প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬

 

রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)

দীপক সেনগুপ্ত

অন্যান্য অংশ - (১) (২) (৩) (৪) (৫)

ভূমিকা



জিম করবেট

আপনি যদি শিকারের গল্প শুনতে বা শিকার কাহিনী পড়তে ভালবাসেন তবে জিম করবেটের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। শিকারি হিসাবে করবেট পরিচিত হলেও বন্য পশুকে হত্যা করা তিনি কিন্তু পছন্দ করতেন না। তাকে যে শিকার করতে হয়েছে সেটা খানিকটা পরিস্থিতির চাপে পড়ে, বাধ্য হয়ে। কুমায়ুন ও গাড়োয়ালের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বাস করত তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে জঙ্গলের পথে যেতেই হত। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে তাদের গৃহপালিত ছাগল বা গরু চড়াতে, জ্বালানীর জন্য গাছের শুকনো ডাল যোগাড় করতে, গ্রামের স্কুলে পড়তে যেতে, অন্য গ্রামের পরিচিত জন বা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে অথবা বাজার হাট করবার জন্য জঙ্গলের পথে না গিয়ে উপায় ছিল না। তখন সে সব গ্রামে পাকা বা চওড়া রাস্তা কোথাও ছিলনা, গাড়ি ঘোড়া তো দূরের কথা। হিমালয়ের জঙ্গলে বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্যময় পাখীর কূজন, দূর থেকে ভেসে আসা বন্য প্রাণীর ডাক বা কাছাকাছি বয়ে যাওয়া কোন নদীর স্রোতের শব্দ ছাড়া নৈঃশব্দ্য ভঙ্গের অন্য কোনো কারণ ছিল না। যাদের এরকম গ্রাম দেখার সুযোগ হয় নি এবং শহরাঞ্চলেই জীবন কেটেছে, তারা এই পরিবেশকে স্বপ্ন বলেই মনে করবেন। দারিদ্রে জীর্ণ এইসব মানুষেরা ছিল ধর্মভীরু এবং সহজ সরল জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত। কিন্তু এই শান্ত ও নিস্তরঙ্গ পরিবেশ মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠত মানুষখেকো বাঘের অত্যাচারে। সাধারণভাবে বাঘ মানুষকে নিজে থেকে আক্রমণ করে না, হঠাৎ সামনা সামনি পড়ে গিয়ে ভয় না পেলে। কিন্তু মানুষখেকো বাঘের কথা আলাদা। মানুষ শিকার করাই তাদের মূল লক্ষ্য।

বাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার পিছনে অনেকগুলি কারণ করবেট সাহেব আমাদের জানিয়েছেন। সজারুর মাংস বাঘের প্রিয় খাদ্য। সজারু ধরে খেতে গিয়ে কোন কোন সময়ে সজারুর কাঁটা গভীরভাবে পায়ে বিঁধে যায় এবং আর বের হয় না। এতে বাঘ ক্রমশ: দ্রুত দৌড়োবার ক্ষমতা ও ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলে এবং এ কারণেই অন্য কোন শিকার ধরা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ বাঘের অত্যন্ত সহজ শিকার বলে, মানুষ মেরে খেতে খেতে ক্রমশ: মানুষখেকো হয়ে পড়ে। বাঘের বৃদ্ধ বয়সও এর জন্য দায়ী হতে পারে। অনেক সময়ে অন্য কোন শিকারির গুলিতে আহত হয়ে বেঁচে গেলেও কিছুটা অক্ষম হয়ে পড়ায় স্বাভাবিক শিকার ধরার ক্ষমতা অংশত: হারিয়ে ফেলে বাঘ ক্রমে মানুষখেকোতে পরিণত হয়। কোন এলাকার একটা বাঘ মানুষ মারতে শুরু করলে আশেপাশে বহু গ্রামের জীবন কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা বাঘ একদিনে অনেকদূর চলে যেতে পারে। তার গতিবিধি জানা না থাকায় বহু গ্রামের লোক তটস্থ হয়ে থাকে এবং সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পায়। এরকম অনেক পরিস্থিতিতে জিম করবেটের ডাক পড়েছে – হয় গ্রামের মানুষের কাতর প্রার্থনা অথবা সরকার পক্ষ থেকে বাঘটি মারার জন্য অনুরোধ – এর কোন একটি বা দুটি কারণেই। এই অবস্থায় অনিচ্ছা সত্যেও করবেটকে বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছে, বিপন্ন গ্রামবাসীদের রক্ষা করার তাগিদে। বাঘ শিকার করেছেন তিনি মোট তেত্রিশটি। সবগুলি কাহিনী যে লিপিবদ্ধ হয়েছে তা নয়। তার প্রথম মানুষখেকো শিকার কুমায়ুনের চম্পাবত গ্রামে – চম্পাবতের মানুষখেকো নামে যে কাহিনী তার লেখা ‘ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুনে’ তিনি বর্ণনা করেছেন। সরকারি নথি অনুযায়ী বাঘটি মোট ৪৩৬ টি মানুষ মেরেছিল। তবে সংখ্যাটা আরও বেশিই হবে কারণ সব মৃত্যুর খবর তো সরকারী দপ্তরে পৌঁছয় না।

করবেট একাধিক বাঘ শিকার করলেও মানুষখেকো চিতা মেরেছেন মাত্র দুটি। ১৯১০ সালে পানারের চিতা বাঘ এবং ১৯২৬-এ রুদ্রপ্রয়াগের চিতা, এই রুদ্রপ্রয়াগের চিতার গল্পই আপনাদের শোনাতে বসেছি। পানারের চিতাবাঘটি মোট ৪০০ জন মানুষ মেরেছিল এবং রুদ্রপ্রয়াগের চিতার খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে ১২৬ জন। দীর্ঘ আট বছর ধরে বহু গ্রামের মানুষকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল এই চিতাটি।

করবেটের পূর্বপুরুষেরা আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন। করবেটের মা ছিলেন মেরি জেন, আগ্রার চার্লস জেমস ডয়েলের স্ত্রী। সিপাহী বিদ্রোহের সময় মৃত্যু ঘটে চার্লসের। মেরির বয়স তখন মাত্র ২১ বছর, সঙ্গে তিনটি সন্তান। আলাপ হয় মুসৌরির ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেটের সঙ্গে। ক্রিস্টোফার ছিলেন বিপত্নীক ও তিন সন্তানের পিতা। দু’পক্ষের ছ’টি ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্রিস্টোফার ও মেরি নতুন সংসার শুরু করেন এবং ১৮৬২ সালে চলে আসেন নৈনিতালে। এই নৈনিতালেই (এখন উত্তরাখণ্ডে) ১৮৭৫ সালের ২৫শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এডওয়ার্ড জেমস করবেট (পরে যিনি জিম করবেট নামেই খ্যাত)। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইংরেজ। ষোল জন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। বাবা ছিলেন নৈনিতালের পোস্টমাস্টার। কাছেই কালাধুঙ্গি গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই জিম বন্যপ্রাণী ও তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসতেন। বন্য প্রাণীদের ডাক শুনে শুনে তার কান এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে তিনি সে সব ডাক অবিকল নকল করে শোনাতে পারতেন। বন্যপ্রাণীরাও বুঝতে পারত না সে ডাক আসল না নকল। অনেক সময়েই তার এই দক্ষতা পরবর্তী কালে তিনি শিকারের কাজে লাগিয়েছেন। স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে নৈনিতালে এখন যেটা বিড়লা বিদ্যামন্দির, সে কলেজেরই তিনি এক সময়ে ছাত্র ছিলেন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনায় ইতি টেনে রেল দপ্তরে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। করবেট ছিলেন একজন নামকরা ফটোগ্রাফার। বন্দুক হাতে নিয়ে চলার বদলে একটা ক্যামেরা থাকলে তিনি অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তার নামেই ১৯৫৭ সালে ‘করবেট ন্যাশনাল পার্কে’র নামকরণ হয়। ১৯৫৭ সালে জিম করবেট ও তার বোন ম্যাগি পূর্ব আফ্রিকায় কেনিয়ার নিয়েরি নামক স্থানে বসবাস করতে চলে যান। সেখানে তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এক সময়ে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে যে বাঘ তিনি শিকার করেছেন তাদের সংখ্যা ক্রমশ: কমে আসায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৫ সালের ১৯শে এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোক গমন করেন।
ইংরেজ কুলোদ্ভব হয়েও জিম করবেট ছিলেন মনেপ্রাণে ভারতীয়। শিকারি জীবনে যে সব গ্রামে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন, সেখানকার গ্রামবাসীদের দারিদ্র্য, সরলতা, অমায়িক ব্যবহার ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এদের প্রতি তার আন্তরিক ভালবাসা তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন তার ‘মাই ইণ্ডিয়া’ নামক গ্রন্থে। বইখানি তিনি –“আমার বন্ধু, ভারতের দরিদ্র মানুষ”কে উৎসর্গ করেছেন। তার বিভিন্ন লেখায় এইসব দরিদ্র সরলমনা লোকদের কথা একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা তার নাম দিয়েছিল ‘কার্পেট সাহেব’।

জিম করবেটের লেখা উল্লেখযোগ্য বই গুলি হল – ‘ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন’ (১৯৪৪), ‘দি ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ (১৯৪৭), ‘মাই ইন্ডিয়া’ (১৯৫২), ‘জাঙ্গল লোর’ (১৯৫৩), ‘দি টেম্পল টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন’ (১৯৫৪)। এর মধ্যে প্রথম বইটির প্রথম সংস্করণ মোট আড়াই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে এবং ২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যারা তার লেখা পড়েছেন তারা জানেন যে তার লেখায় একটা আকর্ষণী শক্তি রয়েছে। একটা গল্প শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বইটা ছাড়তে ইচ্ছা করে না। এমন ঝরঝরে ভাষায় সাবলীল ভঙ্গীতে তিনি তার যাত্রাপথ বা শিকারের বর্ণনা করেছেন যে মনে হয় যেন চোখের সামনেই সেগুলি ঘটছে। একা রাইফেল হাতে জঙ্গলের পথে দিনে বা কখনো কখনো রাতে মাইলের পর মাইল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি কি করে মানুষখেকো বাঘের পিছু নিয়েছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। বেশ কয়েকটি পরিস্থিতিতে তিনি নিতান্তই দৈবক্রমে রক্ষা পেয়েছেন। ছোটবেলায় বন্য প্রাণীদের জীবনযাত্রা ও চলাফেরা সম্বন্ধে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন সে সব অভিজ্ঞতাই পরবর্তী সময়ে তাকে শিকারের কাজে সাহায্য করেছে।

জিম করবেটের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তার নিরহঙ্কার ভাব ও অমায়িক ব্যবহার। তার লেখায় কাহিনীর নিখুঁত বর্ণনা ছাড়া কোন অতিশয়োক্তি, উচ্ছ্বাস বা গর্বের বিন্দু মাত্র ছায়া পড়ে নি। দিনের পর দিন বহু কষ্ট সহ্য করে, বিপদসংকুল পাহাড়ি পথে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে যে সফলতা তিনি অর্জন করেছেন সেখানে কিছুটা উচ্ছ্বসিত হওয়াটা হয় ত খুব অস্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু তার লেখায় সেটা কখনো প্রকাশ পায় নি। বাঘের হাত থেকে অত্যাচারিত গ্রামবাসীদের বাঁচানোতেই তার আনন্দ। এজন্য তিনি দিনের পর দিন শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে বা ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হন নি।

অনেকে বলেছেন যদি ভারতকে এতই ভালবাসতেন তবে দেশ স্বাধীন হবার পরেই তিনি ভারত ছেড়ে চলে গেলেন কেন। ঘনিষ্ঠ জনদের কাছে তার লেখা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে, তার ভয় ছিল স্বাধীন ভারতে তার উপরে হয় ত অত্যাচার নেমে আসবে, ইংরেজ হওয়ায় তিনি হয় ত সুবিচার পাবেন না। ১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌ থেকে মুম্বাই গিয়ে ‘এস. এস. অ্যারোন্দা’ জাহাজে মোম্বাসা, সেখান থেকে নাইরোবি হয়ে নিয়েরি শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন করবেট ও তার বোন ম্যাগি।

লক্ষ্ণৌতে যারা সেদিন করবেটকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তারা কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি। তার প্রিয় ভারতভূমি ছেড়ে যাবার আগে নৈনিতালের বাড়ি বিক্রি করে তার বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী রাইফেল ও বন্দুকগুলি গভীর জঙ্গলে ‘সমাধিস্থ’ করে এসেছিলেন জিম করবেট।

বর্তমান কাহিনীতে ‘দি ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ বইটি বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি শব্দের হুবহু আক্ষরিক অনুবাদ করা না হলেও করবেট যে ভাবে তার কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন সেটা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য কয়েকটি ঘটনা বাদ দিয়ে সংক্ষেপিত করতে হয়েছে; তবে এতে মূল বিষয়ের কোনো ক্ষতি হয় নি।
অনুচ্ছেদের বিন্যাস করবেট তার বইতে যেমন রেখেছেন মোটামুটি সেটারই অনুসরণ করা হয়েছে। বর্ণনা দেওয়া হয়েছে জিম করবেটের জবানিতেই। এবার জিম করবেটের কাহিনী শুরু করা যাক।

১। তীর্থযাত্রীদের পথ


আপনি যদি একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু হন এবং আপনার যদি কেদারনাথ ও বদরিনাথের প্রাচীন মন্দিরে তীর্থ করতে যাবার ইচ্ছা থাকে তবে আপনাকে হরিদ্বার থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে এবং আপনি যদি তীর্থ দর্শনের পুরো সুফলটাই পেতে চান তবে আপনাকে হরিদ্বার থেকে কেদারনাথ এবং পরে পাহাড়ি পথে বদরিনাথ সবটাই যেতে হবে খালি পায়ে।

হরিদ্বারের বহু দেবস্থান ও মন্দির দর্শন করে এবং হর-কি-পৌরির পবিত্র জলে স্নান সেরে একটু উপরেই সঙ্কীর্ণ পথের দু’পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুষ্ঠরোগীদের সাধ্যমত কিছু পয়সা আপনাকে দিতেই হবে, কারণ তা না হলে তারা আপনাকে অভিশাপ বর্ষণ করবে। কিছু পয়সা দিয়ে যদি অভিশাপ এড়ানো যায় তবে সেটাই তো ভাল।

একজন প্রকৃত হিন্দুর যা যা করণীয় এখন আপনার সবই করা হয়েছে, এবার দীর্ঘ দুর্গম পথে পাড়ি দেবার জন্য আপনি এগিয়ে যেতে পারেন।

হরিদ্বার ছেড়ে আপনি প্রথমে যেখানে এসে পৌঁছবেন সেটা হৃষীকেশ। এখানে কালা কমলিওয়ালার সঙ্গে আপনার পরিচয় ঘটবে। এরকম নামের কারণ – এর প্রতিষ্ঠাতা ও অনুগামীরা সকলেই শরীরের মধ্যভাগে একটা কালো আলখাল্লার মত কাপড় ছাগলের লোম দিয়ে তৈরি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। এখানে এবং অন্যান্য জায়গায় যে অর্থসাহায্য এরা পায় তা দিয়ে হাসপাতাল, ডিসপেনসারি এবং যাত্রীদের বিশ্রামাগার তৈরি হয়েছে এবং রক্ষণাবেক্ষণও এরাই করে। গরীবদের অন্নদানের ব্যবস্থাও আছে। আপনি আপনার যাত্রাপথে এরকম অন্য কোন প্রতিষ্ঠান দেখতে পাবেন কি না জানা নেই।

হৃষীকেশ পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলে সামনে পড়বে লক্ষণঝোলা। এবারে ঝোলা পুল পেরিয়ে আপনাকে গঙ্গার ডানদিক থেকে বা দিকে আসতে হবে। পুলের ওপর বসে থাকা অসংখ্য লাল রঙের বাঁদর থেকে কিন্তু সাবধান, এরা হরিদ্বারের কুষ্ঠরোগীদের চেয়ে কিছু কম দুর্বিনীত নয়। এদের মিষ্টি এবং ছোলাভাজা দিয়ে তুষ্ট করতে না পারলে পুল পার হওয়া সহজ হবে না।

গঙ্গার বা দিক দিয়ে তিন দিনের চলা পথে আপনি ঐতিহাসিক সহর, ধর্মস্থান ও ব্যবসাকেন্দ্র গাড়োয়ালের প্রাচীন রাজধানী শ্রীনগরে এসে পৌঁছবেন। চারিদিকে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই প্রশস্ত উপত্যকাটির সৌন্দর্য অসাধারণ। এখানে ১৮০৫ সালে গাড়োয়ালের সৈন্যরা – যারা পরে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রকৃত সৈনিকের মত লড়াই করেছে – গোর্খা অনুপ্রবেশকারীদের কাছে পরজয় বরণ করে। গাড়োয়ালের দুর্ভাগ্য যে ১৮৯৪ সালে গহনা নদীর বাঁধ ভেঙে রাজপ্রাসাদ সহ শ্রীনগরের এক বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার জলে ভেসে যায়। এই বাঁধটি গঙ্গার শাখা নদী ‘বিরহী গঙ্গা’র উপত্যকায় ধস নেমে তৈরি হয়েছিল। জলাধারটির তলদেশের প্রস্থ ছিল ১১০০০ ফুট এবং উচ্চতা ৯০০ ফুট। বাঁধ ভেঙে গিয়ে ছ’ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ১০০০ কোটি ঘনফুট জল বেরিয়ে আসে। নীচে হরিদ্বার অবধি এর ধ্বংসলীলা গিয়ে পৌঁছেছিল, গতি পথে যত সাঁকো ছিল সব জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। তবে দুর্ঘটনাটি এমন সময় ঘটে যে শ্রীনগরে লোক বেশী মারা যায় নি; কেবল একটি মাত্র পরিবার, যারা বারণ করা সত্বেও বিপদ সীমার কাছে ফিরে গিয়েছিল, তারাই ভেসে যায়।

শ্রীনগর থেকে খাড়া চড়াই বেয়ে চটিখালে পৌঁছতে হবে। তবে এখানে পৌঁছে নীচে গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং দূরে কেদারনাথের তুষারাবৃত শৃঙ্গ দেখে পথশ্রম ভুলে যেতে হয়।

চটিখাল থেকে একদিনের পথ পেরিয়ে আপনি সামনেই পাবেন গোলাবরাই গ্রাম। এখানে সারি সারি যাত্রিনিবাস ও পাথরের তৈরি একটা বাড়ির সঙ্গে চোখে পড়বে পানীয় জল ধরে রাখার একটি বৃহৎ জলাধার। গ্রীষ্মকালে পাইন গাছ চিড়ে ছোট ছোট খোল দিয়ে নালা বানিয়ে জল বইয়ে এনে জলাধারে ফেলা হয়। অন্যান্য ঋতুতে তো কোন অসুবিধাই নেই। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জল পাহাড় বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে শ্যাওলা ধরা পাথরের উপর দিয়ে বয়ে এসে জলাধারে পড়ে।

যাত্রী বিশ্রামাগার পেরিয়ে একশ গজ দূরে রাস্তার ডান দিকে একটা আম গাছ চোখে পড়বে। এই আম গাছ এবং একটু ওপরে দো’তলা বাড়িটা, যেখানে বিশ্রামাগারের মালিক পণ্ডিত বাস করে, এ দুটিই দেখে রাখা ভাল কারণ আমাদের গল্পে এ দু’টির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

এসব পেরিয়ে দু’মাইল দূরে এ রাস্তায় যে শেষ সমতল ভূমির দেখা পাওয়া যাবে সেটিই রুদ্রপ্রয়াগ। এখানেই কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হবে; কারণ আপনার রাস্তা গিয়েছে অলকানন্দা পেরিয়ে মন্দাকিনীর বা দিক ধরে কেদারনাথের দিকে আর আমাকে যেতে হবে পাহাড় পেরিয়ে আমার বাড়ি নৈনিতালে।
সামনের যে রাস্তাটা দিয়ে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী যাতায়াত করে, এর পরে সেটি অত্যন্ত খাড়া এবং অবিশ্বাস্য রকমের বন্ধুর। যদি কেউ সমুদ্র পৃষ্ঠ ছাড়িয়ে উপরে না উঠে থাকে অথবা বাড়ির ছাদে ওঠার চেয়ে উঁচুতে ওঠার অভিজ্ঞতা না থাকে কিম্বা নরম বালির চেয়ে কঠিন কোথাও পা না ফেলে থাকে তবে তাকে অসীম কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে। পথ চলতে মাঝে মাঝেই হয় ত নিঃশ্বাসের কষ্টে হাঁপ ধরে যাবে অথবা কঠিন প্রস্তরময় পথে হাটতে গিয়ে পা ফেটে রক্ত বেরোবে; স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগবে এই পরিশ্রমের প্রতিফল পাওয়া যাবে তো ? তবে আপনি যদি নিষ্ঠাবান হিন্দু হন তবে জানেন যে কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না এবং এই ভেবে আপনার সান্ত্বনা যে যতটা কষ্ট করবেন পরিশেষে ফললাভ করবেন সম পরিমাণেই।

২। মানুষখেকো চিতা


নদীর সঙ্গমস্থলকে হিন্দিতে বলে প্রয়াগ। কেদারনাথ থেকে নেমে আসা মন্দাকিনী এবং বদরিনাথ থেকে অলকানন্দা এসে মিশেছে রুদ্রপ্রয়াগে। এই দুই নদীর মিলিত জলধারায় যে নদীটি সৃষ্টি হয়েছে সেটিকে সমস্ত হিন্দুরা ‘গঙ্গা মাঈ’ বলে জানে এবং পৃথিবীর অন্যত্র এর পরিচিতি গঙ্গা নামে। [ প্রকাশক জানাচ্ছেন যে, অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলিত জলধারা অলকানন্দা নামেই এগিয়ে গেছে। দেবপ্রয়াগে এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশে নাম হয়েছে গঙ্গা ]।

কোন জন্তু, তা সে বাঘ বা চিতা বাঘ যাই হোক না কেন, যখন মানুষখেকো হয়, তখন চিহ্নিত করার জন্য তাকে কোনো জায়গার নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই নাম দেওয়া মানে এই নয় যে জন্তুটির প্রথম শিকার সে জায়গাতে হয়েছে অথবা তার হত্যালীলা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ। রুদ্রপ্রয়াগের চিতার প্রথম শিকার হয়েছিল রদ্রপ্রয়াগ থেকে বারো মাইল দূরে যাত্রীদের রাস্তার ধারে একটি গ্রামে।

সাধারণ বাঘ ও চিতাবাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার কারণ কিন্তু এক নয়। এটা বলতে খুব খারাপ লাগছে যে, যে চিতাবাঘ জঙ্গলের সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে সুন্দর এবং লাবণ্যময় এবং কোণঠাসা বা আহত হলে যার সাহস সবাইকে ছাড়িয়ে যায় সে জঙ্গলে ঝাড়ুদারের কাজ করে। কারণ খিদে পেলে জঙ্গলে পড়ে থাকা যে কোনো প্রাণীর মাংস খেতে তার বাধে না, এদিক দিয়ে আফ্রিকার সিংহের সঙ্গে তার মিল আছে।

গাড়োয়ালের অধিবাসীরা হিন্দু এবং তারা মৃতদেহের সৎকার করে থাকে। এই কাজ কোনো নদীর ধারে করা হয় – এই উদ্দেশ্যে যে দেহাবশেষ ভস্মরাশি নদী বেয়ে গঙ্গায় গিয়ে পড়বে এবং শেষে সমুদ্রে ঠাঁই পাবে। অধিকাংশ গ্রাম পাহাড়ের উঁচুতে হবার ফলে মৃতদেহ এবং দাহ করার জন্য পর্যাপ্ত কাঠ নীচে নদীর পারে বয়ে নিয়ে আসতে কি পরিমাণ লোকবল লাগে তা সহজেই অনুমেয়। যখন কোন সংক্রামক ব্যাধি পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি দেহ দাহ করতে যতটা সময় লাগে তার মধ্যে বহু মৃতদেহ জমে যায় তখন মৃতের মুখে একখণ্ড জ্বলন্ত কয়লা রেখে মৃতদেহটি পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়।

কোন অঞ্চলে চিতাবাঘের যখন স্বাভাবিক খাদ্যে ঘাটতি পড়ে, এই ফেলে দেওয়া দেহ গুলি পেয়ে তারা খেয়ে ফেলে এবং মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়ে যায়। ব্যাধির প্রকোপ থেমে গেলেও এই সব চিতা তখন মানুষ মারতে শুরু করে। ১৯১৮ সালে সারা ভারতে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর রূপ নিয়েছিল এবং গাড়োয়ালও ভীষণভাবে এর কবলে পড়েছিল। মহামারী থেমে যাবার পরই গাড়োয়ালের মানুষখেকোর আবির্ভাব ঘটে।

রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাটি প্রথম যে মানুষটি মেরেছিল বলে জানা যায় সেটি ঘটেছিল ১৯১৮ সালের ৯ই জুন তারিখে এবং শেষ শিকারটি করেছিল ভৈষ্ণোয়ারা গ্রামে ১৯২৬-এর ১৪ই এপ্রিল। এ দুটি তারিখের মাঝখানে সরকারি হিসাবে মানুষ মারা পড়েছিল ১২৫ টি। তবে এই তথ্যটি যে সঠিক নয় সেটা আমি ভাল করেই জানি কারণ আমি থাকার সময়েই বেশ কয়েকটি মানুষ মারার ঘটনা ঘটেছে যা এই হিসাবের মধ্যে নেই।
মানুষ শিকারের সংখ্যা যাই হোক না কেন, গাড়োয়ালবাসী অন্তত এটা দাবী করতে পারে যে, এই চিতাবাঘটি সবচেয়ে বেশি সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কারণ, আমি যতদূর জানি এই খবর ভারতের প্রায় প্রতিটি দৈনিক বা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, মালয়, হংকং, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সংবাদপত্রে স্থান পেয়েছিল। সংবাদপত্র বাদ দিয়েও ষাট হাজারের মত যাত্রী যারা প্রতি বছর কেদারনাথ ও বদরিনাথের মদিরে যাতায়াত করে তারাই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে খবরটি ছড়িয়ে দিয়েছিল।

মানুষ শিকারের সংখ্যা সরকারি নথিভুক্ত করার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় সেটি হল – এরকম কোন খবর এলেই মৃতের আত্মীয় বা বন্ধুদের পক্ষ থেকে গ্রামের পাটোয়ারীকে জানাতে হয়। পাটোয়ারী ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে মৃতদেহ না দেখতে পেলে একটি অনুসন্ধান দলকে নিয়োগ করা হয়। মৃতদেহটি খুঁজে পেলে তদন্ত করে দেখা হয় সেটি কোনো হত্যাকাণ্ড কি না। সেটি যে বাঘের কীর্তি এটা নিশ্চিত হলে ঘটনাটির বিশদ তথ্য জেলার ডেপুটি কমিশনারকে জানানো হয় এবং তিনি একটি নির্দিষ্ট খাতায় সেটি তালিকাভুক্ত করেন।

মানুষখেকোদের একটা বিশ্রী অভ্যাস আছে মৃতদেহ বহুদূর বয়ে নিয়ে যাওয়ার। যদি সেটি খুঁজে না পাওয়া যায় তবে সেটি সরকারি ভাবে বাঘের শিকার বলে নথিভুক্ত হবে না। কিম্বা বাঘের আক্রমণে কেউ হয় তো আহত হয়েছে এবং পরে মারা গিয়েছে, সে ক্ষেত্রেও তার নাম তালিকায় থাকবে না।

অতএব মৃত্যুর তালিকা তৈরি করতে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করলেও এটা সম্ভব যে বাঘের আক্রমণে মারা যাওয়া বহু ঘটনাই তালিকাভুক্ত হয় না বিশেষ করে বাঘটি যদি দীর্ঘদিন ধরে তার হত্যালীলা চালিয়ে থাকে।
(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।