সাহিত্য

মার্চ ১৫, ২০১৬
রুদ্রপ্রয়াগের চিতা (ধারাবাহিক)
দীপক সেনগুপ্ত
৮। দ্বিতীয় শিকার
(আগের অংশ) আমার কাছে মানুষখেকোটির পায়ের ছাপের ফটো বা এরকম কিছুই ছিল না যা দিয়ে আমি তাকে চিহ্নিত করতে পারি। যতক্ষণ না আমি এটা যোগাড় করতে পারছি, ততক্ষণ আমি সে এলাকার সব চিতাকেই মানুষখেকো বলে ধরে নেব এবং সুযোগ পেলেই গুলি করব বলে ঠিক করলাম।
রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে আমি দুটো ছাগল কিনলাম। একটিকে আমি পরের দিন যাত্রীপথের এক মাইল দূরে এবং অন্যটিকে অলকানন্দা পেরিয়ে ঘন জঙ্গলে ঢাকা পথের পাশে বেঁধে রাখলাম। এখানেই আমি একটা বুড়ো পুরুষ চিতার পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। পরের দিন সকালে ছাগল দুটোর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি নদীর ওপারের ছাগলটিকে বাঘটি মেরেছে ঠিকই কিন্তু সেটিকে সে খায় নি। সেটি খেয়েছে জঙ্গলের অন্য কোনো প্রাণী।
দিনের বেলাই বাঘটিকে দেখতে পাব মনে করে আমি বেলা তিনটে নাগাদ একটা গাছে উঠে ডালপালা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে মেরে-ফেলা ছাগলটি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিন ঘন্টা বসে থেকেও আমি কোন পাখি বা অন্য পশুদের কাছ থেকে এরকম কোন আভাস পেলাম না যা থেকে বুঝতে পারি যে বাঘটা ধারে কাছে কোথাও আছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে আমি গাছ থেকে নেমে ছাগলটি যে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল সেটি কেটে বাংলোর দিকে যাত্রা করলাম।
আমি আগেই স্বীকার করেছি যে আগে কয়েকটি মানুষখেকো বাঘ মারলেও মানুষখেকো চিতা সম্বন্ধে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। কাজেই গাছ থেকে নেমে বাংলোয় ফেরার পথে আমি সব রকম সতর্কতা মেনে চলেছিলাম এবং আমার কপাল ভাল যে সেটা আমি করেছিলাম।
পরের দিন আমি খুব ভোরে যাত্রা করলাম এবং একটু এগিয়ে দেখি বাংলোর ফটকের কাছে একটা বড় আকারের পুরুষ চিতার পায়ের ছাপ পড়ে রয়েছে। পায়ের ছাপ ধরে আমি জঙ্গলে ভরা একটা খাদ পেরিয়ে যেখানে ছাগলটা পরে ছিল সেখানে এসে পৌঁছলাম। বাঘটি আগের রাতে ছাগলটিকে স্পর্শও করে নি।
আমাকে যে বাঘটি অনুসরণ করেছিল সেটিই যে মানুষখেকো সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। সেদিন আমি পায়ে হেঁটে যতদূর পারি গ্রামের লোকদের এবং রাস্তায় যারা চলাফেরা করছে সবাইকে জানিয়ে দিলাম যে মানুষখেকোটি কাছে পিঠেই আছে এবং তারা যেন সতর্ক থাকে।
সেদিন আর তেমন কিছুই ঘটে নি, কিন্তু পর দিন আমি প্রাতরাশ সেরে গোলাবরাই গ্রামের অদূরে জঙ্গলটি যখন দেখছিলাম, সে সময়ে একজন লোক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বাংলোয় ঢুকে জানালো যে আগের দিন রাতে বাংলোর উপরে পাহাড়ের গ্রামে একটি মেয়ে মানুষখেকোটির আক্রমণে মারা গেছে। মেয়েটি যেখানে মারা গেছে সেখান থেকে বাঘটি যে পাঁচশ বর্গমাইল অঞ্চলে শিকার ধরছে সেটা এক নজরে চোখে পড়ে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস – একটি অতিরিক্ত রাইফেল ও শট গান, কার্তুজ, দড়ি এবং কিছুটা শক্ত সূতো – যোগাড় করে আমার দু’জন লোক ও যে খবরটি এনেছিল সবাইকে সঙ্গে করে পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। দিনটি ছিল গুমোট এবং দূরত্ব বড় জোর তিন মাইল হলেও দুপুর রোদে চার হাজার ফুট উপরে উঠে আমি যখন গ্রামে পৌঁছেছি তখন ঘামে অর্ধেক শরীর ভিজে গেছে।
যে মেয়েটি মারা গেছে তার স্বামীর কাছে পুরো ঘটনাটা শুনলাম। আগুনের পাশে বসে রাতের খাবার খেয়ে মেয়েটি থালা বাসন একত্র করে দরজার কাছে সেগুলি ধুতে নিয়ে গিয়েছিল আর লোকটি বসেছিল তামাক খেতে। মেয়েটি বাসন গুলি নিয়ে দরজার কাছে বসতেই বাসন গুলি সশব্দে ছড়িয়ে পড়ে গেল। যথেষ্ট আলো না থাকায় লোকটি কিছু দেখতে পায় নি। তার উত্তেজিত ডাকে যখন কোন সাড়া মিলল না তখন সে তাড়াতাড়ি উঠে দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিল। সে বলল –“সাহেব, একটা মৃতদেহ উদ্ধার করার জন্য আমার নিজের জীবন বিপন্ন করে কি লাভ?” তার কথাটা হয় ত সঠিক কিন্তু নির্মম। দেখলাম সে যত না তার স্ত্রীর জন্য দুঃখিত তার থেকে অনেক বেশি হতাশ যে সন্তান ও উত্তরাধিকারী আর কিছুদিন পরেই জন্ম নিত তাকে হারিয়ে।
যে দরজার কাছে মেয়েটি মারা গিয়েছিল সেটি খুললে একটি চার ফুট চওড়া রাস্তা চোখে পড়বে, রাস্তাটি দু’সারি বাড়ির মাঝ বরাবর পঞ্চাশ গজ অবধি গিয়েছে। বাসন পড়ে যাবার শব্দে এবং লোকটি উত্তেজিত স্বরে তার স্ত্রীকে ডাকছে শুনে আশেপাশে বাড়ির সব দরজা মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। পায়ের দাগ থেকে বোঝা গেল বাঘটি মেয়েটিকে সমস্ত রাস্তাটাই টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে একশ গজ দূরে ক্ষেতের ধারে একটা ছোট খাদের কাছে বয়ে নিয়ে গিয়েছে।
মৃতদেহটি খাদের কাছে একটা ছোট চষা জমির প্রান্তে পড়েছিল এবং অন্য দিকে চল্লিশ গজ দূরে একটা পাতা ঝরে যাওয়া আখরোট গাছের ডালে জমি থেকে চার ফুট উঁচুতে স্তূপীকৃত খড় গাদা করে রাখা ছিল। খড়ের গাদাটি ছিল ছ’ফুট উঁচু। আমি এটির উপরেই বসব ঠিক করলাম। মৃতদেহটির কাছ থেকে একটা সরু পথ খাদ অবধি চলে গেছে। এই পথের ওপরেই বাঘটির পায়ের ছাপ পড়েছিল। এই ছাপ গুলির সঙ্গে দু’দিন আগে মৃত ছাগলটির কাছ থেকে যে বাঘটি আমাকে অনুসরণ করে বাংলো অবধি এসেছিল তার পায়ের দাগের হুবহু মিল রয়েছে। বাঘটি ছিল একটা বুড়ো বয়সের পুরুষ চিতা, তার পায়ের ছাপে একটিই খুঁত ছিল এবং সেটি তৈরি হয়েছিল চার বছর আগে তার পেছনের পায়ে যে গুলিটি লেগেছিল তা থেকে।
আমি গ্রাম থেকে আট ফুট লম্বা দু’টো শক্ত বাঁশ যোগাড় করলাম এবং ক্ষেতের পাশে যেখানে মৃতদেহটি পড়েছিল সেখানে সে দু’টি মাটিতে পুঁতে আমার অতিরিক্ত রাইফেল ও শট গানটি তার গায়ে বেঁধে দিলাম। এরপর শক্ত সূতো ট্রিগারে জড়িয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপরে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখলাম। বাঘটি আগের দিন যে পথ দিয়ে এসেছিল সেটা দিয়ে এলে সূতোয় টান লেগে তার গায়ে গুলি গিয়ে লাগবে, আর যদি সে অন্য পথটি দিয়ে আসে তবে আমি তাকে গুলি করার সুযোগ পাব। চিতাবাঘের গায়ের রঙ অন্ধকারের সঙ্গে প্রায় মিশে যায় বলে এবং মৃতদেহটির শরীরে কোনো কাপড় না থাকায় অন্ধকারে নিশানা পাওয়া কঠিন, এজন্য আমি খাদ থেকে একটা সাদা রঙের পাথরের চাঁই এনে মৃতদেহটির এক ফুট দূরে রেখে দিলাম।
আমার প্রস্তুতি সব শেষ হয়ে গেলে আমি খড়ের গাদার উপর উঠে আরাম করে বসলাম এবং কিছু খড় দিয়ে আমার সামনে এবং পিছনে কোমর অবধি ঢেকে দিলাম। যেহেতু আমি মৃতদেহটির দিকে মুখ করে গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসেছি চিতাবাঘটির পক্ষে আমাকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা খুবই কম। যদিও এ বাঘটি সাধারণত তার ফেলে যাওয়া শিকারের কাছে ফিরে আসে না, তবু কেন জানি না আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সে রাতে বাঘটি আসবে। পাহাড়ের চড়াই বেয়ে ওঠার পরিশ্রমে আমার গায়ের জামা তখনও ভিজে ছিল কিন্তু আমার জ্যাকেটটা ছিল শুকনো এবং সেটিই আমাকে তীব্র ঠান্ডা হাওয়া থেকে বাঁচালো। আমি এবার আরাম করে বসে সারারাত জেগে থাকার জন্য তৈরি হলাম। আমি আমার সঙ্গের লোকদের জমির মালিকের বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম এবং বললাম আমি তাদের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত বা সূর্য বেশ খানিকটা না ওঠা পর্যন্ত তারা যেন বাইরে না বেরোয়।
সূর্য প্রায় অস্ত যেতে বসেছে। সামনে গাঙ্গেয় উপত্যকার দৃশ্যের সঙ্গে বরফে ঢাকা হিমালয়ের উপর অস্তগামী সূর্যের আলোয় যে নীলাভ রক্তিম বর্ণের সৃষ্টি হল তা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এসে রাত নেমে এল।
রাতের অন্ধকার কতটা ঘন এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার, এর কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। একজনের কাছে যেটা ঘন অন্ধকার অন্য একজনের কাছে সেটা শুধুই অন্ধকার এবং কেউ হয় ত বলবে সেটা মাঝারি ধরণের। বহু বছর ধরে খোলা জায়গায় রাত কাটিয়ে আমার কাছে রাতের বেলার অন্ধকার খুব বেশি বলে মনে হয় না, অবশ্য আকাশ যদি ঘন মেঘে না ঢেকে যায়। আমি এটা বলতে চাই না যে আমি দিনের বেলায় যে রকম দেখি, রাতেও সেরকমই দেখতে পাই, তবে রাত্রিবেলা জঙ্গলের পথে বা যে কোনও জমির ওপর দিয়ে চলতে আমার কোন অসুবিধা হয় না। আমি যে সাদা পাথরটি মৃতদেহের কাছে রেখেছি সেটি অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য। কারণ আমার ধারণা ছিল তারার আলো হিমালয়ের সাদা বরফে প্রতিফলিত হয়ে গুলি করার জন্য আমাকে প্রয়োজনীয় আলো জোগাবে।
কিন্তু আমার ভাগ্য ছিল অপ্রসন্ন। রাত সবে নেমেছে এমন সময়ে বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে বাজ পড়ল এবং সমস্ত আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গেল। সবে বড় বড় ফোটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে এমন সময় খাদের দিকে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ পেলাম এবং মিনিট খানেক পড়েই নীচে খড়ের স্তূপে আঁচড়ানোর আওয়াজ কানে এল। চিতাটি নিঃশব্দেই এসেছে এবং আমি যখন ভারী বৃষ্টির সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া সহ্য করছি বাঘটি তখন খড়ের নীচে অনেক আরামেই আছে। এরকম বেয়ারা ধরণের ঝড় আমি খুব কমই দেখেছি। ঝড় যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে আমি দেখলাম লন্ঠন হাতে একটি লোক গ্রামের দিকে যাচ্ছে; লোকটির সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কয়েক ঘণ্টা পরেই অবশ্য জানতে পেরছি, লোকটি মানুষখেকো এবং ঝড় উপেক্ষা করে পাউড়ি থেকে ত্রিশ মাইল পথ হেঁটে আমার জন্য রাত্রিবেলা শিকারের উপযোগী একটা টর্চ বয়ে নিয়ে এসেছে। টর্চটি পাঠাবে বলে সরকার থেকে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এই টর্চটি যদি আমার হাতে ঘন্টা তিনেক আগে পৌঁছত ......। যা হোক দুঃখ প্রকাশের কোন অর্থ হয় না, কারণ পরে যে চোদ্দটি লোক মারা পড়েছে, বাঘের কবলে না পড়লেই যে তারা বেশি দিন বেঁচে থাকত তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর টর্চটি যদি আমার হাতে থাকত তবে তার আলোতে আমি যে মানুষখেকোটিকে মারতে পারতাম সেটাই বা কে বলল?
বৃষ্টি একটু পরে থেমে গেল। আমার হাড়ে পর্যন্ত তখন কাঁপুনি ধরেছে। আকাশের মেঘও তখন পাতলা হতে শুরু করেছে; এ সময়ে হঠাৎ নীচের সাদা পাথরটা ঢাকা পড়ে গেল এবং একটু পরেই শুনতে পেলাম চিতাটি মাংস খাচ্ছে। আমি যে দিক দিয়ে বাঘটি আসবে ধরে নিয়েছিলাম, বৃষ্টির জমা জল এড়াতে গিয়ে বাঘটি সে রাস্তায় আসে নি। মিনিট খানেক পরে পাথরটি দেখা গেল এবং তখনই নীচে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। নীচে তাকিয়ে আমি হাল্কা হলুদ রঙের চিতা বাঘটিকে খড়ের আড়ালে ঢুকে যেতে দেখলাম। তার হাল্কা হলুদ রঙ হয় ত বয়সের জন্যই হয়েছে; কিন্তু বাঘটি চলবার সময় যে শব্দটি করে – শব্দটা অনেকটা মেয়েরা সিল্কের শাড়ি পরে হাঁটলে যে শব্দ হয় সে রকম – তার কারণ তখন বুঝতে পারি নি, আজও তা জানি না। বাঘটি যখন চলাফেরা করছিল তখন যে মাঠে নরম ঘাস ছিল বা সে খড়ের উপর দিয়ে হাঁটছে বলে ওরকম শব্দ হচ্ছিল তাও নয়।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি রাইফেলটা তুলে পাথরটার দিকে তাক করলাম, উদ্দেশ্য ছিল যে মুহূর্তে সেটা ঢাকা পড়বে তখনই আমি গুলি করব। কিন্তু একটা ভারী রাইফেল কাঁধে তুলে ধরে রাখার ত একটা সীমা আছে। পেশীর ব্যাথা থেকে মুক্ত হবার জন্য যেই আমি সেটা নামিয়েছি, ঠিক তখনই পাথরটা ঢাকা পড়ে গেল। পরের দু’ঘন্টা ধরে ঠিক একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হল; হতাশ হয়ে আমি যখন চতুর্থ বার চিতাটিকে খড়ের গাদার দিকে এগোতে শুনলাম, আমি সামান্য ঝুঁকে অস্পষ্ট বস্তুটার দিকে তাক করে গুলি চালিয়ে দিলাম।
মাঠের সরু ফালি জায়গাটিকে যেটিকে আমি জমি বলে উল্লেখ করেছি সেটি চওড়া ছিল মাত্র দু’ফুট। পর দিন সকালে পরীক্ষা করে দেখলাম আমার ছোঁড়া বুলেটটা এই দু’ফুট চওড়া জমির মাঝে ঢুকে গিয়েছে এবং গুলি লেগে চিতাটির গায়ের কিছু লোম ছড়িয়ে রয়েছে।
আমি সে রাতে চিতাটির আর কোন সাড়া শব্দ পাই নি। সূর্য উঠলে আমি আমার লোকজনদের নিয়ে পাহাড়ের উৎরাই বেয়ে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে চললাম এবং মৃত মেয়েটির স্বামী তার স্ত্রীর দেহাবশেষ নিয়ে সৎকার করতে চলে গেল।
৯। প্রস্তুতি
ব্যায়াম, গরম জলে স্নান এবং খাদ্য – দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠতে এদের অদ্ভুত প্রভাব রয়েছে। পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে নেমে এসে গরম জলে স্নান করে প্রাতরাশ সারার পর দেখলাম আমি সে রাতের ব্যার্থতার ঘটনাটা অনেক যুক্তিসঙ্গত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছি। আমার গুলিটা বাঘের গায়ে না লেগে জমিতে গিয়ে লেগেছে-এ নিয়ে অনুশোচনা করা উথলে পড়ে যাওয়া দুধের জন্য ভাবতে বসার মতই নিরর্থক। বাঘটা যদি অলকানন্দা না পেরিয়ে থাকে তবে আমি তাকে মারবার অনেক ভাল সুযোগ পাব কারণ, সে রাতে রানার লোকটি বাঘের ভয় ও ঝড় উপেক্ষা করে যে টর্চ লাইটটি আমার জন্য নিয়ে এসেছে, সেটি এখন আমার সঙ্গে আছে।
বাঘটা অলকানন্দা পেরিয়েছে কি না সেটা দেখাই আমার প্রথম কাজ বলে মনে হল। আমি নিশ্চিত ছিলাম বাঘটা যদি সেটা করে থাকে, তবে সে ঝোলা পুল পেরিয়েই সেটা করেছে। এ সম্বন্ধে খবর যোগাড় করতে আমি প্রাতরাশ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম। চাটোয়াপিপলের পুল বাঘটা পেরিয়েছে সে সম্ভাবনাটা আমি উড়িয়ে দিলাম। কারণ ভারী রাইফেলের গুলিটা বাঘটির মাথা ঘেঁসে বেরিয়ে যাবার ধাক্কা সামলে এত কম সময়ের মধ্যে চোদ্দ মাইল রাস্তা চলে যাবে এটা সম্ভব না; সুতরাং আমি রুদ্রপ্রয়াগের পুলটি ঘিরেই অনুসন্ধান চালাতে মনস্থ করলাম।
রুদ্রপ্রয়াগের ঝোলা পুলটিতে যাবার তিনটি রাস্তা রয়েছে, একটা উত্তর দিক থেকে অপরটি দক্ষিণ দিক থেকে। তৃতীয় রাস্তাটি বহু ব্যবহৃত এবং রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের দিক থেকে এসেছে। এই তিনিটি রাস্তাই ভাল করে দেখে নিয়ে আমি কেদারনাথের যাত্রী পথটি ধরে আধ মাইল চলে গেলাম; এখানেই তিন দিন আগে পথের ধারে আমার একটি ছাগলকে বাঘটি মেরেছিল। দেখে যখন আমি নিশ্চিত হলাম যে বাঘটি অলকানন্দা পেরোয় নি, তখন বাকি দু’টো পুল বন্ধ করে আমি নদীর যে পারে আছি সে পাশেই বাঘটিকে আটকে রাখতে মনস্থ করলাম। পুলের রক্ষী দু’জনই নদীর বা দিকে প্রবেশ পথের লাগোয়া জায়গাতেই থাকত। তাদের যদি সহযোগিতা পাই তবে এ কাজে আমি সফল হব বলেই মনে হল।
ত্রিশ মাইলের দীর্ঘ পথে নদী পারাপারের একমাত্র রাস্তা পুল দু’টি বন্ধ করে রাখার মতলবটা অনেকের কাছে একটা গা-জোয়ারি কাজ বলে মনে হতে পারে, বাস্তবে কিন্তু তা নয়। কারণ, সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত বাঘের জারি করা কার্ফু ভেঙে কোন লোকই পুল দু’টি ব্যবহারের সাহস দেখাবে না।
ঢোকার মুখে কাঁটা ঝোপ ফেলে পুল দুটি বন্ধ করে দেওয়া হল। নদীর দু’পাশে দু’টি করে পিলার গেঁথে লোহার দড়ি বাঁধা ছিল, এর থেকেই তক্তা-পাতা পথটি ঝোলান থাকত। আমি যতক্ষণ পুল বন্ধ করার কাজ দেখাশোনা করছিলাম, সে সময়ে এমন কোন লোককেই দেখলাম না যে পুল পেরিয়ে ওপারে যেতে চাইছে।
নদীর বা দিকে রুদ্রপ্রয়াগের পুলের উপর আমি কুড়িটি রাত কাটিয়েছি, সে স্মৃতি ভোলার নয়। একটা বেরিয়ে আসা কুড়ি ফুট উঁচু পাথরের উপর পুলটির পিলার তৈরি করা হয়েছে। পিলারের উপরের সমতল জায়গাটি জল হাওয়া লেগে লেগে মসৃণ হয়ে গিয়েছে। সমতল স্থানটি চার ফুট চওড়া ও আট ফুল লম্বা। পিলারের উপরের এই স্থানটিতে পৌঁছনোর দু’টি উপায় আছে। হয় লোহার দড়িটি ধরে ঝুলে ঝুলে সেখানে পৌঁছতে হবে অথবা দু’টি শীর্ণ বাঁশের মই বেয়ে তার উপর উঠতে হবে। আমি দ্বিতীয়টিই করব ঠিক করলাম কারণ, প্রথমটিতে দড়ির গায়ে লেগে থাকা কালো রঙের কোন দুর্গন্ধময় পদার্থ হাতে লেগে পরে জামা কাপড় নোংরা হতে পারে। লোহার দড়ি দুটি পিলারের উপরে দুটো ফুটোর মধ্য দিয়ে গিয়ে পাশের পাহাড়ে পঞ্চাশ ফুট দূরে আটকানো রয়েছে।
মইটি দু’টি অসমান দৈর্ঘের বাঁশের সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে আলগা করে বাঁধা কিছু কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয়েছে। মইটির একেবারে উপরের পাদানিতে পা রেখে দাঁড়ালেও পিলারের উপরের মাত্র চার ফুট জায়গা নাগালে আসে। সেই মসৃণ তলটি ধরে উপরে উঠতে গেলে যথেষ্ট কসরৎ করতে হয়।
হিমালয়ের এই অঞ্চলের সব নদীগুলিই উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে। উপত্যকার মধ্য দিয়ে যে হাওয়া বয় সেটা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সঙ্গে দিক পরিবর্তন করে। স্থানীয় ভাষায় এই হাওয়াকে বলে ‘দদু’, দিনের বেলা এটা দক্ষিণ দিক থেকে বয়, কিন্তু রাতের বেলা এটা আসে উত্তর দিক থেকে।
আমি যখন পিলারের উপরে উঠে চাতালের মত জায়গাটায় ঠিক হয়ে বসলাম তখন হাওয়া প্রায় ছিলই না। কিছু পরেই ফুরফুরে হাওয়া বইতে শুরু করল কিন্তু দিনের আলো পড়ে আসতেই সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় ঝোড়ো হাওয়ায় পরিণত হল। উপরে ধরে বসার মত কিছুই ছিল না। বাতাসের বল কমানোর জন্য উপুর হয়ে শুয়ে পড়লে বাতাসের বেগে উড়ে যাবার ভয় ছিল; সেক্ষেত্রে ষাট ফুট উঁচু থেকে পাথরের উপর পড়তে হবে এবং সেখান থেকে ছিটকে স্থান হবে অলকানন্দার ঠান্ডা জলে। অবশ্য ষাট ফুট উঁচু থেকে এবরো খেবরো পাথরের উপর পড়লে অলকানন্দার জলের তাপমাত্রা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। আশ্চর্যের বিষয় হল, আমার ভয়টা ছিল ঠাণ্ডা জলে, পাথরের উপর পড়াতে অতটা নয়। এর পর আবার আর এক উৎপাত দেখা দিল। অসংখ্য ছোট পিঁপড়ে আমার পোষাকের মধ্যে ঢুকে আমার বহু জায়গায় চামড়া প্রায় খেয়ে ফেলার উপক্রম করল। যে কুড়ি রাত আমি পুলটি পাহারা দিয়েছিলাম সে সময় প্রবেশ পথে কোন কাঁটা ঝোপ ছিল না, কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি মাত্র প্রাণী পুলটি পেরিয়ে ওপারে গিয়েছিল, সেটি ছিল একটি শেয়াল।
(চলবে)
লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (
IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে
অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা
করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার
সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।