমিং-কে এবং আম্পায়ারদের জানান যে ভারত আবার ব্যাটিং করবে!

তৎকালীন প্রধান-নির্বাচক চান্দু বোরদে (এবং বহু ক্রিকেট-প্রেমীই) এই সিদ্ধান্তে অবাক হয়ে যান। লেলে-র কথানুযায়ী ভারতের ওপেনিং বোলাররা কেউই ক্লান্তির কথাই তোলেননি, এবং কিউয়িরা ফলো-অনের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে খুশিই হন। লেলে-র মতে, “It was a sheer bad and extra-cautious decision on the part of the Indian captain/coach to ensure that their side does not lose the match under any circumstances.” পরবর্তীকালে ম্যাচ-গড়াপেটার তদন্ত করতে গিয়ে সিবিআই অফিসাররা এই নিয়ে কপিলকে জেরা করেন – শচীনকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করানো হলে তিনি ব্যাপারটাকে ‘দলীয় সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেন। তবে এই বিতর্কিত ঘটনায় সৃষ্ট গুজবের ফলে কপিল ও শচীন দু’জনেরই ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন এড়ানো যায়নি।

সে মরশুমের অস্ট্রেলিয়া-সফর নিয়ে আরো বিতর্ক। অভিজ্ঞ আজহার, অজয় জাদেজা এবং নয়ন মোঙ্গিয়া, এঁদেরকে বাদ রেখে গঠিত দলের সফরের মুখেই লেলে-র বিতর্কিত (ও তাঁর দ্রুত-অস্বীকার-করা) এক মন্তব্য নিয়ে, “ওরা তো ০-৩ হারবে।” হেনস্থা আরও বাড়ল সফরের পর। অস্ট্রেলিয়াতে টেস্ট-সিরিজে ০-৩ এবং ত্রিদেশীয় সিএন্ডইউ ওডিআই-সিরিজে মাত্র একটা জয় ও ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থতা – ‘দুষ্পাচ্য’ বই কী, শচীনের মতন ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বের পক্ষে।

সফর চলাকালীন আহত উইকেটরক্ষক এমএসকে প্রসাদ-এর বদলে নিজের পছন্দের সমীর দিঘে-কে পেলেন না, পেলেন মোঙ্গিয়া-কে কিন্তু তাঁকে খেলানো হল না এবং তিনি ক’দিন বাদে দেশে ফিরে গেলেন। সফরকারী দল-পরিচালকমণ্ডলীর সঙ্গে বিসিসিআই-এর ও নির্বাচকমণ্ডলী-র মধ্যে মতভেদ চলতেই থাকল, এমনকি দলের মধ্যেও ‘বিভাজনরেখা’ বাড়তে লাগল। শচীন যেন একজন ‘পথহারা পথিক’ -এর মতন অনুভব করছিলেন – নেতৃত্ব উপভোগ তো ‘মাথায় উঠল!’

সফরে ত্রিদেশীয় ওডিআই-সিরিজে উইকেটরক্ষক হিসেবে দিঘে-র নির্বাচনে তিনি নিজেও বোধহয় অবাক হয়ে গেছিলেন। ৩১ বছর বয়সে ক্রিকেট-জীবনের আশা ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠরত দিঘে-কে শচীন-এর একান্ত সুপারিশে শেষ পর্যন্ত দলে নেওয়া হয়, অভিজ্ঞ ও দক্ষ মোঙ্গিয়া-কে বাদ রেখে। সফরে তিনি অবশ্য নেহাৎ খারাপ প্রদর্শন করেননি।

স্পিনার নীলেশ কুলকার্নি
উইকেটরক্ষক সমীর দিঘে

ভারতে ফিরে আসার পরে যেন ‘উটের পিঠে শেষ খড়’ চাপানো হ’ল – এবার পিঠটা অধিনায়ক শচীন-এর, আজহার-র নয়! তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও আজহার এবং মোঙ্গিয়াকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে সিরিজের জন্য নির্বাচিত করা হ’ল। বীতশ্রদ্ধ শচীন হাড়ে হাড়ে বুঝলেন যে অধিনায়কত্ব আর ব্যাটিং আলাদা, বিশেষত ভারতীয়-ক্রিকেটে। অধিনায়ক হিসেবে নিজের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে দেখে টেস্ট-সিরিজের গোড়াতেই তিনি তাঁর সহ-অধিনায়ক সৌরভ-এর হাতে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’ করবার সিদ্ধান্ত নেন, এবং সেইমত ঐ সিরিজের শেষেই অধিনায়কের আসন ছেড়ে দেন।

এই পদত্যাগ নিয়েও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের প্রথম টেস্ট-ম্যাচ মুম্বইতে চলাকালীনই পদত্যাগ করতে উদ্যত শচীন নাকি স্ত্রী অঞ্জলি-র হস্তক্ষেপে টেস্ট-সিরিজটার শেষ অবধি অধিনায়ক থেকে যান! একটু খুলে বলা যাক।

মুম্বই-টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই বোঝা গেছিল যে পরের দিনই ভারত বড় ব্যবধানে হারবে। চারপাশে ভারতীয়-দল এবং শচীন-এর অধিনায়কত্বের তীব্র সমালোচনা চলছিল। তিনি খুব বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ ছিলেন। সেদিনই সন্ধেয় তিনি নাকি তাঁর পদত্যাগপত্র লেলে-র হাতে তুলে দেন। বিস্মিত ও স্তম্ভিত বিসিসিআই-সচিব তাঁকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অধিনায়ক তখন যেন সহ্যের শেষ সীমায়। তিনি পরবর্তী ব্যাঙ্গালোর-টেস্টটা শেষ হওয়া অবধি আর সপ্তাহ দেড়েকও অপেক্ষা করতে রাজি হচ্ছিলেন না।

নিরুপায় লেলে এবার বিসিসিআই-সভাপতি রাজ সিং ও প্রাক্তন ক্রিকেটার রবি শাস্ত্রী,  এই দুজনের সাহায্য নেন। তাতেও যখন কাজ হল না তখন তিনি ও শাস্ত্রী নাকি আলাদা আলাদা করে অঞ্জলি-র সঙ্গে কথা বলেন। প্রস্তাব রাখা হয় যে শচীন যেন ঘোষণা করেন যে তিনি টেস্ট-সিরিজের শেষে অধিনায়কের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত তাইই হয়, চরম অনিচ্ছুক শচীন ব্যাঙ্গালোর-টেস্টে অধিনায়কত্ব করেন – ভারত ম্যাচটা ইনিংসে হারে। নির্বাচকমণ্ডলী ওডিআই-সিরিজের জন্য সৌরভ-কে অধিনায়ক নির্বাচিত করেন। ভারতীয়-ক্রিকেটে এক নতুন যুগ শুরু হয়, যা পরবর্তী বছর-পাঁচেক চালু ছিল।

শেষ হয়ে না হইল শেষ – ইরানি, রঞ্জি, আইপিএল

জাতীয় অধিনায়কত্ব ছাড়বার পরেও শচীন বেশ কয়েকবার অধিনায়কত্ব করেছেন – উদাহরণ দিই।

• ইরানি ট্রফি, ২০০৩-০৪ মরশুম (সেপ্টেম্বর-২০০৩) – চেন্নাইতে অবশিষ্ট ভারত দলের (RoI) বিরুদ্ধে মুম্বইয়ের নেতৃত্ব দেন, বিপক্ষে অধিনায়ক ছিলেন সৌরভ। প্রথম ইনিংসে ৯৫ রানে পিছিয়ে-থাকা RoI চতুর্থ ইনিংসে ৩৪০ রান তাড়া ক’রে তিন উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়।

• দলীপ ট্রফি, ২০০৪-০৫ মরশুম (ফেব্রুয়ারি-২০০৫) – গ্রুপ-পর্বে হায়দ্রাবাদে দক্ষিণাঞ্চলের বিরুদ্ধে পশ্চিমাঞ্চলের (WZ) নেতৃত্ব দেন, বিপক্ষে অধিনায়ক ছিলেন দ্রাবিড়। প্রথম ইনিংসে ২০ রানে পিছিয়ে-থাকা WZ চতুর্থ ইনিংসে ২২২ রান তাড়া করে নয় উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়। ঐ মরশুমে তার আগে দেওধর ট্রফি ও চ্যালেঞ্জার ট্রফি প্রতিযোগিতায় তিনি খেলেননি, তাঁর কনুইয়ের চোটকে বিশ্রাম দিতে। এমনকি দলীপ ট্রফির গ্রুপ-পর্বে লখনৌতে উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে ম্যাচেও তিনি বিশ্রাম নেন। ডিসেম্বরে ঢাকায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ওডিআই-ম্যাচের পর এইটাই ছিল তাঁর প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ। আসন্ন পাকিস্তান-সফরে যাওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই তিনি উৎসুক ছিলেন এবং ম্যাচ-অনুশীলন করতে চাইছিলেন।

• আইপিএল, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১ মরশুম – প্রতিযোগিতার প্রথম বছরে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলের (MI) প্রথম সাতটা ম্যাচ তিনি খেলতে পারেননি, চোটের জন্য। প্রথম চার বছরে তাঁর অধিনায়কত্বে MI সেরা প্রদর্শন করেছিল ২০১০ সালে, যখন তারা চেন্নাই সুপার কিংস দলের (CSK) কাছে হেরে রানার্স-আপ হয়েছিল। ২০১২ মরশুমের আগে তিনি অধিনায়কত্বের ভার তৎকালীন সহ-অধিনায়ক হরভজন-কে তুলে দেন। কারণ হিসেবে বলেন যে ঐ দায়িত্ব থেকে তাঁর “বিশ্রাম” (“break”) প্রয়োজন: “At this point of time, I feel I need a break from the responsibility of captaincy of the Mumbai Indians. … After due consideration, I discussed my intention to hand over the captaincy of the team to Harbhajan Singh, with Mukeshbhai [Ambani] and Nitabhabhi.”

আইপিএল প্রতিযোগিতায় তাঁর শেষ বছরটা, ২০১৩, কেমন জানি ঘেঁটে গেল। তবে সব ভাল যার শেষ ভাল – প্রতিযোগিতায় সেই প্রথমবার MI বিজয়ী হ’ল। শচীন অবশ্য নক-আউট পর্বে ও ফাইনাল-ম্যাচে খেলেননি, আহত থাকায়।

সেবার নিলামের আগে গুজব রটেছিল যে MI নাকি রিকি পন্টিং বা মাইকেল ক্লার্ক এঁদের মধ্যে কোনও একজনকে নিতে ঝাঁপাবে, অধিনায়ক করবার জন্য। কিন্তু শোনা গেল যে শচীন ফিরে আসছেন অধিনায়ক হয়ে, ভাজ্জি নাকি আর অধিনায়ক থাকতে চাননা। অবশ্য কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল প্রতিযোগিতার প্রথমদিকে পন্টিং ও পরের দিকে রোহিত MI-দলকে নেতৃত্ব দিলেন এবং দল শেষ অবধি আইপিএল জিতল। শচীন নিয়মিত খেললেন, রানও করলেন। কিন্তু শেষের দিকে, দলের চতুর্দশ ম্যাচে, সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ (SRH) দলের বিরুদ্ধে চোট পেয়ে প্রতিযোগিতার বাকি পাঁচটা ম্যাচ, ফাইনাল সমেত, খেলতে পারেননি। আইপিএল-এ তাঁর খেলা শেষ – দল বিজয়ী তবে তিনি অধিনায়ক নন। এখানেও কি খানিকটা ২০১১ বিশ্বকাপের ছায়া? হবে হয়ত!

একটু ভেবে দেখুন

২৫টা টেস্ট-ম্যাচে চারটে জয় (সবই দেশের মাঠে), ন’টা পরাজয় (ছ’টা বিদেশের মাঠে) – ১৬% সফলতা। ৭২টা ওডিআই-ম্যাচে ২৩টা জয়, ৪২টা পরাজয় – ৩২% সফলতা। শচীন-এর অধিনায়ক হিসেবে ‘ব্যর্থতা’ ভারতীয়-ক্রিকেটের এক দুর্ভাগ্যজনক আপাত-বৈপরীত্য (unfortunate paradox) – এর একটা বড় কারণ হয়ত তিনি নানা মুনির নানা মত মানতে চেষ্টা করতেন, মনে করতেন যে বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শ না মানলে তাঁদের অশ্রদ্ধা করা হয়। সেটা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই বোধহয় তিনি নিজের সহজাত ক্রিকেট-প্রজ্ঞা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করতেন। আর কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সেই দ্বিধার খেসারত দিতে হ’ত অধিনায়ক শচীন-কে।

এমনও বলা হয়ে থাকে যে তিনি ‘ভুল’ সময়ে অধিনায়ক হয়েছিলেন, অথবা ঐ পদবীর ছাপ নিয়ে দলকে সঠিক দিশা দেখানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা তাঁর ছিলনা। মহান খেলোয়াড়রা সবসময় মহান অধিনায়ক হননা, এই আপ্তবাক্যের সেরা উদাহরণ বোধহয় গ্যারি সোবার্স। এরই বিপরীত মেরুতে আছেন সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের অন্যতম মাইক ব্রিয়ারলি, যিনি আন্তর্জাতিক-মানের মাপকাঠিতে নেহাতই সাধারণ এক খেলোয়াড়। ফ্লেমিং অধিনায়ক হিসেবে বহু-প্রশংসিত যদিও তাঁর কিউয়ি-দল কিন্তু কখনও ‘বিশ্বজয়ী’ হয়নি। ক্রিকেট-দুনিয়ায় খুঁজলে এমন উদাহরণ আরো পাওয়া যাবে। ক্রিকেট-প্রেমীদের এ নিয়ে হয়ত খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই।

একটা কথা কেউ কেউ বলে থাকেন, “Tendulkar has always been a crisis captain for Team India.” হয়ত কারণটা এই যে মূলত দু’টো বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের ফলেই তৎকালীন অধিনায়ক আজ্জু তাঁর মুকুট খোয়ান। আর দু’বারই সেই মুকুট দলের তৎকালীন সেরা ব্যাটার ও জনগণের নয়নমণি শচীনের মাথাতেই পরানো হয়েছিল। একটা বড় তফাৎ অবশ্যই ছিল। প্রথমবারে শচীন ছিলেন আগ্রহী। আর দ্বিতীয়বারে তিনি ছিলেন নিমরাজি। সেই ‘গল্প’ তো আগেই বলেছি।

অধিনায়ক (বা captain) আর নেতা (leader) এই দু’টোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ব’লে মনে করি। একদল মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ ক’রে একজন ব্যক্তিকে একটা পদবী দেওয়া হয়, তিনি অধিনায়ক। একজন নেতাও অনেকটাই একইরকম কাজ করেন, যদিও তাঁর কোনও নির্ধারিত পদবী থাকেনা।

এই প্রসঙ্গের জের টেনে একটা কথা বলি। ১৯৯৯ সালে শচীন-এর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়াটা যে ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে আখেরে মঙ্গলজনক হয়েছে, এটা অনস্বীকার্য। এমন বহুবারই হয়েছে যে তিনি ভারতীয়-দলকে চমৎকারভাবে প্রভাবিত করেছেন, ‘মশলা সংযোগ’ করেছেন। নেতা তো তিনি ছিলেনই এবং তাঁর কথা সহ-খেলোয়াড়রা এড়াতে পারতেন না। তিনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর সৌরভ, দ্রাবিড়, কুম্বলে, ধোনি এঁরা অধিনায়কত্ব করেছেন, এবং এঁরা সকলেই স্বীকার করেছেন যে একাধিক ক্ষেত্রে শচীন তাঁদেরকে সঠিক রাস্তা বাৎলে দিয়েছেন।

একটা জানা কথা আবার মনে করিয়ে দিই। ধোনি-কে অধিনায়ক করবার ব্যাপারে শচীন-এর অবদান যথেষ্ট – গ্রেগ চ্যাপেল থেকে শারদ পাওয়ার অনেকেই এটা জানিয়েছেন। ধোনি-র অধিনায়কত্বে ভারতীয়-ক্রিকেট ২০০৮-০৯ মরশুম থেকে ২০১০-১১ এই সময়ে যে সর্বাত্মক উন্নতি করেছিল, এটা ইতিহাস বলছে। তার পরেও, অতি জনপ্রিয় সাদা-বলের ক্রিকেটে ভারতের প্রদর্শন ধারাবাহিকভাবে ভালই গেছে যদিও তুলনামূলকভাবে লাল-বলের ক্রিকেটে বেশ কিছু হোঁচট খেতে হয়েছে, এও সত্যি।

শেষ করি এই দিয়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অধিনায়ক হিসেবে ঘোষিত না হলেও দলকে নেতৃত্ব দেওয়া যায়। ব্যক্তিগত সম্মান ও সাধুবাদ এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে দলের সুবিধে যিনি দেখতে পারেন, তিনিই নেতা। নির্বাচিত-অধিনায়ক হিসেবে দলীয় সাফল্যের নিরিখে শচীন অবশ্যই তেমন ছাপ রাখতে পারেননি। তবে তাঁর ‘নেতৃত্ব’ তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-জীবনের শেষ দশ-বারো বছরে ভারতীয়-ক্রিকেটকে যে বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতে বড়রকম সহায়তা করেছিল, এটা তো মানতেই হবে।

—– 

ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে। 

কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", ২০২৪ সালে এসেছে “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে। সাম্প্রতিককালে ক্রিকেট-সম্বন্ধীয় বাংলা YouTube ভিডিও-চ্যানেল “উইলোর উইল”-এর কথকের ভূমিকাও পালন করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *